শীতকালে করবেটের জঙ্গলে
পাপড়ি সাহা
জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক' নামটা আজ খুবই পরিচিত সবার কাছে। সাধারণতঃ মানুষ করবেটের জঙ্গল বলতে প্রথমেই বোঝেন 'রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার'। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এটা জঙ্গলের প্রধান আকর্ষণ বটে। কিন্তু শুধু বাঘই নয়, আরও নানান প্রজাতির জীবজন্তুও এই অরণ্যে রয়েছে। পাহাড়, পাহাড়ি-নদী, গাছ-গাছালি, পশু-পাখি সব মিলিয়ে জঙ্গলের চরিত্রটাই অন্যরকম।
উত্তরাখণ্ডের বনদপ্তরের তরফ থেকে জঙ্গলের ভিতর বিভিন্ন স্থানে থাকার সুব্যবস্থা আছে। নৈনিতাল জেলার রামনগর নামের একটি ছোট্ট শহর। এখান থেকেই সরকার অনুমোদিত হুডখোলা জিপসি বা ক্যান্টর-এ করে বনের ভিতরে যেতে হয়। আর যদি জঙ্গলের ভিতর বনবিভাগের অতিথিশালায় এক বা দুইরাত্রি যাপনের বুকিং থাকে, তবে জিপসিই একমাত্র গাড়ি। জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ থেকে শুরু করে, রাত্রিযাপন সেরে জঙ্গলের বাইরে বেরোনো পর্যন্ত সর্বদা গাড়ি ও তার চালক অতিথিদের সঙ্গেই থাকবে।
করবেট ন্যাশনাল পার্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় জায়গা হল 'ধিকালা'। 'ধনগড়হি' গেট দিয়ে ধিকালায় যেতে জঙ্গলের ভিতর চার জায়গায় সরকারি রেস্টহাউস আছে। সুলতান, গৈরাল, শার্পডুলি ও ধিকালা। রামনগর শহর থেকে ধিকালার প্রবেশদ্বার ধনগড়হি-র দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। শীতকালের করবেট ভীষণই আকর্ষণীয়। এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। গেট দিয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে কিছুদূর যাবার পরই বোঝা যায় যে, বাইরের বৈষয়িক জগতের থেকে এ জগৎ একেবারে ভিন্ন প্রকারের। পরিকল্পনা করা হল ৩১ ডিসেম্বরের ছুটিতে আমরা (মানে আমি, স্বামী ও ছেলে, এই তিনজন) 'করবেট ন্যাশনাল পার্ক' এ বেড়াতে যাব। নয়ডা থেকে রামনগরের মোটরদূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার। গাড়িতে সময় লাগে পাঁচ ঘন্টা। তবে থেমে থেমে, প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে গিয়েছিলাম বলে রামনগর পৌঁছতে সময় লেগেছিল ছয় ঘন্টা। সে রাতে রামনগরের কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগম (KMVN)-এ ছিলাম। আগামী দুরাত জঙ্গলের ভিতর থাকার বুকিং করাই ছিল। পরদিন ১ জানুয়ারি ভোর চারটেয় উঠে তৈরি হলাম। গাড়ি রেখে, জিপসিতে চেপে রওয়ানা দিলাম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
ধনগড়হি-র গেট দিয়ে গাড়ি ঢোকার পর শুরু হল অরণ্যে পথ চলা। গাড়ি চলছে জঙ্গলের প্রধান রাস্তার ওপর দিয়ে। পাশে বয়ে চলেছে রামগঙ্গা নদী। নদী কখনও একেবারে পাশে, কখনও দূরে, কখনও অনেক নীচে আবার কখনওবা রাস্তাটাই গেছে নদীর বুকের নুড়ির ওপর দিয়ে। প্রধানত শাল ও শিশু গাছের বন। বড় বড় শাল গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। শীতের সকালে গাছের মাথায় নরম সোনালি রোদ পড়েছে। কিন্তু গাছের বড় বড় পাতা ভেদ করে সে রোদ মাটিতে প্রায় আসছেই না। রোদের মধ্যে ছিদ্রযুক্ত ছাতা নিয়ে বের হলে, ছিদ্রপথের মধ্যে দিয়ে গায়ে যেমন ছোট ছোট গোল গোল রোদ পড়ে; তেমনই ঝাঁকড়া গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে ছোট ছোট, গোল গোল, ছেঁড়া ছেঁড়া রোদ এসে পড়ছে মাটিতে। কোনও কোনও জায়গায় অনেকটা রোদ গোল হয়ে মাটিতে এসে পড়লে সেটিকে নাটকের মঞ্চের 'স্পট লাইট'-এর মত মনে হচ্ছে। এমনই এক অদ্ভুত আলো-আঁধারি রোমাঞ্চকর পরিবেশ।
জঙ্গলের ভিতর প্রথম রেস্টহাউস 'সুলতান' গেট থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে। শীতকালের জানুয়ারি মাসে ঠাণ্ডার প্রকোপ সবথেকে বেশি। তার ওপর লোকালয়ের তুলনায় জঙ্গলের ঠাণ্ডা আরও অনেকটা বেশি। উলেন ইনার, গরম জামা-প্যান্ট, ফুল সোয়েটার, লং-কোট, গ্লাভস, কানঢাকা দুটো টুপি, জুতো-মোজা এত সবকিছু পড়ার পরেও হিমেল হাওয়ায় দাঁতে যেন ঠোকাঠুকি লেগে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাস যেন ধারালো দাঁত দিয়ে অনাবৃত নাকের ডগা ও গালদুটো কামড়ে ধরছে। জঙ্গলের ভিতর গাড়ি চলছে মন্থর গতিতে। রাস্তার দুপাশে দেখা যাচ্ছে চিতল ও সম্বরের দল। গাড়ির শব্দে কেউবা সচকিত চোখে তাকিয়ে দেখছে, কেউ বা ভ্রূক্ষেপও করছে না। আবার কেউ গাড়িকে অগ্রাহ্য করে রাস্তার একপাশের জঙ্গল থেকে ছোট্ট ছোট্ট লাফ দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে অন্য পাশের জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে। হরিণশিশুগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে মায়ের ল্যাজ ও চারপায়ের আশেপাশে। একটু পিছিয়ে পড়লেই ছোট্ট ছোট্ট লাফে আবার চলে আসছে মায়ের কাছে। মায়ের শরীরের আড়াল থেকে অবাক দুটি কালো চোখ মেলে দেখছে জগতের সবকিছু। চিতল বা স্পটেড ডিয়ার ও সম্বর ডিয়ার ছাড়াও এখানে রয়েছে হগ ডিয়ার ও বার্কিং ডিয়ার। আশেপাশের সব গাছ ও ঝোপে নানারকম পাখি – তাদের উপস্থিতি যত না চোখে দেখা যায়, তার তুলনায় কানে শোনা যায় অনেক বেশি।
এখানের একটা বিশেষ নিয়ম হল রেস্টহাউসের বাইরে বনদপ্তর অনুমোদিত দু-একটি বিশেষ স্থান ছাড়া অতিথিরা তো বটেই, এমনকি গাড়ির চালকদেরও জঙ্গলের মাটিতে নামার অনুমতি নেই। তার মধ্যে একটি হল 'হাইব্যাঙ্ক', যেখানে রামগঙ্গা নদীটা অনেক নিচে। এখান থেকে রামগঙ্গা নদীর গতিপথ অনেক দূর পর্যন্ত বাধাহীনভাবে দেখতে পাওয়া যায়। পাহাড়ি নদীর জল কোথাও খুব বেশি, কোথাও খুব কম। নদীতে অনেক কুমিরের বাস। হাইব্যাঙ্ক থেকে নদীর চড়ায় কুমির, হরিণ, বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখা যায়। আবার ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে এখান থেকে হাতির দল বা বাঘের দেখাও পাওয়া যায় অনেক সময়। তবে আমরা এখান থেকে কুমির এবং নানান পাখি দেখতে পেলাম। আর বলা বাহুল্য, বাঁদরের উপস্থিতি তো সর্বত্রই।
সাধারণতঃ জঙ্গল মানেই বুঝি শুধুই সবুজের সমারোহ; সবুজ রঙের বিভিন্ন রকমফের। তবে রুক্ষ শীত ঋতুতেও করবেট কিন্তু রঙিন। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, খয়েরি, সাদা, কালো – এ সব রঙেরই বিভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। বনপথে যেটুকু অংশের ওপর দিয়ে গাড়ির চাকা যায়, তার রং শুধু মেটে। বাকি পথ ঢেকে আছে ঝরে পড়া শুকনো শাল ও অন্যান্য গাছের পাতায়। সেই পাতার রং কোনোটা লাল, কোনোটা হলুদ, আবার কোনোটা বাদামি। সবুজ রঙেরই কত রকমফের – গাছ ও ঝোপঝাড় কোনোটা সবুজ, কখনও গাঢ় সবুজ কখনোবা হালকা, আবার কখনও বা ফিকে সবুজ। নদী ও আকাশ নীল, নদীর নুড়ি পাথর সাদা বা খয়েরি, কালো শাল গাছের গুঁড়ি, হলুদ-নীল-বেগুনি ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের ফোটা ফুল – সব মিলিয়ে একেবারে ‘রঙে রঙে রঙিল’ জঙ্গল। এ জঙ্গলের আরও এক বিশেষত্ব প্রধানরাস্তার দুধারে বিভিন্ন মাপ ও আকারের 'উইঢিপি'।
ধনগড়হি গেট থেকে জঙ্গলের ভিতরের ধিকালা রেস্টহাউসের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। ধিকালা এলাকার প্রধান আকর্ষণ বিরাট জলাশয় (রামগঙ্গা রিজার্ভার), গ্রাসল্যান্ড ও সম্বর রোড। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে এই গ্রাসল্যান্ডের ঘাস কেটে নেওয়া হয় বা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে জলাশয়ের ধারের এই বিস্তীর্ণ এলাকাটা বাধাহীনভাবে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। এই গ্রাসল্যান্ডটিকে জংলি জীবজন্তুর 'জীবন্ত রঙ্গমঞ্চ' বলা যেতে পারে। হাতির দল, হরিণের পাল, বুনো শুয়োর এমনকি হলুদ-কালো ডোরাকাটাদেরও খুব পছন্দের জায়গা হল এই গ্রাসল্যান্ড। জলের ধারে হাতির দল খেলা করে, হাতির ছোট বাচ্চা চলে তার মায়ের চারপায়ের ঠিক মাঝখানে। ওটাই ওদের সবচেয়ে পছন্দের ও নিরাপদ স্থানও বটে। হরিণের দল এদিক ওদিক ঘাস খায়, কেউবা বিশ্রাম নেয়। বুনো শুয়োর মাটি শুঁকতে শুঁকতে ঘুরে বেড়ায়; আবার কখনোবা নিজেদের মধ্যে শুম্ভ-নিশুম্ভের মতো যুদ্ধও শুরু করে দেয়।
যদিও খুবই বিরল ঘটনা, তবে কেউ কেউ এই গ্রাসল্যান্ডে বাঘকে হরিণ শিকার করতেও দেখেছে। ধিকালার রেস্টহাউসের আশেপাশে অনেক শিয়ালের বাস। গ্রাসল্যান্ডে পৌঁছে দেখলাম ছোট একটি হাতির পাল, সেখানে বাচ্চা হাতিও রয়েছে। কিছু হাতি জলে নেমে খেলা করছে, আর কিছু গ্রাসল্যান্ডে ঘাস খাচ্ছে। আর তাদের সামনে, মানে কিছুটা আমাদের দিকে হরিণের পাল ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে। অপূর্ব দৃশ্য। এখানে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল। এবার চলে গেলাম ধিকালা রেস্টহাউসে।
জঙ্গলের ভিতরের রেস্টহাউসে রাত্রিযাপন করলে তবেই এই জঙ্গলকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করা যায়। রেস্টহাউসের চারপাশের পুরো এলাকাটি বৈদ্যুতিক তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকে, যাতে বন্যজন্তু এই এলাকায় ঢুকতে না পারে। জঙ্গলে অতিথিদের কাছে সর্বক্ষণের জন্য গাড়ি থাকলেও জঙ্গলে ভ্রমণের জন্য বনদপ্তরের তরফ থেকে সকালে এবং বিকালে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা আছে। এই নির্ধারিত সময় ছাড়া বাকি সময়টুকু বনবিভাগের রেস্টহাউস চত্বরে থাকা বাধ্যতামূলক।
শীতকালে সকাল সাতটা নাগাদ করবেটের আকাশ তখনও পরিষ্কার হয় না, জঙ্গলে প্রবেশের জন্য গেট খুলে যায়। রেডি হয়ে গেটের সামনে চলে এলাম। রেস্টহাউসের ভিতর গেটের সামনে গাড়িগুলোতে চালকরা ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। গেট খুলতেই একে একে সমস্ত গাড়ি ব্যস্তভাবে বেরিয়ে পড়ল জঙ্গলের বিভিন্ন পথে। সবার উদ্দেশ্য একটাই – 'বাঘদর্শন'। বাঘ দেখার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি খুব ভোরে বা সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে। জঙ্গলের যেসব স্থানে বাঘ দেখতে পাওয়া যেতে পারে, গাড়িগুলো সেসব দিকেই প্রথমে রওয়ানা দেয়। বাঘের গতিবিধি নির্ণয় করা যায় দুভাবে। প্রথমত বাঘের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে আর দ্বিতীয়ত জংলি জীবজন্তুর 'অ্যালার্ম কল' বা 'সতর্ক ধ্বনি' অনুসরণ করে। সাধারণত বন্য জীবজন্তুরা দিনের তুলনায় রাতে চলাচল করে অনেক বেশি; বাঘও তাই। বাঘের পায়ের থাবার তলার দিক নরম হয়। তাই বাঘ জঙ্গলের ভিতর মেঠোগাড়ির পথে বা হাতির চলার পথ ধরে হাঁটা পছন্দ করে। গাড়ির চালকরা তাই ভোরবেলা জঙ্গলে বেরিয়েই আগে মেঠো রাস্তায় বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজে বেড়ায়। যদি তা পেয়ে যায় তাহলে সেই চিহ্নকে নষ্ট না করে, তাকে অনুসরণ করে চলতে থাকে। শীতের সকালের আলো তখনও ফোটেনি। ঘন কুয়াশার আস্তরণে চারিদিক এতোটাই ঝাপসা যে, পাশের ঝোপঝাড়গুলিও স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না – এমনই এক প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে সংকীর্ণ পথে আমাদের গাড়ি চলেছে ধীরগতিতে।
বাঘ মাংসাশী প্রাণী; তাই তৃণভোজীরা যেমন বিভিন্ন হরিণ, বাঁদর, এমনকি ময়ূরও বাঘকে এড়িয়ে চলে। এদের কারোর ঘ্রাণশক্তি বা কারোর দৃষ্টিশক্তি প্রবল হয়। কেউ যদি আশেপাশে বাঘের উপস্থিতি অনুভব করতে পারে, তবে এদের গলা থেকে একপ্রকার বিশেষ শব্দ আপনাআপনিই বেরিয়ে পড়ে। সেই আওয়াজ আশেপাশের বাকি জন্তুদের সবাইকে সতর্ক করে দেয়। একেই বলে অ্যালার্ম কল বা সতর্কধ্বনি। এই কল শুনে গাড়ির চালকরাও বাঘের গতিবিধি অনুসরণ করার চেষ্টা করে। চালকরা কল হওয়ার কাছাকাছি স্থানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, ইঞ্জিন বন্ধ করে নিঃশব্দে বাঘের জন্য অপেক্ষা করে। ভোরেরও আগে আবছা আলোয় এই অপেক্ষার সময়টুকুও টান টান উত্তেজনা, অজানা আশঙ্কা, আবেশ ও রোমাঞ্চে ভরপুর। এই বুঝি চোখের সামনে ঘটে যাবে কোনো এক উত্তেজনাপূর্ণ রোমহর্ষক ঘটনা। যে কোনো মুহূর্তে বাঘ বা হাতি বা অন্য যেকোনো বন্য জন্তু চোখের সামনে স্বমহিমায় উপস্থিত হতে পারে; অনেক সময় হয়ও।
কনকনে শীতের ভোরে জঙ্গলের এই নিঃশব্দ পরিবেশে অনেক অতি মৃদু শব্দও কানে ধরা পড়ে। পাখিরা তখনও বের হয়নি। বার্তালাপও বন্ধ, চারিদিক থেকে ভেসে আসছে হিম পড়ার শব্দ। নিঃশব্দ জঙ্গলে বড় শালপাতার ওপর সামান্য এই হিমের বিন্দু পড়ার শব্দকেও অত্যন্ত ভারী বলে বোধ হচ্ছে। পাশের ঝোপের শুকনো পাতার খসখসানি, এমনকি একে অপরের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও ভালোভাবে অনুভব করতে পারছি। জঙ্গলের শীতল পরিবেশে চারিদিকে যখন হিমের বিন্দুগুলো মাটির ওপর ঝরে পড়ছে, তখন তা বৃষ্টি পড়ার মত অনুভূত হচ্ছে, এমনকি চাক্ষুষ দেখাও সম্ভব হচ্ছে।
ধিকালার আরো একটি বিশেষ আকর্ষণ 'সম্বর রোড'। এটি ওয়ান ওয়ে। মাটির অত্যন্ত সংকীর্ণ পথ। একটি গাড়িই ভালোভাবে চলতে পারে। গাড়ি ধীরগতিতে এই পথে চলার সময়ও খুব সচেতনভাবে বসতে হয়। রাস্তার দুধারের ঝোপের ডালপালা গায়ের ওপর এসে পড়ে কখনও কখনও। কোনও গাড়ি যদি পিছন থেকে এসে আগে যেতে চায়, তবে জঙ্গলের ঝোপের একদিকে একটা গাড়িকে চেপে দাঁড়িয়ে তবেই অন্য গাড়িকে যাওয়ার পথ করে দিতে হয়। ভোরের আবছা আলো-আঁধারি পরিবেশে ঘন কুয়াশায় ঢাকা 'সম্বর রোড' যেন আরো রহস্যময় হয়ে ওঠে।
এরই মধ্য দিয়ে নিঃস্তব্ধ জঙ্গলের পথ ধরে আমাদের গাড়ি চলছে ধীর গতিতে। সামনে-পিছনে আর কোনও গাড়ি ছিল না। হঠাৎই পথের ধারের ঝোপ থেকে শোনা গেল তীব্র গর্জন। একবার নয় - দুবার তিনবার। অনুভব করলাম আমাদের গাড়িটা চলতে চলতেই কেঁপে উঠলো। নিত্য যাতায়াতকারী চালকের হাতও স্টিয়ারিং-ধরা অবস্থাতেই এক মুহূর্তের জন্য হলেও নড়ে গেল। আর আমাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ যেন লাফিয়ে গলা পর্যন্ত উঠেই নেমে গেল। দুই হাতের তালু ওই প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যেও ভিজে উঠল। চোখ একটু ধাতস্থ হলে দেখলাম, রাস্তা থেকে ৭-১০ মিটার দূরে ঝোপের আড়ালে হলুদ-কালো ডোরা, এক জোড়া; নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। বাকরুদ্ধ হয়ে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে দেখতে লাগলাম দুটিকে। হয়ত দেখেছিলাম এক-দু মিনিট। কিন্তু সেই স্বল্প সময়কেই ওই পরিবেশে বহু প্রলম্বিত বলে অনুভূত হয়েছিল। বাঘ-বাঘিনী আলাপে ব্যস্ত ছিল। এমতাবস্থায় হঠাৎ আমাদের উপস্থিতি তাদের পছন্দ হয়নি। তাই একটু বাদেই হয়তোবা বিরক্ত হয়ে নিজেরাই চলে যায়। এ যেন এক রোমহর্ষক অনুভূতি।
আর একটু আকাশ পরিষ্কার হলে টকটকে লাল সূর্য গাছের ওপর দিয়ে আকাশে উঁকি দিল। ধীরে ধীরে সকালের মিঠে সোনালি রোদ জঙ্গলের গাছ-গাছালির মাথার ওপর ছড়িয়ে পড়ল। তখন যেন জঙ্গলের নাটমঞ্চের দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গেল। এইসময় সবথেকে বেশি বের হয় পাখিরা। ভোরের মিঠে নরম রোদ গায়ে মেখে, কলতান তুলে, লেজ উঁচিয়ে নেচে বেড়ায় গাছের মাথায় মাথায়। সে এক অপূর্ব ঐকতান। এইভাবেই ধীরে ধীরে দৃশ্যপটের পরিবর্তন হতে হতে একসময় রেস্টহাউসে ফেরার নির্ধারিত সময় চলে এল। দুপুরের সময়টুকু জঙ্গলের প্রাণীদের বিশ্রাম নেওয়ার সময়।
জঙ্গলের প্রতিটি রেস্টহাউসে বাঁদরের উৎপাত প্রবল। হাতে প্লাস্টিক ব্যাগ দেখলেই তারা জঙ্গিহামলা চালায়। ছাদের ওপরের জলের ট্যাঙ্ক যদি ভালো করে ঢাকা না থাকে, তাহলে তেনারা ঢাকা খুলে তার মধ্যে ডুব দিয়ে স্নানও সারেন। সুযোগ পেলেই ক্যান্টিনের রান্নাঘর থেকেও লুঠপাট চালান। রান্নাঘরের জালের জানলার বাইরে বসে লোভাতুর দৃষ্টিতে খাদ্যসামগ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
ধিকালার রেস্টহাউসের অবস্থান রামগঙ্গা রিজার্ভারের ঠিক ধারে। রিজার্ভারের চড়াতেও বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের দেখা মেলে। এই জায়গাটাকেও আর একটা রঙ্গমঞ্চ বলা যায়। এই দৃশ্যপটের বিস্তার এতটাই বেশি যে জীবজন্তুর কার্যকলাপ নজরে আনার জন্য সময় বিশেষে দূরবীনেরও প্রয়োজন হয়। এখানেও চড়ায় হরিণের পাল বিশ্রাম নিচ্ছে; কোথাও জলে মেছো কুমির সাঁতার কাটছে, আবার কোথাওবা চড়ায় পাথরের মতো পড়ে আছে। ময়ূর-ময়ূরী ঘুরে বেড়াচ্ছে, একজন পেখম মেলে ধরেছে। এখান থেকেও হাতির দলকে জলের ধারে বা জলে খেলা করতে দেখা যায়। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে এখানেও ব্যাঘ্রদর্শন ঘটতে পারে। এছাড়া জলের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পাখি; যেমন – হেরণ, ঈগল, স্টর্ক, আইবিস্, করমোর্যান্ট, শিকারের আশায় বসে থাকা মাছরাঙা ইত্যাদি। চড়ায় শকুনও দেখা যায়। এখন সবাই নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত। কেউ উড়ন্ত, কেউ শিকাররত, কেউ বিশ্রামরত আবার কেউবা জলের ধারে ধ্যানমগ্ন। আশেপাশের গাছে নজর ঘোরাতে ঘোরাতে দেখলাম, কোটরের ভিতর গুটিসুটি মেরে বসে থাকা পেঁচা-পেঁচি। দুপুরের নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করল কাঠঠোকরা আর উড়ন্ত টিয়ার ঝাঁক।
পরেরদিন সকালে গাড়ির চালক আমাদের নিয়ে গেল 'লকড়ি পুল' বলে একটি জায়গায়। এখানে রামগঙ্গা নদীর জল খুব গভীর নয়, তবে চড়া বিস্তীর্ণ। জল বইছে চড়ার একধার দিয়ে। জলের ওপর কাঠের একটি ভাসমান পুল ফেলা আছে, যা দিয়ে গাড়ি পারাপার করতে পারে। আমাদের গাড়ি সেই পুলের ওপর দিয়ে জল পেরিয়ে গিয়ে ওপারে নদীর নুড়ি পাথরের চড়ার ওপর দাঁড়াল। চারপাশের দৃশ্য অতি মনোরম। নুড়ি-পাথর বিছানো বিস্তীর্ণ এলাকা; এক পাশ দিয়ে বইছে নদী। আর একধারে জঙ্গল পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। নদী-আকাশ-বনানী সব যেন এখানে মিলেমিশে একাকার। আমাদের গাড়ি ছাড়া আর একটাই মাত্র গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে চড়ায়। অতি শান্ত পরিবেশ; মাঝে মাঝে পাখির ডাক ও নিরবচ্ছিন্ন নদীর কলধ্বনি। জায়গাটা আমাদের খুব ভালো লাগল। গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পাখিদের মাছ শিকার দেখছিলাম। কত সময় কেটেছিল জানি না, হঠাৎ গাড়ির সাইড মিরারে একটা প্রতিচ্ছবি দেখে চালক আমাদের সচেতন করে দিল। আমরা নিঃশব্দে পিছন ঘুরে দেখলাম, বেশ খানিকটা দূরে, পাশের পাহাড়ি জঙ্গল থেকে নিঃশব্দে একটা বাঘ কখন বেরিয়ে নদী পার হচ্ছে। সে এতটাই নিঃশব্দে এসেছিল যে কেউ টের পাইনি। খোলা নদীবক্ষের অর্ধেক পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর তার আগমন টের পাই। অবাক বিস্ফারিত চোখে শুধু তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আস্তে আস্তে তার পুরো শরীরটা নদীর চড়া পেরিয়ে ঘাসবনের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তারপর সম্বিত ফিরে পেলাম। আর কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম রেস্টহাউসে।
শীতকালের বিকেলে জঙ্গলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আবার একেবারে অন্যরকম। বেলা আড়াইটে নাগাদ প্রবেশের জন্য গেট খোলে। সকালে যেমন সবাই জঙ্গলের গেট খোলার অপেক্ষায় ব্যগ্র থাকে, বিকেলে ততটা থাকে না। কারণ বাঘ দর্শনের সম্ভাবনা সবথেকে বেশি সন্ধ্যার দিকে। তাই গাড়িগুলো জঙ্গলে ঢুকে ধীরগতিতে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের গাড়িও মন্থর গতিতে চলতে থাকল। অনেক সময় শ্রান্ত পশুরা দুপুরে জলাশয়ে জলপান করতে আসে আর তার পাড়েই বিশ্রাম করে। তাই গাড়ি আগে জলাশয়ের ধারে অনুসন্ধান করল। বেশ কিছুসময় অপেক্ষা করে গাড়ি আবার জঙ্গলের পথে ঘুরতে শুরু করল। অ্যালার্ম কল যেখানে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই অপেক্ষা করছি ; যদি কোনও কিছু দেখা যায় তার আশায়।
দুপুরের এই অপেক্ষারত সময়টার স্বাদ একেবারে ভিন্ন। নিঃস্তব্ধ দুপুরের মৌনতা ভঙ্গ করে মাঝে মাঝে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে টিয়ার ঝাঁক বা হর্নবিলের দল। দূর থেকে ভেসে আসছে কাঠঠোকরার ঠক্-ঠকানি। তা যেন জঙ্গলের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। থেকে থেকে পাশের ঝোপ থেকে ডেকে উঠছে দু-একটি বনমোরগ বা ময়ূর। এরসঙ্গে একঘেয়ে ঘুঘুর ডাক মিলে গিয়ে দুপুরের পরিবেশকে আরো যেন বিষন্ন করে তুলছে। কিন্তু এর মাঝেই যখন আবার অ্যালার্ম কল শোনা যাচ্ছে, তখনই ইন্দ্রিয়গুলো আবার সজাগ ও শরীর টান টান হয়ে উঠছে। কল শুনলেই বাঁদরগুলো আগে লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে উঠে পড়ছে। অনেক সময় অপেক্ষা করেও আশানুরূপ জন্তুর দর্শন মেলে না। আবার নতুন করে অনুসন্ধান করার পালা শুরু হয়। এভাবেই সফলতা বা বিফলতার মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ চলে। তবে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে, জঙ্গলের মেঠো পথে লম্বা লেজবিশিষ্ট, হলুদ-কালো ডোরাকাটা, জ্বলজ্বলে চোখের প্রাণীটির দর্শন সবচেয়ে রোমাঞ্চকর; এক অভাবনীয় অত্যাশ্চর্য অনুভূতি। এই বিশেষ প্রাণীটির যেন এক আলাদা আকর্ষণ আছে। একবার দেখা দিলে সে যেন এক আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তি দিয়ে সবার দৃষ্টিকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে রাখে। এ নেশা যেন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। এমনকি সে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলেও আরো দেখার আকুলতাটা রয়েই যায়। ধীরে ধীরে দিনের আলো নিভে আসে ও রেস্টহাউসে ফেরার নির্ধারিত সময় আসন্ন হয়।
রাতের করবেট আরোও রহস্যময়ী। দূষণমুক্ত পরিবেশ বলে কালো আকাশের বুকে সুস্পষ্ট তারামণ্ডলী হীরের মতো ঝকঝক করে জ্বলে। রাতের আকাশের এত নক্ষত্রমন্ডল খালি চোখে যে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যেতে পারে, তা শহরবাসীদের কল্পনার অতীত। অন্ধকারে জলের ধারে টুনিবালবের মতো অসংখ্য আলোকবিন্দু নড়তে দেখা যায়। এই আলোকবিন্দুগুলো আর কিছুই নয়, রাতে জলপান করতে আসা বুনো শুয়োর, হরিণের পালের মত নানান জীবজন্তুর চোখ। এই দৃশ্যপটের সঙ্গে মিশে যায় দূর থেকে ভেসে আসা ময়ূর, হাতি, বাঘ ইত্যাদি জীবজন্তুর ডাক ও পেঁচার ডানা ঝাপটানি। আর তাতে সঙ্গত দেয় ঝিঁঝিঁপোকার কনসার্ট ও রামগঙ্গা নদীর নিরবচ্ছিন্ন কলকল ধ্বনি।
প্রকৃতির মধ্যে বাস করলে তবেই অনুভব করা যায় যে, সংগীত জগতের সপ্তসুরের উৎপত্তি কোথা থেকে; বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনির আদি উৎপত্তিই বা কোথায়। নৈঃশব্দের গর্ভেও যে শব্দ নিহিত আছে, তা অনুধাবন করা যায় এই উন্মুক্ত বন্য পরিবেশেই। পাহাড়, নদী, ঝরনা, পশুপাখি, গাছ-গাছালি ও তার রঙের বিভিন্নতা – সব মিলিয়ে করবেট যেন মোহময়ী। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ-বনানী – সব যেন মিলেমিশে একাকার। একবার এই মোহজালে আবিষ্ট হলে, তার থেকে নিজেকে মুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই 'আরণ্যক' পরিবেশ যেন বার বার হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে।
~ ভিয়েনার আরও ছবি ~
পাপড়ি সাহার নেশা রান্না, নাচ, বইপড়া, ভ্রমণ। নানান শহরে বসবাস ও বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সুবাদে যে অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি লাভ তাই-ই গল্প ও ভ্রমণকাহি্নির মাধ্যমে ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেন।