বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
একদিনের জনাই ভ্রমণ
সৌমাভ ঘোষ
করোনা নামক একটি আণুবীক্ষণিক জীবের কল্যাণে মানব সভ্যতার বিজয় রথের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হয়ে পড়েছিল। ঘরবন্দি হয়ে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' এবং 'ওয়ার্ক ফর হোম'-এর জাঁতাকলে জীবনটা কেমন যেন বিস্বাদ হয়ে যেতে লাগল। ভ্রমণপিপাসু বাঙালির বিচরণক্ষেত্র ব্যাঙ্ক আর বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। এইভাবে একটা একটা করে দিন কাটছিল ঠিকই কিন্তু জীবনের একঘেয়েমি কাটছিল না বরং আরও বেশি তিক্ততায় ভরে উঠছিল। এই তিক্ততা কাটানোর জন্য দরকার ছিল একটু মিষ্টির। তাই করোনার প্রথম ঢেউ একটু থিতিয়ে পড়তেই মিষ্টত্বের খোঁজে আমরা পাড়ি দিলাম জনাই। কারণ একটাই জনাই-এর মনোহরণকারী মনোহরা।
সকালের হাওড়া-বর্ধমানগামী কর্ড লাইনের ট্রেনে মাস্ক পরে আর স্যানিটাইজার সঙ্গে নিয়ে সকলে বেলুড় থেকে চেপে বসলাম এবং যথাসময়ে নামলাম জনাইরোড স্টেশনে। এতদিন ঘরবন্দি থাকার পর বেরোনো হয়েছে তাই কেউই শুধুমাত্র মিষ্টি খেয়েই বাড়ি ফিরতে রাজি নয়! আপাতত স্টেশনের কাছেই একটা দোকানে গরম গরম হিংয়ের কচুড়ি, ছোলার ডাল, জিলিপি এবং ধূমায়িত চা সহযোগে জলযোগ সারা হল এবং তার সঙ্গে দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে রওনা দিলাম জনাই বাজার। সেখানেই রয়েছে সারি সারি জনাই-এর প্রধান আকর্ষণ মনোহরার দোকান। দেখে সত্যিই বলতে ইচ্ছে করে 'এ কোথায় এলাম!' যেদিকেই তাকাই প্রত্যেক দোকানে সুসজ্জিত রয়েছে মনোহরণ, গোলাকার গড়ন মনোহরা। তাদের অমোঘ হাতছানি উপেক্ষা করে আমরা পাড়ি জমালুম দর্শনীয় স্থানের উদ্দেশ্যে।
রাস্তায় প্রথমেই পড়ল কালীবাবুর বাড়ি মতান্তরে জনাই জমিদারবাড়ি। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের কারণে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান না থাকায় বর্তমানে বাড়িটির অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। সামনের দিকটা মোটের ওপর ভাল থাকলেও ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই। চৌহদ্দির মধ্যেই রয়েছে দুটি শিবমন্দির। তার পাশেই দেখলাম চলছে ঠাকুর তৈরির কাজ। কোথাও কাঠামো নির্মাণ, কোথাওবা খড়ের ওপর মাটি লেপার কাজ। একজন পটুয়া নিপুণ হস্তে মৃন্ময়ী দেবীর চোখ আঁকছেন। আমরা গিয়েছিলাম জানুয়ারি মাসের শেষাশেষি, চোখে পড়ল রোদের মধ্যে পর পর দাঁড়িয়ে রয়েছে বাগদেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি রঙের অপেক্ষায়। জানা গেল করোনার প্রকোপ থাকায় ঠাকুর একটু কমই বায়না হয়েছে।
সেখান থেকে পাড়ি জমালুম বারো শিবমন্দির। পথে পড়ল জোড়া শিবমন্দির। পাশাপাশি ছয়টি করে শিব মন্দির দুই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণের পাশে শ্মশান। প্রাঙ্গণটি ছাড়িয়ে আর একটু এগোলে চোখে পড়ল মিত্র বাড়ির ভিটে। দেখলেই বোঝা যায় এককালে বেশ বর্ধিষ্ণু ছিল বাড়িটি,বর্তমানে পিকনিক স্পট হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়ে থাকে। মিত্র ভিটের সামনে একদিকে রয়েছে নাটমন্দির, অন্য দিকে মিত্রদের প্রতিষ্ঠিত রাধা-গোবিন্দ জিউয়ের মন্দির। কথিত আছে, এই মন্দিরের আদলেই রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরটি নির্মাণ করান।
এরপর চৌধুরীদের নাটমন্দির ও দুর্গা দালান যাওয়ার পথে পড়ল বদ্যিমাতার মন্দির। প্রাঙ্গণে অবস্থিত হাঁড়িকাঠ এখনও মন্দিরে বলি হওয়ার সাক্ষ্য বহন করছে। এরপর চৌধুরীদের নাটমন্দির ও দুর্গা দালান। বাড়িটির গড়নও চৌধুরীদের স্বচ্ছল অবস্থারই পরিচায়ক। নাটমন্দির ও দুর্গা দালান ডানপাশে রেখে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে চৌধুরীদের প্রতিষ্ঠিত রাধা মাধবের মন্দির। দুর্গা দালানে পুজো হয় আর নাটমন্দিরে হয় রাস উৎসব। করোনাকালের জন্য মাটিতে আঁকা গণ্ডী প্রচুর লোকসমাগমের সাক্ষ্য বহন করছিল।
এসব দেখতে দেখতেই দুপুর হতে চলল। এইবার ফেরার পালা। পথে পড়ল একটি অপূর্ব সুন্দর নার্সারি। শীতকাল একদিকে যেমন ভ্রমণের সময়, তেমনই প্রকৃতিও সেজে ওঠে বিভিন্ন রঙে। তারই স্পর্শ লেগেছে এই নার্সারিতে। ডালিয়া, গোলাপ,পিটুনিয়া, গাঁদা চারিদিক ভরে রয়েছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। নার্সারি দেখে পৌঁছলাম জনাই বাজারে।
সবশেষে মধুরেণ সমাপয়েৎ হল মনোহরা দিয়ে। মিষ্টি কিনলাম ছোটু ময়রার দোকান থেকে। আলাপ হল ছোটু বাবুর ছেলের সঙ্গে। তিনিই বর্তমান মালিক। দেখলাম সাদা ধবধবে কাঁচাগোল্লার ওপর ঘন চিনির রস ঢেলে দিয়ে কিছুক্ষণ খোলা হাওয়ায় রাখলেই তৈ্রি হয়ে যাচ্ছে মনোহরণকারী মনোহরা। তবে ক্রেতার চাপ খুব থাকলে কৃত্রিম উপায়ে পাখা চালিয়েও রস জমাট করে মনোহরা তৈ্রি করা হয়ে থাকে। ৫, ১০, ১৫, ২০ টাকা বিভিন্ন দামের মনোহরা রয়েছে। জিজ্ঞেস করতে জানলাম দামটা একান্তভাবেই মনোহরার আকারের সঙ্গে সমানুপাতিক কারণ উপাদানের কোন হেরফের নেই। হাল্কা দাঁতের চাপেই চিনির দুর্গের পতন হল। ভেতর থেকে অমনি বেড়িয়ে এল ছোট এলাচ ও পেস্তা সহযোগে মিহি ক'রে গড়া ছানার কাঁচাগোল্লা। যেমন তার স্বাদ তেমনই তার সুবাস।
মনোহরা ছাড়াও আলাপ হল নিখুঁতি আর রাম বোঁদের সঙ্গে। এঁরা দুজনও নিজেদেরকে শক্ত চিনির আস্তরণের মধ্যে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করেন। প্রথমে আসি নিখুঁতির কথায়। আকার ভেদে ৫ এবং ১০ টাকার দুরকম নিখুঁতি পাওয়া যায়। ওপরের চিনির আস্তরণে অসাবধানে কামড় বসালে ভিতরের টলটলে রস গায়ে চলকে এসে পড়ে জামা ভিজিয়ে দিতে পারে। সেকারণে এঁকে জিভের ওপর রেখে কামড় দেওয়াই ভাল। তবে একটা কথা মানতেই হবে কামড় দেওয়ার পরের অনুভূতিটা সত্যিই স্বর্গীয়! এরপর বলি রাম বোঁদের কথা। এটি বিক্রি হয় ওজনে। এর ওপরও থাকে চিনির রসের শক্ত আস্তরণ।
এবার প্রশ্ন হল কেন এই চিনির আস্তরণ? জামাই ঠকানো নাকি মিষ্টি ভাল রাখা - যে কারণেই হয়ে থাকুক না কেন অসাধারণ প্রণালী। শুধুমাত্র মিষ্টিকে ভাল রাখে তাই নয়, স্বাদও বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। মিষ্টি খেয়ে এবং বাড়ির জন্য কিনে টোটোয় চড়ে বসলাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
স্টেশনের কাছে মধ্যাহ্ণভোজন সেরে হাওড়াগামী ট্রেনে চাপলাম। রথ দেখাও হল, কলা বেচাও হল। মাস্কে মুখের অর্ধেক ঢাকা থাকলেও সকলের মুখ-চোখের অভিব্যক্তি সাক্ষ্য বহন করছিল যে করোনাকালের এই ভ্রমণ যেন এক ঝলক মুক্ত বাতাসের স্পর্শ এনে দিয়েছে সকলের মনে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. টেক সৌমাভ ঘোষ বর্তমানে রেডিওফিজিক্স-এ পি.এইচ.ডি.রত। দেশবিদেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজের ফাঁকে অবসর কাটে বই পড়ে, ছবি এঁকে আর লেখালেখি করে। সবরকম বই পছন্দ হলেও ঐতিহাসিক ভ্রমণ ও থ্রিলারের আকৃষ্ট করে খুব। এছাড়াও ভালবাসেন বেড়াতে - সমুদ্র এবং ঐতিহাসিক স্থান বেশি পছন্দের। ভ্রমণের সঙ্গে অবশ্যই মিশে থাকে ভোজন - "ফুড ওয়াক"।
বড়ন্তির সূর্যাস্ত
অরিন্দম পাত্র
শুধু একটা সানসেট দেখতে এতদূর ছুটে আসতে হবে!! বাড়ির লোকজন চটে লাল আমার প্রস্তাব শুনে! বাবা বাছা করে বোঝাতে শুরু করলাম…। উফফ, নেপালের নাগারকোটে কি দেখোনি দুর্দান্ত একটা সানসেট? বা কৌশানির অনাসক্তি আশ্রম প্রাঙ্গণ থেকে দেখা অস্তগামী সূর্যের শেষ কিরণে আলোকিত ত্রিশূল পর্বত? বড়ন্তিও কিছু কম যায় না। আরে, একবার গিয়ে দেখোই না! সঙ্গে এইসময় উপরি পাওনা থোকা থোকা পলাশ ফুল! এছাড়াও আছে আরও অনেক সাইট-সিইং-এর জায়গা। জয়চন্ডী পাহাড়, বেরো হিল, গড়পঞ্চকোট, মাইথন... চলোই না!
এত বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়ে শেষমেশ চলেই এলাম বড়ন্তি! হাওড়া থেকে পূর্বা এক্সপ্রেস ধরে আসানসোল, তারপর গাড়িতে ঘন্টা দেড়েকের পথ পেরিয়ে বড়ন্তি গ্রাম। ঠাঁই হল বড়ন্তি নেচার ইকো রিসর্টে। সুন্দর খেলার জায়গা -বাচ্চাদের জন্য সঙ্গে খাঁচায় বন্দী অনেক পাখি আর খরগোস। ছেলের খুব পছন্দ হল দুই এমু পাখিকে।
পৌঁছেই সবাই খিদেতেষ্টায় কাতর হয়ে পড়লাম। রিসর্টের ডাইনিং হলে দ্বিপ্রাহরিক আহারপর্ব সেরে অল্প বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছে হল বাকিদের। কিন্তু আমার মন টানছে বাইরে। বেরিয়ে ডানদিকে অল্প পা চালিয়ে এগোলেই বড়ন্তি লেক। চারিদিকে পলাশের ছড়াছড়ি। ক্যামেরা হাতে করে বেরিয়ে পড়তেই হল। কাঁহাতক অলস ভাবে বসে থাকা যায়!
পলাশের সমাহার। লালে লাল চারিদিক। আগুনরঙা সেই পরিবেশ সত্যিই মন ভাল করে দেয়। আশ মিটিয়ে পলাশের ছবি তুললাম।
আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে এল। প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজে। বাকিরা এতক্ষণে গা ঝাড়া দিয়ে আলসেমি কাটিয়ে বেরিয়ে এল। "সূর্য ডোবার পালা, আসে যদি আসুক বেশ তো!" সানসেট দেখতে হবে যে -বড়ন্তির বিখ্যাত সূর্যাস্ত!
বেশ অনেক জায়গায় সানসেট দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছে। সে ইঙ্গিত আগেই দিয়েছি। কিন্তু পুরুলিয়ার বড়ন্তি লেকে যে সূর্যাস্ত দেখলাম তা অনেকদিন মনে থাকবে।
ধীরে ধীরে দিনমণি অদৃশ্য হয়ে গেলেন লেকের জলে। আকাশে কিন্তু তার রেশ রয়ে গেল বহুক্ষণ! সেই রাঙা আলোয় আধো-অন্ধকারে লেকের জলে ব্যস্ত কয়েক জন ধীবর ভাই। ছোট ছোট ডিঙি নৌকো চেপে মাছশিকারে মগ্ন তাঁরা তখনো। তারপর আকাশে চাঁদ উঠল আধখানা। চারিদিকের পরিবেশ আরও মোহময় হয়ে উঠেছে। আকাশের রঙের খেলা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসতে লাগল। এবারে ঝুপ করে আঁধার নেমে আসার পালা।
আমরা একদল মানুষ তখন এই অপরূপ প্রাকৃতিক পট দর্শন করে মুগ্ধ, বিস্মিত, হতবাক! নাঃ, সত্যিই বড়ন্তির সূর্যাস্ত অনন্যতায় এক আলাদা স্থান পাবেই!
মার্চে পলাশ রাঙা বড়ন্তি তো দেখা হল। ইচ্ছে রইল একবার বর্ষার ঠিক পরে পরেই আসার! আকাশজোড়া মেঘের খেলা আর নানান রঙের ছটায় দীপ্ত সূর্যাস্ত্ দেখার জন্য।
পেশায় চিকিৎসক (নাক কান ও গলা বিশেষজ্ঞ) অরিন্দম পাত্রের নেশা ছবি তোলা। এছাড়াও দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ভ্রমণ করা তাঁর আর এক শখ। ইদানীং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নিয়মিতভাবে 'আমাদের ছুটি'-র পাতায় লেখালেখি।