লাজবাব লাচুং
অরিন্দম পাত্র
যতগুলি পাহাড়ি জায়গা ঘোরা আছে, তাদের মধ্যে উত্তর সিকিমের লাচুং (৯০০০ ফিট) নিঃসন্দেহে খুব ওপরের দিকেই জায়গা করে নেবে। এত সুন্দর, নিরালা ছবির মত পাহাড়ি গ্রাম আর দুটি দেখিনি!
ঘন্টাছয়েক জার্নি করে এসে পৌঁছেছি লাচুং-এ। গ্যাংটক থেকে গাড়িতে যাত্রা শুরু হয়েছিল বেলা এগারোটা নাগাদ, আর হোটেলে এসে পৌঁছলাম প্রায় সাড়ে পাঁচটায়। ক্লান্ত অবসন্ন দেহ হলেও মনমেজাজ ছিল কিন্তু একদম ফুরফুরে। তার কারণ গতকালের ছাঙ্গু লেকের সেই বৃষ্টি যা গ্যাংটক অবধি ধাওয়া করেছিল, সেটা আর নেই। বরং প্রকৃতির অপরূপ শোভা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লাচুং আসার পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে!
দুইয়ে মিলিয়েমিশিয়ে মেজাজ একদম শরিফ ছিল। লাচুং-এর হোটেলে ঢুকছি, যেন স্বাগত জানাল বিশালাকার মেঘেঢাকা পাহাড়! হোটেলের ঠিক সামনেই এরকম চমৎকার ভিউ দেখতে পেয়ে সবাই আরও খুশি হয়ে উঠলাম!
সেদিনকার মত হোটেলের ঘরেই বিশ্রাম নেওয়া মনস্থির করলাম, পরেরদিন কঠিনপথে যাত্রা – ইউমথাং ভ্যালি ও জিরো পয়েন্ট!
সকালে কেন জানিনা খুব তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে গেল, আড়মোড়া ভেঙে জানলা দিয়ে অভ্যাসবশত উঁকি মেরে অবাক হয়ে গেলাম! প্রকৃতি রূপের ডালি সাজিয়ে নতুন দিনকে স্বাগত জানাচ্ছে! উল্টোদিকের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে আকাশ একটু একটু করে রাঙা হয়ে উঠছে! দূরের বরফাবৃত শৃঙ্গগুলি একেবারে মেঘহীনভাবে সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!
তাড়াতাড়ি চোখেমুখে জল দিয়ে ক্যামেরা নিয়ে একছুটে চলে গেলাম হোটেলের ছাদে। আমাদের রুম ছিল একদম টপ ফ্লোর অর্থাৎ চারতলাতে।
যত পারলাম স্ন্যাপশট নিলাম আশ মিটিয়ে। দূরের পাহাড়ের গা বেয়ে নিরন্তর নেমে আসছে দুর্দান্ত এক পাহাড়ি ঝরনা। সে যে কোন আদি-অনন্তকাল থেকে এরকমভাবে ঝরে পড়ছে কে জানে! পাশ থেকেই শোনা যাচ্ছে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া লাচুং নদীর সঙ্গীত! আস্তে আস্তে লাচুং ভ্যালিতে নেমে আসছে দিনের প্রথম আলো!
অদ্ভুত সুন্দর স্বর্গীয় ছিল সেই সকাল! কিন্ত প্রকৃতির রঙ, রূপ, রসের স্বাদ আহরণ আপাতত বন্ধ থাক এখনকার মত, নীচ থেকে ডাক আসছে, তৈরি হয়ে বেরোতে হবে এখনই।
দিকশূণ্যপুর যাত্রা...
জিরো পয়েন্টের বাংলা নাম কি হবে ভাবতে ভাবতে এই নামটা মাথায় এল ক্যাজুয়ালি! খারাপ শুনতে লাগলে নিজগুণে মাফ করে দেবেন!
আমাদের বোলেরো গাড়ি প্রস্তুত, বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব, হঠাৎ দেখি পাশের নীচতলার ঘরে বাকিরা সবাই শশব্যস্ত হয়ে জটলা করছে! কৌতূহলী হয়ে গিয়ে দেখি সবাই বিরাট ভাড়ার গামবুট পছন্দ করছে। বাকিদের দেখাদেখি একজোড়া নীলরঙের গামবুটে পা গলালাম। কিন্তু জিনিসটা মোটেও পছন্দসই হল না।
গাড়ি ছেড়ে দিল, যাত্রা শুরু হল। পাহাড়ি সেই রাস্তা যেমন সুন্দর তেমনই ভয়ঙ্কর! কখনো একদিকে খাদ, তো বাঁক পেরিয়েই আবার অন্যদিক থেকে অতলান্ত খাদ হাঁ করে রয়েছে! শুরুর দিকে সবুজের সমারোহ ছিল দেখার মত। কিন্তু যত ওপরে উঠছি তত যেন সবুজের পরিমাণ ভয়ানকভাবে কমে আসছে। রুক্ষ, শুষ্ক হয়ে আসছে চারিদিক!
মাঝে এক জায়গা পছন্দ হতে ড্রাইভার সাহেবকে বলেকয়ে দাঁড় করালাম ছবি তোলার জন্য! কিন্তু এ রাস্তায় বেশিক্ষণ দাঁড়াতেও চাননা ড্রাইভারেরা, তাঁদের লক্ষ্য থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেলা থাকতেই যাতে ওপর থেকে ঘুরিয়ে ভালোয় ভা্লোয় নিচে নামানো যায়।
প্রায় ঘন্টা দুই-আড়াই লাগল ইউমথাং পৌঁছতে, কিন্তু প্রথমে যাব জিরো পয়েন্ট! তাই গাড়ি থামল না। এগিয়ে চললাম, ঠিক যেন অজানার উদ্দেশ্যে! চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কত যে অসাধারণ সব ল্যান্ডস্কেপ ফ্রেম! যেখানে সেখানে থামা যাবে না, তাই বাধ্য হয়ে গাড়ির জানলার কাঁচ নামিয়েই ক্যামেরার শাটার খচাখচ চালাতে লাগলাম। কিন্তু এত প্রচণ্ড ঝাঁকুনি সেই পাথুরে রাস্তার, যে কী আর বলব!
অবশেষে এসে পৌঁছলাম ১৫৩০০ ফিট উচ্চতায় জিরো পয়েন্ট - দিকশূণ্যপুর! গাড়ি থেকে যখন নামলাম শরীরের শক্তিও জিরো হয়ে গেছে যেন! মাথা অল্প অল্প ঘুরছে। ধাতস্থ হতে বেশ খানিকটা সময় নিলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখি গাড়ি আর মানুষের সে যেন এক হট্টমেলা বসেছে! দূরের বরফঢাকা পর্বতশৃঙ্গগুলি মেঘের আচ্ছাদন ভেঙে মাঝেমাঝে দৃশ্যমান হচ্ছে, ফের ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মেঘচাদরে।
খেয়াল করলাম যে শ্বাসকষ্ট না হলেও স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে অল্পস্বল্প অসুবিধে হচ্ছে। রোটাং পাসে (১৩০০০ ফিট) খুব তাড়াতাড়ি চলাফেরা করতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু এখানে অসুবিধে উপলব্ধি করলাম কিছুটা। তাড়াহুড়ো করে আশেপাশের পাহাড়ি ছোট উঁচু জায়গায় ওঠা গেল না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকের বেশ কিছু ছবি নিলাম। বেশ অনেকটা দূরে প্রচুর বরফের মাঝে অনেকে খেলাধুলা করছে দেখা গেল। কিন্তু ওই ভারি গামবুট টেনে টেনে অত দূরে যাওয়া আমার আর পোষাল না।
ড্রাইভার সাহেবের বরাদ্দ করা পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা শেষ হতে উঠে পড়লাম গাড়িতে। এবার উৎরাই নামা... গন্তব্য ইউমথাং ভ্যালি। ইউমথাং উপত্যকায় এসে পৌঁছলাম যখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। মেঘের চাদরে ঢেকে গেছে গোটা উপত্যকা! এদিক ওদিক চড়ে বেড়াচ্ছে ইয়াকের দল, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়িয়া নদী! মার্চ-এপ্রিলে নানা রঙের রডোডেনড্রন ফুলে ঢাকা পড়ে ইউমথাং – তাই এর আরেক নাম 'ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স'।
বেশ খানিকক্ষণ ইউমথাং-এর অপার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এবার ফিরে চলার পালা – বিদায় নর্থ সিকিম। কাশ্মীর আমি যাইনি কখনো, জানিনা কোনোদিন যেতে পারবও কিনা। কিন্তু আমার কাছে তুমিই ভূস্বর্গ!
পেশায় চিকিৎসক (নাক কান ও গলাবিশেষজ্ঞ) অরিন্দম পাত্রের নেশা ছবি তোলা। এছাড়াও দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ভ্রমণ করা তাঁর আর এক শখ।