সবুজ দ্বীপ মৌসুনি
অর্পিতা চক্রবর্তী
অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম মূলখরকা ট্রেক করার পর কোথায় যাওয়া যায়,আবার লকডাউনে কোথাও বেড়ানোর প্ল্যান করতেও ভয় লাগছিল। সময়টা হল ফেব্রুয়ারি মাস, ২০২২। ইতিমধ্যে এই দুবছরে হাতে স্টিয়ারিং তুলে নিয়ে গাড়ি চালানোটাও মা-বাবার আশীর্বাদে বেশ রপ্ত করেছি। টুকটাক এখানে ওখানে, মানে একটু দূরে গাড়ি নিয়ে যাওয়াও হচ্ছিল। হঠাৎ মাথায় একটা প্ল্যান এল। কাছাকাছি সমুদ্রে গেলে কেমন হয়? কিন্তু কোথায় যাব? দিঘা, মন্দারমণি যাওয়া ঠিক হবে না, একটু বেশি ভিড় হয় এই জায়গাগুলিতে। তখনও কোভিডের ভয় সবার মাথাতেই চেপে বসেছিল। তারপর কুহু আর কুহান। দুজনেই খুব ছোটো - ৩ বছর আর ৯ বছর। তাহলে কোথায়? মাথায় এলো, বকখালি গেলে কেমন হয়? হয়তো একটু কম ভিড় হবে। নেটদুনিয়ায় বকখালির বিষয়বস্তু অনুসন্ধান করতে করতে হঠাৎই একটা জায়গায় থমকে চোখ গেল।
পশ্চিমবঙ্গের একদম শেষ, দক্ষিণপ্রান্তে একটি ছোট দ্বীপ, মৌসুনি নাম। তিন দিকে বঙ্গোপসাগর ও একদিকে একটি ছোট্ট নদী। খুবই নির্জন এই জায়গাটি। কেউ যদি গুগল-এ এই দ্বীপটির লোকেশন সার্চ করে, দেখতে পাবে চারদিকে জল আর সবুজে ঘেরা গাছের সারি। কলকাতা থেকে কমবেশি ৮০ কিমি, গাড়িতে প্রায় চার ঘণ্টা থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। আর কোনও কিছু না ভেবে নতুন স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথমেই বলে রাখি যে, মৌসুনি দ্বীপে গেলে পুরোটা গাড়ি নিয়ে কখনোই যাওয়া যাবে না। ডায়মন্ড হারবার হয়ে নামখানা ব্রিজ পেরিয়ে হুজ্জুতির ফেরিঘাটে এসে গাড়ি পার্ক করে রেখে বাকিটা নৌকায় যেতে হবে।
নদীপথে যেতে যেতে চারদিকে সবুজঘেরা দ্বীপটির কাছে যতই এগোচ্ছি, এক অসাধারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা মনকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। ওপাড়ে গিয়ে দ্বীপে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে অবাক হওয়ার হয়তো আরও কিছুটা বাকি ছিল। একটি ছোট্ট গ্রামকে প্রকৃতি যে কত সুন্দর সাজিয়ে রেখেছে তা ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না।
হোটেল বলে মৌসুনিতে কিছু নেই। গ্রামের অনেকটা জায়গা জুড়ে ছোট ছোট ক্যাম্প তৈরি হয়েছে, যেখানে আছে অনেক কটেজ, তাঁবু, মাটির বাড়ি। মোটামুটি ভাড়া পড়বে হাজার থেকে বারোশো টাকার মধ্যে। অফসিজন বলতে তেমন কিছু নেই। বর্ষাকাল বাদ দিয়ে যেকোনও সময়েই যাওয়া যায়। তবে ছুটির দিন আর বিশেষ দিনগুলোতে ভাড়া একটু বাড়তে পারে, যেমন দোল-এর আশপাশে, স্বাধীনতা দিবস, পুজোতে, বড়দিনে। আর এদের খরচের মধ্যে ধরা থাকে প্রথম দিনের দুপুরের খাবার থেকে পরের দিনের সকালের জলখাবার অবধি। প্রথম দিন গিয়ে যেটা দেখলাম চারদিকে নারকেল গাছ আর প্রত্যেকটা গাছে অজস্র সবুজ ডাব। ঘন ঝাউয়ের জঙ্গল আর সমুদ্রের জল প্রকৃতিকে যেন আলাদা একটা মাত্রা এনে দিয়েছে। ক্যাম্পে যাওয়ার পরই আমাদেরকে ডাবের জল দিয়ে স্বাগত জানানো হল। স্নান সেরে যখন দুপুরের খাবার খেতে বসলাম, দেখি সে তো এক এলাহি ব্যাপার! কাতলার কালিয়া, গলদা চিংড়ি, ডাল, আলুভাজা, চাটনি, পাঁপড়। আমরা তো আবার আলাদা করে কাঁকড়ার রসাও খেয়েছিলাম। দুপুরের খাওয়ার পরে দ্বীপটা একটু ঘুরে দেখলাম। সমুদ্রের পাশে এঁটেল মাটি। কিছু কিছু জায়গা বেশি পিছল ও কাদা, মনে হয় সেই জায়গাটিই নদী ও সাগরের মিলনস্থল। তবে আমরা মোহনা পরেরদিন ভোরে দেখতে যাব বলে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। সন্ধ্যেও হয়ে আসছিল।
সন্ধ্যে নামার পর অসাধারণ সাজ চোখে পড়ল। সত্যি কথা বলতে কী আঁধার রাতে প্রকৃতি যে কত মোহময় হয়ে উঠতে পারে আমার জানা ছিল না। আমাদের ক্যাম্পটা চারদিকে আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। একটা ফাঁকা জায়গায় অনেক শুকনো কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছিল, মনে হল ক্যাম্পফায়ার হবে। সত্যি, এক অসাধারণ অনুভূতি! আগুনের ওপর জাল বিছিয়ে মুরগির মাংস পোড়ানো হচ্ছিল। এ যেন আদিম যুগের মানুষের মতো পোড়া মাংস খাবার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বাস্তবে ফিরে আসতে হল। একজন এসে হাতের ওপরে মুড়ি মাখা আর বেগুনির একটা প্যাকেট দিয়ে গেল। আর বলে গেল, একটুপরেই সেই পোড়া মাংস খাবার অভিজ্ঞতা হবে।
যাইহোক, রাতের দিকে সমুদ্রের পাশে ঘুরতে গিয়েছিলাম, দেখি সৈকতের ওপর ছোট ছোট কাঁকড়ায় ছেয়ে আছে। মোবাইলের আলো পড়তেই তারা পালাল। দিঘা, মন্দারমণিতেও ঘুরতে গিয়েছি কিন্তু রাতের সমুদ্রের এত মোহময় সৌন্দর্য আর তার সঙ্গে পোড়া মাংস উপভোগ - এই অভিজ্ঞতা প্রথম। অনেকক্ষণ সমুদ্রের পাড়ে বসেছিলাম। ঘোর কাটল যখন রাতের খাবারের ডাক এল। ঘড়িতে রাত দশটা। ভাত-রুটি-র সঙ্গে কষা মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া শেষ করলাম। সারাদিনের প্রচুর ক্লান্তির জন্য রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়লাম। এই প্রথম মাটির বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা হল।
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় প্রাতঃভ্রমণে বেরোলাম। মৌসুনি গ্রামটিকে ঘুরে দেখলাম। প্রথম যে জিনিসটা চোখে পড়ল সেটি হল,এই গ্রামটিতে মানুষজন যত না থাকে, তার চেয়েও বেশি হয়তো হাঁস মুরগির বসবাস। কী সুন্দর! কত হাঁস গ্রামের পুকুরগুলিতে চরে বেড়াচ্ছে। কিছু মুরগি আর হাঁস একসঙ্গে খাবারও খাচ্ছে। কোনও মানুষকেই ভয় পাচ্ছে না।
একটা মর্মান্তিক দৃশ্য চোখে পড়ল। সেটি হল ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব। ইয়াস ঝড় এই গ্রামটির যে কী ক্ষতি করেছে তা বলে বোঝানোর নয়। কংক্রিটের বাড়ি কীভাবে ভেঙে পড়ে তা এই গ্রামটিকে দেখে বোঝা যাবে। বড় বড় গাছের গুঁড়ি এখনও এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে। এখন আবার মোহনার পলিমাটি তুলে নতুন করে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। এই লেখাটির শেষে আমাদের মৌসুনি ভ্রমণের দুটি ভিডিও লিঙ্ক দেওয়া আছে। আপনারা দেখবেন, নিজেই বুঝতে পারবেন। কিছু মানুষের কথোপকথন-ও তুলে ধরা আছে।
যাইহোক, সকালে খালি পায়ে কাদামাটি মেখে নৌকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। কাছেই অনেক ছোট ছোট দ্বীপ আছে। গঙ্গাসাগর দ্বীপটিও খুব সুন্দর দেখতে। সব দ্বীপই সবুজ চাদরে মোড়া। বেশ মোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম। তবে একটি দ্বীপের কথা না বললেই নয়। সেটি হল জম্বু দ্বীপ। দ্বীপটি বড়ই সুন্দর, কিন্তু কোনও পর্যটককেই যেতে দেওয়া হয় না। কারণ প্রচুর পাখির বসবাস এখানে। আগে অনুমতি পাওয়া যেত। এখন আর যেতে দেয় না। তবে হ্যাঁ, ওখানকার স্থানীয় কোনও লোককে যদি রাজি করাতে পারেন, তবে তো সোনায় সোহাগা। দেখে আসুন জম্বু দ্বীপ। আমাদের কপালে হয়নি যদিও। নৌকাভ্রমণে আপনার সঙ্গী হবে প্রচুর সাদা বক আর পরিযায়ী পাখিরা। আর একটা কথা, প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে একটা জিনিসে খুব মজা হয়েছে, তা হল খেজুরের রস খাওয়া। ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিল।
ক্যাম্পে ফিরে সকালের খাবারের ডাক পড়ল, লুচি-তরকারি, ডিম সিদ্ধ, রসগোল্লা। এবার ফেরার পালা। দুদিনের ছুটি কিভাবে যে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। টোটোতে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল কত কষ্টের এদের জীবনযাত্রা। নদী ছাড়া শহরে আসার উপায় নেই, প্রাকৃতিক দুর্যোগে রেহাই নেই, পর্যটক ছাড়া অনেকেরই আয়ের পথ প্রায় বন্ধ। তবু কত আনন্দে থাকে এরা। ভালো রাখুক ঈশ্বর এদের।
মৌসুনি দ্বীপ ভ্রমণের ইউটিউব লিঙ্কঃ
https://youtu.be/_oK1keHOMvE
https://youtu.be/zQBGHLrx8Vc
পেশায় শিক্ষিকা হলেও কর্মস্থল আর সংসার সামলে অর্পিতা চক্রবর্তী গাছ, জল, মাটি আর পাহাড় দেখার টানে বেরিয়ে পড়েন মাঝেমধ্যেই। "আমাদের ছুটি" কে পেয়ে সেইসব দেখাকে লেখার রূপ দেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে।