গঙ্গোত্রী-গোমুখ – দেবভূমি হিমালয়

পারমিতা মুখোপাধ্যায়


জীবনের সবকিছুই অনিত্য। কেবল স্মৃতিই রয়ে যায় – সে সুখকর হোক বা বেদনাময়। মা চলে গিয়েছেন আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল। মাঝে মাঝে যখন একা হই; মায়ের কথা মনে পড়ে; কিংবা কেবল একা কেন? এমনিও মনে পড়ে অনেক সময় অথবা বলা যায় যে মায়ের কথা সব সময়েই মনে থাকে। মাঝেমধ্যে মনের পাল্লাটা খুলে যায় দমকা হাওয়ায় আর একরাশ দখিনা বাতাসের মত কত স্মৃতি ভিড় করে আসে। ভ্রমণের এক অদম্য 'প্যাশন' ছিল মায়ের। 'প্যাশন' বললাম এই কারণে যে, ভ্রমণ বিনে মায়ের জীবন ছিল অর্থহীন। বছরে একবার কী দুবার চেনা ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে পথে না নামতে পারলে মায়ের একটুও ভাল লাগত না। ভ্রমণের বই এবং পত্রপত্রিকাও ছিল অজস্র মায়ের সংগ্রহে। তেমনি একটি বই উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভ্রমণ অমনিবাস। মায়ের মৃত্যুর পর যখন মন ছিল শোককাতর অশান্ত সেই সময় উমাপ্রসাদের হিমালয় ভ্রমণের বর্ণনা এবং অভিজ্ঞতা মনকে অনেক শান্ত করেছিল। নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম হিমালয়ের গহন সৌন্দর্যে।

হিমালয়ে যে কবার গেছি তার সিংহভাগ পরিকল্পনাই ছিল মায়েরই করা। তারই অদম্য উৎসাহে পাড়ি জমিয়েছিলাম হিমালয়ের পথে পথে। কেদার-বদ্রী, গঙ্গোত্রী-গোমুখ, সিমলা-কুলু-মানালি, নৈনিতাল-আলমোড়া-রানিক্ষেত বা নেপাল অথবা দার্জিলিং।

আজ বড় লিখতে ইচ্ছে করছে গঙ্গোত্রী-গোমুখের যাত্রা নিয়ে। সে অনেকদিনই হল। প্রায় আড়াই দশক আগেকার কথা। অনেক কিছুই তুলে আনতে হবে স্মৃতি খনন করে। তা হোক, তবু লিখতে শুরু করলে দেখা যাবে গল্পের মতো স্তরে স্তরে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে কাহিনি বিন্যাস।

তখন সবে আমার বিএসসি পার্ট টু পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মায়ের অনেক দিনের ইচ্ছে গোমুখ দর্শনের। তার বছর পাঁচেক আগে কেদার-বদ্রী দর্শনের পর আর গাড়োয়াল হিমালয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তাই গোমুখ দর্শনাভিলাষী আমরা তিনজন –বাবা, মা আর আমি হাওড়া থেকে পূর্বা এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। মে মাস। দিল্লিতে তখন প্রচণ্ড গরম। নিউ দিল্লি স্টেশনে নেমেই তার তীব্রতা মালুম হল। থার্মোমিটারের পারদ ছুঁয়েছে সেদিন ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। দিল্লিতে রাত্রিবাস না করে সেদিনই বাসে চেপে চলে গেলাম হরিদ্বার -গাড়োয়াল হিমালয়ের প্রবেশদ্বার। যতটা এগিয়ে থাকা যায় আর কী! পৌঁছলাম যখন সূর্য গেছে অস্তাচলে। কিন্তু তখনও ক্ষীণ আভা ছড়িয়ে আছে আকাশ জুড়ে। মায়াময় হালকা কমলা রঙে ভরে আছে হরিদ্বার। হরিদ্বারে গঙ্গা কলনাদিনী – সবে নেমে এসেছে হিমালয়ের গিরিখাত ভেদ করে। গঙ্গার তীর ধরে অজস্র ধর্মশালা, দোকানপাট, হোটেল। উঠলাম ভোলাগিরি আশ্রমে। দুরাত্রি বাস এখানে। তারপরে তো গঙ্গোত্রীর পথে। কাজেই মোটামুটি একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই যথেষ্ট। আশ্রমে সাদামাঠা ঘর, কমন স্নানঘর। চৌকির ওপর শোওয়ার জন্য কোনো গদি নেই। বাহুল্যবর্জিত, প্রায় সন্ন্যাসীর মতো। তা হোক, যে তীর্থপথে যাত্রা করেছি, সেখানে বাহুল্য বিড়ম্বনা বলেই মনে হয়। হিমালয়ের অপরূপ তুষারমৌলি রূপই এ পথের সম্পদ। আর কোনো সম্পদের প্রয়োজন নেই।
ভোলাগিরি আশ্রমে উঠলেও খাওয়াদাওয়া সারা হল দাদা বৌদির হোটেলেই। সেই আদি অকৃত্রিম দাদা বৌদির হোটেল যেখানে খাওয়া শুরুর আগে বাসমতী চালের সাদা ঝরঝরে ভাতে এক চামচে সুগন্ধি ঘি ঠিক পড়বেই!

ভোলাগিরি আশ্রমে বাঙালিদেরই ভিড়। একটি দলের সঙ্গে আলাপ হল। তারা চলেছে কেদার-বদরী। সেই দলে একটি মাঝবয়সী বউ এসেছে একলাই। এসে তো সে পড়েছে কিন্তু হরিদ্বার থেকেই তার চিন্তা শুরু। কেদার-বদরী ঠিকমত পৌঁছতে পারব তো? স্বামী ছেলেকে ছেড়ে একলাই এই দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে, এখন দুশ্চিন্তার অন্ত নেই! ভরসা দিই, চিন্তা করবেন না। নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবেন ঠিকমতই। জয় কেদার বলে এগিয়ে পড়ুন। বলি বটে কিন্তু চিন্তার ভূত তার মাথা থেকে যায় কই! আসলে বিদেশ-বিভুঁই; আত্মীয়স্বজন বিনা একাই এসেছে, তাই চিন্তা হয় বৈকি! বিপদে পড়লে তখন কে বা কার! আবার এও মনে হয় যাঁর দর্শনের অভিলাষে পথে বেরোনো, তিনিই ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবেন। তাঁর শরণাগত হয়েই এগিয়ে চলা। জানি না, ভদ্রমহিলার কেদার-বদরী দর্শন হয়েছিল কিনা, পরে আর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি।

হরিদ্বার থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল উত্তরকাশী। গঙ্গোত্রী গোমুখ যেতে হলে উত্তরকাশী দিয়েই যেতে হয়। পাহাড়ের উচ্চতা বেশি হওয়ায় সইয়ে সইয়ে যাওয়া উচিত। তা না হলে উচ্চতাজনিত কারণে শরীর খারাপ হতে পারে। তাই পরিকল্পনা ছিল উত্তরকাশীতে দুদিন রাত্রিবাস করে যাত্রা করব গঙ্গোত্রীর পথে।

হরিদ্বার থেকে প্রতিদিন সকালে উত্তরকাশীর বাস ছাড়ে। আগের দিন টিকিট বুকিং করে রাখা হয়েছিল। নির্ধারিত দিনে উত্তরকাশীর বাসে উঠে বসলাম। হরিদ্বার থেকে হৃষিকেশ; সেখান থেকে হিমালয়ের চড়াই শুরু। বাস পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে উঠতে শুরু করে। নিচু হয়ে কী একটা জিনিস খুঁজতে গেছি ব্যাগে, মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি জানালার দিকে মুখ করে বসি। জানালা দিয়ে তাজা হাওয়ায় ঝলক আসে। শরীরের আনচান ভাবটা কমে।

পথের দৃশ্য অপূর্ব। হিমালয়ের কোলে আসার এই তো পরম আনন্দ! পথের সৌন্দর্যকে প্রাণভরে দেখা। পাহাড়ের অবিশ্রাম ঢেউ; গিরিখাতে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর উচ্ছ্বাস আর সর্বোপরি গঙ্গার পাশ দিয়ে চলা – এ কি কম সৌভাগ্য!
উত্তরপ্রদেশ পরিবহন নিগমের বাসে চলেছিলাম। পথে একবার বাস খারাপও হয়ে গেল। কাজেই উত্তরকাশী পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল। হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশীর দূরত্ব তো খুব কম নয়। প্রায় একশো সত্তর কী আশি কিলোমিটার।

উত্তরকাশীতে থাকার জায়গা মিলল হোটেল ভাণ্ডারীতে। এখন আর সে হোটেল আছে কিনা কে জানে। গঙ্গোত্রী যাওয়ার মূল প্রবেশদ্বার বলা চলে উত্তরকাশীকে। এর উচ্চতা ১১৫৮ মিটার। উত্তর ভারতের কাশী নামানুসারে এই জায়গার নাম উত্তরকাশী। কাশীর মতই এরও অবস্থান গঙ্গার তীরে। কাছাকাছি একটি পর্বতশিখরের নাম বরুণাবত। উত্তরকাশী শহরের মধ্যেও একটি শিবমন্দির আছে কাশী বিশ্বেশ্বর শিবের মন্দিরের মত। উত্তরকাশী এখন উত্তরাখণ্ড রাজ্যে পড়েছে এবং এটি উত্তরকাশী জেলার সদর শহর। আমাদের গঙ্গোত্রী তো বটেই, গোমুখ যাওয়ারও ইচ্ছা আছে। সুতরাং উত্তরকাশীতে যে দুদিন থাকব মনের মধ্যে গোমুখ যাওয়ার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হওয়ার আকাঙ্খাতেই কাটবে। নিজেকে প্রস্তুত করা হিমালয়ের ক্রোড়ে সঁপে দেওয়ার জন্য।

পরদিন বিকেলের দিকে বেরোলাম শহরটা ঘুরে দেখতে। ভাগীরথীর উপরে ঝুলাপুল পার হয়ে ওপারে গেলাম। বাড়িঘরের দরজায় তালা লাগানো নেই দেখলাম। এখানে চুরি ডাকাতি হয় না।
পরদিন সকালবেলা গঙ্গোত্রীগামী বাসে চড়ে বসলাম। উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রী যাত্রাপথের দূরত্ব প্রায় সাতানব্বই কিলোমিটার। ভাটোয়ারি, গাংনানি, হরসিল হয়ে তারপর গঙ্গোত্রী। যাত্রাপথের সৌন্দর্য অতুলনীয়। মনে হয় পথের কষ্ট সার্থক হিমালয়ের এমন নয়ন মনোহর দৃশ্য অবলোকন করে। পাহাড়ের গা বেয়ে পথ, কোথাও কোথাও আবার পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে রাস্তা চলে গেছে। ছবির মত সুন্দর হরসিল। গঙ্গা নেমে আসছে কলধ্বনি করে; হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায় হিমালয়ের উত্তুঙ্গ চূড়া। এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্য হিমালয় ছাড়া আর কোথাও আছে বলে তো মনে হয় না।

গঙ্গোত্রী পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। বাস থেকে নামতেই হিমেল হাওয়া ছুটে এল অভ্যর্থনা করতে। তুমুল বেগে বয়ে চলেছে পুণ্যসলিলা ভাগীরথী।

থাকার জায়গা মিলল পাঞ্জাব সিন্ধ ধরমশালায়। পাহাড়ের গায়ে দোতলা কাঠের বাড়ি। দোতলায় আমাদের জন্য যে ঘরটি খুলে দেওয়া হল, সেটিতে কোন আসবাবপত্র নেই। কয়েকটি গদি পাতা রয়েছে কাঠের মেঝেতে। রাতে সেখানেই শোওয়ার ব্যবস্থা। সারাদিনের বাসযাত্রার ধকলে ক্লান্ত ছিলাম। সন্ধেবেলা কিছুটা নিচে নেমে ছোট একটা দোকানে রুটি-সবজি খেয়ে এসে শুয়ে পড়লাম কম্বল মুড়ি দিয়ে। পরদিন গোমুখের পথে যাত্রা শুরু হবে।

যেতে হবে পায়ে হেঁটে। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। প্রথম ১৪ কিলোমিটার গিয়ে পৌঁছতে হবে ভুজবাসায়। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে আরো ৪ কিলোমিটার দূরে গোমুখ দর্শন করে সেদিনই নেমে আসতে হবে গঙ্গোত্রীতে।

রাতেই অত্যাবশ্যক জিনিসগুলি ব্যাগে গুছিয়ে রাখা হয়েছিল। বিশেষ করে ওষুধপত্র, শুকনো খাবার, গরম জামাকাপড়। বোঝা বেশি বাড়ানো চলবে না কারণ পথ দুর্গম। মাল বওয়া বড়ো দুঃসাধ্য।
ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে সকাল আটটার সময়ই হাঁটা শুরু করলাম তিনজনে। সঙ্গে অবশ্য একজন গাইডও ছিল মালপত্র বওয়া এবং পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। লোকজন মোটামুটি চলেছে – খুব বেশি যদিও নয়; তবু পথ ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে আর পাহাড়ি রাস্তা এসব জায়গায় বিপদসঙ্কুলও। প্রত্যেকে হাতে একটা করে ছড়ি নিয়েছি। পাহাড়ি রাস্তায় ভর দিয়ে চলার জন্য এইসব ছড়ি বড় উপযোগী।

শুরু হল গোমুখের পথে চলা। জয় গঙ্গামাঈ কী জয়। পথ চলতে চলতে ক্রমশ প্রকাশ হয় নগাধিরাজের অপরূপ রূপ। আকাশ ঘন নীল। সেই নীলের গায়ে ঘুমিয়ে আছে বরফের সুউচ্চ পর্বত। সে যে কী সুন্দর না দেখলে কল্পনা করা যায় না। চড়াই বাড়াবাড়ি কিছু তখনও শুরু হয়নি। পাহাড়ের গা বেয়ে ঢেউখেলানো পথ এঁকেবেঁকে চলেছে। একদিকে গভীর খাদ। সেখান দিয়ে বয়ে চলেছে কলনাদিনী ভাগীরথী। মাঝে মাঝে দুটো একটা ছোটখাটো ঝরনা; তার ওপর দিয়ে ছোট কাঠের পুল। অনেকটা পথ পেরিয়ে হয়তো একটা ছোট্ট ছাউনি দেওয়া দোকান। চায়ের জল ফুটছে। পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করতে এক কাপ চা বড়ো উপাদেয়। দোকানে দুদণ্ড বসলে পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য মনকে শান্ত করে তোলে।

গঙ্গোত্রী থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে চিরবাসা। চির মানে পাইন গাছ। এখানে পাইন গাছ প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়, তাই এর নাম চিরবাসা। উচ্চতা ৩৩৫০ মিটার। চিরবাসায় বেশ কিছু দোকান রয়েছে। এগুলোকে 'চটি' বলা হয়। এরকমই একটি চটিতে সামান্য কিছু খাওয়াদাওয়া হল - রুটি, সবজি। হাঁটার সময় বেশি কিছু খাওয়াও যায় না। এখনও ভুজবাসা পৌঁছতে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার বাকি। এই পাঁচ কিলোমিটার পথ বড় দুর্গম। কিছুটা হাঁটার পরেই পড়ল ঝুরঝুরে পাহাড়ি পথ। সবসময়ই নুড়ি পাথর গড়িয়ে পড়তে থাকে অঞ্চলটায়। প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তা খুব তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতে হয়। কোথাও কোথাও রাস্তার নিশানা তেমন নেই, পা রাখার জায়গা আছে মাত্র। পা ফসকালেই ভাগীরথীর অতলে তলিয়ে যেতে হবে। রাস্তা শুরু এবং শেষে সাইনবোর্ড লাগানো আছে বিপদসঙ্কুল পথ সম্বন্ধে সতর্ক করে। পথশেষে সাইনবোর্ডে 'ধন্যবাদ' শব্দটি দেখে ধড়ে প্রাণ আসে। কিন্তু সেইসঙ্গে আবার এও মনে হয় যে ফিরতে হবে এ পথেই!

যাই হোক, এগিয়ে চলেছি ভুজবাসার দিকে। ওখানেই আজ রাত্রিবাস। বেলা দুটো বেজে গিয়েছে। আবহাওয়াও খারাপ হয়ে আসছে। বেশ ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। অথচ সকালেও আকাশ খুব পরিষ্কার ছিল। প্রায় বিকেল চারটে নাগাদ ভুজবাসা পৌঁছলাম। ভুজবাসায় থাকার জায়গা দুটি। একটি লালবাবার চটি আর একটি গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের কটেজ। সেই কটেজে একটা রুম পাওয়া গেল। বেশ ভাল। অমন দুর্গম জায়গায় এতো ভাল রুম, অ্যাটাচড টয়লেট পাওয়া যাবে কল্পনাই করিনি। রাতে আবহাওয়া কিন্তু বেশ খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি শুরু হল। জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ছে এবার মালুম হচ্ছে। পরদিন আরও ৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে গোমুখ দর্শন করে, কালকেই গঙ্গোত্রী নেমে যেতে হবে। আবহাওয়া তো খারাপ হয়ে গেল, দেখা যাক কাল কী হয়।
ঘুম ভাঙল ভোরবেলায়। বৃষ্টি নেই, কিন্তু বাইরে বেরিয়ে দেখি ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হয়েছে। ডাইনিং হলে চা ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে শুনলাম গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের কর্মচারীরা বলাবলি করছে, 'আভি সব নীচে উতার যাও। বরফ গিরনে লাগা। মৌসম অর খারাব হো যায়গা তো মুশকিল হোগা। রাস্তা বন্ধ হো যায়গা'।

খুব ঘাবড়ে গেলাম। মনটাও খারাপ হয়ে গেল। এতদূর এসে ফিরে যেতে হবে? এ যে তীরে এসে তরী ডোবা। কত কষ্ট করে আসা, এভাবে সব প্রচেষ্টা জলে যাবে? মায়ের মন এত খারাপ যে চায়ের গেলাসই উলটে গেল অসাবধানে হাত লেগে। সব চা গেল পড়ে। কর্মচারীরা অবশ্য বিরক্ত হল না। বলতে লাগল, কোই বাত নেহি। কোই বাত নেহি।

আর কী করা! ঘরে গিয়ে বিষণ্ণ মন নিয়ে বসে আছি।
এতদূর এলাম; জাহ্নবী তোমার উৎসমুখ কি না দেখেই ফিরে যেতে হবে!
মনের ভেতর উথালপাথাল; কেমন যেন একটা কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে গলার ভেতর...
হতাশা, ব্যর্থতা গ্রাস করতে থাকে ক্রমশঃ।
জানালার পর্দা সরাতে যাই ঘরে যাতে আলো আসে; হঠাৎ মনের মধ্যে আশার আলো ঝলকে ওঠে। আকাশটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে না?
হ্যাঁ, তাই তো!
আকাশে নীলের ছোঁয়া লেগেছে। পেঁজা তুলোর মত তুষারপাত আর নেই। অদূরে তুষারধবল শৈলচূড়া হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
না, আর দেরি নয়। গঙ্গামায়ী মুখ তুলে চেয়েছেন। চলো, ভাগীরথীর উৎসমুখের উদ্দেশ্যে এখনি বেরিয়ে পড়া যাক।

গায়ে বর্ষাতি চড়িয়ে নিই। লাঠি হাতে নিয়ে টুকটুক করে এগোতে থাকি। ভাগীরথীর তীর ধরে পথ চলা। মাত্র ৪ কিলোমিটার দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়। নয়নসম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে গোমুখ-আকৃতি হিমবাহ – যার অন্তঃস্থল থেকে নির্গত হচ্ছেন পুণ্যসলিলা ভাগীরথী। এই ভাগীরথী, অলকানন্দা, মন্দাকিনীর সম্মিলিত ধারা সৃষ্টি করবে পবিত্র গঙ্গা - মাতারূপে ঢেলে দেবেন তাঁর জলধারা আমাদের প্রাণসিঞ্চনে। নদী – সে তো মা-ই। নদীই জল; জলই জীবন। যে জীবন দান করে, মায়ের চেয়ে বড়ো আর কী অভিধানেই বা তাঁকে ভূষিত করা যায়?

দুচোখ সার্থক হয়। তবে বেশি দেরি করি না। আবার কখন আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাবে। নামতে শুরু করি। এইদিনই ফিরে যেতে হবে গঙ্গোত্রী। গোমুখের উচ্চতা ৪০২৩ মিটার আর গঙ্গোত্রী ৩৪১৫ মিটার। তখন বেলা প্রায় দশটা। ক্রমাগত একনাগাড়ে হেঁটে যখন গঙ্গোত্রী পৌঁছই, রাত প্রায় আটটা বাজে। ক্লান্ত শরীর কোনরকমে এলিয়ে দিই পাঞ্জাব সিন্ধ ধরমশালার কাঠের মেঝেতে।

বাইরে গঙ্গোত্রীর লোকালয়ে পাহাড়ের গায়ে ফুটে উঠছে বাতির আলো। গঙ্গোত্রী মন্দিরে আরতি শুরু হয়েছে। ঘন্টার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে।
সে এক অপূর্ব অনুভূতি!
জয় গঙ্গামায়ী কী জয়!!

ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি, গানবাজনা, ছবি আঁকার চর্চা করেছেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়। বিবাহের পর স্বামীর সঙ্গে নভি মুম্বইয়ে বসবাস প্রায় দেড় দশক ধরে। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল অবধি আনন্দবাজার পত্রিকার 'মুম্বই' ক্রোড়পত্রে নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। বর্তমানে যুক্ত রয়েছেন নভি মুম্বইয়ের একটি পত্রিকার সহ-সম্পাদকরূপে। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ প্রভৃতি সব রকমের লেখাতেই স্বচ্ছন্দ। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নয়টি। এর মধ্যে দুটি ছোটগল্পের সংকলন, একটি উপন্যাস ও একটি জীবনীগ্রন্থ। 'দেশ', 'সানন্দা' পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন।


HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher