একলা মেয়ে ইথিওপিয়ায়

যশোধরা রায়চৌধুরী



জোসেফিন মথুঙ্গালুয়াঙ্কা আমাকে প্রথম খেয়াল করিয়ে দিলেন, আমি এক মহিলা অডিটর, এবং এই গ্রুপে অন্যতম একজন। এক ঝাঁক কালোকোটের মধ্যে, কামিজে অথবা স্যুটে, আমার আলাদা একটা পরিচয়। অডিট টিমের নেত্রী। বাহবা দিলেন। বাহবাটা পেয়ে ঠিক কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেব, বুঝতে পারছিলাম না।
বহুদিন আগে একটি জুলু উপকথা অনুবাদ করেছিলাম, একটা জায়গার নাম ছিল, NTUMJAMBILI… বাংলায় লিখেছিলাম ন্তুনজাম্বিলি। সেই থেকে জানি, এই ধরণের ব্যঞ্জনবর্ণের যুক্তাক্ষর দিয়ে নাম শুরু করার ধারাটি এখানে আছে। বেশ কঠিন উচ্চারণ করা। এম বা এন অক্ষর দিয়ে শুরু হচ্ছে। তারপর আবার ব্যঞ্জনবর্ণ। ম্-ম্ বলার সময়ে যে ম্-ম্ উচ্চারণ, সেইভাবে বলতে হবে মথুঙ্গালুয়াঙ্কা, এইভাবে উচ্চারণ করা ছাড়া উপায় নেই। তা সেই জোসেফিন মথুঙ্গালুয়াঙ্কা আমাকে বললেন, আমি গর্বিত যে আপনি মহিলা হয়েও ছজনের এই দলের নেত্রী হয়ে আমাদের অডিট করতে এসেছেন।
বোঝ! এমনটা ত ভেবে দেখিনি কখনো। ভারতের বাইরে অডিট করতে গেলে, দেখেছি অকারণে কলার উঁচু করার এমন মওকা আসে। এবারও এল। এসেছি আদ্দিস আবাবায়, ইউনাইটেড নেশন্স বা জাতি সংঘের আফ্রিকার আঞ্চলিক কমিশনে অডিট করতে। অত্যন্ত কর্মপটু এই মথুঙ্গালুয়াঙ্কা, থুড়ি জোসেফিন। এবং পোশাকে সেই রঙের ছটা। যা বাদামি ও কালো চামড়ার বৈশিষ্ট্য। উজ্জ্বল ছাপা ড্রেস, সঙ্গে বড় পুঁতির মালা ও কানে বড় বড় টপ। সবটাই কালার কো-অর্ডিনেটেড।

ইথিওপিয়ায় বেশ বড় দু তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে। এক এই ইকনমিক কমিশন ফর আফ্রিকা। তাছাড়া ইউ এন বা জাতিসংঘের ছাতার তলায় বেশ কয়েকটি সংস্থা এই একই ক্যাম্পাসে। অন্যটা আফ্রিকান ইউনিয়ন। আফ্রিকার ছাপান্নটি দেশ ইকনমিক কমিশনের সদস্য। আর সংস্থায় গিসগিস করছেন অর্থনীতিবিদ আর সংখ্যাতাত্বিক। থিংক ট্যাঙ্ক এটা। গোটা আফ্রিকা মহাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতিকে হালকা গুঁতো বা কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে পরিবর্তিত করতে চেষ্টা করেন। নেগোসিয়েশন আর হ্যান্ড হোল্ডিং ওঁদের প্রিয় শব্দ। অর্থনীতিবিদের অনেকেই আফ্রিকার নানা দেশের থেকে এসেছেন। তার তলায় আছেন প্রচুর পরিমাণে পাকিস্তানি ভারতীয় কর্মীরা, মধ্যবর্তী পদগুলোয়। যাঁরা অফিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেখেন। আর আছেন সাপোর্ট স্টাফ।

জানা যেটা গেল, তা হল ইউনাইটেড নেশন্স এর নীতি আছে জেন্ডার ব্যালান্স রক্ষা করার। ৪০ শতাংশের বেশি নারীকে চাকরি দেবেন খাতায় কলমে এরকমই বিধি। আমরা সে শতাংশের হিসেব ও অডিট করে দেখলাম। তাছাড়া আছে নানা দেশ থেকে মানুষদের চাকরি দেবার রীতিও।

হঠাৎ পেয়ে গেলাম রত্নখনি এক। নিউ ইয়র্কে ইউ এন হেডকোয়ার্টারের করা এক সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের ওপর সার্ভে। যদিও সার্ভে রেজাল্ট গোপনীয় এবং অন্যত্র ব্যবহার করার নিষেধ থাকায় তা আর পাঠকদের কাছে পেশ করতে পারলাম না। কাজের নীতিভঙ্গ করা ঠিক নয়। তবে এটুকু বলাই যায় যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ হল ইউ এন-এ রয়েছে যৌন হেনস্থা সম্পর্কে জিরো টলারেন্স নীতি। অন্তত খাতায় কলমে। তবু গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা বলেই, একটি হেনস্থার "কেস" থাকা সত্ত্বেও তা আমরা দেখতে পাইনি। আইনি কড়াকড়ি। যা মন্তব্য টিপ্পনী কেটেছি সবই ওই সার্ভে রিপোর্ট সম্বল করে।

এসব ত গেল কেজো কথা। আদ্দিস আবাবায় তিন সপ্তাহ থাকার সূত্রে দেখতে পেলাম কত কী। নিজের চোখের দেখার যা মাহাত্ম্য তাইতে জানা গেল আরোকিছু। খবরের সূত্রে সর্বত্র আলোচিত। নতুন ইথিওপিয়া জন্ম নিচ্ছে, এ দেশের প্রেসিডেন্ট সালে ওয়ার্ক জেউদি একজন মহিলা, ৫০% মন্ত্রী মহিলা। সদ্য ২০১৮ তে ক্ষমতায় আসা আবি আহমেদ এই আশ্চর্য কর্মটি করেছেন। এক নতুন আকাশ খুলছে মেয়েদের জন্য। কিন্ত পথেঘাটে যে মেয়েদের দেখেছি তাঁরা কর্মী, শ্রমিক, ব্যাঙ্ক বা ছোটখাট বিজনেসের কেরানি। হাতে সস্তা কিন্তু চটকদার ব্যাগ, পায়ে হিলজুতো, পাশ্চাত্যের পোশাকে তাঁরা অফিস যান, ট্যাক্সি বা অটো ধরণের পাবলিক যানবাহনের অপেক্ষায়, প্রচন্ড ভিড় ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়ান বাস স্টপে ও স্টেশনে, পথের দোকান থেকে কিনে খান বাদামভাজা। মানুষের ঢল নামে সকালে আর বিকেলে, অফিস টাইমের ট্রাফিকে। এই মেয়েদের দেখলে আশা জাগে। মনে হয় কর্মভূমিতে মেয়েদের যোগদানের বিষয়টি এখানে বাস্তব। এখানে মেয়েরা নিজেদের জন্য একটুকরো পৃথিবী খুঁজে নিচ্ছে।
ছুটির দিনে রাস্তায় দেখি অন্য রকম মেয়েদের। হয়ত বাকি পাঁচটি দিনে ফ্রক বা স্কার্টের মেয়েরাই খ্রিস্ট উৎসব টিমকেট-এর দিনে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রথাগত সাজে। সাদা নরম সুতির উজ্জ্বল রং উজ্জ্বলতর রোদ্দুরে ঝকঝকায়। পথে ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা দল বেঁধে, লাল বেগুনি ছাতা নিয়ে, আর সাদা ট্র্যাডিশনাল পোশাকে মিছিল করে উৎসবপালনে নামে। তাদের ছিমছাম বাদামি সুন্দর চামড়া মনে করিয়ে দেয় 'উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ' শব্দযুগলের মানে। পুরুষ নারী নির্বিশেষে ইথিওপিয়ার মানুষ অসম্ভব ছিপছিপে। ভুলি না, ছোটবেলা থেকে জেনেছি এ দেশে, বা পার্শ্ববর্তী সোমালিয়ার, দুর্ভিক্ষ আর খাদ্য সংকটের গল্প। ভুলি না এও, যে আজও প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক খেলার মঞ্চেই, দৌড়বীর হিসেবে সোনা জিতে চলেছে ইথিওপিয়ার ছেলেমেয়েরা। যে শীর্ণতা খাদ্যহীনতার সে শীর্ণতা নয়, যে শীর্ণতা সুস্বাস্থ্য আর সু-অভ্যাসের, তাইতেই তাই মজে যেতে পারি আমি।


প্রাচীনতম খাদ্য সংস্কৃতি

ইথিওপিয়ার মানুষের বিনয় আর ভদ্রতার তুলনা নেই। রোগা রোগা মানুষগুলোর সুষমাও দেখার। ছিপছিপে কৃষ্ণবর্ণ সুদর্শন পুলিশ গাড়ি ভুল রাস্তায় ঘুরলে "সালাম" বলে গাড়ি থামিয়ে স্যালুট মেরে পর্চি কাটে, ২০০ বার (ভারতীয় টাকায় ৫০০) নিয়ে নেয় ফাইন হিসেবে, তারপর মিষ্টি হেসে আবার স্যালুট করে। শরীরী ভাষায় বিনীত ভঙ্গিমা।
এখানে প্রত্যেকে টাকা দেবার সময়ে ডান হাতে দেয় বাঁহাতে ডান কনুই ছুঁইয়ে। ভারতীয়দের ভঙ্গিমা। ভিড়ের মধ্যে পাশ কাটাবার সময়ে শরীর কুঁকড়ে আলতো করে সরে যাওয়াটাও সেই একই সলজ্জ বিনয়ী ভঙ্গিমা।
আফিসে, রেস্তোরাঁয় মিষ্টি হাসি, মিষ্টি ব্যবহার, পথের ভিখিরির হেসে নমস্তে বলা, রাস্তার "পালিশ" হাঁকা ছেলের হেসে হেসে তাকানো।
প্রাচীনতম এই খাদ্যসংস্কৃতি। এখানে মোটা হবার স্কোপ রাখেনি ইথিওপিয়া। এদের কোনও প্রথাগত সুইট ডিশ নেই। চিনি বস্তুটিই নাকি এ মহাদেশে ছিল না। খাবার দাবারের মূল আধার ইনজেরা আর সব্জি। মাংস। সব্জির মধ্যে বাঁধাকপি, বিট, নানা ধরণের ডাল জাতীয় বস্তু। ছোট বড় ছোলা, ছোলার ডাল, রাজমা ধরনের রান্না। আর ইনজেরা হল ফাঁপিয়ে তোলা কার্বোহাইড্রেট, কিন্তু অতি স্বাস্থ্যকর। দেশে দেশে বা পাশ্চাত্যে তাই তার এত কদর। ইনজেরায় তেলের নামগন্ধ নেই।

আদ্দিসে প্রথমে ভয়ে ভয়েই খেয়েছিলাম ইনজেরা নামের সেই পাকানো রুটি। দারিদ্র্য দুর্ভিক্ষ অনাহারের কাহিনির মাঝে আমরা জানিই না ইথিওপিয়ান খাবারের কথা, তবে সারা পাশ্চাত্য এখন ইথিওপিয়ান ফুড বলতে অজ্ঞান। টেফ নামক এক শস্যের দানা অনেকটা পোস্তোর মত দেখতে। তাকে হামানদিস্তে তে বা জাঁতায় গুঁড়ো করে (কী বিশাল সব ভারি ভারি পাথুরে জিনিস সে সব) তারপর তিনদিন ভিজিয়ে গেঁজিয়ে তুলে, তারপর তাওয়ায় অনেকটা দোসার মত বানিয়ে রোল করে রঙিন বেত বা ঘাসের বোনা ঝুড়িতে রেখে রেখে খাওয়া যায় আরো তিনদিন।
ইনজেরা সচ্ছিদ্র, স্পঞ্জের মত। তাই থালায় ইনজেরা পেতে তাইতে ছোলার ঘুগনি বা রসাকষা মাংসের ঝোল ঢেলে খায়। স্পঞ্জের মত সব ঝোল শুষে ঢোল সে ইঞ্জেরা তখন রসসিক্ত সুস্বাদু। এমনিতে টক টক স্বাদ। ঝোলে ডুবে অমৃত। দেশে বিদেশে গ্লুটেন ফ্রি দানা বলে টেফ দানার খুব নাম। ইনজেরা কারবোহাইড্রেট কিন্তু যেহেতু গ্লুটেন ফ্রি, তাই স্বাস্থ্যকর। গ্লুটেনের থেকেই খাদ্য শস্যে আসে আঠালো ভাব, যেটি থাকে গমের ময়দা বা চালে। কার্বোহাইড্রেট খাওয়া হবে অথচ আপনি মেদবহুল হবেন না। এমনিতেই ইথিওপিয়দের সূক্ষ্মশরীর দেখে দেখে হিংসে হচ্ছে। তারপর যখন জানছি এই ইনজেরা খেয়েই এঁদের এই গড়ন, অধিকাংশ কন্যাই তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা, তখন আরও বেশি ভাল লাগছে খেতে। ইনজেরার স্বাদ, সামান্য ফাঁপানো বলেই টক টক। দোসার ভাইবেরাদর বলে ভাবা যেতেই পারে তাকে। সঙ্গে থাকে নানা ধরণের দানা বা ডালের ঘুগনি বা থকথকে তড়কা জাতীয় বস্তু। অথবা মাংসের লাল লাল ঝোল। সরু সরু কাটা রেড মিটের একটা ভাজি ধরণের জিনিস দিয়ে ইনজেরা অমৃত সমান। সঙ্গে সুপ্রচুর স্যালাড। ইথিওপিয়াতে বিটের স্যালাড খেয়ে আমি মুগ্ধ। মনটা তর্ হয়ে যায় এজাতীয় তাজা সব্জির ভাপানো স্যালাড খেলে। সঙ্গে অনেক লেবু আর অলিভ অয়েলের তরজা একেবারে খোলতাই করে বিটের মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ। এই বিট এদের সব লাঞ্চ স্প্রেডেই আছে। আছে বড় বড় ঝালহীন সবুজ লংকা, আছে অনেক গাজর, বাকি ত সবুজ সব্জি আছেই। শসা টমেটো ইত্যাদি। সব মিলিয়ে থালার ওপরে নানা রঙের এমন চমৎকার এক মেলা বসে যায়, বর্ণবহুলতায় যে কোন আর্টিস্টের প্যালেটকে হার মানায়।
কালো কফি আর এই নানা রঙের খাবার, ইথিওপিয়া খাবার দিয়ে জিভের ভেতর দিয়ে মরমে পশিবে খুব দ্রুত।
ইথিওপিয়ার বিখ্যাত কফিতে কোন চিনি দুধের বন্দোবস্ত নেই। ছোট্ট হাতলহীন কাপে কড়া কালো কফি খেয়ে নেয় ঢক করে। পথের ধারে চায়ের ঠেক যেমন ভারতে, এখানে তেমনই কফির ঠেক। ইথিওপিয়াকে ধরা হয় কফিবিন নামক আশ্চর্য যাদু বীজটির জন্মস্থান। কফির উদ্ভিদটি আর কফি পানের সংস্কৃতি দুইই ইথিওপিয়ার মাটিতে জন্মেছে বলে ধরা হয়, যেমন নাকি আদি মানবী লুসি-র হাড় গোড় পাওয়া গেছে বলে এখানকার জীবাশ্ম-বন্ধু মৃত্তিকাস্তরগুলিকে "ক্রেডল অফ সিভিলাইজেশন" বলা হয়।
ভাবা হয় নবম শতাব্দী নাগাদ ইথিওপিয়াতে কফির বাদামগুলো থেকে কালো ওই তরল পানীয়টি আবিষ্কৃত হয়ে। আজ দেড় কোটি ইথিওপিয়াবাসী কফি চাষ, কফি তোলায় ব্যাপৃত। কফি কালচার এতটাই মূলে সম্পৃক্ত ইথিওপিয়ায়, যে ভাষাব্যবহারে, প্রবাদে, বাগধারায়, বার বার এসে পড়ে কফি। সংস্কৃতির ভেতরে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এই কফি কালচার। জীবন যাপন এমন কী প্রেম ভালবাসার কথাতেও কফি এসে যায় বার বার। যেমন "বুনা দাবো নাও" শব্দবন্ধের মানে "কফি আমাদের রুটি"। আরেকটা এমন বাগধারা, "বুনা তেতু"। এই আমহারিক বাক্যাংশের মানে, "কফিপান" হলেও, এর অর্থ সামাজিক মেলামেশা, কফিপানের সূত্রে দেখাসাক্ষাৎ। উত্তর ভারতীয়দের চায়পানি, বা বাঙালির চা খাবেন তো, বা আরো বেশি করে 'চায়ের আড্ডা' মনে পড়ছে, তাইনা? 'আমার কফি পানের সঙ্গী নেই' আমহারিক ভাষায় এটা বলা মানে আমি নিঃসঙ্গ।
কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় যেমন হঠাৎ গজানোর কাল্টুদার চায়ের ঠেক বা বৌদির চা, অথবা গজাদার লেবু চায়ের বেঞ্চিপাতা ছোট্ট দোকান চোখে পড়ে, গায়েঁ গেরামে যেমন লক্ষ্য করা যায় বাঁশের নড়বড়ে বেঞ্চি অথবা কাঠের পাটাতনে বসা গপ্পুড়ে একদল চা খোর, হাতে ধূমায়িত কাচের গেলাস বা মাটিরভাঁড়, আদ্দিসে এসেই চোখে পড়েছিল সেরকম সব ঠেক। বুঝিনি ওগুলো কফির ঠেক। শেষমেশ লাঞ্চের পর সরকারি ছাপ্পামারা গাইড নিয়ে গেল কফি খেতে ওরকমই এক ঠেকে। প্লাস্টিকের টুল পেতে বসতে দিল মিষ্টিমত মেয়েরা। সামনে ধূপ ধুনো জ্বেলে, গোল থালায় কফি বিন রেখে, কালো সরুগলা কফি-পাত্রটি ঈষৎ হেলিয়ে উনুনের ওপর রেখে সে এক মহাযজ্ঞ।
কফি এল হাতলহীন ছোট বাটিতে। কুচকুচে কালো কফি। চিনি চলবে কিন্তু দুধ মেশানো চলবে না। তিক্ততায় মার্কিন কফিকে পুরো চার গোলে হারিয়ে দেবে। ভীষণ মিষ্টি দেখতে সবুজ পাতা দেবে সঙ্গে, হার্বটির নাম "রু", সেটায় আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ। কফিতে ফেলে দিলে কফিও সুগন্ধিত, আমোদিত।
রাশি রাশি লোক গোল হয়ে টুলে বসে কফি খাচ্ছে, রাস্তাঘাটে এইটে দেখার পর মনে হয় কত চেনা এই দেশ, এই সংস্কৃতি।


আদিমাতা লুসি

মিউজিয়ামের গল্প বলি, যেখানে লুসিকে দেখেছিলাম। আদিমাতা লুসি। ইথিওপিয়া হল ক্রেডল অফ সিভিলাইজেশন। তাই এখানেই পাওয়া গেছে এই নারীর হাড়গোড়।
লুসি হল ৩ মিলিয়ন বছর আগের নারী। পূর্ণ বয়স্কা নারী। কেননা আক্কেল দাঁত অব্দি উঠে যাওয়া চোয়াল পাওয়া গেছে। দাঁত ও পেলভিক বোনের স্ট্রাকচার দেখলে বোঝা যায় যে এই প্রাণী বাঁদরের চেয়ে বেশি মানুষ। তাই এ ছিল ১৯৭৫ নাগাদ আবিষ্কৃত প্রাচীনতম মানুষ। ওর স্থানীয় নাম দেম্লেস্ক, বা অনন্যা।

লুসিকে দেখা আদ্দিসে যেমন জরুরি, তেমন জরুরি হাইলে সেলেসির প্রাসাদ দেখা। এই সম্রাট ইথিওপিয়ার নবজন্মদাতা। তাঁর দান করে যাওয়া বিশাল প্রাসাদ আজ বিশ্ববিদ্যালয়। আদ্দিস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িটির একাংশ এখন যাদুঘর। মিউজিয়ামে এথনোগ্রাফির নানা বিষয় রক্ষিত। অসাধারণ কালেকশন । সেলেসি সম্রাটের প্রাসাদের বাগানে প্রচুর পোষা সিংহ ঘুরে টুরে বেড়াত। ইতালিয়রা ১৯৩৫ সালে ইথিওপিয়ায় ঔপনিবেশিক আক্রমণ চালায়। ১৯৩৭ অব্দি চলে সেই যুদ্ধ। ইতালিয়রা সেলেসির প্রাসাদের বাগানের সিংহদের গুলি করে মারে, একটি সিংহের স্টাফ করা দেহ দেখিয়ে সেই রোমাঞ্চকর ভয়াল ইতিহাস বলেন গাইড। প্রতি সংগ্রহালয়ে, প্রতি ক্যাথিড্রালে চিহ্ন আছে, হাতে আঁকা লোকরীতির বড় বড় প্যানেলে পটচিত্রের স্টাইলে আঁকা আছে পরবর্তী বিশাল এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ইতালিয়দের দূরে হটিয়ে আবার ইথিওপিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের সে ইতিহাস। যার হিরো সেলেসিই, আর কেউ নয়।
আমরা দেখি সম্রাটের শোবার ঘর, তাঁর ডাকটিকিটের সংগ্রহ, ভারত থেকে আসা বড় বড় মানুষের সই যেমন রাধাকৃষ্ণনের … ছবি, উপহার…। সেলেসি ১৯৬১ অব্দি সম্রাট ছিলেন, ওই প্রাসাদও ছিল তাঁর। ১৯৬৩ তে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয়ে যায়।



পথ হারানোর গল্প

খোলা আকাশ, পাহাড়, ক্যাথিড্রালের সামনে বিশাল ঢাক বাদ্যি বাজিয়ে টিমকেট। অসামান্য স্যালাড আর ইনজেরা খাওয়া। আর অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কার যেন বাঁশির সুর। অনেক রাত অব্দি পাশের হোটেলে শনিবার রাতে পার্টি করা ইউরোপিয় যুবকযুবতীদের হুল্লোড়। সকালে দুপুরে পথে দেখা বেকার স্থানীয় যুবক, বৃদ্ধ ভিখিরি। ভিখিরি বৃদ্ধের চেহারা সারা পৃথিবীর যে কোন গরিব মানুষের মত। চোখে শত শত বছরের ইতিহাস ছলকে ওঠে।
আমি একা মহিলা, কালো ট্রাউজার আর সাদা ব্লাউজে, গলায় ইউনাইটেড নেশন্স এর ব্যাজ ঝুলিয়ে আপিস যেতে যেতে ভাবি, এই পৃথিবীকে সাদাকালোয় দেখা আমার আর হল না।/p>

আদ্দিসের দ্বিতীয় দিন লড়াই লড়াই লড়াই চলছে তখন। একটা দল নিয়ে অডিট করতে এসেছি। তবে দলে আমিই দলছুট, আমি হোটেলে। অন্যেরা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। হোটেলটা গুগুলে দেখিয়েছিল অফিসের কাছে, হাঁটা রাস্তায়, কিন্তু আদপেই তা নয়। হাঁটতে পারা যায় না।
এমনিতেই এই আদ্দিস হল পৃথিবীর অন্যতম উচ্চতম রাজধানী। ফলত হাঁটলে একটু সময়েই খুব হাঁপিয়ে পড়ি আমরা। জানুয়ারি মাস, শীত আছে তবে সাংঘাতিক নয়। বাতাস স্বচ্ছ, আকাশ নির্মল। শিল্প বেশি নেই তাই দূষণ নেই। আকাশের নীল ঈগলের নখের মত ধারাল। চারিপাশে জবা ও ঝুমকো লতার ঝোপ। অথচ হাঁটলে আউট অফ ব্রেথ লাগে। হাঁটার পথে চড়াই উৎরাইও প্রচুর।
পরিবেশ আরও ঘোরালো করে তুলেছে হাঁটা রাস্তায় অগুনতি মানুষের ভিড়। ময়লা জামাকাপড়ের দরিদ্র বেকার যুবক... মোটামুটি ভদ্রস্থ অফিসগামী তরুণতরুণীর ভিড়ে পথ চলা দায়। তাছাড়াও শতচ্ছিন্ন পোশাকে ভিখিরি, যাদের পথে ঘাটে দেদার দেখছি। একেবারে তৃতীয় বিশ্বের ম্যাক্সিমাম দুরবস্থার চিত্রটি আদ্দিসে দেখা গেল।
আর সেই জাতিসংঘের ম্যান্ডেটরি সিকিওরিটি ব্রিফিং। এখানে নাকি রাস্তায় বেরলেই স্ন্যাচিং মাগিং চুরি বাটপাড়ি ছিনতাই। এমন ভয় দেখিয়েছে গোড়া থেকে!!!
কাল ত আমরা সদলবলেই হাঁটলাম, হেঁটে ফিরলাম আপিস থেকে আমার হোটেল অব্দি। আর ওরা গেল ট্রেনের স্টেশনে বাদুড়ঝোলা ট্রেন ধরতে। আমাকে পথে মাতাল বিশালাকৃতি এক মানুষ তেড়ে এল কীসব বলতে বলতে। কোনমতে এড়িয়ে বাঁচি।
ছোট ছোট সিগারেটের দোকান ইত্যাদিতে পথিপার্শ্ব পরিপূর্ণ। সেখানেই ঘুরেফিরে বেড়ানো দশ বছরের বাচ্চারা "আম্মা" বলে জামা টেনে মুখে আঙুল দিয়ে বোঝায় তিন দিন খাওয়া হয়নি। বৃদ্ধ ভবঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আর অজস্র বেকার যুবক সিগারেট টানে ফুটপাতে খবরের কাগজ পেতে বসে। তৃতীয় বিশ্বের মলিনতা এঁটে বসে আছে এ দেশে, এ শহরে।
কাল পথে অনেকটা হাঁটলাম, আজ কাগজপত্র সব হোটেলে রেখে বেরলাম, তথাপি যেন আজই বিপদ ঘটার অবস্থা ছিল। সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় এরকম বিপদেও পড়ে মানুষ?
ট্যাক্সি প্রথমে ভুল পথে চলতে শুরু করল। কালকের ট্যাক্সি যেদিকে গেছিল তার উল্টোদিকে। কিন্তু ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে যতবার বলছি ই সি এ, সে তার স্মার্ট ফোনের জি পি এসে দেখায়, সে ত ই সি এ যাচ্ছেই। তাহলে আর কেন চেঁচাই। চুপচাপ বসে রইলাম। আমার স্মার্টফোন কাজ করছে না কারণ লোকাল সিম নেই। লোকাল সিম নেই কারণ সিমের দোকান খুঁজে পেলেও তা বন্ধ ছিল আর অনেক কাগজ পত্র লাগবে সেসব নিতে, তাই কাল হয়নি।
আমহারিক ভাষা বলেন ইথিওপিয়াবাসীরা। ইংরেজি বোঝেন। তা, ই সি এ-র এক নম্বর গেটের সামনে এসে ট্যাক্সি আমাকে ছেড়ে দিল। সে গেটে বাইরের গাড়ি অ্যালাউড না। শুধু জাতিসংঘের স্টিকার দেওয়া গাড়ি। এদিকে সেই গেট এমন নিশ্ছিদ্রভাবে তৈরি, যে তা দিয়ে শুধু গাড়ি ঢোকে, কোনও ব্যক্তিমানুষ হেঁটে ঢুকতে পারবে না। এদিকে আমিও কলকাতার কিপ্টে, ভাবলাম ট্যাক্সি নিয়ে আবার কোথায় কোথায় ঘুরব, আমার চেনা তিন নং গেট পৌঁছতে গিয়ে আরও দেড়শ টাকা ( ওদের টাকার নাম বার) নিয়ে ফেলবে। তাছাড়া এক থেকে তিন নং গেটে গাড়ি নিয়ে কিভাবে যাওয়া যায় তাও জানা নেই, তাছাড়া ও ভাষা বুঝছে না, আমাকে ওখানেই নামিয়ে দিতে চায়, কারণ নিয়ম মতো ও ত আমাকে ই সি এ তে পৌঁছে দিয়েইছে!!!
ট্যাক্সি ষাট বার নিল, আর আমাকে এক নং গেটের সামনে ফেলে চলে গেল। কিন্তু আমি ত অথৈ জলে পড়লাম। গেটের লোকরা ত লোকাল, ভাল ইংরেজি বোঝেনা। যতই আই কার্ড দেখাই নিয়ম থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুতি চলবে না। সাফ বলল, গো টু গেট টু। ব্যাস। হাঁটা শুরু। হেঁটেই চলেছি হেঁটেই চলেছি, ই সি এ র পাঁচিল শেষ হয়ে গিয়ে ভাঙাচোরা রাস্তা আর অচেনা বাড়ি, ঘর দোর শুরু। আর পথে লয়টারিং লোয়ার ক্লাস ত আছেই। তার ওপর উচ্চাবচ রাস্তা, অল্পেই পুরো হাঁপ ধরে যাচ্ছে। ভয়ে বুক ধক ধক করছে। উফফ সে কী দুঃস্বপ্নের মত নরক যন্ত্রণা। আমার এটা খুব ফেভারিট দুঃস্বপ্ন, এমনিতেও বহুবার দেখেছি। অচেনা শহরে পথ হারিয়েছি, কেউ আমার ভাষা বুঝছে না। এ স্বপ্নও সত্যি হল তবে!!
হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে এক মহিলা দেখলাম বারান্দায় কার্পেট ঝাড়ছেন, ছোট ফ্ল্যাট বাড়ির বারান্দা। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাষা বুঝলেন না। তারপর অফিসগামিনী এক মেয়েকে পেয়ে ধড়ে প্রাণ এল। জিগালাম, ই সি এ কোনদিকে? সে যেদিক বলল সেদিকে খানিক গিয়ে হিন্দি সিনেমার সর্বধরণের ক্রাইমের আখড়ার মত দেখতে একটা বিশাল কনস্ট্রাকশন সাইটের পেল্লায় পেল্লায় খাঁচার মত স্ট্রাকচারের মধ্যেখানে এসে পড়লাম, কোন প্রপার রাস্তা নেই, ঘেঁষ ফেলা কাদা ভরা ভাঙাচোরা রাস্তা আর তার মধ্যে দিয়ে গাড়িও চলেছে। কোনমতে হাঁটছি আর দেখছি নোংরা চটের বস্তা পরা কুলি কামিন শ্রমিকরা কাজ করে চলেছে শুধু।
ধুম ধাম আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ মনে হল ঘাড়ের ওপর এবার যদি ষোল তলা থেকে একখান ভর্তি সিমেন্টের বস্তা এসে পড়ে, কাগজে বেরবে সিমেন্টের বস্তা চাপা পড়িয়া ভারতীয় অডিটরের আদ্দিস আবাবায় বেঘোরে মৃত্যু।
উফফ। সেই ভাঙা রাস্তা অবশেষে এসে পড়ল আয়ারল্যান্ড আর জার্মান কনসুলেটের গেটে। তারা আমাকে পরের গেট, পরের গেট বলে দিল। ইউনিফর্ম পরা শিক্ষিত দারোয়ান বা অফিস যাত্রী মহিলা ছাড়া আর কেউই নেই জিজ্ঞাসা করার মত।
শেষ মেশ আপিসের তিন নম্বর গেট। প্রচুর কাগজ পত্র দেখান। ভেতরে ঢুকে ধড়ে প্রাণ এল।


ভারতের চিত্রতারকা ও ইথিওপিয়ান

আজ আমাদের গাইড বলল সে অক্ষয় কুমারের ফ্যান। তাছাড়া শাহরুখের কথা ত জনে জনেই বলে। আজ আমাদের প্রহ্লাদ সিং-কে শাহরুখের ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে গাইড অন্য এক ইথিওপিয়ানের সঙ্গে। এখানে লোকাল ভাষায় হিন্দি ছবিগুলো ডাব করা হয়, বড়সড় এক ইন্ডাস্ট্রি।
মুসলমান হওয়াতে সালমান শাহরুখ আমিরের গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। শাহরুখ নামে কোন এক মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত সুলতান ত ছিল। সেটাও বলল কে যেন। স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাজারে আমাদের দেখে, কিনতে ডাকছিল। গাদা গাদা লোক নমস্তে নমস্তে বলছিল, অনেকে বাবুজি বলে হাঁক দিচ্ছিল। আর ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া বলে আওয়াজ দিতেও শুনলাম অনেক কে। আমরা ছজনে ভারতের চার দিক থেকে এসেছি। আমি কলকাতা, দুজনে দক্ষিণী, দুজন লখনউ আর একজন বিহারী। তাও আমরা যে ভারতীয় সেটা বাইরের দেশে এলে লোকে কেমন সহজেই বুঝে ফেলে, আজও।
মেরকাতোতে এক বিশাল বড় বোচকা নিয়ে একটা লোক আসছিল, আমি শামসেরকে বললাম হট যাও, অমনি সেই মজুরটি হজ্জাও হজ্জাও বলে চেঁচিয়ে উঠল।


ধর্মের মেল্টিং পট

লালিবেলার সুপ্রাচীন প্রস্তরনির্মিত ক্রসটি দেখলে কেন জানি না আমার মক্কার কাবার কথা মনে পড়ে। প্রাচীনতা, বিশালতা, আর তীর্থযাত্রীদের নিবিড় ধর্মচেতনায় কোথাও কি মিল আছে? হয়ত অনধিকারীর মত কথা বললাম।
অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম, ইথিওপিয়ার দুটি প্রধান ধর্ম, মোহাম্মদের সময় থেকে সহাবস্থান করেছে। নবী মোহাম্মদ জীবিত থাকাকালীন ইসলামে প্রথম বিশ্বাসীরা ধর্মান্তরিত হয়েছিল এবং অষ্টম শতাব্দীতে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তীতে সংস্কৃতিগতভাবে অর্থোডক্স চার্চ উচ্চভূমির রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে আধিপত্য বিস্তার করেছে। হয়ে উঠেছিল রাজকীয় আদালতের সরকারী ধর্ম।
খ্রিস্টধর্মের ইথিওপিয়ায় আগমনের তারিখটি ধার্য করা হয় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে। মেরোপিয়াস নামক টায়ারের একজন খ্রিস্টান দার্শনিক ভারতে যাওয়ার পথে ইথিওপয়ার উপকূলে জাহাজ ভেঙে পড়েছিল। মেরোপিয়াস মারা গেলেও তার দুই সন্তানসম ফ্রুমেন্টিয়াস এবং এডিসিয়াসকে উপকূলে পেয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ফ্রুমেন্টিয়াস পরে নীলনদ বেয়ে মিশর যান, খ্রিস্টধর্মের আদি রূপটিকে খাতায় কলমে নথিবদ্ধ করার কাজ এঁদের করা।
গভীর সূত্রে গাঁথা আছে ইথিওপীয় খ্রিস্ট ধর্ম পূর্ববর্তী ইহুদি ধর্মের সংগে। নানা ধরণের পূজা পদ্ধতি, নানা প্রথাগত আচারবিচার সবই নির্দেশ করে সেদিকে।
ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স চার্চের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য, যা ইহুদি ধর্মের মূলেও রয়েছে তা হল প্রতিটি চার্চের হোলি অফ হোলির সিন্দুকের প্রতিরূপের উপস্থিতি, যাকে ট্যাবট বলা হয়। যা শুধুমাত্র পুরোহিতদের দেখার এবং পরিচালনা করার অনুমতি থাকে। অর্থাৎ অধিকারীভেদ, পুরোহিতের বিশেষ অধিকার, এই বিষয়টি মিলে যায়।

আমাদের দেশের বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো, ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মে আছে বছরে দেড়শোর বেশি দিবস ও উৎসব। টিমকেট তার অন্যতম। এপিফ্যানির উৎসব এটি। এটাতে ওই সিন্দুক বা ট্যাবট নিয়ে শোভা যাত্রা করা হয়। যাওয়া হয় জলের কাছে, যে জলাশয়ে খ্রিস্টের মাথায় জলসিঞ্চনের মাধ্যমে দীক্ষাদান অভিষেক হয়েছিল তার প্রতীক হিসেবে।
এই টিমকেটের দিনেই পথে নেমে আসা সাদা প্রথাসিদ্ধ পোশাক পরা মেয়েদের ঢল নামার কথা আগে লিখেছি। ঢোলক বাজিয়ে ঝুমঝুমি র মত কাঠের বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রার সংগে চলা মেয়েরা। তাদের সবার মাথা ঢাকা। সে ঘোমটা সাদা সুতির ইথিওপীয় কাপড়ে। সে কাপড় নরম সুন্দর, কারুকাজ করা পাড় দিয়ে মোড়া।
মাথা ঢাকা দেখলে ভুল হয়, হিজাব পরিহিতা মুসলিম মেয়েদের দেখছি কিনা। না, এঁরা অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিতা।
ধর্ম, পোশাক, নারীর দিনগত জীবন সবটাই ওই বিশাল মানুষের ভিড়ে মিলেমিশে একাকার।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর যশোধরা রায়চৌধুরী কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরে। কবি ও গদ্যকার। পণ্যসংহিতা (১৯৯৬) প্রথম গ্রন্থপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে পরিচিতি। কৃত্তিবাস পুরস্কার ১৯৯৮ ও বাংলা আকাদেমি অনিতা সুনীল কুমার বসু পুরস্কার ২০০৬। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সতেরটি, গল্পগ্রন্থ ও নিবন্ধগ্রন্থ বেশ কয়েকটি। অনুবাদ করেন মূল ফরাসি থেকে। বিবাহসূত্রে ফরাসি ভাষাবিদ তৃণাঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে আবদ্ধ।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher