বাঘের খোঁজে টাডোবায়
শুভেন্দু রায়
দূর দূর... এ যাত্রাও হল না… বান্ধবগড় থেকে ড্রাইভ করে ফিরতে ফিরতে এটাই ঘুরে ফিরে মনে আসছিল... লোকমুখে শোনা যে কোথাও না দেখতে পেলে বান্ধবগড়-এ বাঘের দেখা মিলবেই...
বহুদিনের ইচ্ছে খোলা জঙ্গলে বনের রাজাকে দেখার। সেই ইচ্ছে নিয়ে বারবার ছুটে গিয়েছি বিভিন্ন টাইগার রিজার্ভে, কিন্তু তাঁর দেখা মেলেনি। নয় নয় করেও সাফারি করেছি বেশ কয়েকটিই রিজার্ভ ফরেস্টে, যেমন মধ্যপ্রদেশের পান্না ন্যাশনাল পার্ক, কানহা টাইগার রিজার্ভ, বান্ধবগড় টাইগার রিজার্ভ, মহারাষ্ট্রের পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভ, নাগজীরা টাইগার রিজার্ভ, সুদূর আসাম এর কাজিরাঙা এবং মানস ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি, এমনকি সুন্দরবনেও দেখা মেলেনি বাঘের। শুধু লোকমুখে শুনে আর ইউটিউবে ভিডিও দেখে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম আমরা সবাই। আমরা মানে আমি, আমার স্ত্রী, ভায়রাভাই সন্তোষদা ও তার স্ত্রী। অনেক ভেবে তাই টাডোবাকে পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে স্থির করা হল।
টাডোবার কথা আমি প্রথম শুনি জনৈক মারাঠি ভদ্রলোকের কাছে। প্রথমবার পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভে সাফারি করতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলাম। সাফারির জন্য যে আগে থেকে বুকিং করতে হয় তা জানা ছিল না, সাফারি বুকিং না করেই পৌঁছে গিয়েছিলাম পেঞ্চ-এর মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের রিসর্টে। ওখানকার ম্যানেজার ভদ্রলোকের কাছে কথায় কথায় জানতে পারলাম যে সাফারি আগে থেকে বুক করে রাখতে হয় নচেৎ জঙ্গলে ঢোকার সুযোগ পাওয়া সাধারণত মুশকিল, কারণ সাফারির সংখ্যা সীমিত এবং প্রায় সবকটাই আগে থেকে ইন্টারনেটে বুক হয়ে যায়। আজকাল অবশ্য এই ব্যবস্থা বেশিরভাগ ন্যাশনাল পার্কেই চালু হয়েছে, যা সবার পক্ষেই ভালো। যাই হোক, এই মারাঠি ভদ্রলোকটি উদয় হলেন আমার ত্রাতা হয়ে, অবশ্যই ম্যানেজার সাহেবের সৌজন্যে। ওঁদের একটি সাফারি বুক করা ছিল। লোক বলতে তিনজন – উনি, ওঁর স্ত্রী এবং মেয়ে। একটি জিপসি সাফারিতে ছয়জন সাফারি করতে পারে, আমরা ছিলাম দুজন, কাজেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু প্রায় ঘন্টাচারেকের সাফারিতে বাঘের দেখা পাওয়া গেল না। তখন ওই ভদ্রলোক জানান যে ওঁরা টাডোবা থেকে আসছেন এবং ওখানে ভালোভাবে বাঘ দেখতে পেয়েছিলেন।
তাই এবার প্ল্যান করলাম যে নেক্সট সুযোগে আর কোথাও না - সোজা টাডোবা।
টাডোবা টাইগার রিজার্ভটির পুরো নাম হল টাডোবা আন্ধারি টাইগার রিজার্ভ বা টি এ.টি.আর.। আমরা ছত্তিসগড়-এর দুর্গের বাসিন্দা। এখান থেকে টাডোবার দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, অনেক পরিকল্পনা করে করে শেষে ঠিক হল পুজোর সময়টায় যাওয়ার। কলকাতা থেকে মাসি মেসো এসে যোগ দেওয়াতে প্রোগাম আরও জমে উঠল।
এক রবিবারের সকালে বেরিয়ে পড়লাম টাডোবার উদ্দেশে। দুর্গ থেকে টাডোবা যেতে হলে কলকাতা - মুম্বাই হাইওয়ে ধরে প্রায় ১৬০ কি.মি. যাওয়ার পর হাইওয়ে ছেড়ে অন্য পথ ধরতে হয়। প্রায় ১০০ কি.মি. যাওয়ার পর চোখে পড়ল হাইওয়ে চৌপাটি নামে একটি সুন্দর ধাবা। দাঁড়িয়ে পড়লাম লাঞ্চের জন্য। ধাবাটি খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বিশেষ করে বাথরুম। এখানে লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে যখন টাডোবার রিসর্টে পৌঁছোলাম বেলা গড়িয়ে এসেছে, প্রায় চারটে বাজে। সেদিন আর বিশেষ কিছু না করে রিসর্টে বিশ্রাম করলাম।
সকালের সাফারি বুক করেছিলাম টাডোবার মোহারলি গেটে। পরেরদিন সকাল পাঁচটায় উঠে তৈরি হয়ে ঠিক ছটার ভেতর ঢুকে পড়ি অভয়ারণ্যে। প্রথম ঘন্টা খানেক মনে হচ্ছিল যে এখানে আসাও বৃথা হল, জানোয়ার খুব একটা চোখেই পড়ছিল না। এমনকী হরিণও না যা সচরাচর অনেক দেখা যায়। ঘন্টাদেড়েক পর বেলা বাড়াতে আস্তে আস্তে দেখা মিলল তৃণভোজীদের। তারপর দেখা পেলাম তার যার জন্য এতো প্রচেষ্টা – একটা মোড় ঘুরতেই সামনে দেখা গেলো বাঘটিকে, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে জীপের রাস্তা ধরে। দু-একবার নিরাসক্তভাবে ফিরে তাকাল পিছনে থাকা গাড়িগুলোর দিকে, আবার এগিয়ে চলল নিজের পথে গজেন্দ্র গমনে। যার প্রতিটি পদক্ষেপ বলতে চাইছে, এটা আমার এলাকা… দেখতে এসেছ… দেখ… তারপর ফিরে যাও।
যাঁরা সাফারিতে বাঘ দেখেছেন জানেন যে প্রথমবার খোলা জঙ্গলে বাঘ দেখা একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বিশেষত যাঁরা ওয়াইল্ডলাইফ ভালোবাসেন। যা কথায় বলে বোঝানো বোধহয় পুরোপুরি সম্ভব নয়। প্রায় মিনিটদশেক পর বাঘটি ধীরেধীরে পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল। মাঝে মাঝে তার গর্জন শোনা যাচ্ছিল। গাইড জানাল দুটি বাঘকে কিছুদিন ধরে একসঙ্গে ওই অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে এবং সম্ভবত এরা দুই ভাই এবং এখনও নিজের এলাকা ভাগ করে নেয়নি। অন্যটি বোধহয় আশেপাশে কোথাও আছে। যেটিকে দেখলাম এটিও আকারে বেশ বড় এবং পূর্ণবয়স্ক বলে মনে হল। এরপর আরও ঘন্টা খানেক জঙ্গলে ঘুরে ফিরে এলাম রিসর্টে। অন্যান্য জানোয়ার অনেক দেখা গেলেও বাঘ আর দেখা গেল না।
টাডোবার জঙ্গলের মাঝে বয়ে গিয়েছে দুটি নদী, আন্ধারি নদী পূর্ব দিকে এবং এরাই নদী জঙ্গলের পশ্চিম ভাগ ধরে। এই আন্ধারি নদী নিয়েই টাডোবা আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প।
টাডোবাতে চোখে পড়েছিল স্পটেড ডিয়ার বা চিতল, সম্বর, বার্কিং ডিয়ার, চৌশিঙ্গা ও নীলগাই। মাঝে মাঝে ইতস্তত ঘাস খেতে থাকা গাউর-এর দল। গাউরকে অনেকেই বাইসন বলে ভুল করেন, দুটি আলাদা প্রজাতি। ভাগ্য ভালো থাকলে চোখে পড়তে পারে ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড ডগ বা 'ঢোল' এর দল। ভালুক বা লেপার্ড সচরাচর চোখে পড়ে না। দেখা পেলাম বেশ কিছু চেনা-অচেনা পাখির। জঙ্গলে রয়েছে অর্জুন, মহুয়া, তেন্দু ও বাঁশ গাছ। সাফারির সময় ক্যামেরা নেওয়া বারণ এবং মোবাইল ফোনেও ছবি তুলতে দেওয়া হয় না। জঙ্গলে ঢোকার সময় দূরবীন নেওয়া একটি ভালো বিকল্প বিশেষত পাখি দেখার জন্য।
আর একদিন থাকার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পরেরদিন সপ্তমী তাই আর থাকা গেল না। হোটেলে ফিরে স্নান খাওয়াদাওয়া সেরে রওনা দিলাম বাড়ির পথে।
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে কৃষিবিজ্ঞানে ডক্টরেট শুভেন্দু রায় বর্তমানে দুর্গ-ছত্তিশগড়ে একটি বেসরকারি এগ্রিকালচার কলেজের অধ্যক্ষ। বন্যপ্রাণী এবং জঙ্গল তাঁর নেশা। ছাত্রজীবনে ও কর্মজীবনে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং এখনও বেড়ান। সময় পেলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে অল্পবিস্তর লেখালেখি করেন। shubhendu_roy@yahoo.co.in এই ই-মেইল-এ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।