টংলু টপ-এ দিনদুয়েক

অরুণাচল চ্যাটার্জী

 

ধোঁয়াওঠা গরম নুডল স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে আমি আর মৈনাক বাইরে ঝলমলে রোদে এসে বসলাম। সামনে "শায়িত বুদ্ধ"-র পাহাড়গুলি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। একটা জামবাটি থেকেই দুজনে ভাগ করে খেয়ে নিচ্ছিলাম। সকাল সাড়ে দশটা বাজে, শোঁ শোঁ করে হাড়হিম করা বাতাস বইছিল, তাই চটপট খাবারের সদ্গতি করে ফেললাম। কথা হচ্ছিল, অনেকদিন পর শুধুমাত্র আমরা দুই বন্ধু আবার একসঙ্গে বেরোতে পারলাম, তাও বছর পনেরো হবে। তখন অনেক বিষয়েই আনকোরা ছিলাম, তা সত্ত্বেও সেইবারের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চে ভরপুর ছিল। তবে সে গল্প এখানে করছি না, অন্য কোনও লেখায় তা প্রকাশ করব।

কাজের কোনো বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলাম মৈনাকের সঙ্গে, হঠাৎ করেই পরিকল্পনা হল, কোথাও একটু হেঁটে এলে হয়না! এ হাঁটা লেকের পাশে হেঁটে আসা নয় বা বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে গড়িয়াহাটও নয়। প্ল্যান হল হিমালয়ের কোলে চড়াই উৎরাইয়ে খুব কম দিনে কোথাও একটু হেঁটে আসা। ফেব্রুয়ারি মাসেই যাওয়া হবে ঠিক হল। তার মানে যেখানেই যাইনা কেন ঠাণ্ডা ভালোই পাব, সঙ্গে উপরি পাওনা তুষারপাতও জুটে যেতে পারে। ঠিক হল মানেভঞ্জন থেকে ধোতরে হয়ে টংলু, আর সেখান থেকে সরাসরি নেমে আসা হবে মানেভঞ্জনে, অন্য রাস্তা দিয়ে।
সরাইঘাট এক্সপ্রেসে করে মাঝরাতে নিউ জলপাইগুড়িতে পৌছালাম। পরের দিনের পুরোটাই হাতে থাকবে, এই ভেবেই এই ট্রেনটি বেছে নিয়েছিলাম। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যাত্রী প্রতীক্ষালয়টি খুবই ভালো, আগে থেকে বুক করা থাকলে রাত্রে থাকার ঘর বা ডর্মেটরির বেড পেতে অসুবিধা হয়না। আমাদের বুকিং না থাকায় ঘর পাব কিনা চিন্তা ছিল, তবে ডর্মেটরির একটা বেড ফাঁকা পাওয়া গেল, কিন্তু কেয়ারটেকার কিছুতেই একটা বেড দুজনের জন্য দিতে নারাজ। আমরা যতই বলি কয়েক ঘন্টার তো ব্যাপার, ভোর হলেই বেরিয়ে পড়ব, আমাদের অ্যাডজাস্ট করতে কোনো অসুবিধা হবে না, তা সে নাছোড়বান্দা। এসব কথা বলার ব্যাপারে আমি বেশি নাক গলাইনা, জানি চিঁড়ে যদি ভেজে তবে মৈনাকের কথাতেই ভিজবে। অবশেষে তাকে রাজি করানো গেল।
ভোর হতেই প্রথম আলোয় ডর্মেটরির জানালা দিয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘার কিছু অংশ আবছা দেখা গেল। আমরা তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের দিকে, সেখান থেকে শেয়ার জীপে করে রওনা দিলাম দার্জিলিং-এর দিকে। সরাসরি যাবার কোনও গাড়ি পেলাম না। আবহাওয়া বেশ ভালোই ছিল।
ঘুম থেকে একটা মারুতি ভ্যান বুক করে চললাম মানেভঞ্জনের উদ্দেশ্যে। খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। ফলে হাতে অনেকটা সময় পেলাম। দুপুরের খাবারটা নানারকম মোমো দিয়ে সারলাম। এবার ধোতরের দিকে রওয়ানা দেবার পালা, কিন্তু কোনও শেয়ারের জীপ পাওয়া যাচ্ছেনা, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ঠিক করলাম যে, গাড়ি বুক করেই এগোতে হবে নইলে বাকি দিনটা নষ্ট হবে। ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ি বাঁক পেরিয়ে অবশেষে ধোতরেতে নামলাম, রাস্তা বেশ খারাপ ছিল, পৌঁছাতে দুটো বেজে গেল।

এখান থেকে টংলু প্রায় চারঘন্টার হাঁটা রাস্তা, এই হিসাব অবশ্যই আমাদের, পাহাড়িরা এর অর্ধেকেরও কম সময়ে হয়তো পৌঁছে যাবে। পুরোটাই হালকা চড়াই, কখনও ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আবার কখনও গাছবিহীন ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে চলেছে এই পায়ে হাঁটা রাস্তা। পিঠের বোঝা খুবই হালকা ছিল, তাই চড়াই ভাঙতে বড় একটা কষ্ট হচ্ছিল না। কিছুটা এগোতেই একটা বড় মাঠ, হয়তো স্থানীয়দের খেলার জন্যই। সেটা পেরিয়ে একেবারে জঙ্গুলে মেঠো রাস্তায় এসে পড়া। চারিদিকে বরফ পড়ে রয়েছে। অবশ্য রাস্তা বলে যাকে ভাবছি, সে তো বরফের তলায়। শুধু সরু ফালির মতো যে অংশটায় কোনো গাছপালা নেই, সেটাকেই রাস্তা ভেবে এগিয়ে যাচ্ছি দুজনে। মাঝে মধ্যে বরফের ওপর কিছু গবাদি পশু ও বন্যপ্রাণীদের পায়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। শহুরে জীবনযাত্রা থেকে এসে হঠাৎ করেই চড়াই ভাঙতে প্রথমে বেশ কষ্ট হয়, তবে খানিক হাঁটার পর তা ঠিকও হয়ে যায়। পথের কিছু জায়গায় পাথর বসিয়ে রাস্তার মতো করা আছে, কিছুটা পর পর নালার মতো কাটা। এই রাস্তার মতো অংশ দিয়ে বরফ গলে যখন জলের স্রোত নিচের দিকে নামতে থাকে তখন এই আড়াআড়ি নালাগুলো কাজে লাগে।

চারিদিকের পরিবেশ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে দু-এক দিন আগেই বরফ পড়েছে। গাছের পাতার ওপর গুঁড়ো গুঁড়ো বরফে ভর্তি, দেখতে বেশ লাগে। দিন শেষ হতে এখনও কয়েক ঘন্টা বাকি, পড়ন্ত রোদ ঝুরো বরফে পড়ে অপরূপ দেখাচ্ছে। কোথাও কোথাও তাজা বরফের মধ্যে পা অনেকটাই ঢুকে যাচ্ছে, এবড়োখেবড়ো রাস্তা প্রায় সমান দেখাচ্ছে বরফ পড়ার জন্য। মাঝে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম, সঙ্গে শুকনো খাবার ছিল, সেসব টুকটাক মুখে পুরলাম। শুনশান চারিদিক, শুধু তাজা বরফে পা ফেলার আওয়াজ। বরফের ওপর কিছু শাকাহারী বন্যপ্রাণীদের পায়ের ছাপ চোখে পড়ল, হয়তো কোনও হরিণের। ঘন্টা দুয়েক জঙ্গুলে চড়াই পথ পেরিয়ে দূরে একটা পাহাড় দেখতে পেলাম, বুঝলাম আর কতটা বাকি, কারণ এপথে আমরা দুজনেই নতুন নই। সামনের একটা প্রায় সমতল অংশ পেরিয়ে ওই পাহাড়ের মাথায় উঠতে হবে। সমতল জায়গাটায় পাথর বসিয়ে একটা রাস্তামতো করা আছে, রাস্তার দুপাশে কিছু কাঁটা ঝোপ, পড়ে থাকা বরফে প্রায় আয়তাকার কিছু পায়ের ছাপ চোখে পড়ল, যার সামনের দিকে নখরের ছাপও স্পষ্ট, ভাল্লুকের পায়ের ছাপ বলেই মনে হল। আমরা যেদিকে যাচ্ছি, সেই দিকেই পায়ের ছাপটা এগিয়ে গেছে বলে আন্দাজ করছিলাম, শেষে আর বরফ না থাকায় বা থাকলেও গলে যাওয়ায় প্রাণীটি যে কোন অভিমুখে এগিয়েছিল তা আর বোঝার উপায় রইল না।

আমরা এই আরামের সমতল রাস্তাটি পেরিয়ে সামনের চড়াই এর জন্য তৈরি। পাহাড়ের গা দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ রয়েছে মনে হল, তবে তা স্থানীয়দের ব্যবহারেই যে হয়েছে তা বেশ বোঝা যায়, কিছু মেষপালকও এই পথেই নেমে আসে ধোতরের দিকের পাহাড়ি ঢালে ও পাহাড়ি ধাপে গবাদি পশু চরাতে। সূর্য মেঘের আড়ালে, ভ্যালি ক্লাউড-এর আনাগোনা শুরু হয়েছে, মনে হল এরপর হাওয়ার দাপট বাড়তে পারে, সঙ্গে বৃষ্টি বা তুষারপাত। চড়াই ভাঙা শুরু করতেই তাই হল, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় প্রায় জমে যাওয়ার উপক্রম। দুজনেই ঠিক করলাম আর এঁকেবেঁকে না গিয়ে সোজা উঠে পড়ব, তাতে কিছুটা তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারব। কিন্তু মাঝে মধ্যেই দাঁড়াতে হচ্ছিল। বেশ হাঁপিয়ে উঠছিলাম। ঠাণ্ডা শুষ্ক হওয়ার দাপট ক্রমেই বেড়ে চলল, সামনের কিছুই যে আর দেখা যায় না। মৈনাক আমার আগেই ছিল, তবে বেশ কিছুক্ষণ ওকে দেখতে পাচ্ছিনা। ভ্যালি ক্লাউডে চারিদিক ঢাকা। শুধু দিক ঠিক রেখে উঠে চলেছি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে চড়াই ভেঙে উঠে এলাম বাঁধানো রাস্তায়। কিন্তু সামনে-পিছনে ডাইনে-বাঁয়ে কিছুই ঠাওর করতে পারছিনা। এক ফুট দূরের কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।

"উঠেছিস?" মৈনাকের চিৎকারে বুঝলাম ও রাস্তার ওপরেই আছে কোথাও। হোয়াইট-আউট যাকে বলে আর কী! অনেকটা তুষার ঝড়ের মতো হয়ে চলেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া মুখের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধছে। মধ্যে মধ্যে ভ্যালি ক্লাউড কিছুটা হালকা হয়ে যাওয়ায় একে অপরকে দেখতে পাচ্ছিলাম। রাস্তা ধরে কিছু এগিয়ে বাঁদিকে একটা টেন্ট আর কটেজ চোখে পড়ল। তার মানে আরো কিছুটা গেলে জিটিএ লজ, সেটা পেরিয়ে একটা ট্রেকার্স হাট আছে, সেখানেই আমাদের রাত্রিবাসের পরিকল্পনা। এই লজ বা হাট দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল (ডি জি এইচ সি)-এর মাধ্যমে বুক করা যায়। বুকিং তো করে আসিনি, তবে সপ্তাহের মাঝে, এই সময় পর্যটকদের অত ভিড় থাকে না, তাই কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই বেরিয়েছিলাম। কনকনে হাওয়ার মধ্যে মনে হচ্ছে সেই ট্রেকার্স হাট আগে খুঁজে বার করি, তারপর গিয়েই গরম গরম কিছু পেটে চালান করতে হবে, নইলে জমেই যাব। চারিদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে, আবছা আবছা যা দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যেই খুঁজে বার করতে হবে। মৈনাকই দেখে জানান দিল যে পাওয়া গেছে থাকার জায়গাটা। টংলুর ট্রেকার্স হাট-এর বেড়া টপকে সোজা ওদের খাবারের জায়গায়। রাতে শোয়ার জায়গা পাব কিনা তা পরে দেখা যাবে, আগে খাবার অর্ডার করতে হবে। চা আর কিছু খাবার তৈরি করতে বলার পর দাজুকে জিজ্ঞাসা করা হল, থাকার কী ব্যবস্থা হতে পারে। বলল, একটা চারজনের থাকার ঘর ফাঁকা আছে, বুকিংও নেই, দুজনের থাকার ভাড়াই দিতে হবে, তবে কোনও পর্যটক চলে এলে রুম শেয়ার করতে হবে। এতে তো অসুবিধার কারণই নেই, খাবার করতে যতক্ষণ লাগবে ততক্ষণে আমরা রুকস্যাকগুলো রেখে আসব ঠিক করলাম। দাজু আমাদের জন্য একটা ঘর খুলে দিল। ঘরের অবস্থা আর ব্যবস্থা দেখে যারপরনাই খুশি হলাম। কাঠের মেঝে। চারটে আলাদা খাট। প্রত্যেকটি খাটে গদিসহ বালিশ আর দুটো করে গায়ে দেওয়ার লেপ রাখা আছে। ঘরের উত্তরদিকের দেওয়ালে বড় কাঁচের জানালা, অর্থাৎ দিনের আলো ফুটলেই "শায়িত বুদ্ধ"- এর দেখা মিলবে ঘর থেকেই। বাথরুম চারটে আলাদা, সবার ব্যবহারের জন্য। বাথরুমের বাইরে বড় বড় ড্রামে জল রাখা আছে। একটু ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম খাবার জায়গায়। মেঘাছন্ন পরিবেশে চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরে গিয়েছে। খাবার ঘরের আলোটাই যা জ্বলছে। খাবার জায়গাটির লাগোয়া ঘরগুলিতে দাজু তার পরিবার নিয়ে থাকেন। খাবারের জায়গায় কয়েকটি টেবিল আর চেয়ার রয়েছে। দুদিকের দেওয়ালের তাকে নানারকমের বাসনপত্র। একদিকে আবার কাচের আলমারির মধ্যে বাসন সাজানো রয়েছে। পাহাড়িদের এইভাবেই খাওয়ার ঘর সাজানোর রেওয়াজ। তার পাশেই সন্ধ্যেবেলা দাজুর ভাই কাঠের আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে আগুন পোয়ানোর জন্য। সবে মাত্র সে ফিরেছে পাহাড়ের নিচের দিকের জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে। আগুনের পাশে আমি আর মৈনাক বসে পড়লাম ওদের সঙ্গেই। গরম চা চলে এল। জিজ্ঞাসা করছিলাম, এখন আবহাওয়া কেমন চলছে, কাল কী হতে পারে ইত্যাদি। নানা কথার মধ্যেই রাতের খাবার পরিবেশন করে দিল টেবিলে। বাকি রুমের কয়েকজন পর্যটকও ডিনারের জন্য উপস্থিত। হাড়কাঁপুনি ঠাণ্ডায় গরম ভাত, ডাল, আলুভাজার যে কী মহিমা, তা যারা যারা উপভোগ করেছেন, উপলব্ধি করতে পারবেন।

হাওয়ার বেগ বিকেলের মতো না হলেও এই রাতেও বেশ জোরেই বইছে। আকাশ একটু পরিষ্কার লাগছে, ভ্যালি ক্লাউডও আর নেই। তাই তাপমাত্রাও ক্রমশ যে নিচের দিকে নামছে তা খানিকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ টের পেলাম। ভাবছিলাম আকাশের আলোয় যদি একবার তুষারধবল শৃঙ্গরাজি দেখা যায়। কেমন দেখতে লাগে এই সময়, তার অভিজ্ঞতা আছে, তবুও এ দৃশ্য কখনোই পুরোনো হয়না। বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না বাইরে। ঠাণ্ডার বহর দেখে দুজনেই খাটের ওপর স্লিপিং ব্যাগ খুলে তার ভিতরে ঢুকে পড়লাম, তার ওপর চাপা দিলাম বাকি যে সাজসজ্জা রাখা ছিল তাই দিয়ে। খুব ঠাণ্ডায় ঘুম আসতে দেরি হয়, বিশেষতঃ পায়ের পাতা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে। মৈনাককে দেখলাম, মোমবাতি জ্বালিয়েছে। একটা বই বার করেছে পড়বে বলে। আর আমি মাথা থেকে পা, পুরোটাই ঢুকে পড়েছি স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল কিছু শব্দে, হাওয়ার জন্য বোধহয় কোনোকিছু উড়ে এসে পড়েছে বাইরে। এরপর ঘুম ভাঙল একেবারে ভোরে, পাঁচটার পর। উত্তরের কাঁচের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম, আবহাওয়া পরিষ্কার, হওয়ার দাপটও কম মনে হচ্ছে। কাঁচের বাইরের একদিকে গুঁড়ো বরফের আস্তরণ পড়ে গেছে। আবছা আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার পরিবারকে ধূসর রঙের লাগছে। সিঙ্গালিলা রিজ-এর তুষারাবৃত শৃঙ্গ ছাড়া বাকি সব টংলু টপের থেকে কম উচ্চতার পাহাড়গুলো মেঘের সমুদ্রে ডুবে আছে। মনে হবে সামনের সেই সুবিশাল সাদা মেঘের সমুদ্র পেরোলেই "শায়িত বুদ্ধ"-এর পাহাড় ছুঁতে পারব।
পূর্বদিকে তখনও সূর্যের লাল আভা দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে, পূর্বদিকের পাহাড়ের, মানে ডানদিকের, যেদিকে ভুটানের শৃঙ্গরাজিগুলি দেখা যায়, সেদিকের আকাশ রক্তিম আভায় ভরে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে "শায়িত বুদ্ধের" শৃঙ্গগুলিকে একে একে সেই লালাভ আলোয় রাঙিয়ে তুলল। তুষারাবৃত পাহাড় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ রং বদলাতে বদলাতে হলুদ রঙের হয়ে গেল। তখন মনে হচ্ছিল যেন সোনার পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে। কী অপরূপ শোভা! বারংবার দেখেও নতুন করে দেখার আকুতি থেকে যায়।

ঝলমলে রোদে বসে, সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে, ব্রেকফাস্টের গরম নুডল স্যুপের বাটি থেকে ভাগ করে খেতে খেতে আমাদের নানা রকম আলোচনা হচ্ছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল একযুগেরও বেশি সময় আগে এইখানেই একবার একটা ক্যাম্প করতে এসেছিলাম। সেই সব কথাবার্তার মধ্যেই প্ল্যান হল, পাহাড়ের যে ঢালগুলোয় শিক্ষামূলক ভ্রমণ করেছিলাম, সেই সব জায়গায় আর একবার ঘুরে এলে কেমন হয়, তারপর সেখান থেকে নাহয় তুমলিং ঘুরে আসা যাবে।
মানেভঞ্জন থেকে গাড়িতে করে পিচরাস্তা ও ঢালাইরাস্তা দিয়ে সরাসরি এখানে আসা যায়, আর সেই রাস্তাই তুমলিং হয়ে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত সান্দাকফু অবধি চলে গেছে। তবে সেইসব রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত অনুমতিপত্র লাগে। সান্দাকফু ট্রেকেও অনুমতির প্রয়োজন হয়।

কাল রাতে ভালোই তুষারপাত হয়েছে, আগের রাতেও নাকি পড়েছিল। চারিদিক সাদা। ছোট ছোট টিলার ওপর উঠতে গিয়ে প্রায় হাঁটু অবধি বরফে ঢুকে যাচ্ছিল। টিলার মাথা থেকে আশেপাশে যতটা দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ি ঢালগুলো সাদা বরফের আস্তরণে ঢেকে গেছে। টংলুর থেকে তুমলিং-এর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, ডানদিক দিয়ে ঢালাই রাস্তাটা এঁকেবেঁকে ঢেউ খেলে তুমলিং পৌঁছে গেছে। টিলাগুলোর ওপর থেকে দেখলাম রাস্তাগুলোও বরফে ভর্তি, আগের দিনের বরফের সঙ্গে কাল রাতের নতুন বরফ পড়েছে। রাস্তা দিয়ে কিছু এগিয়ে আর একটা টিলার ওপর উঠে বাঁদিকে দূরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট। টংলু থেকে এভারেস্ট এবং চতুর্থ ও পঞ্চম উচ্চতম শৃঙ্গদুটিও দেখা যায় আবহাওয়া ভালো থাকলে। দেখা গেল এভারেস্ট, তবে তার থেকেও একটু বেশি পরিষ্কার দেখা গেল সেই লোৎসে আর মাকালুকে।

রাস্তার বরফে দুটি সমান্তরাল সরু নালার মতো তৈরি হয়েছে, ল্যান্ডরোভারের চাকার চাপে। সূর্যের তাপে বরফ কোথাও কোথাও গলতে শুরু করেছে। ফলে জমাটবাঁধা বরফগুলো পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে, হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই পা হড়কাচ্ছে। রাস্তা ছেড়ে আমরা টংলুর বাঁদিকের পাহাড়ি ঢালে চলে এলাম। একটু আগে যে সাদা পাতলা বরফের আস্তরণ দেখা যাচ্ছিল এই ঢাল বেয়ে, এখন তা সব প্রায় গলে গেছে রোদের জন্য।
এই ঘাসে আবৃত ঢালে কোনও বড় গাছ নেই, কিছু গুল্মজাতীয় গাছপালা, তার মধ্যে কাঁটাওলা গাছের দেখাই বেশি মেলে। গল্প করতে করতে ঢাল বরাবর নেমে প্রায় তুমলিংয়ের কাছে গিয়ে উঠলাম রাস্তায়। ছোট্ট জনপদ তুমলিং, টংলুর থেকে কম উচ্চতায় অবস্থিত। অনেক হোমস্টে ও ট্রেকার্স হাট হয়েছে পর্যটকদের জন্য, এটাই এদের একমাত্র উপার্জনের রাস্তা। এরকমই একটা হোটেলে দুপুরের বিরতি।

দুপুরের খাবার খেয়ে আরও কিছুটা এগোলাম সান্দাকফু যাওয়ার রাস্তায়, বেশি এগোনো যাবেনা, কারণ তার জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র লাগবে। এদিকের পাহাড়ি ঢাল নেমে গেছে নেপালের দিকে। দূরে ঢালের ওপাশে নেপালের দিকে কয়েকটা জনবসতি চোখে পড়ল। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে এদিকওদিক ঘুরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আরও ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দিলাম।
এবার ফেরার পালা। তুমলিং এর পাশ দিয়ে ফেরার সময় দেখলাম, আগের থেকে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। আমরা ঢালাই রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ফিরে চললাম টংলু টপের দিকে। দুপুরের পর থেকে ভ্যালি ক্লাউড এর আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গগুলো মাঝে মধ্যেই ঢাকা পরে যাচ্ছে মেঘের পাতলা আস্তরণে। টংলু ট্রেকার্স হাটের পাশের একটা উঁচুমতো অংশে গিয়ে বসলাম। সূর্যাস্ত দেখার অপেক্ষায়। সকালেই এই জায়গাগুলো বরফে ঢাকা ছিল, এখন বরফহীন ঘাসজমি। আমাদের সামনে, অর্থাৎ উত্তরের দিকে সিঙ্গালিলা রেঞ্জ-এর পর্বতমালা, আর পিছনের দিকে পাহাড়ি ঢাল নেমে গিয়েছে মেঘমা ও চিত্রে-এর দিকে। বিকেলের দিকে, সেই পাশেই মেঘের ঢেউ এসে গোটা পাহাড়ি ঢালটাকে ঢেকে ফেলল মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে। উঁচু পাহাড় আর টিলাগুলোর মাঝে মেঘের সমুদ্র, নিচের কোনোকিছুই আর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। ঢালের গা বেয়ে ওপরে উঠে মেঘগুলি কুণ্ডলী পাকিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নানা দিকে। মেঘের সমুদ্রের ওপরে সূর্যাস্তের আলো পড়ে রঙিন করে তুলছে। সূর্য একটু একটু করে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে আর তার সঙ্গে সঙ্গে আলোর ছটা ক্রমশ বর্ণ পরিবর্তন করে চলেছে হালকা গোলাপি থেকে হালকা লাল, কমলা ইত্যাদি রঙে। মেঘের রঙও সেই অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। শান্ত পরিবেশে এই খেলা দেখে চলেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। উত্তরের শৃঙ্গরাজিও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে রঙের খেলায়।

আজ মনে হচ্ছে রাতের দিকে আকাশ পরিষ্কার থাকবে। ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে গেল চারিদিক। আকাশের তারারা পরিস্ফুট হচ্ছে ক্রমশ। মনে হচ্ছে এইখানেই শুয়ে বসে গল্প করে কাটিয়ে দিই। ঠাণ্ডার সেঁক পেয়ে উঠে পড়তে হল অগত্যা। টিলার ওপর থেকেই দেখেছিলাম, আমাদের ট্রেকার্স হাটের সামনে তিনটে এসইউভি ধরণের গাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে, মানে কিছু পর্যটকের আগমন হয়েছে নিশ্চয়। ফিরে গিয়ে দেখলাম, দাজু দুটো খাট আর বিছানা সরিয়ে নিয়ে গেছে অন্য ঘরে। বলল, একই পরিবারের তাই একঘরেই থাকবে বলছিল, সেজন্য খাটই শিফট করে দিলাম। মানে আমরা দুজনেই থাকব এঘরে। খাওয়ার ঘরে গিয়ে বসলাম, আগুনের কাছে। দেখলাম আজ নানান রান্নার প্রস্তুতি চলছে। অনেকের খাবার তৈরি করতে হবে। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া শুকনো খাবার আর গরম গরম চা খেতে খেতে দাজুর পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা চলছিল। হিন্দিতেই কথা বলছিলাম। ওখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি, পর্যটন শিল্প এসব নিয়ে অনেক কিছু জানা গেল। কষ্টের, অসচ্ছলতার জীবন, তবু নরম মনের অধিকারী ওরা। ওদের ব্যবহার আপনাকে বার বার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে এই হিমালয়ের কোলগুলিতে।
রাতের ঝকঝকে আকাশে অগুনতি তারাদের সমাবেশ। একটু মন দিয়ে খেয়াল করলে হয়তো কিছু উল্কাও চোখে পড়বে। সিঙ্গালিলা রিজ-এর "শায়িত বুদ্ধ"-এর পর্বতমালা এখনও দেখা যাচ্ছে, রাতের আকাশের আবছা আলোয়। বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায়না। কনকনে ঠাণ্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। তবুও এই দৃশ্যের এক কণাও যেন ছাড়া যায়না। আবার কবে এ দৃশ্য দেখতে পাব তার তো ঠিক নেই। কালই নেমে যেতে হবে যে।
খুব ভোর ভোর উঠে পড়লাম, কাল যে টিলার ওপর বসেছিলাম বিকেল বেলায়, সেখানেই আবার গেলাম। ভোরের আলোয় ভুটান, নেপাল, ভারতের পর্বতমালা পরিষ্কার দেখা যায় এখান থেকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়াশা বাড়তে থাকে তখন আর দূরের তুষারাবৃত শৃঙ্গগুলি দেখা যায়না। "শায়িত বুদ্ধ"-র যে শৃঙ্গগুলি পর পর দেখা যায় বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে (মাথার দিক থেকে পা-এর দিকে), সেগুলি হল জানু, কুম্ভকর্ণ-এর দুটি শৃঙ্গ, কাংবাচেন, কোকতাং, রাথঙ, কাবরু গ্রুপের শৃঙ্গ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, গোচা, পান্ডিম ও তিনছেন খাং। এই শৃঙ্গগুলোই এক এক জায়গা থেকে একেক রকম দেখতে লাগে। সান্দাকফু থেকেও খুব সুন্দর দেখা যায় এই শৃঙ্গগুলো।
টিলার ওপর থেকে ধোতরের দিকের রাস্তাগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। তবে আমরা সেদিক দিয়ে নামবো না। ফিরবো মেঘমা হয়ে, চিত্রে দিয়ে মানেভঞ্জন।

আজ মনে হচ্ছে রাতের দিকে আকাশ পরিষ্কার থাকবে। ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে গেল চারিদিক। আকাশের তারারা পরিস্ফুট হচ্ছে ক্রমশ। মনে হচ্ছে এইখানেই শুয়ে বসে গল্প করে কাটিয়ে দিই। ঠাণ্ডার সেঁক পেয়ে উঠে পড়তে হল অগত্যা। টিলার ওপর থেকেই দেখেছিলাম, আমাদের ট্রেকার্স হাটের সামনে তিনটে এসইউভি ধরণের গাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে, মানে কিছু পর্যটকের আগমন হয়েছে নিশ্চয়। ফিরে গিয়ে দেখলাম, দাজু দুটো খাট আর বিছানা সরিয়ে নিয়ে গেছে অন্য ঘরে। বলল, একই পরিবারের তাই একঘরেই থাকবে বলছিল, সেজন্য খাটই শিফট করে দিলাম। মানে আমরা দুজনেই থাকব এঘরে। খাওয়ার ঘরে গিয়ে বসলাম, আগুনের কাছে। দেখলাম আজ নানান রান্নার প্রস্তুতি চলছে। অনেকের খাবার তৈরি করতে হবে। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া শুকনো খাবার আর গরম গরম চা খেতে খেতে দাজুর পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা চলছিল। হিন্দিতেই কথা বলছিলাম। ওখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি, পর্যটন শিল্প এসব নিয়ে অনেক কিছু জানা গেল। কষ্টের, অসচ্ছলতার জীবন, তবু নরম মনের অধিকারী ওরা। ওদের ব্যবহার আপনাকে বার বার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে এই হিমালয়ের কোলগুলিতে।
রাতের ঝকঝকে আকাশে অগুনতি তারাদের সমাবেশ। একটু মন দিয়ে খেয়াল করলে হয়তো কিছু উল্কাও চোখে পড়বে। সিঙ্গালিলা রিজ-এর "শায়িত বুদ্ধ"-এর পর্বতমালা এখনও দেখা যাচ্ছে, রাতের আকাশের আবছা আলোয়। বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায়না। কনকনে ঠাণ্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। তবুও এই দৃশ্যের এক কণাও যেন ছাড়া যায়না। আবার কবে এ দৃশ্য দেখতে পাব তার তো ঠিক নেই। কালই নেমে যেতে হবে যে।
খুব ভোর ভোর উঠে পড়লাম, কাল যে টিলার ওপর বসেছিলাম বিকেল বেলায়, সেখানেই আবার গেলাম। ভোরের আলোয় ভুটান, নেপাল, ভারতের পর্বতমালা পরিষ্কার দেখা যায় এখান থেকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়াশা বাড়তে থাকে তখন আর দূরের তুষারাবৃত শৃঙ্গগুলি দেখা যায়না। "শায়িত বুদ্ধা"-র যে শৃঙ্গগুলি পর পর দেখা যায় বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে (মাথার দিক থেকে পা-এর দিকে), সেগুলি হল জানু, কুম্ভকর্ণ-এর দুটি শৃঙ্গ, কাংবাচেন, কোকতাং, রাথঙ, কাবরু গ্রুপের শৃঙ্গ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, গোচা, পান্ডিম ও তিনছেন খাং। এই শৃঙ্গগুলোই এক এক জায়গা থেকে একেক রকম দেখতে লাগে। সান্দাকফু থেকেও খুব সুন্দর দেখা যায় এই শৃঙ্গগুলো।
টিলার ওপর থেকে ধোতরের দিকের রাস্তাগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। তবে আমরা সেদিক দিয়ে নামবো না। ফিরবো মেঘমা হয়ে, চিত্রে দিয়ে মানেভঞ্জন।

ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তা দিয়ে না হেঁটে, সরাসরি পাহাড়ি ঢাল দিয়ে নামতে শুরু করলাম, পথ সংক্ষেপ করার জন্য আর কী! টংলু তুমলিং ছেড়ে ঠিক তার নিচের একটি গ্রাম মেঘমা, তার উদ্দেশ্যে। নামার পথে একটা জায়গায় অনেকগুলো শকুন দেখলাম, হিমালয়ের বিভিন্ন অংশে এদের বাস। মেঘমা অবধি কোনও বড় গাছ প্রায় নেই। আরও কিছুটা এগোতে ওপর থেকে মেঘমা গ্রাম চোখে পড়ল। গ্রামটিতে খুব বেশি লোকের বাস যে নেই তা বোঝা যায়। তবে একটা সুন্দর মনাস্ট্রি আছে। আর আছে সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি)-এর বর্ডার আউটপোস্ট। মেঘমা নেপাল সীমান্তে অবস্থিত, তাই এই বন্দোবস্ত। সুতরাং এই চেকপোস্টে এরা ইচ্ছে করলেই ব্যাগ তল্লাশি করে দেখতে পারে। এই অঞ্চলে ছবি তোলাও নিষেধ। নিস্তব্ধ মেঘমা পেরিয়ে বড় বড় গাছের দেখা পেলাম।

উচ্চতা কিছুটা কম, হাওয়ার দাপট কম, তাই বড় গুল্ম এবং বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদের দেখা মেলে। উল্লেখযোগ্য গাছের মধ্যে আছে রডোডেনড্রন। ফেব্রুয়ারির শেষের দিক, এখন রডোডেনড্রন ফুলের সময় নয়। তবে কিছু কিছু গাছে দেখলাম নানা রঙের রডোডেনড্রন ফুল ফুটতে শুরু করেছে। এই ফুলগুলি স্থানীয়ভাবে গুরাস বা বুরাস নামেও পরিচিত। বিভিন্ন গাছে বিভিন্ন রঙের ফুল ফোটে। একরঙা বা ছিটযুক্ত হতে পারে। এই ফুলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এই ফুলের রস। অত্যন্ত উপাদেয় পানীয়ও তৈরি হয় বুরাস-এর রস থেকে।

একচোটে অনেকটা নেমে এসেছি, তাই মেঘমা পেরিয়ে ভাবছিলাম কোথায় একটু বিশ্রাম নেওয়া যায় আর খাওয়াদাওয়াও করা যায়। মেঘমা থেকে আর একটু নিচের দিকে নামলে ছোট্ট একটা চটি আছে, জায়গাটার নাম লামাধুরা। ছেলেটি মৈনাককে দেখেই চিনতে পারল। আগেরবার যখন এসেছিল তখন আলাপ হয়েছিল। যাক একটু বিশ্রাম নেওয়া যাবে এইখানে। পিঠের স্যাক নামিয়ে কাঠের বেঞ্চে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লাম আর মৈনাক ওদের পোষ্যটিকে নিয়ে মেতে উঠল। তবে তার মধ্যে খাবার বলে দেওয়া হলো, ম্যাগি আর চা। ঘন্টাখানেক এখানে কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবার সামনে পাব পাহাড়ি গ্রাম চিত্রে। এখানে অনেক লোকের বাস। তারপর সরাসরি মানেভঞ্জন। চিত্রে অবধি পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা রয়েছে হাঁটার। এরপর পায়ে হাঁটার রাস্তা বলতে শুধু ঢালু ও খাড়া সিঁড়ির ধাপ। তার পাশ দিয়ে পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে নেমে গেছে মানেভঞ্জন। আর এই রাস্তাই ওপরের দিকে পৌঁছে গেছে টংলু টপ-এ। পিচ রাস্তা ধরে হাঁটলে রাস্তা দীর্ঘায়িত হবে, সেই ভেবে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে করা সিঁড়ির পথই বেছে নিলাম। স্থানীয় ভাষায় এই ধরণের সর্টকাট চোরবাটো বলে পরিচিত। ক্রমাগত ঢালু ও খাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিরক্তি ধরে যাবে। খালি মনে হবে কতক্ষণে এর শেষ! ঘন্টাখানেক এভাবে যাবার পর প্রায় লোকালয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে নেমে এলাম মানেভঞ্জনে। সিঁড়িপথের শেষে একটা সাইনবোর্ড আছে রাস্তার পাশে, পিছন ফিরে দেখলাম তাতে লেখা আছে - "ইউ আর ওয়েলকাম টু নেপাল"।
চোরবাটো নামতে গিয়ে তার মানে কি আমরা নেপালের গ্রামের মধ্যে দিয়ে এলাম শেষ ঘন্টাখানেক! সেটা বিস্ময়ই থেকে গেল। সেই বিস্ময় নিয়েই শেষ হল এবারের যাত্রা। শেষ হল এই আশা নিয়ে যে, আবার এভাবে হাঁটতে বেরোব কোনও এক হিমালয়ের কোল বেয়ে সর্পিলাকার মেঠোপথে।

অধ্যাপনার পাশাপাশি অরুণাচল চ্যাটার্জি বিভিন্নস্থানে ঘুরে বেড়ানোটা অভ্যেসে পরিণত করেছেন। বিভিন্ন পরিবেশে উপস্থিত জীববৈচিত্র্য তাঁকে আকৃষ্ট করে আর তাই জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে ঘোরার নেশা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সহযোগিতা করে।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher