এস্টোনিয়ায় একদিন

সৌমিত্র বিশ্বাস


এস্টোনিয়ার সম্বন্ধে সম্যক ধারণা ছিল না আমাদের, কিন্তু ট্র্যাভেল এজেন্ট বললে, 'হেলসিঙ্কিতে চারদিন থাকবেন যখন, একদিনের জন্য অন্তত ট্যালিন (এস্টোনিয়ার রাজধানী) ঘুরে আসুন, আমি যাতায়াতের ফেরির টিকিটের ব্যবস্থা করে দেব।'
তথাস্ত, অতঃপর ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়াশোনা করে ট্যালিন যাওয়ার জন্য উদগ্রীব প্রতীক্ষা! অবশেষে এক বৃষ্টিভেজা শুক্রবার সকালে হেলসিঙ্কির ওয়েস্ট হারবার টার্মিনাল দুই-এ পৌঁছাই দুজনে, সাড়ে দশটার ফেরি ধরতে ট্যালিনের উদ্দেশ্যে। অগ্রিম বুকিংয়ের প্রিন্ট-আউট ও পাসপোর্ট দেখাতেই টিকিট কাউন্টারের মহিলা হাসিমুখে যাতায়াতের দুজোড়া বোর্ডিং পাস হাতে ধরিয়ে দেন। সওয়ার হই 'মেগাস্টার' নামে এক জাহাজে ।
ফেরি বললে ঠিক বোঝানো যাবে না – বারোটি ডেক-এ আঠাশশো যাত্রী আর অনেকগুলি বাস, ট্রাক ও গাড়ি বহনকারী 'মেগাস্টার' এক সুবিশাল প্রামোদতরী বিশেষ। জাহাজের খোলে ঢুকে যায় গাড়িগুলো আর ওপরের ডেকগুলিতে যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা । প্রতি ঘন্টায় ২৭ নট (প্রায় ৫০ কিমি) গতিতে 'মেগাস্টার' চালায় ৪০,৬০০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন প্রাকৃতিক গ্যাসচালিত এক পরিবেশ বান্ধবইঞ্জিন! চারটি রেস্তোঁরা, একটি কাফেটেরিয়া ও দুটি বার ছাড়াও জাহাজে রয়েছে ২৮০০ বর্গমিটারের এক 'সুপার মার্কেট' এবং আরও দুটি স্যুভেনির শপ ও কনফেকশনারি।

এছাড়া আছে বাচ্চাদের জন্য বিশাল খেলার জায়গা, বেশি দামের টিকিটের যাত্রীদের জন্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সমেত 'বিজনেস লাউঞ্জ' আর একেবারে ওপরতলায় রোদ পোয়ানোর জন্য সান-ডেক! জাহাজে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ি ক্যামেরা নিয়ে,অভ্যন্তরের নানা অংশের ছবি তুলে রাখি – ঘুরে বেড়াই এক থেকে অপরপ্রান্তে। ক্লান্ত হয়ে একসময় বসে পড়ি রেস্তোঁরার দুটি খালি চেয়ারে। হেলসিঙ্কি ছেড়ে 'গালফ অফ ফিনল্যান্ড' অতিক্রম করে ঘণ্টাদুয়েক পর জাহাজ ট্যালিন পৌঁছয়।
স্থানীয় ভাষায় ট্যালিন-এর অর্থ ডেনিশ শহর – এস্টোনিয়ার একেবারে উত্তরে অবস্থিত এ শহরের প্রাচীন নাম ছিল 'রেভাল'। সেখানে বসবাস করতেন জার্মানি, ডেনমার্ক ও অন্যান্য ইউরোগীয় দেশের উচ্চবিত্ত ব্যবসাদাররা। ট্যালিন-এর পুরোনো অংশ 'ওল্ড টাউন' নামে পরিচিত, সেটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের সাক্ষ্যবহনকারী। অতি যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত সুপ্রাচীন শহরটি ইউনেস্কো-র 'বিশ্ব ঐতিহ্যভূমি' (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট) হিসাবে স্বীকৃত। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত অট্টালিকাগুলি গথিক স্থাপত্যের, ষোড়শ শতাব্দীরগুলি রেনেসাঁস শৈলীর আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি বেশ কিছু ভবন বারোক স্থাপত্যের চিহ্ন বহন করে ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে জার্মান সেনাবাহিনী এস্টোনিয়া থেকে সরে গেলে রাশিয়ার রেড আর্মি দখল নেয় দেশটির। ১৯৪৪ সালে এস্টোনিয়া যুক্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য হিসাবে। পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২০ আগস্ট এস্টোনিয়া পায় স্বাধীনতা; ২০০৪ সালে সদস্য হয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর ২০১১ সালে অন্তর্ভুক্ত হয় ইউরোজোন-এর। বর্তমানে এস্টোনিয়ার অর্থনীতি বেশ তুঙ্গে,নাগরিকদের গড়পড়তা আয় বছরে প্রায় তিরিশ হাজার ইউরো। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে মাথাপিছু স্টার্ট-আপ-এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে এস্টোনিয়াকে বলা হয় 'ইউরোপের সিলিকন ভ্যালি'। সুবিখ্যাত ভিডিও কম্যুনিকেশন সফটওয়্যার 'স্কাইপ'সহ আরো বেশ কিছু বহুলব্যবহৃত সফটওয়্যার প্যাকেজ-এর জন্মস্থল এস্টোনিয়ায়। ন্যাটোর সাইবার সিকিউরিটি ডিফেন্স সেন্টার ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা অবস্থিত ট্যালিন-এ। বিশ্বের প্রথম দশটি ডিজিটাল শহরের মধ্যে ট্যালিন তার পাকা জায়গা করে নিয়েছে।
জাহাজ ট্যালিন পৌঁছলে দেখি প্রকৃতিদেবী সদয় হয়েছেন, মেঘ-বৃষ্টি সরে গিয়ে ঘননীল আকাশে সূর্যের ঝিলিক। মহানন্দে বেরিয়ে পড়ি প্রাচীন ট্যালিন-এর উদ্দেশ্যে, পথনির্দেশ অনুসরণ করে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছে যাই পুরনো শহরের প্রবেশদ্বারে। রাস্তায় পেরোতেই সবুজ ঘাসের গালিচামোড়া এক উদ্যান – বেশ কয়েকটি মহীরূহ বসন্তের আগমনে কচি পাতায় সজ্জিত, কিছু গাছ আবার রঙবেরঙের ফুলের ভারে অবনত। পার্কে ব্রোঞ্জনির্মিত আধুনিক সব ভাস্কর্য। পুরনো শহরের প্রবেশদ্বারে ফুলের বাজার – নানা বর্ণের, নানা বৈচিত্র্যের ফুলের সম্ভার, চোখধাঁধানো টিউলিপের ছড়াছড়ি চারিদিকে। নিমেষে মন ভালো করে দেওয়ার এক মোক্ষম দাওয়াই।

দুটি ছোট মিনার (Turret) প্রবেশদ্বারের দুইপাশে, ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করি এক স্বপ্নরাজ্য। পাথরের (Cobblestone) রাস্তা, দুধারে সুরম্য প্রাচীন অট্টালিকাসমূহ, কিছু বাড়ির কেন্দ্রে প্রশস্ত উঠোন। প্রধান সড়কে এসে মিশেছে উত্তর কলকাতার গলির মত সরু রাস্তা, সেখানেও একের পর এক বাড়ি – অপরূপ তাদের স্থাপত্য। আর্চ-আকৃতির দরজা-জানালা ও অলঙ্কৃত অলিন্দ নিয়ে যায় স্থাপত্যের এক মায়াবী জগতে। এক পরমাশ্চর্য পরিবেশ – সময় যেখানে থমকে গেছে সাতশ বছর আগে। পুরনো শহরে পাব আর ক্যাফেটেরিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আর আছে বিশ্বের নানা দেশের রান্নাঘর নিয়ে অগুন্তি রেস্তোঁরা। এছাড়াও রয়েছে অজস্র বুটিক – সিরামিক, টেরাকোটা, ক্রিস্টাল, পাথরের তৈরি দ্রব্যাদি, ছুরি-কাঁটা ও কাচের বাসনকোসন, নয়নাভিরাম পুতুলের দল, স্থানীয় শিল্পীদের আঁকা ছবি, ক্রুশের কাজ করা বিছানার চাদর থেকে মহিলাদের স্টোল ও স্কার্ফ,হাতেবোনা মোজা – হস্তশিল্পের এক অফুরন্ত প্রদর্শনী! আঙুল ব্যস্ত হয় ক্যামেরার শাটারে, ধরে রাখি চারিপাশের নানা দৃশ্যপট মুগ্ধ বিস্ময়ে।

ধীরে ধীরে পৌঁছে যাই পুরোনো শহরের কেন্দ্রে এক পাবলিক প্লাজা বা সুবিস্তীর্ণ চত্বরে – সেখানেও নানান হাতের কাজ ও স্যুভেনির শপ - পরিচালনায় এস্টোনিয়ান মহিলারা, দলে দলে বিদেশি ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ভিড়ে যাই স্যুভেনির সংগ্রহে। হঠাৎ খোলা চত্বরে জার্মানির ব্যাভেরিয়া অঞ্চল থেকে আসা একঝাঁক মিউজিশিয়ান নানা বাদ্যযন্ত্রসহকারে শুরু করেন সঙ্গীতের মূর্ছনা আর তাঁদের দলের চার তন্বী লোকনৃত্যে মাতিয়ে তোলেন দর্শকদের – ট্যুরিস্টরা বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেন সে প্রাণোচ্ছল পরিবেশন। কিছুক্ষণ পর পেটে খিদের মোচড়, সেন্ট্রাল প্লাজার একটি রেস্তোঁরায় 'ফিস অ্যান্ড চিপস' ও এস্টোনিয়ান ড্রাফট বিয়ার দিয়ে সারি আমাদের মধ্যাহ্নভোজন।
ক্লান্ত পদক্ষেপে ফিরে চলি জাহাজঘাটার দিকে – সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ছাড়ে ফিরতি ফেরি। জাহাজের 'ডিলাইট ব্যুফে' নামের রেস্তোঁরায় মেঝে থেকে ছাদ অবধি কাচেঢাকা জানালার পাশের টেবিলে বসে পড়ি। ব্যুফে ডিনারের খাদ্যতালিকা থেকে যে কাকে ছেড়ে কাকে বাছি – বিভিন্ন আমিষ ও নিরামিষ স্যালাড, আরবদেশের হামাস, নানা রকমের বাদাম, কোরিয়ান স্যালাড - কিমচি, নরওয়েজিয় পিঙ্ক স্যামন,বল্টিক হেরিং, দু-তিন রকমের চিংড়ি, বড় ঝিনুক, মুরগির মাংসের তিন-চার রকমের পদ, বিফ, পর্ক, অন্তত পাঁচ/ছয় রকমের নিরামিষ সবজি, চাইনিজ ন্যুডলস, বাসমতী চালের ভাত এসব মিলিয়ে এক এলাহি ব্যাপার - এরপর আবার ডেজার্টের এক বিশাল কাউন্টার! আর কল খুলে ভরে নাও রেড ওয়াইন, হোয়াইট ওয়াইন ও বিয়ারের গ্লাস যত ইচ্ছে...
সন্ধ্যা সাড়ে নটায় হেলসিঙ্কির বন্দরে ভিড়ল আমাদের জাহাজ। দুই পা তখন বিদ্রোহী, কিন্তু মন টইটুম্বুর ট্যালিনের রূপবৈচিত্র্যে!


সৌমিত্র বিশ্বাস পেশায় কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ার। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকে সুদীর্ঘ আঠাশ বছর কর্মজীবনের পর বর্তমানে কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিতে (সি-আই-আই) কর্মরত। কর্মসূত্রে পৃথিবীর বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন। বিশেষ শখ আলোকচিত্রগ্রহণ।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher