বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

রূপনারায়ণের কূলে শরৎ কুঠি

বাপ্পাদিত্য বর্মন


এক ছুটির দিনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দেউলটির পথে। উদ্দেশ্য 'শরৎ স্মৃতি মন্দির' আর রূপনারায়ণ নদী। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজরিত দেউলটি গ্রামে রয়েছে তাঁর বসতবাড়ি।
কলকাতা থেকে গাড়িতে দেড় ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় হাওড়া জেলার শেষপ্রান্তে দেউলটিতে। হাওড়া স্টেশন থেকে দক্ষিণপূর্ব রেলের প্রায় সব লোকাল ট্রেনই দেউলটি যাচ্ছে। তবে আমরা গাড়িতেই গিয়েছিলাম।
ঝকঝকে সকালে তরতাজা মনে রওনা দিলাম দেউলটির সমতাবেড় গ্রামের পথে। জাতীয় সড়ক ছেড়ে দেউলটিতে ঢুকলে মিষ্টি রোদমাখা রাস্তার দুপাশে হলুদে সবুজে মেশা অপরূপ প্রকৃতির দেখা মিলল।
সুন্দর পথনির্দেশ দেওয়া রাস্তা দিয়ে পৌঁছে গেলাম 'শরৎ স্মৃতি মন্দির'। লেখকের ছোট দোতলা বাড়ির প্রবেশদ্বারের ওপর বোগেনভিলিয়ার গোলাপী নকশা। স্তম্ভে লেখা আছে 'মহেশ'-এর বিখ্যাত উক্তি।

বাড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে নানান কাহিনির ঘটনা,চরিত্রগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সামনের পুকুরে নাকি 'কার্তিক', 'গণেশ' নামে মাছ পুষেছিলেন লেখক। 'রামের সুমতি'র পেয়ারাগাছটি এখন মৃত, তাঁর বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে।
দোতলা বাড়িটির সর্বত্র ছড়িয়ে আছে লেখকের স্মৃতি। ধানের গোলা, কাঠের বারান্দা, লেখার টেবিল, ঘড়ি, বইয়ের তাক সবকিছু সংরক্ষিত পরম যত্নে। এক কালে অনেক গুণী মানুষের পদধূলি পড়ত এই বাড়িটিতে। বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা দুজন খুব ভালো করে দেখালেন সমস্ত কিছু। বাগানটিও সুন্দর গাছ-গাছালিতে সাজানো।
পল্লী-প্রকৃতির লেখক তাঁর বসতবাড়িটি তৈরি করেছিলেন প্রকৃতির মাঝে। সেই সময়ে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যেত রূপনারায়ণ নদী। জানলা দিয়ে নদীকে অনুভব করতেন লেখক। এখনো ওপরের বারান্দায় কাঠের রেলিঙে ভর দিয়ে সামনে দেখা যায় রূপনারায়ণ। শরৎচন্দ্র 'অভাগীর স্বর্গ' লিখেছিলেন এখানেই।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রূপনারায়ণের পাড়ে। রূপনারায়ণের নামের সঙ্গেই যেন লুকিয়ে আছে তার সৌন্দর্য। সোনালি বালির চর আর নদীর প্রেক্ষাপটে সবুজ বনানীর মনভোলানো দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। নদীর পাশে ফুটে থাকা সর্ষেফুলের ক্ষেতে হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। জনপ্রিয় পিকনিক স্পটও এই রূপনারায়ণের পাড়।
দূরে কোলাঘাটের শরৎ সেতু। ওপারে পূর্বমেদিনীপুর, এপারে হাওড়া, আর নদী যেখানে একটু বাঁক নিয়েছে সেখানে পশ্চিম মেদিনীপুর। এই তিন জেলার সন্ধিস্থলে রূপনারায়ণের কূলে ঘাসের ওপর বসে সামনে দেখা যায় ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ গাভীর মত চরে বেড়াচ্ছে। বিশালাকার বালিচর নদীর বুকে উঁচিয়ে আছে। যেন ঘোষণা করছে নদীর মৃত্যুঘন্টা। তবু তার কোন অভিযোগ অনুযোগ নেই কারো কাছে। তার ক্ষুদ্র সম্পদ নিয়ে বয়ে চলেছে আপন খেয়ালে।

কয়েকটি মাছ ধরার ডিঙি নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিকে সেদিকে। আর বালি বোঝাই বড় বড় নৌকাগুলো গভীর জলের সঠিক পথ খুঁজে চলেছে সওদার জন্য। বিকেলের রাঙা আলোর রেশটুকু গায়ে জড়িয়ে দিব্যি সেজেছে প্রকৃতি। বসে থাকলাম সূর্যাস্তের জন্য। আকাশ, নদী, পাড় সবই রাঙা হয়ে উঠল। একটু একটু করে নিচে নামছে সূর্য। নদীর জলে তার ছায়া। সোনালি সেই ছায়া ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে। জলের বুকে যেন শিল্পীর তুলির টান। সূর্যের রঙও সোনালি থেকে সিঁদুর হল। রঙের মেলায় দৃশ্য কেবলই বদলে যাচ্ছে।
কূলে বসে থাকলে কখন যে সময় কেটে যাবে তা বোঝা যাবে না। এবারে ওঠার পালা। তবু যেতে ইচ্ছা করে না।

গ্রামে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে অনেকগুলি নার্সারি। ফেরার পথে ঢুকে পড়লাম তার কয়েকটিতে। চোখধাঁধানো সব ফুলের গাছ,ঘরসাজানোর গাছ, দুর্লভ অর্কিড, ক্যাকটাস দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। অতি যত্নে ফোটানো ফুলসহ ক্যাকটাস দরদাম করে বাড়ির জন্য নিয়ে আসা যেতেই পারে। আছে বাহারি ফলের গাছও। গাছপালা নিয়ে যারা চর্চা করেন তাদের জন্য আদর্শ জায়গা এই নার্সারিগুলো। গাছগাছালির মধ্যে বেশ অনেকটা ভালো লাগার সময় কেটে গেল।

 

 

পেশায় স্কুল শিক্ষক বাপ্পাদিত্য বর্মন-এর শখ বেড়ানো আর বই পড়া।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher