নন্দাকিনীর উৎসমুখে

সুদীপ্ত দত্ত

 

~ রন্টি স্যাডেল ট্রেক রুটম্যাপ || রন্টি স্যাডেল ট্রেকের আরও ছবি ~

যাত্রাপথে নতুন বন্ধুরা

"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে..." তবে আর কী? অন্যের পথ অনুসরণ করে তার হাত ধরেই এগিয়ে চলো! ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই হয়েছিল বছর তিনেক আগে ২০১৭-এর সেপ্টেম্বরের শেষে। চেয়েছিলাম পুজোর ছুটিতে অরুণাচলের একটি অল্পপ্রচলিত ট্রেকরুটে পায়ে হাঁটব, কিন্তু সঙ্গী জোগাড় করতে পারলাম কই? বন্ধুদের কেউ ছুটি ম্যানেজ করতে পারে না, আবার কেউ বা খরচাপাতির বহর শুনে পিছিয়ে যায়। এদিকে "ইউথ হোস্টেলস"-এর পুরনো বন্ধুরা রূপকুণ্ডে যাওয়ার কথা বললেও ততক্ষণে আর কোনও আসনই খালি ছিল না। তাই অফিস কলিগ মানবদা যখন "রন্টি স্যাডেল" যাওয়ার কথা পাড়ল আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। মানবদাদের একটা ট্রেকিং টিম রয়েছে, ক'দিন পরপরই ওঁরা বেড়িয়ে পড়েন পাহাড়ের রাস্তায়। ভিড়ে গেলাম সেই দলে। কথা ছিল ছয়জনের দল নিয়ে রওনা হব, কিন্তু হাওড়া স্টেশনে গিয়ে দেখি লোক কমে মাত্র চার। তার মধ্যে দাঁতের ব্যথায় কাবু মানবদা চলছে অ্যান্টিবায়োটিক আর মনের জোরের ওপর ভরসা করে! দলের ক্যাপ্টেন সুখেনদা একাই একশো, অনেক ট্রেকের অভিজ্ঞতা থাকায় চেনাপরিচিতিও অনেক। তাই ট্রেকের প্ল্যানিং, গাইড থেকে শুরু করে যাতায়াত বা থাকা খাওয়ার কোনও ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে হল না। আর অন্য সাথী বাবুদা যেন হাশিখুশির ফোয়ারা। এরকম মানুষ ছাড়া একটা বড়সড় ট্যুর চিন্তাও করা যায় না। বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও পঞ্চাশ পেরোনো তিনজনের দলে কখন যে মিশে গেলাম টেরই পেলাম না।

পাহাড়ি জঙ্গলি পথ আর "রাত কি রানি"

হাওড়া থেকে উইকলি লালকুঁয়া এক্সপ্রেস, ট্রেন হিসেবে খুব একটা মন্দ নয়, মোটামুটি পাংচুয়াল। তার ওপর স্লিপারে কাটা টিকিট অটো-আপগ্রেডেশনে এসি হয়ে যাওয়ায় লটারিতে প্রাইজ জেতার মত একটা অনুভূতি হতে শুরু করল। ওরা পুষ্টি আর স্বাদ সবকিছুর কথা মাথায় রেখে অল্প তেলে ভাজা পরোটা আর সন্দেশ সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল, চব্বিশ ঘন্টার ট্রেন জার্নিতে তাই কখনোই খালি মুখে বসে থাকতে হল না। লালকুঁয়া পৌঁছতে পরদিন বেলা এগারোটা, হাতে সময় খুব কম, তাই বুক করে রাখা গাড়ি স্টেশনে আসতেই রওনা দিয়ে দিলাম লোহাজংয়ের দিকে। কিন্তু সময় বাঁচাবো বললেই তো আর সময় বাঁচে না, ট্রেন থেকে নেমে খিদে পেটে আর কতদূর যাওয়া যায়। হল্দোয়ানির কাছাকাছি পৌঁছে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হল। রেস্টুরেন্টটা একটা পাহাড়ের ধাপে বানানো হয়েছে, একটু নিচে গোলা নদী বয়ে চলেছে, আর তার পাশে তৈরি হয়েছে বৈষ্ণোদেবীর মন্দির আর একটা মঠ। দেবভূমি উত্তরাখণ্ডে মন্দির দর্শন হবে না এটাও কি সম্ভব? খাওয়াদাওয়া করে আবার লম্বা পথে পাড়ি দিলাম। কিছুটা যেতেই গোমতী নদী আমাদের সঙ্গী হল। নৈনিতাল, আলমোড়া, কৌশানি হয়ে গোয়ালদাম পৌঁছলাম রাত আটটায়। এরপরে রয়েছে জঙ্গলের পথ। রাতের অন্ধকারে সে পথে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হবে সেই ভাবনা মাথায় এলেও সাহসে ভর করে এগিয়ে চললাম পাহাড়ি পথ ধরে। রাস্তা ততটা ভাঙাচোরা নয় কিন্তু আঁকাবাঁকা আর প্রতিটা বাঁকের ওপারেই রয়েছে গভীর খাদ। পাহাড়ি জঙ্গলে গাড়ির হেডলাইটে মাঝে মাঝেই নজরে পড়তে লাগল শেয়াল আর বুনো খরগোশ। বনের রাস্তায় চলতে চলতে মিষ্টি একটা সুগন্ধ টের পেলাম। ড্রাইভারকে জিগ্যেস করলাম "এটা কিসের গন্ধ?" জানালো "ওহ রাত কি রানি হ্যায়"। রাতের জুঁই বা হাসনুহানাকে এরা এই নামেই ডাকে। সমতল থেকে যত ওপরে উঠতে লাগলাম ঠাণ্ডাটাও জাঁকিয়ে বসতে লাগল। লোহাজং পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত তখন দশটা। আমাদের থাকা, খাওয়া-দাওয়া আর পুরো ট্রেকের দায়িত্ব ছিল দেব-এর কাঁধে। এখানকার নামকরা গাইড। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে পরিচয় বহুদিনের। বেশ কয়েকটা ট্রেকে মানবদাদের সঙ্গী ছিল দেব। লোহাজং পৌঁছতেই দেখা হয়ে গেল ওর সঙ্গে। ট্রেকারদের জন্য একটা গেস্ট হাউস রয়েছে, দেব আগেই সেখানে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করে রেখেছিল। দোতলার একটা বড় ঘরে আমাদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে একটু পরেই খাবার নিয়ে হাজির হল। এত রাতে খিদের চেয়ে ক্লান্তিটাই অনেক বড় বলে মনে হল, তাই অল্পকিছু খাবার মুখে তুলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুয়ে পড়লাম।

দুলকিচালে দিদনার পথে
ভোর হল পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট শহর লোহাজংয়ে। আগের রাতে শহরটাকে দেখার বা চেনার কোনও উপায় ছিল না। এদিন সকালে উঠে ব্যালকনি থেকে সামনের পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইলাম সূর্য ওঠার অপেক্ষায়। কিন্তু এই শহরে ভোরের সূর্য থেকে যায় পাহাড়ের আড়ালেই। সামনে নন্দাঘুন্টি পাহাড়ের চূড়া ছাড়া আর বিশেষ কিছুই দেখার নেই। হালকা কুয়াশায় সেই পাহাড়ে ভোরের লাল আভাও সেভাবে চোখে পড়ল না। গোয়ালদাম থেকে এই শহরে গাড়িপথে যোগাযোগ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেও খুবই সীমিত। সকালের হালকা ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা পিঠে ছোট ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলাম দিদনার পথে, শুরু হল প্রথম দিনের ট্রেকিং। তবে নয়দিনের এই ট্রেকে বড় রুকস্যাকগুলো আমাদের বইতে হবে না, তার জন্য ক্যাপ্টেন আগেই পোর্টারের ব্যবস্থা করে রেখেছে।
দিদনার পথের শুরুটা সহজ উতরাই, অনেকটা গ্রামের রাস্তার মত। অল্প কিছুটা এগোতেই দূরে পাহাড়ের গায়ে বিন্দুর মত দেখা গেল আজকের ঠিকানা দিদনা গ্রাম। শুরুতেই গ্রামটা দেখতে পাওয়া গেলেও পথ বেশ অনেকটাই। এই পথে দেব নিজে আমাদের গাইড হয়নি ঠিকই, তবে ওর ভাই আনন্দকে পাঠিয়েছে আমাদের দেখভালের জন্য। বছর একুশের আনন্দ যেমন ছটফটে, শারীরিক ভাবে তেমনি ফিট। অভিজ্ঞতা কম থাকায় হয়তো এই পথের ইতিহাস বা ছোটোখাটো গল্পগুলো সেভাবে গুছিয়ে বলতে পারে না, কিন্তু ট্রেকারদের ভালোমন্দের খেয়াল রাখার ব্যাপারে একটুও গাফিলতি নেই। রাস্তায় কিছু পর পর পাহাড়ি ঝরনা নেমে এসেছে আর তার ওপর দিয়ে বানানো হয়েছে পায়ে চলার মতো ঢালাই করা ব্রিজ। প্রথম প্রথম ঝরনাগুলো গুনতে গুনতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ পর হাল ছেড়ে দিলাম, এ যে অগুন্তি! আমাদের ধীর গতির সঙ্গে তাল মেলাতে আনন্দ কিছুদূর গিয়ে একটু করে জিরিয়ে নিচ্ছিল। সে হোক তা সত্ত্বেও আমরা বেশ ধীরেসুস্থে দুচোখ ভরে পাহাড়ি গ্রাম দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম। কোথাও জনমানুষহীন একটা কুঁড়ে ঘর, কোথাও বা আবার পাহাড়ের গায়ে রংবাহারি জংলি ফুল। কুঁড়েঘরের চাল টালির নয়, পাথরের পাতলা টুকরো পাশাপাশি সাজিয়ে ছাউনি দেওয়া। আর ঘরগুলো পাহাড়ের ধাপে যেন কোনোরকমে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে! প্রায় দেড় ঘন্টা চলার পর একটা ঘাসেঢাকা সমতল জমিতে পৌঁছলাম, আমাদের রাস্তায় প্রথম বুগিয়াল। মাহিলা টপ জাতীয় কিছু একটা নাম এর। ঘাসের মাঝখানে একটা পাথরের বেদি বানানো। সেটাকেই রাজসিংহাসন মনে করে তার ওপর চড়ে বসলাম।

মাহিলা টপের ডান আর বাঁদিকে কিছুটা উঁচু দুটো ঘাসে ঢাকা পাহাড়, আর সামনের দিকে অনেকটা খোলা জমি, একটা উপত্যকা বলা যায়। এখানে আরও কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই, দুপুরের মধ্যে পৌঁছতেই হবে দিদনা। কি আর করার আবার পাহাড়ি ঝরনা আর ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই থমকে দাঁড়াতে হল। সামনে রাস্তার বেশ কিছুটা অংশ ধ্বসে পড়ায় পায়ে চলা পথটাই হারিয়ে গেছে। ডানপাশে ঢাল গিয়ে মিশেছে পাহাড়ি নদীতে, আর মাঝের অংশ কাদামাটিতে ভরা। আনন্দ একটা গাছের গুঁড়ি ফেলে কাদার ওপর কোনোরকমের একটা রাস্তা বানানোর চেষ্টা করল, আর আমাদের হাত ধরে সেই রাস্তা পার করে দিল। কাদারাস্তা পেরোতেই একটা রংবাহারি গ্রামের মধ্যে চলে এলাম। সবুজ পাহাড়ের ধাপে লাল রামদানার গাছ। আর রাস্তার দু'পাশ অসংখ্য জংলি ফুলে সাজানো। তবে সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে বিছুটি গাছের চেয়েও ভয়ংকর একধরনের কাঁটাগাছ। পাহাড়ের সামান্য ধার ঘেঁসে হাঁটতে গিয়ে হাতে সেই কাঁটার একটু ছোঁয়া লাগতেই অসহ্য জ্বালা শুরু হল। তবে ক্যাপ্টেন এর এক দাওয়াই বলল বটে, তবে সেটা মেনে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। নাকের শুকনো কফ দিয়ে নাকি আস্তে আস্তে সেই কাঁটাগুলো তুলে ফেলতে হবে, এটাই উপযুক্ত ওষুধ! ফুলস্লিভ টিশার্ট না পড়ার জন্য আফসোস করতে থাকলাম। কয়েক পা এগোতেই সামনে বেশ বড়সড় একটা ঝরনা দেখতে পেলাম। ঝরনার ঠাণ্ডা জল হাতে দিতে জ্বালা কিছুটা হলেও কমল, আর পরে একসময় মিলিয়েও গেল।

এই ঝরনাটা আগেরগুলোর চেয়ে বেশ কিছুটা বড়, বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে আর এর ওপর দিয়ে কোনও ব্রিজও নেই। তাই পাথরের ওপর সাবধানে পা ফেলে ঝরনাটা পেরোতে হবে। তবে সৌভাগ্য এই যে জলের গভীরতা খুব বেশি না হওয়ায় জুতো ভিজলেও পা ভিজবে না। এর মধ্যেই আরেকটা টিমের একদল ট্রেকার হইহই করে এসে উদয় হল। ওরা ওয়ান থেকে এই পথ ধরেছে, রূপকুণ্ড পর্যন্ত যাবে। ওদের এগিয়ে যেতে দিয়ে আমরা ঝরনার ধারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। আবার চলা শুরু হল। একটা বড় লোহার ফুটব্রিজ পেরোতেই দেখতে পেলাম অসংখ্য ভেড়া আর গরু পাহাড়ের গায়ে নিশ্চিন্তে চড়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তার ধারে গিরগিটিও রঙ পালটে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে না! বানরের দল একটা ছাউনিঘরের ওপরে রীতিমতো দাপাদাপি করছে! সবই যেন প্রাকৃতিক নিয়মেই চলছে, মানুষের রাজত্ব এখানে এখনও কায়েম হয় নি। এরপরেই এল একটা লম্বা চড়াই, ওপরদিকে চড়তে চড়তে হাঁফ ধরার জোগাড়! বেশ কিছুটা ওপরে ওঠার পর একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। চা-বিস্কুট খাওয়ার ফাঁকে একপাল খচ্চর আর ঘোড়াকে মালপত্র নিয়ে ওপরের দিকে উঠতে দেখলাম। চায়ের দোকানদার জানালো দিদনা আর বেশি দূরে নয়। আর কিছুটা হাঁটতেই দিদনা গ্রাম চোখে এল। ঘড়িতে তখন আড়াইটা।
দিদনা খুবই ছোট গ্রাম, এখানকার লোক মূলতঃ চাষবাস করে আর ট্রেকিং গাইড হিসেবে ট্রেকারদের সঙ্গে পাড়ি জমায় পাহাড়ি পথে। দেব-এর বন্ধু মহিপৎ-এর পরিচিত একজনের বাড়িতে আমাদের রাখা হল। পাহাড়ের ধাপে একটা দোতলা গ্রাম্য বাড়ি, বেশ সাদামাঠা। ওপর-নীচ মিলিয়ে খান চারেক ঘর। তার একটায় আমাদের থাকতে দেওয়া হল। পাশের ঘরে আবার অন্য ট্রেকিং টিম। বিভিন্ন ট্রেকিং গ্রুপের সৌজন্যে একসঙ্গে অনেক ট্রেকার হাজির হয়েছে এখানে। সবাই মিলে বেশ জমজমাট করে তুলেছে গ্রামটা। কোনো দলে চার-পাঁচজন আবার কোনো কোনো বড় দলে তো নাকি পঞ্চাশজনও রয়েছে! এরা বেশিরভাগই চলেছে রূপকুণ্ড পর্যন্ত।
দুপুরের খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম গ্রামের আশপাশটা ঘুরে দেখতে। গ্রামের একপাশে কিছুটা চাষের জমি আর অন্যপাশে সমতলে ট্রেকারদের ক্যাম্প করার জায়গা। মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের ওপর দিকে। দেখা হল এক বাঙালি ট্রেকিং গ্রুপ "উই দ্য বোহেমিয়ানস"-এর সঙ্গে। ক্যামেরাকে সঙ্গী করে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো সৌরভ-অভীকদের কাছে একরকম নেশার মতো। ট্রেকারদের জন্য বরাদ্দ সমতল জায়গায় ওরা টেন্ট ফেলেছে। এখান থেকে দূর পাহাড়ের অনেকটাই দেখা যায়।

একটু পরেই মহিপৎ এসে হাজির হল। ও অনেক পুরানো গাইড, মানবদাদের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। এবার একটা ট্রেকিং গ্রুপের গাইড হয়ে রূপকুণ্ড পর্যন্ত যাবে। চেনামুখ দেখতে পেয়ে অনেকক্ষণ ধরে গল্পগুজব চলল। আটটা বাজতে বাজতেই রাতের খাবার সময় হয়ে এল। লঘুপাক নৈশাহারের শেষপাতে কাস্টার্ডও মিলল। খুব জলদিই রাত নেমে এল দিদনায়।

বুগিয়ালের দেশে

পরদিন সকাল সকাল রুটি সবজি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে প্যাককরা টিফিন সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আরো ওপরের দিকে ওঠা পাহাড়ি পথ ধরে। মানবদা দাঁতের ব্যথা আর অ্যান্টিবায়োটিকের অ্যাকশানে কাবু, তার ওপর পেটের গণ্ডগোল। তাই আমরা দুজন খুব আস্তে আস্তে চড়াইপথে এগোতে থাকলাম। প্রথমে কিছুটা পথ খোলা আকাশের নীচ দিয়ে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলের রাস্তা ধরতে হল। তবে এই রুটে আরও অনেক ট্রেকার চলায় পথ হারানোর কোনও সম্ভাবনাই নেই। অন্য ট্রেকারদের ফলো করে, কখনও পায়ে চলার চিহ্ন দেখে এগোতে লাগলাম। প্রায় সোয়া তিন ঘন্টার চেষ্টায় পাহাড়ের ওপর একটা খোলা জায়গায় এসে উঠলাম। জায়গাটার নাম তোলাপানি। একটা চায়ের দোকান থাকায় যেন ট্রেকারদের মেলা বসেছে। ঘন দুধ দিয়ে বানানো গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে অনেকেই ঘাসের জমিতে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ছে। সে এক পরম শান্তি।

তোলাপানিতে চায়ের দোকানটা ছাড়া আর কোনও ঘরবাড়ি চোখে পড়ল না। পুরো জায়গাটা লম্বা লম্বা গাছপালায় ঘেরা। মাঝে কিছুটা ঘাসেঢাকা ফাঁকা জমি। কিন্তু বেশিক্ষণ সময় কাটাবার উপায় নেই, আকাশ মেঘ আর কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে। আমার ক্যামেরার একটা ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় মানবদা নিজের ক্যামেরাটাই দিয়ে দিল ছবি তোলার জন্য। অল্পক্ষণ তোলাপানিতে কাটিয়ে আবার এগিয়ে চললাম অন্যান্য ট্রেকিং দলকে ফলো করে। তবে এবারের রাস্তায় চড়াই অনেক কম, মোটামুটি পাহাড়ের শিরা বা রিজ (Ridge) ধরে এগিয়ে চলতে থাকলাম। চলার পথ সবসময় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না, একটু পরপরই কুয়াশায় ঢেকে যেতে থাকল। আবার কখনও আন্দাজে পায়ে চলা পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। প্রায় ঘন্টাদুয়েক এভাবে চলার পর সামনে দেখতে পেলাম অনেকটা ফাঁকা জমি, পুরোটাই ঘাসে ঢাকা। আরেকটু ভালো করে দেখে বুঝলাম এটা আসলে ঘাসেঢাকা পাহাড় - একেই বলে বুগিয়াল। কিন্তু এত বড় জায়গা জুড়ে এরকম গাছপালাহীন শুধু ঘাসেঢাকা পাহাড় থাকতে পারে আমার কল্পনায়ও কখনো আসে নি।

এই বুগিয়ালের নাম আলি বুগিয়াল। এখান থেকে ঘুরে যাওয়া পথিক নাকি বারবার ফিরে আসে কোন অজানা এক আকর্ষণে! আলি বুগিয়ালের সঙ্গে বেদনি বুগিয়াল মিশে একটানা ঘাসের পাহাড় তৈরি করেছে। মাইলের পর মাইল জুড়ে প্রকৃতির খেয়ালে তৈরি হওয়া এই আলি-বেদনি বুগিয়াল নাকি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বুগিয়াল। এত ওপরেও দেখা গেল গরুর পাল, দিব্য পাহাড়ের ওপর বসে জাবর কাটছে! না শুধু ঘাসই নয়, মানুষের খাওয়ার জন্য ম্যাগি আর চাও পাওয়া যাচ্ছিল একটা ছোট্ট ছাউনিতে। ক্যাপ্টেন সুখেনদা আর বাবুদা অনেক আগেই এখানে পৌঁছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। মানবদা বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। আমরা অপেক্ষা করার ফাঁকে বুগিয়ালের সৌন্দর্য আর মায়াবী রূপ দুচোখ ভরে দেখতে থাকলাম। আলি টপ অনেকটা বড় একটা সমতল ঘাসের জমি। দুপাশে দুটো ঢাল নেমে গেছে অতল খাদের দিকে। সামনে আরো উঁচু একটা ঘাসের পাহাড়, সেটাতেও কোনও বড় গাছের অস্তিত্ব নেই। অনেকক্ষণ ভেবেও বুঝে উঠতে পারলাম না যে কেন এই পাহাড়গুলো শুধুই ঘাসে ঢাকা আর কেনই বা এতে বড় গাছপালার অভাব! অথচ এই পাহাড়েরই সামান্য নীচে স্পষ্ট ট্রি লাইন দেখা যাচ্ছে! একটু পর মানবদা এসে পৌঁছলে প্যাক করা লাঞ্চটা খেয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে নিলাম। তবে আজকের মতো পথ আর বেশি নেই।
এককাত হওয়া ঘাসেঢাকা মাঠের বুক চিরে চলা রাস্তা ধরে আবার এগিয়ে চললাম বেদনি বুগিয়ালের দিকে। আলি টপ থেকে পাহাড়ের ঢালের রাস্তাটা যেন অনেক অনেক লম্বা মনে হচ্ছিল। তবে যত এগোতে থাকলাম শেষ সীমানাটা আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে আসতে থাকল। কিছু পরে দুটো টিলার ফাঁক গলে বেড়িয়ে আসতেই সামনে দেখতে পেলাম এক অনন্য দৃশ্য। নীচের দিকে অনেকটা খোলা ঘাসে ঢাকা জমি আর তাতে সাজানো রয়েছে অসংখ্য রঙবেরঙের তাবু। এই তাহলে বেদনি বুগিয়াল? আকাশ কুয়াশায় ঢাকা থাকায় বিকেল চারটেতেই হাড়কাঁপানো শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলাম। দূর থেকে ক্যাপ্টেন আর বাবুদা আমায় দেখতে পেয়ে হাত তুলে নিজেদের উপস্থিতি জানিয়ে দিল। রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের গায়ের শর্টকাট বেয়ে নীচের দিকে নেমে এলাম। আমাদের টেন্টটা একটু ওপরে, নীচে অন্যান্য ট্রেকিং টিমের ক্যাম্পগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে বানানো হয়েছে। তবে পাহাড়ের ওপরে হওয়ায় এখান থেকেই প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশি সুন্দর দেখতে পাওয়া যায়।

বেদনি বুগিয়াল বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ক্যাম্পসাইটগুলোর মধ্যে একটা। তিনদিক পাহাড়ে ঘেরা, শুধু একদিকে যেখানে কুয়াশাঢাকা রয়েছে সেদিকেই নাকি অনেকগুলো পাহাড়ের চূড়া দেখতে পাওয়া যায়! তবে বেশ বুঝতে পারলাম যে এই বিকেলে তাদের মুখ আর দেখা যাবে না। শুনতে পেলাম নীচে, যেখানে অন্যান্য ট্রেকিং গ্রুপগুলো টেন্ট ফেলেছে সেখানে নাকি মোবাইলে 'টাওয়ার' পাওয়া যাচ্ছে। অল্প কিছু মুখে গুঁজে মোবাইল হাতে নিয়ে সেই খবরের সত্যিমিথ্যা যাচাই করতে বেড়িয়ে পড়লাম। টেন্ট এরিয়ার একদম শেষে খাদের কিনারায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে অবশেষে মোবাইল নেটওয়ার্কের সন্ধান মিলল। খুব দুর্বল কানেকশন হলেও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম, সবকিছু ঠিকঠাক আছে জানিয়ে বাবা-মা কেও আশ্বস্ত করা গেল।
বেদনি বুগিয়ালে টেন্ট এরিয়ার কাছাকাছি পাহাড়ের গা ফুঁড়ে একটা জলের ধারা বেরিয়ে এসেছে। সেই জলেই সবার জন্যে রান্না-খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। মালপত্র আর ক্লান্ত ট্রেকারদের বওয়ার জন্য নিয়ে আসা খচ্চর আর ঘোড়ার চিৎকারে পুরো বুগিয়ালটাই বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে। আমাদের টেন্টের কাছাকাছি পাথর দিয়ে বানানো দেয়ালের ওপর পলিথিনের ছাউনি দিয়ে একটা দোকানঘর বানানো হয়েছে, যদিও সেই দোকান বন্ধই দেখতে পেলাম। সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়াও বাড়তে লাগল। কাঁপুনি থেকে বাঁচতে তাড়াতাড়ি টেন্টে ফিরে এলাম। একটা তাঁবু খাটিয়ে কিচেন টেন্ট ফেলা হয়েছে আর একটু দূরে টেন্ট টয়লেট বসানো হয়েছে। আমাদের চার জনের জন্য দুটো টেন্ট পাশাপাশি বসানো হয়েছে আর তার খুব কাছেই আরও একটি ছোট ট্রেকিং দল টেন্ট ফেলেছে।
সন্ধ্যার ঠিক আগে আকাশ সামান্য একটু পরিষ্কার হতে সামনে ত্রিশূল পর্বতের চূড়াকে দেখতে পাওয়া গেল। তিনটে চূড়ার মধ্যে একটা মেঘে ঢাকা থাকলেও বাকি দুটোর ওপর পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়ে লাল আভা ছড়িয়ে দিল। পাহাড়ের আড়ালে হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে এল বেদনি বুগিয়ালে, আর কখন যে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল টেরই পেলাম না! এই শীতে টেন্টের আশ্রয় ছেড়ে আর খেতে যাওয়ার ইচ্ছে করছিলো না, কিন্তু খালি পেটে শরীরের জোর আরো কমবে সেই ভয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতেই হল। ছোট্ট তাঁবুর আশ্রয় থেকে বাইরে পা রাখতেই বেদনি বুগিয়ালের নতুন রূপ দেখতে পেলাম। আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় চাঁদের আলো পুরো বুগিয়াল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বুগিয়াল নয়, নজর কেড়ে নিচ্ছে সামনের ত্রিশূল আর নন্দাঘুন্টির চূড়া। এমনিতে এই পাহাড়দুটোর চূড়া সব সময়ই দুধসাদা বরফে ঢাকা থাকে, চাঁদের আলোয় তারা যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিল। ওদের দেখতে দেখতেই কখন যেন গরম গরম ডালভাত আর সুজি আমাদের গলা দিয়ে নেমে গেল! সকাল সাতটায় দিদনা থেকে রওনা দিয়ে বিকেল চারটে অবধি হাঁটার ক্লান্তি মেটাতেই চেষ্টা করলাম তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে। কিন্তু বিধি বাম, ঘোড়াদের চিঁহি শব্দ আর গলার ঘন্টার আওয়াজে চোখে ঘুম থাকলেও তা বেশি গভীর হওয়ার আগেই ভেঙে যাচ্ছিল। শেষমেশ অনেক কষ্টে স্লিপিংব্যাগে কান ঢেকে আধঘুমে রাত কাটানো গেল।

ব্যাসদেবের পথ ধরে

ভোর হওয়ার আর তর সইছিল না, পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সূর্যের প্রথম আলোকে ফটোবন্দি করার জন্যে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সূর্যদেব আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পাহাড়ের পেছনেই উদয় হলেও ভোরের আলোয় ত্রিশূল পাহাড়ের চূড়া লাল আভায় রাঙিয়ে উঠল। সম্ভবতঃ আগের রাতে দূর পাহাড়ে তুষারপাত হয়েছিল, এদিন ভোরে তাই আকাশ বিলকুল পরিষ্কার। কাল বেদনি বুগিয়ালের যে পাশটা ঘন মেঘে ঢাকা ছিল আজ সেদিকেই দেখা যাচ্ছে একের পর এক পাহাড়ের সারি। প্রথমে নীলকন্ঠ, তারপর একে একে বালাকুন, চৌখাম্বা, জাহ্নুকুট, সতোপন্থ আর ভাগীরথীর চূড়াও লাল হয়ে উঠল। এদের পেরিয়ে আরও দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তবে সেখানের পাহাড়গুলোকে আর আলাদা করে বুঝে ওঠা সম্ভব হল না।
ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল, আমাদের এক জায়গায় থাকার জো নেই। পাস্তা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার পিঠে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হল। সামনেই বেদনি কুণ্ড, এত সুন্দর লেক সচরাচর দেখা যায় না। সবুজ ঘাসের জমির মাঝে এক টুকরো কাঁচের মত স্বচ্ছ জলে ভরা এই সরোবর। সেই জলেই দেখা যায় সবুজ ঘাসের মাঝে নন্দাঘুন্টি আর ত্রিশূল পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। লেকটা প্রায় গোলাকার আর পাথর-সিমেন্টের পাকাপোক্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা। লেকের জল হাজার বৃষ্টিতেও নাকি উপচে পড়ে না! তবে লেকের থেকে কয়েকটি নালা বাইরে বেরিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে নেমে গেছে, হয়তো উপচে যাওয়া জল এই নালাগুলো দিয়েই বেরিয়ে যায়।

বেদনি কুণ্ডের পাশে পাথর-মাটি দিয়ে বানানো দুটো ছোটো ছোটো মন্দির। শুনলাম, পুরাণে নাকি আছে ব্যাসদেব এই কুণ্ড থেকেই জল নিয়ে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে গঙ্গোত্রীর পথে রওনা হয়েছিলেন আর বেচারা গণেশ সেই মন্ত্র লিখতে লিখতে তাকে অনুসরণ করেছিলেন।
বেদনি কুণ্ড থেকে এগিয়ে আমরা পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা সরু সুতোর মতো পথ ধরলাম। এখান থেকে নীচের দিকে তাকালে সবুজ ঘাসের মাঝে গোলাকৃতি কুণ্ডের সম্পূর্ণ চেহারাটা বুঝতে পারা যায়। সরু রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে মাঝে মাঝে অনেক ঘোড়া আর মালবাহী খচ্চরকেও পাস করে দিতে হচ্ছিল। হঠাৎই দেখতে পেলাম এক সহিস ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচে খাদের দিকে পড়ে অনেকটা গড়িয়ে গেল, তারপর কোনও এক অলীক ক্ষমতাবলে আবার চটজলদি উঠে এল রাস্তায়! পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জিগ্যেস করলাম "সব কুছ ঠিক হ্যায় তো ভাইয়া?" উত্তর এল – "হাঁ হাঁ, সব ঠিক হ্যায়, ইয়ে তো চলতা হি রহতা হ্যায়!" আবার কিছু পড়ে দেখলাম একটা ছোট্ট টাট্টু ঘোড়া ছুটতে ছুটতে মনিবকে ফেলে পাহাড়ের ওপর দিকে উঠে গেল, আর মনিব তাকে কিছুতেই নামাতে পারে না! ও নাকি আমাদের ভয়ে আর নিচে নামছে না। অবশেষে আমরা পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে সেই ঘোড়াকে বাগ মানানো গেল! এদিনের রাস্তায় বেশি একটা বৈচিত্র্য নেই, একটাই সরু রাস্তা এগিয়ে চলেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। সকাল নটায় রওনা দিয়ে প্রায় পৌনে দুচঘন্টা পর একটা চায়ের দোকান খুঁজে পেয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। এই জায়গার নাম ঘোড়া লোটানা। এর পর নাকি ঘোড়ার খাবার পাওয়া যায় না, তাই এখান থেকে সমস্ত ঘোড়াকে ফিরিয়ে দেওয়া হত বেদনির দিকে। তবে এখনকার দিনে ঘোড়ার খাবার তার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে যাওয়া হয়, তাই এর পরের রাস্তাতেও ঘোড়া চলার কোনও বিরাম নেই। এখানে দেখার মতো বেশি কিছুই নেই, মাঝে মাঝে এক একটা চিল কিংবা বাজপাখি অনেক ওপর দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে আর কিছু ছোটো ছোটো পাখি সুড়ুৎ করে উড়ে চলে যাচ্ছে, একটা উঁচু পাথরের ওপর বসে এই দেখা ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না। মানবদা দুর্বল শরীরে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল, তাই প্রায় আধঘন্টা এখানে ওর জন্যে অপেক্ষা করলাম। আর তাছাড়া এদিনের চলার মতো আর বেশি পথ বাকি ছিলো না, সাত-তাড়াতাড়ি ক্যাম্পে গিয়ে করবোই বা কী? মানবদা এসে পৌঁছালে আমরা সেখান থেকে রওনা দিয়ে মাত্র পৌনে এক ঘন্টায় পাথরনাচুনি পৌঁছে গেলাম।
পাথরনাচুনিতে লাঞ্চ রেডিই ছিল। পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই খাবারের প্লেট হাতে পেয়ে গেলাম। এদিন রাস্তা কম হওয়ায় ক্লান্তির লেশমাত্র দেখা যাচ্ছিল না আমাদের চেহারায়। লাঞ্চের পর চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে লাগলাম। পাথরনাচুনির ক্যাম্পসাইটটা পায়ে চলা মূল পথের একটু পাশে, পাহাড়ের ঢালে। পাহাড়ের খাদটা খুব কাছে হওয়ায় সাইটটা খুবই ছোট, তাই খুব বেশি দল এখানে টেন্ট ফেলে না। আমরা ছাড়া আরও দু-একটি ছোট ছোট দলের ক্যাম্প বসেছে এখানে। তবে একদিনে অনেকটা পথ চলতে না চাইলে এখানে একটা রাত কাটিয়ে যাওয়াই ভালো। এখানকার গল্পকথায় জানতে পারলাম কোনো এক রাজা নর্তকিদের নিয়ে এখানে আসায় দেবতারা রুষ্ট হয়ে পাথর চাপা দিয়ে তাদের পাতালে পাঠিয়ে দেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তর্কে না গেলে এই কাহিনিগুলোই চলার পথের প্রাপ্তি হয়ে বহুদিন মনের কোণে রয়ে যায়।

পাথরনাচুনিতে মূল রাস্তার ওপর সেনাবাহিনির একটা অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে, রয়েছে কয়েকটা দোকানও। বিকেলে ঘুরতে বেরিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দোকানে চা-ওমলেটও পেয়ে গেলাম। শুনতে পেলাম দোকানের পেছন দিক থেকে হিমালয়ের অনেকগুলো চূড়া দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু ঘন কুয়াশায় চারদিক ঢেকে থাকায় তার একটারও দেখা মিলল না। সন্ধ্যা নামার আগেই ক্যাম্পে ফিরে এলাম। পাথরনাচুনিকে ঠিক চোখ জুড়ানো ট্রেকিং স্পট বলা যায় না কোনওভাবেই, নেই কোনো নদী বা জঙ্গলের বৈচিত্র্যও, তবে এখানে একটা রাত না কাটানো হলে বেদনি থেকে আমাদের পরবর্তী ক্যাম্প ভাগুয়াবাসার দূরত্বটা একটু বেশিই হয়ে যেত। সন্ধ্যে সাতটাতেই রাতের খাবার রেডি হয়ে গেল, ভাত-রুটির সঙ্গে মাশরুমের তরকারি দিয়ে রাতের খাবার খেতে খেতে জ্যোৎস্নাভরা পরিবেশ ভালোভাবেই উপভোগ করা গেল। এরপর দূরে কোথাও একটা কুকুরের একটানা চিৎকার শুনতে শুনতে চোখে ঘুম এসে গেল।

~ ক্রমশঃ ~

~ রন্টি স্যাডেল ট্রেক রুটম্যাপ || রন্টি স্যাডেল ট্রেকের আরও ছবি ~

'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণপত্রিকার সহসম্পাদক সুদীপ্ত দত্ত ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়েন নিরালার খোঁজে। নতুন জায়গার সাথে মিশে আপন করে নেন সেখানকার জীবন, সংস্কৃতি আর খাদ্যাভ্যাস। তারপর তাঁর প্রিয় পত্রিকাটির পাঠকদের সাথে ভাগ করে নেন সেই যাত্রাপথের খুঁটিনাটি।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher