বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

বাসাই দুর্গে একবেলা

সৌম্য প্রতীক মুখোপাধ্যায়


দেশের করোনা ক্যাপিটাল মুম্বাইয়ে তখন রাস্তায় বেরোলে সব লোককেই সন্দেহ হয়, এ বুঝি করোনা রোগী! ওদিকে করোনাকালে বন্দিদশায় মন প্রাণ উড়ু উড়ু। কিন্তু কোথায় যাব? কোন হোটেলে রাত্রিবাস? এইসব ভাবলেই কিছুক্ষণ পরেই ভাইরাসের ভয় গ্রাস করে ফেলছে। আশপাশের সব জায়গায় অনেকবার গিয়ে গিয়ে – আর যাওয়ার তাগিদও পাই না। শেষমেষ খুঁজে পেলাম কাছের এক জায়গা, যেখানে আগে কখন যাওয়া হয়নি।
মুম্বাই শহরের উত্তরপ্রান্তে বাসাই জনবসতি। মুম্বাই থেকে গুজরাত যাওয়ার রাস্তায় হাইওয়ে চলে গিয়েছে বাসাই ছুঁয়ে। একটা বড় গাড়ি ভাড়া করে, সেটিকে আপাদমস্তক পরিষ্কার করে দুই বন্ধুতে মিলে বেরিয়ে পড়লাম এক সকালে – পরিবারদের সঙ্গে নিয়ে। খাওয়াদাওয়া আবার বাইরে করা মুশকিল। তাই টিফিনবাক্স, যেগুলো চার-পাঁচ মাস অনাদরে পড়েছিল, এবার দরকারে লাগল। টিফিনবাক্স ভরে ঘি ভাত থেকে লুচি, আলুর দম থেকে মিষ্টি নিয়ে যাত্রা শুরু হল।
ঠানে ছাড়িয়ে যখন বাসাই ক্রিক পেরোলাম বেলা প্রায় এগারোটা। বাসাই ক্রিক মুম্বাইয়ের উত্তর সীমা। সেখান থেকে যাব আরও তিরিশ কিলোমিটার। প্রথম ভাগটা হাইওয়ে – মসৃণ, আট লেনের; গাড়ির গতি কখনোই আশির নিচে নামবে না। শেষভাগটি প্রায় পনের কিলোমিটার জনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যে দিয়ে। উপায় ছিল না; লোকাল ট্রেন বন্ধ। নতুবা লোকাল ট্রে্নে যাওয়াই সবথেকে সোজা এবং সময়ও সাশ্রয় হয় প্রচুর। পশ্চিম রেলওয়ে আপনাকে ভিরারগামী কোনও লোকালে চাপিয়ে বাসাই নিয়ে যাবে। জ্যামজটের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে যাবেন সে বলাই বাহুল্য।
যাবো বাসাই দুর্গে। রেল রাস্তা পেরিয়ে আরও ৬-৭ কিলোমিটারের ধাক্কা। বাসাই শহরটি আর পাঁচটি শহরের মতন, কেবল মাঝেসাঝে দু-একটা চার্চ বা একটু অন্য ধাঁচের, ইউরোপীয় গন্ধমাখা বাড়ি চোখে পড়ে। দুর্গটি যেখানে, শহর সেখানে ফিকে হয়ে এসেছে। মাঠঘাট দেখা যেতে শুরু করেছে। ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে আমরা এক বটতলায় থামলাম।
দুর্গ বললেই মনে ভেসে ওঠে দুর্গম এক স্থান - পাহাড়ের ওপরে, উঁচু পাঁচিল ঘেরা। বাসাই দুর্গ সেদিক থেকে আপনাকে হতাশ করবে। উপকূলবর্তী সমতলে, এমনকি সমুদ্রও দেখা যায় না আজ আশেপাশে, দাঁড়িয়ে আছে দুর্গ। বটগাছ, তার পাশের রাস্তার ওপাশে একটা পুকুর, সামনে বজ্রেশ্বরী মন্দির, সব মিলিয়ে এক ঝটকায় যেন বাংলার এক মফঃস্বলে পৌঁছে গেলাম।
বটগাছের পূর্বপ্রান্তে দুর্গের বাইরের অংশ। দেহাতি ভাষায় খন্দহর বিশেষ। সামনেই বিশাল এক ভগ্নপ্রায় স্থাপত্য, দেখে মনে হয়, চার্চ। সামনের পিছনের দেওয়ালগুলি বর্তমান; ওপরের ছাদ গেছে উড়ে। পিছনে আরও কতকগুলি ঘরের মতন, কোনোটারই ছাদ নেই। ভাঙাচোরা কাঠামোটা কোনোমতে দাঁড়িয়ে। হয়তো বসতবাড়ি নতুবা অফিসঘর ছিল এগুলি। সেই ভগ্নাবশেষের মধ্যে বসে – একটা "ঘর" দখল করে – খাওয়াদাওয়া সারা হল; অনেক জার্নি করে পেটের ভিতর থেকে খিদের বার্তা আসছিল।
মূল দুর্গটি প্রায় ১০০ মিটার ব্যাসার্ধের – নানান রকমের গাছ, বিশেষ করে খেজুরগাছে ভরা। মাঝে একটি জলাশয়, আর চারিদিকে প্রায় ২০ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের ওপরে দুজন মানুষ হেঁটে যেতে পারে, সেইরকম পরিসরের রাস্তা। পাঁচিলের গায়ে ছোট ছোট জানালা বিশেষ। নজরদারির জন্যে। দুর্গের চারপাশ গাছগাছালিতে ভরা। একটা গ্রাম্যভাব রয়ে গিয়েছে – শুনলাম অনেক সিনেমার শ্যুটিং বা অ্যাডশ্যুট এখানে নাকি হয়ে থাকে।

এই দুর্গে কোনও কামান নেই। নেই কোনও উঁচু মহল, বা প্রাসাদ। ভাঙাচোরা যা আছে, তা দেখে মনে হয় মামুলি কিছু বাড়ি ঘর, কাজের তাগিদে বানানো। রসদ নিয়ে দোর বন্ধ করে দুর্গটিকে কতদিন হানাদারের হাত থেকে বাঁচানো যেত, তাতে ঘোরতর সন্দেহ আছে! দু-একটি পুরানো কুয়ো আছে, আর আছে চড়ুইভাতি করার উপযুক্ত সবুজে বিছানো একটি মাঠ। মনের আনন্দে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখলাম একদল ছেলেমেয়েকে। দুর্গ থেকে সমুদ্র দেখা যায় না, কিন্তু পরে দেখলাম যে সেখান থেকে মিনিট দশেক পা চালিয়ে হাঁটলেই বাসাই ক্রিকের জেটি। তাই মনে হয় অতীতকালে দুর্গের ব্যাপ্তি সমুদ্রের কিনার পর্যন্ত ছিল। জেটি বলুন বা বন্দর, সেটি বাসাই ক্রিক আর মূল সাগরের মিলনস্থলে - ভাঁটার সময়েও বেশ গভীর। আশেপাশে কিছু মন্দির-দরগা; বন্দরে নোঙর করা কয়েকটা মাছ ধরার নৌকা। আর ক্রিকের ওপারে মুম্বাইয়ের স্কাইলাইন।
লোকে বলল, আরও পশ্চিমে এক খাঁড়ির মধ্যে আছে পাচু বন্দর – সেখানে জেলেদের দাপাদাপি। মাছের বাজার। করোনার ভয়ে যাওয়া হল না।
সমুদ্রসৈকতের খোঁজে গিয়েছিলাম সুরুচি বিচে। মুম্বাইয়ের আশেপাশের কোনও সমুদ্রে স্নান করা উচিত নয়ই, আর ধূসরিত আকাশে সূর্যাস্তও মনোরম নয়। একেবারে সাদামাটা জায়গা, না গেলে কোন ক্ষতি নাই। লাভের মধ্যে হল কচি চালকুমড়ো আর শসা কেনা, বেশ সস্তাই।
নটেগাছটি মুড়ানোর আগে একটু ইতিহাসের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বাসাই বয়সে মুম্বাই থেকে পুরোনো। পশ্চিম উপকুলের পর্তুগিজদের যে বাড়বাড়ন্ত ছিল, বাসাই তারই অঙ্গ। ছত্রপতির মারাঠা সাম্রাজ্যের বাইরে এর অবস্থান। বরং গুজরাটের সঙ্গে যোগ যেন বেশি ছিল। শেষমেশ বাসাই পেশওয়াদের দখলে যায় এবং সেখান থেকে ইংরাজের হাতে। বিখ্যাত বাসাই চুক্তির শর্তানুযায়ী মারাঠারা এই সমগ্র এলাকা, মুম্বাইসমেত, ব্রিটিশের হাতে সমর্পণ করে। ক্রমশ বাসাই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে – মুম্বাইয়ের জৌলুসে ফিকে হয়ে পড়ে। আর্কিওলজিকাল সোসাইটির বদান্যতাই যা কিছু বাঁচিয়ে রেখেছে।

 

জন্ম বসিরহাটে ; পড়াশুনো কলকাতায় – আরও ভাল করে বলতে গেলে উত্তর কলকাতায়। কর্মজীবন মহারাষ্ট্রে। মুম্বাইয়ের উপকণ্ঠে বাস। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়া স্বভাব। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ; কাজের সূত্রে এখানে সেখানে যাওয়া – আর তার মধ্যেও সময় করে দেখার চেষ্টা না দেখাকে, জানার চেষ্টা অজানাকে।

 

স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে

অরিন্দম পাত্র


"তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি!"

অল্প না, ভীষণ ভাবে ভালবাসি তাকে, মানে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। কিন্তু তখনো অবধি আমার এই মধ্যবিত্ত পাহাড়িয়া ভ্রমণের স্বল্প অভিজ্ঞতায় তার দেখা পাইনি। ইতিপূর্বে মে মাসের শেষদিকের কাঠফাটা গরমে দার্জিলিং আর রিশপ-লোলেগাঁও থেকে চেষ্টা চালিয়েছিলাম তাকে এক ঝলক দেখার। কিন্তু ব্যর্থমনোরথ হতে হয়েছে।
পরিকল্পনা বদলে গত বছর এপ্রিলে ছেলের স্কুল কামাই করিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম সিল্ক রুট। যদি তার দেখা পাওয়া যায়! কিন্তু ইচ্ছেগাঁও-এ ভোরবেলা ধোঁয়াশার মত একবার দেখা দিয়েই উধাও হয়ে গিয়েছিল।
এবছর এসেছি গ্যাংটক-লাচুং-পেলিং টুরে। এবার আর ছেলের স্কুল কামাই করাতে সাহস হয়নি। তাই গরমের ছুটিতেই এলাম।
কিন্তু আসা অবধি বৃষ্টি ছিনেজোঁকের মত পিছনে পড়ে আছে! বিরক্তির একশেষ অবস্থা! গ্যাংটকে দুদিন ভুগিয়ে বন্ধ হল শেষমেষ।
লাচুং ঘুরে পেলিং এলাম। আবহাওয়া আপাত মনোরম, কিন্তু মেঘলা! তার দেখা নেই... আশাও ছেড়ে দিয়েছি। লোকাল সাইটসিয়িং করে পরের দিন নিউ জলপাইগুড়ি ফিরে যাওয়া।
ব্যাগপত্র প্যাকিং করলাম। রাতের খাওয়া সেরে ঘুমোতে গেলাম। আবার ভোরে উঠতে হবে। আট দিনের বেড়ানোর ধকল তো নেহাত কম না!
তারিখটা পরের দিন ছিল ৩/৬/১৮...চিরকাল মনে রাখার দিন! ভোর সাড়ে চারটেয় দরজায় ঠক ঠক! বিরক্তির সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল, কে রে বাবা? বেড টি তো সকাল ছটায় আসার কথা! দরজা খুলে দেখি আমাদের ট্যুর অপারেটর তারকবাবু একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে। "কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে.." বলেই দৌড়লেন পাশের ঘরগুলোর দিকে!

আমি তখন বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে! ঠিক শুনলাম তো? কোনমতে পা টেনে পাশের লবির জানালা দিয়ে উঁকি মেরে স্থাণুর মত হয়ে গেলাম! চোখে জল চলে এল... অবশেষে তিনি দেখা দিয়েছেন! ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ জানাতে জানাতে একছুটে ঘরে গিয়ে ক্যামেরা আর লেন্স নিয়ে দৌড়ে চলে এলাম ডাইনিং হলের বারান্দায়। সহযাত্রী তাপসদাও তখন সেখানে চলে এসেছেন।

সেই অপরূপ দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করতে থাকলাম। সে যেন এক অলৌকিক ব্যাপার! ক্ষণে ক্ষণে রঙ পাল্টাচ্ছে আকাশের আর তার ছটা পড়ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই অপূর্ব রঙের খেলা দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে গেলাম!

যে ছবিগুলি তুলেছি আসল দৃশ্য তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ছিল। তারপর ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে আসতেই হল ইচ্ছে না থাকলেও!
ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে আসার আগে শেষবারের মত তার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। বেলা বেড়েছে তখন আর সেও আস্তে আস্তে মেঘের অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে!
কথা দিলাম আবার ফিরে আসব তাকে দেখতে, ফিরে আসতেই হবে।

 

পেশায় চিকিৎসক (নাক কান ও গলা বিশেষজ্ঞ) অরিন্দম পাত্রের নেশা ছবি তোলা। এছাড়াও দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ভ্রমণ করা তাঁর আর এক শখ।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher