সান্দাকফু-ফালুট ট্রেক
পঙ্কজ দত্ত
~ সান্দাকফু ট্রেক রুটম্যাপ || সান্দাকফু ট্রেকের আরও ছবি ~
১৬ এপ্রিল ২০২১-এ আমরা সাতজনের একটা দল কলকাতা থেকে রওনা দিলাম সান্দাকফু-ফালুট-এর উদ্দেশে। সান্দাকফু পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে উঁচু শৃঙ্গ এবং ফালুট দ্বিতীয়। রাতের খাবার খেয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। গল্প-আড্ডা হতে হতে কখন চোখ দুটো বুজে গেল বুঝতেই পারলাম না।
নিউ জলপাইগুড়ি নেমে ফোন করলাম আমাদের গাড়ির দাদাকে যিনি মানেভঞ্জন অবধি নিয়ে যাবেন। পৌঁছতে প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টা লাগবে, তাই ঠিক করা হল রাস্তাতেই দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেব। ভোটের দিন হওয়ায় কোনো ভালো রেস্তোঁরা খোলা পেলাম না। ভাবছিলাম যে, যাহ্, তাহলে কি খালি পেটেই যেতে হবে! হঠাৎ একটা ছোট খুপরিমতন দোকান চোখে পড়ল। প্রথমে মনে হল যে, এখানে কি আদৌ কিছু পাওয়া যাবে? তারপরে ভাবলাম সবই তো বন্ধ, একবার চেষ্টা করে দেখি, যদি কিছু পাই। জিজ্ঞেস করলাম যে, দুপুরের খাবার কী আছে? এক মহিলার উত্তর এল, থাইপও আছে। থাইপও! সেটা আবার কী! পেটে প্রচুর খিদে তখন। বললাম যা আছে তাই দিন, খুব খিদে পেয়েছে। আহা! কী সুস্বাদু। অনেকটা মোমোর মতন খেতে এবং দেখতেও, কিন্তু সাইজে মোমোর থেকে অনেক বড়। পেটটা যেন পুরো ভর্তি হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়ার পর্ব মিটিয়ে শেষ করে আবার গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে।
মানেভঞ্জন পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। দু'কিলোমিটার ওপরে খোপিধারাতে গিয়ে আমাদের গাড়ি থামল। ওখানে একটা হোমস্টেতে বুকিং করা ছিল। পরেরদিনের ট্রেকের প্ল্যান এবং সকলের জীবনের অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প করতে করতেই সন্ধ্যাটা কেটে গেল।
সকাল হতে না হতেই তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে গেলাম ট্রেক শুরু করার জন্য। সেদিনের গন্তব্য ছিল টংলু। ট্রেক শুরু করার ঠিক আগেই পাশং শেরপা এসে উপস্থিত। সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক-এর পারমিট করিয়ে এনেছিলেন পাশংজি। উনিই পুরো ট্রেকটির গাইড - ভীষণ ভালো মনের মানুষ। আমাদের দলের সবথেকে বয়স্ক সদস্য ইলা দত্ত সিং, একষট্টি বছর বয়স ওঁর। পাশংজি ওঁকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানালেন ।
ঠিক দশটার সময় ট্রেক শুরু হল। খোপিধারার জঙ্গল দিয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম। সবার পিঠে ভারী ভারী রুকস্যাক। জঙ্গল পেরিয়ে চিত্রে পৌঁছলাম। পাশংজি বললেন এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবার রওনা দেব। গন্তব্যস্থল তখনও বহুদূরে। কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারলাম না চিত্রেতে, আবহাওয়া খারাপের দিকে যাচ্ছিল। পাহাড়ের আবহাওয়া বোঝা সত্যিই খুব মুশকিল। এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়েই রওনা দিলাম। একটু যেন এনার্জি পেলাম চা খেয়ে। খুবই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম অনেকটা পথ হাঁটার পর। চিত্রে থেকে মেঘমা পৌঁছলাম। মেঘমাতে এসএসবি ক্যাম্পকে পেছনে ফেলে ওপরে উঠতেই আবহাওয়া আরও খারাপ হয়ে এল। এতটাই খারাপ যে এক ফুট দূরত্বের মানুষকেও দেখা যাচ্ছিল না – একে বলা হয় 'হোয়াইট আউট '। ঝোড়ো ঠাণ্ডা হাওয়া, তার সঙ্গে বৃষ্টি। আহা কী অভিজ্ঞতা! এই না হলে অ্যাডভেঞ্চার! সবাই আপাদমস্তক ভিজে গেছি ততক্ষণে। অবশেষে টংলু পৌঁছলাম বিকেলে। সবাই ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছি। তাড়াতাড়ি ট্রেকার্স হাট-এ ঢুকে পোষাক বদলে ভিজে জামাকাপড় মেলে দিলাম খাটের ধারে, টেবিলের ওপরে, যে যেখানে পারলাম। সব কাজ সেরে গরম গরম স্যুপ পান করা হল। বাহ্! একটু যেন স্বস্তি হল। তারপর সোজা লেপের ভেতরে। বাইরে তখন শিলা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সবাই চিন্তায় পড়ে গেলাম যে আজকের দিনটা তো কাটল, কিন্তু আগামীকাল পরের গন্তব্যে পৌঁছব কী করে যদি এরকম আবহাওয়া থাকে! রাতের দিকে ঘরের ভেতর থেকেই শুনতে পারছিলাম বেশ জোরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে বাইরে। একটাই বাঁচোয়া যে বৃষ্টি একদম থেমে গিয়েছিল। খোপিধারা থেকে টংলু অবধি সাড়ে নয় কিলোমিটার ট্রেক করে ফেলেছি প্রথম দিনে।
সকাল হতেই দেখি, আবহাওয়া পুরো পাল্টে গেছে। ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আর তার সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালা। আহা! সে কী দৃশ্য! যত বেলা বাড়ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন রোদের আভায় তত বেশি চমকাচ্ছে। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম পরের গন্তব্যস্থলের দিকে, কালাপোখরি। টংলু থেকে টুমলিং এবং জৌবাড়ি হয়ে গৈরিবাস-এ পৌঁছানো গেল।
ওখানে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে কালাপোখরির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। এখানে একটা পুকুর আছে যার জলটা কালো এবং নেপালি ভাষায় পুকুরকে বলা হয় পোখরি, তার থেকে এই জায়গাটার নামকরণ। টংলু থেকে কালাপোখরি অবধি সেদিন ১১ কিলোমিটার ট্রেক করে ফেলেছি।
কালাপোখরি থেকে পরের দিন সান্দাকফু যাওয়ার পালা। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে। কালাপোখরি থেকে সান্দাকফুর রাস্তা ভীষণ সুন্দর। বার বার যেতে ইচ্ছে করবে। জঙ্গলের মধ্যে ট্রেক করা থেকে শুরু করে গাছভর্তি রডোডেনড্রন ফুলের অপূর্ব রং, ফাঁকা জমির ওপর দিয়ে ট্রেক করা অনেকটা উঠতেও হয় আবার নামতেও হয় সব মিলিয়ে মিশিয়ে দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।
সকাল এগারটা পঞ্চাশ নাগাদ সান্দাকফু পৌঁছলাম ৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। সবার কী আনন্দ। সবাই পেরেছি। যার জন্য এতদিনের অপেক্ষা, এতো কষ্ট করা, সেটাই শেষমেশ সফল হল। আমাদের ট্রেকটা স্পনসর করেছিল ডগলাস মেমোরিয়াল হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল বারাকপুর। স্পনসর-এর ফ্ল্যাগ থেকে শুরু করে আরোহণ ওয়ান্ডারলাস্ট-এর ফ্ল্যাগ, ট্রাভেল ম্যানিয়াক-এর ফ্ল্যাগ, প্রেরণার ফ্ল্যাগ, ফটো অ্যাসোসিয়েশন অফ বারাকপুর-এর ফ্ল্যাগ এবং জাতীয় পতাকা ওখানে ডিসপ্লে করলাম। অনেক অনেক ছবি তোলা হল। এইসমস্ত কাজ শেষ করে ট্রেকার্স হাট-এ ফেরত গেলাম। ওখানে বসে প্রচুর গল্প-আড্ডা হল। সবাই খুব খুশি। কিন্তু এই খুশির মধ্যেও একটু মন খারাপ ছিল কারণ স্লিপিং বুদ্ধার দর্শন পাইনি। তবে মনে আশা ছিল যে পরের দিন ভোরে অবশ্যই পাব।
পরের দিন ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়লাম স্লিপিং বুদ্ধার দর্শনে। আহা! কী দৃশ্য! মন ভরে গেল যখন চোখের সামনে কুম্ভকর্ণ, কুম্ভকর্ণ ইস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত শৃঙ্গগুলো দেখছিলাম। চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না আবেগে, খুশিতে। কিন্তু মাথায় এটাও চিন্তা রয়েছে যে আজকে লম্বা ট্রেক করতে হবে, তাই, বেশি সময় এখানে নষ্ট করা যাবে না। তাড়াতাড়ি না বেরোলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।
মেঘমাতে দুপুরের লাঞ্চ। ট্রেকে হাঁটার সময় কখনও হেভি লাঞ্চ করা হয় না সাধারণত, কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম হল। গরম ভাত, ডাল, পাঁপড়ভাজা দেখে বাঙালি লোভ সামলাতে পারলো না। সঙ্গে গ্লাসভর্তি রডোডেন্ড্রন ওয়াইন। ভুল করলে ফল তো ভুগতে হবেই। তাই মেঘমা পেরিয়ে চড়াইয়ে উঠতে সবার দম বেরিয়ে গেল। পিঠের স্যাক যেন পাথরের মত ভারী হয়ে উঠেছে। তবে একটু চড়াই ভেঙে উঠতেই মেঘ সরিয়ে শেষ বিকেলের নরম রোদ বেরিয়ে এল। স্নেহাশিস চিৎকার করে বলল, "সবাই পা চালাও... টংলু থেকে সানসেট দেখব।"
সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম গন্তব্যস্থলের দিকে। আজকের লক্ষ্য হল ফালুট। অনেক লম্বা রাস্তা। ২১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হবে। তার মধ্যে অনেকটা উঠতে হবে পাহাড়ে। সান্দাকফু থেকে সাবারগ্রাম হয়ে পৌঁছলাম মলি, দুপুরের খাওয়া সারা হল। খেয়েদেয়ে আবার শুরু পথ চলা। বিকেলে পৌঁছে গেলাম ফালুট। আবার জয়ধ্বনি সবার মুখে,জাতীয় সঙ্গীতও গাইলাম ফালুট-এ। তাপমাত্রা তখন ভীষণ কমে গেছে। খুব ঠাণ্ডা, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না। ফ্ল্যাগ ডিসপ্লে করে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ট্রেকার্স হাট-এ ফেরত গেলাম।
সান্দাকফু-ফালুট অভিযানের সাফল্যে পাশংজিকে অনুরোধ করা হল গোর্খেতে একটা ক্যাম্প ফায়ার-এর ব্যবস্থা করতে। অভিযানের সাফল্য উপভোগ করতে চাই সবাই মিলে। পাশংজি তাতে রাজিও হয়ে গেলেন। সেদিন অনেক রাত অবধি চলল গল্প-আড্ডা। আরও একটা দলও পৌঁছেছিল ফালুট। গল্পের আসরে তাদেরও আমন্ত্রণ জানালাম। অনেক নতুন আলাপ হল, বন্ধু হল, গল্প হল। সবশেষে নৈশাহার সেরে ঘুম। পরের দিন সকালে রওনা দিতে হবে গোর্খের উদ্দেশ্যে।
আবহাওয়া খারাপ হতে লাগল। পাশংজি তাড়া দিলেন যে যদি তাড়াতাড়ি না বেরোই, তাহলে আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেলে অভিযান করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ওঁর কথা মেনে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোতে যাব, ঠিক সেই সময় তুষারপাত শুরু হল। ওই দেখে সবাই ভীষণ খুশি। সেই তুষারপাতের মধ্যেই চলল অভিযান।
রাস্তা পিছল হয়ে গেছিল। পা ফেলতে কিছুটা ভয়ও লাগছিল। মনে হচ্ছিল এই না পড়ে যাই। ফালুট থেকে নিচের দিকে নামতেই শুরু হল বৃষ্টি। ফালুট থেকে গোর্খে যেতে অনেকটা খাড়া উৎরাই নামতে হয়। জঙ্গলের রাস্তা তখন ভীষণ পিছল হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে অভিযান করতে গিয়ে কয়েকজন পড়েও গেল, চোটও লাগল কারো কারো। কিন্তু কিছু করার নেই। ওই প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে গোর্খে ট্রেকার্স হাটে পৌঁছলাম বিকেলে।
সেই একই অবস্থা। সবাই পুরো ভিজে গিয়েছি। আবার সমস্ত জামাকাপড় বার করে শুকানোর পালা। চা-বিস্কুট খেয়ে সন্ধ্যেবেলাতে হল ক্যাম্পফায়ার। আগুনের চারপাশে গোল করে ঘিরে বসে গান বাজনা নাচ হাসিঠাট্টা সবই চলল বেশ কিছুক্ষণ। তার মধ্যেই আগুনের চারপাশে ভেজা জামা কাপড় জুতোমোজা শুকোতে দেওয়া হল। অনেক রাত অবধি চলল এসব।
পরের দিন সকাল হতেই চা খেয়ে রওনা দিলাম রাম্মাম-এর উদ্দেশ্যে। রাম্মাম থেকে শেয়ার গাড়িতে শ্রীখোলা ব্রিজ। সেখান থেকে গাড়ি ঠিক করা ছিল আগে থেকেই, তাতে চেপে রিম্বিক, মিরিক হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন।
শেষের দিন সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পাহাড়েই থেকে যাই। কিন্তু ফিরে তো আসতেই হবে…
~ সান্দাকফু ট্রেক রুটম্যাপ || সান্দাকফু ট্রেকের আরও ছবি ~
আদতে ব্যারাকপুরের বাসিন্দা পঙ্কজ দত্ত হলদিয়ার আই ভি এল ধুনসেরি পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিস প্রাইভেট লিমিটেড-এ চাকরি করেন। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং ছবি তোলা ও বেড়াতে যাওয়া বিশেষ করে অ্যাডভেঞ্চার তাঁর প্যাশন। পঙ্কজ মনে করেন শুধু অর্থ রোজগারই বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। জীবন ভারী সুন্দর। বাঁচার জন্য যেটাই করতে হবে ভালোবেসে করতে হবে তাহলেই জীবনে প্রকৃত আনন্দ অনুভব করা যাবে।