সুন্দরবন ভ্রমণ আর দুই বাঘের গপ্প

দময়ন্তী দাশগুপ্ত


টর্চ হাতে নিয়ে অন্ধকারে ছাতে উঠতেই বুঝলাম আড্ডাটা খুব জমে গেছে। দীপ, বিশ্বনাথ আর সুবিত। পাশে চিকেন পকোড়ার প্লেট। পিংকির, আমার অবশ্য আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মাসীমা আর সুমন ক্লান্ত হয়ে ঘরেই বিশ্রাম করছিল।
গল্পের খেইটা ধরিয়ে দিল দীপ – ঘটনাটা পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্কের। পেঞ্চ-এর বেশিরভাগটাই মধ্যপ্রদেশের মধ্যে পড়ে, কিছুটা অংশ মহারাষ্ট্রের মধ্যে। তুরিয়া জোন জঙ্গলের কোর এরিয়ায়, এটাই সবথেকে জনপ্রিয় জোন। তুরিয়া গেটের কাছাকাছি কয়েকটা বাফার জোন আছে। সেগুলোর মধ্যে মহারাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে খুরসাপাড় গেট, এটা তুরিয়া গেট থেকে ৪ কিলোমিটারের মধ্যে। পেঞ্চ ঘুরতে আসা পর্যটকরা সাধারণত তুরিয়া গেট আর তার আশেপাশের বাফার জোনের গেটেই সাফারি করে। সুবিত আবার শুরু করল –

আমার এই ঘটনাটা তুরিয়া জোনের গেট থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে, নাম রুখড় গেট। এটাতে সাধারণত নাগপুর আর তার আশেপাশের ট্যুরিস্টরা ভিড় জমায়। রুখড় গেট মধ্যপ্রদেশের মধ্যে অবস্থিত বাফার জোন। রুখড় গেটের কাছে যে বাঘটা নতুন এসে জুটেছে বলে খবর সেটা সেই সকালবেলায় একটা শুকনো নালার মধ্যে নেমে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করেও তার ঘুমভাঙার কোনো লক্ষণ নেই। এদিকে এই নতুন বাঘটা 'কিংফিশার' বলে একটা স্থানীয় পুরুষ বাঘকে তাড়িয়ে এই এলাকায় এসেছে। লাস্ট ছ-সাত মাস দেখাই নেই কিংফিশারের। সে ভেগেছে বলে খবর।
আমার সাথী ফকিরচাঁদ কলেজের ফিজিক্সের প্রফেসর এবং ফোটোগ্রাফার কিশোরদা আর দিল্লির আরেক জঙ্গলপাগল ফোটোগ্রাফার মামরাজজি। মামরাজজি বহুবার এইসব জঙ্গলে এসেছেন। এখানকার জঙ্গলের রাস্তাঘাট আর খবরাখবর সব হাতের তালুর মতো জানেন। বয়স প্রায় বছর ষাটেক, মাসের কুড়ি-বাইশ দিন দেশের বিভিন্ন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। দিল্লিতে ওঁর পঞ্চাশটি বাড়িতে ভাড়াটে থাকে। সেই ভাড়ার টাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যায়।
বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন বাঘটার ঘুম ভাঙলো না, মামরাজ বললেন তাহলে কুড়াইগড়ের দিকেই যাওয়া যাক। কুড়াইগড় জঙ্গলের অন্যপ্রান্তের পাশে একটা গ্রামের নাম। গেট থেকে কুড়াইগড় পৌঁছতেই ঘন্টাখানেক সময় লেগে যায় তাই সেদিকে সাধারণ ট্যুরিস্ট সাফারির গাড়ি প্রায় যায়ই না। যাওয়ার রাস্তার বেশিরভাগটা ছোটো ছোটো টিলার পাকদণ্ডী বেয়ে। খুবই ঘন পাহাড়ি জঙ্গল আর রাস্তাও বেশ খারাপ। কুড়াইগড়ে একটি মেল এবং একটি ফিমেল বাঘের নিবাস। বাঘিনীটি মারাত্মক রগচটা। কুড়াইগড় ফিমেলের বিভিন্নসময় বিভিন্ন সাফারি গাড়িকে তাড়া করার জন্য বদনাম আছে। ড্রাইভার, গাইডরাও কুড়াইগড় ফিমেলকে বেশ সমীহ করে চলে। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। তাও কিংফিশার আর কুড়াইগড় ফিমেলের সন্ধানে আমরা সেদিকে রওনা দিলাম।
পাকদণ্ডী পথ বেয়ে ওপরদিকে উঠছি। অন্য কোনো গাড়ি নেই পথে। গাইড বলল, বাঘ তো আর রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে উঠবে না, সোজা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠবে। রাস্তার ওপরদিকে নজর রাখুন। আমরাও ঘাড় উঁচু করে ওপরদিকে এপাশ-ওপাশ দেখছি। হঠাৎ একটা শার্প টার্ন নেওয়ার পরেই দেখি রাস্তায় কয়েক হাত দূরেই বাঘ! আমরা হকচকিয়ে গেছি, বাঘটারও একই অবস্থা। খানিকক্ষণ দুপক্ষই চুপচাপ। ছবিটবি তোলা ভুলে গেছি তখন। তারপর সম্বিত ফিরতেই ড্রাইভার ব্যাকগিয়ারে চালাতে শুরু করেছে। আর বাঘটাও খপখপ করে এগিয়ে আসছে। আমরা পেছোচ্ছি, বাঘও এগোচ্ছে…বাঘ এগোচ্ছে, আমরাও পেছোচ্ছি…। এভাবে খানিকক্ষণ যাওয়ার পরে বাঘটা ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমরাও ছবিটবি তুলছি। তারপর বাঘটা আবার এগোচ্ছে, আমরা আবার পেছোচ্ছি। হঠাৎ দেখি আরেকটা গাড়ি এসে হাজির। তাতে ষণ্ডা ষণ্ডা সব লোকাল মানে নাগপুরী লোকে ভর্তি। তারা আমাদের পেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল। যেতেই একেবারে বাঘটার মুখোমুখি। ওরাও ঘাবড়ে গিয়ে ব্যাকে ফেরার চেষ্টা করতেই গাড়িটার চাকা রাস্তার পাশের নালায় পড়ে গেল। সে এক অদ্ভুত অবস্থা। সামনে রগচটা বাঘ, ওদিকে গাড়ি উলটে পড়ে আছে, পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ও নেই। বাঘটা এসে ওদের গাড়ি শুঁকেটুকে আবার এগোতে শুরু করল। আবার আমাদের গাড়ির দিকে খপখপ করে এগোচ্ছে আর আমরা পেছোচ্ছি। পেছোতে পেছোতে একেবারে যেখানে সাফারির অন্য পর্যটকরা ছিল সেখানে পৌঁছে গেছি। আমরা তো এতক্ষণ ভেবে যাচ্ছিলাম যে কুড়াইগড় ফিমেল তেড়ে আসছে। কিন্তু কাছাকাছি এসে রাস্তার পাশের একটা পুকুরে নেমে গেল বাঘটা। তখন লক্ষ্য করলাম ওটা ফিমেল নয় মেল - কুড়াইগড় মেল। একটু পরে ওই গাড়িটাও নেমে এল। জানলাম যে বাঘ চলে যেতে ওই ষণ্ডা ষণ্ডা লোকগুলোই গাড়ি ঠেলে তুলে ফেলেছে।


অতিমারীর জন্য গত দুবছর প্রায় অন্তরীণ থাকার পর আজ সকালেই সুন্দরবনে এসে পৌঁছেছি। বাঘের দেখা মিলবে কিনা জানিনা। তাই শুরুতেই একটা বাঘের গল্প শুনিয়ে রাখলাম। তবে এখনো বাঘের দেখা না পেলেও সকাল থেকে শুরু হওয়া জলযাত্রায় পাখি দেখেছি বেশকিছু, আর হরিণ, কুমীর, ভোঁদড়, বুনো শুয়োরও। সেই গল্পটাই এবার শুরু করি।

বেলা এগারোটা নাগাদ গদখালি থেকে লঞ্চে উঠলাম – এম বি অভয়। আমি আর দীপ। মেয়ে আসেনি বলে মনটা একটু খারাপ। দীপের সহকর্মী ও বন্ধু বিশ্বনাথ, ওর স্ত্রী পিঙ্কি আর দুই মেয়ে। বিশ্বনাথের বন্ধু, দীপেরও পরিচিত সুবিত, ওর স্ত্রী সুমন আর শাশুড়ি মানে সকলের মাসিমা। ওদের মেয়েও আসতে পারেনি নতুন চাকরিতে ছুটি না পাওয়ায়। সুবিত, বিশ্বনাথ দুজনেরই নেশা বার্ড ফোটোগ্রাফি, ওদের পরিভাষায় 'বার্ডিং'। ওরাই আসছিল সুন্দরবনে। ডাকাডাকি করে আমাদের দুজনকেও দলে জুটিয়ে নিয়েছে। এর আগেও ওরা একাধিকবার এসেছে সুন্দরবনে -নিত্যানন্দের লঞ্চে। সুন্দরবনের এই জলজঙ্গল নিত্যানন্দের এতটাই চেনা যে সে লঞ্চ এমনভাবে ঘুরিয়ে নিয়ে দাঁড় করায় যাতে পাখি বা অন্য কোনো জন্তুর ছবি সবথেকে ঠিকঠাক ভাবে নেওয়া যায়। এবারে অবশ্য আমরা নিত্যানন্দের লঞ্চ পাইনি, আগেই তার বুকিং হয়ে গিয়েছিল। তবে এযাত্রার সব ব্যবস্থা ওরই করা। লঞ্চে রয়েছেন নিতাইয়ের মামা, তাঁকে আমরাও মামা ডাকছি। গাইডের নাম মানস মন্ডল। আরেকটি ছেলেও রয়েছে লঞ্চে - উৎপল। রান্না করছেন এক মহিলা যাঁকে মামাই এনেছেন, আর আছে লঞ্চের চালক। সবমিলিয়ে আমরা এই চোদ্দজন লঞ্চে রয়েছি।

শীতের ভোররাতে কলকাতা থেকে সবাই মিলে একটা টাটা উইঙ্গার-এ ক্যানিং হয়ে গদখালি ফেরিঘাটে যখন পৌঁছলাম ভালোই রোদ্দুর চারদিকে। লঞ্চে উঠতেই প্রথমে হাতে হাতে কচি ডাব, তার একটু পরেই লুচি তরকারি আর গুড়ের রসগোল্লা দিয়ে জব্বর ব্রেকফাস্ট হল।
নদীর নাম দুর্গাদোয়ানি, ওপারে হ্যামিল্টন সাহেবের স্মৃতিরঞ্জিত গোসাবা। এখনও লোকালয় ছাড়াইনি, দুপাশে যদিও ম্যানগ্রোভ অরণ্য শুরু হয়ে গেছে। যেতে যেতে চোখে পড়ল, ভাটায় জল নেমে গিয়ে প্লাস্টিকজঞ্জাল আটকে বিশ্রী হয়ে থাকা একটা গাছের ডালে বসে আছে সাদাকালো হোয়াইট ব্রেস্টেড কিংফিশার। আরেকটু এগোতেই গাছের ডালে একটা সাদারঙের বক থুড়ি হেরন বসে রয়েছে।

ওদিকে গাইড মানস মন্ডল তখন সুন্দরবনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভূমিকা শুরু করেছে, কলকাতার ৪০ কিমি পূর্বে গেটওয়ে অব সুন্দরবন ক্যানিং। সেখান থেকে গদখালির ফেরিঘাটের দূরত্ব ২৭ কিমি। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের আয়তন ৯৬৩০ বর্গ কিমি - আরণ্যক এলাকা ৪২১০ বর্গ কিমি আর টাইগার রিজার্ভ ২৫৮৫ বর্গ কিমি, বাকিটা বসতি এলাকা। শেষ গণনা অনুযায়ী এখানের বাসিন্দা ছিয়ানব্বইটি বাঘ। একশো দুইটি দ্বীপের চৌত্রিশটিতে জনবসতি। ১৯৮৯ সালে জীব পরিমণ্ডল আর ১৯৯৭ সালে ওয়ার্ল্ড ন্যাচারাল হেরিটেজ সাইটের শিরোপা পেয়েছে -সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভকে গ্লোবাল বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। মানসের হাতে একটা বাইনোকুলার। তাতে চোখ লাগিয়ে পাখি কিংবা অন্য কোনো জন্তুর নজরে এলেই লঞ্চটা সেদিকে নিয়ে যেতে বলছে। সুবিত বিশ্বনাথও তাদের ট্রাইপড মোনোপড ক্যামেরায় লম্বা লেন্স ফিট করে রেডি।

দুপাশে গোলপাতা,কেওড়া, বাইন, গেঁওয়া-র শ্বাসমূল আর ঠেসমূলওলা গর্জনের নিবিড় অরণ্য। ওরই মাঝে চোখে পড়ল জলের ধারে কমন স্যান্ডপাইপার, কাদাখোঁচা, ওয়ার্বলার, গাছের ডালে ব্ল্যাক ক্যাপড কিং ফিশার, নীল-সাদা কলার্ড কিংফিশার, হলুদে-নীলে কমন কিংফিশার, রঙিন বনমোরগ। কাদার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে মদনটাক। তীরে বুকে হেঁটে চলেছে বড়সড় ওয়াটার মনিটর। বেশ কয়েকটা বাঁদরও চোখে পড়েছে ইতস্তত।

এরই মধ্যে গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত সুমন একটুক্ষণ লঞ্চের চালকের আসনে বসল। দুপুরে বেশ রোদ্দুর। সোয়েটার, জ্যাকেট খোলা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। লাঞ্চের আয়োজনও তোফা,আজ ভাঙর মাছ। জলখাবারের পর আপেল খাওয়াও হয়েছে একটা করে।

পাড়ের কাছেই জঙ্গলের মধ্যে এবার একটা হরিণ নজরে এল। নিবিষ্টমনে গা চুলকাচ্ছে। কে যেন মন্তব্য করল, হরিণটা এত আরামে আছে দেখে বোঝা যাচ্ছে বাঘ ধারেকাছেও নেই। একজায়গায় বালিতে বাঘের পায়ের শুকিয়ে যাওয়া দাগ চোখে পড়ল। আসলে বাঘ-হরিণ দেখা নয়। সুন্দরবনের আসল আকর্ষণ তার নদীর সমুদ্রোপম বিস্তার আর দুপাশে রহস্যময় জঙ্গল। সদ্য পড়া হাংরি টাইড-এর বিবরণগুলো মনে পড়ছিল। অত ভেতরে যাওয়া তো সম্ভব নয়। তবে যেটুকু দেখতে পাচ্ছি তাই বা কম কী!

একজায়গায় এসে আবার পাগমার্ক চোখে পড়ল। এবারেরটা টাটকা। সেই নিয়ে ছবি তোলা আর জল্পনার মাঝেই মানসের ফোনে খবর এল বাঘ দেখা গেছে,বিশেষ দূরেও নয় - পাঁচশো মিটারের মধ্যেই। সেখানের কাছাকাছি একটিমাত্রই প্রমোদতরী ছিল, তার যাত্রীদের কারোর কাছেই ক্যামেরা ছিল না, দেখেছে তারাই। তাদের গাইড মোবাইল ফোনে ছবি তুলে আমাদের গাইডের ফোনে পাঠিয়েছে। একেই বলে কপাল। যেদিকে বাঘ দেখা গেছে, লঞ্চটাকে নিয়ে যাওয়া হল সেদিকে। কাছাকাছি পৌঁছে দেখি আরো অনেক লঞ্চ ভিড় করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঘ আর দেখা দিল না অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। জলের ওপর কমলা রঙের সূর্যটা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে।
রাতে থাকা হবে বালিদ্বীপে। সজনেখালি পাখিরালারই একটা অংশ এই বালিদ্বীপ। লঞ্চ এবারে সেদিকপানে মুখ ঘোরাল।

ছোট্ট হোম স্টে। সামনের অল্প জমিতে মরশুমি ফুলগাছ, তিনটেই মাত্র ঘর, তার একটায় ব্যাগপত্র নিয়ে ঢুকে পড়ি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পাশাপাশি দুটো চওড়া খাট প্রতি ঘরেই। অনায়াসে চারজন শুয়ে পড়তে পারবে। হাতমুখ ধুয়ে চিকেন পকোড়া আর চা খাই। তারপর ছাদের আড্ডায় সেই বাঘের গল্প শোনা।

পরদিন খুব সকাল সকাল বেরোনো হল। তখনও কুয়াশা কাটেনি। উদীয়মান সূর্যের লাল আভা কুয়াশা ঠেলে অল্প অল্প এসে পৌঁছাচ্ছে। বিদ্যাধরী নদী থেকে চলে এসেছি কুন্দিরী নদীর বুকে। দুপাশে হেঁতালের জঙ্গল। সকালে শঙ্খচিল চোখে পড়েছে। এখন দেখছি গাছের ডালে চুপ করে বসে রয়েছে একটা সার্পেন্ট ঈগল। একটু পরেই অবশ্য ডানা মেলল আকাশে। আরো খানিক এগোতেই একটা হরিণ নজরে এল। স্পটেড ডিয়ার। অদূরেই পাড়ের খোলা ঘাসজমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে,ঘাস খাচ্ছে। এরপর জলের ধারে, গাছের ডালে একে একে দেখা দিল পন্ড হেরন, ইগ্রেটরা। নদী ছেড়ে একটা খাঁড়িতে ঢুকে পড়েছি - তার নাম বনবিবি দোয়ানি। সেখান থেকে খলসিতলা খাল। হঠাৎ নজরে এল তিনটে ভোঁদড় নদীর পাড়ে জঙ্গলের গা ঘেঁষে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরাও এগোচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লঞ্চও। বেশ অনেকটা যাওয়ার পর জঙ্গলে মিলিয়ে গেল একসময়।

বাদামী রঙের উইম্ব্রেল, লেসার হুইসলিং ডাক বা সরাল দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম। এক জায়গায় জঙ্গলের ধারে মন দিয়ে কাদা খুঁড়ছে বুনো শুয়োর। সাদা বকেরা ডানা মেলে জলের ওপর দিয়ে এপাড়-ওপাড় করে। ডালে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে নীল-কমলা স্টর্ক বিলড কিংফিশার। রঙিন এই পাখিটা আর সাদা-কালো পাইড কিংফিসার বেশ কয়েকবারই দেখা গেল। নদীর পাড়ে কাদার মধ্যে আবার একটা রিভার মনিটর চোখে পড়ল। এটা আগেরটার থেকেও বড়, প্রায় ছোটখাটো কুমীরের মতো!

নদীর পাড়ে বড় একটা হাঁসের ঝাঁক, সেই লেসার হুইসলিং ডাক। যেতে যেতে আরেকটা চিতল হরিণ চোখে পড়ল, মাথা তুলে গাছের পাতা খাচ্ছে। আরেকটু এগিয়ে আবারও একটা হরিণ। জল থেকে জেগে থাকা শুকনো গাছের ডালে হলুদে-নীলে কমন কিংফিশার – যদিও ততটা কমন নয়, চিনিয়ে দিয়ে বলল সুবিত।

গতকাল যেখানে বাঘ দেখা গিয়েছিল, সেই জায়গাটায় আরেকবার যাওয়া হল। কিন্তু বৃথা অপেক্ষা। দেখতে দেখতে সন্ধে নেমে এল। ফিরে এলাম বালিদ্বীপে।

ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বেরোলাম লাগোয়া গ্রাম দেখতে। ততক্ষণে শীতের বেলা ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হোম স্টের সামনের রাস্তাটা ধরে যেদিক থেকে এসেছিলাম, তার উল্টোদিকে হাঁটা দিলাম আমরা। রাস্তার দুপাশে ঝুপড়ি ঘর থেকে অল্প অল্প আলো দেখা যাচ্ছে। কারোর গৃহলাগোয়া ছোট্ট জমিতে কিছু গাছপালা রয়েছে।আলোহীন রাস্তায় মানুষজন-গাছপালা কিছুই আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। তবে যেটুকু আন্দাজ পেলাম গ্রামের অবস্থা বেশ খারাপ।

আজ সন্ধ্যায় চায়ের সঙ্গে ভেজ পকোড়া। টিনের শেডদেওয়া বেশ বড়সড় খাওয়ার ঘরেই বসেছিলাম। সেখানে নিত্যানন্দ,তার বউ আর তাদের স্কুলের মেয়ে ছিল। তাদের সঙ্গে এটাওটা বলতে বলতেই দলের বাকিরা এসে গেল। অতএব সুবিতের মুখে আবার বাঘের গল্প –

সেবার পেঞ্চেরই বাফার জোন খুরসাপাড়ে গেছিলাম আমি আর স্বর্ণেন্দু। খুরসাপাড়ের কথা তো আগেই বলেছি। সেদিন ছিল ট্রিপের ছয় নম্বর সাফারি, বিকেলের ফ্লাইটেই নাগপুর থেকে ফেরার কথা। কেবল প্রথম সাফারিতটাতেই বাঘ দেখেছিলাম, সে-ও সেটা প্রায় না দেখার মতোই। বেশ দূরে ঘাসজমিতে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। ছবি তোলা সম্ভবই ছিল না। যাইহোক, শেষ সাফারির সময়ও ফুরিয়ে আসছে, কিন্তু বাঘের দেখা মেলেনি। বেশ হতাশই হয়ে গিয়েছিলাম। ততক্ষণে ঘন জঙ্গল থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছি। তার মধ্যেই স্বর্ণেন্দুর বাথরুম চেপেছিল জোর। তো গাইড বলল পাবলিক টয়লেট অনেকটা দূরে। সেখান অবধি যেতে যেতেই সাফারির সময় শেষ হয়ে যাবে। এক কাজ করা যেতে পারে। কাছাকাছিই একটা পরিত্যক্ত ঘর আছে, ফরেস্টগার্ডদের জন্য বানানো। সেখানে কাজ সেরে আসা যেতে পারে। আমরা তো তাতেই রাজি। কিন্তু সমস্যা হল একে তো জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি থেকে নামা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ আর সেদিন আরেকটা ব্যাপারও হয়েছে। রেঞ্জার তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন। সারাদিন ঘুরে ঘুরেও বাঘ দেখতে না পেয়ে বন্ধুরা তাঁকে খুব আওয়াজ দিয়েছে। তিনিও খেপে ব্যোম। যত রাগ সব ট্যুরিস্টদের গাড়িগুলোর ওপর ঝাড়ছেন। তিনি যদি আমাদের এই কান্ড টের পান তাহলে খুব মুশকিলে পড়ব। যাইহোক, সেখানে যাওয়া তো গেল। আমি গাড়িতে রইলাম, ড্রাইভার, গাইড আর স্বর্ণেন্দু নেমে অদূরের তারজালি দিয়ে ঘেরা ঘরটার পিছনদিকে গেল। চুপচাপ বসে আছি তো আছি। হঠাৎ সামনে তাকাতে দেখি বেশ কয়েক হাত দূরে বাঘ! সে আমায় দেখেনি,ধীরেসুস্থে আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে আসছে মাথা নিচু করে। আমার তো তখন হয়ে গেছে। ভাবছি বাঘটা লাফিয়ে এলে কী করব! গাড়ির পেছনের সিটে একটা লাঠি ছিল, যথাসম্ভব নিঃশব্দে হাতে তুলে নিলাম সেটা। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ! ওদিকে হঠাৎ দেখি, তিনমূর্তি নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি তো চেঁচাতে পারছি না। আওয়াজ না করে, হাত-মুখ নাড়িয়ে,ইশারাতে বলে যাচ্ছি বাঘ বাঘ। ওরা খেয়ালই করছে না, এগিয়ে আসছে গাড়ির দিকে। হঠাৎ কারোর নজর পড়ল গাড়ির দিকে, সঙ্গেসঙ্গে তিনজনই আমার হাত লক্ষ্য করে তাকিয়ে দেখে, বাঘ! সে যে কী অবস্থা, বলে বোঝানোর নয়। বাঘটা আরেকটু এগিয়ে ওপাশে একটা ডোবা ছিল, তাতে নেমে গেল। আর ওরাও সঙ্গেসঙ্গে দৌড়ে গাড়িতে উঠে এল। গাড়িও ছেড়ে দিল। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে তারপর শুরু হল ছবি তোলা। ছবিটবি তোলা হল। বাঘও ধীরেসুস্থে জল থেকে উঠে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। ঠিক তার পরেপরেই সেখানে আরো কয়েকটা গাড়ি চলে এল, রেঞ্জারের গাড়িও। রেঞ্জার সাহেব তো আমাদের ওপর তম্বি করছেন মাটিতে পায়ের দাগ দেখে। কে নেমেছিল? কে নেমেছিল? বেমালুম বললাম,জানিনা কিচ্ছু। রেঞ্জার সাহেবকে বললাম না যে বাঘ দেখেছি। ভয় ছিল সেটা বললে হয়তো আরো হ্যারাস করতে পারে। বললাম, সম্বর ডিয়ারের কল হচ্ছিল, তাই বাঘ দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সেটা শুনে বললেন, 'সম্বর কা কল মতলব টাইগার ডেফিনিটলি ওঁহিপে হ্যায়।' বলে বন্ধুদের নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন আর আমরা মুচকি হেসে, হাম লোগোকো তো জলদি হি নিকলনা হ্যায়, বলে ওখান থেকে চলে এলাম।

পরেরদিন ভোরে বেরোনো হল দোবাঁকি ওয়াচটাওয়ারের উদ্দেশে। প্রথমেই চোখে পড়ল একটা কলারড কিংফিশার, তারপরে ঝোপের ফাঁকে একটা বড়সড় বনমোরগ। গাছের মাথায় চুপ করে বসে আছে বক। জলের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা গাছের ডালে একটা কমন কিংফিশার। উঁচু গাছের ডালে টিয়া। জলের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কমন কিংফিশার। জলে নুয়ে পড়া গাছের ডালে কলারড কিংফিশার। আকাশে ডানা মেলে ঘুরে ঘুরে উড়তে থাকে সোনালি ডানার চিল। কাদায় শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে একটা কুমীর। দেখতে দেখতে দোবাঁকি পৌঁছে গেলাম।

বিদ্যাধরী নদীর পাশে দোবাঁকি - জালে ঘেরা বাঁধানো পথে ওয়াচটাওয়ার। টাওয়ারে ওঠার ঠিক আগেই কাদায় ছোট ছোট লাল আর হলুদ একদাঁড়া কাঁকড়া, আমাদের সাড়া পেয়েই হুড়মুড়িয়ে গর্তে ঢুকে পড়ল। ওয়াচটাওয়ারের দীর্ঘ ক্যানোপির নিচে সরকারি ম্যানগ্রোভ রোপণ প্রকল্পের গাছের চারার সারি। হাঁটতে হাঁটতে মাঝামাঝি পৌঁছে নিচে একটা হরিণও দেখতে পেলাম। টাওয়ারের উঁচু জায়গাটায় উঠলে সামনেই একটা জলাশয়। তাতে আবার একঝাঁক লেসার হুইসলিং ডাক, কখনও বসছে, কখনও আবার উড়ছে। নেমে এলাম অন্যপথে - স্যুভেনিরের দোকান, বনবিবির মন্দির আর দুটি সুন্দরী গাছ। সুন্দরবনের নামকরণ এই সুন্দরী গাছের থেকেই, কিন্তু আজ এখানে তারই সবথেকে আকাল।

দূর থেকে দেখি, লঞ্চটা আসছে। এবার ঘরে ফেরার পালা। ঘাটের সিঁড়ির শেষ ধাপের পাশে সিমেন্টের ছোট স্তম্ভের ওপর বসে রয়েছে একটা স্টর্ক-বিলড কিংফিশার।

লঞ্চে উঠতেই একঝাঁক মৌমাছি কোথা থেকে ঘিরে ধরল। কেউ অবশ্য কামড় খাইনি। চলেও গেল তাড়াতাড়ি, যেমন হঠাৎ এসেছিল। খানিক এগোতেই কাদাজঙ্গলের মধ্যে আরেকটা কুমীর চোখে পড়ল। গাছগাছালির মাঝে হরিণের একটা ছোট দল বসে রয়েছে আরেকটু এগিয়েই।

গাছের ডালে বক, মাটিতে আবার একটা ভোঁদড়। পাড় আর জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে শেষে জলে নেমে গেল ভোঁদড়টা। তারপরে আবার উঠে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। ডালে ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে ছোট্ট পাখি ফটিকজল যার অন্য নাম কমন আইওরা। দেখি গাছের শিখরে বসে মাছরাঙা বড়সড় একটা ট্যাংরা মাছকে ঠোঁটে নিয়ে কব্জা করার কসরত চালিয়ে যাচ্ছে। একটু পরে উড়ে গিয়ে একটা ন্যাড়া ডালের মাথায় বসল আর চেষ্টা করে যেতে লাগল ডালে আছড়ে মাছটাকে কাবু করার। চেষ্টায় কী না হয়! একটু বাদেই আস্ত মাছটা গিলে নিয়ে উড়ে চলে গেল।

তারপর বনবিবির দেশ, নিত্যানন্দ আর মানসদের দেশ, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, কুমীর, হরিণ, পাখি আর মৌমাছিদের দেশ ছেড়ে আমরাও ফিরে এলাম।

'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণপত্রিকার সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সম্পাদনাবিভাগে কাজ করেছেন। বর্তমানে পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি স্বাধীন গবেষণায় রত। প্রকাশিত বই – 'অবলা বসুর ভ্রমণকথা', 'আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত - ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গমহিলাদের ভ্রমণকথা'। ভালোবাসেন বই পড়তে, গান শুনতে, লেখালেখি করতে আর বেড়াতে।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher