অরণ্যের দিনরাত্রি
তাপস মণ্ডল
সময়টা সেপ্টেম্বর, ২০০৮...
দু-তিন দিন ধরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে, নিম্নচাপ আর কী... তিন-চার দিন হল দেখা হয়নি জুম্বাদা, বাপ্পা, প্রসেন, সুদীপ্তদা, চিকুর সঙ্গে...ভালো লাগছে না। অফিস থেকেও দেরি করে বেরোচ্ছি। ১৬ তারিখ রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বাপ্পার ফোন এল...
- কী রে কোথায়? কী করছিস?
- এইতো বাড়িতে... তেমন কিছু না...
- কাল সকাল সাড়ে ছটায় বাউরিয়া স্টেশনে চলে আয়। আর কাউকে ফোন করিস না।
কী যেন একটু ভেবে বললাম, – কেন? কোথাও বেরোচ্ছি?
ওদিক থেকে বাপ্পা বলল, – হুমম, বাঁকুড়া। কিন্তু তুই যাচ্ছিস ব্যাপারটা সিক্রেট। আর কেউ জানবে না। ঠিক আছে রাখছি, কাল সাড়ে ছটায় দেখা হচ্ছে।
বাপ্পার কথাটা শুনে মনের ভিতরটা ভীষণ ব্যাকুল হয়ে উঠল...সবকিছু ছেড়ে আবার বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করল। রাত্রে বাড়িতে বললাম, 'মেক মাই ট্রিপ' থেকে দুদিন-এক রাত্রির ফ্রি ট্রিপ আছে। আর প্ল্যান করলাম, কাল অফিসে বলব হলদিয়ায় দাদুর খুব শরীর খারাপ তাই যেতে হচ্ছে। সারারাত চাপা উত্তেজনায় ঘুম হল না।
পরদিন সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোলাম। আকাশ প্রায় অন্ধকার। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। জনশূন্য অটোস্ট্যান্ড... একটাও অটো নেই। প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষার পর মনটা অস্থির হয়ে উঠল। ভাবলাম এই দুর্যোগে যদি কিছু না পাই তা হলে হেঁটেই ষ্টেশন চলে যাব। খুব বেশি হলে হয়তো আধঘন্টা সময় লাগবে। তারপর মাথায় একটা প্ল্যান এল, হাত দেখিয়ে রাস্তায় এক লরি দাঁড় করালাম। সহৃদয় ড্রাইভারদাদা হাসিমুখে স্টেশন অবধি লিফট দিয়ে দিলেন। স্টেশনে পৌঁছালাম ছটা কুড়িতে। বাকিরা আমাকে দেখে অবাক। ট্রিপের শুরুতেই এই চমকটা ওরা কেউ আশা করেনি। সুদীপ্তদা চিৎকার করে উঠল 'ট্রিপটা তো জমে গেল'।
বাউড়িয়া থেকে ডাউন লোকালে সাঁতরাগাছি, তারপর সাঁতরাগাছি থেকে শালিমার-আদ্রা 'আরণ্যক এক্সপ্রেস'। গন্তব্য বাঁকুড়া জেলার কোনও এক 'আসনার জঙ্গল'। এরচেয়ে বেশি তথ্য আমাদের কারও কাছেই নেই। নেওয়ার ইচ্ছাও কারোর ছিল না। এই ভেবেই ভালো লাগছিল কোথায় যাচ্ছি, কিভাবে যাব, সেখানে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে কিছুই জানি না। শুধু চলার তাগিদেই পথে নামা। ছুটে চলা এক সবুজ আনন্দের উদ্দেশ্যে কোনও এক দিকশূন্যপুরে...
সাঁতরাগাছি থেকে ট্রেন ছাড়ল সাড়ে সাতটায়। ফাঁকা ট্রেন। ঘোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কিছু রেল কর্মচারী আর আমরা কয়জন বাদে কেউ আর ঘর ছেড়ে বেরোতে সাহস করেনি। কাঠের চওড়া পাটাতন দেওয়া সিটে হাত পা ছড়িয়ে বেশ আয়েশ করে মুখোমুখি বসে পড়লাম। এক আকাশ মেঘের নিচে পাতা সমান্তরাল সর্পিল রেলপথ বেয়ে ছুটে চলেছে আমাদের ট্রেন পিছনে ফেলে রেখে গাছপালা, ঘরবাড়ি। পার হয়ে যাচ্ছি ছোট বড় ষ্টেশন, আটপৌরে মফঃস্বল। দেখতে দেখতে ঘরবাড়ি, জনপদের জায়গা অদলবদল করে নিল সবুজ ধানখেত। তার শেষপ্রান্তে গিয়ে মিশেছে স্লেট রঙা আকাশটা। ট্রেন থামল, মেচেদা ষ্টেশন। ট্রেনজার্নি আর আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাওয়া হল নারকোল দেওয়া মশলামুড়ি আর মাটির ভাঁড়ের চা। জুম্বাদা কোথা থেকে কিনে আনল 'নিউজ পেপার'। সেইসময় এখনকার মত হাই ডেফিনেশন ক্যামেরা ফোন সহজলভ্য ছিল না, বা থাকলেও তা ছিল আমাদের সাধ্যাতীত। সম্বল বলতে বাপ্পার নোকিয়া ৬২৩৩। আর একটি ছোট হটশট ক্যামেরা। তাই দিয়েই ফ্রেমবন্দী করতে লেগে পড়লাম বিভিন্ন মুহূর্তদের।
শীর্ণকায়া কংসাবতী বর্ষার জলে উন্মত্ত যৌবনা। তার দুই পাড় জুড়ে সাদা কাশের জঙ্গল বোধহয় শরতের নীল আকাশ আর পেঁজা তুলোর মত মেঘের প্রতীক্ষায় সাজিয়ে তুলছে নিজেকে। ট্রেনের জানলা দিয়ে শেষ বর্ষার অপরূপ রাঢ়বঙ্গ চোখে মাখতে মাখতে নিখাদ আড্ডায় বিলীন হয়ে গেলাম আমরা ছয়জন। শালবনিতে ট্রেন দাঁড়াতে একটু নেমে হাতপাগুলো ছাড়িয়ে নিলাম। সবুজে মোড়া ষ্টেশনকে সাক্ষী রেখে কয়েকটা ছবিও ফ্রেমবন্দী করলাম। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেলাম গড়বেতা, পিয়ারডোবা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে তুলে নিলাম বেশ কিছু ছবি। তার মধ্যে বাপ্পা হঠাৎ রেগে ভীষণ গালাগাল করল। ব্যাপার সাংঘাতিক, অনেকক্ষণ পোজ দেওয়ার পর তোলা ছবিতে দৃশ্যমান শুধু ওর নাক! ক্যানডিড ফটোগ্রাফি নিঃসন্দেহে !
এরকম আনপ্ল্যানড ট্যুর আগে কখনো হয়নি। আর জঙ্গলে রাত্রিবাসও প্রথম। তাই একটা চাপা উত্তেজনা সবার মধ্যেই ছিল। বিষ্ণুপুর ষ্টেশনে নামলাম তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। ষ্টেশনে বড় ডিসপ্লেবোর্ড জুড়ে বাঁকুড়ার ম্যাপ।
সুদীপ্তদা বলল, "ভাই ম্যাপে তো তোর 'আসনা' নামে কোন জায়গা নেই"।
জুম্বাদা জিজ্ঞেস করল, "কোথায় বাবা তোমার 'আসনা' ?"
ঘাবড়ে না গিয়ে চিকুর কনফিডেন্ট উত্তর, "ও আছেই আশেপাশে কোথাও। একটু খুঁজে দেখতে হবে। ঠিক আছে, কোন চাপ নেই... একটা ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলব।"
এখানে বলে রাখি চিকুর ওই তথ্য আশির দশকের কোন এক ভ্রমণ সংক্রান্ত ম্যাগাজিন থেকে প্রাপ্ত। তার আগে পরের কোন কিছুই জানার চেষ্টা আমরা করিনি। ওই যে বললাম গন্তব্যটা মূল উদ্দেশ্য ছিল না। সে যাই হোক, চিকু বেশ কেতা মেরে পাশের সিগারেটের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনল। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট ধরিয়ে বেশ কায়দা করে জিজ্ঞেস করল, "দাদা এখানে 'আসনা' জায়গাটা কোন দিকে?"
চিকুর কনফিডেন্সে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দোকানদার দাদা উত্তর দিলেন, "ওই নামে তো এখানে কিছু নেই।"
উত্তর শুনে আমাদের সম্মিলিত হাসির আওয়াজে আশপাশের গাছ থেকে কাক উড়ে গেল। তারপর চিকুকে বন্ধুবৃত্তে প্রযোজ্য উপযুক্ত সম্ভাষণে ভূষিত করে আমাদের কর্তব্য পালন করলাম। ওর ভরসায় আর না থেকে ঠিক হল জঙ্গল যখন যাব ঠিক করেছি তখন কাছের রেঞ্জ অফিসে একবার ঢুঁ মেরে দেখা যাক। বৃষ্টিভেজা লাল মাটির রাস্তায় হাঁটু অবধি প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটা লাগালাম রেঞ্জ অফিসের দিকে। জুম্বাদা বরাবর সাহেবি কেতার মানুষ, ওসব দিশি প্যান্ট গোটানো ধাতে নেই। তাই লাল কাদামাটি সাদা প্যান্টে যে অপরূপ শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলেছিল তা সহজেই অনুমেয়।
লাল রঙা, পুরনো ব্রিটিশ আমলের বিল্ডিং। গেট পেরিয়ে রেঞ্জঅফিসে ঢুকে দেখলাম সার দিয়ে দাঁড়ানো তিনটে জিপ। বিশ্বকর্মা পুজো -তারই তোড়জোড় চলছে। বাইরের বেঞ্চে বসলাম। জুম্বাদা ভিতরে গেল রেঞ্জার সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে। সব শুনে তিনি জানালেন আসনা রেঞ্জ এখান থেকে অনেকদূর। তারপর অ্যাডভান্স বুকিং-এর ব্যাপার আছে। তার থেকে আমরা যদি চাই উনি জয়পুর রেঞ্জে ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। শুনে সবচেয়ে স্বস্তি পেল চিকু। বেচারা আমাদের জ্বালায় বেশ কিছুক্ষণ থেকে মুখটা প্যাঁচার মত করে ছিল। যদিও খুব সত্যি কথা যে কম বেশি চিন্তিত আমরা সবাই ছিলাম। রেঞ্জার সাহেবের কথা মত জুম্বাদা একটা ফুলস্কেপ সাদা কাগজ জোগাড় করে প্রাঞ্জল ইংরেজিতে খসখস করে লিখে ফেলল পাতাভর্তি অ্যাপ্লিকেশন। আবেগের বশে কিঞ্চিৎ বেশিই লিখেছিল বোধহয়। কারণ নিচে আমাদের সই করার জায়গা প্রায় ছিল না। বাপ্পা চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল, "করেছ কী!"
ঝোলানো চশমার ফাঁকে জুম্বাদার গম্ভীর উত্তর, "অ্যাপ্লিকেশন। কেন তোর কী মনে হচ্ছে?"
আমরাও মুচকি হেসে ছোট করে সই করে দিলাম। তারপর রেঞ্জ অফিস থেকে যদ্দূর মনে পড়ে চারশো টাকার রসিদ কেটে নেওয়া হল। ওরা জানাল 'জয়পুর ওয়াচ টাওয়ার' এখান থেকে বাসে ঘন্টাখানেকের রাস্তা। রেঞ্জ অফিসের কাজ মিটিয়ে আবার বাস রাস্তায় এলাম। কিন্তু বিধি বাম। দোকান চা খেতে গিয়ে শুনলাম, আজ বিশ্বকর্মা পুজো বলে রাস্তায় বাস প্রায় নেই। অগত্যা বাকিদের অপেক্ষা করতে বলে, প্রসেন আর আমি গেলাম গাড়ির খোঁজে। স্ট্যান্ডে কোনও গাড়ি নেই। পথে দু-একটা যাওবা চোখে পড়্ল তারা যা ভাড়া চাইল সেটা আমাদের বাজেটের বাইরে। এসব চলার মাঝেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। কপালজোরে একটা টিনের শেড পেয়ে গেলাম দুজনে। মিনিট কুড়ি দাঁড়ানোর পর আবার যখন বাকিদের কাছে ফিরলাম, দেখলাম আমরা দুজন বাদে বাকি সবাই কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের অপেক্ষা করছে। আর ইতিমধ্যে একটা মোটর ভ্যানও যেতে রাজি হয়েছে। শুধু আমাদের দুজনের অপেক্ষায় বেচারারা খোলা ভ্যানে বসে ভিজেছে। বাপ্পার তুমুল গালাগালের তোড়ে আমাদের বৃষ্টিতে শেডের নিচে দাঁড়ানোর লজিক কোথায় ভেসে গেল! মোদ্দা কথা হল যেহেতু সবাই বৃষ্টিতে ভিজেছে তাই আমাদেরও ভিজে ভিজে ফেরা উচিত ছিল। আর কথা না বাড়িয়ে আমরা ভ্যানে চড়ে রওনা দিলাম। জুম্বাদা জিজ্ঞেস করল, "রাতের জন্য কি নেওয়া হবে?"
সুদীপ্তদা বলল, "হোয়াইট…" বাপ্পা চেঁচিয়ে বলল, "ওকে। ঠিক আছে।"
সুদীপ্তদা বলল, "তুমি আর চেঁচিও না। তুমি এক বর্ণও চেঁচাতে পারোনা!"
চিকু বলে উঠল, "কাকা... বাজারটা ঘুরে যেও। রাতের জন্য কেনাকাটা করতে হবে।"
কেনাকাটা সেরে আমরা রওনা দিলাম জয়পুরের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে পিয়াল, শাল, মহুয়া, পলাশের জঙ্গল। জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে কালো পিচঢালা রাস্তা। বৃষ্টিভেজা লাল মাটির সোঁদা গন্ধমেশা সবুজের হাতছানি। যতদূর দেখা যায় ফাঁকা রাস্তা... জনশূন্য। সবুজ যেন আরও ঘন হয়ে ঘিরে আসছে আমাদের গ্রাস করার জন্য। সেই পথের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু হল গান... সে গান মাটির গান...সবুজের গান।
জয়পুর রেঞ্জ অফিসে পৌঁছলাম তখন বাজে দেড়টা। মোটরভ্যানের টাকা পয়সা মিটিয়ে গেলাম রেঞ্জ অফিসে। রসিদ দেখানোর পর রেঞ্জ অফিস থেকে ওয়াচটাওয়ারের কেয়ারটেকার লক্ষ্মণদাকে দেওয়া হল আমাদের সঙ্গে। লক্ষ্মণদার থেকে ওয়াচটাওয়ারের রাস্তা জেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে বললাম। রাস্তার ধারের টালিছাওয়া খাবারের দোকানে ঢুকলাম। আধঘন্টার অপেক্ষার পর গোল চালের ধোঁয়াওঠা গরম ভাত, মুসুর ডাল আর আলুভাতে মাখা দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। লাঞ্চ করে হাঁটা লাগালাম বাংলোর দিকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় চওড়া পিচ রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে চললাম ডানহাতি লালমাটির রাস্তায়। আঁকাবাঁকা রাস্তা চলেছে কোনও গ্রামে। পাশে একটা সদ্যকাটা পুকুর, কয়েকটা জামরুল গাছ। রাস্তা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে 'জয়পুর ওয়াচ টাওয়ার', সামনে একটা ছোট্ট চমৎকার বাগান। পাশে খোলা মাঠ। ওয়াচ টাওয়ারের ঠিক পিছন থেকেই শুরু হয়েছে জঙ্গল। সেই নিবিড় অরণ্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে জুম্বাদা, নিশ্চুপ। হারিয়ে গেছে কোন্ অসীমে। সেই অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের স্রোত যেন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমাদের।
লাঞ্চ হয়ে যাওয়ায় হাতে ছিল অগাধ সময়। একে একে স্নান সেরে এসে বসলাম আড্ডায়। নিখাদ, নির্ভেজাল বন্ধুত্বের সময়ের সঙ্গী হয়ে থাকতে। বাঙালির আড্ডার নিয়ম মেনেই এল গান, বিতর্ক, হাসি-মস্করা। আড্ডা দিতে দিতেই ঠিক হল একটু ল্যাদ খেয়ে বিকেলের দিকে জঙ্গলটা এক্সপ্লোর করতে বেরোনো হবে।
ওয়াচ টাওয়ারটা পাঁচতলা। নিচের তলায় লক্ষ্মণদার রান্নাঘর, তারপরের দুটো তলার প্রতিটাতে একটা করে রুম - দোয়েল আর শ্যামা। পরের তলায় তিনদিক খোলা ক্যাফেটেরিয়া আর তার ওপরে খোলা ছাদ। ছাদ থেকে নেমে বাগানে এলাম। বাগানের গাছ থেকে হাত বাড়িয়ে কিছু পেয়ারা পেড়ে নিয়ে চললাম জঙ্গল ভ্রমণে। সবুজ ঘাসেঢাকা মাঠে এসে খুব ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে ইচ্ছে করছিল। অগত্যা হাতের পেয়ারা ছুঁড়ে ক্যাচিং প্র্যাকটিস করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম। সময়ের কথা তখন খেয়াল ছিল না। সাড়ে চারটে কি পৌনে পাঁচটা হবে হয়তো। এরপর সূর্যও ডুবে যাবে। সুদীপ্তদা বলল, "চল আমরা একটু জঙ্গলটা এক্সপ্লোর করি।"
একে একে জঙ্গলে ঢুকলাম। কিছুটা ছাড়া ছাড়া হাঁটছি সবাই। গত কদিনের বৃষ্টিতে জঙ্গলের মাটি ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে। চারিদিকে শুধু পিয়াল, শাল, মহুয়া, সেগুন আর ইউক্যালিপ্টাসের ঘন জঙ্গল। কিছুটা ছাড়া ছাড়া গুল্মের ঝোপ। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় জঙ্গলটা যেন একটু বেশি জীবন্ত। ঘন ঘাসের বুকে আঁকাবাঁকা পায়েচলা শুঁড়িপথ। কাদায় গবাদি পশুদের পায়ের ছাপ। বেশ কিছু জায়গায় চোখে পড়ল উইঢিপি আর পিঁপড়ের বাসা। দুপুরে লক্ষ্মণদার মুখে শুনেছিলাম এই জঙ্গলে মাঝেমধ্যেই হরিণ আর হাতির পাল চোখে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম দেখা পেলে মন্দ হয় না। বাপ্পা একটু আলাদা হাঁটছিল। বাপ্পার চিৎকারে সবাই ছুটে গেলাম ওর দিকে। সম্ভবত কিছু একটা দেখেছে। মাটিতে একটা বড়সড় পায়ের ছাপ। বাপ্পা জিজ্ঞেস করল "সুদীপ্তদা এটা কি হাতির পায়ের ছাপ?"
সুদীপ্তদা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, "এরকম এক ঠ্যাং-এর হাতি তো হয় না রে! এটা কোন মোষের একটা পা হড়কে গর্তে পড়েছে সেই দাগ। আর বাকি দাগগুলো যথারীতি মোষের খুরের।" আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। আকাশে তখন গোধূলির রং লেগেছে। জঙ্গল জুড়ে পাখপাখালির ঘরে ফেরার গান। জুম্বাদা উদাত্ত কন্ঠে শুরু করল, "আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে...", একে একে গলা মেলালাম সবাই। সন্ধ্যে ঘনাতে শুরু করেছে। প্রসেন সাবধানী গলায় বলল, "আমাদের এবার ফেরা উচিত।" অন্ধকারে দিশাহীনভাবে এদিক ওদিক করার পর বোঝা গেল, ঘন জঙ্গলে আমরা পথ হারিয়েছি। একটু একটু ভয় যে লাগেনি তা নয়... এর মাঝে জুম্বাদা বলে উঠল, "আমি যেখানে আছি সেখানে তোদের ভয় কী!" শুনে সুদীপ্তদা চাপা গলায় বলল, "আমরা রবিনহুডকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি রে পাগলা ।" ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে নিল আমাদের। অন্ধকার নামতেই জঙ্গল যেন আরও ঘন হয়ে এল, সেভাবে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না একে অপরকে। ঝিঁঝিঁর ডাক আরও তীব্র হয়ে উঠল। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাওয়া আকাশ খানিকটা সাদাটে, বাকি নিকষ কালো অন্ধকার। মোবাইল রেখে এসেছি ওয়াচ টাওয়ারে। সেই অর্থে সভ্যতার সঙ্গে সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন। চিকুর কাছে ছিল ডিজিটাল ক্যামেরা। সেটার ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ছবি তোলা হল। ছবি জুম করে দেখতে বহুদূরে একটা ছাউনিগোছের কিছু চোখে পড়ল। সেদিকেই হাঁটা লাগালাম। বনবিভাগের বানানো বিশ্রামস্থল। তার মানে রাস্তা থেকে বেশি দূরে নেই। প্রায় এসে পড়েছি। বেশ আয়েশ করে বসে সিগারেট ধরালাম। আড্ডা চলল আরও কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনে পড়ল রাতে কী খাওয়া হবে তা তো লক্ষ্মণদাকে জানানো হয়নি। তাই না চাইতেও উঠতে হল। জঙ্গল থেকে বেরোনোর সময় বুঝতে পারলাম আমরা পুরো উল্টোদিক দিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিলাম। পথ হারিয়ে প্রায় একপাক ঘুরে নিয়েছি কিছুটা অংশে।
ওয়াচ টাওয়ারের সামনে গিয়ে দেখলাম গেটে তালা ঝোলানো। সাইকেল সমেত লক্ষ্মণদা বেপাত্তা। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সাইকেলের বেল বাজিয়ে লক্ষ্মণদা ফিরল। একগাল হাসি হেসে বলল, "আপনাদের দেরি হচ্ছে দেখে এই বাজারটা করে নিয়ে এলাম। কী খাবেন কিছুই তো বলে যাননি। "
-"রাতে কি খাওয়াবে?" জিজ্ঞেস করলাম।
-"আজ্ঞে, আলু দিয়ে ডিমের ঝোল আর রুটি।"
-"ফাটাফাটি..", সবাই বলে উঠল। তারপর জুম্বাদা আর আমি লক্ষ্মণদার সাইকেল নিয়ে বাজারে গেলাম। মুড়ি আর গরমাগরম তেলেভাজায় জলখাবার সারা হল।
সান্ধ্য আসর বসল ছাদে। ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়ায়, মেঘ চাঁদের লুকোচুরি, ঝিঁঝিঁর কলতানের সেই বিচিত্র পরিবেশে আমাদের নির্ভেজাল আড্ডা চলেছিল অনেকক্ষণ। নৈশাহার ঢাকা রেখে দিয়ে লক্ষ্মণদা শুয়ে পড়েছিল। আজকের ব্যস্ত সময়ে বসে সেই সময়ের হিসেব মেলানো যায় না কিছুতেই। রাতে সবাই মিলে শুয়েছিলাম একটাই ঘরে, অন্য ঘরে রাখা ছিল আমাদের লাগেজ।
সকাল হল ঝমঝমে বৃষ্টিতে। ঝোড়ো হাওয়া মনটা কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। একদিনের জঙ্গলযাপনের অবকাশ ভুলে আবার ছকে বাঁধা জীবনে ফিরে যাওয়া। হুঁশ ফিরল লক্ষ্মণদার ডাকে। কাল রাতের খরচের হিসাবপত্তর নিয়ে হাজির। ক্যাশিয়ার প্রসেন-এর হাসিতে জানা গেল বিলের তারিখ ছয় মাস আগের। লক্ষ্মণদাকে জিজ্ঞেস করতে কাঁচুমাচু মুখে জানাল, "ওই একটিই বিল আছে বাবু। যা মনে করে দেবেন তাই সই।" সাদাসিধে ভালো মানুষ লক্ষ্মণদার টাকাপয়সা মিটিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। সিম্পল মেনু ডিমটোস্ট। প্রাতরাশপর্ব মিটিয়ে একটু হাঁটতে বেরোলাম। আশপাশটা দেখার জন্য। নিঃশব্দে হাঁটছি সবাই। রাস্তার ধারে লজ্জাবতীর বনে গোলাপি ফুল ধরে আছে। জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ কুড়িয়ে কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরছে আদিবাসী রমণী। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে... তাই যতটুকু সময় আছে তার মধ্যে এই প্রকৃতির স্বাদ বুকে নিয়ে ফিরব।
ঘণ্টাদুই পর ফিরলাম। লক্ষ্মণদা বলল, "খাবার রেডি।" খেতে বসে কেউ কোনও কথা বলছে না। সবার মনখারাপ। জুম্বাদা বলল, "মনখারাপ করছিস কেন? আবার আসব এখানে, আর তখন তিন চারদিন থাকব।" দুপুর পৌনে দুটো... আমরা ব্যাগ কাঁধে বেরোচ্ছি। সবার ভীষণ মনখারাপ। বুকের ভিতরটা যেন কাঁদছে। বাংলো গেটের সামনে লক্ষ্মণদা দাঁড়িয়ে। ছল ছল চোখে বলল, "আবার আসবেন বাবুরা।"
প্রসেন হঠাৎ বলল, "পরেরবার মুদিখানার ফর্দটা চেঞ্জ কোরো কিন্তু... ", সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।
সেই মাটির রাস্তা ধরে গুটিগুটি পায়ে ফেরার পথ ধরলাম। পিছনে পড়ে থাকল শাল পিয়ালের নিবিড় জঙ্গল, দোয়েল, শ্যামা, সেই পেয়ারা গাছ, জয়পুর ওয়াচ টাওয়ার, অগণিত সবুজ স্মৃতি আর আমাদের অরণ্যের দিনরাত্রি।
তাপস মণ্ডল পেশায় বেসরকারি সংস্থার এক্সিকিউটিভ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় কাটে বই পড়ে। অন্যতম প্রিয় লেখক সত্যজিৎ রায়। ভালোবাসেন ঘুরে বেড়াতে। বিশেষ করে অফবিট জায়গায়। এছাড়া গান শোনা ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া অন্যতম পছন্দের কাজ। লেখালিখির অল্পবিস্তর চর্চা থাকলেও কোন পত্রিকায় লেখা পাঠানো এই প্রথম।