ভিয়েতনাম-কাম্বোডিয়া – সাতান্ন বছর পরে আবার

তপন পাল



বিমানবন্দর। ভিয়েতনাম এয়ারলাইন্সের উড়ান VN 0843, Airbus 321, VN A 399, কাম্বোডিয়ার সিয়েম রিপে নামলাম। সিয়েম রিপে-র পরিবহনের প্রধান মাধ্যম স্কুটার রিকশা। দু চাকার ওপর লোহার কাঠামো, ছাদ; মুখোমুখি দুজন দুজন চারজনের বসার বন্দোবস্ত। গাড়িটির সামনে একটি হাতল, তার শীর্ষে স্প্রিং-এর আংটা। মোপেড বা স্কুটার বা মোটর সাইকেলের পিছনে আটকে নেওয়ার জন্য। দ্বিচক্রযানের পিছনে সংযুক্ত হয়ে পাঁইপাঁই করে দৌড়য়, সরু বা জনাকীর্ণ রাস্তাতেও নব্বই ডিগ্রিতে বাঁক নিতে পারে। প্রতিটি গাড়ির গায়ে মালিকের নাম লেখা।

শ্যাম কাম্বোজে 'ওঙ্কার-ধাম', - মোদেরি প্রাচীন কীর্তি।
চার তারিখ দিনটি ছিল আঙ্করভাট (মন্দির-শহর)-এর জন্য। সকাল আটটায় বেরিয়ে সাঁইত্রিশ ডলার দিয়ে সারাদিনের টিকিট নিয়ে আমরা চত্বরে। আঙ্করভাট নিয়ে বলা শেষ হবে না। একটি ভ্রমণগন্তব্য, সেই সারা দেশটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার জন্যেই গড়ে উঠেছে একটি আস্ত বিমানবন্দর, একটি শহর, হর্ম্যরাজি, দেশের পতাকাতেও তার সোচ্চার উপস্থিতি – তার পাব স্ট্রিট যেন ব্যাংককের খাও সান রোড, রাত যেখানে নির্ঘুম, নির্নিমেষ, অনিঃশেষ; বিশ্বজগৎ যেখানে এসে মেশে। মধ্যরাত্রে ধুতি পরে পানশালায় ঢুকতেই গান গাওয়ার ফরমাশ। আমি তালকানা সুরকানা গলাভাঙা, কিন্তু ভিতু নই। সত্তরের দশকে বজবজ লোকালে এক অন্ধ ভিক্ষুককে গাইতে শুনতাম 'ও গো গোয়ালিনী দোকান খোলো দেখি, পসরা সাজাও দেখি, যে ঘাটে রাধিকা হবে পার, কানাই সেই ঘাটের মাঝি। ও রাধে গো নিতি নিতি যাও গো রাধে আমায় ফাঁকি দিয়া, এবার পারের কড়ি দিয়া যাও নইলে তো আর ছাড়বোনা সাঙ্গ করে দেব বেচাকিনি, ও গো গোয়ালিনী'। উচ্চকিত বাদ্যবৃন্দের সাথে তাই গেয়ে দিলাম। সঙ্গে ইন্টারলিউড 'তাইরে নাইরে না দুটো ছোলা ভেজাও না'; এক কৃষ্ণাঙ্গী রাইকিশোরী ঘুরে ঘুরে লংস্কার্ট উড়িয়ে নাচলেন। কী হাততালি সে আর কী বলব! খুব মজা লাগছিল। কেউ কাউকে চিনিনা। ইহজীবনে আর দেখাও হবে না। চলে যায় দিন, যতখন আছি পথে যেতে যেতে কাছাকাছি আসার সুবাদে মুখের চকিত সুখের হাসি দেখে অকারণে গান গাওয়া। জগতে আনন্দযজ্ঞে সত্যিই আমার নিমন্ত্রণ।

আঙ্করভাট দেখতে গিয়ে স্মৃতি কল্পনা আর বাস্তব মিলেমিশে একাকার! আঙ্কর দেখেছি কোন শৈশবে, কিন্তু তার পর বাবা মার মুখে তার এত গল্প শুনেছি, পারিবারিক এ্যালবামে তার সাদা কালো এত ছবি দেখেছি যে যাই দেখি মনে হয় 'ঠিক গেলবারের মতো'।

এই মন্দিরে যেহেতু সারা পৃথিবীর পর্যটক আসেন, তাই পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষায় কথা বলা গাইড এখানে আছেন - চিনা, ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু, স্পেনীয়, আরবি, পর্তুগিজ, রুশ, জাপানি, জার্মান, ফরাসি – সবাই। এমনকি বাংলাও। আমাদের গ্রুপের জন্য একজন ইংরাজিভাষী গাইড বরাদ্দ হয়েছিল। তবে বাংলাভাষী গাইড দেখে আমার বাংলা প্রেম চাগিয়ে উঠল। একজনকে বললাম আমাকে ঘুরিয়ে দেখাতে।

তারপরেই স্বপ্নভঙ্গ। তিনি যে বাংলা বলতে লাগলেন সেটি কলকেত্তাইয়া বাংলা নয়; বাংলাদেশি বাংলা – স্প্যানিশের চেয়েও দুর্বোধ্য। সবিনয়ে তার সম্মানদক্ষিণা (কুড়ি মার্কিন ডলার; কাম্বোডিয়ার সর্বত্র মার্কিন ডলার চলে, তাদের নিজস্ব মুদ্রা কাম্বোডিয়ান রিয়েল কেউ ছুঁয়েও দেখে না) মিটিয়ে দিয়ে ফিরে এলাম ইংরাজিভাষী গাইডের ছত্রছায়ায়। বেঁচে থাক ইংরাজি ভাষা! মার্ক টোয়েনের সেই উক্তি মনে পড়ল - There is no such thing as the Queen's English. The property has gone into the hands of a joint stock company and we own the bulk of the shares! ইংরাজি ভাষা ঠিক যতখানি রানির, ঠিক ততখানিই আমার।

আঙ্করভাট চত্বরে বেড়াবার তিনটে নিয়ম। মন্দিরে ঢোকার সময় কাঁধ ও হাঁটু ঢাকতে হবে। ভিক্ষুদের সঙ্গে কথা বলার বা তাদের স্পর্শ করার চেষ্টা করা যাবে না। রক্ষীরা যতবার চাইবেন ততবার কার্ড দেখাতে হবে। দর্শনার্থীদের অধিকাংশ সাহেব মেম। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এসে গরমে তাদের হাঁসফাঁস অবস্থা। তাদের সার্বিক পোশাক হাপ পেন্তুল আর স্যান্ডো গেঞ্জি। তাদের জন্য সারা মন্দিরশহর জুড়ে পাজামা আর হাপ আলখাল্লা বিক্রির ধুম লেগেছে। কোন একটি মন্দিরের সামনে সাহেব- মেমরা বাস থেকে নামছেন, পাজামা আলখাল্লা কিনছে্ন, লাফিয়ে লাফিয়ে পরছেন, সেই মন্দিরটা দেখছেন, তারপর সদ্যকেনা পাজামা আর হাপ আলখাল্লা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, পরের মন্দিরে ফের কিনছেন।

মন্দিরচত্বরে শাড়ি পরা শ্রীমতী পালকে দেখে এক ইন্দোনেশিয়ান মহিলা এগিয়ে এলেন। তুমি কি ওড়িশা থেকে আসছো? তার খুব একটা দোষ নেই, শ্রীমতী পালের শাড়িটি ছিল ওড়িশার। ওড়িশা থেকে নয়, বেঙ্গল থেকে বলতেই প্রশ্ন, তুমি কখনও পুরী গেছো? শ্রীমতী পাল বললেন আমি তো বছরে একবার করে পুরী যাই, তবে এই ভদ্রলোক যান প্রতিমাসে। এবার তিনি শ্রীমতী পালকে ছেড়ে আমাকে ধরলেন। শোনো! আমরা হলুম গিয়ে বালিদ্বীপের হিন্দু, তুমি টাকা নিয়ে যাও, যখন পুরী যাবে আমার নামে একটা পুজো দিয়ে দিও তো! আমি পড়লাম ফাঁপরে! পুরী মন্দিরের পূজা মহার্ঘ, সোয়া পাঁচ আনা বা ষোল আনার মামলা নয়; হাজার চার-পাঁচের মোকদ্দমা। একটি অচেনা অজানা লোকের কাছ থেকে হুট করে অতগুলো টাকা নিয়ে নেওয়া সমীচীন নয়, বিশেষত তাকে যখন প্রসাদ পাঠাতে পারব না। বললাম তুমি চিন্তা করো না, একটা কাগজে নাম গোত্র লিখে দাও; তোমার পূজা আমি ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছিয়ে দেব, দিয়ে তোমাকে জানিয়েও দেবো। তিনি নাম গোত্র লিখে দিলেন। গোত্র দেখলাম alyamba – খুব সম্ভবত আলম্বায়ন এর অপভ্রংশ। আর দিলেন ইন্দোনেশিয়ার মুদ্রা। সারাদিন ঘুরে, বিস্তর হেঁটে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

পরদিন অর্থাৎ পাঁচ তারিখে সকালে Wat Thmey Buddhist Monastery. এটি একই সঙ্গে মন্দির ও প্রদর্শনীকক্ষ। গিয়ে দেখি সেখানে এক হবু দম্পতির প্রি ওয়েডিং ফটো শ্যুট হচ্ছে। কাম্বোডিয়াতে বিবাহ মাত্রেই অ্যারেঞ্জড, এবং বিয়ে করতে হলে পাত্রকে পণ দিতে হয় মেয়ের বাবাকে। এ ছাড়া বিবাহের যাবতীয় ব্যয়, প্রীতিভোজ, উপহার ক্রয়, মধুচন্দ্রিমা, বাজনাবাদ্যি, আতসবাজি... সবই পাত্রের। পণ মেয়ের রূপগুণ ও তাঁর পিতার বৈভবের সমানুপাতিক। বিবাহের পর পাত্র মেয়ের বাড়িতে পাকাপাকিভাবে থাকতে যায়; কন্যার পিতামাতার সম্পত্তিতে তার অধিকার জন্মায়। এর মধ্যে কেউই কোন অশালীনতা বা রাজনৈতিক অশুদ্ধতা খুঁজে পান না; অর্থনীতির সহজ শর্তটি মেনে নেন; বাঙালি অকালবিপ্লবীদের মত এ নিয়ে পাড়া মাথায় করেন না। যেমন এই মেয়েটি নিজমুখেই বলল তার বিয়ের জন্য তার বাবা পাত্রের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা) নিয়েছেন। শুনে শ্রীমতী পাল লাফিয়ে উঠলেন, তোমার ফরেক্স কার্ডে কত ব্যালান্স আছে; তোমার ক্রেডিট কার্ডের লিমিট কত; তোমার কাছে নগদে কত ডলার আছে? তুমি এদেশেই থেকে যাও – রাজত্ব থেকে রাজকন্যা সবই পাবে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯, কাম্বোডিয়ার ক্ষমতাসীন কিমাইর রুজ সরকার কাম্বোডিয়াকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কয়েক শতক। শহর খালি করে লোকজনকে পাঠানো হয়েছিল গ্রামে, পরিবার থেকে প্রত্যেককে বিচ্ছিন্ন করে নতুন করে তাদের পরিবার দেওয়া হয়েছিল; কারণ কিমাইর রুজ কম্যুনিস্টদের মনে হয়েছিল শহর মানেই পুঁজিবাদের গোলকধাঁধা। তাই আদর্শ সাম্যবাদী সমাজ গঠনের জন্য গ্রামে ফিরে যাওয়া, নির্বিচার গণহত্যা এবং প্রতিটি পরিবার ভেঙে সেই সদস্যদের নিয়ে নতুন পরিবার গঠনই নতুন সমাজের উদ্গাতা হতে পারে। কম খরচে মানুষ মারার পন্থাপদ্ধতি উদ্ভাবনে কিমাইর রুজ বাহিনীর সৃষ্টিশীলতা অপরিসীম - প্লাস্টিক প্যাকেট, হাতুড়ি, বাঁশ, কী নয়। তাই কাম্বোডিয়ার দু হাজার বছরের ইতিহাস মুছে ফেলে ১৯৭৫ সালকে শূন্য বছর ধরে নতুন করে বর্ষগণনা শুরু হয়েছিল। দু মিলিয়ন মানুষ, কাম্বোডিয়ার মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ চার বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এবং এটি ঘটিয়েছিল নিজের দেশেরই লোক, আক্রমণকারী কোনও বিদেশি সেনাবাহিনি নয়। আমরা তো অমিতাভ ঘোষের ড্যান্সিং ইন কাম্বোডিয়া অ্যান্ড অ্যাট লার্জ ইন বার্মা পড়েছি। ১৯৭৯-তে ভিয়েতনামি বাহিনি গিয়ে এই বাঁদরামোর ইতি ঘটায়। Wat Thmey Buddhist Monastery-র ভিতরে গণহত্যায় মৃত এইসব মানুষদের দেহাবশেষ সংরক্ষিত আছে, আছে স্মৃতিমন্দির। যেহেতু কাম্বোডিয়ার সব পরিবারই এই নির্বোধ সাম্যবাদীদের কবলে কোন না কোন প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, পরিবারে জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহে তারা এখানে আসেন।
আমাদের যখন ভিয়েতনাম যাওয়ার সব ঠিকঠাক, জননী বললেন হ্যাঁরে, লোকের বাড়ি কি খালিহাতে যাওয়া যায়? আমি পড়লাম বিপদে। ভিয়েতনাম নিয়ে আমার জননীর আবেগ আমি অন্তত বুঝি। ১৯৬৩-তে আমরা দুজনে যখন ভিয়েতনাম যাই, তিনি একুশ, আমি চার। নিম্ন-মধ্যবিত্ত, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে নিম্নবিত্ত, বাড়ির মেয়ের একাকিনী বিদেশযাত্রা, সেই যুগে উড়োজাহাজ চেপে, পাসপোর্ট ভিসা করিয়ে, দু দিকের প্রগাঢ় রক্ষণশীল যৌথ পরিবারের বাধা পেরিয়ে; সে এক অযাচিত বিপ্লব। মা তখন যদি তার সেই বিমানযাত্রার কথা, দুধের বোতল দিয়ে লুচি বেলার কথা, সামরিক অভ্যুত্থানের কথা, জীবিকার সর্বস্তরে মহিলাদের বিস্তৃত প্রাধান্যের কথা (এখানে তখন 'মহানগর' এর যুগ, রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ আরতি মজুমদার বাড়ির অমতে চাকরি করতে গিয়ে তার নবলব্ধ আর্থিক ও মানসিক স্বাধীনতা অর্জন ও উপভোগ করেন; সুব্রত মজুমদার চাকরি হারালে আরতিই কিভাবে বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে ওঠেন – তাই নিয়েই বাঙালির দিগন্ত) লিখে রাখতেন, আমি নিশ্চিত, দময়ন্তীদির সংকলনে তার জায়গা হত। পরে যখন বড় হয়েছি, আমার জননীই লজ্জার মাথা খেয়ে আমাকে বলেছেন সীতা কেন অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তা ছেড়ে রামের সঙ্গে বনবাসে গিয়েছিলেন, সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভিয়েতনাম গিয়ে। সেই মানুষটি যদি দূরের সেই দেশটিকে আত্মীয়সম ভেবে থাকেন, মনে করে থাকেন যে আত্মীয় কুটুম্বজনের বাড়ি খালি হাতে যাতায়াত অশোভন, তাহলে আমি কিছু বলার কে? সে না হয় যাওয়ার সময় কিছু উপহারসামগ্রী কিনে নিয়ে যাওয়া গেল। কিন্তু দেবো কাকে? সেই সময়ের কে আছেন, কার সঙ্গে যোগাযোগ আছে? মা বললেন যাকে হয় দিবি; রাস্তার লোককে, হোটেলের পরিচারককে, দোকানদারকে – তবে দিবি। আর জানেনই তো আমি আবার খুব মাতৃভক্ত। সেটা ভক্তিতে নয়, ভয়ে। জীবনে যতবারই মার পরামর্শের বিপ্রতীপে গিয়ে কিছু করতে গেছি, ফেলে ছড়িয়েছি, কেস খেয়েছি। কাশীরাম দাস তো সেই কোনকালেই যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে বলিয়েছেন 'লোকমধ্যে গুরু শ্রেষ্ঠ গুরুতে জননী। মাতৃবাক্য কেমনে লঙ্ঘিব নৃপমণি।। মাতা মম গুরুদেব ইষ্টদেব জানি। মাতার বচন আমি দেবতুল্য মানি'।। সাকুল্যে গুটিবিশেক উপহারসামগ্রী নেওয়া হল - সবই অতি সস্তার, তার মধ্যে আছে বাঁকুড়ার বিকনার ঢোকরার ছোট মূর্তি, কটকের রুপোর ফিলিগ্রির গহনা, গড়িয়াহাটের ফুটপাথের চটের ব্যাগ, নতুনগ্রামের প্যাঁচা। মাতৃবাক্য কি আর মিথ্যা হয়! ভিয়েতনামে গিয়ে দেখা গেল জননীর আইডিয়াটি যাকে বলে স্ম্যাশ হিট। দোকানের বিক্রয়বালিকাটিকে শ্রীমতী পাল একটি রুপোর গহনা দিলে, বা হ্যানয়ে আমাদের স্থানীয় গাইডটিকে একটি চটের ব্যাগ দিলে, বা প্রি ওয়েডিং ফটো শ্যুট করতে আসা হবু দম্পতিকে একটি ঢোকরার হাতি দিলে - তারা যে কী খুশি হয় বলবার নয়। জড়িয়ে ধরে, হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে জেসমিন টি, লোটাস টি, সিত্রাস টি খাওয়ায়। বিয়ের কনে তো বলল শুভকাজে হাতি উপহার পাওয়াটা অতীব শুভলক্ষণ; কারণ কপিলাবস্তু নগরীতে আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাতে মায়াদেবী স্বপ্ন দেখেছিলেন এক সাদা হস্তী মেঘের ওপর দিয়ে এসে তার শুড়েঁর শ্বেতপদ্মটি রানির কোলে এনে দিল।
তারপর কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই; সারা দিনটা আছে আমাদের নিজেদের ইচ্ছামত শহরটি ঘুরে দেখার জন্য – আর যার যা করতে ভাল লাগে তাই করার জন্য। আমাদের স্থানীয় গাইড ছিলেন শরথ নামের এক কাম্বোডিয়ান যুবক। সে বৌদ্ধ, তবে তার সেলফোনের রিংটোন 'জয় গণেশ, জয় গণেশ, জয় গণেশ দেবা'। সে বলল কেনাকাটা কিছু করার থাকলে এখান থেকে করে নাও; সায়গনে দাম অনেক বেশি পড়বে।

তথাস্তু! তদনুযায়ী আমরা গেলাম শহরের পুরনো বাজার এলাকায়। স্বচ্ছতোয়া সিয়েম রিপ নদী সেখানে বয়ে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে, আড়ে বহরে গড়চুমুকের কাছের দামোদর, আর তার উপর অগণন সেতু – নদীর দুপারে বিস্তীর্ণ মাঠ, সেখানে বসার বেঞ্চি, নানাবিধ আহার্যের সম্ভার, কেউ মধুতে ডুবিয়ে জ্যান্ত মৌমাছি খাচ্ছে তো কেউ বিট নুন ছিটিয়ে কাঁচা ঝিনুক, মিলছে সাপ ও কুকুর, ইঁদুর ও শূয়র। বোঝা গেলো এটা শহরের লোকেদের বেড়াবার জায়গা। নদীটিকে দেখে বুকের ভিতর থেকে এক পুকুর দুঃখ উঠে এল যেন! আমরাও তো আমাদের নদীগুলিকে এমন করে ধরে রাখতে পারতাম - কেন চুরি হয়ে গেল সোনাই আর নোয়াই, কোথায় গেল অচলা নদী (ধাত্রীগ্রাম), গাঙুর নদী (গলসী), বেহুলা নদী (কালনা), বেহুলা নদী (পুরাতন মালদহ), সরস্বতী নদী (হাওড়া), মণি খাল (দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা)? জঞ্জাল আর প্লাস্টিক ফেলে, জলধারার মধ্যে থেকে পিলার তুলে দোকানঘর বানিয়ে স্রোত রুদ্ধ করে আমরা তাদের পাঠিয়ে দিলাম না ফেরার পথে!
নদীর দুপারের মাঠ পেরিয়ে রাস্তা, পশ্চিমের রাস্তাটির নাম পোকাম্বোর এভিনিউ; তার পাড়ে কাম্বোডিয়ার রাজার রয়্যাল রেসিডেন্স, রাজামশাই সিয়েম রিপে এলে এখানে থাকতেন, এখন এটি হোটেল। সন্নিহিত রাস্তাটির নাম Charles de Gaulle। নদীর পূর্ব পাড়ের রাস্তাটির নাম Achar Sva Street। Pokambor Avenue এবং Achar Sva Street – দুটি রাস্তা বরাবর দোকানপাট; দুটি রাস্তা থেকেই ঢুকে গেছে অসংখ্য গলি, তাদেরও দুপাশে দোকানপাট; দোকানগুলিতে ঠাসা কাম্বোডিয়ার প্রথাগত শপিং আইটেমস – পাথরের ও ধাতব বুদ্ধমূর্তি, গণেশমূর্তি, দেবাসুরের সমুদ্রমন্থন মূর্তি, আঙ্করভাট মন্দিরের মডেল; বেতের বোনা জিনিসপত্র, সুপারি দিয়ে তৈরি বাক্স ও খেলনা, জামাকাপড়, রুপো ও রঙিন পাথরের গহনা, রেশমের স্কার্ফ, কাঠখোদাই মূর্তি – বিশেষত অপ্সরার – ঘরে যা রাখলে সৌভাগ্যলাভ সুনিশ্চিত, ধূপের মোটা মোটা বান্ডিল – এরা ঠাকুরের সামনে আমাদের মত পাঁচ দশটা ধূপ জ্বালায় না, শয়ে শয়ে জ্বালায়, সুগন্ধি ধোঁয়ায় ভরিয়ে দেয়, রাইস পেপার ইত্যাদি। এক জায়গায় কাম্বোডিয়ার জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল। তার সুর অনেকটাই আকাশবাণীর মহালয়ার মত। কান খাড়া করে শুনতে তার মধ্যে অনেকগুলি বাংলা শব্দ শোনা গেল। রক্ষা, মহা, মঙ্গল ইত্যাদি; যদিও গানটি কিমাইর ভাষায়।

ভিয়েতনাম কাম্বোডিয়ায় বেড়াতে গেলে পর্যটকরা প্রথাগতভাবে যা যা কেনেন, যথা Áo dài পোশাক, Lacquer Painting, সূক্ষ্ম সুতোর কাজকরা ব্যাগ বা টুপি, কাঠের খেলনা - তা আমরা হ্যানয় থেকেই কিনে নিয়েছিলাম - বাকি ছিল সুবিস্তৃত আত্মীয়কুলের সদস্যদের জন্য স্মারক কেনা। ভেবেচিন্তে ঠিক হল, সবার জন্যই চিত্রিত টি শার্ট কেনা হবে। একটি দোকানে যাওয়া হল। ও মা! বিক্রয়বালিকাটি বিন্দুমাত্র ইংরিজি বোঝে না। তারপর দেখা গেল সব দোকানেই ওই অবস্থা! একটি মেয়ে শ্রীমতী পালকে প্রায় হাইজ্যাক করে তার দোকানে ঢুকিয়ে নিল।

আমরা টি শার্ট দেখতে লাগলাম, অনেকগুলি কিনতে হবে, প্রায় বাইশ পঁচিশটি। একটি পছন্দ করে মেয়েটিকে দেখালাম, সে ত্বরিতে ক্যালকুলেটরে পঁচিশ লিখে এক মার্কিন ডলারের একটি নোট বার করে দেখিয়ে দিলো। বুঝলাম পঁচিশ মার্কিন ডলার! অবিশ্বাস্য! কিন্তু ওরা তো আর জানে না যে আমরা গড়িয়াহাটের ফুটপাথে বাজার করা লোক! শ্রীমতী পাল তাকে দুটি আঙ্গুল দেখালেন, অর্থাৎ দু মার্কিন ডলারে হবে? মেয়েটি তৎক্ষণাৎ ক্যালকুলেটরে পাঁচ লিখে দেখিয়ে দিলো। এভাবে অনেকক্ষণ চললো। শেষ পর্যন্ত অনেকগুলি টি শার্ট, রেশমের স্কার্ফ, কাঠ খোদাই অপ্সরা, রঙিন পাথর নিয়ে আমাদের দেয় হল আশি মার্কিন ডলার। তাই দিয়ে বিজয়গর্বে পিছন ফিরেছি, মেয়েটি বলল 'মাই টিপস'!
আকাশ থেকে পড়লাম! এ কোন দেশে এলাম গো! দোকানদার টিপস চায়। কিন্তু সে শ্রীমতী পালের আঁচল ধরে রেখেছে, ছাড়বেই না। বোঝা গেল এটাই এখানে দস্তুর - বিদেশি পর্যটকদের কাছে স্নেহের প্রত্যাশা। শ্রীমতী পাল তাকে দিলেন পাঁচ মার্কিন ডলার; আর নতুনগ্রামের কাঠের প্যাঁচার ছোট্ট একটি লকেট। সেটি পেয়ে সে ভারি খুশি।
সেদিন সন্ধ্যাটা ফাঁকা ছিল। আমরা রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেহেঁটে বিস্তর ঘুরলাম। গণেশমন্দিরে পূজা দিলাম, আর স্ট্রিট ফুড খেলাম। অতীতে যাই থেকে থাকুক না কেন, বর্তমানে কাম্বোডিয়ার জনসংখ্যার আটানব্বই শতাংশ মানুষ থেরাবাদী বৌদ্ধ। থেরাবাদী লিখলাম কারন হীনযান শব্দটি আজকাল আর প্রচলিত নয়। থেরাবাদীদের চরম লক্ষ্য অর্হৎত্ব প্রাপ্তি, অর্থাৎ প্রকৃত ভিক্ষু হয়ে ওঠা; ও পরিণামে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি। জন্মান্তর বাদ বা কর্মফলের ধারণা এদেশে বহুল ব্যাপ্ত। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯, কিমায়র রুজ শাসনকালে সকল ধর্মাচরণ নিষিদ্ধ ছিল; তাতে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়নি। ১৯৭৯তে ওই সরকারের পতনের পর বর্ষার জল পেয়ে গ্রীষ্মের শুকনো ঘাসের সঞ্জীবিত হওয়ার মতন, ধর্মাচরণ ফিরে এসেছে হইহই করে।
এঁদের আরাধ্য দেবদেবীদের মধ্যে আছেন পঞ্চ বোধিসত্ত্ব – অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, ক্ষিতিগর্ভ, মহাস্থমপ্রাপ্ত ও সামন্তভদ্র; পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধ - বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি এবং অক্ষোভ্য - এই পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধর পঞ্চশক্তি তারা, মামকী, পাণ্ডরা, আর্যতারা এবং লোচনা। তবে প্রধানতম অবশ্যই হাসিখুশি মোটাসোটা টেকো চৈনিক হাস্যরত বুদ্ধ (Laughing Buddha, Hotei, Pu-Tai)। ইনি স্নেহশীল, দুঃখহর ও বাৎসল্যরসে পূর্ণ, সৌভাগ্য, প্রাচুর্য ও শান্তি প্রদায়ী। এনার হাতে রেশমের ঝোলা, সেটি সর্বদাই ধানচারা (সমৃদ্ধির প্রতীক), ভালো ভালো খাবার জিনিস, চকলেট লেবেঞ্চুস কিসমিস বাদামে পরিপূর্ণ। শিশু, প্রবীণ, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও দরিদ্রদের প্রতি তার মমতা অসীম; তিনি ভোজনস্থানসমূহের রক্ষাকর্তা। কখনও তাঁর হাতে ভিক্ষাপাত্র, কখনও তার পাশে ছেলেপিলের দল, কখনও তাঁর হাতে পাখা, কখনও বা তিনি টানাগাড়িতে সমাসীন। ইনি বোধিসত্ত্বের এক রূপ, শেষের সেই দিনে ইনিই আসবেন মৈত্রেয় নাম নিয়ে। এঁর সঙ্গে দেহগত সাদৃশ্যের কারণেই হোক, বা হস্তী সংযোগের কারণেই হোক, (গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে মায়াদেবী শ্বেতহস্তীর স্বপ্ন দেখেছিলেন); আমাদের পাড়ার গণেশদাদাও দেখলাম এদেশে তুমুল জনপ্রিয়। ক্ষুদ্রতম ইঁদুর ও বৃহত্তম হাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রতীক এই গণেশ; জানালেন আমাদের হোটেলের এক দিদি।
পরদিন অর্থাৎ ছ তারিখে হোটেল (Angkor Holiday Hotel Sivatha Rd, Krong Siem Reap, Cambodia) ছেড়ে বিমানবন্দর। Cambodia Angkor Airlines এর উড়ান VN 3818, Airbus 320, XU 356, সায়গনে নামলাম সাতান্ন বছর পর।

~ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য ~

হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূল ক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সে বিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালের বাংলায় ভ্রমণকাহিনি লেখালেখির প্রেরণা 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না।'

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher