বেত্রবতী নদীতীরে উপেক্ষিতা ওরছা

পৃষতী রায়চৌধুরী

 

একটি পাখিকে দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখার পর হঠাৎ একদিন খাঁচার দরজা খুলে বার করে দিলে সে যেমন উড়তে গিয়ে হোঁচট খাবে, ঠোক্কর খাবে, তার আঁধার-সওয়া, আলোয় অনভ্যস্ত চোখ যেমন খোলা আকাশের ঝকঝকে রোদ্দুরে ধাঁধিয়ে যাবে, গাড়িটা ক্যাম্পাসের গেট পেরিয়ে শহরের রাস্তায় পড়া মাত্র ঠিক সেই অনুভূতিই হল আমার। ২০২০-এর মার্চ থেকে মার্চ, ২০২১ - বন্দীদশার বর্ষপূর্তি। ক্যাম্পাসের লক্ষণরেখা পেরোইনি গুণে গুণে বারোটি মাস। চার দেওয়ালের মধ্যে নিরন্তর ঠোক্কর খেতে খেতে হাঁপিয়ে ওঠার পর আজ যেন তাই 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত'। আদেখ্লার মত হাঁ করে তাকিয়ে দেখি রাস্তার দুধারে বয়ে চলা জীবনপ্রবাহ। যেন জন্মে দেখিনি এমন মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে থাকি ঠেলাগাড়িতে স্তূপ করে বিক্রি হতে থাকা চিকন-সবুজ শসা-কাঁকরি, নানাপ্রকার নমকিন আর পাঁপড়ের সম্ভার, সাদা পুরুষ্টু ফোলা ফোলা মাখানার স্তূপ, সিমেন্টের বস্তাঠাসা গুদামঘর, স্টিল রডের গোডাউন, টাইলস আর মার্বেলের দোকান, থরে থরে সাজানো আসন্ন গ্রীষ্মের মোকাবিলায় তৈরি কুলারের বাক্স। দেখি রকমারি বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং – অমুক কোচিং সেন্টার থেকে কতজন জয়েন্ট এন্ট্রান্সে পেয়েছে, তমুক ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্ডেন স্কুলটি স্বর্গের কতটা কাছাকাছি, তমুক সুপার-স্পেশালিটি হসপিটালে কত যত্ন নিয়ে চিকিৎসা করাবে ইত্যাদি। দেখেশুনে মনে হল শিক্ষা আর স্বাস্থ্যই শেষ অবধি সবচেয়ে বড় কমোডিটি। রাস্তার এপাশে লাল-হলুদ শাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে প্যান্টশার্ট পরিহিত এক টিকিধারী হাপুসহুপুস ফুচকা খাচ্ছেন, অন্যদিকে নির্বিকারে জাবর কেটে চলেছেন খুঁটিবাঁধা এক গোমাতা। বহুদিনের অদর্শনে চারপাশের তুচ্ছ গতানুগতিক দৃশ্যরাও আজ আমার কাছে মূল্যবান। তৃষিতের মত এইসব দৃশ্য-শব্দ-গন্ধ চাখতে চাখতে একসময় হাইওয়েতে উঠি। ধীরেধীরে শহরের সীমানা পেরিয়ে যাই। বাড়িঘর, দোকানপাট বিদায় নিয়ে এখন রাস্তার দুধারে চৈত্রের খাঁ খাঁ মাঠ। বেশিরভাগ ক্ষেতই শুখা, ফসল তোলার পর ধূধূ পড়ে আছে। কোথাও কোথাও গেঁহু, বাজরা আর সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে। মাঝেমাঝে বাবলার জঙ্গল।

শুক্রবারের বিকেল। তাড়াতাড়ি বেরোনোর শত চেষ্টা করেও ঠিক সেই সাড়ে চারটে বেজেই গেল। কাল্পি শহরে ঢোকার মুখে যমুনা নদীর সেতুতে উঠলাম তখন যমুনার জলে অস্তগামী সূর্যের ছায়া। কানপুর-ঝাঁসি হাইওয়ে ধরে চলেছি এখন। গন্তব্য কানপুর থেকে আড়াইশো কিলোমিটার দূরের এক ছোট্ট জনপদ – ওরছা। ভারতবর্ষের হাই-প্রোফাইল ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনের তালিকায় ওরছার নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে না আছে কোনো মনোহর সমুদ্র সৈকত, সফেন জলরাশি, না আছে সুউচ্চ কোনো পর্বতমালা, নেই কোনারক বা খাজুরাহোর মত কিন্নর-কিন্নরীশোভিত তেমন কোনো মন্দির, বা তাজমহলতুল্য কোনো বিস্ময়কর শ্বেতশুভ্র মার্বেলের স্থাপত্য, অথবা বান্ধবগড়ের মত শার্দূল-বিচরিত অরণ্য। তাহলে কী আছে এখানে? কেন কিছু মানুষ তবু আসে? কে জানে, হয়তো তারা আসে বিস্মৃত ইতিহাসের হৃদ্স্পন্দন শুনতে। চারশো-পাঁচশো বছরের পলিমাটি সরিয়ে তার নিচে চাপা পড়ে থাকা অতীতের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জয়-পরাজয়, গৌরবগাথার কাহিনিতে ডুব দিতে। বুন্দেলখন্ডের এই রুক্ষ পাথুরে মাটিতে, পাতাঝরা শালবনে, রাঙা আগুনজ্বালানো পলাশ-শিমূলের জঙ্গলে,বেত্রবতীর কুলুকুলু জলস্রোতে, শতাব্দী-প্রাচীন কেল্লায়, পাথরের মন্দিরে আর ছত্রীর খাঁজে খাঁজে কান পাতলে শোনা যায় কতসব বিচিত্র কাহিনি, উপাখ্যান, লোককথা, উপকথা। অনুভূত হয় শত শত বছরের ইতিহাস আর যুগ যুগের কল্পনার মিশেলে তৈরি হওয়া আলোআঁধারির জাফরিকাটা রহস্যময়তা।
আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল কানপুর থেকে। ঝাঁসিকে ডাইনে রেখে যখন বাঁদিকের টিকমগড়- ঝাঁসি রোডে বাঁক নিলাম,তখন অদূরে ঝাঁসি শহরের আলোকমালা দেখা যাচ্ছে। এখানে উত্তরপ্রদেশকে বিদায় জানিয়ে মধ্যপ্রদেশে প্রবেশ। একদা যা ছিল বুন্দেলখন্ড, এখন তা বিভক্ত উত্তরপ্রদেশ আর মধ্যপ্রদেশের মধ্যে।
ওরছা পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা বাজল। বেত্রবতীর তীরে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের অতিথিনিবাস – বেতোয়া রিট্রিট। দুটি হেরিটেজ স্যুইট আর গোটাকুড়ি স্যুইস টেন্ট নিয়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বানানো অতিথিনিবাসটি। পাথরের খাঁজ কেটে কেটে ছোট ছোট চাতালে একেকটি তাঁবু, তাদের ঘিরে শাল-পলাশ-অমলতাস-জাকারান্ডা গাছেদের ভিড়। এমনই একটি তাঁবুতে আমাদের দু'রাতের আশ্রয়। রিসর্টের গা ঘেঁষেই বয়ে চলেছে বেত্রবতী নদী। স্থানীয় নাম – বেতোয়া। নদীর জলে তখন গাঢ় আঁধার ঘনিয়েছে। শুধু ছলাৎছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাথরের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে জলরাশি জানান দিচ্ছে তার বিরামহীন বহমানতা।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর সোজা ফোর্ট কমপ্লেক্সের চত্বরে। ফোর্টের সিংহদুয়ারে কয়েকজন স্থানীয় যুবা মোটরসাইকেলসহ ইতস্তত দাঁড়িয়ে। এরা সব ওরছার ট্যুর গাইড। খানিক কথাবার্তার পর এদেরই একজনের ওপর আমাদের নগরপরিদর্শনের ভার ন্যস্ত হল। হেমন্ত সিং গাউর নাম্নী ওরছার সেই ভূমিপুত্রের সঙ্গে দুর্গপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করলাম। ইতিহাসের চাকা ধীরে ধীরে গড়াতে লাগল উল্টো দিকে। পিছিয়ে গেলাম পাঁচশত বছর সময়কাল।

ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধ। উত্তরভারতের রাজনীতিতে সদ্য ঘটে গেছে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন। লোদি সুলতানবংশের হাত থেকে দিল্লির সিংহাসন ছিনিয়ে নিয়েছেন তরুণ এক মুঘল বীর। তিনি নাকি মাতৃকূলের দিক দিয়ে দুর্ধর্ষ মঙ্গোলীয় যোদ্ধা চেঙ্গিস খানের এবং পিতৃকূলের দিক দিয়ে তুর্কি যোদ্ধা তৈমুর লঙ্গের উত্তরসূরী। দিল্লির সিংহাসন দখলের পরই উত্তর ও মধ্যভারতের অন্যান্য রাজ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারে বিশেষ সচেষ্ট নতুন বাদশা। উত্তরভারতের এই রাজনৈতিক পটভূমিকায় মধ্যভারতের বুন্দেলা বংশের রাজপুত রাজা রুদ্র প্রতাপ সিং মুঘল আগ্রাসন থেকে নিজের রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য তাঁর রাজধানী গড়কুণ্ডা থেকে সরিয়ে এনে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও কিছুটা দুর্গম কোনো জায়গায় স্থাপন করার পরিকল্পনা করছিলেন। একদিন শিকারে বেরিয়ে বেত্রবতী নদীর তীরে জঙ্গলে ঘেরা একটি পাথুরে সমতল জায়গা দেখে তাঁর মনে হল, রাজধানী স্থাপনের জন্য এ একেবারে উপযুক্ত স্থান। বুন্দেলখন্ডি ভাষায় 'ওরছা' শব্দের মানে হল লুক্কায়িত বা 'hidden'। চারদিকে উঁচু টিলা আর ঘনজঙ্গলে ঘেরা জায়গাটি খানিক সেরকম।

ওরছাতে রাজধানী স্থানান্তরিত করার পর প্রথমেই স্থানটিকে উঁচু পাথরের প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত করালেন রাজা রুদ্র প্রতাপ। অতঃপর শুরু হল কেল্লা তৈরির কাজ। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার কিছুকালের মধ্যেই একদিন শিকারে গিয়ে এক শার্দূলের আক্রমণে আহত হলেন রাজা। দিনকয়েকের মধ্যে সেই ক্ষতস্থানে পচন হয়ে মৃত্যু হল তাঁর।
১৫৩১ সালে রুদ্রপ্রতাপের মৃত্যুর পর রাজা হলেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ভারতী চাঁদ বুন্দেলা। ইনি অসমাপ্ত কেল্লার নির্মাণকার্য সমাপ্ত করালেন। ফোর্টের আর্কিটেকচার হল রাজপুত ঘরানার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ঘরানার মিশেলে। ততদিনে মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্যশৈলী এদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চতুষ্কোণ একটি বাঁধানো চাতাল ঘিরে সারি সারি খিলান আর গম্বুজের সমন্বয়ে তৈরি চতুর্তল প্রাসাদ।

সূক্ষ্ম পাথরের জালি-কাজের কারুকার্যখচিত ঝুলন্ত বারান্দা প্রাসাদের চারদিক ঘিরে। পিলারে, কার্ণিশে, দেওয়ালে সর্বত্র পাথরের সূক্ষ্ম কারুকাজ। আলো-বাতাস চলাচলের উপযুক্ত খোলা বাতায়ন, পাশাপাশি দুটি মহলের মাঝে উন্মুক্ত ছাদ, যাকে বলে ওপেন টেরেস, স্কাইলাইট-যুক্ত অলিন্দ – সমস্তই একাধারে বিজ্ঞানসম্মত ও দৃষ্টিনন্দন।
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমস্থাপত্যের রীতি মেনে এখানে রাজদরবারও দুটি ভাগে বিভক্ত। দিওয়ান-ই-আম ও দিওয়ান-ই-খাস। আমজনতার জন্য সাধারণ দরবার আর বিশেষ অমাত্যদের সঙ্গে শলা-পরামর্শের জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট মন্ত্রণাকক্ষ। আর রয়েছে ফ্রেসকো। দেওয়ালজোড়া, ছাদ-জোড়া উজ্জ্বল রঙিন সব ফ্রেসকো। কী নিপুণ সেইসব অঙ্কন! কী উজ্জ্বল তাদের রঙের বাহার! মনেই হয়না, চার-পাঁচশো বছর বয়স সেগুলোর। কিছু ছবি কালের প্রকোপে সামান্য রঙ হারালেও, বেশিরভাগ ছবিই এখনও উজ্জ্বল। ছবিগুলিতে বর্ণিত হয়েছে হিন্দু পুরাণের কাহিনি, রাধাকৃষ্ণের লীলা, রামায়ণের নানা ঘটনা। রয়েছে বিষ্ণুর দশাবতারের ছবিও। প্রতিটা অবতারকে স্পষ্টভাবে চেনা যায় ও গল্পগুলোও বোঝা যায়। শাক্য রাজপুত্র গৌতম বুদ্ধও বিষ্ণুর অবতার হিসেবে চিত্রিত। এছাড়াও কোনো কোনো কক্ষে রয়েছে রাজার শিকারের দৃশ্য, রাজসভার দৃশ্য, সুন্দরী রাজপুত রমণীর কেশসজ্জা ও প্রসাধনের চিত্র।

কেল্লার সীমানার বাইরে একটু দূরে একটা মন্দির দেখা যাচ্ছে। ফোর্টের প্রায় প্রতিটা অংশ ও প্রতিটি ঘর থেকে মন্দিরটি দৃশ্যমান। হেমন্ত সিং গাউর সেই মন্দিরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল - ওহ্ যো মন্দির দেখ রাহে হ্যায় না আপলোগ, ওহ্ হ্যায় চতুর্ভুজ মন্দির। উসকে সাথ ভি বহত সারে কাহানি জুড়ে হুয়ে হ্যায়। কাহানির নামে আমরা যে যার মোবাইল, ছবি তোলা ইত্যাদি স্থগিত রেখে উৎকর্ণ হলাম। সিংজি বলতে শুরু করলেন -
১৫৫৪ সালে ভারতী চাঁদ বুন্দেলা অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে ওরছার সিংহাসনে বসলেন রুদ্রপ্রতাপের আরেক পুত্র মধুকর শাহ বুন্দেলা। রাজা হবার পর মধুকর শাহ বুন্দেলাদের আরাধ্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণের একটি মন্দির নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এদিকে তাঁর রানি গণেশ কুঁয়ারি আবার রামচন্দ্রের ভক্ত। এই নিয়ে রাজা-রানির মধ্যে বিরোধ শুরু হল। অবশেষে রানির ইচ্ছে মেনে নিয়ে রাজা রামচন্দ্রের জন্য এই চতুর্ভু্জ মন্দির তৈরির কাজ শুরু করলেন। চতুর্ভুজ বিষ্ণুর নামে এই মন্দিরের নাম। রাজা ও রানি হয়তো এই ভেবে সন্ধিতে এসেছিলেন যে হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী কৃষ্ণ ও রাম দুজনেই তো সেই বিষ্ণুরই অবতার, সুতরাং বিরোধে কাজ কী। যাহোক, মন্দিরের কাজ শুরু হবার পর মহারানি গণেশ কুঁয়ারি অযোধ্যা সফরে গেলেন রামচন্দ্রের একটি উপযুক্ত মূর্তি আনার জন্য। অযোধ্যা থেকে রামের মূর্তি নিয়ে ওরছা নগরীতে ফিরে রানি দেখলেন মন্দির তৈরির কাজ তখনও সামান্য বাকি আছে। ততদিন রামমূর্তিকে অস্থায়ীভাবে নিজের বাসভবন 'রানিমহল'-এই রেখে দিলেন। শেষে মন্দির সম্পূর্ণ হলে যখন রামের মূর্তিকে মন্দিরে স্থাপনের সময় হল, তখন নাকি সেই মূর্তিকে আর কেউ সেখান থেকে ওঠাতে পারে না। রানির স্মরণ হল তিনি একদা স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে রামচন্দ্রের মূর্তি প্রথম যেখানে স্থাপিত হবে, সেখানেই তাঁর মন্দির করতে হবে। যাহোক, এতে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াল, রানিমহল সেই থেকে হয়ে গেল জনসাধারণের জন্য অবারিত দ্বার 'রাম রাজা মন্দির' আর অনন্যসুন্দর স্থাপত্যের চতুর্ভুজ মন্দির বহুকাল বিগ্রহহীন হয়ে পড়ে রইল। পরে সেখানে রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি স্থাপনা করে কৃষ্ণের পুজো শুরু হয়।

গল্প শোনার পর দ্বিগুণ উৎসাহে চতুর্ভুজ মন্দির ও রাম-রাজা মন্দিরের ছবি তুলতে লাগলাম। তবে দুটিতেই এখনও দুবেলা পুজো হয় এবং যথেষ্ট ভক্ত সমাগম হয় শোনার পর কোভিড ভাইরাসের সম্মান রক্ষার তাগিদে এযাত্রা আর মন্দিরচত্বরে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম না। কেল্লার নিরাপদ দূরত্ব থেকেই মন্দিরদর্শন করে আর ছবি তুলে সন্তুষ্ট থাকলাম।

এদিকে বুন্দেলাদের গল্প এগিয়ে চলল। মধুকর শাহের ছিল আট পুত্র। রাজার মৃত্যুর পর তাঁর আট পুত্রের মধ্যে রাজ্য ভাগ হয়ে গেল। ওরছার রাজা হলেন বড় রাজপুত্র রাম শাহ বুন্দেলা। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে মনে রাখেনি। মনে রেখেছে মধুকর শাহের অন্য পুত্র বীর সিং দেওকে। বীর সিং দেও পেয়েছিলেন বড়ৌনির জায়গিরদারি, কিন্তু তিনি ছিলেন অসম্ভব উচ্চাকাঙ্খী, সাহসী আর দূরদর্শী। সামান্য ওই জায়গিরে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল সমগ্র বুন্দেলখন্ডের একছত্র অধিকার।
দিল্লির বাদশাহ্ আকবরের সঙ্গে সেসময় তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সেলিমের বিরোধ চলছে। পিতার বিরুদ্ধে একপ্রকার বিদ্রোহই ঘোষণা করেছেন সেলিম। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে সেলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন বীর সিং দেও। ইলাহাবাদে গিয়ে দেখাও করে এলেন বিদ্রোহী যুবরাজের সঙ্গে। এইসময় বাদশাহ্ আকবর তাঁর একান্ত সুহৃদ আবুল ফজলকে পাঠালেন সেলিমের সঙ্গে মধ্যস্থতা করার জন্য। আকবরের নররত্ন সভার অন্যতম রত্ন আবুল ফজল ছিলেন একাধারে আইন-ই-আকবরি ও আকবর-নামার মত বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা, বীর যোদ্ধা এবং সম্রাটের প্রধান পরামর্শদাতা। কিন্তু বিচক্ষণ ও বীর হলেও আবুল ফজল সম্ভবত প্রস্তুত ছিলেন না পথিমধ্যে ওরছার রাজপুত রাজাদের কাছ থেকে কোনো অতর্কিত আক্রমণের জন্য। বীর সিং দেও বুন্দেলা তাঁকে অতর্কিতে আক্রমণ করে পরাজিত করলেন, এবং হত্যাও করলেন। শুধু তাই নয়, আবুল ফজলের ছিন্নমস্তক লাল শালুতে মুড়ে রুপোর থালায় সাজিয়ে ভেট পাঠালেন এলাহাবাদে সেলিমের কাছে। ১৬০২ সাল সেটা। ক্রোধে দিশাহারা হয়ে গেলেন আকববর, তবু তাঁকে ক্রোধ সম্বরণ করতে হল, কারণ অপর দুই পুত্র মুরাদ ও দতিয়ান ততদিনে মৃত এবং তিনি নিজেও বৃদ্ধ হয়েছেন। সুতরাং মুঘলসাম্রাজ্যের স্থিতির জন্য রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যস্থতায় পিতাপুত্রের পুনর্মিলন সংঘটিত হল। বছর তিনেক পরে আকবরের মৃত্যু হলে যুবরাজ সেলিম জাহাঙ্গীর নাম নিয়ে হিন্দুস্তানের মসনদে বসলেন। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের দুঃসময়ের বন্ধু বীর সিংহ দেওকে স্মরণ করলেন, পাঠালেন প্রচুর নজরানা এবং ওরছার রাজা হিসেবে তাঁর রাজতিলকের পরোয়ানা।

বীর সিং দেও-এর অতিথি হিসেবে ওরছাতে এলেন বাদশাহ জাহাঙ্গীর। তাঁর সম্মানে বীর সিং দেও বানালেন একটি মনোরম প্রাসাদ। ফিরোজা নীল ও সবুজ রঙের মিনে করা পাথরের কারুকাজ করা মিনার, গম্বুজ ও খিলানে শোভিত 'জাহাঙ্গীর মহল' নামের এই প্রাসাদটিও সপ্তদশ শতকের রাজপুত ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্যশৈলীর মিশেলের এক অপূর্ব নিদর্শন হয়ে ওরছা ফোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিনের রঙগুলো যদিও এখন অনেক জায়গাতেই খসে গেছে, তবু কোনো কোনো খাঁজ থেকে বা কোনো খিলানের তলায় উঁকি মারে সেই নীল-সবুজের ঝলকানি।

বীর সিং দেও-এর আমলে বুন্দেলখন্ড রাজ্যের সীমানা অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ঝাঁসি, কাল্পি, মাহোবা, দাতিয়া, পান্না, সাগর, চিত্রকূট এই সমগ্র এলাকা নিয়ে ছিল বুন্দেলখন্ড রাজ্য। বলা হত, দক্ষিণে নর্মদা, উত্তরে তামস বা টনস, পশ্চিমে চম্বল আর পূর্বে যমুনা – এর মধ্যবর্তী পুরো অঞ্চল ছিল বুন্দেলখন্ডের অন্তর্গত। ঝাঁসি আর দতিয়ার কেল্লাও বীর সিং দেও-এর আমলেই তৈরি। কথিত যে, বৃদ্ধবয়সে বীর সিং দতিয়া থেকে ঝাঁসির কেল্লা দেখতে না পেয়ে বলেন, 'আঁখমে পুরা ঝাঁসি দিখাই যাতি'। অর্থাৎ সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। সেই থেকে ঝাঁসির ওই নামকরণ। পরে ঝাঁসি ও বুন্দেলখন্ডের অনেকখানি অংশ মারাঠাদের দখলে চলে যায় এবং কেল্লাটি রানি লক্ষ্মীবাঈ-এর সঙ্গে ব্রিটিশ আর্মির যুদ্ধের পর একপ্রকার ধ্বংসই হয়ে যায়।

যাইহোক, ওরছাতে ফিরে আসি। জাহাঙ্গীরমহলের একটি অংশে এখন মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের হেরিটেজ হোটেল হয়েছে, নাম - 'শিশমহল'। ওরছার মূল ফোর্টটির প্রবেশদ্বার হিন্দুরীতি মেনে পুবমুখী, কিন্তু জাহাঙ্গীরমহলের প্রবেশদ্বার মুসলিমরীতির প্রতীক হয়ে পশ্চিমে। সেই পশ্চিমমুখী সিংহদুয়ারের বিশাল কপাটের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক দূর অবধি পলাশের লাল আগুনে রাঙা প্রান্তর দেখতে দেখতে আর চৈত্রের হু হু করা বাতাসের স্পর্শ নিতে নিতে যখন মনে মনে চলে গেছি সেই সপ্তদশ শতকে, তখন হেমন্ত সিং গাউরের কথায় চমক ভাঙল - ওপাশে ওই যে তিনতলা মহলটা দেখছেন, ওটারও একটা কাহানি আছে। তাই নাকি? শোনা যাক তাহলে। কাহানি শুনতেই না এখানে আসা!

ওই যে ওপাশে ত্রিতলা মহলটি, ওর নাম রাই পরভিন মহল। কে ছিল এই রাই পরভিন? কী তার কিসসা? সেই কথাই শোনাই এবার আপনাদের - হেমন্ত সিং বলে চলল। রাই পরভিন ছিল ওরছা রাজসভার এক রত্ন। অসাধারণ রূপসী সেই রমণী একাধারে প্রতিভাধর শায়ের, গায়িকা এবং নর্তকী। তার নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল ওরছা রাজ্যের বাইরেও। দেখতে দেখতে বাদশাহ্ আকবরের রাজসভাতেও পৌঁছে গেল রাই পরভিনের খ্যাতি। আকবর রাই পরভিনকে আগ্রায় আমন্ত্রণ জানালেন। ওরছাতে তখন রাম শাহের রাজত্বকাল। রাই পরভিন রাম শাহের ভাই ইন্দ্রজিত সিং-এর প্রেয়সী। তার জন্য ইন্দ্রজিৎ বানিয়ে দিয়েছেন রাই পরভিন মহল। ইন্দ্রজিৎ নিজেও নৃত্যগীতকুশলী গুণী। কিন্তু সম্রাটের আমন্ত্রণ তো আর উপেক্ষা করা যায় না। তাই নিরুপায় ইন্দ্রজিৎ রাই পরভিনকে আগ্রার দরবারে পাঠাতে বাধ্য হলেন। রাই পরভিনের নৃত্য-গীত-শায়েরীতে মুঘল রাজসভা মুগ্ধ। এমন রত্ন কেন ক্ষুদ্র রাজ্য ওরছায় পড়ে থাকবে, তোমার উপযুক্ত স্থান তো দিল্লিশ্বরের দরবারে। বাদশাহের এই আহ্বানের উত্তরে তাঁকে একখানি শায়রী শোনান রাই পরভিন।

ভিনতি রাই পরভিন কি,
শুনিয়ে শাহ্ সুজান,
জুঠি পাতর ভকত হ্যায়,
বারি, বায়াস, সেয়ান।

বাংলায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় খানিক এরকম – হে মহান বাদশা, রাই পরভিনের মিনতি শুনুন, অন্যের উচ্ছিষ্টের জন্য অভিলাষী যে জন, সে নিশ্চয় সারমেয়, বায়সপক্ষী, অথবা কোনো ভিখারী।
আকবর যা বোঝার বুঝলেন। কিন্তু তিনি গুণীর সমাদর করতে জানতেন, তাই রাই পরভিনের উপর তিনি ক্রুদ্ধ তো হলেনই না, বরং সামান্য এক নর্তকীর এই নির্ভীক স্পষ্টবাদিতায় যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে প্রচুর উপঢৌকনসমেত সসম্মানে রাই পরভিনকে ওরছা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

কেল্লার আনাচে-কানাচে ঘুরতে ঘুরতে, গল্প শুনতে শুনতে আর ছবি তুলতে তুলতে ঘন্টাতিনেক কেটে গেছে। ঘড়িতে দুপুর দেড়টা। বাইরে আগুনের মত রোদ। আর কোথাও না যাই, লক্সমী টেম্পলটা একবার দেখতেই হবে। সেখানে অসাধারণ কিছু ফ্রেসকো আছে তা জানি। তাছাড়া সেই মন্দির মূলশহরের বাইরে লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে, তাই খুব ভিড় বা ভক্তসমাগমের ভয় সেখানে নেই।

কেল্লা থেকে তিন-চার কিলোমিটারের রাস্তা লক্ষ্মীমন্দির। গাড়িতে উঠলাম, আর আমাদের আগে আগে মোটরবাইকে পথ প্রদর্শক হেমন্ত সিং গাউর। মন্দির যাওয়ার পথে নদীর ধারের ছত্রীতে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। হেমন্ত সিং ঘুরে ঘুরে দেখাল রুদ্রপ্রতাপ থেকে শুরু করে মধুকর শাহ, ভারতী চাঁদ, বীর সিং দেও – সকল বুন্দেলা রাজা ও তাঁদের রানিদের ছত্রী। মোট পনেরোটি ছত্রী আছে এখানে। রাজপুত সংস্কৃতি অনুসারে রাজা-মহারাজাদের অন্ত্যেষ্টির পর বানানো স্মৃতিস্তম্ভকে বলে ছত্রী। পাঁচিলঘেরা রাজপরিবারের এই পুরনো ছত্রীগুলির অন্যপাশেই এখনকার শ্মশান - নাম 'মুক্তি ধাম'। কী সুন্দর নামখানি।

ছত্রী থেকে বেরিয়ে সোজা লক্সমী টেম্পল। মিনিট দশেক লাগল। একটা উঁচু টিলার ওপরে বিশাল মন্দিরটি। এখান থেকে পুরো ওরছা শহরের যাকে বলে ৩৬০ ডিগ্রি প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায়। লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা, তাই মন্দিরের চালাটি যেন একটি লক্ষ্মী প্যাঁচার ডানা মুড়ে থাকা মূর্তি। অবশ্য, হেমন্ত সিংজি না দেখালে এটা আমাদের কোনোমতেই চোখে পড়ত না। এটিও বীর সিং দেও-এর আমলেই তৈরি, অর্থাৎ সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে। অথচ এই মন্দিরের অলিন্দে,দালানে যেসব ফ্রেসকো রয়েছে, তাতে ইউরোপিয়ানদের ছবি এল কিভাবে? সিংজীর উত্তর তৈরি – মন্দির সপ্তদশ শতকে নির্মিত হলেও ফ্রেসকো আঁকা হয়েছে পরের দুশো বছর সময়কাল জুড়ে। ফ্রেসকো আঁকা খুবই সময়সাপেক্ষ কাজ, দু-একদিনে তা হয় না। তাই দেওয়ালচিত্রে যেমন চিরায়ত পুরাণ-কাহিনি আছে,তেমনি সমকালীন চিত্রও আছে।

আর সমকালীন মানেই তো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনশীল। তাই দেওয়ালে সীতার বনবাস, দশগ্রীব রাবণের সঙ্গে বানরসেনা সমেত রামচন্দ্রের যুদ্ধ, নন্দলালার মাখনচুরি বা বিষ্ণুর অবতারদের পাশাপাশি বুন্দেলখন্ডি কুস্তিগীরদের মল্লযুদ্ধ, রাজপুত রমণীর কেশসজ্জা, রাজসভায় নর্তকীর নৃত্য, রাজাদের শিকারক্রীড়া, আবার অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে মধ্যভারত জুড়ে ছড়িয়ে পরা সাহেব সৈন্যদের বন্দুক হাতে মার্চ করা, কামান নিয়ে যুদ্ধ, টেবিলের দুদিকে বসে দুই গোরা সাহেবের আঙুরলতাসহ মদ্যপান – সবই স্থান পেয়েছে মন্দিরের দেওয়ালে।
মন্দিরের বাকি সবকিছু ভাল লাগলেও হেমন্ত সিং-এর দেওয়া একটা তথ্য শুনে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। এই মন্দিরের কারুকার্য, ফ্রেসকো, দেওয়ালচিত্র সব টিঁকে গেলেও একটা জিনিস চলে গেছে। তা হল মন্দিরের অষ্টধাতুর তৈরি লক্ষ্মীমূর্তিটি। সে কী? কবে? না, মুঘলদের হাতে নয়, মারাঠা আক্রমণে নয়, এমনকি ব্রিটিশ আমলেও নয়। এই তো, মাত্র চল্লিশ বছর আগে এবং সেই চুরির কোনো কিনারাও হয়নি। মূর্তিও উদ্ধার হয়নি। কে জানে বিদেশের কোন বিলিওনিয়ারের ব্যক্তিগত মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে সেই অমূল্য বিগ্রহ।
মন্দিরের বাইরে বেরোতেই আবার বুন্দেলখন্ডের আগুনে বাতাস চোখমুখ সেঁকে দিয়ে স্বাগত জানাল। হেমন্ত সিংকে ধন্যবাদ ও বিদায় জানিয়ে ফিরে চললাম বেতোয়া রিট্রিটে। আর নয়। রোদ পড়ার আগে পর্যন্ত অন্তত রিট্রিট করে বেতোয়া রিট্রিটেই থাকতে হবে।
ত্রয়োদশী কন্যা ইতিহাসের গল্পে খানিক উৎসাহ পেলেও পৌনে দশের পুত্রের মুখটা ভার হয়ে আছে। এটা কেমন হলিডে? খালি ভাঙা কেল্লায় ঘুরে ঘুরে রাজা-মহারাজাদের গল্প শুনে যাও। কী বোরিং! তবে তুমি কী চাও বৎস? জানা গেল, তার ইচ্ছে বেতোয়া নদীতে স্নান করা, সাঁতার কাটা, রিভার-র‍্যাফটিং, কিছু না হলে নিদেনপক্ষে নদীর জলে বোটিং। অগত্যা রোদ পড়লে বেরোই পরিবারের ক্ষুদ্রতম সদস্যের দাবি পূরণ করতে।

বেতোয়া রিট্রিট থেকে ছত্রীর ঘাট দশ মিনিটের হাঁটাপথ। হেঁটেই এলাম। কয়েকটা প্যাডেল বোট রয়েছে সেখানে। স্থানীয় মানুষ নদীতে নৌকোবিহার করছে, কেউ কেউ স্নানও করছে। একটা ছোট বোট নিয়ে আমরাও ভেসে পড়লাম নদীতে। বেতোয়ার জলে তখন গোধূলির আলো। নদীবক্ষ থেকে দূরের কেল্লা, ছত্রী, নদীতে তাদের প্রতিবিম্ব, নদীকে ছুঁয়ে অনুভব করা – অন্যরকম ভাল লাগায় ভরে গেল মনটা। ওরছাতে এর আগেও দুবার এসেছি, কিন্তু কোনোবারই বেত্রবতীর বক্ষে নৌকোবিহার কিংবা নদীর জল ছুঁয়ে দেখা এসব হয়নি। ভাগ্যিস ছেলেটা জেদ ধরেছিল। ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল দশ বছর আগে এখানে প্রথমবার আসার দিনটির কথা। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির এই ত্রয়োদশী তো সেদিন আড়াই বছরের আড়াই ফুটিয়া, আর পৌনে দশের বালক তখন সবে অঙ্কুরিত, পৃথিবীর আলো দেখতে তার তখনও মাস পাঁচেক দেরি আছে। কতটা সময় চলে গেছে মাঝখানে! ভাবতেই অবাক লাগে। কত জল বয়ে গেছে এই বেত্রবতী নদী দিয়ে গত এক দশকে। তারপরেই চোখ পড়ল ছত্রীগুলোর দিকে। হাসি পেল। দশ বছর সময়কে আমি অনেক সময় ভাবছি। তাও আবার এই শহরের বুকে বসে, যেখানে কিনা এই কেল্লা, ছত্রী, মন্দির সব শত শত বছরকে শরীরে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। চারশো পাঁচশো বছরের তুলনায় দশ বছর তো গণ্ডূষমাত্র, পল-অনুপলের তুল্য। সত্যি, রেফারেন্স ফ্রেম চেঞ্জ হয়ে গেলে সবকিছুই কেমন আপেক্ষিক হয়ে যায়।

বোটিং সেরে ঘড়িতে দেখি সন্ধে সাতটা। এবার ছুটি কেল্লার দিকে। সাড়ে সাতটায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো শুরু হবে। সাতটা কুড়ির মধ্যে টিকিট কেটে কেল্লার দরবারের সামনের লনে উপস্থিত হই। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটায় শুরু হল শো। আলো আর শব্দের সাহায্যে মূর্ত করে তোলা হল ঘুমন্ত অতীতকে। হে অতীত, কথা কও, কথা কও। সকালে হেমন্ত সিং-এর কাছে যা শুনেছিলুম, সেগুলো তো বটেই, তার বাইরেও আরো কিছু কাহিনি শোনা গেল এখানে। সেগুলোই বলি এবার।

শাহজাহানের শাসনকালে ওরছার রাজা ছিলেন ঝুঝর সিং। তাঁর ভাই লালা হরদৌল ছিলেন খুব বীর ও সাহসী। কোনো কারণে ঝুঝর সিং-এর মনে সন্দেহ হল রানি চম্পাবতীর সঙ্গে হরদৌলের অবৈধ সম্পর্ক আছে এবং তাঁরা দুজনে মিলে ঝুঝর সিংকে সিংহাসন থেকে সরানোর চক্রান্তে লিপ্ত। এই সন্দেহের বশে তিনি হরদৌলকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করলেন। অকালমৃত লালা হরদৌল কিন্তু বুন্দেলখন্ডবাসীর হৃদয়ে স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। হরদৌলের মূর্তি এখনও পূজিত হয় বুন্দেলখন্ডের নানা স্থানে। বুন্দেলখন্ডের আর কোনো রাজা দেবতার সম্মান পাননি, কিন্তু হরদৌল রাজা না হয়েও তা পেয়েছেন। আজও বুন্দেলখন্ডের কন্যাদের বিয়েতে প্রথম নিমন্ত্রণ পত্রটি প্রেরিত হয় হরদৌলের উদ্দেশ্যে। সে যেন যুগ যুগ ধরে সকল বুন্দেলখন্ডি কন্যার প্রিয় ভ্রাতা। হরদৌলের শুভকামনা না পেলে বিবাহ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে না। বুন্দেলখন্ডের বিবাহগীতির বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে হরদৌলকে নিয়ে নানা গীতিকা।

আইয়ো আইয়ো মোরে ভাইয়া হরদৌল
তুমরে হি বল্ পে বিয়াহ্ হ্যায় রচো।
কন্যা বৈঠি জোরে হাথ,
আ গয়ি দুয়ারে পে বারাত
তুম বিন জিয়ারা ঘবরাত।
তুমসে লগি হমরি আশ
ভাইয়া করিও নহি নিরাশ
হৃদয় মে জগি হো বিসওয়াস।
তুমরে হি বল্ পে বিয়াহ্ হ্যায় রচো…

সময় বয়ে যায়। শাহজাহানের সময় থেকেই ওরছা মুঘলসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করদ রাজ্য। ওরছার রাজারা মুঘল দরবারে বার্ষিক কর পাঠান। কিন্তু আওরঙ্গজেবের আমলে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল। আওরঙ্গজেব নাকি তাঁর সেনাপতি রণদৌল্লা খাঁকে ওরছা পাঠিয়েছিলেন চতুর্ভুজ মন্দিরটিকে ভেঙে একটি মসজিদ গড়ার জন্য। রণদৌল্লা খাঁ ও তার সেনাদলকে দেখে এবং তাদের আসার কারণ জেনে রাজপুরীতে শোরগোল পড়ে গেল। কিন্তু মুঘল বাদশার সঙ্গে টক্কর নেওয়ার মত বাহুবল তখন আর ওরছার রাজাদের নেই। সুতরাং চতুর্ভুজ মন্দিরের ধ্বংস আটকানোর কোনো উপায় নেই। রণদৌল্লা খাঁ মুঘল সৈন্যদের নিয়ে যখন চতুর্ভুজ মন্দিরের দরজায় ধাক্কা দিল, তখন দরজা আগলে দাঁড়াল এক তরুণ কিশোর। কোমর থেকে তরোয়াল বার করে এক কোপে সেই তরুণের শিরচ্ছেদ করতে উদ্যত হয়েও থমকে দাঁড়াল রণদৌল্লা। অবাক হয়ে দেখল সেই সুকুমার কিশোর হাতের এক ঝটকায় নিজের পাগড়ি খুলে ফেলেছে, আর সেই পাগড়ির বাঁধন খুলে বেরিয়ে এসেছে এক ঢাল কেশরাশি। পুরুষ নয়, এ যে রমণী এক ! এবং এই রমণী আর কেউ নয়, আওরঙ্গজেবের কন্যা স্বয়ং বদরুন্নেসা। কথিত যে, ওরছার রাজপুত্র ইন্দ্রমণির সঙ্গে আওরঙ্গজেবের কন্যা বদরুন্নেসার নাকি প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং সেদিন বদরুন্নেসার সাহসী প্রতিবাদের জন্যই চতুর্ভুজ মন্দিরের গায়ে আঁচড় লাগাতে পারেনি রণদৌল্লা খাঁ। মন্দিরটি আজও তাই টিঁকে আছে।

রুদ্রপ্রতাপের আরেক পৌত্র চম্পৎরাও, যিনি মাহোবার জায়গির পেয়েছিলেন, তাঁর পুত্র ছত্রসালের হাত ধরে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে বুন্দেলা বংশের রাজ্যসীমা ও গৌরব সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল। ছত্রসালের ছত্রছায়ায় বুন্দেলখন্ডি কাব্য, গীতি, সাহিত্যেরও ব্যাপক প্রসার ঘটে। কিন্তু এই ছত্রসালই আবার শেষ বয়সে মুঘল সেনাপতি মহম্মদ খাঁ বাঙ্গাশের সঙ্গে মোকাবিলায় সুবিধে করতে না পেরে মারাঠাদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন মারাঠা বীর প্রথম বাজিরাও পেশোয়া। বাজিরাও-এর সাহায্যে নিজের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পেরে তুষ্ট ছত্রসাল মৃত্যুর আগে বাজিরাওকে বুন্দেলার অনেকখানি অংশের জায়গির দিয়ে যান। মধ্যভারতে মারাঠাদের প্রবেশের অন্যতম সূচনা এই ছত্রসালের হাত ধরেই। ছত্রসাল তাঁর মুসলিম উপপত্নীর গর্ভজাত রূপসী কন্যা মস্তানির সঙ্গে বাজিরাও-এর বিয়েও দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বলিউডি ব্লকবাস্টারের কল্যাণে এই বাজিরাও-মস্তানির কাহিনি অবশ্য সকলেরই জানা।

১৭৮৫ সালে রাজা বিক্রমজিৎ সিং ওরছা রাজ্যের রাজধানী ওরছা শহর থেকে সরিয়ে টিকমগড়ে স্থানান্তরিত করলেন। ধীরে ধীরে ওরছার গৌরবের দিন শেষ হল। জমতে শুরু করল বিস্মৃতির পলি। রয়ে গেল শুধু ইতিহাসের নানা ঘটনার সাক্ষী এই কেল্লা, এই জাহাঙ্গীর মহল, রাই পরভিন মহল, চতুর্ভুজ মন্দির, রাজারাম মন্দির আর ছত্রীগুলি। আর কেল্লার আনাচে-কানাচে পাক খেয়ে বেড়ানো অতীতের যত হাসি-কান্না-স্বপ্ন-অতৃপ্তি-হাহাকার।

লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোয়ের শেষে রিসর্টে ফেরার রাস্তায় চলতে চলতে একটা খটকাই মনে রয়ে যায়। এই যে রুদ্র প্রতাপ সিং এসে দেখলেন বেত্রবতীর তীরে জঙ্গলাকীর্ণ পাথুরে ভূমি, এই ভূমি কি একেবারে মনুষ্যশূ্ন্য ছিল? তা কি হওয়া সম্ভব? বিন্ধ্যাচলের অরণ্যে যেমন অরণ্যাচারী মানুষ ছিল, তেমন এখানকার বনভূমিতে, নদীর ধারে কি ছিল না কোনো আদিম জনগোষ্ঠীর বাস? তাদের কী হল? কোথায় হারিয়ে গেল তারা? সেই কোল, ভিল, গোন্ড আর অন্যান্য উপজাতির মানুষেরা? নিজেদের অধিকার ছাড়তে ছাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছল তারা শেষ অবধি? সকালে নিজের পরিচয় দেবার সময় আমাদের গাইড হেমন্ত সিং সগর্বে যোগ করেছিল – ম্যায় রাজপুত হুঁ। ঘোষণাটির মধ্যে জাত্যাভিমান আর অহংবোধ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। আর এই শহরের কাহিনিতে সবই তো দেখি রাজপুত, মুঘল, আর মারাঠাদের কথা। তাদের পরস্পরের মধ্যে বৈরিতা, যুদ্ধ, জয়-পরাজয়, প্রেম, বিবাহ, সন্ধি – নানান সম্পর্কের উত্থান-পতনের সাইন কার্ভ। সেই কোণঠাসা মানুষগুলোর কথা তো কেউ বলে না। কী জানি, হয়তো সেই আদি জনগোষ্ঠীদের কথা জানতে গেলে সেই আদিম ভারতবর্ষের হৃদ্স্পন্দন শুনতে গেলে কান পাততে হবে আরো গভীরে। ক্যামেরা আর মোবাইল হাতে দুদিনের ঝটিকা সফরে এসে সেই স্পন্দন শোনা যাবে না। তার জন্য সাধনা দরকার। অন্যরকম সাধনা। সেই ধৈর্য এবং সময় কি আছে আমাদের মত শহুরে পল্লবগ্রাহীদের? উত্তর তো জানা। আর এও জানি, আজ এই প্রশ্ন মনের মধ্যে খচখচ করলেও কাল বাড়ি ফিরে গিয়ে ভুলে যাব প্রশ্নগুলো। রয়ে যাবে শুধু রাজপুত, মুঘল, মারাঠা আর ব্রিটিশদের লেখা ইতিহাসই। বাকি কথা ডুবে যাবে বেত্রবতীর জলে। সেই বিষাদ বুকে ধারণ করে বয়ে চলবে নদী। শত শত বছরের পট পরিবর্তনের নির্বিকার, নিরুত্তাপ সাক্ষী হয়ে। কুলু কুলু ধ্বনি জাগিয়ে তার শুধু অবিরাম বয়ে চলা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। নদীর জন্ম-মৃত্যুর কালসীমার তুলনায় পাঁচশত বৎসর সময়কালও তো শেষ অবধি সেই গণ্ডূষই মাত্র।

তথ্য ঋণ:
• "Orchha State". The Imperial Gazetteer of India, Vol. 19. Oxford at Clarendon Press. 1909. pp. 241–247
• "Orchha Town". The Imperial Gazetteer of India, Vol. 19. Oxford at Clarendon Press. 1909. pp. 247–248
• ঝাঁসির রাণী – মহাশ্বেতা দেবী
• উইকিপিডিয়া
• ওরছা ফোর্টের সান্ধ্য লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো'তে বর্ণিত এবং স্থানীয় ট্যুর গাইডদের কাছে শোনা নানা উপাখ্যান

পৃষতী রায়চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে। বর্তমানে কর্মসূত্রে কানপুরনিবাসী। পেশা অধ্যাপনা। কলেজ ম্যাগাজিনের চৌহদ্দি পেরিয়ে লেখালিখির সূচনা বাংলালাইভ ওয়েবজিনের হাত ধরে। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, বাংলালাইভের শারদীয় ই-পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস – 'প্রথম উড়াল', ২০০৭-০৮ সালে বাংলালাইভে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত। পরবর্তীকালে 'দেশ' ও 'সানন্দা' পত্রিকায় একাধিক গল্প এবং ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। 'দ্বৈত' নামে একটি গল্পসংকলন সদ্য প্রকাশিত হয়েছে 'সৃষ্টিসুখ' প্রকাশনী থেকে।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher