কুরিঞ্জি ফুলের দেশে

প্রজ্ঞা পারমিতা


নাগরিক শীত দুয়ারে নয় আর, অন্দরে হানা দিয়েছে। হেমন্ত রাতের বিছানায় পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাদর গায়ে উঠে এসে যে উষ্ণতা দিয়েছিল তা আর যথেষ্ট নয়। সুতরাং বালাপোশ, লেপ, কম্বল ইত্যাদি শীতার্তকে ওম দেওয়ার যত আয়োজন এক বছরের শীতঘুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে একে একে। এই সময় আরও গভীর শীতের মায়ায় জড়াতে ইচ্ছে করে। অবশ্যই বেয়াড়া ইচ্ছে! কিন্তু শীতকালে সমতলের চেনা শীত ছেড়ে অচেনা শীতের স্বাদ নিতে সাধ হয়। আর ঠিক তখনই তেমন সব স্থান যেন ডাক পাঠায় আমায়। একবার যেমন ডেকেছিল দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি শহর কোদাইকানাল। এবছর তেমন কোন আমন্ত্রণ গ্রহণ করার উপায় নেই যখন আসুন স্মৃতির সফরে আপনাদের শরিক করে নিয়ে আমার কোদাইকানাল বেড়ানোর গল্প শোনাই।
কোদাইকানাল তামিলনাড়ুর পালানি পাহাড়ের এক অসাধারণ শৈলশহর। যদিও আধুনিক কোদাইকানালের জন্ম হয় ব্রিটিশ ও আমেরিকান মিশনারিদের হাতে, কিন্তু এই স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রায় হাজার দুয়েক বছরের প্রাচীন তামিল সাহিত্য 'সঙ্গম কাব্যে'। দেবতা মুরুগানের সঙ্গে জড়িত বিশেষ কিংবদন্তির জন্য বিখ্যাত এই পার্বত্য এলাকা। এখানে বারো বছর অন্তর ফোটে এক বিরল পুষ্প 'নীলকুরিঞ্জি' বা সংক্ষেপে 'কুরিঞ্জি'। সেই ফুলে মুরুগান পূজিত হন। এখানে তিনি কুরিঞ্জি আন্দাভর স্বামী নামে পরিচিত। স্ট্রবিল্যান্থেস কুন্থিয়ানা প্রজাতির ফুল কুরিঞ্জি বস্তুত পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বৈশিষ্ট্য। নীলগিরি পাহাড়ের নামটাও কুরিঞ্জির দান। মুন্নার উটি কুন্নুর এই সব এলাকাই কুরিঞ্জির ছোঁয়া পায় যেখানে এই দীর্ঘসূত্রী পুষ্প পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ছয়, আট বা দশ বছর অন্তরও ফুল ফোটায়। কিন্তু পালানি পাহাড় অঞ্চলে কুরিঞ্জি বারো বছর অন্তরই ফোটে এবং অত্যাশ্চর্য একটি তথ্য হল পালানির আদিম অধিবাসী পালিয়ানরা ফুল ফোটা দিয়ে তাদের বয়স নির্ধারণ করেন। দুই কুরিঞ্জি দেখেছে অর্থাৎ তারা পূর্ণ যুবক বা যুবতী। এমন ফুল জড়িয়ে বেঁচে থাকার হিসেব বড় রোম্যান্টিক ঠেকেছিল আমার। এমনিতেই কোদাইকানালের কুরিঞ্জি সংযোগ একই সঙ্গে বিশেষ ভাবে রোম্যান্টিক এবং ধ্রুপদীও বটে। নীলাভ বেগনি রঙের কুরিঞ্জি ফুল যেন কিশোরীর প্রেম, কারণ তাতে মিশে রয়েছে মুরুগানের প্রতি অরণ্য-পর্বত কন্যা ভল্লির প্রেমের হাজার বছরের কিংবদন্তী। মুরুগান ভল্লিকে বিবাহ করেন কুরিঞ্জি ফুলের মালা পরিয়ে। যখন পালানি পাহাড়ের উপত্যকা অধিত্যকা ছেয়ে যায় সেই ফুলে তখন প্রকৃতি মোহময়ী হয়ে ওঠে। পুঞ্জ পুঞ্জ কুরিঞ্জি ফুলের টানে ছুটে আসা রাশি রাশি ভ্রমরের গুঞ্জরনের কথা 'সঙ্গম সাহিত্যে' বর্ণিত। এছাড়া অজস্র হ্রদ অসংখ্য ঝরনা বন পাহাড় মিলিয়ে কোদাইকানাল এক নিরন্তর প্রকৃতি উদযাপন। কোদাইকানাল শব্দের অর্থই 'অরণ্যের দান'।
ভ্রমণবৃত্তান্তে আসি। এক মেঘলা বিকেলে ঘাট রোড ধরে কোদাইকানাল শহরের দুয়ারে পৌঁছতেই এখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য সিলভার ক্যাসকেড ঝরনা স্বাগত জানাল। বেড়ানোর শুরুতেই এমন প্রাকৃতিক সম্ভাষণে আপ্লুত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে এযাত্রার প্রকৃতি পাঠ শুরু করে দিলাম। কালো পাথরের গা বেয়ে অনেক ওপর থেকে নেমে আশা রূপোলি জলধারা ধাপে ধাপে তার নামটির যাথার্থ্য প্রমাণ করে বয়ে চলেছে। পাশেই স্টল থেকে মশলা চা কিনে খেতে খেতে বিকেলটা আরও মনোরম করে তোলা গেল। শুধু একটি ব্যাপার চোখের বালি মনে হচ্ছিল। ঝরনার চারপাশে পলিপ্যাক ও প্লাস্টিকের বোতলের ছড়াছড়ি! আমরা কি কোনদিন শিখব না পরিবেশকে অনাবিল রাখতে!

পরের দিন থেকে শুরু হল আসল ঘোরাঘুরি। প্রাতরাশ সেরে সারাদিনের মতো বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। প্রথমে কোদাই লেকের চারপাশ বেড় দেওয়া লেক রোডে এক পাক ঘুরে নিলাম। কোদাই লেক কিন্তু সেই অর্থে যাকে বলে ম্যানমেড লেক। ১৮৬৩ সালে মাদুরাই-এর ডিসট্রিক্ট কালেক্টার স্যার লেভিঞ্জ ছোট জলধারাগুলিকে এই পাহাড়ি উপত্যকায় ধরে রাখার ব্যবস্থা করে এই লেকের সৃষ্টি করেন। তারকাকৃতির কোদাই লেক এ শহরের মধ্যমণি। এই লেকের চারপাশেই ধীরে ধীরে কোদাইকানাল শহর বেড়ে উঠেছে। প্রায় দেড়শ বছর আগে এই লেকে প্রথম যে বোটটি ভেসেছিল সেটি আনানো হয়েছিল তুতিকোরিন থেকে। এখন এখানের অন্যতম আকর্ষণ বোটিং। আমরাও লেকের জলে নৌকা ভাসালাম। বেশ মেঘ ছিল তখন। হঠাৎ করে তা কেটে গিয়ে শহর দৃশ্যমান হয়ে উঠল। চোখে পড়ল শতাধিক বৎসরের প্রাচীন কোদাইকানাল বোট ক্লাব, অভিজাত হোটেল কার্লটন ইত্যাদি। মেঘেরা আস্তে আস্তে আবার নেমে এসে প্রায় জল ছুঁইছুঁই যখন আমরা লেক থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পরবর্তী গন্তব্য কোয়েকার'স ওয়াক-এর দিকে রওনা দিলাম।
কোয়েকার সাহেব এখানে এসেছিলেন কোদাই এলাকার মানচিত্র তৈরি করতে। সে কাজ করতে গিয়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব খোলা অসাধারণ একটি ভিউ পয়েন্ট আবিষ্কার করেন যেখান থেকে উপত্যকার দৃশ্য অসামান্য সুন্দর। ১৮৭২ সালে তিনি ওই জায়গাটিকে বাঁধিয়ে একটি ১ কিমি লম্বা পায়েচলা পথের রূপ দিলে এটি তাঁর নামাঙ্কিত হয়ে কোয়েকার'স ওয়াক নামে পরিচিতি পায়। প্রবেশমূল্য দিয়ে ওখানে ঢুকতেই সামনে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ি নিসর্গ কিছুক্ষণের জন্য যেন বাক্যহারা করে দিল। দেখলাম নীলচে-বেগনি উপত্যকা, ঢেউখেলানো পাহাড়, গায়ে গায়ে ছোট ছোট গ্রাম, আঁকাবাঁকা পথরেখা, ইউক্যালিপটাস, বার্চ, পাইন বনানী আর তাদের ওপর ছায়া ফেলছে নিরন্তর মেঘেদের জমায়েত। ওই দৃশ্য ভালো করে উপভোগ করতে একটি টেলিস্কোপের ব্যবস্থাও আছে যা আমরা ব্যবহারের সুযোগ ছাড়লাম না। ওয়াকের একদিকে বসার জায়গায় কিছুক্ষণ বসতে মনে হচ্ছিল অ্যাম্ফিথিয়েটারে বসে আছি আর সামনে প্রকৃতির প্যানোরামিক ভিউ-এর সবকিছুই আমার জন্য। নীল এবং বেগুনি রঙের মায়াঅঞ্জন যেন চোখে আঁকা হয়ে গেল, মন ভরে উঠল।

এই ভালোলাগা নিয়ে পর পর কোদাইকানালের আরও কয়েকটা দ্রষ্টব্য যেমন পিলার রকস, গ্রিন ভ্যালি ভিউ, সোলার অবজারভেটরি ইত্যাদি দেখে নিলাম। পিলার রকস একটি ভূতাত্ত্বিক বিস্ময় যেখানে ৪০০ ফুট লম্বা তিনটি সলিড গ্রানাইট বোল্ডার যুগ যুগ ধরে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের মধ্যে দিয়ে যেটুকু দেখলাম কেন জানিনা আমার মনে হোল ছোটবেলায় পড়া অরণ্যদেব কমিক্সের হিজ ও হার্জ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, একটু বিশালাকৃতির এই যা। গা ঘেঁসে দাঁড়ানো এই তিনটি পিলারের বেস একটি ভয়ঙ্কর গুহা তৈরি করেছে যাকে ডেভিল'স কিচেন বলে। এখানে কমল হাসনের একটি বিখ্যাত সিনেমা 'গুনা'র শুটিং হওয়ার পর থেকে একে গুনা কেভ বলা হয়। এই কেভ সাধারণ টুরিস্টদের অগম্য, রোমাঞ্চ সন্ধানীরা প্রস্তুতি ও অনুমতি নিয়ে সেখানে অভিযান করতে পারেন। আমরা গুহাগর্ভে নেমে যাওয়ার পথটি দেখেই ক্ষান্ত হলাম।

গ্রিন ভ্যালি ভিউ হল উপত্যকার দৃশ্য দর্শনের আরেকটি সুন্দর জায়গা। পাহাড়ের গা থেকে প্রায় ৫০০০ ফুট খাদ নেমে গেছে অতলে। জায়গাটায় গিজগিজ করছে ভিড় দেখে আমরা পত্রপাঠ বেরিয়ে এসে অবজারভেটরিমুখো হলাম। কোদাইকানালের সোলার অবজারভেটরি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন মানমন্দির। সেই ১৮৯৫ সাল থেকে এখানে অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্স নিয়ে কাজ হয়ে আসছে। এটির অবস্থিতি শহর কোদাইকানালের সর্বোচ্চ বিন্দুতে। তাই অবজারভেটরি থেকে শহরের কেন্দ্রে ফিরে আসার সময় আপার লেক রোড থেকে দেখলাম দূরে কোদাই লেক দৃশ্যমান আর তাকে ঘিরে বিছিয়ে আছে কোদাইকানাল শহর। আমরা সেদিনের মত ঘোরা শেষ করে পরের দিনের জল্পনা করতে করতে হোটেলে ফিরলাম।
পরদিন বেরিয়ে পড়লাম বিয়ার শোলা ফলস, পাইন বন, বেরিজাম লেক, দুটো পার্ক, মন্দির ইত্যাদির টার্গেট নিয়ে। সব যে দেখতেই হবে এমন কোনও মানে নেই, যতক্ষণ মন চায় প্রাণ চায় দেখা যাবে। তবে বিয়ার শোলা ফলস একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। শুনলাম ভালুক জল খেতে আসত এখানে তাই এই নাম। শোলা ফরেস্ট দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি অঞ্চলের এক বিশেষ ধরনের অরণ্য যা এই সব স্থানের বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই শোলা অরণ্য ও তৃণভূমি দ্রুত উধাও হয়ে যাচ্ছে! তবে এখানে গাড়ি থেকে নেমে ঝরনা অবধি পৌঁছনোর পথটি বড় সুন্দর। এখানেই প্রথম কুরিঞ্জি ফুল স্পর্শ করার সুযোগ হল। মনে হল তামিল সংস্কৃতি ছুঁয়ে দেখলাম।

কোদাইকানালের পাইন বন দেখলেই চেনা চেনা লাগবে। খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন এই বন আপনি অসংখ্য বার দেখেছেন বিখ্যাত বা অখ্যাত বহু সিনেমায়। আসলে কোদাইকানাল ও তার আশপাশ বিজ্ঞাপন বা সিনেমার শুটিং লোকেশন হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়। শুধু দক্ষিণি ছবি নয় হিন্দিও। যেমন "যো জিতা ওহি সিকন্দর" পুরোটাই এখানে তোলা কিন্তু দেখানো হয়েছে দেরাদুন বলে। তেমনি আবার কোদাইকানালের পাম্বার ফলস বিখ্যাত 'লিরিল' বিজ্ঞাপনের জন্য।

বেরিজাম লেক কোদাই শহর থেকে ২৩ কিমি দূরে সবুজ অরণ্যের মাঝে একটুকরো অনাবিল নীল নির্জনতা। এই হ্রদের বন্য সৌন্দর্য প্রথম দেখাতেই মন কেড়ে নেয়। পাইন কোন কুড়োলাম বেশ কিছু। এটি বনাঞ্চল দফতরের অধীনে বলে এখানে আসা অনুমতি সাপেক্ষ যা আমরা আগেই সংগ্রহ করেছিলাম। ফেরার পথে 'হ্যাটস অফ' পয়েন্ট বা 'ক্যাপ ফ্লাই' পয়েন্ট বলে একটি দারুণ ভিউ পয়েন্ট থেকে আবার নীল বেগুনি রঙের রায়ট দেখে মুগ্ধ হলাম। এখান থেকে নীচের দৃশ্য দেখতে গেলে মাথার টুপি পড়ে যাওয়া অবধারিত তাই এই মজার নাম। কোদাইকানালের প্রতিটি দ্রষ্টব্যের বর্ণনা এই পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। তাই পছন্দের কয়েকটির কথা উল্লেখ করে কাহিনিতে ইতি টানব। কোদাইকানাল গড়ে ওঠায় যেহেতু খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচুর অবদান তাই এখানে অসংখ্য চার্চ ও কনভেন্ট আছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি হল লা সালেথ চার্চ যেখানে ভার্জিন মেরী পূজিতা। ১৮৬৫ সালে স্থাপিত এই চার্চটি ফ্রান্সের লা সালেথ চার্চের ফরাসি দেশের বাইরে একমাত্র শাখা। ১৮৪৬ সালে ফ্রেঞ্চ আল্পসের লা সালেথ বলে ছোট্ট একটি গ্রামে মা মেরী দুটি শিশুকে দর্শন দিয়েছিলেন। ক্যাথলিক বিশ্ব তাদের কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যান। পরে ওই গ্রামে একটি মঠ তৈরি করে মা মেরীকে "আওয়ার লেডি অফ লা সালেথ" নামে উৎসর্গ করা হয়। পরবর্তী কালে স্থান মাহাত্ম্যের কারণে লা সালেথ ভুবন বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ফাদার ল্যুই নামে কোদাইকানালের একজন মিশনারি ট্রপিকাল ডিজিজে মরমর অবস্থায় "আওয়ার লেডি অফ লা সালেথ" কে মনপ্রাণ দিয়ে সুস্থতার প্রার্থনা করেন এবং অলৌকিক ভাবে মৃত্যু তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি সুস্থ হয়েই লা সালেথের অনুরূপ একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর সংকল্পের প্রতিচ্ছবি কোদাইকানাল লা সালেথ মঠ। মানুষের বিশ্বাসকে সম্মান জানিয়ে এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে খুব ভালো লেগেছিল আমাদের।
আসি কুরিঞ্জি আন্দাভর স্বামীর কথায় যাঁর দর্শন ছাড়া কোদাই ভ্রমণ অসম্পূর্ণ। দেবতা মুরুগানের তামিল সঙ্গম বর্ণিত ছটি অধিষ্ঠানের প্রথমটি এই পালানি পাহাড়ে। সঙ্গম সাহিত্যে দাক্ষিণাত্য অঞ্চল পাঁচ ভাগে বিভক্ত এবং এই প্রতিটি অঞ্চলের অধিপতি ভিন্ন। কুরিঞ্জি হল পার্বত্য অঞ্চল, মুল্লাই অরণ্য, নেইথাল সমুদ্র তীরভূমি, মারুথাম শস্য ক্ষেত্র এবং পালাই অনাবাদি অঞ্চল। মুরুগান হলেন পার্বত্য অঞ্চলের আন্দাভর অর্থাৎ অধীশ্বর। কুরিঞ্জি ফুল তাঁর পরম প্রিয়। এই মুরুগান হলেন আমাদের কার্তিকেয়; জানতে আগ্রহ হয় নিশ্চয়ই তিনি দক্ষিণ দেশে এমন অবশ্য-উপাস্য হয়ে উঠলেন কোন পথে। সংক্ষেপে জানাই সে গল্প। নারদ একবার মহাদেবকে নিবেদন করেন 'জ্ঞানফলম'। তখন দেবাদিদেবের ইচ্ছে হয় দুই পুত্রের পরীক্ষা নিয়ে বিজেতাকে সেই জ্ঞান ফল উপহার দেওয়ার। তিনি বলেন যে আগে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসবে তাকেই তিনি ফলটি দেবেন। এ কাহিনি আমাদের জানা যে কি ভাবে গণেশ মায়ের চারদিকে চক্কর কেটে আগে এসে জিতে যান। কিন্তু তামিল উপকথায় 'কাহানি মে টুইস্ট হ্যায়'। গণেশের নিপাতনে সিদ্ধ পথে জ্ঞানফল লাভ এবং পিতার সমর্থন পাওয়া দেখে বালক স্কন্দের অভিমান হয়। সেই সময় ব্রহ্মা মহাদেবের সঙ্গে আলাপ করতে আসেন। কার্তিকেয়র মনে কিছুদিন ধরেই একটি প্রশ্ন ঘুরছিল যে প্রণব মন্ত্রের অর্থ কী। তিনি তা ব্রহ্মার কাছে জানতে চাইলে ব্রহ্মা শিশু জ্ঞানে তাকে 'তুমি বুঝবে না' বলে উপেক্ষা করেন। যুগপৎ এই দুটি ঘটনায় আহত হয়ে কার্তিক কৈলাস ত্যাগ করে দক্ষিণ দেশে চলে আসেন এবং প্রথমে অবস্থান করেন এই পালানি পাহাড়ে। পরবর্তী অধ্যায়ে দেখা যায় তিনি জনজাতি কন্যা ভল্লির প্রেমে পড়েন। মুরুগান ও ভল্লির প্রেম দক্ষিণ ভারতীয় উপকথায় গাথায় কাব্যে বারবার উল্লেখিত। এখানে তারকাসুর বধের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তারকাসুরের ভাই অত্যাচারী রাজা সুরপদ্মকে সংহার করে স্থানীয় মানুষকে রক্ষা করার কাহিনি। অথবা মহাদেবকে ওমকারের অর্থ ব্যাখ্যা করার প্রসঙ্গ। মুরুগানের নানা কীর্তির সঙ্গে জড়িত যে ছটি স্থানের কথা সঙ্গম সাহিত্যে উল্লেখ আছে তাই আজ মুরুগান তীর্থ। পালানি তেমনই এক স্থান।
দক্ষিণী শৈলীর ছোট মন্দিরটি হয়তো কাহিনির টানেই বহু জমকালো মন্দিরের তুলনায় সেদিন অনেক বেশি মন কেড়েছিল আমার। আমাদের 'ক্যালানে কার্তিক' দেখা চোখে দক্ষিণের কার্তিক সম্ভ্রম জাগায়, সত্যি সে যুদ্ধ ও প্রেমের দেবতা। মন্দিরে মুরুগানের প্রিয় কুরিঞ্জি গাছে ফুল ধরেছে। সেটা ছিল ২০০৬ সাল, আবার ফুটেছে তিন বছর আগে ২০১৮-য়! এখন আবার প্রতীক্ষা।

প্রজ্ঞা পারমিতা ভ্রমণ কাহিনি, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লিখছেন বছর দশেক। মেডিক্যাল জার্নালিজম করেছেন 'বর্তমান' হাউসের স্বাস্থ্যপত্রিকায়। 'মাতৃশক্তি' ও 'জাগ্রত বিবেক' পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে কলম ব্যবহার করে থাকেন।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher