কনকচৌরির কার্তিক মন্দির

অরিন্দম পাত্র


কনকচৌরি (স্থানীয় উচ্চারণে কনকচোরি) নামটা বেশ সুন্দর, তাই না? নামটা আমার শোনা বেশ কিছুদিন ধরেই। অনেকদিনই ভেবেছি যাব, যাব। কিন্তু ভয়ে পিছিয়ে এসেছি বার বার। কারণ? কারণ আর কিছুই না… ওই হাঁটার ভয়ে!
একটু বুঝিয়ে বলি। ভ্রমণ পত্র-পত্রিকা পড়ে বা ফেসবুকে ট্রাভেল গ্রুপ ঘেঁটে আপনারাও নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছেন যে এই কনকচৌরি গ্রাম থেকেই যেতে হয় কার্তিকস্বামী মন্দির। তাও আবার ৩ কিমি পায়ে হেঁটে। তবেই পৌঁছাতে পারবেন মহাদেব-পার্বতী পুত্র কার্তিকের মন্দিরে। হিমালয়ের বুকে কার্তিক ঠাকুরের ওই একটিই মন্দির। তাও আবার এত উঁচুতে!
কিন্তু এত ঠাকুর আর দেবদেবী থাকতে শুধু কার্তিক ঠাকুরের মন্দিরে যাওয়ার এত উদগ্র ইচ্ছা কেন সবার? আসলে ওই মন্দিপ্রাঙ্গণ হল হিমালয়ের ব্যালকনি। মন্দিরের ঠিক পেছনেই ১৮০ ডিগ্রি জুড়ে শুধু হিমালয় আর হিমালয়। তার সঙ্গে অসম্ভব সুন্দর আর চোখজুড়ানো সূর্যোদয়!
তা সেইসব দেখতেই তো এবারের গাড়োয়াল ভ্রমণে আসা। কয়েক মাস ধরে অনেক খোঁজখবর নিয়ে, রিসার্চ করে, আগে যারা এসেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে বুকও করে ফেলেছিলাম সঞ্জয় সিং নেগি'র কার্তিকেয় প্যালেস। দুদিন হৃষিকেশে কাটিয়ে সকাল সকাল রওয়ানা হবার কথা ছিল কনকচৌরি। কিন্তু ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জার গেল বিগড়ে!! তাই সকাল দশটায় হৃষিকেশে দোকান খুলতে একটা বিকল্প চার্জার কিনে তবে রওনা হওয়া গেল!
দীর্ঘ পথ যাত্রা করে রুদ্রপ্রয়াগ হয়ে চললাম কনকচৌরির পথে। আরও প্রায় ৩৮ কিমি। মাঝে শ্রীনগরে লাঞ্চ করার জন্য থামা হয়েছিল একবার।
বেলা পড়ে আসছে। সূর্য্য অস্ত যেতে বসেছেন প্রায়! দু-একবার গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করছি, যতটা সম্ভব কমই অবশ্য। কনকচৌরি থেকে কিমি দুয়েক আগে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে আমাদের পুত্র বমি করে দুপুরের খাবারদাবার সব তুলে ফেলল! বিহ্বল আর হতভম্ব লাগছিল তখন! নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিল। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ছেলেটা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরছে! হঠাৎ কী হল! দুপুরের খাওয়াটা কি তবে ভাল ছিল না? এইদিকের খাওয়াদাওয়া সব নিরামিষ, যদিও বড্ড ঝালমশলা সমৃদ্ধ! সহ্য হচ্ছে না সেই হৃষিকেশ থেকেই! যাইহোক, ওকে গাড়ি থেকে নামিয়ে, চোখেমুখে জল দিয়ে আর ওষুধ খাইয়ে একটু চাঙ্গা করার চেষ্টা করলাম।

মিসেস ততক্ষণে রাগে অগ্নিশর্মা!! এবারের যাত্রায় যে পুরোটা না হলেও অনেকটাই হাঁটাপথ সেকথা ওদের বহুবার বুঝিয়েছি। তারপর ওরা গাঁইগুঁই করলেও আমিই জোরাজুরি করে আসতে বাধ্য করেছি। এরপরে আমার এই শখপূরণের ঠ্যালায় ছেলে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে… সেটা তো খুব খারাপ হবে।
মিনমিন করে মিসেসকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ফের গাড়ি স্টার্ট করালাম। ওদিকে পাহাড়ে আর আকাশের গায়ে তখন অদ্ভুত রঙের খেলা! এক অপার্থিব দৃশ্যপটের রচনা হয়েছে। সূর্যের শেষ আলোয় রাঙা মেঘরাশির উপরে গোল থালার মত পূর্ণচন্দ্র উদিত হয়েছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! তবে সেই স্বর্গীয় শোভা ক্যামেরাবন্দী করার জন্য ফের গাড়ি দাঁড় করানোর রিস্ক আর নিলাম না মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছাল কনকচৌরি গ্রামে।
খুব ছোট্ট,জবুথবু এক অজ পাড়াগাঁ। বেশি খুঁজতে হল না… একটু এগিয়েই পেয়ে গেলাম কার্তিকেয় প্যালেস। তবে প্যালেসসুলভ তো নয়ই… হঠাৎ করে দেখলে ভিরমি খেতে হয়। ছোট্ট একটা চায়ের দোকান, ওপরে হোর্ডিংয়ে লেখা "কার্তিকেয় প্যালেস"! দোকানের এক পাশে গুটিকয়েক বেঞ্চি আর টেবিল পাতা, আর একদিকে স্টোভ আর গ্যাস জ্বালিয়ে দশভূজার মত রান্নাবান্না, চা বানানো, ওমলেট ভাজতে ব্যস্ত ক্যাপমাথায় সদাহাস্যময় এক ব্যক্তি। ইনিই সঞ্জয় সিং নেগি, যাঁর সঙ্গে এর আগে মাত্র দুবারই হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়েছে রুম বুকিং করার সময়।
গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে বলতেই উনি শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বললেন "আরে দাদা! আপ লোগোকা রুম রেডি হ্যায়! আইয়ে!" গাড়ির ডিকি থেকে মালপত্র নামিয়ে নিজেই পাশের খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নিয়ে এলেন। একটু নিচে পাশাপাশি দুটো ঘরের একটায় আমাদের আজকের আস্তানা গাড়ার কথা। লাগোয়া বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে এখানকার সবচেয়ে নামী রিসর্ট মায়াদীপের কটেজগুলি। আর চোখ চলে গেল আকাশের দিকে… অন্ধকার নেমে এলেও জ্বলজ্বল করে বিরাজমান সেই পথের সঙ্গী পূর্ণচন্দ্র!
আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে নেগিজি ওপরে চলে গেলেন রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। ওদিকে ঘরে ঢুকে মা আর ছেলে তখন পথের ক্লান্তি ভুলে রেগে অগ্নিশর্মা! খুবই ছোট্ট আট বাই আট-এর একটা ঘরের প্রায় পুরোটাই জুড়ে রয়েছে দুটো খাট। বাকি যা জায়গা রয়েছে,তার সবটাই দখল করে নিয়েছে লাগেজগুলো। ওরা রেগেমেগে বলল "এ কোথায় এনেছ? এ তো রীতিমতো অজ পাড়াগাঁ!"
আমার তখন পালাই পালাই অবস্থা। কোনোমতে ঢোঁক গিলে, আমতা আমতা করে বোঝালাম একটা রাত একটু কষ্ট করে কাটিয়ে নাও। কাল কার্তিকস্বামী মন্দির দর্শন করেই বেরিয়ে যাব উখিমঠ। নিমরাজি হল, তবে শর্ত দিল যে ওরা এই অসুস্থ শরীরে হাঁটাহাঁটি করতে পারবে না। মন্দির ট্রেকিং আমাকে একাই করতে হবে। ওরা এখানেই রেস্ট নেবে ততক্ষণ। আমি সেই শর্তেই রাজি তখন! বাঁচতে হবে তো আগে!
ওদের ঘরে একটু বিশ্রাম নিতে দিয়ে লাগোয়া বারান্দাটায় চলে এলাম চন্দ্রালোকিত রাতের কনকচৌরির ছবি তোলার চেষ্টা করার উদ্দেশ্য নিয়ে। ক্যামেরা নিয়ে খুটখাট করতে থাকলাম। সকাল দশটায় বেরিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছি সন্ধ্যা ছটায়। ঝুপ করে আঁধার নেমে এসেছে যেন। শুনশান চারিদিক। খুব কম জনবসতি এখানকার। রাত আটটার মধ্যে রাতের খাবার সেরে নেওয়া গেল। খুব হালকা করে ভাত (চাওল), অঢ়হর ডাল আর আলু-জিরা। সঞ্জয় সিং বলে গেলেন যে রাত সাড়ে তিনটে'র সময় আসবেন ডাকতে। হোমস্টে-এর আরও একটি ফ্যামিলির তিন জন যাবেন আর আমি। যাত্রা শুরু আগামীকাল ভোর চারটেয়। "শো যাইয়ে সাবজি"!
সঞ্জয় সিং-এর পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। দরজা ভেতর থেকে আটকে শুয়ে পড়লাম। চুপচাপ শুয়ে সাতপাঁচ ভাবতে লাগলাম। কাল এতটা পথ চড়ে উঠতে পারব তো! নিজের ওপর সেরকম কনফিডেন্স নেই নিজেরই। ওরা তো কাল আর যাচ্ছে না! যাক একটু হলেও চিন্তা কমল। নিজে হাঁচোড়পাঁচোড় করে চড়ে যেতে পারব আশাকরি। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেশ সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম! খুব ঠান্ডা একটা জায়গা, বেশ উঁচুতে, আর প্রচুর ঘন্টা চারিদিকে। ঘন্টাগুলো একসঙ্গে টুং টাং করে যেন বাজছে… ওপরে খোলা আকাশ। ভোরের আকাশের মতন লালচে। তারপর আর কী যেন দেখলাম?

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল মোবাইলের অ্যালার্মের রিংটোনের আওয়াজে। তাকিয়ে দেখি রাত তিনটে কুড়ি বাজে! আসলে ইন্টারনেটে আর পত্রিকার ছবিতে এত বার কার্তিকস্বামী মন্দিরের ওই ঘন্টাগুলো দেখেছি যে স্বপ্নেও পিছু ছাড়েনি ওই দৃশ্য। মনে মনে হেসে উঠে পড়লাম। হাতে আপাতত পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট আছে। চোখেমুখে জল দিয়ে, ব্রাশ করে, একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বাকি দুজন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গায়ে গরম জ্যাকেট আর মাথায় টুপি চাপিয়ে পিঠের ব্যাগে টুকিটাকি জিনিস, জলের বোতল ভরে নিলাম। আর অবশ্যই টর্চ!! ক্যামেরা তো আছেই!
পৌনে চারটে নাগাদ দরজায় খুব মৃদু টোকার আওয়াজ পেলাম। সঞ্জয় সিং প্রস্তুত। প্রত্যুত্তরে আওয়াজ দিয়ে ওঁকে আশ্বস্ত করলাম। আমাকে রেডি হয়ে আসতে বলে উনি ওপরে চলে গেলেন। তৈরি হয়ে দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে ওপরে চলে এলাম। ওপরে এসে দেখি সঞ্জয় সিং আর তাঁর সহোদর ভাই রেডি। সঙ্গী হলেন ভোলানাথ ব্যানার্জি মহাশয় এবং ওঁর পরিবারের আরও দুজন সদস্য। ওঁরা ওপরের তলায় এই হোম স্টের একটি ঘরেই উঠেছেন। সকলের জন্য একটা করে লাঠির বন্দোবস্ত করে ফেললেন সঞ্জয়জি। উনি এবং ওঁর ভাইও সঙ্গে যাবেন।

হোম স্টের পাশ দিয়েই রাস্তা শুরু হয়েছে। সবাই মিলে হাঁটা শুরু করলাম। একটু এগিয়েই চড়াই ওঠা শুরু। রাস্তার বিশেষত্ব হচ্ছে খুব একটা খাড়াই না হলেও প্রচন্ড এবড়োখেবড়ো। আর ভোররাতের শিশিরে ঘাস খুব ভিজে রয়েছে। তাই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। নয়তো পিছলে যেতে পারে। পায়ে পাতি খাদিমের জুতো… ট্রেকিং শ্যু-ফু কিছুই আনিনি। জানিওনা ছাই কোথায় পাওয়া যায়। ভগবানের নাম নিতে নিতে এগিয়ে চললাম লাঠি সম্বল করে। তবে পিঠের ভারী ব্যাগের দায়িত্ব আমাকে আর নিতে হচ্ছে না। সঞ্জয় সিং স্বতঃস্ফূর্তভাবে পিঠের ব্যাগ আর ক্যামেরার ব্যাগ দুই-ই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আপত্তি জানাতে গেলাম, হাঁ হাঁ করে উঠলেন। "আরে আপ শরমাইয়ে মাত! চলতে রহিয়ে।"
অগত্যা এগিয়ে যেতে থাকলাম। সঙ্গী ভোলানাথ বাবুর সঙ্গেও অনেক কথা হতে থাকল। ওঁরা পাকাপোক্ত ট্রেকার। এর আগে অনেকগুলো রুটে হেঁটেছেন। এবারেও এখানে এসেছেন কেদারনাথ ঘুরে। স্বভাবতই নভিশ আমি ওঁর সাহচর্যে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। মাঝে মাঝে লাঠি ফসকাচ্ছে নিচের জমি। তখন পা ব্যাকআপ কভারেজ দিচ্ছে। এই ভাবেই তিন ঠ্যাঙে ওঠা চলতে থাকল। মাঝেমধ্যে একটু দাঁড়িয়ে বা বসে বিশ্রাম আর দম নেওয়া। তারপর আবার হাঁটা শুরু।

চারিদিকে ঘন জঙ্গল আর প্রচুর গাছগাছালির সমাহার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। একমাত্র পাঁচটা টর্চের আলো জ্বলছে। পেছনে আরও দুটো-একটা দল ওঠা শুরু করেছে। হঠাৎ খেয়াল পড়ল অনেকদিন আগে, কোথায় খেয়াল নেই, পড়েছিলাম এক ভদ্রলোকের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায়, উনি নাকি জংলি জানোয়ারের অস্তিত্বের আভাস পেয়েছিলেন আশেপাশে। তৎক্ষণাৎ সঞ্জয়জিকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা। উনি অবলীলাক্রমে বললেন, "হ্যাঁ, তা তো আছেই। জানোয়ার বলতে চিতা আর ভাল্লুকই আছে এদিকটায়।" শুনেই গলা শুকিয়ে কাঠ! ব্যাগ হাতড়ে জল খাব কিনা ভাবছি, উনি বলে উঠলেন, "লেকিন ঘাবড়ানা মাত! উওহ লোগ ইনসান দেখকে আশপাশ নেহি আতা!"
শুনে টেনশন কমল আবার কমলও না! যাইহোক কিছু করার নেই,এসেই যখন পড়া গেছে! মনে মনে পুরনো একটা গান গুন গুন করে গাইতে শুরু করলাম… "শোচনা ক্যায়া, যো ভি হোগা দেখা যায়েগা!" এতক্ষণে কতটা উঠেছি বুঝতে পারলাম না। সঞ্জয়জির ভাই সতীন্দর বললেন প্রায় দেড় কিমি উঠে এসেছি। মাঝে মাঝেই খাদের পাশ থেকে রুদ্রপ্রয়াগের রাতের আলো তারার মত ঝিকমিক করছে। আরও একটা দলের সঙ্গে মাঝপথে দেখা হল। দলের দুজন বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে এখন বাকিদের জন্য ওয়েট করছেন। হাই হ্যালো করে এগিয়ে চললাম। শুনলাম মন্দিরের বেশ খানিকটা আগে একটা চায়ের দোকান আছে। ওখানে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাবে। দূর থেকে সম্ভবত সেই দোকানের আলোই দেখা যাচ্ছে। চলতে চলতে অনেকটা পথই পার হয়ে এসেছি। প্রথম প্রথম যতটা কষ্ট আর দমের ঘাটতি হচ্ছিল, এখন আর ততটা হচ্ছেনা।
ঘড়িতে এখন বাজছে চারটে পঞ্চাশ। চায়ের দোকানটা সামনেই। গাইডদ্বয় বললেন, "ওয়েল ডান"... মাত্র পঞ্চাশ মিনিটে অনেকটাই উঠে এসেছি। এরপর এখান থেকে মন্দিরের সিঁড়ি শুরু। প্রায় দেড়শো-দুশো ধাপ পেরিয়ে তবে পাহাড়ের মাথায় কার্তিকেয় দেবের মন্দির।
আমার আবার চা, কফি, সিগারেট কিছুই চলেনা। বাকিরা গলা ভেজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দোকানের সামনে বসে সঞ্জয়জির থেকে ক্যামেরার ব্যাগটা হাতবদল করে নিলাম। এইবারে আমার কাজ শুরু। এতদিন ধরে যে স্বপ্ন সযত্নে লালন পালন করে এসেছি, সেটা সফল করার মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। সবাই হিসেব করলেন যে এখান থেকে ধীরেসুস্থে উঠলে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আরামসে পৌঁছে যাওয়া যাবে। বলা হল সূর্যোদয়ের টাইম মোটামুটি ছটা থেকে সোয়া ছটা। সুতরাং অনেকটা সময় আছে হাতে!
মিনিট দশেক পরে সবাই চাঙ্গা হয়ে গাত্রোত্থান করলেন। এবার সিঁড়ি চড়ার পালা। খুব খাড়াই সেগুলো আর বেশ বড় বড়। দেখেশুনে পা ফেলে উঠতে হচ্ছে। পেছনের দু-তিনটে দলের গুঞ্জন আরো কাছে এসে পড়ছে। সব মিলিয়ে কতজন হবে তা অবশ্য জানিনা। আকাশের একটা দিক আস্তে আস্তে লালচে হয়ে উঠছে।

অবশেষে মন্দিরপ্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হওয়া গেল! ঢোকার মুখেই সেই সার সার ঘন্টার সারি … রাতের স্বপ্নে যেগুলো মাঝেমধ্যেই আসে, যাদের ছবি কতবার দেখেছি নেটে আর ট্র্যাভেল ম্যাগাজিনে। বেশ বড় একটা চত্বরের মাঝে অবস্থান মন্দিরটার। চারপাশ রেলিং দিয়ে বাঁধানো, ঠিক ব্যালকনির মতোই - হিমালয়ের ব্যালকনি। পেছনদিকে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। আস্তে আস্তে সবাই এসে ভিড় জমাচ্ছেন।
ছটা পাঁচ…দশ…পনেরো… দিনের প্রথম আলো আস্তে আস্তে পুব দিগন্ত রাঙা করে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে সব কটি শৃঙ্গ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। কোনটা কী জানিনা! সঙ্গী দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি এক এক করে চিনিয়ে দিলেন সব। ভাগীরথী-১, ২, ৩, কেদারনাথ, কেদারডোম, নীলকন্ঠ, নন্দাদেবী, নন্দাঘুন্টি, আর সবচেয়ে সহজে যেটা চেনা গেল তা হল চৌখাম্বা! তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! হাতি পর্বতের পিছন থেকে টুক করে মুখ বাড়িয়ে মাথা তুলল সূর্য। ভোরের আকাশ এক লহমায় মোহময় হয়ে উঠল। আবিরের রঙে যেন রক্তিম হয়ে উঠল গোটা আকাশ। পাঁচ-ছয় বছর পাহাড়ে বেড়াচ্ছি, খুব বেশিদিন নয়। এত ভাল সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আগে হয়নি! দার্জিলিং-এর টাইগার হিল থেকেও সানরাইজ দেখতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। তাই এই অপরূপ দৃশ্য চিরকাল মনে রাখব!

ক্যামেরার মেমোরি কার্ডে ততক্ষণে কম করে হলেও সাতশো ছবি বন্দী হয়ে গেছে। পকেট হাতড়ে দেখলাম তাড়াহুড়োয় মোবাইলটা ফেলে এসেছি। ভরসাস্থল হয়ে উঠলেন সেই সঞ্জয় সিং নেগি। ওনার মোবাইলে বেশ কয়েকটা সেল্ফি তুললাম দুজনে। তারপর মন্দিরে পূজারীজির কাছে পুজো দিয়ে, কপালে টীকা এঁকে ফিরে যাওয়ার পালা। ফিরতে গিয়ে ওই সিঁড়িগুলোর কাছে এসে মাথাটা ঘুরে গেল। খাড়াই সিঁড়ি আর পাশেই অতল খাদ। অন্ধকারে বোঝা যায়নি। ভয়ঙ্কর সুন্দর সেই দৃশ্য। খাদের পাশে সেই অসাধারণ সুন্দর প্রকৃতির মাঝে গাইড কাম হোমস্টে মালিককে বললাম, "দাদা, এক ফোটো হো যায়ে? দোনো হাত ফ্যায়লাকে এক সিগনেচার এস আর কে পোজ দিজিয়ে না!" সঞ্জয় সিং আমার কথামতো তাই করলেন আর আমিও খচাখচ ক্যামেরার শাটার চালালাম। ছবিগুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেব কথা দিলাম।
এরপর নেমে আসার পালা। নেগিজি বললেন একটু সামলে আর দেখে নিচে নামতে। কিন্তু তখন আর পায় কে! জীবনের প্রথম পায়ে হেঁটে পাহাড়চূড়োয় ওঠার অভিজ্ঞতা ছেলেকে শোনাতে যাওয়ার আনন্দে আমি তখন আত্মহারা! তাছাড়া নিচে নেমে রেডি হয়ে, ব্রেকফাস্ট সেরে চেকআউট করে রওনাও দিতে হবে। গন্তব্য উখিমঠ।

 

পেশায় চিকিৎসক (নাক কান ও গলা বিশেষজ্ঞ) অরিন্দম পাত্রের নেশা ছবি তোলা। এছাড়াও দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ভ্রমণ করা তাঁর আর এক শখ।


 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher