বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

বারকুলে একদিন

প্রদীপ্ত চক্রবর্তী


বাঙালি পুরী যায়নি, খুঁজে পাওয়া বেজায় কঠিন। আর পুরী গেলেই ডলফিন দেখতে চিল্কা। আগে পুরী থেকে চিল্কা বলতে বোঝাতো বারকুল। এখন পুরীর সবচেয়ে কাছে, ডলফিন দেখা যায়, শতপদ বা টুরিষ্টদের কাছে সাতপাড়া। যারা গোপালপুর থেকে চিল্কা আসতে চান তাঁদের জন্য রূপবতী রম্ভা তো রয়েইছে। সবমিলিয়ে বারকুল হঠাৎ করেই কেমন দুয়োরানি। স্থানীয় মানুষজন কালিজাই মন্দিরে আসেন, ফলে নৌকার ঘাট সামান্য কিছুটা সময় ব্যস্ত থাকে। ওটিডিসি-র একটা অসাধারণ সুন্দর ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স আছে, কিন্তু লকডাউনের ধকলে তার হতশ্রী অবস্থা। সুন্দর করে সাজানো ওটিডিসি-র পান্থনিবাস প্রায় খালিই পড়ে থাকে। অভিমান নিয়ে নিজের মনে ঢেউ ভাঙে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, আর নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় বকসহ অন্যান্য পাখির দল। আজ্ঞে হ্যাঁ, একমাত্র বারকুলেই চিল্কার বিস্তৃতি ধরা দেবে, শতপদতে একেবারেই নয়, রম্ভাতে অনেকটা দেখা গেলেও বারকুলেই আপনার চোখ বাধাহীন ভাবে মেলে দিতে পারবেন।
গিয়েছিলাম পুরী থেকে, অবশ্যই থাকব বলেই। বাঙালির কাছে পুরীর গল্প করার বাহুল্য নাই বা করলাম। ১০৬ কিমি রাস্তার প্রথম অংশ গ্রামের মধ্য দিয়ে, বড় চেনা ছবি। বাংলা আর ওড়িশার প্রকৃতি এত কাছাকাছি যে ভালো লাগবে, কিন্তু অবাক হবেন না। এরপর মাখনের মতো হাইওয়ে। পান্থনিবাসে পৌঁছে বুকিং-এর কাগজপত্র দেখিয়ে ওদের ঘর ঠিকঠাক করার ফাঁকে চিল্কার দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি দেখতে দেখতে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। ডাইনিং রুম থেকে চিল্কা সুন্দরভাবে চোখে পড়ে। ব্রেকফাস্ট-এর পর ঘরে গেলাম। দোতলার ঘরের জানলার পর্দা সরাতেই বোল্ড।

চোখ মেলে দিলাম, সামনে চিল্কার দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, সামনে ছোট ছোট নৌকা, অনেকটা ভিতরে ঢুকে আসা জেটি। মাঝে মাঝে কালিজাই মন্দিরে যাওয়া আসা করা নৌকা, তাদের আরোহীদের যাতায়াত, নিটোল একটা ছবি। এক চক্কর দিতে বেরোলাম বাইরেটাতে। নভেম্বরের ১ তারিখ হলেও বেশ ভালো গরম। কিছুক্ষণ পাখির পিছনে সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরলাম। কোভিডের সময়, তাই যথাসাধ্য পরিষ্কার করে, স্নান করে জানলার ধারেই বসে রইলাম। এই জানলার ধারে বসেই একটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায় বারকুলে। অলস চালে সময় কেটে গেল অনেকটা সেটা টের পেলাম লাঞ্চের ডাক পড়তে। কাঁকড়ার ঝোল দিয়ে ভাত অমৃত মনে হলো। দুপুরের ভাতঘুম বিছানায় টানছিল, কিন্তু আরো বড় টান ওই জানলাটার, ফলে হাতপা ছড়িয়ে বসে গেলাম। জলের দুলুনিতে নৌকাগুলো দুলছে, নৌকার মানুষগুলোর মধ্যেও কেমন একটা আলস্যজড়ানো চলন। গরম একটু কমতেই ক্যামেরা বাগিয়ে বাইরে। খেয়াল করলাম আকাশ ভালোই মেঘলা, আলো যথেষ্ট, কিন্তু সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো, বন্ধ ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স-এর ভিতরে খানিকটা ঘুরে বেড়ালাম, চিল্কার ভিতর ঘিরে রাখা অংশ, একটুখানি জায়গা দিয়ে জল ঢোকে, শান্ত, কয়েকটা ভাসমান জেটি, তবে অযত্নের ছাপ সর্বত্র, ভাঙা রেলিং, ময়লা। বুঝলাম লকডাউনের প্রভাব। এলাম নৌকা ছাড়ার জেটিতে, এইবার টের পেলাম দুলুনি। এই অংশ বাধাহীন, হাওয়ায় চিল্কার জলে ঢেউ উঠছে, তালে তালে দুলছে ভাসমান জেটি, বেশ মজা লাগছিল। আলো কমতে ঘরে ফিরলাম। আবার সেই জানলার ধার।

সন্ধ্যেবেলা পাখির দল ঘরে ফিরছে। ওটিডিসি-র পাশেই একটা অংশে বড় বড় গাছ, সেখানে এদের আস্তানা, ফলে এদের চলাফেরা লক্ষ্য করার পক্ষে আদর্শ জায়গা। সন্ধ্যে নামছে, শেষ বোট কালিজাই থেকে ফিরে আসছে, লগি ঠেলে মাঝিরা ফিরছে। আকাশে নীল রঙের ছোঁয়া, সূর্যদেব মুখ দেখালেন না যে। রাতের খাবার ঘরে এনে খেয়ে ঘুম।

সকালের চেনা লালচে নরম আলো নয়, ঘুম ভাঙল কেমন একটা ধূসর আলো নিয়ে। দেখলাম রাতে বৃষ্টি হয়েছে, তখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে, তবে খুব সামান্য। ধূসর মেশানো নীল আলো মেখে চিল্কার ঘুম ভাঙছে।

মাছধরা নৌকাগুলো ইতিউতি ঘুরছে, কেমন একটা মনখারাপ করা সকাল। চা হাতে নিয়ে এই ছবির সামনে বসে থাকা, কোনও কথা নয়, নীরবতাই এখানে শ্রেয়। বৃষ্টি থামল, আবার বেরোলাম, এখানে থাকার আয়ু তো আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। পান্থনিবাসের ভিতরটাও খুব সুন্দর, ফুল, বড় বড় গাছ, সেখানে প্রচুর প্রজাপতিও আসে।

বাইরে এলাম, পাখির দল তখন রীতিমতো শোরগোল তুলে দিয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দুদল পাখি সামান্য ঝগড়ার পরেই 'হাত থাকতে মুখে কেন' নীতি মেনে মারামারিতে লেগে গেল। বেশ কেটে গেল সময়টা।

ব্রেকফাস্ট করে স্নান সেরে মালপত্র রিসেপশনে জমা দিয়ে (ঘর ছেড়ে দিয়েছিলাম) চললাম বোট নিয়ে কালিজাই মন্দিরের পথে। সঙ্গিসাথী না পাওয়ায় আমরা কত্তাগিন্নি দুজনে মিলেই পুরো বোট নিয়ে চললাম। বারকুল গেলে এই বোট অবশ্যই চড়বেন, নইলে মজা অনেকটাই অধরা থেকে যাবে। শুরুতে শান্ত জলে চলা শুরু, একটু পরেই হাওয়ার দাপটে জলে ঢেউ আর পাল্লা দিয়ে নৌকার দুলুনি। ছবি তোলা মাথায় উঠে গেছে, ক্যামেরা ব্যাগ থেকে বের করতেই পারছি না, মাঝি অভয় দিচ্ছে কিছু হবে না। আর অভয়, নৌকা মাঝে মাঝে কাত হয়ে জল ঢুকে যায়-যায় অবস্থা! ঢেউ নৌকার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এইভাবে কালিজাই মন্দির পৌঁছে গেলাম। ওড়িশার আর পাঁচটা সাধারণ মন্দিরের মতই। ফেরার পথে মাঝি লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দিল। স্ত্রী বললেন, এটা ভ্যাকসিনের মত, কাজ হবে কিনা জানি না, কিন্তু আত্মবিশ্বাস দেবে। সত্যিই ফেরার সময় একই দুলুনিতে অত ভয় করেনি। ঘন্টা দুয়েক লাগবে পুরো বোট রাইডে। ফিরে এসে পান্থনিবাসে লাঞ্চ করে একটা অটো নিয়ে বালুগাঁও-এর পথে, সেখান থেকে ট্রেনে হাওড়া।

 

পেশায় শিক্ষক প্রদীপ্ত চক্রবর্তী নেশায় আলোকচিত্রী ও ভ্রামণিক।

 

 

 

টেমি চা-বাগিচায়

বাপ্পাদিত্য বর্মন


বেড়ানোর নতুন জায়গার সন্ধান করতে করতে জানতে পারলাম সিকিমের একমাত্র চা বাগান টেমি-র কথা। আর আমার পছন্দের ভ্রমণতালিকায় সিকিমের নাম বরাবর ওপরের দিকেই থাকে।
দক্ষিণ সিকিমের টেনডং পাহাড়ের টেমি চা বাগানের উচ্চতা ৫০০০ ফুট। ৪৫৩ একর পরিধি জুড়ে বিস্তৃত এই চা বাগানের অপূর্ব শ্যামলিমা দেখে জূড়িয়ে যায় চোখ। শুধু সেটুকুই নয় কাবরু, কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ অন্যান্য শৃঙ্গরা দৃশ্যপট আরও অতুলনীয় করে তুলেছে।
নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি গাড়িতে টেমি টি গার্ডেনে পৌঁছানো যায়। তবে আমরা গ্যাংটকে কিছুদিন কাটিয়ে রাবাংলা, নামচি ঘুরে টেমি টি গার্ডেনে পৌঁছালাম।
নামচি থেকে মাখনের মত মসৃণ আর চকচকে রাস্তা বরাবর টেমির দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। আমাদের থাকার জায়গা ছিল একদম চা বাগানের মধ্যে সিকিম সরকার দ্বারা পরিচালিত 'চেরি রিসর্ট'। আবাসস্থলটির স্থান মাহাত্ম্যে অতুলনীয়। চেরির হাসিতে মুখরিত হয়ে আছে। ১৮০ ডিগ্রি ব্যাপী এক অসাধারণ প্যানোরমা দৃশ্যমান এখান থেকে। এক লহমায় ভালোবেসে ফেললাম শান্ত সুন্দর জায়গাটিকে। চা বাগানের মধ্যে নীল আকাশের নিচে চেরি রিসর্টকে দূর থেকে দেখে মনে হবে, জল রঙ দিয়ে কেউ যেন একটা অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ এঁকে রেখে দিয়েছে।

দুপাশে ঢালু বাগানের মধ্য দিয়ে পিচের রাস্তা চলে গেছে রিসর্টের সামনে। গাড়ি থেকে নামতেই প্রথম অনুভব করলাম বাতাসে কাঁচা চা পাতার গন্ধ। চোখ বুজে সেই গন্ধ বুক ভরে নিলাম। অপরিচিত এই গন্ধের এক অদ্ভুত মাদকতা। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে নির্ধারিত ঘরে পৌঁছালাম। কাচের জানালার ভারী পর্দা সরিয়ে যেদিকেই তাকাই চায়ের বাগান। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে পাহাড়ের পিছনে অস্ত যেতে ব্যস্ত। আকাশে রঙের খেলা শুরু হয়েছে। হু হু করে ফুরিয়ে যাছে দিনের আলো। আর মাত্র কয়েক মিনিট, তারপরই জমাট অন্ধকারে ঢেকে যাবে সব কিছু। আলো জ্বলে উঠল অনেক দূরে পাহাড়ের ছোট ছোট গ্রামগুলোতে। এক ঝাঁক জোনাকির মতো জ্বলে নেভে নিঃশব্দে। তখনই মহার্ঘ্য চায়ের পাতা হাত, পা ছড়ায় উষ্ণতায়। রাত বাড়ে, দামি ক্রকারিজ-এ সার্ভড হয় ডিনার।
মোটা লেপের অলস আরাম ছেড়ে খুব ভোরে চেরি রিসর্টের বিশাল ছাদে এসে দাঁড়িয়েছি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গগুলো ফুটে উঠছে। এক অচেনা অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবী আমার সামনে। নিস্পলক দৃষ্টিতে প্রকৃতির এই সদ্য ঘুমভাঙা রূপ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি।

হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে চললাম চা বাগানের মধ্যে হাঁটাহাটি করতে। অসীম নির্জনতা চারদিক ঘিরে আছে। বাগানের মধ্যে আছে টেমি চা ফ্যাক্টরি। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম সেখানেই। কারখানার গেট থেকে টিকিট কেটে ভিতরে ঢোকা যায়। আর আছে টি-স্টল। বিভিন্ন প্রকার চা খাওয়া যায়, আবার প্যাকেট চা কেনা যায়। কারখানা থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাগানে বেড়াতে চললাম। নিচ থেকে চা বাগানের দৃশ্য অনবদ্য।

এরপর ব্রেকফাস্টের জন্য রিসর্টে ফেরার পালা। নামার থেকে ওঠার সময় লাগল তিনগুণ। তবে অপূর্ব সুন্দর চা বাগানের দৃশ্য কখনও ক্লান্ত হতে দেবে না। কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। চলছে চা পাতা তোলার কাজ। এক ঝাঁক মেঘ এসে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে অদৃশ্য করে দিল। মাঝে মাঝে কুয়াশা ঘিরে ধরছে। মেঘ-কুয়াশার মধ্যে চা বাগান যেন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে।

অ্যাডভেঞ্চারের সব ব্যবস্থা আছে এখানে। আছে জিপ লাইন, প্যারাগ্লাইডিং-এর ব্যবস্থা। রিসর্ট থেকে একটা গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম জিপলাইন আর প্যারাগ্লাইডিং করতে। আকাশে উড়তে উড়তে পাখির চোখে গোটা চা বাগানের দৃশ্য সারা জীবন মনে রেখে দিতে হবে। সারাদিন যে কী ভাবে কেটে গেল বোঝা গেল না। আগামীকাল যাবো পেলিং, কিন্তু বার বার মনে হচ্ছে এখানে যদি আরও কটা দিনের বুকিং থাকত!

 

স্কুল শিক্ষক বাপ্পাদিত্য বর্মন-এর শখ বেড়ানো আর বই পড়া।

 

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher