কদিনের কুর্গ
প্রজ্ঞা পারমিতা
ইংরেজদের স্কটল্যান্ডের কথা মনে করিয়ে দিত কুর্গের নিসর্গ। সেখানের অধিবাসীরা দক্ষিণ ভারতের একমাত্র জনগোষ্ঠী যারা দ্রাবিড় নয়। দক্ষিণ-গঙ্গা নামে অভিহিত কাবেরী নদীর উৎপত্তি কুর্গ-এ, যা এক সুবিখ্যাত হিন্দু তীর্থক্ষেত্র। কুর্গি রান্নার স্বাদ একবার পেলে জীবনে ভোলা সম্ভব নয়।
এহেন স্থানমাহাত্ম্যের যেকোনো একটির জন্যই সেখানে উপস্থিত হওয়া যায়। অন্যসব আকর্ষণের প্রতি গয়ংগচ্ছভাব দেখালেও কুর্গি-কুইজিন আমাকে প্রবল ডাকাডাকি জুড়ে দিল। সকাল-সন্ধে কারণে অকারণে পান্ডি কারি আর আক্কি রুটির স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। চোখ বুজলেই মনের আঙিনায় মাখনে নেয়ে ওঠা সারা অঙ্গে গোলমরিচমাখা ক্যাপসিকাম দেখতে লাগলাম। অগত্যা কুর্গ বেড়াতে যাওয়া আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। তাই এক সেপ্টেম্বরে দিনতিনেকের অবিভক্ত মনোযোগসহ অবকাশের আয়োজন করে কুর্গের দরজায় কড়া নাড়লাম।
পশ্চিম কর্ণাটকের একটি অরণ্য-পর্বতময় জেলা কুর্গ, যার আসল নাম কোডাগু। ইংরেজদের উচ্চারণ বিকৃতির ফলে কোডাগু হয়ে গেছে কুর্গ আর প্রাচীন কুর্গ রাজ্যের রাজধানী মাদিকেরি হয়ে গেছে মারকারা। অবশ্য নামে কী আসে যায়, যা সুন্দর তাকে যে নামেই ডাকো সুন্দরই থাকে। কুর্গের নিসর্গ যেমন অপরূপ তেমনই সুদর্শন এখানকার অধিবাসী কোডাভা জনগণ।
আদিগন্ত ঢেউ খেলানো সবুজ উপত্যকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইংরেজ আইসিএস অফিসার হিলটন ব্রাউন ১৯২২ সালে ব্ল্যাকউড'স ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, "A comparison of Coorg with Scotland is really almost inevitable. Scotland in the days of Sir Walter and Coorg at this present moment are not nearly so dissimilar as latitude and distance would suggest. Both have grand and regal highlands with sturdy mountain dwelling races; … Both are rich in folklores and folksongs, in hearts ready for hospitality and hands ready for the swords." [The Astonishing Land of Coorg] একশ বছর আগে লেখা হিলটন ব্রাউনের প্রবন্ধ থেকে এই বাক্য ক'টি তুলে আনার উদ্দেশ্য এরমধ্যে ধরা পড়েছে কুর্গের নিখুঁত পরিচয়। কোডাভারা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যোদ্ধা জাতি। ব্রিটিশ আমল থেকেই আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখতে তাদের লাইসেন্স লাগে না। এক বিশেষ ধরণের কুর্গি ছোরা 'পিচেকাট্টি' কোমরবন্ধে গুঁজে রাখাটা তাদের বেশভূষার অঙ্গ। প্রাচীন কুর্গ রাজ্যের 'কোট অফ আর্মস' ছিল দুটি ক্রসকরা পিচেকাট্টি যা এখন ভ্রমণস্মারক হিসেবে সংগ্রহযোগ্য। কুশলী যোদ্ধা হওয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্পদ এঁরা। জেনারেল কারিয়াপ্পা, জেনারেল থিমাইয়াহর মতো বহু সামরিক ব্যক্তিত্ব কোডাভা জাতির গর্ব।
প্রথমেই কোনও শহরে আস্তানা না গেড়ে কোদাভাদের আদি অকৃত্রিম জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে চাইছিলাম আমরা। তাই ব্যাঙ্গালোর-মাইসোর-মাদিকেরি হাইওয়ে (NH 275) ছেড়ে দিয়ে কেএসএইচ ৯০ (KSH 90) দিয়ে গোনিকোপ্পা হয়ে কুর্গের দক্ষিণ বিন্দুতে এক ছোট গ্রাম কুর্চির পথ ধরলাম। গোলমরিচ-এলাচ-দারচিনি-জায়ফল ইত্যাদি মশলা, নানা ধরনের ওষধি এবং কফির দিগন্তবিস্তৃত খেতের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তাটা ছোট ছোট জনপদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে চলল। এইসব খেতমালিকদের বাস বাগানলাগোয়া বাড়িতে এবং তাঁরা যে হোমস্টের ব্যবস্থাপনা করে থাকেন সেগুলোই কুর্গ ভ্রমণে 'দি বেস্ট'। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এই সিদ্ধান্ত জানাতে দ্বিধা নেই। আমরা তেমনই ব্যবস্থা করেছিলাম।
বাঙ্গালোর থেকে সকাল ছটায় রওনা দিয়ে দুপুর বারোটা নাগাদ কুর্চি কফি এস্টেটের মালিকের একতলা বাংলোর সামনে আমাদের গাড়ি থামল। গাড়ির শব্দ থামতেই বুঝলাম জায়গাটা কতটা নির্জন। একরাশ নৈঃশব্দ্য ঘিরে ধরল যেন। একটু ধাতস্থ হতে বুঝলাম যে আসলে মানুষের কোলাহল নেই শুধু, প্রাকৃতিক শব্দ আছে। কানে আসছে দূরের ঝরনার জলের আওয়াজ, পাখির ডাক। সেসব থেকে আপাতত মন সরাতে বাধ্য হলাম। এক সুদর্শন বৃদ্ধ আমাদের অভ্যর্থনা করতে বাংলোর বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আরেকজন লোকও গাড়ির কাছে উদয় হয়েছে খেয়াল করিনি, বৃদ্ধ ভদ্রলোক স্থানীয় ভাষায় তাকে মালপত্রসংক্রান্ত নির্দেশ দিয়ে আমাদের বাংলোর ভিতরে আসতে অনুরোধ করলেন। কথাবার্তা সব ইংরেজিতেই হচ্ছিল। একটি প্রশস্ত বসার ঘরে ঢুকলাম আমরা দুই বাঙালি দম্পতি - আমি, রাজীব, মিতালী ও কৌশিক। বসতে অনুরোধ করে তিনি ভিতরে গিয়ে ফিরে এলেন একজন মহিলাকে সঙ্গে করে। বললেন, "We are Mr. and Mrs. Ganesh. I am a coffee planter but she is a retired teacher. As a host we are so glad to have you here. You people are the first Bengali couples in my home." গদগদ হয়ে আনন্দটা যে উভয়ত তা জানালাম।
কোডাভাদের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীনাম ও ব্যক্তিনাম হয় যা একেবারেই হিন্দু নামাবলি থেকে ভিন্ন। যেমন জেনারেল কারিয়াপ্পার নাম কোদানদেরা মাডাপ্পা কারিয়াপ্পা। পুরুষদের ক্ষেত্রে আপ্পা বা আন্না দিয়ে শেষ হয়, মেয়েদের আম্মা বা আক্কা। কিন্তু এখনকার যুগে ব্যক্তিনাম আর সেরকম রাখা হয় না। যেমন রবিন উত্থাপ্পা, অশ্বিনী নাচাপ্পা। তবে এই প্রবণতা আধুনিক কালের - আন্দাজ বছর পঁয়ষট্টি বয়সি ভদ্রলোকের এমন সহজ নাম দেখে নানারকম প্রশ্ন জাগছিল আমার মনে। গোড়াতেই নাম নিয়ে পড়াটা বাড়াবাড়ি হবে ভেবে ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু পরে অন্যান্য কৌতূহল মেটাতে গিয়ে প্রশ্নটা চাপা পড়ে যায়। আজ লিখতে বসার আগে নানা কুর্গ মেমেন্টোর মধ্যে তাঁর নাম লেখা ভিজিটিং কার্ডটা পেয়ে সেই মুহূর্তটা ফিরে এল।
গণেশদম্পতির পিছন পিছন একজন ট্রেতে সরবত নিয়ে হাজির হয়েছিল। গণেশ গিন্নি, 'কোকুম সরবত' বলে, খেতে ইঙ্গিত করলেন। একটা গ্লাস তুলে চুমুক দিতেই মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিল সেই মালাবার তেঁতুলের স্বাদ। প্রায় সবাই টুকটাক কথার পিঠে কথা জুড়ে চলেছি, কিন্তু চোখ চলে যাচ্ছে গণেশগিন্নির দিকেই। ভদ্রমহিলা থামিয়ে দিয়ে বললেন, "যথেষ্ট বেলা হয়ে গেছে, আপনারা ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে আসুন। খেতে খেতে গল্প করা যাবে।" একথা শুনেও আমরা মহিলা দুজন ভদ্রমহিলাকে নির্নিমেষ নয়নে দেখেই যাচ্ছিলাম। একে দীর্ঘাঙ্গী এবং দারুণ সুন্দরী তায় তাঁর শাড়ি পরার ধরন আমাদের যারপরনাই চমৎকৃত করেছে। বিশেষত আমি, এমন নির্লজ্জের মত দেখছিলাম যে তিনি বাধ্য হয়ে হেসে বললেন, "আমাদের শাড়ি পরার ধরন শিখিয়ে দেব তোমাদের দুজনকে।" শুনে সবাই হেসে উঠলাম। অগত্যা আমাদের দেখিয়ে দেওয়া ঘরের দিকে রওনা হতেই হল। বসার হল লাগোয়া ঘর, সাজসজ্জার বাড়াবাড়ি নেই, কিন্তু আয়োজন যথেষ্ট আরামদায়ক। দুই দেওয়ালে মেঝে থেকে একহাত উপরে চারপাল্লার জানলা, বাইরে প্রচুর সবুজ দেখা যাচ্ছে। অন্য দেওয়ালে এক সদ্যবিবাহিত কোডাভা দম্পতির বাঁধানো বিরাট ছবি। সেটা দেখেই আমার ভাবনা যে পথে হাঁটা দিল তা এইরকম – কুর্গি বিয়ে… কুর্গি বিয়ের ভোজ, তারপরেই মন বলল কুর্গি খাওয়াদাওয়া অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কথাটা মনে আসতেই ঝড়ের বেগে স্নান সেরে ছুটলাম খাওয়ার ঘরে। সেখানে দেখলাম ছ'জন বসার মতো খাওয়ার টেবিলের এক প্রান্তে আমাদের হোস্ট বসে, তাঁর স্ত্রী বাঁদিকের চেয়ারে এবং টেবিলে বিছানো নানা সুখাদ্য। ভদ্রলোকের আচরণ একেবারে গৃহস্বামীর মতো এবং আমরা তাঁর অতিথি। চব্বিশঘণ্টা এঁদের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম, একবারও এই অনুভবে আক্রান্ত হইনি যে যা পাচ্ছি অর্থের বিনিময়ে পাচ্ছি। বহু হোম স্টেতে থাকার অভিজ্ঞতা আছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, কিন্তু এই কুর্গি দম্পতির আতিথ্য শ্রেষ্ঠতম অভিজ্ঞতা। হয়তো ভ্রমণের দেবতা আমাদের প্রতি, বিশেষ করে আমার প্রতি অত্যন্ত সদয়। এঁরা দুজন যেভাবে আমার নানা কৌতূহল মিটিয়েছেন, নিজেদের সম্পর্কে নানা ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে বুঝিয়েছেন তাঁদের জাতির বিভিন্ন দিক যে ব্যাপারটা প্রায় ক্ষেত্রসমীক্ষার পর্যায়ে চলে গেছিল।
গণেশগিন্নি সযত্নে খাবার পরিবেশন করলেন পদগুলির পরিচয় দিতে দিতে। একই সঙ্গে কর্তাকেও দিলেন। তাঁর নিজের থালাও রাখা আছে সামনে, কিন্তু তখনই নিলেন না। গণেশমশাই "আসুন খেতে শুরু করি" বলামাত্র আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম। খাবারের বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। চালের তিনরকম খাবার ছিল। আক্কি ওট্টি - ভাতের মণ্ড থেকে তৈরি রুটি, নুলপুত্তু – চালের নুডলস এবং নেই কলু – এক ধরনের ঘিভাত। আক্কি রুটির সঙ্গে আমের এক অনাস্বাদিতপূর্ব পদ 'কাড মাঙ্গে' বা ওয়াইল্ড ম্যাঙ্গো কারি দিয়ে শ্রীমতি গণেশ বললেন, "এটা আমাদের প্রিয় জলখাবারও বটে।" আমের আচার জানি, চাটনি জানি, কিন্তু আমের যে কারি হতে পারে তা এই প্রত্যক্ষ করলাম! আমি তো ক্লিন বোল্ড, বেশ কয়েকটা খেয়ে নেওয়া যায় এই আম ও ভাত-রুটির যুগলবন্দী, কিন্তু অন্যান্য খাবারের কথা ভেবে একটাতেই থেমে গেলাম। এর পর এল আশ্চর্য খাবার নুলপুত্তু-র সঙ্গে মাছের আচার, বাঁশের কোঁড়ের একটি পদ আর কুট্টু কারি – নারকেল কোরা দিয়ে হরেক রকম আনাজের স্টু। অভিনব সব খাদ্য কুর্গি মশলা এবং রান্নার গুণে রসনার উৎসব লাগিয়ে দিয়েছিল। জানতাম যে কোডাভারা প্রবল আমিষাশী। কিন্তু দেখলাম তাদের নিরামিষ রান্নার বৈচিত্র্যও কম নয়। শেষ পর্বে এল পেঁয়াজ-রসুন ভাজা ও কাজুবাদাম দেওয়া ঘিভাত নেই কলু। তার সঙ্গে মরিচ মুর্গি পরিবেশন করতে করতে ভদ্রমহিলা বললেন রাতে খাওয়াবেন পান্ডি কারি। কুর্গিদের সবচেয়ে বিখ্যাত সিগনেচার ডিশ হল পান্ডি কারি। কিন্তু আমরা ভবিষ্যৎ নয়, আপাতত বর্তমানেই মুগ্ধ। খাঁটি মশলার তীব্র স্বাদ, পরিবেশনের মাধুর্য আমাদের বাকস্ফূর্তির সুযোগই দিচ্ছিল না। গোলমরিচের স্বাদ যে কী ঝাঁঝালোরকমের সুন্দর, প্রায় আমাদের জীবনের মত, কুর্গি পেপার চিকেনের টুকরোগুলো মুখে মিলিয়ে যেতে যেতে বুঝিয়ে ছাড়ছিল। একসময় ছোট দুটি কাচের গ্লাসে ভাঙা চালের পায়েস ও গুড় দিয়ে কফি রেখে গেল গৃহকর্ত্রীর সহযোগিনী। এই গুড় 'কাপি' কোডাভা ভোজের ফুলস্টপ বোঝায়। শেষ পর্বে পৌঁছে গেছি দেখে একটু ঢিমে তেতালায় খেতে খেতে গল্প শুরু করলাম। আমাদের ঘিভাত পরিবেশন করার পর গণেশগিন্নি নিজের পাতে খাবার নিলেন। ঠিক এই ছন্দেই তিনি খাবার দিতেন এবং খেতেন। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম গৃহকর্তার খাওয়ার বহর দেখে। আমাদের সবার খিদে পেয়েছিল, সামনে অতি উপাদেয় খাবার ছিল, বয়সও ওঁর তুলনায় কম। কিন্তু এক একজন যা খেলাম তার চতুর্গুণ খেলেন ভদ্রলোক। আমাদের খাওয়ার দৌড় দেখে রীতিমত ঠাট্টা করলেন তিনি। অথচ গলা পর্যন্ত খেয়েছি আমরা!
জানলাম সব রান্নাই শ্রীমতী গণেশ করেছেন, তবে তাঁর তিনজন সহায়িকা আছে। গণেশদের দুই ছেলে, বাঙ্গালোরে কর্মরত । আমাদের ঘরে যে ছবি আছে তা তাঁদের বড় ছেলের বিয়ের ছবি। মানুষজন খুব ভালোবাসেন ওঁরা। ভদ্রমহিলাও কর্মহীন থাকতে পারেন না। তাই বছরপাঁচেক হল নিজেদের দুটি গেস্টরুমে হোম স্টের ব্যবস্থা করেছেন এবং দারুণ আনন্দে আছেন এইসব নিয়ে।
কর্তাগিন্নির খাওয়া শেষ হতে উঠে পড়লাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরোব ইরুপ্পু জলপ্রপাত দেখতে। যদি আলো থাকে, কাবেরী নদীতে রাফটিং করা যেতে পারে। কিন্তু ক্লান্তি এবং অতিভোজনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, চোখ খুলতে দেখি প্রায় চারটে। পুরুষ সদস্য দুজনের দেখি রাফটিং-এ প্রবল আগ্রহ জেগেছে। অতএব ইরুপ্পু বাতিল করে সোজা কাবেরীর তীরে যেতে হল। কিন্তু ততক্ষণে সাড়ে চারটে বাজবে বাজবে করছে। যারা গেছে তারা ফিরবে, নতুন করে আর জলে নামানো হবে না। আমি ও মিতালী অবাক হয়ে দেখলাম রাজীব ও কৌশিক বাচ্চাছেলের খেলনা চাওয়ার মত করে পিড়াপিড়ি করছে, আরেকটা রাফট নামান না, প্লিজ প্লিজ, যথেষ্ট আলো আছে। এই জলক্রীড়ার ব্যবসাটি যিনি চালান তিনি প্রবল কায়দার ইংরেজিতে ভারতীয়দের সময়জ্ঞান নিয়ে একটি প্যারাগ্রাফ শুনিয়ে দিলেন। তিনি নাকি দীর্ঘ পনেরো বছর আমেরিকায় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তারপর ভারতে এই কাজে নেমেছেন। সে দেশে সবাই বিপজ্জনক খেলার ক্ষেত্রে সময়ের মূল্য বোঝে। এই সব বলে তিনি ঝাঁপ বন্ধ করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তিনি স্থান ত্যাগ করা মাত্র বঙ্গ সন্তান দুজন রাগে ফেটে পড়ল। তাদের বেজায় প্রেস্টিজে লেগেছে বৌদের সামনে এহেন বেইজ্জতি। "শালা! অ্যামেরিকা দেখাচ্ছে!" বলে শুরু করে রকমারি বাংলা গালাগালির তোড়ে নদী তীর চমকিত হয়ে উঠল। এমন সময় বাংলায় কেউ বলে উঠল, "আপনেরা নদিতি নামবেন? কাল সকালে আইয়া পড়লেই তো হয়।" আমরা চারজনই স্তম্ভিত। দেশের ওই প্রত্যন্ত কোণে উল্টে রাখা একটা কায়াকের উপর এক বাংলাভাষীকে দেখতে পেয়ে। এমন সিচুয়েশনাল কমেডির মুখোমুখি হইনি বহু দিন। মানুষটি কাজের খোঁজে ভেসে এসেছে ওইখানে।
আর সময় নষ্ট না করে গণেশের কফি ও মশলার বাগান দেখতে চলে এলাম। এতদিন ধূমায়িত ফিলটার কফি খেয়ে আহা বাহা করেছি, লাল টুকটুকে কফিবিনে ছেয়ে থাকা বেঁটে বেঁটে গাছগুলো দেখেও 'আহা'ই বেরোল মুখ থেকে। আর দেখলাম নানা ধরনের মশলা গাছ – এলাচ, জায়ফল, গোলমরিচ। বড় গাছের কাণ্ড ঘিরে উঠেছে গোলমরিচ গাছ। সবুজ গোলমরিচের দানা দেখে যারপরনাই চমৎকৃত হলাম।
সন্ধেবেলা কফির সঙ্গে মাটন বল খেতে খেতে গণেশ দম্পতির কাছে তাঁদের সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে নানা গল্প শুনছি যখন, মাথায় এল ছেলের বিয়ের সিডি আছে নিশ্চিত। ওঁদের ভাষ্যসহ তা দেখতে পেলে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হবে। প্রস্তাব করতেই ভদ্রলোক উল্লসিত হয়ে চালিয়ে দিলেন বড় ছেলের বিয়ের সিডি। ছেলেরা কুর্গি পরিধেয় 'কুপ্পা' পরে আছে যা ড্রেসিং গাউনের মত এক র্যা প অ্যারাউন্ড পোশাক। বরের কোমরবন্ধ লাল রঙের, অন্যান্যদের সাদা। একে 'চেলে' বলা হয় এবং এতেই একটি কুর্গি ছোরা গুঁজে রাখা থাকে। মেয়েদের শাড়ির কুঁচি পিছনে গোঁজা এবং আঁচল সারা শরীর বেড় দিয়ে ডান কাঁধে ব্রোচ দিয়ে আটকানো। প্রাচীন কালে নাকি এক বিশেষ ধরনের গিঁঠ দেওয়া হত, ব্রোচ বা পিন বর্তমান ব্যবস্থা। বিবাহিতা মেয়েরা 'চৌকন্না' বলে উজ্জ্বলরঙের ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে পিছনে বেঁধে রাখেন। প্রাত্যহিক জীবনে সবাই এই সব পোশাক না পরলেও অনুষ্ঠানের দিন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাবেকি পরিধেয়তেই সাজেন সবাই। বিয়ের মূল অনুষ্ঠান হচ্ছে দুপক্ষের নির্বাচিত বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়কে সাক্ষী রেখে 'নেল্লাকি বলুচা'র সামনে শপথ নেওয়া। কিছু মজাদার প্রথা আছে। যেমন মেয়ের বাড়ি বরযাত্রী ঢোকার আগে বরকর্তা সামনে রাখা পাঁচটা বা সাতটা কলাগাছের কাণ্ড এক কোপে কেটে ফেলেন। তারপর হই হই করে সবাই প্রবেশ করে। শত্রুনিধন করে কন্যাকে জয় করে নেওয়ার দ্যোতক এই রীতি।
কোডাভারা নিজেদের বিরাট রাজার বংশোদ্ভূত মনে করে। স্কন্দ পুরাণমতে বিরাট রাজ্য বা মৎসদেশের চতুর্থ রাজপুত্র চন্দ্রবর্মা সৌভাগ্যের খোঁজে এই অঞ্চলে আসে। তারপর ব্রহ্মগিরি পর্বতে তপস্যা করে নতুন রাজ্য গড়ার বর পায় দেবী ভগবতীর কাছে। চন্দ্রবর্মার এগারোটি পুত্র হয়, তারা এই অঞ্চলে বসবাস করে ও বংশবৃদ্ধি করে। এদের উত্তরপুরুষরাই কোডাভা। ভগবতীর অবতার কাবেরী নদী রূপে প্রবাহিত হয়ে এই অঞ্চলকে শস্যশ্যামল করে তোলে। কাবেরী তাই কোডাভাদের কাছে দেবীরূপে পূজিতা এবং তুলাসংক্রান্তি তিথি তাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র; কারণ সেই তিথিতেই কাবেরীর মর্তে আগমন ঘটেছিল। সেটি তাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের দিন। এই কাহিনিটুকুই যা সংযোগ হিন্দুধর্মের সঙ্গে কুর্গিদের। তাদের জীবনের আচারঅনুষ্ঠানে কোনো বৈদিক প্রভাব নেই। বাড়িতে কোনো মূর্তির উপাসনা হয় না। তারা যে কাবেরীর পুজো করে সেও লৌকিক রীতিতে প্রকৃতি উপাসনা। কোডাভা জাতি আদতে পূর্বপুরুষপূজক। ধীরে ধীরে তাদের সংস্কৃতি নানা হিন্দু প্রভাব আত্মস্থ করলেও তাদের সামাজিক নিয়মে বা জীবনযাপনে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। জন্ম, মৃত্যু বা বিবাহ কোন অনুষ্ঠানেই বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হয় না। বিয়েতে ব্রাহ্মণ লাগে না, বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়রাই সেই কাজটা করেন। প্রতিটি কুর্গিবাড়িতে গোষ্ঠীর আদিপুরুষের আত্মার উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট স্থান থাকে। সেখানে 'নেল্লাকি বলুচা' অর্থাৎ পবিত্র প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে হয়। সেই স্থানে প্রার্থনা করে যেকোনো শুভ কাজ করা হয়। গণেশ তাঁদের 'নেল্লাকি বলুচা' দেখালেন এবং আমরাও শ্রদ্ধা জানালাম।
কিন্তু দ্রাবিড়দের মাঝে এই পাহাড়ঘেরা জায়গায় কিছুসংখ্যক অ-দ্রাবিড় কি করে এল সে প্রশ্নে মন আলোড়িত হয়ে চলল। নৃতাত্ত্বিকদের কাছে কোডাভাদের অবস্থান আজো একটা ধাঁধা হয়ে রয়েছে। তাদের খুলির মাপ থেকে তাঁরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে কোডাভারা আর্য নয়। তবে তারা কারা?! সেই খোঁজ এখনও চলছে।
নৈশভোজে প্রধান আকর্ষণ ছিল পান্ডি কারি ও কাডমবুত্তু। কাডমবুত্তু হল চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি গোল বল, যা পান্ডি কারির অনবদ্য জুড়িদার। পান্ডি অর্থ পর্ক। আগেকার দিনে বুনো শুয়োর শিকার করে কাচমপলি নামক কুর্গের নিজস্ব কালো ভিনিগারে দীর্ঘক্ষণ ভিজিয়ে রেখে রোস্টেড মশলায় রান্না হত। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। অমন নরম পর্ক সত্যিই আমি খাইনি কোথাও। এটা ওই ভিনিগারের গুণ। সকালের মতোই চালের তিনরকম অপশন ছিল। কাডমবুত্তু ছাড়াও আক্কি রুটি আর কুর্গি পোলাউ। সঙ্গে ছিল অভিনব স্বাদের হলুদ শসার তরকারি বোলারি বারথাড এবং একটি মাছের পদ। শেষপাতে মধু দেওয়া পুডিং। সত্যি বলতে কী পঞ্চেন্দ্রিয় ব্যবহার করে খাওয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম।
রাতে ঝরনার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব ভোরে উঠে হাঁটতে বেরোলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। চুপ করে থেকে সময়ের নির্যাসটুকু শুষে নিচ্ছিলাম অন্তরে। ফিরে এসে সারাদিনের মত তৈরি হয়ে নিয়ে প্রাতরাশ করতে গেলাম। আবারও নতুন একটা চালের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। পাপুত্তু – ভাঙা চাল, নারকেল ও দুধ দিয়ে তৈরি কেকের মতো খণ্ড। অবাক এবং মুগ্ধ হয়ে হয়ে ক্লান্ত আমি! আরও ছিল নীর ধোসা, ছিল আক্কি রুটিও, সঙ্গে দারুণ সাইডকিক এলু পাজি এবং আমার স্বপ্নে দেখা পেপার ক্যাপসিকাম স্ট্যর ফ্রায়েড ইন বাটার। একমাত্র গুড় কফি ছাড়া প্রতিটি খাবার আমার রসনাকে সাত তারা পরিতৃপ্তি দিয়েছিল।
গণেশদম্পতির কাছে বিদায় নিতে গিয়ে মন ভারি হয়ে উঠল। গাড়িতে যাচ্ছি যখন ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়, শ্যামল অরণ্য আর খেতখামার ঘিরে সহস্রাধিক বছর ধরে কিছু মানুষের যে আনন্দিত বসবাস তার এক বিশ্বস্ত ছবি আঁকা হচ্ছিল মনের ভিতর।
ইরুপ্পু জলপ্রপাত দারুণ সুন্দর, কিছুটা বনপথে হেঁটে পৌঁছতে হয়। লক্ষ্মণতীর্থ নদী তিন ধাপে এই প্রপাত সৃষ্টি করেছে। এদেশের প্রতিটি রাজ্যই রামায়ণ-মহাভারতের সঙ্গে সংযোগসূত্র দাবি করে। আর্যায়ণে নিহিত এই আকাঙ্ক্ষার বীজ। এখানে এসে আবার সেই প্রমাণ পেলাম। কথিত যে রাম ও লক্ষ্মণ নাকি সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে এই অঞ্চলে হাজির হয়েছিলেন। রাম তৃষ্ণার্ত হলে জলের অভাবে লক্ষ্মণ শরনিক্ষেপ করে এক জলস্রোত সৃষ্টি করেন। সেই স্রোতই লক্ষ্মণতীর্থ নদী রূপে প্রবাহিত। জলের শব্দ আমাদের সব কথা থামিয়ে দিয়েছিল, মুগ্ধদৃষ্টি দিয়েই তাকে ছুঁলাম। অনেকক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করলেও সেখান থেকে রওনা দিলাম থলকাবেরী।
অসংখ্য এলাচ খেত, কফি খেত পেরিয়ে গেলাম, পেরোলাম গভীর অরণ্য, উচ্চাবচ উপত্যকা। তারপর পৌঁছলাম ব্রহ্মগিরি পাহাড়ের সেই পবিত্র কুণ্ডে, যেখান থেকে কাবেরীর উৎপত্তি। কুণ্ড ঘিরে শ্বেতপাথরের সুবিশাল মন্দিরচত্বর। কুণ্ডের প্রাকৃতিক রূপ কল্পনায় আনার চেষ্টা করে বিফল হলাম। কাবেরীর পৌরাণিক জন্ম-কথা স্মরণ করলাম - কাবেরীর মানুষী সত্ত্বা ব্রহ্মবাদিনী লোপামুদ্রাকে যার লেখা ঋগ্বেদের রতিসূক্ত। পরমাসুন্দরী লোপামুদ্রা কুরূপ এবং বৃদ্ধ স্বামী অগস্ত্যকে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু মানতে পারছে না তাঁর ঔদাসীন্য। তার সেই সময়ের মনের ছবি ধরা আছে রতিসূক্তে। বহু সহস্র বছর আগেকার এক দম্পতির আরণ্যক আশ্রম-জীবনের ছবি ঘিরে ধরল আমায়। থল কাবেরী ছেড়ে যখন অ্যাবে ফলসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তখনও কাবেরীর ভাবনা ছাড়ল না। কাবেরীর এক উপনদী সৃষ্টি করেছে এই জলপ্রপাত। মনোরম কফি বাগানের মধ্যে দিয়ে পৌঁছতে হয়। অবিরাম জলের ধারা দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল আচ্ছা, লোপামুদ্রার কাবেরী হয়ে বয়ে যাওয়া কি আসলে সংসারত্যাগের রূপক?!
বিকেলে মাদিকেরি শহরে ঢুকে প্রথমেই চলে এলাম রাজা'স সিট। এখানে বসে রাজা সূর্যাস্ত দেখতেন। উপত্যকার অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হল স্কটল্যান্ডের তুলনার নিকুচি করেছে। এ আমার দেশ, ক্রমাগত সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে, বৈচিত্র্যে স্তম্ভিত করে আর কথা ও কাহিনি দিয়ে ভাবায়।
পরিশিষ্ট: মাদিকেরি থেকে হ্যান্ডমেড চকলেট, ইউক্যালিপটাস অয়েল আর অরিজিন অফ কোডাভা নামে একটি বই কিনেছিলাম। প্ল্যানটার'স ওয়াইফ পরিচালিত একটি কফিপাবে ফিল্টার কফি খেতে গিয়ে ম্যানেজার মেয়েদের জন্য বাড়িতে তৈরি নানারকম ওয়াইন আমাদের চেখে দেখতে অনুরোধ করেছিলেন। চামচে করে টেস্ট করে বোঝদারের মত ভঙ্গি করে গেছিলাম। তবে সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম পানের ফ্লেভারের ওয়াইন চেখে। ঠিক যেন আমার দিদার ছাঁচি পানের আমেজ রসনায় ছড়িয়ে গেল। বলা হয়নি যে কথাটা, সুরা কোডাভাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মহিলাদের জন্য বাড়িতেই তৈরি হয় আলাদা রেঞ্জের সুরা।
প্রজ্ঞা পারমিতা ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লিখছেন বছরদশেক। মেডিক্যাল জার্নালিজম করেছেন 'বর্তমান' প্রকাশনার স্বাস্থ্য পত্রিকাতে। 'মাতৃশক্তি' ও 'জাগ্রত বিবেক' পত্রিকার সহসম্পাদক ছিলেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্যরক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে কলম ব্যবহার করে থাকেন।
HTML Comment Box is loading comments...