বাঘের বাসা থেকে ফিরে আসা
সুবীর কুমার রায়
২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি। ভুটানের ‘হা’ শহর থেকে ফিরে পরের দিন তাক্তসাং, যা টাইগার্স নেস্ট নামে পরিচিত, যাওয়ার কথা। কিন্তু গতকাল চেলেলা পাসের ওপর দিয়ে ‘হা’ শহরে যাওয়ার সময় বরফেঢাকা রাস্তায় বারবার গাড়ির চাকা পিছলে যাওয়ায়, ড্রাইভার ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে আর এগোতে সাহস করছে না। সেখান থেকে ‘হা’ শহর আরও প্রায় ৩৯ কিলোমিটার পথ। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে, চেলালা থেকে প্রায় ১২-১৩ কিলোমিটার আগে, বরফের ওপর কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে পারো শহরে ফিরে আসি। পরিবর্তিত পরিকল্পনামত, আজ তাই বেশ ভোরে আমাদের টাইগার্স নেস্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা। কিন্তু, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সময়মতো সবাই তৈরি হতে না পারায়, হোটেলের নিচে গাড়ি এসে অপেক্ষা করা সত্ত্বেও, বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেল।
পারো শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে, সম্ভবত ‘রামথাংখা’ নামের এক জায়গা থেকে টাইগার্স নেস্টের উদ্দেশ্যে হাঁটাপথের শুরু। ঘন্টাখানেক পরে যখন নির্দিষ্ট স্থানে এসে উপস্থিত হলাম, তখন বেলা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। সমস্যা একটাই, সঙ্গে তিনজন মহিলা রয়েছেন, যাদের মধ্যে দুজনের প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়স এবং হাঁটুর রীতিমতো সমস্যা। শুধু তাই নয়, তিনজনের মধ্যে দুজন আগে কিছু ট্রেক করে থাকলেও, একজন আবার ট্রেকের সঙ্গে পূর্বপরিচিত নন। আমি যদিও কিছু ট্রেক করেছি, কিন্তু বাইপাস অপারেশন করা সাড়ে ছেষট্টি বছর বয়সে, মনোবল এখনও কিছু সঞ্চিত থাকলেও, শারীরিক বল যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, অস্বীকার করি কিভাবে।
যাইহোক, গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই কাউন্টার থেকে মাথাপিছু পাঁচশত টাকা করে টিকিট কিনে নিলাম। টিকিট ছাড়া ওপরে যাওয়া যায় কি না জানি না। যাওয়া হয়তো যায়, কিন্তু টিকিট ছাড়া তাক্তসাং অর্থাৎ টাইগার্স নেস্টের মঠের ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় কি না, বা ওপরে টিকিট কাটার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, জানা নেই। এরপরে লাঠিপিছু পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায় বেশ শক্তপোক্ত পাঁচটা লাঠি নিয়ে নেওয়া হল। ফেরার পথে ফেরৎ দিয়ে দিতে হবে। একশো টাকা দিলে অবশ্য লাঠির মালিকানা পাওয়া যায়।
কেউ বলল এখান থেকে প্রায় ৪ মাইল পথ, কেউ বলল সাড়ে ৪ কিলোমিটার পথ, কেউ আবার বলল ৬ কিলোমিটার পথ হেঁটে, প্রায় তিন হাজার ফুট উচ্চতা অতিক্রম করে, ১০,২৩২ ফুট উচ্চতায় এই বিখ্যাত মঠটি অবস্থিত। এটিকেই ভুটানের বৌদ্ধ ধর্মের জন্মস্থান বলে মনে করা হয়। তিব্বতি ভাষায় তাক্তসাং কথার অর্থ নাকি বাঘের গুহা, বাঘ নিয়ে অবশ্য অনেক গল্প শোনা যায়। অষ্টম শতাব্দীতে গুরু পদ্মসম্ভব (গুরু রিনপোচে) তিব্বত থেকে বাঘিনীর পিঠে করে নাকি এই তাক্তসাং গুহায় এসে তিন বৎসর তিন মাস তিন সপ্তাহ তিন দিন তিন ঘন্টা তপস্যা করেন। পরবর্তীতে ১৬৯২ সালে এই মঠটির প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে প্রচলিত। বাঘ নিয়ে আরও গল্প আছে, সেকথা থাক, তবে এতটা পথ এই খাড়াই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হবে শুনে, মহিলাদের মুখচোখে বেশ দুশ্চিন্তার মেঘ চোখে পড়ল। এগিয়ে চললাম, ড্রাইভার সোনম নিচে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে বলে জানাল। সামান্য একটু পথ ওপরে উঠে খানিক সমতল মতো জায়গায় দেখলাম, কয়েকটা ঘোড়া নিয়ে মালিকরা যাত্রীর আশায় দাঁড়িয়ে আছে। মাঝরাস্তায় অসুবিধায় পড়লে ঘোড়া পাওয়া যাবে কি যাবে না ভেবে, তাদের সঙ্গে কথা বললাম। জানা গেল, মোটামুটি মাঝামাঝি দূরত্বে ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত ঘোড়া যায়, তারপরে আর না। ঘোড়াকে যেতে দেওয়া হয় না নাকি ঘোড়া যেতে পারে না, ঠিক বোঝা গেল না। তবে ফেরার পথে কোনো অবস্থাতেই ঘোড়ার পিঠে মানুষ তোলা হয় না। প্রতিটি ঘোড়ার জন্য ছয়শত টাকা করে ভাড়া দিতে হবে। ঘোড়া যাওয়া আসার গল্প শুনে, রাস্তা সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা করে নিয়ে, তিনজন মহিলার জন্য তিনটি ঘোড়া পনেরোশ টাকায় ঠিক করে দেওয়া হল। একটা ঘোড়ার দায়িত্ব আবার একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চার হাতে ছেড়ে দেওয়া হল। ওরাও খুশি, আমরাও খুশি। ঘড়িতে তখন সকাল পৌনে দশটা, ঘোড়ারা এগিয়ে চলল, আমাদের জন্য ক্যাফেটেরিয়ার কাছে অপেক্ষা করতে বলে দিলাম।
তরুণ আর আমি ধীরে সুস্থে এগিয়ে চললাম। অল্পরাস্তায় অনেকটা ওপরে উঠতে হওয়ায়, স্বাভাবিকভাবেই রাস্তা বেশ খাড়াই। প্রচুর গাছপালাভরা লালচে মোরামজাতীয় রাস্তা হলেও, ছোট বড় মেজ সেজ পাথরে ভর্তি। অনেক বিদেশি বিদেশিনীর দেখা পেলাম। কেউ ঘোড়ার পিঠে, কেউ আবার নিজের পায়ে, তবে হেঁটে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সকলের দলের সঙ্গেই আলখাল্লার মতো ভুটানের জাতীয় পোশাকপরিহিত গাইড আছে। বুঝতে পারছি, আমার হাঁটার মধ্যে এবার স্বাচ্ছন্দ্যের বেশ অভাব। পিঠে যেটুকু মাল আছে, সেটাই বেশ ভারী ও কষ্টকর বলে মনে হচ্ছে। তরুণ আমার থেকে প্রায় বছর ছয়েকের ছোট, কাজেই আমার মতো না হলেও ওর হাঁটার মধ্যেও কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ে লজেন্স মুখে দিয়ে এগোতে হচ্ছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের একটা বেশ বড় একটা দলকে দেখছি, বারবার রাস্তার পাশে পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। যদিও বিশ্রামের থেকে নিজেদের মধ্যে গুলতানি করতে ও সেলফি তুলতেই বেশি ব্যস্ত। এক একসময় আমাদের অতিক্রম করে তারা আবার এগিয়েও যাচ্ছে। বয়স বোঝা মুশকিল, তবে খুব বেশি বয়স নয়, এমন এক বিদেশি যুগলকে বারকতক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগোতে দেখার পর দেখলাম, সম্ভবত স্ত্রীকে গাইডের সঙ্গে এগিয়ে যেতে দিয়ে, হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ভদ্রলোক ফিরে গেলেন। যাঁরা বেশ ভোরবেলা বেরিয়েছিলেন, এখনো তাঁদের ফেরার সময় হয়নি। তবে মাঝেমাঝেই উলটো দিক থেকে কিছু যাত্রীকে নিচের দিকে নেমে যেতে দেখছি, জানি না, তাঁরা শেষপর্যন্ত যেতে অক্ষম হয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে যাচ্ছেন কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দশ-বারো বছরের ছেলেটাকে, যে আমাদের দলের একজনের ঘোড়ার সঙ্গে ওপরে গিয়েছিল, তার ঘোড়া নিয়ে নিচে ফিরে যেতে দেখলাম। সে জানাল, আমাদের দলের তিনজনকেই তারা ক্যাফেটেরিয়ার কাছে ভালভাবে নামিয়ে দিয়েছে। এইভাবে গাছপালা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এবড়োখেবড়ো পাথুরে রাস্তা ভেঙে, একটা জায়গায় এসে অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের আরেকটা দলের সাক্ষাৎ পেলাম। এরা সবাই বাংলাদেশ থেকে এসেছে। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে, সবাই ওদের দেশে আই.টি.সেক্টরে কাজ করে। জানাল যে, থিম্পুতে একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে এসেছিল। টাইগার্স নেস্ট না দেখলে ভুটান আসা সার্থক হয় না, তাই টাইগার্স নেস্ট দেখে দেশে ফিরে যাবে। তাদের সঙ্গে কথা বলে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে, ক্যাফেটেরিয়া অঞ্চলে এসে পড়লাম। উজ্জ্বল রঙিন কাপড়ের টুকরো দিয়ে গোটা জায়গাটা সাজানো। কাপড়ের ওপর সংস্কৃত ও অন্য কোনো ভাষায়, সম্ভবত বুদ্ধের বাণী লেখা। বামদিকে টাইগার্স নেস্ট যাওয়ার রাস্তা, ডানদিকের বাঁধানো সরু রাস্তা কিছুটা নিচে ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত গেছে। সেখানে আমাদের দলের কাউকে না দেখতে পেয়ে, কিছু ছবি তুলে, ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত হেঁটে গিয়েও কারও সন্ধান পেলাম না। ক্যাফেটেরিয়ায় জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ওখানে তিনজন মহিলার কোনও দল আসেনি। এবার চিন্তা শুরু হল। গেল কোথায় ওরা? এতক্ষণে আমরা মাত্র অর্ধেক পথ এসেছি, এটুকু ওরা ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো ঘোড়ায় চেপে আসলেও, বাকি অর্ধেক পথ আর গোটা ফেরার পথটা কিন্তু হেঁটে যেতে হবে। তরুণের কথায় এগিয়ে চললাম। বেশ কিছুটা পথ ভেঙে ওপরে উঠে দেখলাম, দুটো বেঞ্চিতে ওরা বসে আছে। আমরাও বসে সবাইকে কমলা লেবু দিলাম। আরও কিছুক্ষণ বসে, ওদের তাড়া দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললাম। মুখ-চোখ, হাঁটার গতি ও চলার ছন্দ জানিয়ে দিচ্ছে যে ওরা বেশ ক্লান্ত। পাথুরে রাস্তা ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে কখনও হাত ধরে সাহায্য করে, কখনও মৌখিক উৎসাহ দিয়ে, এগিয়ে নিয়ে চলেছি। ধীরে ধীরে ওদের গতি কমতে শুরু করলেও, বেলা বাড়তে লাগল। হঠাৎ উলটোদিক থেকে বাঙালি ছেলেদের একটা দল এসে হাজির হল। মুখোমুখি হতেই তাদের কথা শুরু হল। এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, অন্যকে নিরুৎসাহ করার মধ্যেই যাঁরা নিজেদের ভ্রমণ, বিশেষ করে ট্রেকিং-এর সার্থকতা খুঁজে পান। এরাও দেখলাম সেই প্রজাতির মানুষ। মহিলাদের খুব কষ্ট করে চড়াই ভাঙতে দেখে তারা সাহেবি কেতায় শুরু করে দিল— “আপনাদের হ্যাটস অফ! ধীরে ধীরে এগিয়ে যান। খুব কষ্টকর রাস্তা কাকিমা। সামনেই সাতশ ষাটটা সিঁড়ি ভেঙে আপনাদের মন্দিরে যেতে হবে”, ইত্যাদি ইত্যাদি। চুয়ান্নটা সিঁড়ি ভেঙে আমাদের ফ্ল্যাটে উঠতে হয়। দিনে বেশ কয়েকবার আমাকে ওপর নিচে যাতায়াত করতে হলেও, আমার উনি সিঁড়ি ভাঙার ভয়ে নানা অজুহাতে নিচে নামতে চান না। এহেন একজন মানুষকে হঠাৎ সাতশ ষাটটা সিঁড়ি ভাঙার গল্প শোনালে, তার মানসিক অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। কোনোরকমে তাদের বিদায় করে আমরা এগিয়ে চললাম।
ধীরে ধীরে হাত ধরে, প্রয়োজনমত সাহায্য করে, একসময় সেই জায়গাটায় এসে পৌঁছলাম, যেখান থেকে মঠগুলোর গঠনশৈলী সবথেকে পরিষ্কারভাবে দেখে মুগ্ধ হতে হয়, আবার শ'য়ে শ'য়ে পাথুরে সিঁড়ি নিচে নেমে যেতে দেখে আতঙ্কিতও হতে হয়। একটা নিরেট তেলতেলে শক্ত পাথরের প্রায় খাঁজহীন পাহাড় যেন অনেক ওপর থেকে সোজা নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে, আর তার প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়, কেউ যেন কিছুটা জায়গা তরোয়াল দিয়ে কেটে সমান করে এমনভাবে মঠগুলো তৈরি করেছে, যে দেখে মনে হবে, মঠগুলো পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে। আতঙ্কের আরও কারণ আছে। অনেক সিঁড়ি নামার পর, সংখ্যায় কিছু কম হলেও, আবার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে মঠের কাছে যেতে হবে। আহা, আমাদেরও যদি একটা করে বাঘ বা বাঘিনী, নিদেন পক্ষে গুপি-বাঘার মতো জুতো থাকতো, তাহলে বেশ হত! বিভিন্ন রঙের রঙিন কাপড়বাঁধা একটা ব্রিজমতো পার হয়ে, আমরা গুণে গুণে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে শুরু করলাম। বাঁপাশে একটা ঝরনার জল, অনেকটা জায়গায় বেশ উঁচু বরফ হয়ে জমে আছে। অল্পকিছু সিঁড়ি ভেঙে নামার পরেই, মহিলাদের সিঁড়ি ভাঙায় সাহায্য করতে গিয়ে, সিঁড়ির সংখ্যা গোনার কথা ভুলে গেলাম। আগেই শুনেছিলাম সাতশ সিঁড়ি ভাঙতে হয়, একটু আগে বাঙালি ছেলেদের দলটার কাছে শুনলাম, সাতশ ষাটটা সিঁড়ি। এখন তো মনে হচ্ছে সংখ্যাটা কিছু বেশি হলেও হতে পারে।
ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় নিয়ে পাশের রেলিং ধরে বা আমাদের কাঁধ ও হাতের ওপর চাপ দিয়ে নামতে সাহায্য করে, একসময় ওদের দুজনকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামা পর্ব শেষ করতে সমর্থ হলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে, এবার শুরু হল সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার পালা। ওদের অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে, কষ্টও হচ্ছে, কিন্তু জানি, এই কষ্টের রেশ কয়েকদিন পরেই মুছে যাবে, কিন্তু সারা জীবন এই জায়গায় আসা ও তার আনন্দের রেশ বেঁচে থাকবে। হাত ধরে টেনে টেনে বিকেল প্রায় সোয়া তিনটে নাগাদ ওদের ওপরে উঠিয়ে নিয়ে আসতেও সমর্থ হলাম। বেশ বিকেল হয়ে গেছে, ফেরার পথে এবার আবার অনেক বেশি সংখ্যক সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হবে। তাছাড়া ফেরার সময় সমস্ত পথটাই হেঁটে যেতে হবে। তাই এখানে আর বেশি সময় ব্যয় করা চলবে না। কাউন্টারে টিকিট দেখাতে, আমাদের হাতে একটা ছোট তালা দিয়ে পাশের লকারে ক্যামেরা, মোবাইল ইত্যাদি সবকিছু রেখে, তালা দিয়ে দিতে বলা হল। অনেকগুলো লকার, কিন্তু অধিকাংশেরই তালা দেওয়ার আঙটাটি ভাঙা। যাইহোক, মালপত্র ভিতরে রেখে ওপরে উঠে, একে একে সবক'টা মঠ দেখে নিলাম। মূল মঠটির বিরাট বুদ্ধমূর্তিটির মাথা ছাড়া বাকি অংশটি সোনার তৈরি বলে মনে হলো। এত শান্ত পরিবেশে আরও বেশ কিছুটা সময় কাটাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু উপায় না থাকায়, ওদের একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিয়ে, কাউন্টারের কাছে নেমে এলাম। লকার থেকে মালপত্র বের করে নিয়ে চাবি ও তালা ফেরৎ দিয়ে দিলাম। সঙ্গে অল্প জল থাকলেও, কিছুটা জল ভরে নেবার ইচ্ছা ছিল। পাশে 'হোলি ওয়াটার' লেখা খাবার জলের জায়গা থাকলেও, জুতো খুলে সেখান থেকে মগে করে জল ভরে আনা অসুবিধাজনক। ঘড়িতে প্রায় পৌনে চারটে বাজে, তাই ফেরার পথ ধরলাম। খাবার জলের ব্যবস্থাটা এখানে অনেক সহজলভ্য হওয়া উচিত বলে মনে হল।
এবারেও প্রথমে সিঁড়ি ভেঙে নামতে হবে, তবে পরবর্তী পর্যায়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তে, ওদের কথা ভেবে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। মন্দির অঞ্চলে এক কমবয়সী স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর অল্প কয়েকজনকেই দেখলাম। তবে তারা স্থানীয় মানুষ বলেই মনে হল। একদল অবাঙালি যাত্রীকে এতক্ষণে ওপরে উঠে আসতে দেখলাম। আসার পথে অনেককেই দেখেছিলাম, যাদের আর এখানে পৌঁছতে দেখলাম না। অনেকেই মাঝপথ থেকে বা শেষ প্রান্ত থেকে, ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। নিচে নামার সিঁড়িও একসময় শেষ হল, আমাদের বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মতো সমান উচ্চতার সিঁড়ি হলেও তবু একরকম ছিল, কিন্তু এই সিঁড়ির উচ্চতা তো একেকটা একেক মাপের। এবার ওঠার পালা, প্রায় পিছন ফিরে হেঁটে, স্ত্রীর হাত ধরে টেনে ওপরে তোলা শুরু করলাম। তরুণেরও প্রায় একই অবস্থা। ও নিজেও সীমার হাত ধরে প্রায় একই প্রক্রিয়ায় ওপরে উঠছে। ওরা আমাদের থেকে সামান্য এগিয়ে গেছে। তরুণের কন্যা পুপু অনেকটা এগিয়ে গেছে, ও এখন নজরের বাইরে। ধীরে ধীরে রোদের তেজ কমছে, অন্ধকার হয়ে গেলে বিপদের সম্ভাবনা প্রবল, তাই সঙ্গিনীকে একটু দ্রুত পা চালাতে বললাম। যদিও জানি, বাস্তবে সেটা প্রায় অসম্ভব। অনেকটা সময় ধরে অনেক কসরত করে অনেক সিঁড়িভাঙার পর, ওপর থেকে তরুণ জানাল, যে সিঁড়িভাঙা পর্ব শেষ। তাতে উপকার কতটুকু হল জানি না, তবে মনে হল ওর মুখে শুধু ফুল চন্দন নয়, সাথে কিছু গুজিয়াও পড়ুক।
বেশ বুঝতে পারছি যে বেলা ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, দিনের আলো দ্রুত কমতে শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু করার কিছু নেই। বারবার 'আর একটু গতি বাড়াও' বলতে বলতে, আমরা দুটি মাত্র প্রাণী, খুব ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছি। সীমার হাঁটুর অবস্থাও বেশ খারাপ, কিন্তু ওর যেটা আছে, তা হল বেড়ানোর প্রবল আগ্রহ ও অসম্ভব মনের জোর। তাছাড়া ওর কিছু ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতাও আছে। ওদের গতি কিছু বেশি হওয়ায়, ক্রমশ ওরাও চোখের আড়ালে চলে গেল। এইভাবে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলেও আর চার দিন পরেই পূর্ণিমা, তাই হালকা একটা আলোর ভাব আছে। তবে তা এই ভাঙাচোরা পাথুরে নির্জন জঙ্গলের পথ চলার পক্ষে পর্যাপ্ত মোটেই নয়। পিছন থেকে কারও গলার আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। শেষ অবাঙালি দলটার ফিরতে দেরি আছে, কিন্তু সেই অল্পবয়সি দম্পতি এখনও কেন এসে পৌঁছল না, বুঝতে পারছি না।
এইভাবে আরও কিছুটা পথ পার হয়ে দেখলাম একটা বেশ বড় পাথর, আর রাস্তাটা যেন তার দুদিক দিয়ে দুটো ভাগ হয়ে গেছে। সঙ্গিনীকে দাঁড়াতে বলে, সরেজমিনে পরীক্ষা করে বাঁদিকের রাস্তাটাই আমাদের পথ বলে স্থির সিদ্ধান্তে এসে, বাঁদিকের পথ ধরে আবার এগিয়ে চললাম। এখানে কয়েকটা এবড়োখেবড়ো সিঁড়ির মতো ধাপ থাকায়, আরও নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। স্ত্রীর হাত বেশ শক্ত করে ধরে, আমার দেখানো জায়গায় পা ফেলে ফেলে নামতে বলে কয়েক পা মাত্র নেমেছি, এমনসময় নীচে, খুব কাছ থেকেই তরুণের ডাক শুনতে পেলাম। বুঝলাম দেখা না গেলেও, ওরা খুব কাছাকাছিই আছে। দাঁড়াতে বলে সামান্য পথ এগিয়েই ওদের দেখা পেলাম ও তরুণের মুখে সেই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক বাক্যটি শুনলাম— "সুবীরদা, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি"। এই অন্ধকারে জঙ্গলে পথ হারানোর সবরকম বিপদের কথা ছেড়ে, আমার যেটা প্রথম মনে হল — আবার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হলে কী করব? তরুণ জানাল, সামনে কোনো রাস্তা নেই। সবাইকে দাঁড় করিয়ে, কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, ডানদিকে একটা সরু রাস্তার মতো পথ আগাছার জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। বামদিকের রাস্তাটা অধিকতর চওড়া হলেও সেটা একটু এগিয়েই শেষ, কাজেই সেটা আমাদের ফেরার রাস্তা হতে পারে না।
প্রায় সাত দিন হল ভুটানে আছি। সন্ধ্যার পর থেকে সর্বত্র ভীষণ ঠাণ্ডা, সকালে রাস্তার পাশেও গাড়ির ওপর বরফ জমে থাকে। একমাত্র পুনাখার উত্তাপ সামান্য কিছু অধিক হলেও, সন্ধ্যার পর রাস্তায় হাঁটা খুব একটা সুখের ছিল না। অন্ধকারে তরুণের মোবাইলের আলোয় দাঁড়িয়ে, কী করা উচিত ভাবছি। এখনও ক্যাফেটেরিয়ার কাছে এসে পৌঁছতে পারিনি, অর্থাৎ এখনও নিচে গাড়ির কাছে পৌঁছতে অর্ধেকের বেশি পথ বাকি। এমন সময় নিচ থেকে পুপুর চিৎকার শুনলাম। জিজ্ঞাসা করছে, আমরা কোথায় আছি। জানা গেল, সে ক্যাফেটেরিয়ার কাছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চিৎকার করে তাকে জানালাম, যে আমরা পথ গুলিয়ে ফেলেছি, সে যেন ওখানেই অপেক্ষা করে। পাহাড়ি হাঁটা পথে যেখানে ঘোড়ার যাতায়াত আছে, সেখানে ঘোড়ার মল পথ চিনতে সাহায্য করে। ক্যাফেটেরিয়ার আগে সে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, আর তার পরেও এই অন্ধকারে সেই দুর্মূল্য বস্তুটির দেখা পাওয়ার আশা কম।
শেষপর্যন্ত আবার সেই ওপরের বড় পাথরটার কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে যাব, এমন সময় ঠিক পিছনে, অর্থাৎ যে পথ ধরে এখানে এসে হাজির হয়েছি, একজনকে মোবাইল জ্বালতে দেখা গেল। ভদ্রলোক ঠিক পিছনে বাঁকের মুখে থাকায়, তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়নি, তবে ওই পথ দিয়ে আমরাও এসেছি, কাজেই উনি এইমাত্র এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন বোঝা গেল। পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রী 'ভাইসাব' বলে ডাকায় তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমাদের বিপদের কথা বলাতে জানালেন, যে ঠিক রাস্তাতেই এসেছি, তবে ভুল করে বাইপাস দিয়ে আসায়, চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। তিনি আমাদের এগিয়ে যেতে বলে জানালেন, যে বাজার আনতে নিচে যাচ্ছেন, তাঁর জন্য নিচে গাড়ি অপেক্ষা করছে। বাজার নিয়ে আবার ওপরে ফিরে যাবেন। এপথে তিনি প্রায় রোজই যাতায়াত করেন এবং নিচে নামতে পৌনে এক ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা সময় লাগে। আমার স্ত্রী একটু সাহায্য করতে বলায়, দাঁড়িয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে এগিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বাঘের গুহা থেকে আসছেন, কাজেই তাঁর চিতাবাঘের মতো গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারব কেন? যথারীতি আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়ায়, তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে আমার স্ত্রীকে বললেন, আপনি খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আমাকে স্ত্রীর হাত ছেড়ে দিতে বলে তাঁকে বললেন, যে ঠিক তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে দুহাতে কাঁধের দুদিকে শক্ত করে ধরতে। এবার স্বাভাবিকভাবে গতি অনেক কমে গেলেও, ইঞ্জিন যেমন করে রেলের কামরা টেনে নিয়ে যায়, সেইভাবে আমার স্ত্রীকে নিয়ে এগোতে শুরু করলেন।
এতক্ষণ নিজে ব্যস্ত থাকায়, তরুণকে কোনরকম সাহায্য করার সুযোগ ছিল না। ঠিকভাবে এবং ঠিক জায়গায় পা না ফেলার জন্য, একটু আগেই সীমা একবার লালচে ঢালু জমির ওপর গড়িয়ে পড়ে গেছে। আমি আর তরুণ চেষ্টা করেও তাকে সোজা করে দাঁড় করাতে পারছিলাম না। শেষে অনেক চেষ্টায় পিছন থেকে বগলের তলা দিয়ে ওর হাত চেপে ধরে দাঁড় করাতে হয়েছে। তরুণকে সীমার হাত ছেড়ে দিতে বলে, আমি তার হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। আমি নিজে দীর্ঘদিনের স্পন্ডাইলোসিসের রোগী, ডান হাতে এমনিই একটা যন্ত্রণার ব্যাপার আছে, তার ওপর এতক্ষণ ডান হাতের ওপর অত চাপ পড়ায়, যন্ত্রণাটা বেশ বেড়েছে। ভদ্রলোক মোবাইলের আলোয় পথ দেখিয়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন, মাঝেমাঝে শুধু পা সোজা ও শক্ত রাখতে বলছেন। ওদের গতি আগের তুলনায় বেশ বেড়েছে, হাঁটার ভঙ্গিমাও বেশ সাবলীল বলে মনে হলো। সীমাকে শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। ওই ভদ্রলোকের কায়দায় তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, সেই শক্তি বা দম আমার কোথায়?
একসময় ক্যাফেটেরিয়ার কাছে চলে এলাম। এখানেই পুপু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, এবার সেও সঙ্গী হল। ওই ভদ্রলোকের মোবাইলে নিচ থেকে বারবার ফোন এলেও তিনি কিন্তু বিরক্ত হননি, বা ছেড়ে চলে যাননি, বরং নিজে থেকে বললেন যে "ভয় পেয় না, দরকার পড়লে আমি পিঠে করে নিচে নামিয়ে নিয়ে যাব"। পুপুর কাছে জানা গেল, যে অনেক্ষণ আগে সোনম একবার ফোন করে জানতে চেয়েছিল, যে আমরা এখন কোথায়। পুপু জানিয়েছিল, যে সে নিজে ক্যাফেটারিয়ার কাছে থাকলেও, সঙ্গীরা এখনও এসে পৌঁছয়নি। সোনম জানিয়েছিল এরপর অন্ধকার নেমে আসবে, আমরা যেন ক্যাফেটেরিয়ায় থাকার ব্যাপারে একটু কথা বলে চেষ্টা করে দেখি।
আরও অনেকটা পথ এইভাবে নেমে আসার পর সোনম আবার ফোন করলে আমরা তাকে একবার ওপরে আসতে বললাম। সত্যি কী না জানি না, তবে সোনম জানাল যে সে নাকি দুবার অনেক ওপর পর্যন্ত উঠে এসেও, আমাদের সাক্ষাৎ পায়নি। ওই ভদ্রলোক বললেন, তিনি অধিকাংশ সময় বাইপাস ব্যবহার করায় সোনম আমাদের খুঁজে পায়নি। ওঁর হাতে মোবাইলটা দিয়ে সোনমের সঙ্গে একটু কথা বলে ঠিক কোথায় আছি তাকে একটু জানাতে বললাম। উনি নিজেদের ভাষায় কথা বলে সোনমকে আমাদের অবস্থানটা জানিয়ে দিলেন। আবার এগিয়ে চললাম। জঙ্গলের পথ, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হলেও উত্তেজনা ও শারীরিক পরিশ্রমে শীত সেরকম অনুভূত হচ্ছিল না।
এইভাবে আরও কিছুটা পথ চলার পরে টর্চ হাতে সোনম এসে হাজির হল। এত দ্রুত কিভাবে চলে এল বুঝলাম না। তাহলে কি ও আমাদের সাহায্য করতে এসে কাছেপিঠেই কোথাও ছিল, নাকি আমরা নিচে রাখা গাড়ির কাছাকাছি কোথাও এসে গেছি? মনে মনে প্রার্থনা করলাম, দ্বিতীয়টাই যেন সত্য হয়।
সোনম এসেই সীমাকে অনেকটা ওই ভদ্রলোকের কায়দায় ধরে, নিচে নামতে শুরু করল। বারবার সে সীমাকে পা সোজা করে হাঁটতে বলছে। সেই একেবারে ওপর থেকে এতটা পথ নিজের হাতের ওপর ওদের চাপ সহ্য করে এসে, আমি নিজেও বেশ ক্লান্ত। তবে মাইলের পর মাইল উতরাইয়ের পথ হাঁটতে, আমার কোনদিনই তেমন বিশেষ কষ্ট হয় না। ভারমুক্ত হয়ে হাঁটায় স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পেলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত আলোর প্রয়োজনে আমি নিজের মোবাইল ব্যবহার করিনি। না,এখন দিবসও নয়, বা মনের হরষেও আলো জ্বালার প্রয়োজন অবশ্যই নয়, আলো না জ্বালায় স্বল্পালোকে হাঁটতে কিছু অসুবিধাও হচ্ছিল সেকথা সত্য। কিন্তু চাইছিলাম না, যে সবক'টা মোবাইলের ব্যাটারি একসাথে শেষ হয়ে যাক, কারণ এখনও কতটা পথ, বিশেষ করে কতটা সময় আলো জ্বেলে হাঁটতে হবে কে জানে?
আসার পথে বারবার লক্ষ্য করেছি, যে সোনমের কথা বুঝতে না পারলে, অথবা ওর ইচ্ছা বা বক্তব্যকে উপেক্ষা করলে, ও ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়। এখনো ও বারবার মোবাইল জ্বালাতে বলছে। 'পড়েছি সোনমের হাতে, মোবাইল জ্বেলে চলো সাথে' পন্থাই অবলম্বন করা শ্রেয় বিবেচনা করে, মোবাইলের টর্চ জ্বেলে ওদের সঙ্গে চললাম। আরও বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে এঁকেবেঁকে হাঁটতে হাঁটতে, একসময় মনে হলো নিচে নেমে এসেছি। কিন্তু গাড়ি রাখার বড় ফাঁকা অঞ্চলটা তখনও চোখে না পড়ায় বুঝলাম, আমরা শেষপ্রান্তে এসে পড়লেও এখনও কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে পৌঁছইনি।
এইভাবে নেমে এসে একসময় আধো-অন্ধকারে সেই ফাঁকা নির্জন জায়গাটার একপাশে আমাদের সাদা গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আর কোন গাড়িতো দূরের কথা, একটা মানুষ পর্যন্ত কোথাও নেই। ধীরে ধীরে সেই ঘেরা জায়গাটার ভিতর দিয়ে, যার সামনে থেকে যাওয়ার সময় লাঠি ভাড়া করেছিলাম, যার ভিতর দিয়ে ওপরে ওঠার পথে যাওয়ার সময়, মেলার মতো বিভিন্ন পসরা নিয়ে মেয়েদের বিক্রি করতে দেখেছিলাম, হেঁটে গিয়ে গাড়ির সামনে হাজির হলাম। কেউ কোথাও নেই যে লাঠিগুলো ফেরৎ দেব। সোনম আমাদের পাঁচটা লাঠি একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এবার ভদ্রলোকের কাছে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা চাইলে, জানালেন তাঁর কোন হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার নেই। তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করাতে, প্রথমে এড়িয়ে গিয়েও শেষে বললেন 'প্রেমা'। নাম বলার ভঙ্গি দেখে, সত্যই তাঁর সঠিক নাম বললেন বলে মনে হল না। তাঁকে এইভাবে সাহায্য করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে শুধু বললেন, "ধন্যবাদ কিস্ লিয়ে, এ তো হামারা ফর্জ থা।" আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। আমার হৃদয়ে তিনি মানব প্রেমের প্রতীক হয়েই চিরদিন অবস্থান করুন।
সঙ্গে এখন কোনও লাগেজ নেই, তাই গাড়ির ছটা সিটই ফাঁকা। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে নিজেদের ভাষায় সোনমের কিছু কথা হল। বুঝলাম তাঁর গন্তব্যস্থলে সোনম পৌঁছে দিয়ে যাবে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। যাওয়ার পথে একসময় একটা বড় হোটেলের মতো বাড়ির সামনে তিনি নেমে গেলেন। জানি না তাঁর কথামতো আজই আবার ওপরে ফিরে যাবেন কি না। একটা ছবি নেওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তাঁর মতো প্রচারবিমুখ একজন মানুষকে, যিনি নিজের নাম পর্যন্ত বলতে চান না, ওই রাতে ওই অবস্থায় ছবি তোলার কথা বলাটা কিরকম হাস্যকর মনে হল।
রাত প্রায় পৌনে নটার সময় হোটেলের সামনে নামলাম আমরা। সোনমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভদ্রলোক তার পরিচিত কি না। সোনম জানাল, উনি তাক্তসাং গুহার একজন লামা। সোনম গাড়ি নিয়ে চলে গেল। হোটেলে কোনও খাবার না পাওয়ায়, আমি আর তরুণ একটু দূরের 'হোটেল ড্রাগন'-এ গেলাম রাতের খাবার কিনে আনতে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সুবীর কুমার রায় প্রধানত ভ্রমণ কাহিনী লিখতে ভালবাসলেও তাঁর ঝুলিতে ছোট গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা, ইত্যাদির সম্ভারও যথেষ্ট। ১৯৭৯ সালে জীবনের প্রথম ট্রেকিং থেকে ফিরে লেখালেখির শুর এবং তারপর থেকে সেই অভ্যাস আজও রয়ে গেছে। বিভিন্ন ই-ম্যাগাজিন ছাড়া, তাঁর লেখা বহু পত্রপত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে।