গ্রামের নাম মূলখরকা
অর্পিতা চক্রবর্তী
জীবনে যে কোনোদিন ট্রেকিং করতে পারব সেই ভাবনাটা হয়তো শুধু স্বপ্নই থেকে যেত যদিনা সুদীপ্তদা-র দৌলতে এই ছোট্ট গ্রামটি ঘুরতে না যেতাম।
গ্রামটির নাম মূলখরকা। কালিম্পং-এর শেষপ্রান্তে এর অবস্থান। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু সিকিমের মধ্য দিয়ে বেশ কিছুটা পথ যেতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দিয়ে এই গ্রামে যাওয়ার যে রাস্তা রয়েছে তা এখনও সেভাবে পরিচিতি পায়নি, গাড়ির যাতায়াতও খুব কম।
১০ মার্চ, ২০২০, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে পাহাড়ি রাস্তার মহিমা দেখতে দেখতে কালিম্পং-এ ঢুকলাম, তখন প্রায় ঘড়ির কাঁটা দুপুর বারোটা। এখনও অনেকটা পথ যাওয়ার বাকি। সকালে রাস্তায় জলখাবার সেরে তিস্তা নদীর কোলাহল কানে শুনতে শুনতে যাত্রাপথটি বেশ মোহময় হয়ে উঠেছিল। তবে এই মোহময় আবেশ আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না সিকিম পেরিয়ে যখন আমাদের গাড়ি মূলখরকা রওনা দিল, বুঝতে পারলাম যাত্রাপথ কতখানি দুর্গম হতে চলেছে। বিশাল বড় বড় পাথর ছড়িয়ে রেখে রাস্তার রূপ দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ দেব গাড়ি চালককে, কতটা ধৈর্য্য থাকলে সেই রাস্তায় গাড়ি চালানো যায়। আমাদের সঙ্গে ছিলেন দুজন বয়স্ক মানুষ – সুদীপ্তদার বাবা আর মা। তাঁদের অবস্থা যে কতটা করুণ হয়েছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা, আর ছিল দুটি বাচ্চা, তাদের একটির বয়স এক বছর চার মাস।
সত্যি বলছি, জীবনে এমন অবস্থায় এই প্রথমবার পড়েছিলাম, ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। গাড়ি এগোচ্ছিল খুব ধীর গতিতে, ঘড়িতে তখন দেড়টা বাজে। কিন্তু একটা জিনিস না বললেই নয়, চারপাশের যা দৃশ্য দেখছিলাম, তাতে সারাদিনের ক্লান্তি আর খিদে দুটোই ভুলিয়ে দিচ্ছিল। অবশেষে, যখন গ্রামটিতে পৌঁছালাম শরীর আর বাঁধ মানলো না, যেমন ঠাণ্ডা ঠিক সেইরকমই শরীরের ব্যথা। তাড়াতাড়ি যে যার ঘরে গিয়ে শীতের কাপড় পরে নিলাম। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘরে গিয়ে যখন একটু বিশ্রাম নিলাম তখন ঠিক বিকেল চারটে। শরীর আর দিচ্ছিল না।
মূলখরকা একটি ছোট্ট গ্রাম। খুব বেশি হলে সব মিলিয়ে পাঁচটি বা ছটি ছোট ছোট বাড়ি, আর তাদের নিজস্ব কিছু ছোট ছোট হোম-স্টে যেখানে ট্যুরিষ্টদের থাকতে দেওয়া হয়। আমরা যেখানে ছিলাম সেই বাড়ির কর্ত্রী ছিলেন পূর্ণিমা ছেত্রি, বছর পঁচিশের এই তরুণীর অসামান্য আতিথেয়তা। তিনি আর তার ভাই দুজনে মিলে এই হোম-স্টেটি চালান। আর ছিলেন তাঁদের একজন কর্মী, সন্তোষ সজোক, তিনি রান্নার দিকটা দেখতেন। জায়গাটি এতটাই উঁচুতে যে রান্নার চাল প্রেসার কুকারেও ঠিকঠাক সিদ্ধ হয় না। আমরা যাওয়ার পর দুপুরে ওখানে খেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম তাড়াহুড়ো করে রান্না করেছে তাই বোধহয় ভাত এত শক্ত, কিন্ত পরে জানলাম, এখানে এইরকমই চাল সিদ্ধ হয়। আর হ্যাঁ, এখানে কিন্তু কোনোরকম দোকান বা কিছু কোনোকিছুরই আশা করা বৃথা, পানের জন্য ঝরনার জল-ই ভরসা, আমরা সবাই নিজেদের বোতলে ঝরনার জল ভরে নিচ্ছিলাম, সে এক নতুন অভিজ্ঞতা।
চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে যাওয়াতে সেদিন চারপাশটা আর কিছুই দেখতে পেলাম না। আমার তো বিকেলের পরই এত ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছিল যে প্যারাসিটামল খেতে হয়েছিল। আর হ্যাঁ, সন্ধ্যেবেলায় একটা বিশেষ টিফিন ছিল, আলুপাতার বড়া, আহা... কী স্বাদ। আবার একটা নতুন অভিজ্ঞতা। রুটি তরকারি সহযোগে রাতের খাবার শেষ করলাম। যথেষ্ট ভয় ছিল মনে মনে। আমরা এমন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জায়গায় আছি, ডাক্তারের দরকার হলে কী করব জানি না।
পরদিন সকাল হল। কিন্তু চারদিকে শুধুই সাদা। এক হাত দূরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর তেমন ঠাণ্ডা। তখন ভোর ছটা। প্রকৃতি যেন কিছুতেই সাদা চাদর থেকে বাইরে আসতে চাইছে না। বেলা আটটার সময় যখন চারদিক অল্প পরিষ্কার হল, সত্যি বলব, মনে হল যেন কৈলাস, হ্যাঁ, ঠিকই বললাম মনে হল যেন কৈলাস-এ এসেছি। চারদিক পাহাড়ে ঘেরা, পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট ঘর, নাম-না-জানা ফুলের বাহার, আর অজানা পাখির ডাক। আমাদের ঘরের সামনেই আলুর ক্ষেত, দূরে ঝরনার আওয়াজ, পাইপ দিয়ে সেই ঝরনার জলই এরা সব কাজে ব্যবহার করছে। বুঝতে পারলাম কত কষ্টকর এদের জীবন। আমরা গিয়েছিলাম মার্চ মাসে, তাতেই জল বরফ হয়ে যায়, তখন এদের খুব সমস্যা হয়। শীতকালে তো এরা এখানে থাকেই না। মূলখরকায় একটি সুন্দর আর বিখ্যাত লেক আছে। কথিত আছে, শিব পার্বতী নাকি এই জলাশয়ে স্নান করতে আসতেন। খুব পবিত্র সেই জায়গাটা। কিন্তু সেই লেক-এর রাস্তা খুবই দুর্গম। রাস্তা বলে কিছু নেই। একদম পাহাড় চূড়ায়। সেইটাই আমাদের লক্ষ্য। চিন্তা করছিলাম এই এক বছর চার মাসের বাচ্চাকে নিয়ে কীভাবে সেটা সম্ভব? ভীষণ দুর্গম রাস্তা। ছয় থেকে সাতটি স্লোপ আছে। কিন্তু কথায় আছে মহাদেব যেখানে ডাকবেন, তাঁর ডাক ফেরায় কার সাধ্য। সুতরাং বেবি কেরিয়ার নিয়ে, মনে একটু ভয় আর বুকভরা আশা নিয়ে রওনা হলাম মূলখরকা লেক-এর দিকে। যাত্রার শুরুতেই হোঁচট খেলাম কারণ একটা একটা করে পাথর পেরিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে হবে। বুঝলাম, যাত্রাপথ একদমই সহজ হবে না। তাও পিছপা হইনি, বাচ্চাটাকে সাবধানে ধরে খুব আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে লাগলাম। জীবনের প্রথম ট্রেকিং এতটা চ্যালেঞ্জিং হবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। কিছুটা ওঠার পর যথারীতি দাঁড়াতে হল, অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল। সুদীপ্তদার মুখে শুনেছিলাম, পাহাড়ি অঞ্চলে একটা জংলি গাছ আছে, নাম তিতপাতি গাছ। সেই গাছের পাতা সাধারণত অক্সিজেন সরবরাহ করতে সাহায্য করে। তাই ট্রেকিং-এর সময় এই গাছের পাতা সঙ্গে রাখতে হয় আর মাঝে মাঝে ওই পাতার ঘ্রাণ নিলে কষ্ট কম হয়। সুতরাং সেটাই করছিলাম। আমি আর আমার স্বামী দুজনে ভাগাভাগি করে বাচ্চা নিয়ে হাই পিকে উঠব, এই রকম অভিজ্ঞতা হয়তো কেউই আন্দাজ করতে পারিনি।
তবে হ্যাঁ, সঙ্গের অন্য শিশুটি, নাম কুহু, যার কথা না বললেই নয়, ভগবান শিব বোধহয় সব শক্তি ওকেই দিয়েছিলেন। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে, কী অবলীলায় সে ওপরে উঠছিল। মনে মনে বলছিলাম, ভগবান যেন সারাজীবন ওকে এইরকমই উচ্ছল রাখে। এক একটা স্লোপ উঠতে আধঘন্টারও বেশি সময় লাগছিল। কুড়ি মিনিটের রাস্তা, কিন্তু পৌঁছালাম আড়াই ঘণ্টায়।
ওপরে উঠে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। সে কী অপরূপ দৃশ্য, আমরা একদম পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে একটি আয়তাকার লেক, জল খুব বেশি নয়, তার পাশে মহাদেব-এর মন্দির। চারদিক ঝাউ গাছ দিয়ে ঘেরা, এই উঁচুতেও যে এত সবুজ গাছ থাকতে পারে, এটাও একটা বিস্ময়। সত্যি আমার চোখ থেকে জল বেরিয়ে এল, ওপরে উঠতে যে কী কষ্ট হয়েছিল, শুধু আমরাই জানি। তবে হ্যাঁ, আশার আলো এটাই যে, দেখেছিলাম রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে, কবে শেষ হবে জানা নেই, যদি শেষ হয়, হয়তো গাড়ি ওই লেক অবধি যাবে। তখন হয়তো এত কষ্ট হবে না। কিন্তু কেউই এই ট্রেকিংয়ের ভয়মিশ্রিত রোমাঞ্চকর মজা আর পাবেও না। আর একটা কথা, জেঠিমাও আমাদের সঙ্গে ওপরে উঠেছিলেন। তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে আমার প্রণাম।
নিচে নামতে প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল, অসম্ভব খিদের কষ্ট নিয়েও যে বাচ্চাদুটো এই দেবদর্শনে সমর্থ হয়েছিল, সেটাও খুব ভাল লেগেছিল। খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর দুটো বেজে গিয়েছিল। পরের দিন রওনা দিয়েছিলাম ফেরার পথে।
পেশায় শিক্ষিকা হলেও অর্পিতা চক্রবর্তী কর্মস্থল আর সংসার সামলে গাছ, জল, মাটি আর পাহাড় দেখার টানে বেরিয়ে পড়েন মাঝেমধ্যেই। এবার "আমাদের ছুটি"-কে পেয়ে সেইসব দেখাকে লেখার রূপ দেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছে পূর্ণ হল।