স্মৃতির দার্জিলিং

দময়ন্তী দাশগুপ্ত


২০১৮ সাল। লেডি অবলা বসুকে নিয়ে গবেষণার কাজ করছি। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সূত্রে তাই এবার দার্জিলিং-এ এসে উঠেছি বসুদের বাসভবন মায়াপুরী লাগোয়া বোস ইনস্টিটিউটের দার্জিলিং শাখার গেস্টহাউসে। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে বেশ কিছুটা দূরেই এটা। চড়াই ভেঙে দীর্ঘ হাঁটাপথ। ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় রাস্তার ওপারে খাদের থেকে উঠে আসা ঘন লম্বা গাছের সারি। তাদের পেরিয়ে সোনারঙা কাঞ্চনজঙ্ঘায় ভোর হয়। আরও কিছুটা এগোলে ডান হাতে পড়বে লাল কুঠি – বর্তমানে দার্জিলিং হিল কাউন্সিলের প্রশাসনিক দপ্তর। আগের নাম ছিল গৌরী ভিলা। কুচবিহারের মহারাজা প্রসাদনাথ রায় তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিতে এটি তৈরি করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে প্রথমদিকে বাড়িটি ইংরেজদের বড় বড় পার্টির জন্য ব্যবহৃত হত। পরে মহারাজা ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছেন না এই অজুহাতে ব্রিটিশরা ভিলাটি দখল করে নেয়। এই বাড়িতেই বাংলা ছায়াছবি 'লালকুঠি'-র শুটিং হয়েছিল, তারপর থেকে লোকমুখে এর নাম হয়ে যায় লালকুঠি। এর একটু পরেই জাপানী প্যাগোডা। ধৌলীর স্তূপের মতোই এটিও নির্মিত হয়েছিল জাপানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ফুজির পরিকল্পনানুযায়ী।

ব্রেকফাস্ট সেরে মায়াপুরীর ভেতরে যাই। পুরো চত্ত্বরটা ফুলের গাছে সাজানো। নিবেদিতার মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা রায়ভিলার দখল নিলে বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর যন্ত্রপাতিগুলি এনে ডাঃ নীলরতন সরকারের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য রেখেছিলেন। কিন্তু ছোট জায়গার মধ্যে ল্যাবরেটরি গড়তে অসুবিধা হচ্ছিল। অবশেষে এখানের বাড়িগুলি কিনে নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো বাড়ি বানানো শুরু করেন। বাড়ির ডিজাইন করে দিয়েছিলেন প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্রনাথ। বাড়ির নাম 'মায়াপুরী'-ও তিনিই দিয়েছিলেন। পাশের লাগোয়া বাড়িটার নাম রেখেছিলেন 'হৈমবতী'।

'আমার জন্ম এখানেই' - কথা বলতে বলতেই বারান্দা পেরিয়ে জগদীশচন্দ্র-অবলার একতলার বসার ঘরে নিয়ে গেলেন ছেষট্টি বছরের তরতাজা দেবকুমার রায়; জীবিকার সূত্রে ছিলেন দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগে, অবসরগ্রহণের পর এখন জগদীশ বোস মিউজিয়াম-এর এই বাড়ি-ঘরের আজও যিনি অতন্দ্র পাহারাদার। মায়াপুরীর সদর দরজাতে অজন্তার গুহাচৈত্যের প্রবেশদ্বারের আদলে কাঠের কারুকাজ - কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দির-এর প্রবেশ তোরণও এইরকমেরই, তবে সেটি আরও অনেক বড়। বাড়ির একতলায় রান্নাঘরের লাগোয়া কাঠের সুদৃশ্য আটজনের ডাইনিং টেবল ঘিরে পাঁচটা চেয়ার আজও যেন কারও অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। রান্নাঘরের তাকে এখনও রাখা চিনামাটির বাসনপত্র, মশলাদানি। বসার ঘরের একপাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নিবেদিতার তৈলচিত্র চোখে পড়ে। দোতলায় বসুদম্পতির শয়নকক্ষ, ভারী পালঙ্ক, কারুকার্যমন্ডিত প্রকান্ড ড্রেসিং টেবল। হ্যাটস্ট্যান্ড, পুরনো কিছু বইপত্র, জগদীশচন্দ্রের লেখাপড়ার টেবিল পেরিয়ে আড্ডাঘর। এখন অবশ্য তা ফ্যাকাল্টি রুম। তার পাশের ঘরে সাজানো আছে বিজ্ঞানাচার্যের সৃষ্ট যন্ত্রপাতিগুলি, বিবরণীসহ। বড় বড় ফ্লেক্স-এ ছবিসহ জগদীশচন্দ্রের আশ্চর্য সব আবিষ্কারের বর্ণনা, আজকের মোবাইল ফোন, মাইক্রোওয়েভ-এরও পথিকৃৎ ছিল তাঁর গবেষণা। লম্বাটে ঘরটার একদিক কাচে ঘেরা, সেটা পেরিয়ে সামনেই খোলা চওড়া ব্যালকনি – অনেকটা ছাদের মতোই। নিচে রাস্তার ওপারে সবুজ গাছে ভরা খাদ নেমে গেছে। দিগন্তে প্রহরী কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারাবৃত শৃঙ্গেরা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখান দেবকুমারবাবু আর কাহিনির জাল বোনেন। মনে হয় সত্যি যেন এই মায়াপুরীর চাবিকাঠি রয়েছে ওঁর স্মৃতির ভাণ্ডারে।

'বাবা বলতেন, তোমরা এখানে আছ, এ জায়গার ইতিহাসটা জেনে রাখো। তাঁর কাছেই শোনা সব। শুরুর থেকে বলি। আমার দাদু মানে ওঁর বাবা, দার্জিলিং রেলওয়ে স্টেশন, তার নিচে একটা গভর্নমেন্ট হাইস্কুল আছে, সেখানের একটা বাগানে গার্ডেনার হিসাবে কাজ করতেন। ব্রিটিশ একজন, মার্টিন সাহেব, তাঁর গার্ডেনে। সময়টা ১৯৩০ সালের আশপাশে, বাবার তখন বছর ষোলো বয়স, বিয়ে হয়নি। ঘুরতে ঘুরতে একদিন এদিকটায় চলে এসেছিলেন। তখন ঘরবাড়ি এত বেশি ছিল না এখানে। পেছনে অর্কিড সেন্টারটা ছিল, পাশের বাড়িটা ছিল, এই বাড়িটা ছিল, আরেকটু ওপরে কুচবিহার মহারাজার বাড়িটা ছিল, আর গুটিকয়েক বড় বাড়ি ছিল ছড়িয়েছিটিয়ে। বাদবাকি ঘন জঙ্গলই ছিল আশপাশটা। বাবা ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে দাঁড়িয়ে গিয়ে ওপরে তাকিয়ে আছেন, বাড়িটা দেখছেন। স্যার জে.সি.বোস আর অবলা বোস দাঁড়িয়েছিলেন এই ওপেন ব্যালকনিটাতেই। লেডি বোস ওপর থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, অ্যাই খোকা, কী দেখছ? বাবা বাংলা তেমন জানতেন না। হিন্দিতে উত্তর দিলেন, মেমসাহাব য়্যহ্ বিল্ডিং বহুৎ আচ্ছা লাগা, ইসি লিয়ে দেখ রহেঁ। অবাঙালি বুঝতে পেরে জে.সি.বোস বললেন, কেয়া করতে হো? – কুছ নাহি, সাহাব। জে.সি.বোস বললেন, ওপরে এসো। হাত নাড়িয়ে ডাকলেন। উনি উঠে এলেন উপরে। নাম জিজ্ঞাসা করলেন। তারপরে কাঁহা রহতে হো, কেয়া করতে হো এইসব। বাবা বললেন এখানে বেড়াতে বেড়াতে চলে এসেছি, বাড়িটা দেখে ভাল লাগল। সুন্দর বাড়ি। হিন্দিতেই বললেন। আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, ইধার কিঁউ আয়া? বাবা তখন বললেন, কাম ঢুঁড়নে। জে.সি.বোস বললেন, য়্যঁহা কাম করোগে? – হাঁ, সাব, করেঙ্গে। অবলা বোস বললেন, তোমাকে কিন্তু এখানেই থাকতে হবে। থাকবে? –হাঁ, মেমসাব। হাম রহেগা। তো সেদিনই ওঁকে চাবিটাবি হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। বাবার সে কী আনন্দ, যেন কী একটা পুরস্কার সম্মান পেয়ে গেছেন। সেদিন থেকে বাবা এখানেই থাকতেন, এ বাড়ির কেয়ারটেকার। মারাও যান এখানেই। পরে অবশ্য আমরা সামনেই এখান থেকে একটু দূরে একটা বাড়ি করেছি। ওঁরা থাকতেন কলকাতায়। কোনও বছরে দুবার আবার কোনও বছর চারবার-পাঁচবার আসতেন। ঠিক ছিল না। জে.সি.বোসের ল্যাবরেটরি ছিল এখানে। উনি নানারকম গবেষণার কাজ করতেন। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ, নীলরতন সরকার, চিত্তরঞ্জন দাশ এঁরাও আসতেন। উনিশশো একান্ন সালে লেডি বোস মারা গেছেন, উনপঞ্চাশ-পঞ্চাশ সাল পর্যন্ত এসেছেন এখানে।'

দেবকুমারবাবু জানালেন, অবলা বসু খুব বাগান করতে ভালোবাসতেন। একবার গাছ চুরির জন্য রীতিমতো থানা-পুলিশ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। ঘটনাটি এইরকম – লেডি বোস একবার দুটো চারাগাছ নিয়ে এসেছিলেন ইউরোপ থেকে। দেবকুমারবাবুর বাবা তখন কেয়ারটেকার। তাঁকে দিলেন লাগাতে। সেসময় বাগানের চারধারে পাঁচিল ছিল না। যেদিন লাগিয়েছেন, তার পরেরদিন চুরি হয়ে গেল। সকালে কেয়ারটেকার দেখছেন, আরে, গাছটা তো নেই! তিনি সঙ্গে সঙ্গে লেডি বোসকে বলতে গেলেন। অবলা বোস চা খাচ্ছিলেন ডাইনিং রুমে। শুনে বললেন, চুরি হয়ে গেছে! ঠিক আছে, এটা তো থানায় রিপোর্ট করতে হবে। থানায় একটা এফ.আই.আর.লিখে দিলেন। সেটা নিয়ে কেয়ারটেকার থানায় গেলেন। এফ. আই.আর. করার পরে পুলিশ এল, কোথায় ছিল গাছটা দেখেটেখে গেল। খুঁজতে খুঁজতে তিনদিন চারদিন পরে দেখা গেল যে অন্য একটা বাড়িতে ওটা লাগানো আছে। সেখানে গিয়ে বাড়ির মালিককে পুলিশরা জিজ্ঞাসা করল, গাছটা কোথা থেকে এল? তিনি বললেন, অমুক লোক দিয়ে গেছে। সেই লোকটাকে ধরা হল এবং থানায় বন্ধ করা হল। গাছদুটোও থানায় রাখা হল। অবলা বোস কেয়ারটেকারকে বললেন, রোজ তুমি ওখানে গিয়ে গাছে জল দিয়ে এসো। তিনি দুটো গাছের জন্য দুবোতল জল ঝোলায় করে নিয়ে গিয়ে ঢেলে আসতেন। এই করে করে দশ-বারোদিন পরে গাছদুটো পুলিশ আবার এখানে ফেরত দিয়ে গেল। তারপর সে গাছকে আবার বসানো হল। তারমধ্যে একটা গাছ বাঁচেনি। অন্যটি এখনও আছে মেন গেটের পাশে। ক্যামেলিয়া। আরও নানান স্মৃতিচারণে কেটে গেল একটি বর্ণময় সকাল।

ফিরে এসে ভাগ্নে দেবেন্দ্রমোহন বসুর স্মৃতিচারণের কথা পড়ি মর্ডান রিভিউ পত্রিকায়। অবলা ও জগদীশচন্দ্রের প্রাত্যহিকী চলত একইরকম, ঘন্টাখানেক উপাসনা, প্রাতরাশের পর খানিকক্ষণ বাগানে কাটানো কিংবা আশপাশে একটু পায়চারি – জগদীশচন্দ্রকে প্রায়ই দেখা যেত টাট্টু ঘোড়ায় সওয়ার আর অবলা বসু হাঁটছেন। ফিরে এসে জগদীশচন্দ্র ঢুকতেন তাঁর পড়ার ঘরে, সেখানে তাঁর সচিব মিস অর্নশল্ট অপেক্ষা করে থাকতেন তাঁর চিঠিপত্রের নিষ্পত্তি বা জগদীশচন্দ্র তখন যে নিবন্ধগুলি লিখছেন তা টাইপ করার জন্য। এইরকম চলত বেলা বারোটা অবধি, দুপুরের খাওয়া তারপর। লেডি বোস এইসময়টাকে ব্যবহার করতেন তাঁর দিস্তা দিস্তা চিঠিপত্র লিখতে। এত কাজের মধ্যেও তিনি বাজারে গিয়ে তাজা ফল, সবজি ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য কেনাকাটার সময় বের করে নিতেন। মায়াপুরী থেকে বাজার ছিল মোটামুটি ২ মাইল দূরে, আর প্রায় ১০০০ ফুট নিচে। সত্তর বছর বয়স অবধি লেডি বোস সাধারণত যাওয়া ও আসা দুই-ই হেঁটেই করতেন। কেবলমাত্র পরবর্তীতে, ফেরার সময় একটা রিকশা নিতেন। বাজারে খুব কম লোকই জগদীশচন্দ্রকে চিনত, দোকানদার, কুলি আর রিকশাওলারা চিনত লেডি বোসকে।

মায়াপুরী থেকে বেরিয়ে আসি। সামনের রাস্তার ওপাশে সবুজ গাছগাছালিতে ভরা খাদেই সারারাত কাটাতেন জগদীশচন্দ্র। পাইনছাওয়া পিচরাস্তা দিয়ে কিছুদূর এগোনোর পরই রাস্তা আচমকাই অনেকটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। চড়াই ভেঙে উঠে আসছেন হলুদ অঙ্গবস্ত্রের ওপর গাঢ় বাদামী চীর পরিহিত দুই বৌদ্ধভিক্ষু, বোধহয় সাম্প্রতিক গড়ে ওঠা জাপানি প্যাগোডার উদ্দেশে। সারাদিন ঘোরাঘুরির ক্লান্তিতে এই পথটা গাড়িতেই ফি্রেছি আমরা গত দুদিনই, বেশ খাড়া এই চড়াই-ই ভাঙতেন অবলা রোজ নিচের বাজার থেকে রসদ কিনে ফেরার সময়!
পুরোনো ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছেই মসজিদের গলিতে দার্জিলিং ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির। ইতিহাস বলছে ১৮৭৯ সালে এই মন্দির প্রথমবারের জন্য উদ্ঘাটন করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্ভবত তখনও মন্দিরটি সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। পরের বছর বৈশাখে মন্দিরটি সম্পূর্ণ হলে আবার উদ্ঘাটন করেন পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৯১৯ সালে পুরোনো জমির বিনিময়ে সরকার থেকে নতুন জমি ও ১৫০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা হেমলতা সরকারের উদ্যোগে ১৯২০ সালে বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণকার্য শুরু হয়। ১৯২২ সালে মন্দিরটির উদ্বোধন হয়। প্রথমদিককার ট্রাস্টিদের মধ্যে ছিলেন আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস (অবলা বসুর পিতা) প্রমুখ। জগদীশচন্দ্র ও অবলা প্রায়ই এখানে উপাসনা করতে যেতেন। অবলা বসু নিয়মিতই তাঁদের দার্জিলিং-এর বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে সমাজে আসতেন।

দার্জিলিং বাজারের জিপস্ট্যান্ড থেকে একটা যাত্রীবাহী ভাড়ার গাড়িতে উঠে লেবং কার্ট রোডে রায়ভিলা-য় পৌঁছলাম। দ্বারকানাথ রায়ের বাড়িটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে থাকার পর রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে আসায় তাদের উদ্যোগে চলছে সংরক্ষণের কাজ। দ্বারকানাথ ছিলেন সেকালের একজন নামকরা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার রায়ের ভাই। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল ব্রাহ্ম নেতা দুর্গামোহন দাসের কনিষ্ঠ কন্যা এবং সরলা রায় ও অবলা বসুর ছোট বোন শৈলবালার। দ্বারকানাথ এই বাড়িটি কেনার পর অনেকবারই খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসু এসে এখানে থেকেছেন। তাঁদেরই অতিথি হিসেবে দার্জিলিং-এ বাসকালীন এই বাড়িতেই প্রয়াত হন ভগিনী নিবেদিতা। সেবারে বসুদের নিবেদিতা সহ দার্জিলিং থেকে ট্রেক করে সান্দাকফু-ফালুট যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

মুঠোফোনে স্বামী বিশ্বরূপানন্দ মহারাজ জিজ্ঞাসা করেন, বোন কোথায় আছিস? বলি, যে ঘরে সব বই রয়েছে। বলেন পাশে একটা সিঁড়ি রয়েছে দেখ, ওটা দিয়ে উঠে আয় ওপরে। ওপরে উঠে নিবেদিতার ঘরের সামনে গিয়ে আবারও ফোনে কথা হয়। তারপর জুতো খুলে নিবেদিতার ঘরে ঢুকি। ঘড়ি, টাইপরাইটার, পুরোনো রেডিও যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। সেইসময়ের ছবিটা মনে আঁকতে চেষ্টা করি। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর ভোররাতে জীবনাবসান হয় নিবেদিতার। তাঁর রোগশয্যাপাশে অবিরত বসে থাকা অবলাকেই শেষ কথা বলে গেলেন – 'The boat was sinking, but she will see the sunrise'। শেষমুহূর্তে নিবেদিতাকে হৈমবতী উমার মতো মনে হয়েছিল অবলার। যেন পিত্রালয় থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন উমা।
দোরগোড়ায় এসে মহারাজ হাত নেড়ে ডাক দেন। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসি। টেবিলের সামনের বেতের চেয়ারে মহারাজ, স্নেহময় চোখদুটো ঝকঝক করছে। লেখালেখি নিয়ে আলোচনা চলে। সমৃদ্ধ হই।

কাজ সেরে ঘুরে ঘুরে রায়ভিলা দেখি। মহারাজের ঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়াই। নিরাভরণ ঘরের মেঝেতে পাতা কম্বলে বসে পড়াশুনো করছে কয়েকটি স্কুলপড়ুয়া মেয়ে, এদেরকেই পড়াচ্ছিলেন মহারাজ, আমরা আসার আগে। বাইরের বিশাল খোলা ব্যালকনি থেকে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। বাড়ির ওপরতলায় গড়ে তোলা হচ্ছে একটি লাইব্রেরি। মহারাজের ঘরেও রয়েছে প্রচুর বই।

ম্যালে পৌঁছে গেছি। এখনও কুয়াশায় ঢাকা। ঝাড়ুদারেরা ঝাঁটা হাতে পরিষ্কার করছে। এই সকালেই পর্যটকেরা ভিড় জমিয়েছেন। ইতিউতি স্থানীয় মানুষজনও রয়েছেন। মাঝে মাঝে লুকোচুরি খেলার মতো ঘন কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া। ম্যালের চেয়ারগুলো সব ভর্তি। প্রভাতী ভ্রমণার্থীরা গায়ে মাথায় গরম পোশাক চাপিয়ে বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছেন, খবরের কাগজ পড়ছে্ন নাহলে নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন। কেউ কেউ আবার শরীর চর্চাও করে নিচ্ছেন। ঘোড়াওলারা ইতিউতি ঘোড়া নিয়ে ঘুরছে। কেউ কেউ সওয়ারও হয়েছেন। স্কুলে পৌঁছবার আগে ছেলেমেয়েরা এক জায়গায় জটলা করে গল্প করছে। একটি ছোট্ট মেয়ে ম্যাল পেরিয়ে স্কুলে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর উঠে পড়লাম আবার।

ম্যাল রোড দিয়ে নেমে গেলে শতাব্দী প্রাচীন দাস স্টুডিও আর তারপরে গ্লেনারি'জ। অন্যদিনের মতো সেদিকে যাব না আজ। আজকের গন্তব্য চিত্তরঞ্জন দাশের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। সেই বাড়িটিকেও এখন মিউজিয়াম করা হয়েছে। ম্যালের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা নেমে গেছে – সি. আর. দাস রোড, তার ডানদিকটা খাদ। সেই পথ দিয়ে কিছুটা নামলেই বাঁহাতে দোতলা বাড়িটি পড়ে - স্টেপ এসাইড।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে অসুস্থ শরীরে দার্জিলিং যাত্রা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন। সেবারে উঠেছিলেন কৌঁসুলি স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকারের এই বাড়ি 'স্টেপ অ্যাসাইড'-এ। দার্জিলিং-এ যাঁরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর মধ্যে ছিলেন গান্ধিজিও। স্বদেশের তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয় গান্ধী ও চিত্তরঞ্জনের । এরমধ্যে একদিন তিনি জগদীশচন্দ্র-অবলার দার্জিলিং-এর বাসা মায়াপুরীতেও যান। ডাক্তার দ্বারকানাথ রায়ের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাই চলছিল। ১৬ জুন বিকেলে দেশবন্ধুর জীবনাবসান হয়, এই বাড়িতেই। বাইরের দরজা বন্ধ ছিল। দরজা ঠেলে চত্ত্বরে ঢুকে দেখি বাড়ির দরজাও বন্ধ। সামনের কাঠের বেঞ্চে বসি। ভাবি এইখানে একদিন সেই মানুষগুলি বসে কথা বলেছেন, গল্প করেছেন...। আর আজ আমরা এসে বসেছি। মেঘ উঠে আসে খাদের গভীর থেকে। কুয়াশায় ক্রমশ সাদা হয়ে যায় চারদিক।

~ মুর্শিদাবাদের আরও ছবি ~

'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেছেন। বর্তমানে পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি স্বাধীন গবেষণায় রত। তাঁর সম্পাদনায় বেশ কয়েকটি পুরোনো ও নতুন ভ্রমণকাহিনির বই প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কাজ – আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত, ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গমহিলাদের ভ্রমণকথা (চার খণ্ড)। ভালোবাসেন বই পড়তে, গান শুনতে, লেখালেখি করতে আর বেড়াতে।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher