ফ্রেডেরিক নগরের সেমেট্রিতে

গৌরব বিশ্বাস


"কাল তো বলছ বেরোবে। কিন্তু ক'দিন যা রোদ হচ্ছে দেখেছ? ঝলসে দিচ্ছে এক্কেবারে। আর দূরও তো অনেক।" একটু মিনতি করেই বললাম আমি।
"ধ্যাড়, আমি সারাদিন অফিস করে এই ঢুকলাম। রোদ আবার কী? ও তো থাকবেই। আর তুই কী এত দূর দূর করিস?"ফোনের ওপার থেকে বলল অনির্বাণদা।
আমি একটু এড়াতেই চাইছিলাম। রোববার দুপুরে কোথায় একটু ভালো-মন্দ খেয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে ভাতঘুম দেব তা না,সারাদিন ভাদরের পচা রোদে টো-টো করে ঘুরতে হবে!তার ওপর সন্ধ্যেবেলা ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ। অত দূরে গেলে সন্ধ্যের আগে ফিরতে পারব কিনা তাও জানিনা।
যাওয়ার কথা হচ্ছিল উত্তরপাড়া। সেখানে একটি আর্কাইভ ঘুরে দেখবার ইচ্ছে। অনির্বাণদা আগে থেকে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করেই রেখেছিল। কিন্তু সে আর্কাইভ রোববার বিকেল তিনটের আগে খোলে না। সেটাই আমার বেঁকে বসবার প্রধান কারণ। তাহলে, সারাদিন রোদে মিছি মিছি ঘুরে মরব!
বিকল্প প্ল্যান বাতলে দিল অনির্বাণদা-ই - " বেশ তো, এক কাজ করি। আমরা শ্রীরামপুরটা ঘুরে নিই। ওখানকার সেমেট্রিগুলো ঘুরে দেখি। আমাদের সেমেট্রি প্রজেক্টের কাজটাও এগিয়ে যাবে। এছাড়াও ড্যানিশ চার্চ-টার্চ, অনেক কিছুই দেখবার আছে শ্রীরামপুরে। সারাদিন সময় কেটে যাবে। তারপর দুপুর নাগাদ ট্রেন ধরে উত্তরপাড়া গেলেই হল। শ্রীরামপুর থেকে গোটা দু-তিন স্টেশন।"
এই প্রস্তাবটা মনে ধরল। এ শহর, শহরতলি ঘুরে বেড়াই সমাহিত অশ্রুত স্বরের খোঁজে। অতঃপর রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে বসে পড়লাম বেঙ্গল অবিচুয়ারি আর উইলসন-এর বেঙ্গল এপিটাফ নিয়ে। কলকাতা আর তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ঔপনিবেশিক আমলের কবরখানাগুলোর খোঁজ করতে এ বইদুটোর জুড়ি নেই।
বইপত্তর ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনেক রাত গড়িয়ে গেল। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি আটটা বাজে। সব্বনাশ! নটা চল্লিশের কল্যাণী সীমান্ত ধরতে বোধহয় আর পারব না।
কোনরকমে স্নান সেরে সামান্য কিছু টিফিন মুখে গুঁজে দে-ছুট। বেলঘড়িয়ার এক নম্বরে যখন পৌঁছালাম, কল্যাণী সীমান্ত তখন হর্ন বাজিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। ট্রেনে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে অনির্বাণদাকে ফোন -" উঠে পড়েছি। তুমিও উঠে পড়ো।"

ব্যারাকপুরে নেমে বাস ধরে ফেরিঘাট। নদী পেরিয়ে শ্রীরামপুরে পা রাখা। বেশ একটা ছিমছাম বিগত দিনের চার্ম আছে শ্রীরামপুরের বাতাসে। দু-এক পা যেতে না যেতেই কলোনিয়াল যুগের পুরনো সব বিল্ডিং। কোনটা রেস্টোর করা হয়েছে। কিছু আবার জীর্ণ, বট-অশ্বত্থের স্নেহধন্য। চোখে পড়ল মিশন গার্লস হাইস্কুল। ১৯২৭-এর বিল্ডিং। একশো বছরও পেরোয়নি। কিন্তু দেওয়ালের গায়ে ফলকটি না থাকলে, পোড়ো বাড়ি বলে ভুল হওয়া আশ্চর্যের নয়। গেট বন্ধ, তাই ঢুকে দেখার মনস্কামনা পূর্ণ হল না। ইচ্ছে করে এসব বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখি। হাত বুলিয়ে দিই জীর্ণ শরীরের গায়ে। শুনব তাদের অন্তরের গহন কথা। সময় বয়ে যাবে স্রোতের মতো।
মা-কে একটা ফোন - পৌঁছসংবাদ দিয়ে দিলাম। তবে খেয়া পেরিয়েছি সে কথা বলিনি। মা বলে, জলে নাকি আমার ফাঁড়া আছে। তখনও ধারণা করতে পারিনি, সামনের গোটা দিনটা কী মারাত্মক হতাশাজনক হতে চলেছে।
আমরা আগে যাব কেরী সাহেবের সমাধি দেখতে। শুধু কেরী তো নন, একইসঙ্গে মার্শম্যান এবং তাঁর পরিবারের লোকজনের সমাধিও আছে।
চেপে বসলাম অটোতে। অটো কাকা নাকি সব চেনে এ শহরের। অটো চালাতে চালাতে রীতিমত আমাদের গাইডের ভূমিকা পালন করছে কাকা। ওমুক রাস্তা দিয়ে গেলে তমুক দেখা যাবে - আমাদের চেনাতে চেনাতে চলেছে।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর এক রাস্তার মুখে নামিয়ে দিয়ে বলল – এই তো এই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে কেরী সাহেবের সমাধি। এই বলে কাকা বিদেয় নিল।
স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করতে গন্ডগোলটা বুঝতে পারলাম। এখানে কোথায় কেরী সাহেবের সমাধি! সে তো ব্রজ দত্ত লেনে। কাকা পুরো উল্টো জায়গায় এনে আমাদের ছেড়ে দিয়েছে।
শুরু করলাম হাঁটা। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছালাম কেরী সাহেবের সমাধিক্ষেত্রে - শ্রীরামপুর মিশন সেমেট্রি। ও হরি, গেট তো তালা বন্ধ! বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারছি, তালা বাজাচ্ছি - কারও কোনও সাড়া নেই।
উল্টোদিকের একটা মুদির দোকানে কয়েকজন বৃদ্ধ রবিবাসরীয় আড্ডা জমিয়েছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম-' ইয়ে, বলছিলাম যে, এটায় ঢুকতে দেয় না?"
"ওই ছোট্ট ঘরখানা দেখছেন, ওতে কেয়ারটেকার থাকে।" এক বৃদ্ধ উপায় বাতলে দিলেন।
বারচারেক দরজা ধাক্কাতে, দরজা খুলে মুখ বাড়াল কবরখানার কেয়ারটেকার। বেচারার সুখনিদ্রা যে আমরা চটকে দিয়েছি, সেটা ওর নিমের পাঁচন-মার্কা থোবড়া দেখেই বুঝতে বাকি রইল না। ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলাম-'একটু ঢোকা যাবে?"
"কলেজ থেকে পারমিশন লিখিয়ে এনেছেন?" তেতো গলায় জিজ্ঞেস করল চৌকিদার।
আমরা মাথা নাড়ি।
"তাহলে ঢুকতে দেওয়া যাবে না" - সাফ উত্তর।
সেমেট্রিতে ঢুকতে গেলে শ্রীরামপুর কলেজ থেকে পারমিশন করাতে হবে, তেমন তো জানা ছিল না।
নানান কাকুতি মিনতি করে বহু চেষ্টা করলাম। কিন্তু চিঁড়ে ভিজল না। চৌকিদার মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। এই সেমেট্রি নাকি শ্রীরামপুর কলেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। প্রাইভেট প্রপার্টি। ব্যাজার মুখে যখন ফিরে যাচ্ছি, দোকানের বৃদ্ধরা বলছে-'ওহ, আমাকে আপনাকে ঢুকতে দেবে না দাদা। ফরেন ডেলিগেট আসলে সব সুড়সুড় করে ঢুকিয়ে নেয়'।
এই অভিযোগের সত্যিমিথ্যে জানিনা। তবে, আমার বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্র ঘোরার স্বল্প অভিজ্ঞতা বলে- এইটুকু একটা সমাধিক্ষেত্র, যেখানে কুড়িটা কবরও নেই, রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা নজরদারি চালাতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথাই নয়, তার জন্য এত কড়াকড়ি হাস্যকর।

যাই হোক, 'গতস্য শোচনা নাস্তি'। ড্যানিশ সেমেট্রি তো আছে শ্রীরামপুরে। সেখানেই যাওয়া যাক। সেখানকার চৌকিদার আবার, সাহেব ভূতরা রোববার পার্টিতে ব্যস্ত, তাই দেখা হবে না - এই অজুহাতে আটকাবে কিনা কে জানে!
না, ড্যানিশ সেমেট্রি খুব উদার। গেট হাঁ করে খোলা। চৌকিদার, কেয়ারটেকার, গেটকিপারের বালাই নেই। চৌকিদার, এক সমাধির উপর চিৎপাত হয়ে রোববারের মধ্যাহ্ননিদ্রায় সমাধিস্থ হয়েছেন। সুতরাং, নিশ্চিন্ত মনে আমাদের ঘুরে দেখতে বাধা নেই।
শ্রীরামপুর প্রায় পুরোটাই ড্যানিশদের হাতে গড়া। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্ক-এর তদানীন্তন সম্রাট ৬ষ্ঠ ফ্রেডেরিক-এর সম্মানে নামকরণ হয়েছিল ফ্রেডেরিক নগর। শহরটিকে তিলে তিলে গড়ে তোলার অগ্রপথিক দিনেমার ব্যক্তিত্বরা সমাধিস্থ রয়েছেন এখানে। সেইসঙ্গে এঁদের পারিবারিক প্রিয়জনেরাও রয়েছেন।
এখানে শেষশয্যা নিয়েছেন – শ্রীরামপুরের ড্যানিশ গভর্নর ওলে (ওলাভ) বীই। শ্রীরামপুরের যে বিখ্যাত ড্যানিশ চার্চ - সেন্ট ওলাভ'স, সেটা ওঁর আমলেই বানানো। আরও অনেক মান্যিগণ্যি ড্যানিশ ব্যক্তি এখানে রয়েছেন, কিন্তু সমস্যা একটাই। গোটা চারেক বাদে আর একটারও সমাধিরও ফলকের অস্তিত্ব নেই। বেমালুম হাওয়া। চারটে সমাধির ফলকের মধ্যে তিনটে পুরো আস্ত আছে - বীই, জেকব ক্রিফটিং, ক্যাস্পার টপ। আরেকটি ভেঙে চৌচির। পড়বার মতো অবস্থায় নেই। ওই তিনটে সমাধি বাদে আর কারা এখানে সমাহিত, সেটা জানা খুব মুস্কিলের। এমনকি, বেঙ্গল অবিচুরিতেও এই সেমেট্রির পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড নেই। দায়সারাভাবে সামান্য কয়েকটি নথিভুক্ত রয়েছে। একমাত্র সম্বল হতে পারে সেন্ট ওলাভ'স চার্চের রেকর্ড। অতএব হাঁটা লাগলাম চার্চের পথে।

চার্চের সামনে দাঁড়াতেই মনে কু ডাকল। গেট ভিতর থেকে বন্ধ। কিন্ত দরজা একটা খোলা দেখছি। কম্পাউন্ডের মধ্যে একটা স্কুটি দাঁড় করানো। অর্থাৎ ভিতরে লোক আছে। চার্চের সামনে দাঁড়াতেই ভিতর থেকে একটা ভেজা ঠান্ডা প্রাচীন গন্ধ নাকে লাগে। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করি। কোনও সাড়া নেই। মিনিট কুড়ি দাঁড়িয়ে থাকার পর, ভিতর থেকে কেয়ারটেকার গোছের একজন বেরিয়ে এল। কাকা হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয় - ভিতরে ঢোকা যাবে না। ওদিকে চার্চের দেওয়ালে যে সময়সারণীর বোর্ড ঝুলছে, তাতে লেখা নেই রোববার বন্ধ। গুগলও বলছে রোববার বিকেল অবধি খোলা। তাই ঢুকতে না দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু উত্তর যা পেলাম, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। "আপনাদের সাথে অত হ্যাজাতে পারব না", এই হল কাকার এককথা। এমন উত্তরের পর আর অপেক্ষা করার মানে হয়না।
কিছুদিন বাদেই আবার শ্রীরামপুর যাব। আশা করি সেন্ট ওলাভ'স চার্চেও ঢুকব। চার্চের ভিতর ঘুরেও দেখব এবং এই কেয়ারটেকার কাকাটির জন্য কড়া দাওয়াইয়ের ব্যবস্থাও করে আসব।

কথায় আছে, মনেপ্রাণে ইতিহাস খুঁজতে চাইলে কোথাও না কোথাও তার সূত্র ঠিক জোগাড় হয়ে যাবেই। সেন্ট ওলাভ'স থেকে শূন্য হাতে ফিরলেও, আমায় ফেরায়নি 'বেঙ্গল পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট'।
আজকাল অনেক বেস্টসেলিং লেখক দাবি করেন, কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ঔপনিবেশিক সম্পর্কিত তাঁর ওমুক লেখাটা সম্পূর্ণ মৌলিক। কিন্তু পাঠক জেনে রাখুন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসমস্ত কাজ 'বেঙ্গল পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট' এর কোনও প্রাচীন খন্ডে কোনও এক অখ্যাত পরিশ্রমী গবেষক পূর্বেই করে গেছেন।
সেদিন বাড়ি ফিরে তাই ঘেঁটেছি 'বেঙ্গল পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট'-এর খন্ডগুলো। এবারও আমায় নিরাশ করেনি সে। ১৯২১-এর এক খন্ডে রেভারেন্ড হস্টেন, শ্রীরামপুরের এই ড্যানিশ সেমেট্রির সবকটা সমাধির এপিটাফ উদ্ধার করেছিলেন। হস্টেনের এই লেখা থেকেই উদ্ধার করেছি ভেঙে যাওয়া চতুর্থ ফলকের সমাধির পরিচয় - Mrs. M.C. Rabeholm। সেই সঙ্গে খুঁজে পেয়েছি এখানে সমাধিস্থ বাকিদের এপিটাফও। দিনের শেষে জিত হয়তো আমাদেরই হল।
কলকাতা শহর এবং শহরতলির ব্রিটিশদের নিয়ে আলোচনা, বইপত্রের শেষ নেই। কিন্তু সেই তুলনায় দিনেমাররা কতকটা উপেক্ষিত। সমুদ্র উজিয়ে এদেশে এসে এই ছিমছাম শ্রীরামপুর গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। দেশে আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ফিরতে কি চেয়েছিলেন তাঁরা? কে জানে! দুটো গোটা শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। তাঁদের উত্তর-অধিকারীরা খোঁজ কি করেন তাঁদের? হয়তো খুঁজেছেন, কিন্তু নিষ্ফল হয়েছে সেসব প্রচেষ্টা।
একটি আন্তর্জাতিক জেনেলজিক্যাল সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করি আমি। তাদের ডেটাবেসে এই ড্যানিশ সেমেট্রির সমাধিগুলোর ব্যাপারে কোনো আপডেট ছিল না। ছবিসহ ডেটা সব আপলোড করে দিয়েছি। কোনও উত্তর-অধিকারী ভবিষ্যতে এঁদের সমাধির খোঁজ করলে এবার সহজেই পাবে।

স্নাতকোত্তর পর্বের পর লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন গৌরব বিশ্বাস। রকমারি খাওয়া-দাওয়া, বই পড়া, ঘুরে বেড়ানো আর এক-আধটু লেখালেখি। বর্তমানে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সংকলনে প্রকাশিত হচ্ছে প্রবন্ধ নিবন্ধ।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher