বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
তুমলিং – সাধ ও সাধ্যের ট্রেকিং
প্রদীপ্ত চক্রবর্তী
'হাঁটুতে আজ টান লেগেছে', তাই ইচ্ছে থাকলেও ৫০+ বয়সে পাহাড়ের পথে পথে হেঁটে বেড়ানো যখন ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে তখন মাথায় এল একটা ছোট্ট ট্রেকিং রুটের কথা। এমনিতেই রডোডেনড্রন বাঙালির আবেগ। বছর দশেক আগে বারসে গিয়ে নেশা ধরে গিয়েছিল। সঙ্গে আছে বাঙালির প্রথম পছন্দের সান্দাকফু। কিন্তু এখন গাড়ির রাস্তা হয়ে ভিড় বেড়েছে, হারিয়েছে সেই নির্জনতা। একটু সমঝোতার পথে হাঁটলাম, ঠিক করলাম গাড়িতে তুমলিং গিয়ে সেখান থেকে ট্রেক করে ধোতরে হয়ে ফিরব। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ, কাজেই রডোডেনড্রন পাওয়ার আশা ষোলোর জায়গায় আঠারো আনা। সেই মত দার্জিলিং মেলে চেপে বসলাম।
সকালে নিউ জলপাইগুড়ি নেমে গাড়িতে মানেভঞ্জন। এবার একটা বোলেরো নিয়ে তুমলিং-এর পথে। এখন সান্দাকফু্র রাস্তা অনেকটাই কংক্রিট বাঁধানো, তবে প্রচন্ড খাড়াই। বুনো শুয়োরের মত ঘোঁতঘোঁত করতে করতে গাড়ি পৌঁছাল তুমলিং।
প্রচন্ড মেঘ, দৃশ্যমানতা অত্যন্ত কম, তবে মেঘমা ছাড়ার পরই দুপাশে রডোডেনড্রনের রঙের ছড়াছড়ি, বুঝলাম প্রকৃতি দেবীর অপার কৃপায় রডোডেনড্রনের দৃশ্যসুখ থেকে বঞ্চিত হব না। টংলু-র পর রাস্তা খাড়া নেমে গেছে ১.৫ কিলোমিটার। তুমলিং-এ শিখর লজ বুক করাই ছিল। ঘরে ঢুকে মালপত্তর রেখেই আবার বেরোলাম, উপায় নেই, বাইরে যে রঙের রায়ট, তাকে এড়াবো কীভাবে!
অধিকাংশ ট্যুরিস্ট কোনোরকমে একটা রাত তুমলিং-এ কাটিয়ে দৌড়োয় সান্দাকফুর দিকে, সে গাড়িতেই হোক আর সামান্য কয়েকজন যারা এখনও হাঁটেন। খুব তাড়া না থাকলে একটা দিন বরাদ্দ করুন তুমলিং-এর জন্য। সামান্য কয়েকটা হোটেল বা হোমস্টে, সামনে মস্ত এক অজগরের মত বিছিয়ে আছে রাস্তা, সামনে উঠে গেছে গৈরিবাসের দিকে, পিছনেও চড়াই, টংলু। সামনে তাকান, পিছনে ফিরুন, দৃশ্যপট পালটে যাবে। একটু হেঁটে চলে যান গৈরিবাসের দিকে, মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টাবে দৃশ্যপট। এগোন টংলুর দিকে, সে আরেক ছবি। আর দুপাশে রডোডেনড্রন তো স্বমহিমায় বিরাজমান। কপাল ভালো থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দেবেন। এযাত্রা অবশ্য আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি, তবে রংবাহারি রডোডেনড্রন সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে।
সকালের লালচে আলোয় সে ছবি একরকম, সন্ধ্যের নরম আলোয় আরেকরকম। নরম রোদের মায়ায় আরও অন্যরকম। কখনও মেঘ ঝাপসা করে দিচ্ছে, আবার যেন ইরেজার বুলিয়ে কেউ তা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। হাতের ক্যামেরা হাতেই থেকে যায়, লেন্সের সাধ্য কী এই মায়ার খেলাকে বন্দী করে। সঙ্গে অবিশ্রান্ত পাখির ডাক। আসলে এটা তো ওদেরই এলাকা, আমরা তো অনুপ্রবেশকারী।
কাল ট্রেক করে ধোতরে যাব, ৭ কিলোমিটার রাস্তা, পুরোটাই উৎরাই, তাই দমে টান ধরার আশংকা নেই। আগে এই রাস্তাতেই ধোতরে থেকে সান্দাকফুর পথে এসেছি, তাই জানি রাস্তা বেশ খাড়াই, তাই উৎরাই হলেও পায়ে চাপ পড়বেই। হোটেলে বলে রাখলাম একজন গাইড কাম পোর্টারের কথা। সঙ্গী আমার স্ত্রী, সেও ৫০+, কাজেই মোট বওয়া একটু কঠিন। একটু চিন্তা হচ্ছিলই, আসলে হাঁটু দুটো এখন বেশ কমজোরি, তবু ছুটে বেড়াই কোন এক অমোঘ আকর্ষণে।
সকালে খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে বেলা নটা নাগাদ রওনা হলাম ধোতরের পথে, সাথে বীরেন তামাং বলে একটি ছেলে। গতকালই কংক্রিট বাঁধানো পথে টংলু পর্যন্ত ঘুরে এসেছি, তাই বীরেনকে বললাম অন্য পথে যেতে। আসলে বছর পাঁচেক আগে এই পথেই উঠেছিলাম, সবুজে মোড়া তার স্মৃতি অটুট। আগের রাতের বৃষ্টির কারণে মাটি নরম, পথে সবুজ ঘাসের গালিচা চোখের আরাম। গোটা রাস্তাটাই নেপালের মধ্য দিয়ে। গাড়ির রাস্তা টংলুর পর থেকে পুরোটাই ভারত নেপাল সীমান্ত, কিন্তু এখানকার কোনও বাসিন্দাই এই নিয়ে কিছু ভাবেন না। প্রায় দেড় কিলোমিটার পর গাড়ির রাস্তা টপকে ধোতরের পথে পা দিলাম।
এক লহমায় বাকরুদ্ধ হওয়ায় মত অবস্থা। পথের দুধারে রডোডেনড্রন মেলা বসিয়েছে, কাল রাতের বৃষ্টিতে ঝরা ফুলের গালিচা। নীচু গাছের ডালেও ফুলের বাহার। চাইলে যেন একটু আদর করেও নেওয়া যায় ফুলের দঙ্গলকে। তবে ফুল দেখতে হচ্ছে সাবধানে। রাস্তা পাথুরে, অসমান এবড়োখেবড়ো। সাবধানে পা না ফেললে মচকানোর সমূহ সম্ভাবনা। উৎরাই পথে দমে টান না পড়লেও পায়ের আঙুলে যথেষ্ট চাপ। ২৫-৩০ মিটার পরেই মোড় নিচ্ছে। একবার শর্টকাট করতে গিয়ে যথেষ্ট চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। আসলে মন না মানলেও বয়স তো আর বসে নেই। মেঘ ঢুকে মাঝে মাঝেই পথ রহস্যাবৃত করে তুলছে। সব কিছু কেমন ঝাপসা, যেন ক্যানভাসে কেউ হঠাৎ করে খানিকটা সাদা রঙ ঢেলে দিচ্ছে। চোখে পড়ল সাদা রডোডেনড্রন যাকে স্থানীয়রা চিমাল বলে। বারসেতে দেখেছিলাম। এই পথে নাকি ভাল্লুক আর লাল পান্ডার আনাগোনা আছে। পান্ডার প্রিয় বাঁশের বন রয়েছে, যদিও তারা কেউই দেখা দিয়ে ধন্য করেননি। উৎরাই হলেও ৭ কিলোমিটার রাস্তা এই বয়সে ক্লান্তিকর বটেই।
পথের সৌন্দর্য আর রোমাঞ্চ মন ভোলালেও শরীর জানান দিচ্ছে বয়স হয়েছে হে, এবার সামলে। একবার বসে, জল, চকোলেট খেয়ে আবার হাঁটা। এইভাবে একসময় পৌঁছে গেলাম ধোতরে। আগে থেকেই শেরপা লজে ঘর বুক করা ছিল। সুন্দর লোকেশন, কিন্তু পেশাদারিত্বের অভাব প্রকট। যাইহোক, একটা তো রাত, কেটে গেল।
পরদিন সকালে সুন্দরী ধোতরের রূপ দেখতে দেখতেই শিলিগুড়ির গাড়ি চলে এল। তারপর নটে গাছ মুড়নোর কথা। নিউ জলপাইগুড়ি হয়ে দার্জিলিং মেলে কলকাতা। সঙ্গে কিছু ছবি আর একরাশ আত্মবিশ্বাস, হোক না উৎরাই, খাড়া পাহাড়ি রাস্তায় ৭ কিলোমিটার হেঁটেছি তো। তাহলে এখনও ততো বুড়িয়ে যাইনি।
পেশায় শিক্ষক প্রদীপ্ত চক্রবর্তী নেশায় আলোকচিত্রী ও ভ্রামণিক।