বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

শঙ্করপুরে একদিন

সৌমেন্দ্র দরবার


~ শঙকরপুরের আরও ছবি ~

কর্মব্যস্ত জীবন। একটু বিরতি হলে মন্দ হয় না। রোজকার অফিসের দিনগত পাপক্ষয়, বসের লাল চোখ, সংসারের প্রাণান্তকর ব্যস্ততা কিংবা পড়শির পি. এন. পি. সি। কী দুর্বিষহ জীবন। মন চায় একটু ছুটি, একটু বিরতি – দু-তিন দিন! পুজোশেষে মাকে কৈলাসের পথে বিদায় জানিয়ে দীর্ঘ আট মাসের ঘরবন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেতে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতির কোলে। মন চাইছিল বনানীর সবুজ, আকাশের নীল আর উত্তাল ঢেউ। যেখানে সমুদ্র আমাকে আলিঙ্গন করে বলবে "এসো মোর কাছে, একান্ত নিভৃতে," সবুজ ঝাউ হাত নেড়ে বলবে "অবগাহন করো মোর রূপ", নির্মল আকাশ কাছে ডেকে কইবে "ডানা মেলো খোলা হাওয়ায়, হে পথিক।"
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বেনফিশ-এর অতিথিনিবাস কিনারা। কলকাতা থেকেই অনলাইনে এ. সি. ঘর বুক করা ছিল। ছিমছাম, আপাত জীবাণুমুক্ত ঘরে খানিক বিশ্রাম নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বেরোলাম প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করতে। সবুজের মধ্যে দিয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তায় যেতে যেতে মন চলে গেল ছোট্টবেলার দিনগুলোতে। রাস্তার দুপাশে প্রজাপতি, মথ শরীর ছুঁয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। তাদের কত রং, কী বাহার! গাছের ডালে নাম না জানা পাখির কূজন মনকে নিয়ে যাচ্ছে কল্পলোকে। এরই মধ্যে হঠাৎ পায়ের সামনে কাঠবেড়ালি এসে প্রণাম ঠুকল, বুকটা ভোরে গেল গর্বে। দূরে ভোঁ বাজিয়ে ট্রলারেরা পাড়ি দিচ্ছে অতল সমুদ্রে। অন্বেষণ শেষ হলে ফিরে আসবে রুপোলি মাছের ডালি নিয়ে। স্থানীয় জেলেদের সারল্য মন কেড়ে নিল। এবার সমুদ্র অবগাহন। মনে হলো কত যুগ পর আবার হারিয়ে যাব অতলান্ত গভীরে। গা ভেজানোর আগে সবুজ ডাবের মিষ্টি জল তৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে দিল। সাগরবেলায় ছোটদের বালিয়াড়ি আর ঝিনুক সংগ্রহ মনকে সত্যিই নিয়ে গেল শৈশবে। বালির ওপর অতি যত্নে লেখা নিজের নামকে সমুদ্র ভরিয়ে দিয়ে গেল ওষ্ঠের চুম্বনে। গায়ের ওপর সমুদ্রের মুহূর্মুহূ আলিঙ্গন উপলব্ধি করতে করতে হারিয়ে গেলাম অন্যলোকে। সমুদ্রগাহনে পায়ের তলায় ছোট্ট ছোট্ট নুড়িগুলো এঁকে দিল আদরের রেখা। আদুল গায়ে লেগে রইল নোনতা তরল আর সাক্ষী রইল উন্মুক্ত নীল আকাশ আর একরাশ ঝাউ।

দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নিদ্রাকে বললাম আজ তোমার ছুটি। আবার বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতি অন্বেষণে। মৎস্যবন্দরের অবিরাম কর্মব্যস্ততা, দুপুর রোদে মাঠের ধারে জেলেদের জালবোনা কিংবা সমুদ্রে নৌকা বাওয়া আর জাল টেনে তটে তোলা –সে যেন এক অন্য জগৎ। কুলিং টাওয়ারের অবিরাম জলধারায় সূর্যের আলোয় তৈরি রামধনু থেকে চোখ ফেরানো ভার। সময় গড়াতে লাগল। পড়ন্ত বিকেলে লাল পাথরের ওপর বসে সাদা ক্যানভাসে পেন্সিল ড্রয়িং আর ডায়েরির পাতায় দুকলম কবিতা লিখতে মন্দ লাগল না। রঙিন বিকেলে সূর্যের বাড়ি ফেরা তুলতে তুলতে ক্যামেরার স্টোরেজ ফুল হয়ে গেলে মনটা একটু খারাপ হল বটে কিন্তু পরক্ষণেই প্রকৃতি বলল কাল আবার এসো আমি থাকব তোমার অপেক্ষায়। ঝাউয়ের দোলায় দোল খেতে খেতে নির্জন সৈকতে ভ্রমণকালে গলায় গুনগুন করে উঠল "আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি, আর মুগ্ধ হয়ে শুধু চেয়ে থেকেছি।"

সন্ধ্যার আলোঝলমল সমুদ্রতটে উষ্ণ চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে সান্ধ্যভ্রমণ স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে সমুদ্রের পাড়ে বসে শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় রুপোলি ঢেউয়ের অবিরাম আস্ফালন অবলোকন করতে লাগলাম। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে ফিরলাম অতিথি নিবাসে। সমুদ্রে এলাম অথচ আমার মতো মেছো মাছ খাব না তা কি করে হয় যেখানে মৎস্যবিলাসীদের রসনায় সামুদ্রিক জীবেরা সদা দন্ডায়মান। চিংড়ি ও ভেটকি সহযোগে রাতের আহার। ভোজন শেষ করে হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে খানিক গল্পগুজব করে আবার বেরিয়ে পড়লাম রাতের রূপ পর্যবেক্ষণে। নৈশআহারের পর নির্জন সমুদ্রসৈকতে সমুদ্র গর্জন সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। নির্জন, শান্ত আর গভীর। ঝাউয়ের বনে শুধু ঝিঁঝিঁদের শব্দ। প্রকৃতি যেন তার সবরকম নৈবেদ্য নিয়ে হাজির।

পরদিন সকালে আবছা আলোআঁধারিতে ধীরে ধীরে সূর্যদেবের আবার প্রত্যাগমন। সত্যি জীবনের জাঁতাকলে আর অজানা ভাইরাসের আক্রমণে কতদিন যে এমন ভোর দেখিনি! ক্যামেরার শাটার চলতেই থাকল। বন্দী হতে থাকল প্রকৃতির নানা রূপ। সমুদ্রের তটে বসে দেখতে থাকলাম দিনের শুরু, জেলেদের কর্মব্যস্ততা। দুপাশের বুনোফুলগুলো ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলছে, নাম-না-জানা পাখির দল গাছে গাছে আড়মোড়া ভাঙছে। প্রকৃতি তার রূপের ডালি আবার ধীরে ধীরে মেলে ধরছে। আবার গতকালের রুটিনের রিপিট টেলিকাস্ট শুরু হয়ে গেল। শুধু ভোজনে ইলিশ আর পারসের আগমন। অনেকটা সময় বারান্দার অলিন্দে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিরানিকে আস্বাদন করলাম। স্থানীয় মানুষদের সারল্য আর আন্তরিকতায় দুটো দিন যে কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। এবার ঘরে ফেরার পালা। অমৃত না উঠলেও এ ভ্রমণের স্বাদ মিটিয়ে দিল মনের তৃষ্ণা। স্বাদ আর সাধ্যের মধ্যে শঙ্করপুর ভ্রমণ স্মৃতির ক্যানভাসে বন্দি হয়ে রইল।

~ শঙকরপুরের আরও ছবি ~

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারীরবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট সৌমেন্দ্র দরবার বর্তমানে কলকাতার এক প্রখ্যাত ঔষধ প্রস্তুতকারক সংস্থার গবেষণা ও উদ্ভাবনবিভাগে সহকারীর প্রধান। দেশে ও বিদেশের বহু জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে একটু ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়েন প্রকৃতির কোলে, অজানার সন্ধানে। কবিতাপাঠ ও লেখা তাঁর অন্যতম নেশা। ভোজনরসিক আর সংগীতপ্রিয় সৌমেন্দ্র ভালোবাসেন অবসরে মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে।

 

ছোট্ট ছুটিতে দিঘায়

পঙ্কজ দত্ত

~ দিঘার আরও ছবি ~

দিঘা, কত মানুষের ভালোলাগা, ভালোবাসা। এক দুদিনের ছুটি পেলেই আর কোথাও যাওয়ার কথা মাথায় আসে না, আসে শুধু দিঘা। এমনই একটা আকর্ষণ যে যতবারই দিঘাতে যাওয়া হোক না কেন আবারও যেতে ইচ্ছে করে। একদিন হঠাৎ ঠিক করলাম যে দিঘা যাব। পরের দিন যেতে হবে, তাই, আনন্দে সারারাত ঘুম এলো না। ঘড়িতে ঠিক ভোর তিনটে বাজে। উঠে পড়লাম। এক টোটোওয়ালাকে বলে রেখেছিলাম যে ভোর চারটেতে এসে স্টেশন নিয়ে যেতে। ঘুমচোখে স্টেশনে পৌঁছলাম, তারপর ট্রেন ধরে চলে এলাম এসপ্ল্যানেডে। এসপ্ল্যানেড থেকে বাসে চেপে রওনা দিলাম দিঘার উদ্দেশ্যে। কী আনন্দ হচ্ছিল, উফফফ, মনে হচ্ছিল যাক দিনকয়েক একটু রেহাই পাওয়া যাবে্ দৈনন্দিন জীবন থেকে আর একটু মুখবদলও হবে। দিঘা পৌঁছলাম তখন দুপুর বারোটা। হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল। উঠলাম নিউ দিঘাতে হোটেল আস্থা। এই হোটেলটা বিখ্যাত জাহাজ বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে। পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সৈকতভ্রমণে। সমুদ্রে স্নান করে মজা পেলাম। স্নান করার পরে খুব খিদে পাচ্ছিল। দুপুরে খেয়ে একটানা ঘুম দিলাম। সন্ধেবেলা ঘুম থেকে উঠে একদম চনমনে লাগছিল। চলে গেলাম আবার সৈকতে। চা, ঝাল মুড়ি খেলাম। তারপরে রাতে ডিনার সেরে রেস্ট নিলাম হোটেলে।

পরের দিন ভোরবেলা উঠে গাড়িভাড়া করে গেলাম তালসারি। তালসারিটা কিন্তু দারুণ জায়গা। তালসারি ভ্রমণ করে ফেরার পথে ঢুকলাম চন্দনেশ্বর মন্দিরে। তারপরে সোজা চলে এলাম উদয়পুরে। স্নানটা সেরে ফেললাম সমুদ্রে। উদয়পুরে অনেকটা বিচ পাওয়া যায়। আবার স্নান করার আগে মাছভাজা খেতে ইচ্ছে হল। দেখলাম, কত দোকান আছে যারা মাছ, কাঁকড়া ভেজে দিচ্ছে। এক বয়স্ক মহিলাকে দেখে খুব কষ্ট হল। ভাবলাম এনার কাছেই খাই, অন্তত, কিছু পয়সা পাবেন। কাছে গিয়ে বললাম, ও মাসিমা, শুনছেন, কাঁকড়া ভাজা কত করে? আর মাছ ভাজা? দাম-দর ঠিক করে বললাম, আচ্ছা, আমাকে আমোদি ভেজে দিন এক প্লেট আর তারপরে কাঁকড়া দেবেন। তাই ভেজে দিলেন। আহা, কী বানিয়েছি্লেন, অতুলনীয়। খেয়ে পয়সাকড়ি মিটিয়ে স্নান করে হোটেলে ফিরলাম। দুপুরে অল্পকিছু খেলাম। কারণ, উদয়পুরে অনেকটা ভাজা খেয়ে পেট ভরে গিয়েছিল। খেয়ে একটু আরাম করে বিকেলে চলে গেলাম অমরাবতী পার্ক আর তারপরে মেরিন মিউজিয়াম ওল্ড দিঘাতে। তারপরে ভাবলাম ওল্ড দিঘাতে যখন চলেই এলাম, নেহরু মার্কেট একটু ঘুরে দেখি। মার্কেট ঘুরে চলে গেলাম সোজা বিশ্ববাংলাতে। দারুণ বানিয়েছে বিশ্ববাংলাটা, আহা, দেখে মনে হচ্ছে বোধহয় বিলেতে চলে এসেছি। অনেকগুলো দোকানও আছে খাবারের। খেয়েদেয়ে ভাবলাম হেঁটেই চলে যাব। কিন্তু, তৎক্ষণাৎ মনে হল যে রাস্তা তো কম না ওল্ড দিঘা থেকে নিউ দিঘা পর্যন্ত, তার ওপর, চেনা জায়গা না, হেঁটে যাওয়াটা নিরাপদ হবে না। টোটো ধরে চলে গেলাম হোটেলে।

পরের দিন আবার গাড়ি বুক করে চলে গেলাম বিচিত্রপুর। বেশ অনেকটা রাস্তা। গিয়ে টিকিট কেটে বোটে উঠে পড়লাম। যাচ্ছি আর ভাবছি, কোথায় যে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে! পৌঁছলাম একটা দ্বীপে। কী সুন্দর দ্বীপটা। তিন-চার ঘন্টা সেখানে কাটিয়ে রওনা দিলাম সোজা হোটেলের উদ্দেশ্যে। সেদিনটা আর কোথাও বেরোলাম না। পরের দিন সকালে উঠে গাড়ি ভাড়া করে চলে গেলাম মোহনায়। বাপ রে! মাছের কী বিদঘুটে গন্ধ। তার মধ্যে ছুটছে গাড়ি। আর থাকা যাচ্ছিল না। অবশেষে মোহনায় পৌঁছে স্বস্তি পেলাম। মোহনাতে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে একটু মাছের বাজারটা ঘুরে নিলাম। ততক্ষণে গন্ধটা সহ্য হয়ে এসেছিল। তারপরে ফেরত এলাম হোটেলে। এদিন অনেকক্ষণ স্নান করলাম সমুদ্রে। পরেরদিন অনেক স্মৃতি আর মানুষের ভালোবাসা নিয়ে ফিরে এলাম কলকাতাতে। ইচ্ছে রইল আবার যাব, আবার একটু রিফ্রেশমেন্ট হবে, আনন্দ হবে।

~ দিঘার আরও ছবি ~

 

হলদিয়ার আই ভি এল ধুনসেরি পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিস প্রাইভেট লিমিটেডে কর্মরত পঙ্কজ দত্তের আগ্রহ ফটোগ্রাফি এবং অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ। তাঁর কথায়, জীবনে বাঁচার জন্য যেটাই করতে হবে ভালোবেসে করতে হবে, তাহলেই জীবনের মজা পাওয়া যাবে। জীবন ভারী সুন্দর।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher