ট্রেক ডায়েরি: সান্দাকফু - ফালুট

সুদীপ্ত ঘোষ


~ সান্দাকফু ট্রেক রুটম্যাপ || সান্দাকফু ট্রেকের আরও ছবি ~

শুরুর কথা :
#পাহাড়ে না করতে নেই


দিনকয়েকের ফোনালাপে ঠিক হল এবারের ট্রেক সান্দাকফু- ফালুট। বাইরে দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে বিশেষ নেই। কয়েকজনের অফিসে ছুটির সমস্যা, আবার কয়েকজনের এই পথে অনেকগুলো ট্রেক হয়ে গেছে। তাই আবার একই রুটে যেতে নারাজ। আবার অনেকে এই রুটে গাড়িতে ঘুরে এলেও এবার ট্রেকে যেতে চায়। তাই এইসব পক্ষে-বিপক্ষের মতামত, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, অফিস-ছুটির বিস্তর হিসেবনিকেশের পর সান্দাকফু- ফালুট- গোর্খে-ভারেং রুটটা ঠিক করা হল। এবারেও বেশকিছু বন্ধু নতুন। দীপেন, বিল্টুদার সঙ্গে এবার আমার প্রথম ট্রেক। টিকিট কাটার আগে বাপ্পা জানতে চাইল, "সুদীপ্তদা, পাপাই আর সুজিত যেতে পারে বলেছে, কী করব?"
"টিকিটটা আপাতত কেটে রাখ। আর পাহাড়ে কেউ সঙ্গে যেতে চাইলে না করতে নেই।"
১২ তারিখ সকালে আবার বাপ্পার ফোন, "শুভ যাবে বলছে...! কী করব? সব বুকিং তো হয়ে আছে?"
"কোনো চাপ নেই ভাই, সবাই অ্যাডজাস্ট করে নেব। ওকে যেতে বল। আর শোন, পাহাড়ে না করতে নেই।"
শিয়ালদহ ষ্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল সাড়ে এগারোটায়। দশজনের গ্রপের ন'জন একসঙ্গে ট্রেনে চড়লাম। দীপেন ব্যক্তিগত কাজে উত্তরবঙ্গে, ও মালদহ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে।
আমাদের প্রতিটা ট্রেকের জবরদস্ত শুরুটা হয় ট্রেনে ডিনার দিয়ে। তবে এবারেরটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিল। লুচি, পরোটার সঙ্গে আলুভাজা, আলুর দম, চিকেন কষা, চিকেন কারি আর ঝাল ঝাল হাঁসের মাংস। শেষ পাতে সুজির হালুয়া, নলেন গুড়ের মাখা সন্দেশ আর মিল্ক কেক। ডিনার করে যে যার বার্থে চলে গেলাম। তবে আশপাশের লোকের উৎপাতে রাতে বিশেষ ঘুম হল না।

১৩ ডিসেম্বর, ২০২০ (নিউ জলপাইগুড়ি থেকে চিত্রে):
#বাংলার শেষ নবাব


ষ্টেশনে পৌঁছালাম সাড়ে ন'টা নাগাদ। ট্রেন প্রায় রাইট টাইম। রুকস্যাক পিঠে হাঁটার শুরু। ওভারব্রিজের সিঁড়ি ভেঙে এসে উঠলাম ওয়েটিং রুমে। সকালের ট্রেনের বেশিরভাগ যাত্রী তাড়াতাড়ি পাহাড়ে পৌঁছাতে চায়। আমরা লেট লতিফ। তাই সকালের চা খেয়ে, খানিকটা ল্যাদ খেয়ে, ব্যাগপত্তর রেখে একে একে স্নান করে এলাম। ঠিক হল রাস্তায় কোথাও গাড়ি থামিয়ে ব্রাঞ্চ (ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ) করে নেওয়া হবে। লটবহর গাড়ির ছাদে বাঁধাছাঁদা সেরে চড়ে বসলাম গাড়িতে।
নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশন, শহরের গলি-ঘুঁজি, শর্টকাটের গোলকধাঁধা ছাড়িয়ে গাড়ি চলল পাহাড়ের দিকে। আকাশে রোদ নেই। মেঘলা আকাশ। রাতের একপশলা বৃষ্টির পর সকালের বাতাসে একটু গুমোট ভাব। শহর পার করে ক্যান্টনমেন্টের সেই সবুজে ঘেরা মায়াবী রাস্তায় পোঁছাতেই প্রাণে যেন এক ঝলক খোলা হাওয়া। পাহাড়ের আগে তরাইয়ের এই বনভূমি অনেকটা সেই দূর্গাপুজোর আগে মহালয়ার মতো। মনের মধ্যে লাফালাফি করে ওঠে অগুনতি চঞ্চল জলফড়িং। কিছুটা এগিয়ে একটা রোডসাইড হোটেলে গাড়ি থামিয়ে এক প্লেট করে চিকেন মোমো, পরোটা, চিকেন কারি দিয়ে ব্রাঞ্চ করে নেওয়া হল। তারপর গাড়ি চলল পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সেই পাইনের সারি, চা বাগান, সেই চেনা ভালোবাসা। মিরিক, থারবো চা বাগান, তাবাকোশী, সুখিয়া পোখরি পার হয়ে সীমানা। এখান থেকে নেপালের অনেকটা দেখা যায়। একটা ছোট ভিউ পয়েন্ট আছে। আবার কিছুক্ষণের বিরতি। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। গাড়ির দরজা খুলতেই বাইরে অপেক্ষমান ঠান্ডা হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর। লাকি, বাবুকা, শুভ সীমানা বাজার থেকে গ্লাভস, টুপি কিনল। বেশ সুন্দর। এক কাপ করে গরম চা খেলাম। তারপর আবার পথ চলা। মানেভঞ্জন পৌঁছতে হবে বিকেল চারটের মধ্যে। তারপরে গেলে সিঙ্গালিলা ন্যাশানাল পার্কের পারমিট পাওয়া যাবে না। বৃষ্টির জন্য রাস্তা একটু ভেজা। সাবধানে গাড়ি চলছে। তাই কোনোভাবেই ঠিক সময়ে পৌঁছানো গেল না। মানেভঞ্জন পৌঁছে সমতলের গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হল।
মানেভঞ্জন থেকে চিত্রে দুই কিলোমিটার। আমাদের আগের প্ল্যান অনুযায়ী সেটা ল্যান্ড রোভারে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাওয়ায় সেটা আর সম্ভব হল না। অগত্যা গাইড যোগেশ ভাইয়ের কথামতো রুকস্যাক কাঁধে হাঁটা শুরু করলাম। অদ্ভুত সেই শর্টকাট রাস্তা, কারও উঠোন, কারও বাগান, কারও সিঁড়ি বেয়ে খাড়াই উঠে চললাম। মানেভঞ্জন পার হয়ে একটা গাড়ি পাওয়া গেল, সেটাতে আমাদের লাগেজ তুলে দেওয়া হল। সঙ্গে দীপেন, বাবুকা আর পাপাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
শুরুর দিনের ট্রেকের ওয়ার্ম আপ শেষ করে যখন চিত্রে পৌঁছলাম ঘড়িতে প্রায় পৌনে পাঁচটা। কুয়াশায় মোড়া পাহাড় ঘিরে মনকেমনের এক বিকেল নেমে এসেছে। আমাদের রাতের আস্তানা 'হোটেল হক'স নেস্ট'। যে যার মত গ্রুপ বানিয়ে রুম দখল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ডাইনিংয়ে বসতেই চলে এল গরম ম্যাগির বোউল। সেই ম্যাগির গুণে কিনা জানি না...শুভ'র মেজাজ তখন তূরীয়। নবাবী কেতায় আধশোয়া শুভ তখন সিরাজের থেকে কোনো অংশে কম নয়। ট্রেকের একটা উদ্দেশ্য যদি পাহাড় প্রেম হয়, অন্যটা অবশ্যই নিখাদ আড্ডা। প্রতিদিন হাঁটার ক্লান্তি ভুলতে যার কোনো বিকল্প নেই। রাতে ডিনারে ছিল ভাত, রুটি, ডাল, স্কোয়াশের সবজি, ডিমভাজা আর পাঁপড়ভাজা। ডিনারশেষে বাইরে বেরোতে ডিসেম্বরের ঠান্ডা তার উপস্থিতি জানান দিল। সন্ধের বিষণ্ণতা কাটিয়ে ঝকঝকে রাতের আকাশ।

১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ (চিত্রে থেকে টোংলু):
#লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন

সকালের তেরচা রোদ জানলার কাঁচ ছুঁয়ে সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে এল। দুটো ভারী কম্বলের তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে শুভ আর বাপ্পা। অন্য খাটে বাবুকা। স্লিপিং ব্যাগের চেন খুলে বাইরে এলাম। বাকিরা অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে গেছে সূর্যোদয় দেখতে। একটু চড়াই ভাঙলেই 'সশস্ত্র সীমা বল'-এর সেনা ছাউনির পাশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। প্রবল ঠান্ডায় আমাদের আজ উঠতে ইচ্ছা করছিল না। জানলার স্লাইডিং কাঁচে পাতলা বরফের স্তর। ডাইনিং হলে গিয়ে এক কাপ গরম চা খেলাম। অসাধারণ ফ্লেভার। বাইরের রোদে ভেজা সকালে হলুদ ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু বরফ কণা। পাকদণ্ডী বেয়ে একটু নিচেই চিত্রে মনাস্ট্রি। বাবুকা আর সুজিতের সঙ্গে চললাম।

খানিক নেমে একটা বৌদ্ধ স্তূপ। রঙিন প্রেয়ার ফ্ল্যাগ ঝোলানো। হাতে জপমালা নিয়ে প্রদক্ষিণরত এক স্থানীয় রমণী। মৃদু হেসে ইশারায় আমাদেরও তাই করতে বললেন। নতমস্তকে প্রদক্ষিণ করলাম। স্তূপ থেকে সিমেন্ট বাঁধানো একফালি রাস্তা নেমে গেছে মনাস্ট্রিতে। নীল আকাশে একটু একটু করে জমতে শুরু করেছে চিন্তার মেঘ। মনাস্ট্রি ঘুরে দ্রুতপায়ে ফেরত এলাম।

কেক, চিঁড়েভাজা, চা দিয়ে জলযোগ করে বেরোনো হল। যোগেশ ভাই, আমাদের দশকর্ম্মা ভাণ্ডারের মত শুকনো খাবারের প্রকান্ড ব্যাগটা টংলুর দিকে যাওয়া গাড়িতে তুলে দিল। এখানে বলে রাখি খরচ কমাতে কিছু শুকনো খাবার আমরা বহন করি। কিন্তু এই পথে এত গাড়ি চলে যে সেই বাড়তি লাগেজ এবার প্রায় বইতেই হয়নি।
যোগেশ ভাইকে শুরুতেই জানিয়ে দিলাম, আমরা গাড়ি চলার রাস্তায় হাঁটতে নারাজ। সেইমত চিত্রে থেকে পিচঢালা রাস্তা ফেলে বাঁদিকের সোজা খাড়াই পাকদন্ডি বেয়ে চলা শুরু হল। সবার আগে বাবুকা আর দীপেন। আগের দিনের দুই কিলোমিটারের ওয়ার্ম আপ ট্রেকের কল্যাণে সবাই ফিট। শুধু আকাশ মেঘে ঢাকা। চিত্রে থেকে চড়াই খুব বেশি নেই। আঁকাবাঁকা পায়ে চলা ঘাস জমি। গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছি সবাই। পথটা বেশ মজাদার, একদিকে নেপাল, অন্যদিকে ভারতবর্ষ। রাস্তাও দুই দেশের রাজনৈতিক সীমানাকে তোয়াক্কা না করে কখনও ভারতে, কখনও বা নেপালে ঢুকে গেছে।

দেখতে দেখতে লামেধুরা গ্রাম। মেঘ কুয়াশায় ঢাকা। টাল খেয়ে আসা পিচঢালা রাস্তাটা বাঁক ঘুরে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের বুকে। রাস্তার পাশেই টিনের শেডঢাকা দোকান। সামনে কয়েকটা বেঞ্চ পাতা। পিঠের রুকস্যাকগুলো নামিয়ে একটু গা এলিয়ে দেওয়া হল। চা, ডিমসেদ্ধ আর এক প্লেট করে মোমো খেয়ে আবার চলার পথে।

অবাধ্য, এলোমেলো হাওয়া বইছে পাহাড় জুড়ে। মেঘ, কুয়াশার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এগিয়ে চলেছি। ঢালু গড়ানে জমির শেষে একটা পোখরি (পুকুর), ঘন কালো জল। দেখেই বসতে ইচ্ছে করল। আবার চকোলেট ব্রেক। তবে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট না করে আবার এগোলাম। মেঘমা পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর আড়াইটে বেজে গেল। রাস্তার বাঁদিকে মনাস্ট্রি। ডান দিকে পাহাড়ের ঢালে টিনের শেডের কটেজ টাইপের একটা গেস্টহাউস। মনখারাপের মেঘেরা আলগোছে কার্নিস ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মেঘমাতে দুপুরের লাঞ্চ। ট্রেকে হাঁটার সময় কখনও হেভি লাঞ্চ করা হয় না সাধারণত, কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম হল। গরম ভাত, ডাল, পাঁপড়ভাজা দেখে বাঙালি লোভ সামলাতে পারলো না। সঙ্গে গ্লাসভর্তি রডোডেন্ড্রন ওয়াইন। ভুল করলে ফল তো ভুগতে হবেই। তাই মেঘমা পেরিয়ে চড়াইয়ে উঠতে সবার দম বেরিয়ে গেল। পিঠের স্যাক যেন পাথরের মত ভারী হয়ে উঠেছে। তবে একটু চড়াই ভেঙে উঠতেই মেঘ সরিয়ে শেষ বিকেলের নরম রোদ বেরিয়ে এল। স্নেহাশিস চিৎকার করে বলল, "সবাই পা চালাও... টংলু থেকে সানসেট দেখব।"

পাহাড়ের বাঁক ঘুরতেই বিকেলের কমলা রোদে শায়িত 'ঘুমন্ত বুদ্ধ'। যার টানে বারবার ছুটে আসা। পাপাই-এর ক্যামেরার শাটার থামছে না। আমার পকেট থেকে ক্যামেরা বার করতে গিয়ে অসাবধানে পড়ে গেল কিছু টাকা। নিমেষে দমকা বাতাস উড়িয়ে নিল সেগুলো। লাকি চিৎকার করে উঠল, "কাকার টাকা...।" ছ'খানা পাঁচশো টাকার নোট বাতাসে ভাসতে ভাসতে চোখের সামনে কাঁটাতার পেরিয়ে উড়ে গেল খাদের দিকে। গৌরী সেনের মত টাকা ওড়ানোর চিন্তা আমাদের আটপৌরে জীবনে নেহাতই কষ্টকল্পনা। কিন্তু শায়িত 'ঘুমন্ত বুদ্ধের' সামনে ওই টাকার প্রতি আর মায়া জাগল না। অনেক কষ্টে পাপাই, শুভ আর লাকিকে নিচে নামা থেকে নিরস্ত করলাম। বিপদে মুশকিল আসান হল যোগেশ ভাই, আমার বাধা সত্ত্বেও কাঁটাতার টপকে নিচের ঝোপ থেকে উদ্ধার করে আনলো টাকাগুলো।
একটু এগিয়ে টংলুর 'ট্রেকার্স হাট'। আমরা রাস্তায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অস্তরাগের আলোয় স্থবির। বেলাশেষের রবিকে সঙ্গ দেওয়ার পালা সাঙ্গ হতেই ডিসেম্বরের ঠান্ডা ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। ট্রেকার্স হাটের দুটো ঘর দখল করে রাজত্ব কায়েম করলাম। অনেক অনুরোধে রাতের খাবার সময় আটটা থেকে পিছিয়ে সাড়ে আটটা করা হল। আড্ডা সাঙ্গ করে বাইরে এলাম যখন, তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে। রাতের মেনু চমরী গাইয়ের দুধের ঘি দিয়ে খিচুড়ি সঙ্গে পাঁপড়ভাজা আর ঝাল আচার। ডিনার সেরে যে যার কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লাম।

১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ (টংলু থেকে কালিপোখরি):
#সামনের বাঁক ঘুরেই...

কাকভোরে বিছানা ছেড়ে সদলবলে সামনের ভিউ পয়েন্টে চড়ে বসলাম। ডিসেম্বরের পাহাড়ি শীত তার একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করতে নারাজ। সঙ্গে দোসর মাতাল হাওয়া। হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লাগছে আর কী...! তবে বাঙালি চিরকালই 'আউট অফ দ্য বক্স' ভেবে এসেছে... তাই বাপ্পা যখন 'ট্রেকার্স হাটের' কম্বল গায়ে জড়িয়ে পাহাড় চড়ল, তখন কেউই খুব একটা অবাক হল না। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁয়ে দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ে।

শুরু হল আরও একটা দিন। দূরে বাঁদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে রাস্তা। টুমলিং হয়ে কালিপোখরির দিকে।

আজ আকাশ একটু বেশিই খোশমেজাজে। দূরদূরান্তে মেঘের চিহ্ন নেই। চায়ের কাপের ধূমায়িত বাস্পেরা স্বছন্দে হারিয়ে যাচ্ছে ব্যাকড্রপের কাঞ্চনজঙ্ঘায়। ট্রেকার্স হাটের কাঁচের জানলায় লেগে থাকা জলীয় বাষ্পরা বিন্দু বিন্দু জলকণার আকারে গড়ে নিচ্ছে নিজেদের। বাইরে নাম না জানা সহস্র পাখির ডাক। কোনও এক হারিয়ে যাওয়ার সকাল। যে আনমনা সকালে সব হিসেবে ভুল করতে ইচ্ছে হয়...

টংলু থেকে টুমলিং দুই কিলোমিটারের আশেপাশে। খুব বেশি চড়াই উতরাই নেই। নটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম টুমলিং। সামনে ঝকঝকে 'ঘুমন্ত বুদ্ধ'। এখানে অনেকগুলো হোটেল, লজ। ট্যুরিস্টদের ভিড়। নুডুলস, স্যুপ আর মোমো মিলিয়ে ব্রেকফাস্টটা মন্দ হল না। প্রাতরাশপর্ব মিটিয়ে আবার পথে নামলাম। বাবুকা'র পৈটিক গোলযোগ। বেশি ঘি খাওয়ায় চমরী গাই বেজায় খাপ্পা হয়ে পেটের মধ্যে হুলুস্থুল কান্ড বাধাচ্ছে নির্ঘাত। যোগেশ ভাই করিতকর্মা লোক, গতিক বুঝে কালিপোখরিগামী গাড়িতে বাবুকাকে বসিয়ে দিল। আর আমরা লাট খেতে খেতে এগিয়ে চললাম কালিপোখরির দিকে।
কিছুটা এগিয়ে সিঙ্গালিলা ন্যশানাল পার্কের চেকপোস্ট। নিয়মমাফিক পারমিট করিয়ে নেওয়া হল। চারজনের একটা ছোট গ্রুপ একটু বিপদে পড়েছে। সঙ্গে গাইড না থাকায়, কিছুতেই পারমিশন পাচ্ছে না। যোগেশ ভাই নিজেকে ওদের গাইড পরিচয় দিয়ে পারমিট করিয়ে দিল। আমরাও নিজেদের দল বাড়িয়ে নিলাম।

বড় রাস্তা ছেড়ে সরু পায়ে চলা জঙ্গলের পথ। পাইন, ওক, রডোডেন্ড্রনের ঘন জঙ্গল। ছোট ছোট গুল্মের ঝোপে লাল বেরি জাতীয় ফল। পাহাড়ের রিজ বরাবর রাস্তা, মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে বিশেষ বৈরিতা নেই। বিস্তৃত ঘাসজমিতে মাঝে মধ্যের বিরতি। উতরাইয়ের পথে বিরতি গৈরিবাসে। নতুন চার বন্ধুর জায়গাটা বিশেষ পছন্দ হয়ে গেল। তারা গৈরিবাসেই রাত কাটানোর প্ল্যান করল। চারমূর্তিকে বিদায় জানিয়ে আবার চলা শুরু করলাম।
গৈরিবাস অবধি হাঁটাতে বিশেষ কষ্ট হয়নি। কিন্তু তারপরই শুরু হল চড়াই। পাহাড়ের খামখেয়ালি আবহাওয়া সকালের একেবারে বিপ্রতীপ। একে চড়াইয়ের কষ্ট তারপরে শীতের কামড় শরীরকে নিমেষে কাবু করে দিল। ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে চললাম কাইয়াকাট্টার দিকে।
গুটিকয় বাড়ি আর তার সংলগ্ন দোকান নিয়ে কাইয়াকাট্টা। একটা ছোট জনপদ। আজকের লাঞ্চ কাইয়াকাট্টায়। আগেই 'ইন্ডিয়া হাইকসে'র' বড় টীম ঢুকেছে। তাই না চাইতেও আমাদের অনেকটা দেরী হয়ে গেল। নুডুলস আর স্যুপ দিয়ে লাঞ্চ সারা হল। রুকস্যাক কাঁধে নিয়ে নির্জন পাহাড়ি জনপদকে আবার নির্জন করে দিয়ে এগিয়ে চললাম কালিপোখরির দিকে। পিছনে পথের পাশে একলা পড়ে থাকল কাইয়াকাট্টা।

কাইয়াকাট্টা থেকে কালিপোখরির রাস্তায় চড়াই বিশেষ নেই। কিন্তু সারাদিনের হাঁটার ক্লান্তি, সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। পা চলতে চাইছে না। পাপাই জিজ্ঞেস করল, "আর কতটা...?"
বাপ্পার কনফিডেন্ট উত্তর, "এই তো এসে গেছি। সামনের বাঁক ঘুরেই কালিপোখোরি।"
পাপাইয়ের এটা প্রথম ট্রেক। আমদের গ্রুপের কনিষ্ঠতম সদস্য। আর বাপ্পা এই রাস্তায় বহুবার এসেছে। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে পাপাই এগিয়ে চলল। পরপর তিনটে বাঁক ঘোরার পরও দেখা গেল কালিপোখরি তখনও প্রায় এক কিলোমিটার...! বাকি রাস্তায় বাপ্পা আর পাপাইয়ের দিকে তাকাতে সাহস করে নি।

কালিপোখরির দিকে যত এগোচ্ছি কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার দাপট তত বেড়ে চলেছে। পথের ধারে মাঝে মধ্যে ঝরনার জল জমে বরফ হয়ে আছে। ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে টাল সামলানো দায়। প্রায় অন্ধকার রাস্তায় হেঁটে চলেছি কোনো এক অনন্তের উদ্দেশ্যে। কালিপোখরি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধে নেমে এল।

রাত্রির মতো তমসাচ্ছন্ন এক জলাশয়। সন্ধ্যার স্বল্পালোকে সাদা চোর্তেনগুলো খানিক রহস্যাবৃত। পশ্চিমদিকের উপত্যকা জুড়ে গোধূলির আলোয় ঈষৎ রক্তাভ তরঙ্গায়িত মেঘমালা, কোনও এক অলীক মহার্ণবের। অন্ধকার ঘনাতে রাতের আস্তানায় ফিরলাম। হাওয়ার দাপটে কাঠের কটেজ ঠকঠক করে কাঁপছে। জানলার ফাঁক গলে বর্শার ফলার মত আক্রমণ শানাচ্ছে নিষ্ঠুর হিমেল বাতাস। হাওয়ার গুন্ডাগিরি থেকে বাঁচতে ফাঁকা জায়গাগুলো কাগজ, সেলোটেপ দিয়ে সিল করে দেওয়া হল। প্রবল ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি সবাই। রান্নাঘরের সংলগ্ন ডাইনিং-এ আড্ডা জমালাম। এক কাপ অসাধারণ মশলা চা আর আন্টির আন্তরিক ব্যবহারের উষ্ণতায় কষ্ট অনেকখানি কমে গেল। কাঠকয়লার গনগনে আগুনের তাপে রক্ত সঞ্চালন একটু স্বাভাবিক হল। রাতের ডিনারের পর আর বাইরে থাকা সম্ভব হল না।

১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ (কালিপোখরি থেকে সান্দাকফু):
#এ বাতাসে বিস্‌ নাই...


কালিপোখরি থেকে সান্দাকফু ছয় কিলোমিটার। সকালে স্যুপি-নুডলস আর দার্জিলিং-চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে হাঁটতে শুরু করলাম। কাজল কালো মেঘে ঢাকা রহস্যময়ী কালিপোখরি পিছনে রয়ে গেল অন্য পথিকের অপেক্ষায়। রাস্তা জুড়ে ইতঃস্তত বরফ জমা। জানলার কার্নিসে, ছাদের টিনের শেডে লেগে থাকা গত রাতের শীতের প্রলেপ সকালের রোদের প্রতীক্ষায়। রাতের অসহনীয় ঠান্ডা রবির পরশে একটু গা-সওয়া। সিঙ্গালিলা ন্যাশানাল পার্কের বুক চিরে চলেছে রাস্তা। দুপাশে ওক, ম্যাপল, পাইনের ভিড়। পাখিরা ব্যস্ত ঘরগেরস্তালিতে। তাদের প্রাত্যহিকী বার্তালাপে মুখরিত হিমালয়। কখনও পাহাড়ের রিজ বরাবর রাস্তা। দুপাশে রডোডেণ্ড্রনের জঙ্গল। রাস্তার বাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। অপার্থিব। নীল আকাশ, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সাক্ষী রেখে ফ্রেমবন্দী হল আমাদের একমাত্র গ্রুপফটো। বিকেভঞ্জন পর্যন্ত রাস্তায় প্রকৃতির অসংখ্য মণি-মুক্তো ছড়ানো। এক এক করে কুড়িয়ে নিলাম সেসব, ভরে নিলাম স্মৃতির ঝুলি। বিকেভঞ্জন পৌঁছে আবার চায়ের বিরতি।

বিকেভঞ্জন শব্দের আক্ষরিক অর্থ বিষাক্ত উপত্যকা। বিষাক্ত অ্যাকোনাইট গোত্রের উদ্ভিদের আধিক্যের জন্য এমন অদ্ভুত নামকরণ। এখান থেকে সান্দাকফু চার কিলোমিটার। বাকি রাস্তায় কেবল চড়াই আর চড়াই। রাস্তা যত দুর্গম, প্রকৃতি তত সুন্দর। ওকের পাতায় পিছলে যাচ্ছে সূর্যালোক। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁয়ে পাইন বনের পথ ধরে ছুটছে বাতাস। প্রাণভরে মাখছি পাহাড়। সমতলের ফুসফুস, পাহাড়ের চড়াইয়ে বেদম। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলছে পাহাড়ি হাওয়া, 'অফুরন্ত অক্সিজেন...শ্বাস নাও প্রাণ ভরে। এ বাতাসে বিস্‌ নাই লালমোহান বাবু...!!' সামনে গতকাল দেখা হওয়া 'ইন্ডিয়া হাইকসের' বিরাট দল। পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে বাঁকে হাঁটছে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। আমরা বরাবরের মত রাস্তা ছেড়ে দুরূহ শর্টকাটে। শর্টকাটের কল্যাণে পেরিয়ে গেলাম ওদের। বুকে হাপর টানছে। অবশেষে দেখা যাচ্ছে 'শেরপা শ্যালে'। আবার নতুন উদ্যমে হাঁটা... দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম সান্দাকফু। বাংলার উচ্চতম স্থান। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাঁচটি শৃঙ্গের চারটিই চোখের সামনে। ভিউপয়েন্ট থেকে একবার 'ঘুমন্ত বুদ্ধের' দর্শন সেরে চললাম হোটেলের দিকে।
দুপুরে লাঞ্চ করে আবার বাইরে উদ্দেশ্যহীনভাবে একটু হেঁটে নিলাম। কিন্তু প্রচণ্ড ঠান্ডা আর প্রবল হাওয়ায় বেশিক্ষণ দাঁড়ানো দায়। চললাম ভিউপয়েন্টের দিকে। যদিও গোটা জায়গাটাই ভিউ পয়েন্ট। প্রায় সবখান থেকেই সবকটা শৃঙ্গ দেখা যায়। ভিউপয়েন্টে কাচেঘেরা ছোট একটি ঘর। সেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কও পাওয়া যায়। সেই ঘরেই চললাম সবাই। গল্পের ফাঁকে দিন ফুরিয়ে এল। মন ভরে গেল শেষ বিকেলে। মেটে সিঁদুরগোলা, একলা পাখির ঘরে ফেরা আকাশের সীমানায় দাঁড়িয়ে তুষারশৃঙ্গরাজি। সন্ধ্যার স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। নিয়ম মেনে জমাট বাঁধল অন্ধকার। সান্দাকফু থেকে জোছনা রাতের সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যতই কোনো সুদূর কল্পলোকের। রাত গভীর হল।

১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ (সান্দাকফু থেকে ফালুট):
#হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা...


দরজায় টোকার শব্দে ঘুম ভাঙল। স্লিপিং ব্যাগের চেন খুলতেই বাইরের ডিপ ফ্রিজের ঠান্ডা মুচকি হেসে গুডমর্নিং বলল। আপাদমস্তক ঢেকে বেরিয়ে পড়লাম সবাই। প্রবল ঠান্ডায় হাত পা অবশ হয়ে আসছে।

পুব আকাশে তখন রক্তিম আভা। সামনে সদলবলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কুম্ভকর্ণ থেকে পান্ডিম...সবাই তৈরি দিনের আলো বুক পেতে নিতে। সামনেই গোলাপি আবিরমাখা কাঞ্চন। একটু বাঁদিকে অপেক্ষায় তিন বোন (থ্রি সিস্টার্স – লোৎসে, মাউন্ট এভারেস্ট, মাকালু)। এক এক করে প্রথম আলো ছুঁয়ে গেল সবাইকে। জেগে উঠল হিমালয়। সন্ধের ঘরে ফেরা পাখির দল আবার ডানা মেলল আকাশে। এক নতুন দিনের সন্ধানে।

সান্দাকফু থেকে ফালুট একুশ কিলোমিটার। পথে পড়বে সাবারগ্রাম। সেটাও প্রায় চোদ্দ কিলোমিটার। গোটা রাস্তায় কোথাও কিছু নেই। নেই কোনো জলের ব্যবস্থাও। প্যাকড লাঞ্চ নিয়ে শুরু হল পথচলা। সান্দাকফু থেকে আলেতে পৌঁছে দেখলাম ক্যাম্পসাইটের তাঁবু তখনও গোটানো হয়নি। সামনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। এগিয়ে চললাম। সান্দাকফু থেকে সাবারগ্রামের রাস্তা বড় মোহময়। শুরুতে কিছুটা উতরাইয়ে নেমে শুকনো ঘাসে ঢাকা তৃণভূমি, মাঝে মধ্যে সবুজ পাইন, ফার। হাওয়ার বেগ যেখানে প্রবল, জীবিত গাছের সংখ্যা সেখানে নেহাতই নগণ্য। বজ্রপাতে জ্বলে যাওয়া গাছ, তুষারপাতের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ন্যাড়ামাথা গাছের সংখ্যাই বেশি। ভেঙে পড়া গাছের মাথায় বাসা বেঁধেছে হিমালয়ান ঈগল। এক ধ্বংসকে কেন্দ্র করে মাথা তুলছে এক নবীন, কোন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। ছুটে আসা উন্মত্ত বাতাস ওয়াকিং স্টিকের ছিদ্রপথে প্রবাহিত হয়ে তুলছে বাঁশির অলীক সুরের মুর্ছনা। সামনে অনন্ত দিগন্তরেখায় হিমালয়। উত্তরের অতন্দ্র প্রহরী। হয়ত সেই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। হেঁটে চলেছি আমরা... সম্মোহিতের মত।

পথে পড়ল পশুপালকদের কিছু অস্থায়ী ছাউনি। বরফজমা পাহাড়ি নালা। ঘাসজমিতে চড়ে বেড়ানো ইয়াক। আমরা হেঁটে চলেছি ... যেন সেই কোন আদিকাল থেকে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে। সঙ্গে বয়ে আনা জল প্রায় শেষ। সাবধানে শেষ কয়েক বিন্দু বাঁচিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। একসময় মুখে হাসি ফোটে। যোগেশ ভাই জানাল, সামনে এক ঝরনায় জল পাওয়া যেতে পারে। একদল তৃষ্ণার্ত চাতককে ফেলে রেখে বাপ্পা আর যোগেশ ভাই সরু পাকদন্ডী বেয়ে জঙ্গলের পথে হারিয়ে গেল। এক অন্তহীন অপেক্ষা। অবশেষে দুজনের দুহাত ভর্তি জলের বোতল দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। আমাদের চাওয়াপাওয়াগুলো হয়ত আদতে খুবই নগণ্য। কী জানি!

সাবারগ্রাম পৌঁছে একটু বিরতি। লজেন্স, চকোলেট, গ্লুকোজ জল দিয়ে শরীরে শর্করার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা। সবরগ্রাম থেকে ফালুটের রাস্তা ক্রমশ চড়াই। সারাদিনের হাঁটার ক্লান্তি বাড়াতে হাজির মেঘের দল। মেঘছায়ার আলো-আঁধারির সঙ্গে সঙ্গে খেলতে খেলতে এগিয়ে চললাম। হাওয়ার বেগ বাড়াতে মেঘের দেশে আবার ফিরল রোদের তেজ। ফালুটে পৌঁছানোর আগে শেষ চড়াইয়ের শরীর আর চলতে চায় না। হাত পা ছড়িয়ে দম নিচ্ছি সবাই। শেষ বিকেলের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে। একটু দূরের ফালুটে একমাত্র ট্রেকার্স হাট ঘিরে এক বিষণ্ণ, বয়স্ক বিকেল ঢলে পড়ছে সন্ধ্যের কোলে।

১৮ ডিসেম্বর, ২০২০ (ফালুট থেকে গোর্খে):
#আমরা বাঙালী জাতি!!!


রাতে ভালো ঘুম হল না। ট্রেকার্স হাটের কাঠের মেঝে, জানলার পাল্লা, সিলিং-এর ফাঁক গলে ঢুকে পড়ল ছিদ্রান্বেষী ঠান্ডা। জানলার কাচে হাওয়ার প্রবল আস্ফালন। এক এক করে উঠে পড়লাম সবাই। ট্রেকার্স হাটের সামনের চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম ভিউ পয়েন্ট। প্রচন্ড ঠান্ডায় চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হাওয়ার দিকে পিঠ করে বসলাম। সেজে উঠছে চরাচর। 'রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও গো এবার...' - গোলাপি তুলির টানে রাঙিয়ে দিল সে। রঙিন প্রেয়ার ফ্ল্যাগের মন্ত্রগুলো প্রার্থনাসঙ্গীত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল দূরদূরান্তে।

ফালুট থেকে মাউন্ট এভারেস্ট আরও কাছের মনে হয়। নিচে উপত্যকা জুড়ে শুধু মেঘেদের ঘরবাড়ি।

ফালুট থেকে গোর্খে প্রায় পনেরো কিলোমিটার। কিন্তু পুরোটাই প্রায় উতরাইয়ে। সুতরাং হাঁটার কষ্ট এবং সময় দুইই কম লাগবে। বাইরে বেরিয়ে দেখি দুই কিশোরী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পিঠে স্কুল ব্যাগ। ল্যান্ড রোভারে এসে পৌঁছেছে কিছু আগে। গোর্খে যাবে। ঘন জঙ্গলের পথে একসঙ্গে যেতে চায়। উতরাইয়ে নেমে চললাম। ঘন, গহীন পাইন বনের মধ্যে দিয়ে চলেছি। দমকা বাতাসে বাঁশের জঙ্গলে অদ্ভুত সুরের হিল্লোল। কিছুটা অতিপ্রাকৃত।
একটানা হেঁটে চলেছি। বাকিদের থেকে অনেকটা এগিয়ে এসেছি আমরা। আমি, বিল্টুদা, শুভ, লাকি আর পাপাই। সামনের দুই পাহাড়ি কন্যা চঞ্চল প্রজাপতির মত উড়ে চলেছে। পিছনে গড়াতে গড়াতে আমরা। হৃদপিণ্ডের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি বোধহয়। হাল দেখে মেয়ে দুটোর নিশ্চিত করুণা হল। বসে পড়লাম। ভাগ করে চকোলেট, জল খাওয়া হল। উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু মেয়ে দুটো ব্যাগকাঁধে তৈরি। ওদের এগোতে বলে আর একটু ল্যাদ খাব ভাবছি... বিল্টুদা বলে উঠল, "আমরা বাঙালি। ক্ষুদিরাম, নেতাজী কত বীর বিপ্লবীর রক্ত বইছে আমাদের ধমনীতে। আমরা ক্লান্তির কাছে হেরে যাব? জাগো বাঙালি জাগো।" উঠে দাঁড়াল বাঙালি! বীরদর্পে আর কোথাও ল্যাদ না খেয়ে বাকিদের থেকে পৌনে দুঘন্টা আগে পৌঁছে গেলাম গোর্খে। জি.টি.এ ট্রেকার্স হাটের দোতলার দুটো ডর্মিটারিতে আমাদের লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম।

ছবির মত সাজানো গ্রাম। ঘন পাইন বনের মাঝে গোর্খে নদীর তীরে গুটিকয় বসতি। একটা ট্রেকার্স হাট। বেশ কয়েকটা হোমস্টে। দূরে একটা ওয়াচ টাওয়ার। পাহাড়ের গায়ে ধাপি কেটে বানানো চাষের জমি। রেলিঙঘেরা কাঠের ছোট ছোট রঙিন বাহারি ঘরের সামনে কেয়ারি করা বাগান। আলগোছে বেড়ে ওঠা স্কোয়াশের লতা। ছোট একফালি ক্ষেতে টম্যাটো ফলে আছে। পায়ে চলা একলা রাস্তা সবার দুয়ার ছুঁয়ে বনের পথে মিলিয়ে গেছে। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সেটি। উপত্যকা জুড়ে নদী প্রবাহের ছান্দিক অনুরণন। দূরে পাইনণবনের কোণ ঘেঁষে একটুকরো মেঘ ছেঁড়া ঘুড়ির মত লাট খাচ্ছে। বাতাসে খুশির ছোঁয়া। কেন জানি মনে হয় এই গ্রামে দুঃখ থাকতে পারে না!
দুপুরের লাঞ্চে ভাত, ডাল, আলুভাজা আর কপির তরকারি। অনেকদিন পর খোশগল্পে কাটল সারা দুপুর। রাতে বনফায়ারে গান আর দেশি মুরগির স্বাদ হয়ত সারা জীবন মনে থাকবে।


১৯ ডিসেম্বর, ২০২০ (গোর্খে থেকে সামানদিন):
#মোরিনহো বনাম গুয়ার্দিওলা


অনেকদিন পর সকালে ওঠার কোনো তাড়া নেই। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পরই সকাল সকাল ঘুম ভাঙে। বরাবরের অভ্যেস। এবারও তাই হল। খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। গোটা পাহাড় জুড়ে শুধু নাম না জানা অজস্র পাখির ডাক। চা খেয়ে গ্রামটা একটু ঘুরে নিলাম। ক্ষেত ভর্তি সব্জি। কোথাও রাসায়নিক সারের ব্যবহার নেই। প্লাস্টিকহীন, দূষণহীন আদর্শ গ্রাম। পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
যোগেশ ভাই গোর্খে থেকে বিদায় নিল। ওর গ্রামে কাল ফুটবল টুর্নামেন্ট। মন খারাপ হয়ে গেল। এই ক'দিনে আমরা একটা পরিবার হয়ে উঠেছিলাম।
স্নান করে, আলু পরোটা দিয়ে সকালে জলযোগ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। আজ সারাদিনের তেমন কোনও লক্ষ্য নেই। ভবঘুরের জীবন। গোর্খে থেকে সামানদিনের দূরত্ব খুব কম। দুই কিলোমিটারের আশেপাশে। গোর্খে থেকে রাম্মাম যাওয়ার রাস্তায় চললাম। আকাশছোঁয়া পাইন বনের জঙ্গল, সূর্যের আলো প্রবেশের অধিকার রহিত। কাঠের লগবাঁধানো মাটির রাস্তা, কোথাও বা সিমেন্টের। বাঁক ঘুরে একফালি খোলা জায়গা। হাত-পা ছড়িয়ে গড়িয়ে নিলাম সবাই। পায়ে পায়ে হাজির সোনালি পশমের বলের মতো সারমেয়। গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল পাপাইয়ে গা ঘেঁষে। হাবভাবে যেন বহুদিনের পরিচিত। আমরা উঠে দাঁড়াতে, গা ঝাড়া দিয়ে তিনিও চললেন সঙ্গে। বলা ভালো পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সামানদিনের দিকে।

প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম সামানদিনের। এরকমও হয়!!! এত মোহময়। গহীন পাইন জঙ্গলের মধ্যে দ্বীপের মতো একটুকরো জনপদ। সাকুল্য কুড়ি-পঁচিশ ঘর লোকের বসবাস। ঝকঝকে তকতকে। কয়েকটা মাত্র হোমস্টে। সামানদিন ছুঁয়ে রাস্তা নেমে গেছে রাম্মামের দিকে। ঢুকতেই গ্রামের এক দিদি জিজ্ঞেস করলেন চা-কফি কিছু লাগবে কিনা। এখানে সেই অর্থে কোনো দোকান নেই। কফি খেতে খেতে দিদির কাছে দুপুরে লাঞ্চের কথাও বলে দেওয়া হল। দেশি মুরগির ঝোল আর ভাত। সামনেই একটা ফুটবল মাঠ। দিদিকে বলতে ফুটবলও জোগাড় হয়ে গেল। দুই দলে ভাগ হয়ে, মিনি গোলপোস্ট করে খেলা হবে। আমার আর শুভর ইচ্ছে করছিল না। মাঠের পাশের বেঞ্চে আয়েশ করে বসলাম। হাবেভাবে যেন বিরাট মাপের দুই কোচ। মোরিনহো বনাম গুয়ার্দিওলা। এই অবধি ঠিকই ছিল কিন্তু বাঙালি ছেলে মাঠের ফুটবল ছেড়ে বসে থাকবে সেটা ভাবাটা একটু কষ্টকর। তাই ইতিহাসের পাতায় নাম তুলতে দুই কোচও ফুটবল পায়ে সম্মুখ সমরে নেমে পড়ল।
আক্রমণ প্রতি আক্রমণে খেলা জমে উঠেছে। মাঠের বাইরে দুচারজন দর্শকও জুটে গেছে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর আমরা জিতলাম ৩-১ গোলে। হিমালয়ের বুকে সেই অবিস্মরণীয় ম্যাচের পর দেশি মুরগির ঝোল আর ভাত... যেন অমৃত। লাঞ্চের পর আরও কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে ফেরার পথ ধরলাম। সোনালী পশমের সেই চতুষ্পদী বন্ধু আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেল গোর্খের একটু আগে পর্যন্ত। যেখানে তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল।

২০ ডিসেম্বর, ২০২০ (গোর্খে থেকে ভারেং):
#ইয়ে গলতি ভারি পড় সকতা থা...


গোর্খে ছেড়ে আসার সময় সবারই মনখারাপ। সঙ্গে যোগেশ ভাই নেই। তাই গোর্খে থেকে ভারেং-এর রাস্তা জেনে নিয়ে চলতে শুরু করলাম। পুরো গ্রামটা এক পাক দিয়ে নদীর দিকে নেমে গেলাম। ব্রিজ টপকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিমে। পায়েচলা মাটির রাস্তা জঙ্গলের দিকে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। নীল আকাশের নিচে গোর্খে গ্রাম যেন ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। ঝিঁঝিঁডাকা গহীন বন দিনের বেলায়ও বেশ গা ছমছমে। রাস্তা বেশ সহজ সরল, অহেতুক চড়াই উতরাইয়ে পথিককে বিপদে ফেলার কোনও অভিপ্রায়ে নেই। জঙ্গল ক্রমশ গভীর হচ্ছে। রাস্তা হারালেই বিপদ। কোনো শর্টকাট নেওয়ার চেষ্টা করিনি। পায়েচলা পথ মাঝে মধ্যেই শুকনো পাতায় ঢাকা পড়েছে। জঙ্গলের একধারে একটু বেশি আকাশ দেখা যাচ্ছে... একটা পাতা ঢাকা কুটির। কথা বলে জানা গেল আমরা ঠিক রাস্তায় এসেছি। আর কিছুটা গেলেই ভারেং।
ভারেং গ্রামের প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। কয়েকজন বয়ঃবৃদ্ধ দুপুরের রোদের উষ্ণতায় আড্ডায় মশগুল। জিজ্ঞেস করলাম 'দোর্জি শেরপার' ফেনেশা হোমস্টের রাস্তা। রাস্তা বলে দিয়ে একজন জিজ্ঞেস করলেন, "আপ লোগো কা গাইড কিধার হ্যায়?"
নেই, শুনে ঘাড় নেড়ে বললেন, "ইয়ে গলতি ভারি পড় সকতা থা। গয়ে সাল দো তিন লোগ ভটক গ্যয়ে থে জঙ্গল মে। তিন দিন বাদ মিলে...।" সম্পুর্ণ অজানা, অচেনা একদল ছেলের জন্য এই উৎকণ্ঠা দেখতে হয়ত আমরা অভ্যস্ত নই। মন ছুঁয়ে গেল। মাথা ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে চললাম।
ফেনেশা হোমস্টের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে এক খুদে। বছর দু-তিন হবে হয়তো। অবাক চোখে দেখছে আমাদের। লাঞ্চের সময় গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির। চকোলেট ঘুষ দিয়ে বন্ধুত্ব পাতালাম। কোলে বসে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করল। নাম বলল, 'খুংশুক ডোমা শেরপা'। দেখতে দেখতে বন্ধুত্ব একটু গাঢ় হল। হাসি খেলায় মেতে উঠলাম সবাই। কখনো বিড়াল কোলে বিছানায়, কখনও খড়ের গাদায় গড়াগড়ি...। তার বন্ধুরা এসে ডেকে ডেকে ফিরে গেল। আজ সে নতুন বন্ধু পেয়েছে। রাত বাড়লে অনেক কষ্টে খুংশুককে তার মায়ের জিম্মায় দিয়ে এলাম।

২১ ডিসেম্বর, ২০২০ (ভারেং থেকে নিউ জলপাইগুড়ি):
#Do widzenia


ঘুম ভাঙার পরও বিছানা ছেড়ে নড়তে ইচ্ছা করছিল না। বিল্টুদা যথারীতি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে গেছে। আর আড্ডা যেন শেষই হতে চায় না। একটু পরেই বেরোতে হবে। আজ রাতে ফেরার ট্রেন। জানি না আবার কবে একসঙ্গে দেখা হবে...। লাগেজ গুছিয়ে একে একে স্নান করে তৈরি হয়ে নিলাম সবাই। আজ স্পেশাল ব্রাঞ্চ। বাবুকা'র পুরি তার সঙ্গে আলুর তরকারি। পুরিতে ছাতুর স্পেশাল স্টাফিং।
সাড়ে আটটা নাগাদ মায়ের হাত ধরে তিনি হাজির। খুংশুক ডোমা শেরপা। চাষের ক্ষেতে যাবার আগে তার মা তাকে মাসির কাছে রেখে যায়। আর মাসি হলেন আমাদের হোমস্টের দিদি। খুংশুক এসেই কোলে ঝাঁপিয়ে উঠল। কোলে পিঠে চড়ে নানান কসরত দেখিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল আমাদের। কখনও আমার ফোন নিয়ে সেলফি, কখনও বিড়াল ছানার ক্যান্ডিড...!
গাড়ি হাজির। রুকস্যাক গাড়ির মাথায় তুলে বেঁধে ফেলা হয়েছে। তখনো কিছু বুঝতে পারছে না সে...। তার বন্ধুরা তাকে ফেলে চলে যাবে এটা সে ভাবতেই পারছে না! একে একে গাড়িতে উঠছি সবাই। মাসির হাত ছাড়িয়ে গাড়ির খুব কাছে চলে আসছে খুংশুক। "খুংশুক হট যাও...লাগ যায়েগি তুমহে..." ফরসা টুকটুকে গাল অভিমানে লাল হয়ে উঠেছে। দুটো মায়াবী চোখ জলে ভরা। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ঢালু পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ির পিছনে ছুটে আসছে খুংশুক। জানি ফিরে আসার মিথ্যা আশ্বাসে কোনও কাজ হবে না। গলার কাছে একটা দলাপাকানো কষ্ট। গাড়ির রিয়ার ভিউ ফাইন্ডারে, চশমার কাচে ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে খুংশুক... দূরত্ব, কুয়াশা না কী অন্য কিছু ঠিক বুঝতে পারলাম না...

~ সান্দাকফু ট্রেক রুটম্যাপ || সান্দাকফু ট্রেকের আরও ছবি ~

পেশায় জিওলজিস্ট সুদীপ্ত ঘোষ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে জীববিদ্যার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, বর্তমানে ভারত সরকারের ‘জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার’ জয়পুর অফিসে কর্মরত । কাজের জন্য বছরে ছয় মাস কাটে পাহাড়ে, জঙ্গলে। ফিল্ডে অবসর কাটে বই পড়ে, ক্রাইম থ্রিলার আর ভ্রমণকাহিনি বিশেষ পছন্দ। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পাখি দেখাও পছন্দের তালিকায় নতুন সংযোজন। ভালো লাগে ঘুরে বেড়াতে। পাহাড় আর জঙ্গল দুইই বিশেষ প্রিয়। এছাড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া অন্যতম পছন্দের কাজ। লেখালেখির হাতেখড়ি ‘আমাদের ছুটি’ আন্তর্জাল পত্রিকায়।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher