তাঞ্জানিয়ার ওল্ডুভাই গর্জ

দেবযানী চক্রবর্তী


আরুশা - সেরেঙ্গেটির কাছাকাছি তাঞ্জানিয়ার একটি ব্যস্ততম শহর, গ্রেট রিফ্ট ভ্যালির পূর্ব শাখার পূর্বপ্রান্তে 'মেরু' পর্বতের নিচে অবস্থিত। অঞ্চলটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটকদের বিচরণভূমি। এখানে থেকে ঘোরা যায় নর্দান সাফারি সার্কিট, সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্ক, কিলিমাঞ্জারো ন্যাশনাল পার্ক, এনগোরোঙ্গোরো (Ngorongoro) কনজারভেশন এরিয়া, আরুশা ন্যাশনাল পার্ক, লেক মানিয়ারা ন্যাশনাল পার্ক এবং ত্যারাঞ্জিরে ন্যাশনাল পার্কসহ আফ্রিকার সেরা কিছু জাতীয় উদ্যান। 'মাসাই' নামে পরিচিত স্থানীয় জনগণের 'মা' ভাষায় সেরেঙ্গেটি (Serengeti)-র অর্থ "অন্তহীন সমভূমি"। ১৯৮১ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকাভুক্ত হয় এই 'আনটাচড আফ্রিকান ওয়াইল্ডারনেস হোয়্যার টাইম স্ট্যান্ডস স্টিল'। প্রায় ১৫,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে কুড়ি লক্ষেরও বেশি আনগুলেট (ungulates) বা খুরওলা স্তন্যপায়ী, চার হাজার সিংহ, এক হাজার চিতাবাঘ, পাঁচশ পঞ্চাশটি চিতা এবং পাঁচশটিরও বেশি পাখির প্রজাতি বসবাস করে। ট্যুরিজমই আরুশা শহরের অর্থনীতির একটি প্রধান অংশ এবং তাঞ্জানিয়ার বৃহত্তম ডলার উপার্জনকারী অর্থনৈতিক খাত।

২০২১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ব্রতীনের সঙ্গে দার এস সালাম থেকে আবার এসে উপস্থিত হয়েছিলাম আরুশাতে। ভ্রমণপিপাসু মন - নতুন কিছু দেখবার বা জানবার আগ্রহ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি দেশবিদেশের নানান স্থানে যখনই সুযোগ পাই। এবারের উদ্দেশ্য ছিল এই শহরকে কেন্দ্র করে ঘুরে নেব তাঞ্জানিয়ার ওল্ডুভাই গর্জ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি স্বর্গরাজ্য যা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্যালিওনথ্রোপলজিক্যাল সাইটগুলির মধ্যে একটি। বিগত কুড়ি লক্ষ বছরে মানুষের জৈবিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশ এবং প্রাথমিক মানব বিবর্তনের জীবাশ্মনিদর্শন। এরই সঙ্গে দেখে নেব চলমান কালো বালিয়াড়ি-টিলা (Shifting sand black dune)।

দুমাস আগে এই আরুশাতে প্রথম এসে উপভোগ করে গিয়েছি সেরেঙ্গেটির জঙ্গলে অবস্থিত বন্য হাতির ছোটাছুটি, সিংহের রাজকীয় বিচরণ। গাড়িতে বসেই সেইসময় মুখোমুখি হয়েছিলাম দলছুট এক বন্য হাতির, আর দেখতে পেয়েছিলাম শিকার করে আনা একটি জেব্রাকে ঘিরে সিংহদের ভোজনের দৃশ্য। দিনের সাফারির থেকে বেশি আনন্দ পেয়েছি জঙ্গলের মাঝে তাঁবুতে বন্য জন্তুদের চলাফেরা-কোলাহলের মাঝে রাত কাটাতে। তাঁবুর ভেতরে বসে মাঝে মাঝেই শুনেছিলাম সিংহের গর্জন, চারপাশে বন্যজন্তুদের পদধ্বনি। অন্ধকার জঙ্গলে দেখেছিলাম আগুনের গোলার মতো জ্বল জ্বল করছে তাদের চোখগুলো। রাতের আঁধারে জঙ্গলের এক অপূর্ব রূপ রয়েছে সেটা সেবার উপলব্ধি করেছি এখানে এসে। এ শুধু মনেতে অনুভব করা যায়, বর্ণনা করে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা যায় না। আগের ভ্রমণের এইসব স্মৃতি মনে নিয়েই আমরা এবার আবার এসেছি আরুশাতে - ওল্ডুভাই গর্জ যাকে সভ্যতার ইতিহাসে বলা হয়ে থাকে 'দ্য ক্র্যাডেল অফ হিউম্যানকাইন্ড' আর চলমান কালো বালিয়াড়ি টিলা দেখতে।

পরের দিন খুব সকাল সকাল আরুশা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম ওল্ডুভাই গর্জ (Olduvai Gorge)-এর উদ্দেশে। সুন্দর পরিষ্কার রাস্তা। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা চলার পর গাড়ি এসে থামল এনগোরোঙ্গোরো কনজারভেশন এরিয়া এবং সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্কের সংযোগস্থলে। এখান থেকে রাস্তা একদিকে চলে গিয়েছে ওল্ডুভাই গর্জের দিকে, অপর দিকের পথ ধরে এগিয়ে গেলে পৌঁছানো যাবে চলমান কালো বালিয়াড়ি টিলাতে। ইঞ্জিনিয়ার জশুয়া এমোয়ানকুন্ডা এই গুরুত্বপূর্ণ মোড়টিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সেইমতো এখানে একটি মনুমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল যা পর্যটকদের কাছে সাইনপোস্ট হিসাবেও কাজ করে আসছে।

বিরাট এক পেডেস্টালের ওপরে বসানো আছে জীবাশ্ম খুলির দুটি বিশালকায় মডেল। বাঁদিকের খুলিটি প্যারানথ্রপাস বোয়েসি(Paranthropus boisei)-র (পূর্বে জিনজানথ্রপাস বলা হত)। এদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল আধুনিক মানুষের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ডানদিকেরটি হোমো হ্যাবিলিস (Homo Habilis) বা হ্যান্ডি ম্যান)-এর। আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ বলে মনে করা হয় এদের। বৃহত্তর মস্তিষ্কের অধিকারী ছিল তারা। পাশেই লাগানো রয়েছে একটি তথ্যপূর্ণ ফলক। তাঞ্জানিয়া সরকারের অনুরোধে জীবাশ্মবিদ নিকোলাস টথ, ক্যাথি স্চিক এবং জ্যাকসন এঞ্জাউ এটির পরিকল্পনা করেছিলেন এবং কংক্রিটের এই বৃহদাকার খুলিদুটি নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত তাঞ্জানিয়ান শিল্পী ফেস্টো কিজো । স্মৃতিস্তম্ভ থেকে ৫ কিমি দূরে অবস্থিত ওল্ডুভাই গর্জ মিউজিয়াম আর প্রধান গিরিখাতটা। পথটি বলতে গেলে সেরেঙ্গেটি জঙ্গলেরই একটি অংশে অবস্থিত। কিছুক্ষণের মধ্যে উপস্থিত হলাম সুন্দর একটি প্রবেশদ্বারের কাছে। কাছেই ওল্ডুভাই গর্জ মিউজিয়াম, যেটিকে আফ্রিকার বৃহত্তম অনসাইট জাদুঘরগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে গণ্য করা হয়। এখানে রয়েছে হোমিনিড এবং প্রাণীজ জীবাশ্মের অসাধারণ সংগ্রহ, সেইসঙ্গে প্রাচীন সরঞ্জামগুলি যাদের এখন ওল্ডোয়ান (ওল্ডুভাই গর্জ' থেকেই এই নামকরণ) থেকে নেওয়া হয়েছে) হিসাবে উল্লেখ করা হয় আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীনতম পরিচিত পাথরের সরঞ্জাম শিল্পের প্রতিনিধি এগুলি। এছাড়াও রয়েছে কাস্টিং-এর মাধ্যমে সংরক্ষিত নানা জীবাশ্ম, যার মধ্যে আছে আদিম হোমিনিড খুলিগুলিও। রক্ষিত করা রয়েছে দ্য লিতোলি ফুটপ্রিন্টস (Laetoli Footprints)-এর প্রকাণ্ড কাস্ট, আর এই খনন এলাকায় একেবারে গোড়ার দিকে কর্মরত লিকি পরিবারের বেশ কয়েকটি ছবি।
স্টোন এজ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড জন টেম্পটেশন ফাউন্ডেশন-এর অর্থানুকূল্যে স্থাপিত এই প্রকল্পের অংশীদার এনগোরোংগোরো কনজারভেশন এরিয়া অথরিটি ।

এখানে খনন করে মানবজাতির বিবর্তনের ভিত্তিতে মানব বসতির পাঁচটি স্বতন্ত্র স্তর পাওয়া গিয়েছে। হোমো হ্যাবিলিস বা হ্যান্ডি ম্যান বিবেচিত হয়েছে সম্ভবত প্রথম মানব প্রজাতি হিসাবে।এযাবৎ বৃহত্তম মস্তিষ্কবিশিষ্ট আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স-এর পূর্বপুরুষ । এরা ছিল বৃহত্তর আকারের মস্তিষ্কবিশিষ্ট আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ। ওল্ডুভাই গর্জে প্রাথমিক 'ওল্ডোয়ান' পাথরের হাতিয়ারের প্রধান নির্মাতা বলে মনে করা হয় এদের। তারপরে প্যারানথ্রপাস বোয়েসি (Paranthropus boisei) বা নাটক্র্যাকার ম্যান। প্রায় ১৪ লক্ষ বছর আগে এই বংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। এদেরই একটি মাথার খুলি ১৯৫৯ সালে মেরি লিকি ওল্ডুভাই গর্জ-এ আবিষ্কার করেছিলেন। বিবর্তনের ধারা বেয়ে এরপর আসে হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus), লাতিন ভাষায় অর্থ 'উন্নত মানব'। সম্ভবত আফ্রিকাতেই হোমো ইরেক্টাসের উৎপত্তি হয়েছিল, তবে ইউরেশিয়াকেও এই ব্যাপারে বাতিল করা যায় না। তবে আনুমানিক ১৭ লক্ষ বছর আগে এই প্রজাতির সদস্যরা যে আফ্রিকার ক্রান্তীয় অঞ্চলে ছিল সে বিষয়ে গবেষকরা একমত। এরা ছিল মাঝারি উচ্চতার এই আদিমানুষকে 'ইরেক্ট' বলার কারণ হল এরা দুই পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটতে পারত। মাথার খুলিটি অবনত, কপাল একটু পেছনের দিকে হেলানো, নাক, চোয়ালও তালু প্রশস্ত। আধুনিক মানুষের তুলনায় এদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল কম কিন্তু দাঁতের দৈর্ঘ্য বেশি। অনুমান করা হয় যে প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে এরা বিলুপ্ত হয়ে আজকের মানুষ হোমো সেপিয়েন্সদের (Homo sapiens) জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। তবে আফ্রিকার যে কোন প্রজাতিই হোক, এরা কিন্তু সবাই ১৭,০০০ বছর আগের থেকেই গর্জের জায়গা দখল করেছিল বলে মনে করা হয়।

ওল্ডুভাই গর্জে বা গিরিখাতে সাধারণ-এর নামা নিষিদ্ধ। ওপর থেকে দাঁড়িয়েই পর্যটকরা দেখে নেন। এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে সিসাল নামে একপ্রকার বন্য উদ্ভিদ প্রচুর দেখা যেত। এই সিসালকেই এখানকার আদিবাসী মাসাইদের ভাষায় বলা হয় গর্জ। পর্যটকদেরকে গাইড জানিয়ে দেন কী করে এই ওল্ডুভাই গর্জ গঠিত হয়েছিল – এনদুতু হ্রদ থেকে এনগোরোংগোরোর পাদদেশের ওলবালবাল নিম্নভূমিতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বয়ে আসা জলধারার চাপে ভূমিক্ষয়ের ফল এই গভীরভাবে ছেদিত উপত্যকা। ওল্ডুভাই গর্জের খননকার্য চলাকালীন কাজের সুবিধার জন্য অঞ্চলটিকে কতকগুলো ধাপ বা বেড-এ চিহ্নিত করা হয়েছে। ১নং বেড থেকে ৪নং বেডে পাওয়া গিয়েছে ওল্ডোয়ান টুলসগুলি বা বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম। বেড নং ১-এ রয়েছে ১.৮৫ মিলিয়ন বছর থেকে ১.৭ মিলিয়ন বছর আগের ওল্ডোয়ান টুলস ও প্যারানথ্রপাস বোয়েসির জীবাশ্ম। ১.৭ থেকে ১.২ মিলিয়ন বছর আগের হোমো হ্যাবিলিসের জীবাশ্ম রয়েছে বেড নং ২-এ। প্রায় ১.৬ মিলিয়ন বছর আগের হোমো হ্যাবিলিসরা পথ ছেড়ে দিয়েছিল হোমো ইরেক্টাসদের। কিন্তু প্যারানথ্রপাস বোয়েসিরা তখনও ছিল এই অঞ্চলে। ৮০০,০০০ থেকে ৬০০,০০০ বছর আগে ব্যবহৃত ওল্ডোওয়ান সরঞ্জামগুলি বেড নং ৪-এ পাওয়া গিয়েছে। তবে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন বছর ধরেই কিন্তু বেড নং ১ ও ২-এর মধ্যে ঘন ঘন পরিবর্তন ঘটেছে। সরঞ্জাম এবং হাতিয়ার তৈরিতে আরও পারদর্শী হয়ে উঠেছিল তারা। সেইসঙ্গে এইসব সরঞ্জামগুলি প্রয়োজনমতো সুষ্ঠুভাবে পরিবহন করার পদ্ধতিও আয়ত্ত করেছিল।

দূরে দৃশ্যমান নাইবোর সোইট পাহাড়ের (Naibor Soit hills) সঙ্গে ওল্ডুভাই গর্জের ক্লাসিক রম্যাণী দৃশ্যাবলী ভ্রমণপিপাসুদের মনে এনে দেয় এক অফুরন্ত তৃপ্তি। সামনেই ৩ নং বেডের লাল পলি দিয়ে তৈরি এক মনোলিথের দৃশ্য, আকৃতির দরুণ যা "ক্যাসল" (Castle) নামে পরিচিত। গর্জের এই অতুলনীয় অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা যায় না, শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। দিনান্তে এই নিস্তব্ধ গিরিখাতের স্মৃতির রেশ সঙ্গে নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম কাছেই অবস্থিত চলমান কালো বালিয়াড়ি টিলার উদ্দেশ্যে। তখন প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলের স্বর্গরাজ্য ওল্ডুভাই গর্জ আফ্রিকান সূর্যের কমলা আভায় এক অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে।

অনুবাদ - অতীন চক্রবর্তী

মাদুরাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজী সাহিত্যের স্নাতক দেবযানী চক্রবর্তীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল শহরে। বিবাহের পর স্বামীর কর্মক্ষেত্রের সুবাদে দেশ-বিদেশের নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে সজীব হয়েছে তাঁর ভ্রমণপিপাসু মন। পছন্দ করেন বনে-জঙ্গলে বন্য পশুদের বিচরণক্ষেত্রে সময় কাটাতে, এছাড়া মানব বিবর্তনের ইতিহাস আর প্রাচীন ভগ্নস্তূপের কাহিনির খোঁজ নিতে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেও ভালোবাসেন খুব।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher