টিউবিংগেন আর বেবেনহাউসেন

কণাদ চৌধুরী


ভারত থেকে পশ্চিমমুখে পাড়ি জমায় যে সব বিমান, তাদের সিংহভাগই ভারতের মাটি ছেড়ে আকাশে ওড়ে ভারতীয় সময় মধ্যরাত্রে বা তার কিছু পরে। সিটবেল্ট খুলে রাখার ঘোষণাটা হয়ে যাওয়ার পরেই কেবিনের আলো নিভে যায়, অনেক মানুষ আছেন যারা যে কোনও অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ার মতো ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী, সেই ভাগ্যবান যাত্রীরা চোখের ওপর কালো পট্টি বেঁধে ঘুমিয়ে পড়েন। অনেকে আবার কীভাবে ঘুম আসবে, সেই চিন্তা করতে করতেই পুরো রাস্তাটা নিদ্রাহীন কাটিয়ে দেন। মাঝরাতে খাবার-টাবার পরিবেশন করার প্রয়োজন হয় না, তাই 'রিফ্রেশমেন্ট উইল বি সার্ভড' জাতীয় ঘোষণাও বন্ধ থাকে তখন। যাত্রীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের তত্ত্বাবধায়িকারা মাঝেসাঝে দু-একজনের প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে বিমানের এমাথা থেকে ওমাথা যাতায়াত করেন বটে, কিন্তু সেটুকু ছাড়া বিমানসেবিকাদের কর্মতৎপরতা সাধারণত সেসময় কিছুটা স্তিমিতই থাকে। বিমানের ইঞ্জিন থেকে ভেসে আসা ভ্রমরগুঞ্জনের মতো একটানা মৃদু আওয়াজটুকু বাদ দিলে প্রায়ান্ধকার কেবিন তখন প্রায় নিঃশব্দই থাকে। এরোপ্লেনে জানলার পাশের আসনটায় বসতে পারলে বাহনটা যে চলমান সেটা যদিবা একটু বোঝা যায়, কিন্তু দুই প্যাসেজের মধ্যবর্তী আসনের সারিতে বসার ব্যবস্থা হলে মনে হয় একটা বিশাল ধাতব কৌটোর মধ্যে আমাকে কেউ বন্ধ করে রেখেছে; এগোচ্ছিও না, পিছোচ্ছিও না; অন্তহীন সময় ধরে যেন আমাকে মহাশূন্যে নট-নড়নচড়ন অবস্থায় ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
দীর্ঘ আন্তর্জাতিক বিমানযাত্রায় শশী থারুর বর্ণিত ক্যাটল-ক্লাসে আমার মতো লম্বা মানুষের একটা প্রধান অসুবিধা হল, সারাটা রাস্তা হাঁটুজোড়া সামনে উপবিষ্ট যাত্রীর হেলিয়ে দেওয়া আসনের পেছনে গুঁতো খেতে থাকে, শরীরটাকে নানাভাবে ভাঁজ করে রাখার কসরত করতে করতে দু-চোখের পাতা কিছুতেই আর এক করা যায় না। অগত্যা মাথার ওপরের রিডিং লাইট জ্বেলে কিছুক্ষণ বইপত্র নাড়াচাড়া করে, অথবা সামনের ইন-ফ্লাইট এন্টারটেনমেন্ট সিস্টেমের পর্দায় কিছু উলটোপালটা ছবি দেখে প্রথম এক-দেড় ঘণ্টা কেটে যায় ঠিকই, কিন্তু তারপর থেকেই গ্রাস করে একঘেয়েমি, বিমানের ভিতরের পরিবেশকে তখন একেবারেই একমাত্রিক এবং বৈচিত্র্যহীন মনে হয়। আসনের সামনে রাখা পর্দায় বিমানের অবস্থান সম্পর্কিত যে সমস্ত তথ্য দেওয়া থাকে, সেখানে বারবার চোখ রেখে দেখতে ইচ্ছে করে নিজের গন্তব্য আর ঠিক কতটা দূরে। চার বছর আগে শেষবার যে লম্বা বিমানসফরে আসীন হয়েছিলাম, তখন মোবাইলের ক্যামেরায় সামনের সেই পর্দার ছবি তুলে রেখেছিলাম কয়েকটা। দেখছি সেই বছর জুলাই মাসের চার তারিখে ভারতীয় সময় সকাল ছটা নাগাদ আমাদের অবস্থান ছিল লুফত্‍হানসার ফ্রাঙ্কফুর্টগামী ফ্লাইট নম্বর এলএইচ৭৫৭ বিমানের অভ্যন্তরে। স্ক্রিনে ফুটে ওঠা বিমানের জিপিএস কো-অর্ডিনেটের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের মান থেকে বুঝতে পারছি সেই সময় বিমানের অবস্থান ছিল তুর্কমেনিস্থানের আকাশে, তখনও আরও প্রায় সাড়ে-পাঁচ ঘণ্টা আকাশপথে অতিবাহিত করার পরে তবেই বিমান ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে জার্মানির মাটি ছোঁবে। তারপরে আমাদের চারজনের দলটা ফ্রাঙ্কফুর্ট ছাড়িয়ে রেলপথে আরও এগিয়ে যাবে জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, সেখানে জার্মানির অন্যতম প্রধান শহর স্টুটগার্টের অনতিদূরে শহরতলি বোবলিংগেনে পৌঁছে তবেই আমাদের যাত্রা হবে শেষ, এবং শুরু হবে ভ্রমণ।

চার বছর আগে আমাদের সেই জার্মানি সফর ছিল এক হৃদয়জুড়ানো সুখানুভূতিতে পরিপূর্ণ। প্রবাসে জ্যেষ্ঠা কন্যা এবং জামাতার বিবাহোত্তর নিজস্ব সংসারে সেটাই ছিল আমাদের প্রথম পদার্পণ। তাদের সংসারযাপনের খণ্ডচিত্রগুলো মোবাইলের মাধ্যমে নিয়মিত দৃষ্টিগোচর হত সেকথা ঠিক, কিন্তু সেখানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তার পূর্ণরূপ প্রত্যক্ষ করার মধ্যে একটা আলাদা রোমাঞ্চ অবশ্যই ছিল। আর একটা কারণ, এটা ছিল সেই বিরলের মধ্যে বিরলতম একটা দেশভ্রমণ, যেখানে আসা-যাওয়ার টিকিট কাটা, প্রয়োজনীয় ভিসা আর ইনসিওরেন্স ইত্যাদি করানোর ঝামেলাটুকু বাদ দিলে সফরের আনুষাঙ্গিক পরিকল্পনা এবং রূপায়ণ নিয়ে আমাকে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতে হয়নি। জার্মানিতে কন্যার প্রবাসজীবন তখন মাত্র বছর-দুয়েকের পুরোনো, কিন্তু সেই অল্প সময়েই সে তার স্বামীর সঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছে বিস্তর, ইউরোপ ভ্রমণের প্রচুর অভিজ্ঞতা ততদিনে সঞ্চিত হয়েছে তাদের দুজনের ঝোলায়। জামাই তো বটেই, মেয়েও তখন বেশ পোক্ত ভ্রামণিক। তারা উভয়ে মিলে আমাদের ঘুরে বেড়ানোর রূপরেখাটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ছকে নিয়েছিল আমরা উপস্থিত হওয়ার আগেই। কাজেই আমরা নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়, নিঃশঙ্কচিত্তে শুধু তাদের পেছনে পেছনে ঘুরে বেরিয়েছি, তারা ডানদিকে যেতে বললে ডানদিকে গিয়েছি, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। কী কী দেখব, ট্রেনে উঠব না বাসে চড়ব, মেট্রো করে যাব না ট্রামে করে, থাকব কোথায়, খাব কী; যেখানেই বেড়াতে যাই না কেন, এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব থেকে খুব কম ক্ষেত্রেই আমার অব্যাহতি মেলে। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে আমার জন্যে এই বেড়ানোটা ছিল একটা উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম।

প্রদীপ জ্বালানোর আগে যখন সলতে পাকানোর কাজটা চলছে, তখন সে দেশ থেকে মেয়ে ফোনে বারবার জিগেস করত যে আমরা কোথায় কোথায় ঘুরতে যেতে চাই। আগেই ঠিক করেছিলাম, যদি কোনোদিন ওদিকে যাওয়া হয়, তাহলে এমন কিছু দেখতে চাইব না যা মনকে ক্লিষ্ট এবং সংক্ষুব্ধ করে তোলে। বিদেশ যাওয়ার সুযোগ জীবনে খুব বেশি জোটেনি, তাই বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও খুবই সীমিত। ভেবেছিলাম, পয়সা খরচা করে সামান্য কটা দিনের জন্যে বিদেশ ঘুরতে গেলে যা চোখকে তৃপ্তি দেয় এবং মনকে আনন্দদান করে, সেইরকম কিছু দ্রষ্টব্যের দিকেই দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রাখাটা বাঞ্ছনীয় হবে। তাই হিটলার, হলোকস্ট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কন্সেনট্রেশন ক্যাম্প এই সব মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলা ঐতিহাসিক স্মারক দেখার ইচ্ছে একেবারেই ছিল না, মনে হয়েছিল তার চাইতে বরং প্রকৃতি, শিল্প-সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের ওপর মনোনিবেশ করাই ভালো। এই ভাবনার মধ্যে যৌক্তিকতা কতটা ছিল জানি না, তবে মেয়ে এবং জামাতা সফরসূচিটা সাজিয়েছিল আমাদের এই ইচ্ছের কথা মাথায় রেখেই। এর আগে যখন স্ক্যান্ডিনেভিয়া ঘুরতে এসেছিলাম, সেবার পুরো বেড়ানোটাই ছিল ভ্রমণ সংস্থার আয়োজনের অধীনে। কিন্তু এই সফরে দ্রষ্টব্য জায়গাগুলোর সবটাই নিজেদের পরিকল্পনায় এবং হাতে একটু সময় নিয়ে ঘুরে দেখা হয়েছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পায়ে হেঁটে আর স্থানীয় গণ-পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে। ভ্রমণ-সংস্থার বাসে চড়ে তাদের পথনির্দেশকের নির্ধারিত বাঁধাধরা পথে এবং সময়ের নিগড়ে আটকে থাকা ঝাঁকিদর্শনকে সম্পূর্ণ পরিহার করার ফলে ওইসব দর্শনীয় স্থানগুলোতে আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুগুলো তো বটেই, তাছাড়াও সেখানকার সাধারণ বাড়ি-ঘর, বাজার-হাট বা রাস্তা-ঘাটগুলোর একটু কাছাকাছি পৌঁছানোর সুযোগ হয়েছিল। ইউরোপের তিনটে দেশের তিনটে বড়ো শহর – প্রাহা ওরফে প্রাগ, ভিয়েনা এবং ব্রুসেলস্ ছাড়াও দিনে-দিনের সফরে মেয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছিল বোবলিংগেনের কাছাকাছি বেশ কয়েকটা আকর্ষণীয় জায়গা, ভারতীয় পর্যটকদের অনেকেই যেসব জায়গার নামের সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন। সেইরকমই দুটো জায়গা ছিল টিউবিংগেন এবং বেবেনহাউসেন।

জার্মানিতে পা রাখার পরের দিনই ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা হাতে বেরিয়ে পরা গেল রাস্তায়। আমাগো দ্যাশের মতো আকাশভাঙা, জনজীবন অচল করা ধারাবর্ষণ এখানে হয় কি না জানা নেই, তবে এই টাপুরটুপুর ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টিকে এদেশে কেউ খুব একটা পরোয়া করে না। যে জায়গার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া হয়েছিল, তার নাম Tübingen, বা টিউবিংগেন। স্টুটগার্টের কাছেই এক শহরতলি বোবলিংগেনে মেয়ে-জামাইয়ের বাসস্থান – সেখান থেকে দু-তিন স্টেশন দূরে হেরেনবার্গ (Herrenberg)। হেরেনবার্গ থেকে ট্রেন বদল করে নেকার নদীর ধারে অবস্থিত টিউবিংগেন পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় আধ-ঘণ্টা। জার্মান সংস্কৃতিতে একটা প্রবাদপ্রতিম কথা আছে 'Ordnung muss sein' – ইংরেজিতে যার অর্থ 'দেয়ার মাস্ট বি অর্ডার'। জীবনে 'অর্ডার', মানে নিয়ম-শৃঙ্খলার এর অভাব ঘটলে জার্মানরা বড়ই অসহায় এবং বিচলিত বোধ করেন, তাই দেখা গেল এখানে রাস্তাঘাটে সেই 'অর্ডার'-এর ছড়াছড়ি। বিশ্বের যে প্রান্ত থেকে আমরা এসেছি, সেখানে আবার 'অর্ডার'-এর অনুপস্থিতিটাই স্বাভাবিক, তাই প্রথম দিন পথে নেমে পদেপদেই অনুভূত হল জনজীবনে সেই বিশ্বখ্যাত জার্মান নিয়মানুবর্তিতা এবং সুশৃঙ্খলা। সময় মেনে বাস আসছে, ট্রেন চলছে, কোনও হুড়োহুড়ি বা ঠেলাঠেলি নেই, লোকজন লাইন দিয়ে ওঠানামা করছে নিঃশব্দে, এমনকি ট্রেনে উঠেছে যে পোষা সারমেয়গুলো, তারা পর্যন্ত রীতিমত সুশিক্ষিত, একবারের জন্যেও তাদের কাউকে ঘেউ-ঘেউ করতে শুনলাম না। আর অফিস-টাইমের বনগাঁ লোকালে চড়া বাঙাল আমরা, এখানকার লাল-নীল-হলুদ রঙের আপাদমস্তক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ট্রেনের চেহারা দেখে প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে চাইছিলাম না যে এগুলো লোকাল ট্রেন। ট্রেনের জানলার অতবড় কাঁচগুলোতে আঁচড়ের দাগ নেই, দুপাশে পুরু ধুলোর আস্তরণ নেই, কামরার দেওয়ালে কোচিং সেন্টার অথবা হেকিমি দাওয়াইয়ের বিজ্ঞাপন সাঁটা নেই, আর পানের পিক বা গুটখার দাগটাগ তো একেবারেই নেই। তারপর যখন শুনলাম এখানে ট্রেনের কামরায় জোরে জোরে কথা বলা বারণ, তখন মনে হল "ইয়ে কাঁহা আ গয়ে হম!"
স্টুটগার্ট থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত ছোট্ট শহর টিউবিংগেনের ইতিহাস প্রায় এগারোশো বছরের পুরোনো। এর খ্যাতি মুখ্যত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, শহরে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই ছাত্র-ছাত্রী। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান্স কেপলার এবং দার্শনিক হেগেল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের অন্যতম। জার্মানিতে এইসব ছোট শহরগুলোর প্রাচীন অংশ, যাকে বলা হয় Altstadt (জার্মান উচ্চারণে আলস্টাট), তাদের বিন্যাস অনেকটা একই ধাঁচের। সেখানে থাকে একটা উপাসনাগৃহ বা চার্চ, একটা টাউন হল বা Rathaus (জার্মান উচ্চারণে রাটহাউস), পাথরে বাঁধানো রাস্তাঘাট, আর বেশ কিছু কাঠের ফ্রেমে তৈরি বাড়িঘর, যেগুলোর অভ্যন্তরে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও বহিরঙ্গের প্রাচীন চেহারাটা সুন্দরভাবে সংরক্ষিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির অনেক ঐতিহাসিক শহর মিত্রশক্তির বোমার আঘাতে কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও টিউবিংগেন সে তুলনায় অক্ষতই ছিল বলা চলে, যার ফলে পুরোনো অংশের চেহারাটা প্রায় অবিকৃত রয়ে গিয়েছে, অনেক পর্যটকই যা দেখতে টিউবিংগেনে ভিড় জমান। পুরোনো শহরের কেন্দ্রস্থলে আছে প্রাচীন সেন্ট জর্জেস কলিজিয়েট চার্চ, আর আছে চারশো বছরেরও বেশি পুরোনো টাউন হল, তার সম্মুখভাগে অলংকৃত স্থাপত্যের অংশ হিসাবে আছে এখনও চালু থাকা একটা 'অ্যাস্ট্রোনমিকাল ক্লক'। এই পুরোনো শহর এলাকার আরও একটা বৈশিষ্ট্য এখানকার 'হাফ-টিমবার হাউস'।

এই বাড়িগুলোর বাইরের এবং ভিতরের দেওয়াল কাঠের ফ্রেমে তৈরি আর ফ্রেমের মধ্যবর্তী ফাঁকা অংশটুকু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইট বা প্লাস্টার দিয়ে ভরাট করা হয়ে থাকে। পুরোনো শহরের সরু সরু পাথরে বাঁধানো আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাচীন রংচঙে বাড়িগুলোর সামনের দিকে কাঠের ফ্রেমের জ্যামিতিক কারুকাজ আর ওলটানো 'ভি' অক্ষরের মতো ছাদ এক মনোরম মধ্যযুগীয় পরিবেশ তৈরি করে। রাস্তা দিয়ে অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হতেই পারে শহরটা যেন গ্রিম ভাইদের লেখা জার্মান রূপকথার বইয়ের পাতায় আঁকা কোনও ছবি থেকে সোজাসুজি উঠে এসেছে।

শহরে ঢোকার মুখেই নেকার নদীর ওপর আছে 'এবেরহার্ড ব্রিজ'। নেকার নদী এই জায়গায় দুটো ধারায় ভাগ হয়ে গিয়ে তৈরি করেছে নেকার আইল্যান্ড। রঙিন ফুলে সুসজ্জিত 'এবেরহার্ড ব্রিজ'-এর লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা যায় নেকার আইল্যান্ডে। দ্বীপের মাঝ-বরাবর রয়েছে 'প্লাটানেনালি' - সারিবদ্ধ এবং সুউচ্চ তরুবীথির মধ্যে দিয়ে দ্বীপের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অবধি প্রসারিত পদচারণার জায়গা। একই ধরণের গাছগুলোর বেশ কয়েকটার বয়েস দুশো বছরেরও বেশি।

দ্বীপের একদিকে নদীতে বাঁধা আছে বেশকিছু কাঠের লগিতে ঠেলা নৌকো। নদীর অপর প্রান্তে তিন-চারশো বছরের পুরোনো সারিবদ্ধ কাঠের বাড়িগুলো, নৌকায় চড়ে যেগুলোর পাশ দিয়ে নেকার নদীতে জলবিহার টিউবিংগেন ঘুরতে আসা পর্যটকদের অন্যতম প্রধান বিনোদন। ব্রিজের এক প্রান্তে একটা লাল রঙের বাড়ি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য, বাড়ির গায়ে প্রচুর দেওয়াল-চিত্র এবং স্লোগান দেখে বোঝা যাচ্ছিল সেটার সম্ভাব্য চরিত্র। দেওয়ালে এক জায়গায় বেশ বড় করে লেখা ছিল 'Kein Mensch Ist Illegal', অর্থাৎ কেউই বেআইনি নয়। তখন খোঁজ নেওয়া হয়নি, পরে জেনেছিলাম বাড়িটার নাম ছিল 'এপেলহাউস' (Epplehaus), বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্র-যুবদের সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র সেটা।

টিউবিংগেনের 'আলস্টাট' অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতে করতে ঘড়িতে বিকেল সাড়ে-চারটে বেজে গেলেও যেহেতু গরমকালে এখানে রাত নটা অবধি ঝকঝকে দিনের আলো থাকে, কাজেই ফেরার পথ ধরার আগে ঘুরে দেখে নেওয়া যাবে টিউবিংগেনেরই নিকটবর্তী আরও একটা দর্শনীয় জায়গা, যার নাম 'বেবেনহাউসেন ক্লস্টার' বা 'বেবেনহাউসেন অ্যাবে'।

টিউবিংগেনের উত্তরে শ্যনবাখ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত একটা ছোট্ট গ্রাম বেবেনহাউসেন (Bebenhausen), সেখানেই রয়েছে প্রায় একহাজার বছর আগে নির্মিত এই 'অ্যাবে' বা মঠ। দুইপাশে সামান্য উঁচুনিচু পাহাড়ি বনভূমির মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রায় মিনিট দশেক বাসযাত্রার পর বেবেনহাউসেন গ্রামের যে বাসস্টপে নামতে হল, তার চতুর্দিক জনমানবশূন্য। বাসস্টপের পাশ দিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলে অ্যাবের মূল প্রবেশপথ। দেখে মনে হল প্রবেশপথের সামনের চত্বরে দিনের বেলা বাজার বসেছিল, যার পোশাকি নাম 'ফার্মার্স মার্কেট'। ভর সন্ধ্যেবেলা আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছি তখন ভাঙা হাটে প্রায় সব ক্রেতা-বিক্রেতাই ঘরের পানে রওয়ানা দিয়েছেন, কেবল একজন মাত্র দোকানি তার অবিক্রীত সওদা গাড়িতে তুলছিলেন। ইতিহাস বলছে, ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত মধ্যযুগীয় এই বেবেনহাউসেন অ্যাবেকে ত্রয়োদশ এবং পঞ্চদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ জার্মানির অন্যতম সমৃদ্ধশালী ধর্মীয় আশ্রম হিসাবে গণ্য করা হত। ষোড়শ শতকে উরটেমবার্গ কাউন্টির শাসকেরা এই মঠের অবলুপ্তি ঘটিয়ে সেখানে একটা আবাসিক বিদ্যালয় এবং প্রোটেস্টান্ট ধর্মচর্চার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। বনাঞ্চলের সন্নিকটে হওয়ার ফলে পরবর্তীকালে উরটেমবার্গের প্রথম রাজা মঠের একটা অংশ অধিগ্রহণ করে সেখান নিজের জন্যে একটা প্রাসাদ তৈরি করেন, শিকারের সময় রাজপুরুষদের থাকার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হত সেটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে উরটেমবার্গ রাজত্বের অবসান হলে সিংহাসনচ্যুত রাজা-রানি এই মঠেই কাটিয়েছিলেন বাকি জীবনটা।

দিনের শেষে বেবেনহাউসেন অ্যাবের দর্শক বলতে তখন আমরাই কয়েকজন। বর্তমানে এই মঠ এবং সংলগ্ন গির্জার অভ্যন্তরে সেই মধ্যযুগীয় আবহের প্রায় অবিকল একটা প্রতিরূপ সাজিয়ে রাখা আছে। ঘুরে দেখা হল গির্জা, যাজকদের থাকার জায়গা, তাদের ভোজনকক্ষ, গথিকশৈলীর খিলান-যুক্ত প্রশস্ত অলিন্দ। নির্জন মঠের নিঃশব্দ অভ্যন্তরে সভাকক্ষের প্রাচীন আসবাব আর আলো-আঁধারি পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিল সাদা জোব্বা পরিহিত যাজকেরা বুঝি লাতিন ভাষায় ধর্মালোচনা করতে করতে সদ্যই সেখান থেকে উঠে চলে গিয়েছেন।

বেবেনহাউসেন দেখা শেষ করে ঘরে ফেরার পথে হেরেনবার্গ স্টেশনে এসে দেখা গেল বোবলিংগেন যাওয়ার ট্রেন পেতে তখন হাতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় আছে। সেই সময়টুকুও সদ্ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে চট করে একটা চক্কর লাগিয়ে আসা হল হেরেনবার্গ শহরের পুরোনো এলাকাটায়। স্টেশন থেকে বেশি দূরেও ছিল না জায়গাটা, তাই হেঁটেই পৌঁছানো গিয়েছিল সেখানে। ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত গির্জা, টাউন হল আর বেশ কয়েকটা চোখ-জুড়ানো 'হাফ-টিমবার হাউস' নিয়ে হেরেনবার্গের 'আলস্টাট' অঞ্চলটাও টিউবিংগেনের মতোই তার প্রাচীন চেহারা প্রায় অবিকৃত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বেড়ানো শুরুর প্রথম দিনটাতেই টিউবিংগেন, বেবেনহাউসেন আর হেরেনবার্গের মতো অপেক্ষাকৃত অপ্রসিদ্ধ জায়গাগুলোতে একটা গোটা দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা সেবারের ইউরোপ সফরের মূল সুরটা বেঁধে দিয়েছিল গোড়াতেই। সেই গ্রীষ্মে পরবর্তী তিন সপ্তাহে ইউরোপের তিনটে বড়ো শহর এবং জার্মানির আরও কয়েকটা অল্প-পরিচিত জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রত্যেক জায়গাতেই রীতিমত বিস্মিত হয়ে দেখেছি যে প্রাচীন ঐতিহ্যের রূপটিকে যথাসম্ভব অবিকল রেখে প্রত্নতাত্ত্বিক স্মারকচিহ্নগুলোকে আধুনিক পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার কাজে ইউরোপের দেশগুলোর প্রশাসন এবং সেখানকার মানুষ কতটা যত্নবান। দক্ষিণ জার্মানির তুলনামূলকভাবে অখ্যাত অথচ চিত্তাকর্ষক এই তিনটে পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে দেখার মধ্যে দিয়েই সেই মুগ্ধতার মুখবন্ধটা লেখা হয়েছিল।

শৈশব থেকে এখনও পর্যন্ত বসবাস কলকাতায়। আইআইটি, খড়গপুর থেকে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্র্যাজুয়েশন এবং পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন। কর্মজীবন কেটেছে ভারতের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থায়। বর্তমানে সম্পূর্ণ অবসরপ্রাপ্ত, সময় কাটে বেহালা বাজিয়ে আর নানান ধরণের গান-বাজনা শুনে। তাছাড়া একটু-আধটু বই পড়া, টুকটাক লেখালেখি, এদিক-ওদিক বেড়ানো আর সুযোগ পেলে পাখির ছবি তোলা এগুলোও আছে।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher