পুরী থেকে পশ্চিমে সতপদায়

তপন পাল


সতপদায় প্রথমবার গিয়েছিলাম ছিয়ানব্বই সালে। পুরী গিয়েছিলাম, একদিন স্বর্গদ্বার থেকে হোটেলে ফিরছি, দেখি মহোদধি প্যালসের সামনে একজন মাইক নিয়ে কিসব বলছে। বলছে ওড়িয়ায়,তবে ডলফিন শব্দটি বারদুয়েক শোনা গেল। কৌতূহলী হয়ে একটি হ্যান্ডবিল নিয়ে দেখা গেল তার এক পিঠে ওড়িয়ায়, আর অন্য পিঠে বাংলায় লেখা। এবার থেকে প্রতি বুধবার ও রবিবার উড়িষ্যা সরকারের উদ্যোগে একটি ছোট বাস সকাল আটটায় মহোদধি প্যালেসের সামনে থেকে ছেড়ে অলরনাথ মন্দির ও বলিহারিচণ্ডী মন্দির হয়ে আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরে চিলিকাতীরের সতপদায় যাবে। তদবধি বাঙালি সতপদার নাম শোনেনি – সে তখন চিলিকাকে চিল্কা বলতো; আর ভাবতো বালুগাঁওই চিলিকার একতম অধিগম্যতা। সতপদা শুশুক (Irrawaddy dolphin; orcaella brevirostris) এর জন্য খ্যাত। যাত্রীরা সেখানকার পান্থনিবাসে মধ্যাহ্নভোজ সারতে পারবেন, নৌকা ভাড়া নিয়ে শুশুক দেখতে পারবেন – চারটের সময় বাস সতপদা ছেড়ে বিকালে পুরী ফিরে আসবে। আমরা তক্ষুনি গিয়ে নাম লেখালাম,এবং ঘুরেও এলাম।
সেবারে একটি ভারি মজার ঘটনা ঘটেছিল। সতপদার এক রিকশাচালকের হাতে ছিল একটি কচ্ছপের ছানা (Indian Roofed Turtle; pangshura tecta)। পুত্র সেটি দেখে নাছোড়; ওটিকে সে বাড়ি নিয়ে যাবেই। রিকশাদাদারও কচ্ছপের ছানা দিতে আপত্তি নেই, বরং উৎসাহই আছে। বন্যপ্রাণ আইন তদবধি জনমানসে খুব একটা দাগ কাটেনি। কিন্তু আমার বিপদ ষোল আনা। রেলগাড়িতে তাকে কিভাবে নিয়ে যাওয়া হবে,বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাকে কিভাবে রাখা হবে,মহানদী অববাহিকার এই বাসিন্দা পুরসভার কলের জলে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন কি না – ইত্যাকার উদ্বেগে আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। অবশেষে রফা হল, আমরা বাড়ি গিয়ে চানঘরে মাটি আর বালি দিয়ে একটা দ্বীপ বানাবো, সেখানে কিছু জলজ গুল্ম লাগিয়ে দেব; তারপর ফের সতপদা এসে তাকে নিয়ে যাব। ততদিনে সেও একটু বড় হয়ে যাবে। ছাব্বিশ বছর কেটে গেছে। সেই কূর্মশাবককে আর নিয়ে আসা হয়নি। জানি না এই ছাব্বিশ বছরে ভগবান বিষ্ণুর সেই দ্বিতীয় অবতার কত বড় হয়েছেন!
তখন পুত্র ছিলেন দশ। এখন পৌত্রী ছয়। তার পিতা শুশুক দেখে থাকলে তিনিই বা দেখবেন না কেন? অতএব আমরা সতপদায়। পুরী থেকে একটি গাড়ি ভাড়া করে প্রাতরাশান্তে বেরিয়ে অলরনাথ মন্দির ও বলিহারিচণ্ডী মন্দির হয়ে সতপদায়।
অলরনাথ মূলত বিষ্ণুমন্দির। সত্যযুগে, বলা নেই কওয়া নেই, মহর্ষি ব্রহ্মা এখানকার পাহাড়ের উপরে বিষ্ণুর স্তবস্তুতি শুরু করে দেন। বিষ্ণু,ওই আর কী,বার খেয়ে...; মহর্ষি ব্রহ্মাকে পাহাড়চূড়ায় গরুড়সহ বিষ্ণুমূর্তি স্থাপনের অনুমতি দেন; এই বিষ্ণুমূর্তিই অলরনাথ। মহর্ষি ব্রহ্মা এই পাহাড়ে বিষ্ণুকে তুষ্ট করেছিলেন বলে পাহাড়ের নাম হয় ব্রহ্মগিরি। রাজস্থানের আলোয়ারের রাজা সম্ভবত এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন; সেই সূত্রে বিষ্ণু এখানে আলোয়ারনাথ বা অলরনাথ। প্রথাগত চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি, সঙ্গে গরুড় তো আছেনই, আর আছেন দুই কৃষ্ণজায়া, রুক্মিণী আর সত্যভামা। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পিছনের চন্দনসরোবরে চন্দনযাত্রা হয় বছরে একুশ দিন। স্নানযাত্রার পর শ্রীজগন্নাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন,তাঁর জ্বর আসে। রাজবৈদ্য তাঁর চিকিৎসা করেন। অসুস্থতার এই পর্যায়টি 'অনসর' নামে পরিচিত। এই সময় ভক্তেরা দেবতার দর্শন পান না। তাঁদের দর্শনের জন্য বিগ্রহের পরিবর্তে মূলমন্দিরে তিনটি পটচিত্র রাখা হয়। এই সময় ভক্তেরা ব্রহ্মগিরিতে অলরনাথ মন্দিরে আসেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, অনসর পর্যায়ে জগন্নাথ অলরনাথ রূপে অবস্থান করেন।

গল্প বলে অনসরকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রভু জগন্নাথের দর্শন না পেয়ে আকুল হয়ে পড়েন। শ্রীজগন্নাথ তাঁকে জানান,অনসরকালে তিনি ব্রহ্মগিরির অলরনাথ মন্দিরে বিশ্রাম করেন। তদনুযায়ী, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এখানে এসে শ্রীজগন্নাথদেবের দর্শন পান। বিগ্রহকে সাষ্টাঙ্গ প্রণামকালে তাঁর করুণায় শিলা বিগলিত হয়, হয়ে দেহচ্ছাপ সেই শিলায় উৎকীর্ণ হয়ে যায়। পাণ্ডা মহারাজরা খুব গর্বের সঙ্গে সেই দেহচ্ছাপ দর্শনার্থীদের দেখান; দেখিয়ে দক্ষিণা দাবি করেন। এখানকার ক্ষীরভোগ সত্যিই দেবভোগ্য। পুরীর শ্রীমন্দিরে প্রভু জগন্নাথকে যা যা ভোগ দেওয়া হয়, অনসরকালে অলরনাথজিউকেও তাই তাই ভোগ দেওয়া হয়।

পুরীর সাতাশ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, ভার্গবী নদীর মোহনায় একটি বালিপাথরের টিলার টঙে পূর্বমুখিন বলিহারিচণ্ডী বা হরচণ্ডী মন্দির। দেবী এখানে অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী - নাবিক, নৌকা ও মৎসজীবীদের রক্ষয়িত্রী – সোনার বঁটির উপর উপবিষ্টা। মহানবমীর দিন শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের পূজা এই মন্দিরে পাঠানো হয়। দেবী নাকি রোজ রাত্রে ঘুরতে বেরোন। বালুকাময় ঢেউ খেলানো প্রান্তর, বড় বড় গাছ, লোকালয়হীনতা সেই বিশ্বাসকেই পরিপুষ্ট করে। কিছুটা দূরে কালীমন্দির, খুব কম লোকই সেখানে যান। মন্দিরের স্বল্পদূরত্বে একটি বালিয়াড়ি পেরিয়ে বলিহারিচণ্ডী সৈকত, নির্জন, কুমারী, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। অত্যুৎসাহী যুবকবৃন্দ পুরীর মোহনা থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে আসেন।
সেখান থেকে সতপদা। দিনটি চমৎকার। আকাশ সমুদ্রের মত নীল,তাপমাত্রা না গরম না ঠান্ডা – যদিও উত্তুরে হাওয়া মাঝে মাঝে জানান দিচ্ছে। ফিন এয়ারের হেলসিঙ্কি সেবু উড়ানটি ঊনত্রিশ হাজার ফুট উপরে চমৎকার দুটি সাদা রেখা টেনে গ্যাছে, তাইতে আকাশকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। বস্তুত, গন্তব্যে পৌঁছানোর চেয়ে চলতেই আমার বেশি ভাল লাগে, বিশেষত অদিশার রাস্তায়। এই সমুদ্র তো এই পাহাড়, এই ধানক্ষেত তো এই জঙ্গল, এই গ্রাম তো এই বাজার, এই রেলগাড়ি তো এই পাখির দল। পুরী, খোড়দা ও গঞ্জাম – ওড়িশার এই তিন জেলায় বিস্তৃত চিলিকার বিস্তৃতি ১১৬৫ বর্গ কিলোমিটার; এশিয়ার বৃহত্তম লোনাজলের হ্রদ (brackish water lagoon)। বঙ্গোপসাগরে চিলিকার যে মুখ, সতপদা তার খুব কাছেই। নৌকা যাচ্ছে রাজহংস দ্বীপে, চিলিকার মুখে, চার ঘন্টার দূরত্বে কালিজল মন্দির হয়ে নলবন পাখিরালয়ে। আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদের পর চিলিকা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পরিযায়ী পাখিদের আস্তানা। 'পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না। ছেড়ে দে নৌকা আমি যাব মদিনা'। আমাদের অত সাহস হয়নি,বিশেষত যখন পৌত্রী আছেন। বেড়াতে গিয়ে হঠকারিতা আমার বিলকুল না পসন্দ। নৌকাগুলি সবই যন্ত্রচালিত; তাদের শব্দ ও ঢেউ জলচরদের কাছে কতখানি বিরক্তিকর তা অনুমান করতে পারি। সেইজন্যেই মনে হয় প্রকৃতি পর্যটনের দরজা হাট করে সবাইয়ের জন্য খুলে দেওয়া আদৌ কাঙ্ক্ষিত নয়। যাদের এক্ষেত্রে উৎসাহ ও অবদান আছে, আছে প্রকৃতির বৈচিত্র্য অনুধাবন করার মত শিক্ষা – তাঁরাই শুধু যাবেন প্রকৃতি পর্যটনে। নচেৎ অন্যরা সঙ্গমের পক্ষীকুলকে ভুজিয়া খাওয়াবেন, সতপদার শুশুককে খোঁচা মারবেন, থাইল্যান্ডে বাঘের সঙ্গে আর কাজিরাঙ্গায় ময়াল (Indian rock python; python molurus)এর সঙ্গে ছবি তুলবেন।

নৌকাগুলি বেশ বড়, জনা পনেরো কুড়ি স্বচ্ছন্দে উঠতে পারে; তবু নিরাপত্তার জন্যে আমরা দুটি নৌকা নিলাম। একটিতে আমি পুত্র আর পৌত্রী, অন্যটিতে স্ত্রী ও পুত্রবধূ। মাঝিদাদাদের বলা হল যন্ত্র না চালিয়ে দাঁড় বাইতে, এবং কিছুটা যেতেই শুশুকের দেখা মিলল, প্রথমে দূরবীনে, তারপর খালিচোখে। পৌত্রী তো মহাখুশি,পারলে দু-চারটে ধরে বাড়ি নিয়ে যায়! শুশুকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকদিনের। কৈশোরে, এই সত্তরের দশক অবধি, হুগলী নদীতে দেদার শুশুক দেখা যেত। মেকং-এও আমি শুশুক দেখেছি। পাকেচক্রে আমাকে কিছুদিন লবণ হ্রদের এক অফিসে চাকরি করতে হয়েছিল। অফিসটিতে কাজ কিছু ছিল না,কিন্তু রোজ গিয়ে গরমে বসে থাকতে হত। তখন অলস দ্বিপ্রহরে জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে মনে পড়ত,১৮৫২র জুলাইয়ের বানে এক দঙ্গল ইরাবতী শুশুক ভেসে এসেছিল এই লবণ হ্রদে; হয়তো আমি আজ যেখানে বসে আছি সেইখানটিতেই। এডোয়ার্ড ব্লিথ, শিবপুরের কোম্পানির বাগানের তখনকার সুপারিন্টেনডেন্ট, খবর পেয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন; একটিকে ধরেও এনেছিলেন। তখনও অবধি শুশুককে মনে করা হত তিমির বাচ্চা; সে যে একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি সেটিই জানা ছিল না। শুশুক দেখে প্রত্যাবর্তন; সারথি মহোদয় এখানকার পান্থনিবাসে জানিয়ে দিয়েছিলেন আমরা দুপুরে কী কী খেতে চাই। তদনুযায়ী কচ্ছপের মাপের কাঁকড়া ও হাঙরের মাপের পারশে মাছ অহল্যার মত আমাদের প্রতীক্ষায় ছিলেন। তাদের প্রতি সুবিচার করব, ফেরার পথে।

পথে একজায়গায় দেখলাম মেলা গোছের কিছু হচ্ছে, আর সেখানে তুমুল জোরে বাংলা রঙ্গবতী বাজছে। আশ্চর্য হলাম। জয়দেব থেকে বিদ্যাসাগর, সুভাষ থেকে চৈতন্য, রসগোল্লা থেকে পান্তা ভাত – মালিকানা স্বত্ব স্বামিত্ব নিয়ে বাংলা আর অদিশার মন কষাকষির শেষ নেই; তাইতে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে পদ্মশ্রী মিত্রভানু গাওতিয়া (১৯৪২ - ) র লেখা এই সম্বলপুরি গানটি। প্রভুদত্ত প্রধান (১৯৪৩ – ২০১৮)-এর সুর দেওয়া গানটি নিয়ে অনেক অদিশি ভাইবোনেরই আক্ষেপ যে গানটি বাঙালি বাবুরা হাইজ্যাক করে নিল। চলচ্চিত্রটিতে এই গানটির দৃশ্যে জগন্নাথের পতাকা উল্টো টাঙানো হয়েছিল। তাই নিয়েও অদিশায় প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল। আর এখন এখানে বাংলা রঙ্গবতী বাজছে!

সন্ধ্যায় সমুদ্র; আর স্বর্গদ্বারের নৈশবাজার।

হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূল ক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সে বিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালের বাংলায় ভ্রমণকাহিনি লেখালেখির প্রেরণা 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না।'

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher