ভিয়েতনাম-কাম্বোডিয়া – সাতান্ন বছর পরে আবার

তপন পাল


প্রস্তাবনা

অবসরের পর হঠাৎ একটু বিদেশভ্রমণের সখ হল। বিদেশভ্রমণ মানে একদম সত্যিকারের বিদেশভ্রমণ, বেশ এক্সোটিক ব্যাপারস্যাপার হবে, হাপ পেন্টুল আর রঙচঙে জামা পরে ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াব – এমনটি আর কী! বাংলাদেশ নেপাল ভুটান বিদেশ বলে মনে হয় না, আর আমার তো আজকাল ব্যাংকক সিঙ্গাপুর কি দুবাইকেও বিদেশ বলে মনে হয় না। চিত্রতারকা ধর্মেন্দ্র একবার বলেছিলেন তিনি লন্ডন খুব ভালোবাসেন কারণ লন্ডন একদম লুধিয়ানার মত। লুধিয়ানা মনে না হলেও, ব্যাংকককে প্রায়শই আমার রামপুরহাট বা জলপাইগুড়ি বলে ভুল হয়। আর ইতিহাস আমাকে যে দেশগুলিতে টানে, মায়ানমার বা সমরকন্দ বুখারার উজবেকিস্তান; সেখানে যাওয়ার বড় হ্যাপা। বেড়াতে গিয়ে কষ্ট করা আমার বিলকুল না-পসন্দ। বেড়াতে গিয়ে যদি একটু টানটান হয়ে ঘুমানো না গেল, দুটি দীর্ঘায়িত হাই না তোলা গেল, তবে এত পয়সা খরচ করে বেড়াতে যাওয়া কেন!

যখন সরকারি চাকরি করতাম, দীর্ঘকাল থাকার সুবাদে কোনও কোনও জেলার সঙ্গে নিবিড় সখ্য হত। তারপর বদলির চিঠি পেলেই বেরিয়ে পড়তাম সেই জেলার আমার প্রিয় জায়গাগুলো আর একবার, শেষবারের মত, দেখে নিতে; কারণ জানি তো মুখে যতই বলি, 'বারে বারে আর আসা হবে না' – এলেও আসা হবে জেলাশহর অবধি, জেলার নিভৃতে পৌঁছানো হবে না। মুর্শিদাবাদ ছেড়েছি ১৯৯২-তে – তারপর একবারও কি গিয়ে উঠতে পেরেছি আমার প্রিয় দোহালিয়া কালীবাড়িতে, বা ভট্টবাটিতে, বা আমাইপাড়ায়! বয়স বাড়লে মৃত্যুচিন্তা লোকসঙ্গীতের ধুয়ার মত ফিরে ফিরে আসে। মৃত্যুর আগে হাতিরা নাকি দল ছেড়ে চলে যায় গভীর অরণ্যে, প্রতীক্ষায়। আমারও তেমনি সখ হল ছোটবেলার চেনা জায়গাগুলিকে আর একবার দেখে নিতে।

আমার শৈশব কেটেছে শ্যামনগরে ও বাটানগরে; তবে তার মধ্যে কিছুকাল (১৯৬২ – ১৯৬৪) ভিয়েতনামে। আমার বাউন্ডুলে বাবা চাকরি করতেন এ.জি.বেঙ্গলে। সেখান থেকে ডেপুটেশন নিয়ে ১৯৬১-তে তিনি চাকরি করতে যান ইন্টারন্যাশনাল কন্ট্রোল কমিশন-এ। কমিশনের সদরদপ্তর ছিল তদানীন্তন দক্ষিণ ভিয়েতনামের সায়গনে, কর্মকাণ্ড বিস্তৃত ছিল লাওস, কম্বোডিয়া ও তখনকার উত্তর ভিয়েতনামেও। সদ্যযুবক বাবা যাওয়ার সময় আমার কিশোরী মাকে বলেছিলেন এক বছর পরে আসবেন; কিন্তু কোথায় কী! অগত্যা আমার স্বল্পশিক্ষিতা মা তিন বছরের আমাকে নিয়ে দমদম থেকে একদিন চেপে বসলেন প্যান এমের বোয়িং ৭০৭-এ; ব্যাংককে একবার থেমেই তিনি আমাদের নামিয়ে দেবেন সায়গনে। এই অবধি পড়ে যারা ভাবছেন যে ষাটের দশকে দমদম বিমানবন্দরের সোনার দিন ছিল, আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থাগুলির উড়োজাহাজ হরদম নামত উঠত, তাদের অবগতির জন্য বলি, সরু ও মাঝারি আকারের দূরপাল্লার চার ইঞ্জিনের বোয়িং ৭০৭ (উচ্চারণ সেভেন ওহ সেভেন)-এর ব্যাপ্তিসীমা ছিল মোটে ৫৭৫০ নটিক্যাল মাইল। প্রতিতুলনায় আজকের বোয়িং ৭৭৭-২০০ এলআর-এর ব্যাপ্তিসীমা ৯৩৯৫ নটিক্যাল মাইল,এয়ারবাস এ-৩৮০ এর ব্যাপ্তিসীমা ৮৪৭৭ নটিক্যাল মাইল। সেই সময় তাই ইউরোপ থেকে ইন্দোচিন বা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার বা ফেরার পথে সব উড়োজাহাজকেই দমদমে নামতে হত। যাত্রাপথে এদের এখন আর দমদমে তেল ভরতে নামার দরকার পড়ে না; দমদমে তাই ভিড় কমেছে।

তা সায়গনে পৌঁছানো গেল, বাবাকে বেশি খুঁজতে হল না, তিনি তাঁর কূটনৈতিক পরিচয়পত্রের সুবাদে উড়োজাহাজের সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, আমাদের দেখেই তরতর করে উঠে এলেন। বস্তুত সেই প্রথম জ্ঞানত বাবার সঙ্গে আমার পরিচয় হল। সেবারে একবছর সায়গনে ছিলাম, ঘোরা হয়েছিল লাওস আর কম্বোডিয়া; দেখা হয়েছিল আংকরভাট। সময় ওপর দিয়ে বয়ে যায় দ্রুত,নিচে ফেলে রেখে তার মলিন ছায়া। এতগুলো বছর পেরিয়ে আংকরভাট দেখার ইচ্ছেটা চেগে উঠল।

পুত্র শুনেই বললেন, কোন চিন্তা নেই। আংকরের কাছের বিমানবন্দর – সিয়েম রিপ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (Siem Reap International Airport – IATA: REP, ICAO: VDSR)। কলকাতা থেকে সরাসরি উড়ান নেই, মধ্যিখানে একবার শুধু নামতে হবে, তা তুমি কোথায় নামবে বলো – কুয়ালালামপুর না ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর না হংকং। আংকর সেখান থেকে ছয় কিলোমিটার, কিসে যাবে বল, গাড়িতে না হেলিকপ্টারে? আমি অতটা দুঃসাহসী হতে সাহস পেলাম না। বাবা ফরাসি, ভিয়েতনামি (tiếng Việt) ও কিমায়র (Khmer) জানতেন, মা ফরাসি জানেন; কিন্তু আমি ইংরিজিটাও ভালোভাবে বলতে পারি না। এই ভাষাজ্ঞান নিয়ে বিদেশবিভূঁইয়ে একলা যেতে সাহস পেলাম না; সঙ্গে দুটো দেশের ভিসা, মুদ্রা বিনিময়ের ঝঞ্ঝাট, তাই ভ্রমণসংস্থার সঙ্গে যাওয়া ঠিক হল। পুত্রবধূ বললেন, কোনও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যাও – বাঙালি ম্যানেজার বাঙালি খাওয়ার লোভে হুট করে যেও না - তাতে অন্তত যে হোটেলে উঠবে সেখানে ফায়ার অ্যালার্ম থাকবে, রাতবিরেতে শরীর খারাপ করলে ডাক্তার জুটবে, বাসি ডাল খেয়ে পেট ছাড়বে না। খুল্লতাত মহোদয় বলিলেন, ট্রাভেল এজেন্টদের তিনটি সংগঠন আছে, বুক করার আগে জেনে নিস যে ভ্রমণসংস্থাটি ওই তিনটির কোনও একটির সদস্য কি না।

ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে একটি পর্যটন মেলা হচ্ছিল; সেখানে গেলাম। উপরোক্ত প্রশ্নগুলি করাতে অনেক স্টলের দাদাদিদিরাই অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনেক খুঁজে পেতে একটি ভ্রমণসংস্থায় বুক করলাম। দশ দিন, ভ্রমণনির্ঘণ্টে কলকাতা থেকে হ্যানয়, সেখানে তিনদিন কাটিয়ে আংকর, তিনদিন পর এখনকার হো চি মিন সিটি অর্থাৎ সাবেকি সায়গন; আমার শৈশবের বৃন্দাবন। সেখানে তিন দিন কাটিয়ে বাড়ি।

যাত্রাপথের আনন্দগান

কলকাতা-হ্যানয় সরাসরি উড়ান চালু করেছে ইন্ডিগো। বিরতিহীন দুঘণ্টার সেই উড়ানে গেলে অনেকখানি সময় বাঁচত। কিন্তু ভ্রমণসংস্থার যাত্রীদলটি সর্বভারতীয়, কিয়দংশে বহুজাতিক। তাই আমাদের যাত্রাপথটি ঢেঁশকেল দিয়ে কটক গোত্রের। কলকাতা থেকে বিকাল সাড়ে ছটায় ইন্ডিগো ৬ই ৫৩৪ ধরে চেন্নাই। যাত্রীদলের ভারতীয় সদস্যদের নিয়ে সেখান থেকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এমএইচ-১৮১ রাত বারোটা কুড়িতে; কুয়ালালামপুর স্থানীয় সময় সকাল ছটা পঞ্চাশে। সেখান থেকে আরও কিছু সদস্যকে নিয়ে সকাল নটা চল্লিশের এমএইচ-৭৫২; হ্যানয় পৌঁছনো স্থানীয় সময় বেলা বারোটায়। আশা ছিল আন্তর্জাতিক উড়ানে একটু ভালো উড়োজাহাজে চড়বো; বোয়িং ৭৭৭ বা ৭৮৭ বা এয়ারবাস ৩৩০; একটু ভালো এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যাবো থাই বা সিঙ্গাপুর বা ক্যাথে; কিন্তু কোথায় কি! কলকাতা-চেন্নাই সেই অনিবার্য এয়ারবাস ৩২০; শ্রীমতী পালের ভাষায় সাতাত্তর রুটের বাস। আর চেন্নাই-কুয়ালালামপুর আটপৌরে বোয়িং ৭৩৭ – লোকে যাতে চড়ে রাঁচি যায়। সূচিটি পেয়েই ভ্রমণসংস্থাটিকে বললাম আপনাদের সঙ্গে আমার এই শেষ যাওয়া। সামনের বছর ইসরায়েল জর্ডানের জন্য একটা ভ্রমণসংস্থা দেখছি এখন থেকেই খুঁজতে হবে। তারা তারস্বরে দুঃখপ্রকাশ করে বলতে লাগলেন বড়দিন নববর্ষের মরশুমে কোনো উড়ানেই নাকি টিকিট নেই। বিশ্বাস করলাম না।

ডিসেম্বরের তিরিশ তারিখে অপরাহ্ণে অতএব দুর্গা দুর্গা দমদম। আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী লোক, যখন কেউ বলে ঈশ্বর নেই, আমার ভারি রাগ হয়। ঈশ্বর বলে কেউ না থাকলে বিগত ষাট বছর ধরে প্রতি পদে আমার জীবন দুর্বিষহ করছেন কে! এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না – আমাদের উড়োজাহাজ VT-IHN চেন্নাই নামলেন আটটা চল্লিশের পরিবর্তে এগারোটা পঞ্চাশে। কলকাতায় পারদ সেদিন তেরোয়,গায়ে বিস্তর শীতবস্ত্র – চেন্নাইয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আন্তর্দেশীয় বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিকে দুটো ব্যাগ টানতে টানতে আমি ঘর্মস্নাত। গিয়ে শোনা গেল মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই, এম.এইচ.-১৮১ এই উড়ল বলে।

ভ্রমণ সংস্থাটিকে ফোন করলাম। তারা বললেন ভাববেন না। কোনো হোটেলে উঠে আরাম করুন, পয়সা আমরা দিয়ে দেব। দুপুর এগারটা পঁয়তাল্লিশের মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এম.এইচ.-১৮৩ তে বুক করে দিচ্ছি, চারটেয় কুয়ালালামপুর। তারপর যা হোক একটা ব্যবস্থা তো হবে, আপনার হ্যানয় যাওয়া কে আটকায়! রাজি হলাম না। পয়লা জানুয়ারি সকাল আটটা থেকেই নির্ঘণ্ট অনুযায়ী ভ্রমণ শুরু; আমি তার এক পলও হারাতে রাজি নই। বললাম আমার ফুল সার্ভিস উড়ানসংস্থার দরকার নেই, আপনি আমাকে ইন্ডিগো কেটে দিন। তা তারা দিলেন। তদনুযায়ী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরোতে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীর মুখোমুখি। য়্যহ নির্গমন লাউঞ্জ হ্যায়, নিকলনা আলাওড নেহি। তাকে কে বোঝায় যে আমাদের উড়োজাহাজ ছেড়ে গেছে! বৃথা চেষ্টা। খুঁজেপেতে এক হোমরাকে ধরলাম, বললাম, টিকিট দেখালাম। তিনি বললেন যে বিমানসংস্থার টিকিট তাদের লোককে নিরাপত্তা বাহিনীর খাতায় লিখে দিতে হবে। কিন্তু চেন্নাইতে তো মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিসই নেই। তিনি খোঁজ নিলেন চেন্নাইতে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের হ্যান্ডলিং এজেন্ট কে, তাদের লোককে তিনিই ডাকলেন,তারা মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হলেন যে আমাদের টিকিটের বোর্ডিং পাস ই্স্যু হয়নি; তারপর খাতায় টিকিট নম্বর থেকে পাসপোর্ট নম্বর সব লিখেটিখে আমরা বাইরে এলাম।

তখনো বৃষ্টি অব্যাহত। রাতটা চেন্নাই বিমানবন্দরে কাটিয়ে সকাল সাড়ে পাঁচটার উড়ানে ফের কলকাতা; ৬ই-৯৮৭, VT-IDT। শুয়ে বসে সময় কাটিয়ে দুপুর দেড়টায় ইন্ডিগো উড়ানে হ্যানয়। দুঘণ্টার উড়ান; ৬ই-১৩৯৬ VT-IHK। সহযাত্রীদের মধ্যে ছুটি কাটাতে যাওয়া ভারতীয়বাবুদের দেখব প্রত্যাশা ছিল কিন্তু উড়োজাহাজটিতে উঠে দেখা গেল বস্তুত ভারতীয়ই খুব কম। যাত্রীদের মধ্যে বিদেশি বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদেরই প্রাধান্য। তারা অনেকেই অনেক অনেক দূর থেকে অমিতাভ তথাগতের দেশ দেখতে এসেছিলেন। ভারতে বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা আসেন জানতাম, বস্তুত গয়া-বারাণসী, গয়া-ব্যাংকক, গয়া-পারো, গয়া-ইয়াঙ্গন, কলকাতা-ইয়াঙ্গন, গয়া-কলম্বো, বারাণসী-ব্যাংকক, বারাণসী-কলম্বো, বারাণসী-কাঠমান্ডু প্রভৃতি উড়ানগুলি এঁদের জন্যেই টিঁকে আছে। জানালার পাশের আসনে শ্রীমতী পাল, মাঝের আসনে আমি,আমার পাশের আসনে এক কোরিয়ান যুবক। এত স্বল্পবয়সে তিনি তীর্থভ্রমণে বেরিয়েছেন দেখে আমি তো অবাক। তিনি আমাকে কলকাতার মহাবোধি সোসাইটির গল্প শোনাতে লাগলেন,বললেন তোমার তো ভারি মজা, ইচ্ছে হলেই সেখানে যেতে পারো। শুনে আমার 'হে ধরণী দ্বিধা হও, আমি তন্মধ্যে প্রবেশ করি' অবস্থা। কলুটোলা স্ট্রিটের নাম বদলে অনাগরিক ধম্মপালা স্ট্রিট হয়েছে জানি,১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনিই সংগঠনটির মূল কার্যালয় কলম্বো থেকে স্থানান্তরিত করে কলকাতায় এনেছিলেন তাও জানি। বুদ্ধগয়ায় বৌদ্ধদের হৃতঅধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার্থে তার উদ্যমের কথাও শুনেছি। কিন্তু লজ্জার কথা যে খুব ছোটবেলায় আমার নাস্তিক বাবার হাত ধরে একবার যাওয়া ব্যতিরেকে ন্যূণাধিক বারো বছর কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে কাটানো সত্ত্বেও একদিনের তরেও সেখানে যাওয়া হয়ে ওঠে নি।

আমাদের জমিয়ে গ্যাঁজাতে দেখে আসনশ্রেণির মধ্যবর্তী পথের (aisle) ওপার থেকে কোরিয়ান যুবকটির সহতীর্থযাত্রী ভিয়েতনামি প্রৌঢ়টি উসখুস করছিলেন; বোঝা যাচ্ছিল গ্যাঁজানোয় যোগ দিতে না পেরে তার পেট ফুলছে। সহৃদয়া বিমানসখিকে বলে ব্যবস্থা হল, শ্রীমতী পাল তাঁর আসনে গিয়ে বসলেন, তিনি এপারে এলেন। আমার শৈশবের কিছুকাল ভিয়েতনামে কেটেছে শুনে তিনি তো অবাক। তখনকার গল্প শুনতে চাইলেন। সে কি ছাই মনে আছে, তবু বললাম বিকেলবেলায় মার সঙ্গে ত্রাং বোনেদের মূর্তি চত্বরে বেড়াতে যেতাম। মা খুচখাচ কেনাকাটা করতেন; ততদিনে মা কাজ চালানো ফরাসি শিখে ফেলেছেন। শুনে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন; তুমি ত্রাং বোনেদের কথা জানো!

তখনকার সায়গন শহরে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকা খুব উঁচু ত্রাং বোনেদের মূর্তি ছিল। ত্রাং বোনেরা ছিলেন ভিয়েতনামের জাতীয় বীর। দুহাজার বছর আগে চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনযুদ্ধে তাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভিয়েতনামের জাতীয়তাবাদের প্রতীক এমন সুন্দর ভাস্কর্যটিকে ১৯৬৩-র নভেম্বরের অভ্যুত্থানে (তখন আমরা ভিয়েতনামে) ভেঙে দেওয়া হয়। কারণটি ছিল হাস্যকর; মূর্তিটিতে দুই বোনের মুখের সঙ্গে নাকি ভিয়েতনামের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গো দিন দিয়েমের ভ্রাতৃবধূ মাদাম গো দিন হু-র মুখের মিল ছিল। রাষ্ট্রপতি গো দিন দিয়েম ছিলেন অকৃতদার, তাঁর ভ্রাতৃবধূ মাদাম গো দিন হু ছিলেন ফার্স্ট লেডি। শুধু এই অপরাধে খ্রিস্টের সমসাময়িক এই দুই বোনকে মুখ থুবড়ে পড়তে হল। ওই বয়সেও খুব খারাপ লেগেছিল। আমার মা তো দস্তুরমত মর্মাহত হয়েছিলেন।

হ্যানয়ে নেমে ভিয়েতনামি প্রৌঢ়টি বললেন, কিছু মনে কর না, আমি একটু বেশি বকি, যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি তো! এবারে আমার জড়িয়ে ধরার পালা। ভাইরে, কী শোনালি! আমার দিদিমার সংসারে দুবেলায় ষাটটা পাত পড়ত মনুষ্যের, তার বাইরে গরু, ছাগল, খরগোশ, হাঁস, মুরগি, টিয়াপাখি, পায়রা...। সে কথা বলতেই তিনি বললেন তাই নাকি? জানো তো আমিও দিদিমার বাড়িতে মানুষ। আমার বাবা জোতদার - প্রায় জমিদার বাড়ির ছেলে, কিন্তু বাড়ির অমতে আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন বলে আমার ঠাকুরদাদা বাবাকে বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিয়েছিলেন। তা দাদা এসোনা আমার বাড়িতে একদিন, দুভাইয়ে একসঙ্গে বসে চাট্টি ভাত খাব!

অভিবাসনে সামরিক উর্দি - জলপাই রঙের পেন্তুল ও স্তালিনিয় কোট, সাদা জামা টাই পরা লোকজন। কলকাতা থেকে ফর্ম লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম, কয়েকটি কলাম খালি ছিল, জিজ্ঞাসা করে লিখব বলে; স্বাক্ষরও করিনি – তা সে সব ফাঁকাই রইল; ব্যাগপত্তরও কেউ খুলে দেখল না। সবটাই বেশ 'আরে বাপ্পা এসেছিস! বাঃ বাঃ! দে পঞ্চাশ ডলার দে, এই নে ভিসা, যা আনন্দ কর' গোছের ব্যাপার। এবার মুদ্রা বদল। এক ডলারের বিনিময়ে সেদিন ভিয়েতনামি ডং পাওয়া যাচ্ছিলো ২৩০৯৫। দুশো ডলার দিয়ে ৪৬,১৯,০০০ ভিয়েতনামি ডং নিয়ে বিজয়গর্বে বাইরে। সদাশয় হোটেল কর্তৃপক্ষ (KURATAKE INN THO NHUOM 84) গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। গাড়িতে অনেকখানি রাস্তা; এবং রাস্তা সেতু দেখে আমি চমৎকৃত। একটা জাত মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছরে (১৯৭৫ – ২০২০) এতখানি এগোল! সাতান্ন বছর আগে, যখন আমরা এখানে থাকতাম, দক্ষিণ ভিয়েতনাম (Việt Nam Cộng hòa) ও উত্তর ভিয়েতনাম (Việt Nam Dân chủ Cộng hòa) ছিল দুটো আলাদা রাষ্ট্র। দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেই হলুদের উপরে আনুভূমিক তিনটি লাল সরলরেখার পতাকাও আজ ইতিহাস। দক্ষিণের রাজধানী ছিল সায়গন, আমরা সেখানেই থাকতাম। উত্তর ভিয়েতনাম ছিল হো চি মিনের দখলদারিতে, রাজধানী হ্যানয়। আমি ও মা কাম্বোদিয়া আর লাওস যেতে পারলেও উত্তর ভিয়েতনাম যেতে পারিনি, কারন তদানীন্তন সমাজতান্ত্রিক সন্দেহপরায়ণ বাতিকগ্রস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা ভিসা দেয়নি। তবে বাবার মুখে শুনেছি উত্তর ভিয়েতনাম বড়ই গরিব, কিন্তু আদর্শবোধে উদ্দাম (হো চি মিনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বাবা বার খেয়ে বামপন্থী হয়েছিলেন; সত্তরের দশকে তাঁর সেই অবিমৃষ্যকারিতার দায় আমি সয়েছি); আর হ্যানয় তো প্রায় গ্রাম। দুই দেশ এক হয় পঁচাত্তরে; যারা ভাবেন দেশভাগ হলেই মানুষের দুঃখকষ্ট; তাদের সবিনয়ে জানাই ঠিক উল্টোটাও সমান সত্য। বাবার ভিয়েতনামি বান্ধবী Nguyêt (আক্ষরিক অর্থে চাঁদ, আমি বলতাম চাঁদুপিসি) বোট পিপল (Thuyền nhân Việt Nam) হয়ে ভেসে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন। চৌষট্টিতে বাবা ভারতে ফেরার পর চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল; ২০০২-এ বাবার উর্দ্ধগমনের খবরও তাঁকে দিয়েছিলাম। বর্ধমানের মহারাজার মত অভিমানে মানুষটি আর মাতৃভূমিতে পা রাখেন নি। আমিও আমার এবারের ভিয়েতনাম ভ্রমণের কথা তাঁকে জানাইনি। 'পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চ'লে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে'!

অবশেষে হোটেল – সারা পথের ক্লান্তি আমার সারাদিনের তৃষা পেরিয়ে বাড়ি ছাড়ার সাতাশ ঘণ্টা পরে। হোটেলটি পছন্দ হল,ঘরে ঢুকেই চিতপটাং। দলের অপর আঠারো জন সদস্য ইতোপূর্বেই হ্যানয় পৌঁছে গেছেন, ট্যুর ম্যানেজার তাদের নিয়ে বেরিয়েছেন ভারতীয় রেস্তোরাঁয় খেতে; ফেরার পথে আমাদের দুজনের খাবার নিয়ে আসবেন।

গুড মর্নিং ভিয়েতনাম

তৃতীয় দিন পয়লা জানুয়ারি সকালে বেরিয়ে শহর ঘোরা। প্রথম গন্তব্য হ্যানয় শহরের কেন্দ্রে হোয়ান কিয়েম (Hoàn Kiếm –Lake of the Returned Sword) হ্রদের জেড আইলেট (Jade Islet)-এ ডেন গক সন (Đền Ngọc Sơn – Temple of the Jade Mountain) বৌদ্ধ মন্দিরে। জাতীয় বীর ট্রান হুং দাও (Trần Hưng Đạo) (১২২৮ – ১৩০০)-র নামে উৎসর্গীকৃত কনফুসিয়ান ও তাও বৌদ্ধদের মন্দিরটি বহুপুরাতন, ১৮৬৫-তে সংস্কৃত ও বিস্তৃত। বারো হেক্টরের সবুজ জলের হ্রদটি ভারি সুন্দর আর শান্ত। তরুবীথিময় পারিপার্শ্বিক, কুয়াশা বিছিয়ে আছে জল ছুঁয়ে, মৎস্যশিকারীরা ছিপ নিয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন, বাঁকে ফলমূল নিয়ে ভিয়েতনামি মহিলারা ফিরি করছেন, বেশ একটা নির্লিপ্তির ছোঁয়া চারিপাশে। রাস্তা থেকে কাউ থে হাক (Cầu Thê Húc – Welcoming Morning Sunlight Bridge) পেরিয়ে দ্বীপে, সেখানে মন্দিরের চারটি অংশ; থাপ বাট (Tháp Bút – Pen Tower), দাই জিয়েন (Dai Nghien – Ink-slab), দাক গুয়েত (Dac Nguyet – Moon Contemplation Pavilion) এবং দিন ট্রান বা (Đình Trấn Ba – Pavilion Against Waves)। এই মন্দির তাও বৌদ্ধদের, ফলে বুদ্ধ এখানে মোটাসোটা চৈনিক। নৈবেদ্যর উপচারে আম শশা জামরুল আনারস বাতাবি লেবু কমলালেবু ড্রাগন ফ্রুট প্যাশন ফ্রুট; পাশাপাশি পাউরুটি, ন্যুডলসের প্যাকেট, চা, কফি,এমনকি সিগারেট ও লাইটার। সত্যনারায়ণকে পান সুপারি দিতে পারলে অমিতাভ বুদ্ধকে সিগারেট লাইটার দিতে অসুবিধা কি; দুটোই তো নেশার জিনিস! একটু দূরে ভোগ বিলি হচ্ছে - ঠাণ্ডা স্তিকি রাইস, প্রায় আমাদের পান্তাভাত; সঙ্গে আমাদের পিঁয়াজির মত শুয়োরের মাংসের বড়া। ভোগ সর্বদাই অপ্রত্যাখ্যানীয়; আর এ আমিষভোগ অমৃততুল্য; তবে আলুনি। আমরা বেড়াতে বেরোলে শ্রীমতী পালের হ্যান্ডব্যাগে সর্বদাই ঘি,লবণ আর আমসি থাকে। তাই দিয়ে চেটেপুটে খেলাম। ইচ্ছে করছিল আমার ধর্মপ্রাণ, ফেসবুকে ঠাকুর দেবতার ছবি শেয়ার করা বন্ধুদের ডেকে ডেকে ভোগ খাওয়াই। বুদ্ধ তো বিষ্ণুর দশ অবতারের একজন; দশাবতার স্তোত্রে পড়েননি 'নিন্দসি যঞ্জবিধেরহং শ্রুতিজাতং সদয়হৃদয় দর্শিতপশুঘাতম্! কেশব ধৃতবুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে'! তার ভোগ প্রত্যাখান করলেই সোজা নরকে; আমি আটকাতে পারব না। একটা কথা প্রায়ই মনে হয়। সেটা হচ্ছে ধর্মহীনরাই সম্ভবত ধর্মস্থানগুলির মাহাত্ম্য ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, কারন তাঁদের দৃষ্টি স্বচ্ছ; চেতনা উন্মুক্ত। আমি বুদ্ধের দেশ থেকে গেছি শুনে উদ্যোক্তারা প্রসাদের এক প্যাকেট সিগারেটও দিয়ে দিলেন।

লাল নদীর উপর লং বিয়েন ব্রিজ (Long Biên Bridge) (উদ্বোধন ১৯০৩) শহরের দুই ব্যস্ত অঞ্চল হোয়ান কিয়েম (Hoan Kiem) আর লং বিয়েন (Long Bien)-কে জুড়েছে। মূলত ভিয়েতনামের উত্তরাংশে ফরাসি কর্তৃত্ব কায়েম করার উদ্দেশ্যেই এই সেতু নির্মিত হয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন বিমানবাহিনীর এফ ১০৫ যুদ্ধবিমান নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে এক বছরের জন্যে সেতুকে অচল করে দিয়েছিল। সেই থেকে এই সেতু শহর হ্যানয়ের আত্মমর্যাদার, আত্মসম্মানের প্রতীক, কবিতায় গানে তাকে নিয়ে আবেগের ছড়াছড়ি।

হ্যানয়ে গিয়ে সাইক্লো ট্যুর না করাটা প্রায় বারাণসী গিয়ে রাবড়ি না খাওয়ার মত অপরাধ। তিন চাকার এক-আরোহী রিকশা অতি খোলামেলা, চালক থাকেন পিছনে, তাই দৃষ্টি ব্যাহত হয় না মোটেও। দুঘণ্টা ধরে ধীরলয়ে মন্দাক্রান্তা ছন্দে শহরের পুরনো ফরাসি পাড়া ঘুরে দেখতে পরিবেশবন্ধু এই বাহনটির জুড়ি নেই; চালকরাও পেশাদার, ভ্রমণকালে তারাই গাইডের কাজ করেন। হাজার বছরের হ্যানয় শহরের মেজাজটিকে ধরতে ও বুঝতে সাইক্লো ট্যুর অপরিহার্য। হোয়ান কিয়েম (Hoan Kiem –Old Quarter) অঞ্চল দিয়ে চলার সময়ে রাস্তার ভিড়, রাস্তার খাদ্য মেলা; আর বা দিন (Ba Dinh –French Quarter) অঞ্চল দিয়ে চলার সময়ে ফরাসি প্রাসাদরাজি দেখা তো হবেই, নাকে আসবে ফুলের ঘ্রাণ, রান্নার গন্ধ, কানে আসবে শহরের নিজস্ব কোলাহল। বিগত পঁয়তাল্লিশ বছরে ভিয়েতনাম আধুনিক হয়েছে, তবে রিকশার ঐতিহ্যটিকেও বহাল রেখেছে।

ভিড়ঠাসা গলি দিয়ে আমাদের সাইক্লো যাচ্ছে, আর বাজার-মাসিরা ডাকছে, বাজারে আমাদের সব সবজি ফল-ফুলই উপলব্ধ; আপসোস হতে লাগল বাজারের থলেটা কেন আনলাম না। এরা খাটিয়ে জাত, সকালে কড়াইশুঁটি দিয়ে ফুলকপির তরকারি লুচি নির্মাণে শক্তিক্ষয় করে না; সবাই বাইরে খায়। তাই ফুটপাথের উপরে সারি সারি খাবারের আখড়া, সেখানে জলচৌকি, নিচু টুল বা পাবিহীন চেয়ারের ছড়াছড়ি। গরম গরম স্তিকি রাইস নুডল সুপের পাশাপাশি আস্ত আস্ত কুকুর শুয়োর ঝলসে রাখা। দলে দলে লোক ফুটপাথে বসে গরম গরম স্তিকি রাইস আর নুডল সুপ খাচ্ছে। আছে পুকুরের গেঁড়ি গুগলি, নুন ছড়িয়ে খাও। ওরা বলল ক্রিকেট – আমার দেখে মনে হল বিশুদ্ধ উচ্চিংড়ে – একটু ভাপিয়ে নিয়ে মধুতে ডুবিয়ে এরা যে কী পরিতৃপ্তির সঙ্গে খায় বলার নয়। অনেক দোকানে সন্দেহভঞ্জনের জন্য শুয়রের মাথাটি, বা আস্ত বড় মেঠে ইঁদুর (Bandicota indica) কিংবা আস্ত ছোট মেঠে ইঁদুর (Bandicota bengalensis) বা ধানজমির ইঁদুর (Rattus argentiventer) সগৌরবে ঝোলানো। আমাদের গাইড বলেছিলেন ইঁদুর খেলে যেন জ্যান্ত ইঁদুর দেখে ভাজতে বলি, কারন গ্রামাঞ্চলে মৃদু বিষ দিয়ে ইঁদুর ধরা হয়। তদনুযায়ী খাঁচা থেকে ইঁদুর বার করা হল, কাঠের গুঁড়ির উপর চপার দিয়ে তার চারটি পা, লেজ ও ঠোঁটটি বাদ দিয়ে চালের গুড়ো মাখিয়ে তাকে যখন কড়ায় ছাড়া হল, তখনও তিনি লাফাচ্ছেন। কিন্তু যেভাবে তার লোম থেকে দাঁত, অন্ত্র থেকে কান, কিচ্ছুটি বাদ না দিয়ে ভাজা হল, দেখে গা গুলিয়ে উঠল। য পলায়তি স জীবতি – মূল্য ধরে দিয়ে আমি সেখান থেকে হাওয়া। তবে ইঁদুর মহিলাদের মধ্যে অতীব জনপ্রিয়, যৌবন দীর্ঘায়িত করতে তার নাকি জুড়ি নেই। সবাই যে খাচ্ছে এমনটি নয়, অনেকে বসে স্রেফ কফি খাচ্ছে, সিগারেট খাচ্ছে, সেলফোন ঘাঁটছে।

আমাদের অতিকায় বিলাসবহুল বাস থেকে নেমে যখন একে একে রিকশায় উঠছি, এক বুড়ো ভিয়েতনামি প্রত্যেকের ছবি তুলল। দুঘণ্টা পরে ঘুরেঘারে ফের যখন সেখানে, প্রত্যেকের হাতে ছবি ধরিয়ে বলে এক ডলার দাও। কেন রে! আমি কি তোকে ছবি তুলতে বলেছি? তুই কাউকে না বলে গ্রুপের মেয়েদের ছবি তুললি কেন? যা, ছবি নেব না। তখন বুড়ো বলে কী,ইফ নট তেক,আই দেস্ত্রয় ইত উইথ ফায়ার। ফায়ার ইস ব্যাদ লাক, কনফুসিয়াস তোলদ। এমনিতেই ধর্মগুরুদের নাম শুনলে আমার বিরক্ত লাগে,এখন আরও লাগল।

হ্যানয়ে এক কাফেতে আমরা এগ কফি (Cà phê trứng) খেতে গিয়েছিলাম। এগ কফি শুনে যারা ভাবছেন এটি সোনার পাথরবাটি বা কাঁঠালের আমসত্ব, তাদের সবিনয়ে বলি, সাবেকি উত্তর ভিয়েতনামি বিপ্লবীয়ানার এক প্রতীক এই কফি – তখন ওরা এতটাই গরিব ছিল যে কফিতে দুধ জোগাতে পারতো না, তাই ডিম। ডিমের কুসুম দিয়ে গোলা কফি, গরম রাখার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত কাপে পরিবেশিত – যেখানে কফির নিচে একটি লম্ফ জ্বলে। কাফেটি একটি সাবেকি বাড়িতে, কলকাতা বা তার আশেপাশের দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ি যেমনটি হয়, ঠিক তেমনটি। উঠান - তাকে ঘিরে বারান্দা - বারান্দা পেরিয়ে ঘর - তার ছাদ অনেক উঁচু, দেওয়াল ভীষণ মোটা – আর হ্যাঁ, দেওয়ালে কুলুঙ্গিও আছে। একটা বড়সড় ঘরে চেয়ার টেবিল পাতা, বাইরে বারান্দার অংশটাতে কাউন্টার, ভাঁড়ার, রান্নাঘর। সেখানে টিভিতে ভিয়েতনামি অনুষ্ঠান চলছে, একঝলক দেখে দেখি ওমা! এতো আমাদের কৌন বনেগা ক্রোরপতি গো! এগ কফির পাশাপাশি সেখানে আর দুরকম ভিয়েতনামি কফি পাওয়া যায় - Cà Phê Sữa Đá বা ভিয়েতনামি বরফ কফি, এবং Cà Phê Cot Dua বা নারকোল দেওয়া কফি। এছাড়া পরিচিত কফিগুলি – অ্যাফোগাতো, কাফে মোচা, ল্যাতে ম্যাকিয়াতো, এস্প্রেসো, ক্যাপুচ্চিনো, কোল্ড ব্রিউ কফি – তো আছেই।

কাফেটিতে সাকুল্যে চারটি কর্মী, এক প্রৌঢ়া, দুই যুবক আর এক যুবতী। এত ফর্সা আর এত রোগা এরা যে দেখে বয়স বোঝা যায় না। আমরা এগ কফির ফরমাশ করে বসে আছি, শ্রীমতী পাল দেখলাম খুব মন দিয়ে ওই চারজনকে দেখছেন। তিনি বললেন 'ছেলেদুটো ভিয়েতনামি স্ট্যান্ডার্ডে অবিশ্বাস্য ভাল ইংরিজি বলছে, আর ওদের চেহারাতেও দেখো একটু ককেশিয়ান ছাপ আছে। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে!' এগ কফি শেষ হয়ে গিয়েছিল। সময় পেতে তিনি নারকোল দেওয়া কফির ফরমাশ করলেন, আমি রাজি হলাম না। নারকোল দেওয়া কফি খেতে খেতে তিনি সহসা উঠে গিয়ে দুরপ্রাচ্যের কায়দায় মাথা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে প্রৌঢ়াটিকে বললেন 'জিন চাও। চাও বু সাং, বা।' (হ্যালো, গুড মর্নিং, মাসি -সেলফোনে গুগল করে দেখে নেওয়া)। মাসি খুব খুশি হলেন। ভিয়েতনামিরা বাঙালিদের মতই গল্প করতে পেলে আর কিছু চায় না। গল্প শুরু হয়ে গেল।

শ্রীমতী পাল ঠিকই দেখেছিলেন, ছেলেদুটোর চেহারায় ককেশিয়ান ছাপ আছে। প্রৌঢ়াটি তাদের মা, পিতা প্রয়াত। পিতা ছিলেন মার্কিন সেনা, ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৫ – ১৯৭৫) এর সেনানী। যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন,তার পরিচর্যা করেছিলেন এক ভিয়েতনামি নার্সদিদি। ৩০ এপ্রিল ১৯৭৫ সায়গন শহরের পতনের মধ্যে দিয়ে ওই যুদ্ধের সমাপ্তি। তারপর সেই মার্কিন সেনানী ভিয়েতনামে ফিরে আসেন সেই নার্সদিদিকে খুঁজতে, তার পরিবারকে খুঁজে পান; কারন সেই নার্সদিদি ততদিনে অকালপ্রয়াতা। তাকে না পেয়ে ওই সেনানী সেই নার্সদিদির ভাইঝিকে বিবাহ করেন। সেই অকালপ্রয়াতা নার্সদিদি এই প্রৌঢ়ার পিসি। কিছুদিন আমেরিকায় কাটিয়ে তারা দুজনেই ভিয়েতনামে ফিরে আসেন। যুবতীটি বড়ছেলের স্ত্রী, তিনি ভিয়েতনামি। ইতোমধ্যে নারকোল দেওয়া কফি শেষ; আমাদের দুজনের জন্যে এবারে ক্যাপুচিনো এল। বেড়াতে বেরিয়ে যতই আদিত্য চন্দ্রমা জ্যোতিষ্ক তটিনী রত্নাকর ইরন শৈল আগ্নেয়গিরি উষ্ণপ্রস্রবণ দেখিনা কেন,শেষ পর্যন্ত দেখার জিনিষ তো একটিই – মানুষ।

বাবার মুখে শুনেছিলাম দূরপ্রাচ্যের লোক ভাত ঠাণ্ডা করে খায়। তদুপরি ওদের দেশে আরামবাগ নেই, ফলে আরামবাগের রাইস মিলও নেই, তাই ওরা আমাদের মত ধান প্রক্রিয়াকরণ জানে না; কিভাবে ধান থেকে চাল বার করে কে জানে, ভাত খুব আঠালো হয়। সেই আঠালো ভাতের গোল্লা পাকিয়ে চপস্তিক দিয়ে বাগিয়ে ধরে খায় – সঙ্গে মাংস। তা সে মাংস গরুর হতে পারে, হতে পারে শুয়োরের। এই অবধি ঠিক আছে – তবে কুকুরের বা মেঠো ইঁদুরের মাংস হলেও নাকি আশ্চর্যের কিছু নেই। হ্যানয়ে শুয়োরের কাঁচা রক্তের পুডিং (Tiết canh) খেয়ে দেখলাম; দিব্যি লাগল। তবে কুকুর খাওয়া অত সহজ নয়, কুকুরের মাংস অতি মহার্ঘ – ফলে গরু বা শুয়োরের মাংসের সঙ্গে কেউ ভাগাড়ের কুকুরের মাংস মিশিয়ে দেবেন, এমন সম্ভাবনা নাস্তি। ফলে এক অভিজাত ডগ মিট রেস্তরাঁয় গিয়ে কুকুরের ভাপানো মাংস চিংড়ি চালগুঁড়োর পদ (Rựa Mận) খেতে হল। খরচ পড়ল বিস্তর। খরচটি বাঁচানো যেত, কারণ আমাদের ভ্রমণসংস্থা অভ্যস্ত খাবার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তা তারা দিচ্ছেনও। তবে লন্ডন গিয়ে যদি ফিশ এন্ড চিপস না খেলাম, বালি গিয়ে যদি মি গোরেং না খেলাম, তাহলে শুধু শুধু পয়সা খরচ করে যাওয়া কেন! তবে ট্যাঁপা মাছ খেতে সাহসে কুলোয়নি। এ আমাদের দিঘার সবজেটে ট্যাঁপা (Green Pufferfish / Chelonodon fluviatilis) নয়, কালো অতিকায় ট্যাঁপা।

রাস্তাঘাটে ফুলের মেলা; দোকানের সামনে, ফুটপাথে আলঙ্কারিক ফুলের পসরা; সাইকেলে, দ্বিচক্রযানে, ভ্যানরিকশায়, বাঁকে করে ভিয়েতনামি দিদিরা ফুল বিক্রয়ে ব্যস্ত - তাদের মাথায় সাবেকি ভিয়েতনামি টুপি (nón lá); দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। সেখান থেকে ভিয়েতনামি হস্তশিল্পের এক মস্ত গ্যালারিতে। ভিয়েতনামি হস্তশিল্পের মধ্যে উল্লেখ্য লাক্ষাশিল্প, রেশমশিল্প, কাঠের পুতুল, সেরামিক শিল্প, বাঁশ থেকে নির্মিত নানাবিধ বস্তু। তারপর সেখান থেকে হো চি মিনের সমাধি। সকালে তিন ঘণ্টার জন্য খোলে,এবং দেখার কোন আগ্রহও ছিল না। নিজের দেশেই তিনি প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছেন,তাঁর রাজনৈতিক লাইন আর্থিক নীতি পঁচানব্বইয়ের পর পরিত্যক্ত, চিনের সঙ্গে চূড়ান্ত মন কষাকষি, সেই আমেরিকার সঙ্গে নৈকট্য। যুদ্ধে তাহলে জিতল কে? আমেরিকা তো ঠিক এটাই চেয়েছিল, কমিউনিজমের প্রসার রোধ, মুক্ত অর্থনীতি। যুদ্ধজয় কি তবে পাইরহিক ভিকট্রি (Pyrrhic victory)?

অপেরা হাউস, সেন্ত জসেফ'স ক্যাথেড্রাল দেখে যাওয়া হল লোটাস ওয়াটার পাপেট শো দেখতে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের শো, ছোট ছোট দশটি আখ্যান, এবং বিষয়বস্তুগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচিতির সুবাদে – যথা খেঁকশিয়ালের হাঁস ধরা, নদীতে মাছ ধরা, পুকুরে মহিষকে স্নান করানো, ধান রোয়া – দেখে ভারি মজা লাগল। ওয়াটার পাপেট্রি শো (Múa rối nước) উত্তর ভিয়েতনামের লাল নদীর অববাহিকা অঞ্চলের এক সমৃদ্ধ লোককলা, উৎস একাদশ শতাব্দীতে জলভর্তি ধানক্ষেতের শ্রমিকদের সৃষ্টিশীল বিনোদনে। কাঠ আর লাক্ষার পুতুলগুলি কোমরসমান জলে দাঁড়িয়ে নাচ দেখায়, নাচ পরিচালিত হয় পর্দার পিছন থেকে, পুতুলের সঙ্গে যুক্ত লম্বা লাঠির মাধ্যমে – মনে হয় পুতুলগুলি যেন জলের ওপর নাচছে।

হাই হ্যালং

চতুর্থ দিন দোসরা জানুয়ারি সকালে চার ঘণ্টার বাসযাত্রা, গ্রামীণ ভূচিত্র ফুঁড়ে সাবেকি মিটারগেজ রেললাইন দেখতে দেখতে কিউয়াং নিনহ (Quảng Ninh) প্রদেশের হালং উপসাগর (Vịnh Hạ Long) তীরবর্তী হালং আন্তর্জাতিক ক্রুইজ বন্দরে। পথে এদের অভিনব সৎকার পদ্ধতি দেখা হল। মৃত্যুর পর দেহ সমাহিত করা হয় বাড়িলাগোয়া জমিতেই, কবর চেনার সুবিধার জন্য তার ওপর লাগানো হয় জবা, করবী বা টগর জাতীয় ছোট ফুলের গাছ। ছ বছর পর এক মধ্যরাত্রে, তা ফের তুলে হাড়গোড় ধুয়ে মুছে, সুগন্ধি ছড়িয়ে তা পাকাপাকি ভাবে সমাহিত করা হয়। লোকবিশ্বাস, ওই ছ বছর বাড়ির কাছাকাছি থেকে মানুষটি অশুভ সকল শক্তি থেকে বাড়িটিকে ও তার বাসিন্দাদের রক্ষা করেন।

হালং কথাটির অর্থ নেমে আসা ড্রাগন। অনেক অনেক বছর আগে,যখন ভিয়েতনামি জনগণ চিনের ছায়া থেকে বেরিয়ে তাদের জাতীয় পরিচিতি ও জাতীয় সত্ত্বার খোঁজে উন্মুখ,আকাশ থেকে দেবতারা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এই ড্রাগনদের। হালং উপসাগরের আয়তন ১,৫৫৩ বর্গ কিলোমিটার, সেখানে হাজার দুয়েক পাহাড়,অধিকাংশই চুনাপাথরের – ৫০০ মিলিয়ন বছর ধরে প্রকৃতির আপন খেয়ালে গড়ে ওঠা। দশ হাজারেরও বেশি বছর আগে এখানে মনুষ্যবসতি ছিল। সেখান থেকে মাঝারি (কুড়ি আসনের) নৌকা চেপে আমাদের জাহাজে, গ্রে লাইন ক্রুইজ। সংস্থাটি অতীব প্রামাণ্য, ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত; তাদের আহারের বড়ই পারিপাট্য,তাদের জাহাজে অবস্থিতি বড়ই বিলাসবহুল। অপরাহ্ণে আবার মাঝারি কুড়ি আসনের নৌকা (Tenderboat) চেপে আরেক বন্দরে, বলা হল তুমি একা কায়াকিং করতে পারো, নচেৎ আমাদের ছোট দশ আসনের নৌকা তোমাকে এই অঞ্চলটি ঘুরিয়ে দেখাবে। দ্বিতীয় পছন্দে বিস্তর ঘোরাঘুরি হল, নীল কাকচক্ষু জল, ঢেউ নেই, যতদূর চোখ যায় জলে এক টুকরোও কাগজ বা প্লাস্টিক ভাসছে না। জলের মধ্যে থেকে মাথা তুলেছে অতিকায় চুনাপাথরের পাহাড়, তাদের মাথায় বৃষ্টি-অরণ্যের টুপি। জীববৈচিত্রের শেষ নেই – বাঁদর, পাখপাখালি, খরগোশ, কাঠবেড়ালি। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে নৌকা চড়ে ভারি মজা হল। মাঝারি কুড়ি আসনের নৌকা চেপে আরেক দ্বীপে, তার নাম টি-টপ দ্বীপ। দ্বীপে নেমেই সব্বাই দুদ্দাড় করে পাহাড়ে উঠে গেল সূর্যাস্ত দেখতে। আমার অত পরিশ্রম পোষালো না; বিশেষত সূর্য যখন আমাদের ওখানেও ডোবে, রোজই ডোবে।

অসমান সৈকতে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম;এবং অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়লাম। সূর্যস্নানরতা এক গৌরী বালিকা এসে তুললেন,'আঙ্কল,আহিস্তা'। এবারে আমার চমৎকৃত হওয়ার পালা। জানা গেল মা জননী কলম্বিয়ার মেয়ে, মেয়েদের ফুটবল খেলতে ভারতে এসেছিলেন; তারপর থেকে গিয়েছেন, হায়দ্রাবাদের এক ইস্কুলে অর্থনীতি পড়ান। একা একা একটা মেয়ে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরোচ্ছে; ওর মার রাতে ঘুম হয়; দুশ্চিন্তা হয় না? শ্রীমতী পাল বেরসিক মানুষ, রাত্তিরবেলায় তিনি আনারসের রস খেতে চাইলেন। আমি দেখলাম আস্ত আনারস সাজানো, পাশে মিক্সারও আছে। আমি তাদের বললাম পাইনাপল জুস, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম আনারস,মিক্সার। লস্যি ঢালাঢালির ভঙ্গি করে,দুহাত ওপর নিচে করে বললাম জুস। তারা কিছুই বুঝল না। সারা জাহাজে একজনই ইংরিজি জানে, বিপদে পড়ে তাকে ডেকে আনলো,সে আমার কাছে শুনে ওদের বলল ত্রাই দুরা নুয়ক এ – তবে আনারসের রস মিলল। রাতে জাহাজের ডেকে; ঠাণ্ডায় সেখানে কেউ নেই। উজ্জ্বল নক্ষত্রখচিত আকাশ, অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে চুনাপাথরের পাহাড়গুলি; জাহাজ খুব ধীরে চলছে। বাতাসে জলের টান।

পরদিন ভোর হতে না হতেই দেখি সমুদ্রময় অগণন ডিঙি নৌকা, আমাদের জাহাজ ঘিরেও কয়েকটি। প্রৌঢ়া ভিয়েতনামি পিসিমারা চিপস, কলা, কাচের বোতলে জল (পুরো হালং উপসাগরে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ), আনারস, জামরুল, ফ্লাস্কে গরম জেসমিন চা ইত্যাদি নিয়ে জাহাজের আরোহীদের কাছে বিক্রি করতে এসেছেন। প্রাতরাশ সেরে আমরা মাঝারি নৌকায় বন হন (Bo Hon) দ্বীপের সর্ববৃহৎ গুহা (১০,০০০ বর্গ মিটার) সাং সৎ (Sung Sot –Surprise Cave) । ১৯০১ সালে এটি আবিষ্কার করে ফরাসিরা এত আশ্চর্য হয়েছিল যে এর নাম রেখেছিল "গ্রতে দেস সারপ্রাইজেস (Grotte des Surprises)"। বর্তমানে এটি ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। সারা গুহা জুড়ে নানা রঙের পাথর।

সেখান থেকে জাহাজে ফিরে গুছিয়ে নিয়ে বাসযাত্রা। এবারে সরাসরি বিমানবন্দরে, পথ কিছুটা কম, কিন্তু সময় লাগল অনেকক্ষণ কারণ পথিমধ্যে এক মুক্তা ফার্মে ও এক সুপারমার্কেটে দাঁড়িয়েছিলাম। মুক্তা ফার্মটি বিশাল, সেখানে কালচারড মুক্তার চাষ, আর সুপারমার্কেটটি (Hong Ngoc Fine Arts Co. Ltd and Chan - Thien - My Co. Ltd. 110B Ngọc Hà, Ba Đình, Hanoi, Vietnam। www.hongngocvn.com) অতিকায়। ভিয়েতনামে রাস্তার ধারে ধারে মূলত বিদেশি পর্যটকদের কথা ভেবে এমন সুপারমার্কেটের ছড়াছড়ি। বেশ আন্তরিক, এসো ভাই, বসো ভাই গোছের ব্যাপার। ওয়াশরুমে যাও, পয়সা লাগবে না। লাউঞ্জে স্লিপিং পড পাতা আছে, ঠ্যাং ছড়িয়ে কোমর ছাড়িয়ে নাও, পয়সা লাগবে না। তারপর ডিম গোলা কফি খাও, হরেক কিসিমের চা (বাম্বু টি জেসমিন টি, লোটাস টি, সিত্রাস টি, হনি টি, বাম্বু টি, এগ টি, লিচি টি, জিনসেং টি, ম্যাঙ্গো টি......)খাও, ফলের রস খাও – প্রথম গেলাস পয়সা লাগবে না, যদি অন্য পানীয় খেতে সাধ জাগে, নিজেকে বঞ্চিত করো না; জানো তো জীবন একটাই। এমন মানবজনম আর পাবেনা – বারে বারে আর আসা হবে না। আর হ্যাঁ! তোমাদের বাস এখানে দেড় ঘণ্টা থামবে। তাই এইসব করে সময় থাকলে আমাদের দোকানটা একটু ঘুরে যেও। আমাদের দোকানের দশটা প্যাভিলিয়ন – ভাস্কর্য, জেমস্টোন, এমব্রয়ডারি, ল্যাকার পেন্টিং, জামাকাপড়, হাতব্যাগ, ভিয়েতনামি পটারি, তোয়ালে, ল্যাকার ও কিট্টি টেবিলক্লথ এবং ব্যাগ; আর জানোই তো! পুরোটাই একতলায়।

শুরুতেই ভাস্কর্যের প্যাভিলিয়ন; বুদ্ধের নানাবিধ মূর্তি। তবে ইনি আমাদের দেখা ভারতীয় বুদ্ধ নন, তাও বৌদ্ধদের বুদ্ধ; মোটাসোটা চৈনিক। আমাদের দেখেই একজন দৌড়ে এলেন – পছন্দ করো, ঠিকানা দিয়ে যাও, পাঠিয়ে দেব। হাজার হলেও তোমরা বুদ্ধের দেশের লোক, তোমাদের ক্যাশ অন ডেলিভারি অপশন করে দেব। জেমস্টোন, এমব্রয়ডারি ও ল্যাকার পেন্টিং ভিয়েতনামের প্রথাগত শিল্প-পর্যটকদের অবশ্যক্রীতব্যর তালিকায় পড়ে। আমরা যাওয়ার আগেই ভেবে গিয়েছিলাম কিনব; গাইডও বললেন এখান থেকেই কিনে নাও, সায়গনে দাম অনেক বেশি।

সুপারমার্কেটের বিক্রয়বালিকাগুলি সদাচঞ্চল প্রায় কিশোরী। তারা আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি, একটা প্যাভিলিয়ন দেখা হয়ে গেলে সেই প্যাভিলিয়নের বালিকাটি আমাদের পরবর্তী প্যাভিলিয়নের বিক্রয়বালিকাটির হস্তে সমর্পণ করে যাচ্ছে। এবারে জামাকাপড়ের দপ্তরে। আমাদের বাজারফর্দয় ভিয়েতনামের জাতীয় পোশাক আও দাই (áo dài) ছিলই – এখানে দেখলাম নানা মাপের নানা রঙের নানা ধাঁচের áo dài থরে থরে সাজানো। কিন্তু জামাকাপড় তো আর ছবি বা পাথর নয় যে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলাম ওইটি দাও। আমরা ঠিক কী চাইছি সেটি বিক্রয়বালিকাটিকে বোঝাতে গলদঘর্ম। শ্রীমতি পাল পুত্রবধূ ও পৌত্রীর জন্য ভিয়েতনামের áo dài কিনবেন, কিন্তু বিক্রয়বালিকাটি বিন্দুমাত্র ইংরিজি বোঝে না; আরও আশ্চর্য লাগল এই কারণে যে এইসব সুপারমার্কেট ভিনদেশি পর্যটকদের জন্যেই। বিক্রয়বালিকাটি আমাদের ছাড়বে না। শ্রীমতী পাল প্রায় চড় বাগিয়ে তাকে বোঝাতে লাগলেন ফাইভ ইয়ার গার্ল; পিঙ্ক একটা; আর অনর্গল বাংলায় বলে গেলেন তোমার সাইজের আরেকটা, হাতাওয়ালা, গোলাপি রঙের। সে কি বুঝলো কে জানে, ঠিক জিনিসটিই বার করে আনলো।

তারপরেও পাঁচটি প্যাভিলিয়ন; হাতব্যাগ, ভিয়েতনামি পটারি, তোয়ালে, ল্যাকার ও কিট্টি টেবিলক্লথ এবং ব্যাগ। শ্রীমতি পাল সব প্যাভিলিয়ন থেকেই কিছু না কিছু কিনলেন; খেলনা, টুপি, রুমাল। ভারতীয় রুপি মার্কিন ডলার ভিয়েতনামি ডং এর পারস্পরিক বিনিময়হারের জটিল অঙ্ক বুঝিনা বলে দোকানের বিল মিটিয়েছিলাম ভারতীয় কার্ডে, ভারতীয় রুপিতে; দেখলাম বিল খুব বেশি হয়নি। তবে ওই দেড় ঘণ্টার রাজকীয় অভ্যর্থনা জীবনভর মনে থাকবে। বার বার মনে পড়ছিল জাতীয় বা রাজ্য সড়কের ধারে, কৃষ্ণনগর বা পলষন্ডা, আসানসোল বা ধলডাঙ্গার ধাবাগুলি। তারাও তো এমনটি হতে পারতো - দীর্ঘ সড়কযাত্রার যাত্রীকে অতি প্রয়োজনীয় পরিষেবাটুকু দিয়ে বাণিজ্য করতে।

~ ক্রমশ ~

হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূল ক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সে বিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালের বাংলায় ভ্রমণকাহিনি লেখালেখির প্রেরণা 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না।'

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher