ভিয়েনা – এক ঐতিহ্যমণ্ডিত আভিজাত্য

কণাদ চৌধুরী


~ ভিয়েনার আরও ছবি ~

চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ শহরে তিনদিন কাটিয়ে এক সকালে ট্রেনে চেপে চলেছি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার দিকে। দ্রুতগামী রিজিওজেট ট্রেনের কামরার গবাক্ষপথে নজরে পড়ছে পথের ধারের ক্রমাগত অপসৃয়মান নয়নাভিরাম দৃশ্যপট, ঝলমলে রৌদ্রকরোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দিনে ইউরোপের গ্রামাঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী আক্ষরিক অর্থেই তুলনাহীন, বিশেষ করে এই রেলযাত্রায় প্রথমে চেক রিপাবলিক এবং পরে অস্ট্রিয়ার গ্রামাঞ্চলের অনুপম সৌন্দর্য চোখে মায়াকাজল পরিয়ে রাখে। নীল আকাশের নিচে সবুজের গালিচাবিছানো প্রান্তর, তার মাঝে লাল টালির ছাদের বাড়ি দিয়ে সাজানো ছবির মতো সুন্দর এক-একটা গ্রাম, সেই বাড়িগুলোর মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের গির্জার সবুজ বা কালো তীক্ষ্ণ চূড়া, সবুজ ঘাসের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে রীতিমত স্বাস্থ্যবান গবাদি পশুর দল, কখনো দূরে চোখে পড়ছে টিলার মাথায় পুরোনো কোনও প্রাসাদ বা কেল্লা, মনে হয় অজস্র পিকচার পোস্টকার্ডের এক চলচ্ছবি চলেছে পুরো সময়টা ধরে। ট্রেনের জানলায় চোখ রেখে সেই অনবদ্য পথশোভায় বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে কোথা দিয়ে যে প্রায় চারঘণ্টা সময় কেটে গেল, বোঝাই গেল না।
উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম, চারদিকে দুটি দুটি করে মোট আটটি দেশ দিয়ে ঘেরা অস্ট্রিয়া মধ্য ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, আল্পস পর্বতমালার পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি দিয়ে সজ্জিত এই দেশটির নৈসর্গিক দৃশ্যের খ্যাতি রয়েছে সারা বিশ্বে। এ দেশের ভিয়েনা, ইনসব্রুক এবং সালজবুর্গ, এই তিনটে শহরই পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর মধ্যে ভিয়েনা শুধু যে অস্ট্রিয়ার রাজধানী তাই নয়, ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানীও বলা যায় একে। ইউনাইটেড নেশনসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ভিয়েনায় অবস্থিত, রয়েছে বেশ কিছু খ্যাতনামা আর্থিক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদরদপ্তরও। মিউজিয়াম, চার্চ, বারোক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত প্রাসাদ, উদ্যান, অজস্র সুন্দর অট্টালিকা, অভিজাত অপেরাহাউস আর কফিহাউসে সজ্জিত ভিয়েনা পর্যটকদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরোপের এক অবশ্যদ্রষ্টব্য শহর। বিশিষ্ট জার্মান নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেখট ভিয়েনা সম্পর্কে বলেছিলেন – 'গোটাকতক কফিহাউসের চারপাশ দিয়ে বানানো একটা ছোট শহর, যে কফিহাউসগুলোতে স্থানীয় লোকেরা একত্রে বসে খবরের কাগজ পড়ে।' কফিহাউসের খ্যাতি ছাড়াও ভিয়েনার রয়েছে অতি সমৃদ্ধ এক সাংগীতিক ঐতিহ্য, যার জন্যে ভিয়েনাকে 'সিটি অফ মিউজিক' বলা হয়ে থাকে। 'ওয়াল্ট্জ' নৃত্যের জন্ম ভিয়েনায়, আর পাশ্চাত্য সংগীতের যেসব দিকপাল সংগীতজ্ঞের নাম জড়িয়ে আছে ভিয়েনার সঙ্গে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন উল্ফগাঙ্গ আমাদেউস মোজার্ট, ফ্রাঞ্জ শ্যুবার্ট এবং পিতা-পুত্র দুই য়োহান স্ট্রস – সিনিয়র ও জুনিয়র।

প্রথম দিনে ভিয়েনায় পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে গেল। তাতে অবশ্য অসুবিধে নেই, গরমকালে এখানে দিনের আলো থাকে রাত নটা অবধি, ঘুরে বেড়াতে কোনো সমস্যাই নেই। ভিয়েনা এইচবিএফ বা ভিয়েনা সেন্ট্রাল রেল স্টেশন থেকে আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট বিশেষ দূরে নয়। অ্যাপার্টমেন্টের মালিক আগেই বলেই দিয়েছিলেন দরজা খোলার কোড নম্বর এবং কোথায় চাবি থাকবে। জিনিসপত্র ঘরে রেখে নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন থেকে মেট্রো ধরে চললাম দিনের প্রথম গন্তব্য 'রিংস্ট্রাস' – শহরের ঐতিহাসিক 'ইনার স্ট্রাড' বা 'ইনার সিটি'-কে বেষ্টন করা এক বৃত্তাকার অভিজাত তরুবীথি, যার দুইপাশে রয়েছে ভিয়েনা শহরের কিছু ঐতিহাসিক ইমারত, নজরকাড়া বারোক শৈলীর স্থাপত্যের জন্যে যেগুলো বিখ্যাত। রিংট্রামে চড়ে বসলে সেই ট্রাম এই রিংস্ট্রাস বরাবর চলতে থাকে, ট্রামের আসনের সঙ্গেই রয়েছে হেডফোন, কানে লাগালে শোনা যায় সেইসব পুরোনো বাড়িঘরের প্রধান প্রধানগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনাসম্বলিত ধারাবিবরণী। রিংট্রামে চড়ে এক চক্কর ঘুরে আসা হল রিংস্ট্রাস, ট্রাম থেকেই পরিচিত হওয়া গেল 'স্টেট অপেরা', 'সিটি হল', 'পার্লামেন্ট', 'হফবুর্গ প্রাসাদ', 'আর্ট হিস্ট্রি মিউজিয়াম' এবং 'ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম'-এর মতো কয়েকটি বিখ্যাত অট্টালিকার বাইরের চেহারাটার সঙ্গে। এদের কয়েকটিকে পরে আরও নিকট থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
ট্রাম থেকে নেমে এবার হাঁটার পালা। রিংস্ট্রাসকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যুলেভার্ড, সেই তরুবীথি ধরে রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর জমকালো স্থাপত্যের দিকে নজর রাখতে রাখতে পৌঁছে গেলাম 'স্টাডপার্ক' বা 'সিটি পার্ক'। 'উইয়েনফ্লস' বা উইয়েন নদী এই পার্ককে দুটো ভাগে ভাগ করেছে। সুন্দর পার্কটিতে রয়েছে বেশ কয়েকজন সঙ্গীতস্রষ্টার স্মৃতিসৌধ, যার অন্যতম হল 'ওয়াল্ট্জ'-এর রাজা য়োহান স্ট্রস জুনিয়রের গিল্টিকরা ব্রোঞ্জের মূর্তিটি। সিটি পার্কের পরের গন্তব্য ছিল তিনশো বছরের পুরোনো 'কার্ল্সকিরসে' বা 'সেন্ট চার্লস চার্চ'। সুউচ্চ বিশাল গম্বুজ আর দুটো মিনার নিয়ে বারোক শৈলীতে তৈরি এই গির্জাটি ভিয়েনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্মারক।

'কার্ল্সকিরসে' গির্জাতে নিয়মিত সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। আমরা যেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলাম, সেই সন্ধ্যায় 'অর্কেস্ট্রা ১৭৫৬' আয়োজিত 'মোজার্ট রিকুইয়েম' শোনার ব্যবস্থা ছিল, টিকিটের দাম জনপ্রতি বারো ইউরো, তাও সেটা একেবারে পিছনের সারিতে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখার জন্য, আসনে বসে দেখার টিকিট আরও মহার্ঘ। খুব নামী-দামী অর্কেস্ট্রার অনুষ্ঠানের টিকিট আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, তাছাড়া সেইসব টিকিট অনুষ্ঠানের অনেকদিন আগে থেকেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এটি সেরকম খ্যাতনামা কোনও অর্কেস্ট্রার অনুষ্ঠান না হলেও, ভিয়েনায় বসে মোজার্টের সংগীত একটু উপভোগ করার প্রলোভন এড়াতে না পেরে কেটে ফেলা হল টিকিট। ভিতরে ঢুকে আমরা তো একেবারে পিছনের দিকে গির্জার মেঝের ওপরেই বসে পড়লাম, ভাবলাম অনুষ্ঠান শুরু হলে উঠে দাঁড়ানো যাবে। আমাদের পরনের ভারতীয় পোশাক দেখে আকৃষ্ট হয়েই সম্ভবত আয়োজকরা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই আমাদের মাঝামাঝি সারির আসনে বসিয়ে দিলেন অতিরিক্ত কোনো পয়সা না নিয়েই! সুতরাং অনুষ্ঠানটা আমাদের আর দাঁড়িয়ে দেখতে হয়নি। গির্জার অভ্যন্তরের ধ্বনিপ্রক্ষেপণ ব্যবস্থার তারিফ করতে হয়, প্রায় জনা-পঞ্চাশেক যন্ত্রীর বাজনা কোনো বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের সাহায্য ছাড়াই নিখুঁতভাবে শ্রোতাদের কানে পৌঁছে যাচ্ছিল। একঘণ্টা ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনা হলো সেই বাজনা, আর সেই সঙ্গে এক ঝলক দেখেও নেওয়া হলো কার্ল্সকিরসের অভ্যন্তরের অনবদ্য অলঙ্করণ।
দ্বিতীয় দিনে ভিয়েনায় দ্রষ্টব্য-তালিকায় প্রথমে ছিল 'স্ক্লস বেলভেডিয়ার' বা বেলভেডিয়ার প্রাসাদ। বারোক শৈলীতে তৈরি দুটি অট্টালিকা, যার একটির নাম 'আপার বেলভেডিয়ার' এবং দ্বিতীয়টি 'লোয়ার বেলভেডিয়ার'। দুইয়ের মাঝে প্রচুর মর্মর মূর্তি, ফোয়ারা আর ছোট ছোট জলপ্রপাত দিয়ে সুসজ্জিত বিস্তীর্ণ সবুজ উদ্যান।

'আপার বেলভেডিয়ার' বর্তমানে একটি শিল্প-সংগ্রহশালা, মধ্যযুগ থেকে সাম্প্রতিককাল অবধি অস্ট্রিয়ার চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবির এক বিশাল সংগ্রহ এখানে প্রদর্শিত আছে। অস্ট্রিয়ান শিল্পী গুসতাভ ক্লিম্ট এবং এগন শ্চিল-এর আঁকা ছবির সঙ্গে রাখা আছে ক্লদ মনেট, ভিনসেন্ট ভ্যানগগ, পিয়ের রেনোয়া-র আঁকা কয়েকটি ছবিও। সেখান থেকে ফিরে ভিয়েনার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এসে দেখা হলো 'বুর্গগার্টেন'-এ অবস্থিত প্রায় পঁচিশ ফিট উঁচু মোজার্টের মর্মর মূর্তিটি। প্রায় দেড়শো বছর আগে গোথিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ভিয়েনার 'সিটি হল' এই শহরের অজস্র সুন্দর সুন্দর স্থাপত্যের অন্যতম সেরা নিদর্শন। গোথিক ক্যাথিড্রালের অনুকরণে নির্মিত পাঁচটি মিনারের মধ্যে মাঝেরটির উচ্চতা প্রায় তিনশো কুড়ি ফিট। এই 'সিটি হল' বর্তমানে ভিয়েনা শহরের মেয়রের কার্যালয়। একটি চলচ্চিত্র-উৎসব চলার কারণে অট্টালিকাটির প্রধান প্রবেশপথের সামনে টাঙানো ছিল একটি সুবিশাল পর্দা, যার ফলে এই অসামান্য স্থাপত্যটির চিত্তাকর্ষক চেহারাটা সম্পূর্ণভাবে চোখে ধরা দিচ্ছিল না কিছুতেই।

সিটি হলপ্রাঙ্গণে মেলা বসে গিয়েছে প্রচুর খাবারের দোকানের, সেখানে আমরাও একটু গলা ভিজিয়ে নিলাম। এর ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে ভিয়েনার 'বুর্গথিয়েটার' বা 'ইমপেরিয়াল কোর্ট থিয়েটার'। মার্বেলপাথরে নির্মিত এই বাড়িটির বহির্ভাগের 'করিন্থিয়ান' পিলারগুলি আর জানলার উপরিভাগে স্থাপিত বিভিন্ন নাট্যব্যক্তিত্বদের আবক্ষমূর্তি নজর কাড়ার মতো।

শহরের একেবারে ভৌগোলিক কেন্দ্রস্থল 'স্টিফেনপ্লাত্‍জ'-এ অবস্থিত প্রায় চল্লিশ-হাজার বর্গফিট জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা 'স্টিফান্সডম' বা সেন্ট স্টিফেন্স ক্যাথেড্রাল ভিয়েনা শহরের আরেক আকর্ষণ। ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হওয়ার পরে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে অগ্নিকাণ্ডের ফলে একবার এবং তার পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরও একবার গির্জাটি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এখন যে অবস্থায় আমরা এই স্থাপত্যটিকে দেখতে পাই, সেটি এর পুনর্নির্মিত রূপ। গির্জার দক্ষিণের চূড়াটি প্রায় সাড়ে চারশো ফিট উঁচু, বিভিন্ন রঙের টালিতে অলঙ্কৃত এই গির্জার ছাদে আঁকা আছে ভিয়েনা শহর এবং রাজ-পরিবারের প্রতীকচিহ্ন।

সুবিশাল অভ্যন্তরের দর্শনীয় সবকিছু ভালভাবে ঘুরে দেখতে গেলে সারাটা দিন লেগে যাবে। বাইরে স্টিফেনপ্লাত্‍জ সংলগ্ন স্যুভেনিরের দোকানগুলো গিজগিজ করছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের ভিড়ে, ঘণ্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে আবার ফিরে আসা হল 'হেলডেনপ্লাত্‍জ' এলাকায় 'হফবুর্গ' বা 'হাবসবুর্গ' শাসকবংশের প্রধান প্রাসাদগুলি দেখতে। অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রপতির সরকারি আবাসস্থল এবং কার্যালয় এখানেই অবস্থিত। এটি অনেকগুলো সুবিশাল অট্টালিকার সমষ্টি, যার মধ্যে রয়েছে রাজকীয় গির্জা, কোষাগার, গ্রন্থাগার, অশ্বশালা ও একটি অশ্বারোহণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এই প্রাসাদশ্রেণীর সবচাইতে প্রাচীন অংশটি নির্মিত হয়েছিল তেরশো খ্রিস্টাব্দে। কাছেই রয়েছে সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার নামাঙ্কিত 'মারিয়া-থেরেসিয়ান প্লাত্‍জ', যেখানে আছে সম্রাজ্ঞীর মূর্তিসম্বলিত একটি স্মৃতিসৌধ আর রয়েছে ভিয়েনার অপর দুইটি বিখ্যাত সংগ্রহশালা, 'নেচারহিস্টরিসেশ মিউজিয়াম' বা ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম এবং 'কুন্সহিস্টরিসেশ মিউজিয়াম' বা আর্ট হিস্ট্রি মিউজিয়াম। সময় এবং অর্থ, উভয়েরই অপ্রতুলতার কারণে কোনও মিউজিয়ামেরই অভ্যন্তরে প্রবেশ করা হয়নি, বাইরে থেকে তাদের অসাধারণ স্থাপত্যের চেহারাটুকু দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
তৃতীয়দিন রাত্রে ফেরার বিমান ধরার আগে প্রথমে যাওয়া হল 'শ্যনব্রউন' প্রাসাদ। প্রাসাদের বাগানে ঢুকলে মনে হবে হ্যাঁ, 'হাবসবুর্গ' বংশের রাজামশাইরা করেছিলেন বটে বাগান একখানা! ছয় শতক ধরে তাঁরা ছিলেন ইউরোপের শাসক। গরমকালে এসে থাকার জন্যে বাগানের সঙ্গে পেল্লায় প্রাসাদখানাও তাঁরা হাঁকিয়েছিলেন জব্বর।

'শ্যনব্রউন' অর্থে 'সুন্দর বসন্ত', বারোক স্থাপত্য-অনুসারী এই প্রাসাদের বর্তমান চেহারাটা তৈরি হয় সতেরোশো-চল্লিশ খ্রিস্টাব্দে, মহারানি মারিয়া থেরেসার আমলে। যেটুকু জায়গার ওপর এই বাগানখানা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে নয়-নয় করে প্রায় শ-দুয়েক প্রমাণ সাইজের ফুটবল মাঠ এঁটে যাবে। বাগান ঘুরে দেখতে টিকিট লাগেনা, সেটুকু নিখরচায়। কেয়ারিকরা ফরাসি বাগানের একদিকে প্রাসাদ, সেদিকে দাঁড়ালে প্রায় দেড় কিমি দূরে অন্যপ্রান্তে দেখা যাবে 'নেপচুন ফাউন্টেন', তার ওপর 'গ্লোরিয়েট' বা 'লিটল হাউস'।

ঝকঝকে লন, পরিষ্কার রাস্তা, এমনকি গাছের নিচের বেঞ্চিগুলোর ওপরেও একফোঁটা ময়লা পড়ে নেই। সাহেব কোচোয়ান দর্শনার্থীদের জুড়িগাড়িতে চড়িয়ে বাগান ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। সারা পৃথিবী থেকে বছরে প্রায় আটত্রিশলক্ষ লোক আসেন এই প্রাসাদ দেখতে। এই বিশাল এস্টেট আর তার এলাহি ব্যাপারস্যাপার পরিচালনা করার জন্য রয়েছে একটা আস্ত কোম্পানি। বেশি নয়, মোটে সাড়ে-চোদ্দশটা ঘর আছে এই প্রাসাদে, তার মধ্যে মাত্র বাইশটা ঘর ঘুরে দেখতেই পয়সা লাগে পনেরো ইউরো। এটাই ন্যূনতম মূল্য, আরো বেশি দেখতে হলে খরচাও বেশি।
শ্যনব্রউন প্রাসাদের বাগানে ঘণ্টা-খানেক ঘোরাঘুরি করার পরে ভিয়েনায় আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য ছিল 'ন্যাসমারকেট'। ষোড়শ শতকে উইয়েন নদীর ওপরে তৈরি হয়েছিল এই বাজার, তখন এখানে শুধু দুধ আর দুগ্ধজাত জিনিস বিক্রি হত। শ্যনব্রউন থেকে মেট্রো চড়ে ন্যাসমারকেট, আর ভিয়েনায় মেট্রো বা ইউ-বানে চড়া মানে 'গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও'-এর গল্প। এক এক সময় মাটির নিচে নামতে নামতে মনে হচ্ছিল প্রায় পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যাচ্ছি। ইউ-ফোর মেট্রোয় চড়ে নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে ভূগর্ভ থেকে ওপরে উঠে দেখি প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা সে এক বিশাল বাজার, শতাধিক দোকান, সেখান এখন সত্যি বলতে কী দুধ বিক্রি হতে দেখা গেল না, তবে অন্য অনেক কিছুরই কেনাকাটা চলছে। ফল-মূল, শাক-সবজি, তরিতরকারি, মাছ-মাংস, স্থানীয় ওয়াইন আর চকোলেট, নানারকমের মশলা, মধু, সুগন্ধী তেল, স্যুভেনির এমনকি হলদিরামের চানাচুর পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে সেখানে, দাম দুই ইউরো। নামে বাজার হলেও হৈ-হট্টগোল নেই, ক্রেতাদের ধাক্কাধাক্কি নেই, জলকাদায় পিছল হয়ে থাকা মাছের বাজার নেই। অনেকেই ট্যুরিস্ট, কিছু স্থানীয় মানুষও এসেছেন কেনাকাটা করতে। বিক্রেতারা বেশ দরাজভাবেই সম্ভাব্য ক্রেতাদের হাতে দোকানের খাবারের নমুনা তুলে দিচ্ছেন চেখে দেখার জন্য। খুব বিক্রি হচ্ছে চিজের পুরভরা নানা রঙের লম্বা লম্বা লঙ্কা বা প্যাপরিকা, সেগুলো খেতে যাকে বলে 'ব্যাপক'। রেস্তোরাঁগুলোতে বেশ ভিড় - তুর্কি, গ্রিক, লেবানিজ, থাই ইত্যাদি নানান খাবারের দোকান। আড্ডা দেওয়ার জায়গাকে 'ঠেক' বলাটা বাংলায় এখন বেশ চালু, ওখানে দেখলাম ওয়াইন-এর দোকানের নাম 'ওয়াইনোঠেক'।

কেনাকাটা করার বিশেষ ইচ্ছে ছিলনা, ঘুরে ঘুরে শুধু উইনডো-শপিং করে, আর হরেককিসিমের জিনিসপত্র দেখতে দেখতেই পেটে খিদে চাগাড় দিয়ে উঠল। খিদের আর দোষ কী, সকালে শ্যনব্রউন দেখতে গিয়ে প্রায় মাইলখানেক হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছে, আর এখন এই ন্যাসমারকেটের এমাথা থেকে ওমাথা একবার আপ-ডাউন করলেই দুই মাইল হাঁটা হয়ে যায়। বাজারে খাওয়ার জায়গার অভাব নেই, তার মধ্যে থেকেই একটা মধ্যপ্রাচ্যীয় রেস্তোরাঁ বেছে নেওয়া হলো। এসব জায়গায় আমিষ আহার্য বলতে প্রধানত বিফ আর পর্ক, সে আমার চলবেনা। অতএব তার বাবার নিরামিষ আহার্যের জন্য মেয়ে বেছে দিল 'বাবাগানুস' আর পিটা ব্রেড। আরবি ভাষায় 'বাবা' আর বাংলাতে বাবা একই ব্যাপার, যদিও গানুসের সঙ্গে গণেশের কোনও সম্পর্ক নেই। আজ অনেকদিন বাদে এই লেখাটা লিখতে গিয়ে দেখলাম, 'বাবাগানুস' কথাটার অন্য একটা মানে হল 'দি স্পয়েলড ওল্ড ড্যাডি'!

জিনিসটা আসলে মিহি করে বাটা বেগুনপোড়া, সঙ্গে থাকে তিল থেকে তৈরি 'তাহিনি', অলিভ অয়েল, লেবুর রস আর মসলা। নীল বর্ডার দেওয়া কানাউঁচু সাদা কলাই-করা বাটি চড়ে 'বাবাগানুস' এলেন, পিটা ব্রেড দিয়ে খেতে দারুণ লাগল। এই রকম কলাই-করা থালা, বাটি আর মগ ছোটবেলায় বাড়িতে ব্যবহার করা হতে দেখেছি, এখন বোধহয় হসপিটাল ছাড়া অন্য কোথাও আর কলাই করা জিনিস ব্যবহার করা হয়না। ভিয়েনার খানদানি কফি-হাউসগুলোর একটাও দেখা হয়নি, আজ তাই এক কাপ কফিও নেওয়া হল 'বাবাগানুস'-এর সঙ্গে। এখানে কফির সঙ্গে ছোট একটা গ্লাসে জল দেওয়ার রেওয়াজ আছে, জল দিয়ে জিভটা পরিষ্কার করে তবেই কফির কাপে চুমুক দিতে হয়, যাতে কফির স্বাদটা পুরোমাত্রায় পাওয়া যায়। এই বাজার দেখা আর খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষ হওয়ার সাথেসাথেই ভিয়েনা ভ্রমণের পালাও সাঙ্গ হল। ভাবগম্ভীর আভিজাত্যে ভরপুর ভিয়েনাকে ছেড়ে এবার স্টুটগার্টে মেয়ে-জামাইয়ের ডেরায় প্রত্যাবর্তন।

~ ভিয়েনার আরও ছবি ~

আই.আই.টি. খড়গপুরের প্রাক্তনী কণাদ চৌধুরীর পড়াশোনা এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। পরবর্তী সময়ে কর্মজীবন কেটেছে ভারতের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থায়। অবসরজীবন কাটছে বেহালা বাজিয়ে,নানান ধরণের গানবাজনা শুনে,বই পড়ে,ফেসবুকে টুকটাক লিখে এবং সুযোগ পেলে একটুআধটু বেড়িয়ে। ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালেখির জগতে প্রথম পদক্ষেপ 'আমাদের ছুটি'র আঙিনাতেই।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher