পেলিং-এ তিনদিন
সৌমী নাগ
ডাক্তারদের জীবনে মানসিক চাপ আজকাল একটু বেশি, কখনো কখনো মনে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চলে যাই দূরে… অজানাকে জানতে আর অদেখাকে দেখতে। বিয়ের পর থেকেই আমরা দুজন মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়ি। সেবার রওনা দিয়েছিলাম পেলিং-এর উদ্দেশ্যে। শীতের দিনে শীতের জায়গা যেতে ভীষণ ভালোবাসি। আজকের এই অতিমারির দুনিয়ার ঠিক আগে আগে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। দিনটা ছিল রবিবার, সকাল নটা দশে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে এয়ার এশিয়ার ফ্লাইট। সাড়ে দশটার সময় নামলাম বাগডোগরা বিমানবন্দরে। ফ্লাইট একদম রাইট টাইম। লাগেজ নিয়ে বেরোতে বেরোতে এগারোটা বাজল। আগে থেকে বুক করে রাখা গাড়ি অপেক্ষা করছিল, ড্রাইভারসাহেবের নাম আমান।
এন.এইচ.-৩১ ধরে সেবক কালীবাড়ি পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। সমতল থেকে আস্তেআস্তে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায়। এরপর রাস্তায় সঙ্গী হল সুন্দরী তিস্তা। তিস্তার অপূর্ব রূপ আর আকাশী-সবুজ রঙ – চোখ ফেরানো যায় না। পথে চোখে পড়ল বাঁদরের দল। কেউবা বসে রোদ পোহাচ্ছে, কেউবা উকুন বাছতে ব্যস্ত, শিশুগুলো খেলা করছে। পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর সর্পিল রাস্তা – আমাদের মত সমতলের মানুষদের কাছে এ যেন বিস্ময়।
কখন বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। কিন্তু শরীরের দাবীকেও তো উপেক্ষা করা যায় না। খেয়াল হল প্রচন্ড খিদে পেয়ে গেছে। রাস্তার ধারে একটি ছোট পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন দোকান দেখে দাঁড়ালাম। নাম লিলামানি। শরীর নামক ইঞ্জিনটির জন্য কিছু রসদ সংগ্রহ করে আবার বেরিয়ে পড়লাম। পৌঁছে গেলাম পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমের বর্ডারে। চেকপোস্টে সিকিম পুলিশের কিছু সাধারণ প্রশ্নোত্তরপর্বের পর আবার শুরু হল যাত্রা।
এবার পথের বাঁকে দেখা পেলাম রঙ্গিত নদীর। তিস্তার থেকে রঙ্গিতের রূপ সম্পূর্ণ আলাদা – পাথুরে, চঞ্চল – অনেক বেশি উচ্ছ্বল। শাল-সেগুনের জঙ্গল পেরিয়ে চোখে পড়ল পাহাড়ের গায়ে গায়ে এলাচ চাষ। সুবিস্তৃত জায়গা জুড়ে শুধু এলাচ গাছের ঝোপ।
এই প্রথম দেখলাম এলাচ গাছ। দেখতে অনেকটা 'পিস লিলি' গাছের মতন। রাস্তার দুইধারে পনসেটিয়া গাছের বাহার। এই সৌন্দর্যে কোনো কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই। যাত্রাপথে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ছে ক্ষীণকায়া ঝরনা, দেখতে পেলাম কত নাম না জানা পাখি। যত দেখছি ততই যেন আরো দেখার তৃষ্ণা বেড়ে উঠছে।
পেলিং-এ পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। প্রায় বিকেল চারটের সময় পৌঁছালাম হোটেলে - নিরিবিলি পাহাড়ের কোলে পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন - নাম ম্যাগপাই পাকচু ভিলেজ রিসর্ট। হোটেলকর্মীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং আতিথেয়তা মন জয় করে নিল। শুনেছিলাম হোটেলের ঘর থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে। কিন্তু সেদিন দেখতে পেলাম না আকাশ মেঘলা থাকার কারণে। মন ভীষণ খারাপ হল। পাহাড়ে কিরকম ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। পাঁচটার সময় দেখলাম কেমন নিঝুম হয়ে গেল চারিদিক। সাতটার মধ্যে যেন গোটা শহর ঘুমিয়ে পড়ল। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়িগুলোতে মিটমিট করে আলো জ্বলছে –মনে হচ্ছে যেন কয়েকশো জোনাকি। দুজনে ঘরে জানলার ধারে বসে কফি আর তেলেভাজা নিয়ে গল্প করছি। আলোচনা করছি পরের দিনের সাইটসিইং নিয়ে। হঠাৎ খেয়াল হল বাইরেটা জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। মনে পড়ল সেদিন তো মাঘী পূর্ণিমা। ঘরের আলো নিভিয়ে জানলা খুলে দাঁড়ালাম। ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া ঢুকে আসছে। রীতিমতো কাঁপু্নি ধরছে। কিন্তু সামনে যে দৃশ্য দেখলাম হয়ত সারাজীবন তার আবেশ চোখে লেগে থাকবে। জ্যোৎস্নাস্নাত কাঞ্চনজঙ্ঘা - দুধসাদা বরফের চূড়া। দুচোখ ভরে শুধু দেখতে থাকলাম। বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম সেই রূপে। সম্বিত ফিরল রুমসার্ভিসের কলিং বেলে। ডিনার দিতে এসেছে একটি মেয়ে। ঘড়িতে দেখি সাড়ে নটা বেজে গেছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার একটু জানলার ধারে বসলাম। প্রচন্ড ক্লান্তি শরীর জুড়ে, কিন্তু তবুও ইচ্ছা করছিল দেখতে… এই অপূর্ব সুন্দরকে আরও আরও দেখতে।
সকালে অ্যালার্মঘড়ির শব্দে ঘুম ভাঙল। সাড়ে পাঁচটা। তখনও অন্ধকারের চাদরমুড়ি দিয়ে আছে শহরটা। ইলেকট্রিক কেটলে জল গরম করে কাপে টি-ব্যাগ ভিজিয়ে নিয়ে বসলাম আবার ওই জানলার ধারে। অপেক্ষা এবার সূর্যোদয়ের। প্রচন্ড ঠাণ্ডা। কম্বলমুড়ি দিয়ে বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে একটু আরাম হল। আগের দিন রাতেই ওয়েদার ফোরকাস্ট অ্যাপ থেকে দেখে রেখেছিলাম সূর্যোদয়ের সময় - সকাল ছটা দশ মিনিটে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম পুবের আকাশ লাল হয়েছে। চেয়ারে আর বসে থাকতে পারলাম না। দাঁড়ালাম জানলা খুলে। দিগন্তে আস্তে-আস্তে ফুটে উঠছে কাঞ্চনজঙ্ঘার অবয়ব।
এই দৃশ্য মর্মস্পর্শী - জীবনের সব চিন্তা থেকে যেন মুক্তি। এক অপার প্রশান্তি আমাদের গ্রাস করে নিল। শিল্পী যেমন ক্যানভাসে রঙ নিয়ে খেলা করেন এও তাই। কোনো অজানা কিন্তু শক্তিশালী শিল্পী যেন প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে নতুন করে সাজিয়ে দেন তাঁর তুলির টানে আর রঙের স্পর্শে। আকাশে এখনো চাঁদ বিরাজমান। এ এক পালাবদলের ক্ষণ। আস্তে আস্তে চাঁদ পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে গেল। পুবআকাশ ঝলমল করছে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ে উঠেছে স্বর্ণ-বর্ণ। সম্বিত ফিরলে মনে পড়ল ড্রাইভার-দাদা সাড়ে আটটার সময় আসবে। আজ প্রথম সাইট-সিয়িং।
বেরোতে বেরোতে প্রায় নটা বেজে গেল। পেলিং শহরটা ছবির মতন সুন্দর। সর্পিল রাস্তা, স্বচ্ছ-নীল আকাশ, ইতিউতি পাহাড়ি ঝরনা, আর কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য। সবটুকুই যথাযথ।
প্রথমেই পৌঁছে গেলাম পেলিং স্কাই-ওয়াক। ঝকঝকে নীল আকাশ। মেঘের লেশমাত্র নেই। সামনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। আর একদিকে ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধ। পথের দুধারে রয়েছে বিভিন্ন রঙের প্রার্থনা-পতাকা।
পথ ধরে একটু হেঁটে যেতেই চোখে পড়ল সাঙ্গা-চোলিং মনাস্ট্রি। সিকিমের অন্যতম প্রাচীন মনাস্ট্রি। স্থাপিত হয় সপ্তদশ শতকে। প্রার্থনা সঙ্গীতের সুর… ঘণ্টার মৃদু শব্দ… শালগাছের মধ্যে দিয়ে হালকা বাতাসের বয়ে যাওয়া… বিভিন্ন নাম-না-জানা পাহাড়ি পাখির-কূজন… এইসব শব্দের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এক অপার্থিব পরিবেশ। পাশেই ছিল একটি ছোট চায়ের গুমটি। দুজনে দুকাপ চা নিয়ে বসলাম একটা ছোট টিলায়। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
রিম্বি ফলস। পাহাড়ের বুক চিরে নেমেছে একটি ঝরনা। ড্রাইভারদাদার কাছে শুনলাম বর্ষাকালে ফুলেফেঁপে ওঠে এই ঝরনা, এখন সে অবশ্য অনেক শান্ত। আমরা কিছু ছবি তুললাম, ঝরনার আশপাশ থেকে কয়েকটা নুড়িও কুড়িয়ে নিলাম। তারপর আবার শুরু হল যাত্রা।
একদিকে উঁচু পাহাড় আর একদিকে গভীর খাদ। আঁকাবাঁকা পথ আর প্রত্যেক বাঁকে বিস্ময়। মাঝে মাঝে অনেক নীচে রঙ্গিত নদী দেখা যাচ্ছে। আর যখন রঙ্গিত চোখের আড়াল হচ্ছে, তার বয়ে চলার শব্দ আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। এভাবে অনেকটা পথ চলার পর পৌঁছে গেলাম খেচিপেড়ি লেক। আগেই শুনেছিলাম এই লেকে প্রচুর মাছ আছে। দুপ্যাকেট মাছের খাবার কিনে বেশ কিছুটা পথ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌছে গেলাম লেকে। একটি কাঠের ব্রিজ তৈরি করা আছে লেকের ওপর। ব্রিজটা লেকের ভিতর বেশ কিছুটা যায়। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কিছু খাবারের দানা জলে দিয়ে অপেক্ষা। একটুপরেই ঝাঁকে-ঝাঁকে মাছের দল এসে হাজির, আয়তনে তারা সকলেই বিশাল। হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই এই লেকের গুরুত্ব নাকি অনেক। ফেরার পথে চোখে পড়ল একটি ছোট বাচ্চা আর তার মা বসে মোমো তৈরি করছে। দুপুরে খাওয়ার সময়ও প্রায় পেরিয়ে গেছে। দুজনে বসে পড়লাম গুমটির এককোণে। ধূমায়িত মোমো আর তার সঙ্গে বাদাম-লঙ্কার চাটনি। উফফ দারুণ জমে গিয়েছিল লাঞ্চটা! খাওয়ার পর্ব মিটিয়ে আবার যাত্রা শুরু।
এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস। আমার মনে হয় যাত্রাপথের উন্মাদনাটাই আসল। কিছু একটা দেখার আগে সেই জিনিসটা সম্পর্কে মনের কল্পনা, মনের ক্যানভাসে নানারকমের আঁকিবুকি কাটা – তার মজাটাই আলাদা। পথের দুধারে অসংখ্য এলাচ গাছ। কিরকম যেন অযত্নেই বেড়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে রোদ্দুর চলে গেল। বেলা প্রায় শেষ হয় হয়… ঠাণ্ডাও বেশ বেড়ে গিয়েছে; গন্তব্যে পৌঁছানোর কিছু দূর থেকেই শব্দ পেলাম – দুর্নিবার দুরন্ত গতিতে জল পড়ার শব্দ। মনের উত্তেজনার পারদ আরও বাড়ল। অবশেষে পৌঁছলাম জলপ্রপাতের সামনে। অবিশ্রান্ত ধারায় চঞ্চলগতিতে পাথর চিরে জল ঝরে পড়ছে। এই ঝরনার উৎস নাকি দেখা যায়না। স্থানীয় কিছু মানুষের কাছে জানতে পারলাম এর উৎস হল কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফগলা জল, তাই সারা বছর এর প্রবাহ মোটামুটি একই রকম থাকে; তবে বর্ষাকালে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। প্রপাতের ঠিক নীচে তৈরি হয়েছে একটি ছোট জলাধার। তারপর আবার জলধারা প্রবাহিত হয়েছে নিজের ছন্দে বিশাল বিশাল পাথরগুলোর আনাচ-কানাচ দিয়ে; যেখানেই যাই, চেষ্টা করি কিছু স্মৃতি সংগ্রহ করার। এখান থেকেও কুড়িয়ে নিলাম নুড়ি-পাথর, আর এই কর্মসাধন করতে গিয়ে বরফশীতল জলের স্পর্শে খানিক ভিজেও গেলাম। শীতে কাঁপতে-কাঁপতে দুজনে গেলাম পাহাড়ের কোলে অবস্থিত একটি গুমটিতে। গরম দুকাপ কফি সেবন করে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম… আবার শুরু হল যাত্রা।
রাবডেন্টসে রুইনস। এটি হল সিকিম রাজার দ্বিতীয় রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ। ১৬৭০ থেকে ১৮১৪ সাল অবধি এখানেই ছিল সিকিমের রাজধানী। পৌঁছলাম যখন দিনের আলো প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। পাহাড়ি সরু রাস্তা আর দুপাশে সারি দিয়ে গাছ। জায়গাটাতে অন্ধকারটা যেন একটু বেশিই। আলো-আঁধারির মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে অবশেষে পৌঁছালাম মূল গন্তব্যে। গা-টা ভালোই ছমছম করেছিল … তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম গাড়িতে।
সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে শরীর বেশ ক্লান্ত। মন চাইছিল হোটেলের ঘরের জানলার ধারের চেয়ার আর তার সঙ্গে একটা স্ট্রং কফি। ফিরে এসেই তাই প্রথমে কফি আর স্ন্যাকস অর্ডার করলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে নিয়ে কফির কাপ হাতে দ্বৈতআড্ডা। সারাদিনের অভিজ্ঞতার আলোচনা, নিজেদের গল্প, প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততায় যে গল্পগুলো করা হয়না সেইসব গল্প। প্রত্যেকটা মুহূর্তে একে অপরের পাশে থাকার অনুভূতি নিয়ে সন্ধ্যেটা বেশ কেটে গেল।
পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হল। তাই আর সূর্যোদয় দেখা হল না। মনটা একটু খারাপ হল, নিজেদের ওপর খুব রাগও হচ্ছিল। কিন্তু সারাদিন অন্যান্য আরও অনেক কিছু করার ছিল, অনেক নতুন জায়গা দেখার ছিল। তাই মনখারাপ ভুলে গিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হলাম দুজনে। ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম দ্বিতীয় দিনের সাইট-সিয়িং-এর জন্যে।
প্রথমেই পৌঁছে গেলাম পেমইয়াংসি মনাস্ট্রি। এটিও সিকিমের একটি অন্যতম প্রাচীন মনাস্ট্রি। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে এটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পেলিং শহরটার বৈশিষ্ট্য হল যে প্রায় সব দ্রষ্টব্যস্থান থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌম্যসুন্দর মূর্তি যতই দেখি ততই বিহ্বল হই। পুরো পরিবেশটায় এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে। ধ্যান করার জন্য এ হল আদর্শ পরিবেশ; ওখানকার সন্ন্যাসীদের মুখে শুনলাম এখানে নাকি অনেক বিদেশিদের সমাগম হয়। তাঁরা এখানে আসেন আত্মদর্শন করতে, নিজেদের অন্তরাত্মাকে খুঁজে পেতে। মনাস্ট্রিতে অনেক সন্ন্যাসীর বসবাস। যখন পৌঁছেছিলাম সেটি ছিল মঠের প্রার্থনার সময়। আবাসিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ছাড়াও স্থানীয় মানুষও ছিলেন প্রার্থনাগারে। মনাস্ট্রির চতুর্দিকে খুব সুন্দর বাগান আর ওই বাগানের এক কোণ থেকে রাবডেন্টসে রুইনের এর কিছু অংশ দেখা যায়। ধূপ-ধুনো-কর্পূরের গন্ধে পরিবেশ হয়ে উঠেছিল আরও মোহময়, আরও পবিত্র।
এরপর দেখতে গেলাম পেলিং হেলিপ্যাড। নিয়মিত কোনো হেলিকপ্টার পরিষেবা নেই এখান থেকে। স্থানীয়দের কাছে শুনলাম কোনও এমার্জেন্সি ছাড়া এখানে হেলিকপ্টার অবতরণ করেনা; তবে এখান থেকে একদিকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা আর একদিকে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা জন-বসতি, কোথাওবা পাইন বন, আবার কোথাওবা সোপান-কৃষির নিদর্শন।
এরপর যাত্রা শুরু হল সিংসোর ব্রিজের দিকে। ড্রাইভার দাদা বললেন, সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। অনেকটা ঘুরপথে যেতে হবে কারণ পরিচিত রাস্তাটা কিছুদিন আগে ধ্বসে নষ্ট হয়ে গেছে। যাই হোক যাত্রা শুরু হল। প্রচন্ড খারাপ রাস্তা। ঝাঁকুনিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। রাস্তায় মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে ছবিও তুললাম অনেক। কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ল একটি নাম-না-জানা পাহাড়ি ঝরনা। খরস্রোতা এবং চঞ্চলা। স্বচ্ছ কাচের মতন তার জল। রিমবি বা কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলসের থেকে রূপে কিছু কম যায় না কিন্তু এখনও পরিচিত পর্যটন-আকর্ষণ হয়ে ওঠেনি। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। অনেকখানি পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সিংসোর ব্রিজ - এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম ঝুলন্ত সেতু। বলা হয় এর উচ্চতা ১০০ মিটার আর প্রায় ২০০ মিটার লম্বা। দুটি বিশাল পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত এই ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ালে নীচে দেখা যায় গভীর জঙ্গল আর তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এক দুর্দান্ত নাম-না-জানা নদী। দুদিকের পাহাড়ে এলাচ গাছের ঝোপ নয়তো ধাপ-চাষের নিদর্শন। আকাশ বেশ মেঘলা ছিল, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। কখনো কখনো ঝিরঝির করে বৃষ্টিও পড়ছিল। আবার একটি মোমোর দোকান পেয়ে গেলাম। মোমো তখনও তৈরি হয়নি। তাই প্রথমে খেলাম থুকপা। নুডুলস আর বিভিন্ন সবজি দিয়ে বানানো অতি সাধারণ একটি খাবার কিন্তু খুব সুস্বাদু। তারপর খেলাম চিকেন মোমো। আর সব শেষে এককাপ করে গরম চা।
সিংসোর থেকে বেরিয়ে পড়লাম ডেন্টাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভারদাদা একটি ভিউপয়েন্টে নিয়ে গেল যেখান থেকে পুরো ডেন্টাম উপত্যকা দেখা যায়। বিস্তীর্ণ উপত্যকায় সরষে, ভুট্টা ইত্যাদির চাষ হয়েছে। উপত্যকার আর এক দিকে ছোট ছোট বাড়ি, স্কুল, বাজার ইত্যাদি। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল।
পেলিং শহরে এসে ইচ্ছে হল স্থানীয় বাজারটা একটু ঘুরে দেখতে। নেমে পড়লাম বাজারে। ছোট্ট বাজার। কয়েকটা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান, কিছু ট্রাভেল এজেন্সি, ফাস্টফুডের দোকান, আর কিছু স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকান। হাতে তৈরি ধূপ কিনলাম। বাকি জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেশি বলে মনে হল। ক্লান্ত শরীরে হোটেলে পৌঁছলাম।
আজ শেষ রাত্রি এখানে। তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছিয়ে ডিনার করে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাগডোগরা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। মনে অনেক ভালোলাগা নিয়ে আর আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় জানালাম কাঞ্চনজঙ্ঘাকে।
পেশায় চিকিৎসক সৌমী নাগ ভালোবাসেন কাজের ফাঁকে একটু ছুটি মিললেই বেড়াতে যেতে।