বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

সূর্যাস্তের হাট

তৃষ্ণা বসাক


ডাক বাংলো রোড

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘটনাটা এরকম নয়। বাড়ির গেটের বাইরে পা ফেলে আবাসনের পলাশ গাছটা, একেক দুপুরে সেই আমার পর্যটনকেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিংবা, একটু হেঁটে স্পেন্সার, ডোমিনো'জ ফেলে বাঁদিকে গেলেই বুদের হাট। যেখানে নগরায়নকে তুড়ি মেরে এখনো মাঝে মাঝেই মোরগ লড়াই, ঘুগনির বিকিকিনি আর টিপ চুড়ি সিঁদুরের সম্ভার। সেই বুদের হাট থেকে সূর্যাস্তের হাটে যেতে বেশি সময় লাগে না।
এখানে যাওয়ার কথা হচ্ছিল অনেকদিন ধরেই। ডাক আসছিল তরুণ বন্ধুদের কাছ থেকে। কিন্তু ঠিক ব্যাটে বলে হচ্ছিল না। এই করতে করতে একদিন হাওড়া মেদিনীপুর লোকালে চেপে বসলাম। ১১ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ট্রেন ছাড়ল ১২.২৫ মিনিটে। পৌঁছতে চারটে বাজল। নেমে একটা টোটোতে মৃত্তিকা। রানি শিরোমণি টুরিস্ট লজ। এখন নাম মৃত্তিকা টুরিস্ট প্রপার্টি।
আবাসনের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই মন ভালো হয়ে গেল। সরকারি আবাস কেন্দ্র যেমন হয়, অনেক ফেলা ছড়ার জায়গা। প্রাইভেট হোটেলের তৎপরতা না থাকল, এখানে বেশ একটা গা ছেড়ে দেবার আমেজ আছে। প্রাণের আরাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, পাশেই একটা খুব পুরনো আর পরিত্যক্ত বাংলো চোখে পড়ল। ডাক বাংলো। ১৯০৩। ক্ষয়ে আসা হরফে সালটা দেখে বেশ রোমাঞ্চ জাগে। তার উল্টো দিকে বর্তমানের আবাসের সিঁড়ি থেকে ওপরের বারান্দা ভরে আছে ঝরা শিশু গাছের পাতায়। রোদ পড়ে আসা বিকেলের একটা নিজস্ব নির্জন গন্ধ থাকে। লম্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই গন্ধ নেবার সময় একটু বেশিই পাওয়া গেল, কারণ ঘরের চাবি লাগছিল না। সরকারি আবাসের এটা এক বিশেষত্ব। প্রচুর স্পেস, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ নেই।

নদীর বুকে সূর্যাস্ত দেখব বলে

ঘরে ঢুকে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেওয়া। এখনই একদল তরুণ বন্ধু আসবে। তাদের সঙ্গে যাব কাঁসাই নদীর কাছে। কাঁসাই নদীতে সূর্যাস্ত দেখার কথা। তারা আসতে দেরি করে ফেলে, যখন আসে তখন সূর্য ঢলে যায় যায়। গাড়ি নিয়ে এসেছিল কবি অর্থিতা, সে বা তার ড্রাইভার রাস্তা চেনে না। আর বাইকে কম্যান্ডো বাহিনির মতো যাদের সামনে সামনে যাওয়ার কথা ছিল, দুখানন্দ আর অভিষেক, তারা একটু পরে কোথাও যে উধাও হয়ে গেল!
ফোনে ধরা হতে তারা খুব বিরক্ত হয়ে বলল, 'আরে পলিটেকনিকের গলি দিয়ে ঢুকতে হবে বললাম না?'
কে বলেছে আর কে শুনেছে খোদায় মালুম। সে রাস্তা দিয়ে ঢোকাও হল, আরেকটু এগোলে কলেজ, সেদিকে গেলে নদীর থেকে দূরে যাওয়া হয়, এই আন্দাজে আমরা বাম পন্থা বিবেচনা করলাম। এবার রাস্তা অতি সরু, নদীর নাম তো নেই, গন্ধও পাওয়া গেল না। তবু বুঝলাম নদী আছে খুব কাছেই। কারণ পাশ দিয়ে বাইকে, হেঁটে জোড়ায় জোড়ায় যেভাবে চলেছিল, সামনে নদী না থাকলে এখানে কে আসে? কমন সেন্স, ওয়াটসন কমন সেন্স!
একটি এলোমেলো বড় মাঠ, ইতস্তত লে'জ, কুড়কুড়ের খালি প্যাকেট ঘুরছে হাওয়ায়, নদীর হাওয়ায়। 'সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ, প্রভাতে পড়ে না ঝাঁট।' এমনি হাট বটে। এর নাম হচ্ছে সূর্যাস্তের হাট। মূলত মেয়েরাই দেখছি হাটে পসরা সাজিয়ে বসেছে। আগে শাড়ি গামছা সংসারের হাঁড়ি পাতিল-সব থাকত। এখন পসরার মধ্যে ঘুগনি, প্যাকেট করা সাবুর পাঁপড়, চালের পাপড়, রঙিন আলু চিপস- এই সব চোখে পড়ল। আগে নাকি এখানে ছোট পত্রিকাগুলি তাদের সম্ভার সাজিয়ে বসত। শুধু বিক্রির জন্যে নয়। আলোচনা, কবিতা পাঠ - সবই হত। এখন সেসব উঠে গেছে। কবিতা পড়ার লোক কমে গেছে, নাকি এই হাট লোকালয় থেকে দূরে বলে বিক্রিবাটা তেমন হয় না, নাকি পৃথিবী বৃদ্ধা হইয়াছেন? আগে যারা উৎসাহ নিয়ে পত্রপত্রিকা করেছেন, সাইকেলে বা হেঁটে কাঁধে বিশাল ঝোলা নিয়ে আসার মতো যৌবন ছিল, ছিল পাগলামির বয়স, এখন চল্লিশ পেরিয়ে চালশে, রাতদুপুরে কাশি এবং স্বপ্নভঙ্গ। নদী আর কথা বলে না নাকি তাদের সঙ্গে?
সে যাই হোক। কিন্তু হাটে লোক মন্দ হয়নি, বেশিরভাগ অবশ্য সূর্যাস্ত দেখতে এসেছে। 'কংসাবতী' বা কাঁসাই দক্ষিণপশ্চিম পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান নদী। কালিদাসের মেঘদূত ও অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যগ্রন্থে এই নদী কপিশা নামে উল্লিখিত। কিংবদন্তি অনুসারে, সমুদ্রের কাছে বাগদত্তা কংসাবতী, কৃষ্ণ দামোদর নদের রূপে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলে কংসাবতী দ্রুত ধাবমান হয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়।
পুরুলিয়া জেলার ঝালদা অঞ্চলে প্রায় ৬০০ মিটার উঁচু পাহাড় জাবড়বন কাঁসাই নালার আকারে কংসাবতী নদীর উৎপত্তি। নিকটবর্তী অযোধ্যা পাহাড় থেকে সাহারঝোরা নামে একটি ছোট নালা এরপর বেগুনকুদারের কাছে কংসাবতীতে মিশেছে। তেলদিহি গ্রামের কাছে বান্দু বা বন্ধু নদী কংসাবতীতে পড়েছে।
এরপর কংসাবতী পুরুলিয়া-চান্ডিল রেললাইন পেরিয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে কিছুদূরে কারমারা নামার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভেদুয়া গ্রাম পার হয়ে এই নদী বাঁকুড়া জেলায় প্রবেশ করেছে। বাঁকুড়াতেই কংসাবতীর প্রধান উপনদী কুমারী নদীর সঙ্গে এর মিলন। মুকুটমণিপুরে কংসাবতী ও কুমারী নদীর মিলনস্থলে বিখ্যাত কংসাবতী বাঁধ ও জলাধারটি গড়ে উঠেছে।

বাঁধ ছেড়ে বেরিয়ে রায়পুরের পাশ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে মেদিনীপুর জেলার বিনপুর অঞ্চলে প্রবেশ করেছে কংসাবতী। ভৈরববাঁকী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এরপর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করেছে এই নদী। কেশপুরের কাছে নদী দুটি শাখায় ভাগ হয়ে গেছে। একটি শাখা দাশপুর অঞ্চলের ওপর দিয়ে পালারপাই নামে প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদের দিকে এগিয়ে গেছে ও অপর শাখাটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে কালিয়াঘাই বা কেলেঘাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
কাঁসাই বা কংসাবতী নদী এই জায়গাটায় চওড়া থেকে সরু হয়ে গেছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে তাকে রবীন্দ্রনাথের আঁকা রহস্যময়ী নারীর মতো দেখায়। দুপারে গাছের সিল্যুয়েট। এই সূর্যাস্তের হাটে এখন এদিক ওদিক বিপজ্জনকভাবে পড়ে আছে মদের খালি বোতল, এমনকি কাচের টুকরো। রাতে এখানে স্থানীয় যুবকদের আড্ডা মদ্যপান চলে। উড়ে যাওয়া চিপসের প্যাকেটগুলি দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল গোদাপিয়াশাল স্কুলের শিক্ষক মণিকাঞ্চন রায়ের কথা। তিনিই এই হাটের প্রধান উদ্যোক্তা। গাছ তাঁর প্রাণ। রাস্তায় গাছ পড়ে থাকতে দেখলেও তুলে নিয়ে চলে আসেন। প্রথমে গাছটিকে সুস্থ করে তোলেন। তারপর কোনও একটি জায়গায় তা পুঁতে দেন। একবার মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে এক আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে যান। দেখেন একটি গাছকে কেউ ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে। সেটিকে তুলে এনে ফের উপযুক্ত পরিবেশে লাগিয়ে দেন।
সেই মণিকাঞ্চন সরকারি বন্ধ্যা জমিতে সরকারি আধিকারিকের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন, 'সূর্যাস্তের হাট'। মেদিনীপুর শহর ঘেঁষা কাঁসাই নদীর ধারে রেল ব্রিজের কাছে ল্যাটেরাইট মাটিতে নিজ উদ্যোগে প্রায় দেড়শোর উপর চারা লাগিয়ে যত্ন করে বড় করে তুলেছেন। সূর্যাস্ত হাটে তিনি বসিয়েছেন স্থানীয় হাতের কাজে দক্ষ শিল্পী এবং দুঃস্থ অনেক মহিলাকে যাঁরা বাড়িতে বড়ি আচার তৈরি করে হাটে বিক্রি করেন। ক্রমে সেখানে হাতের কাজ ছাড়াও পত্রপত্রিকা আসে। করোনার সময় বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার চালু হয়েছে। তবু যেন সেই ছন্দে ফিরছে না।

'যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে সব সঙ্গীত ইঙ্গিতে গেছে থামিয়া'

হাঁটতে হাঁটতে একেবারে নদীর কিনারায় আসি। বাঁদিকে রেল ব্রিজ। নদী অনেক নিচুতে। সেখানে গরু চরাতে এবং কাঠকুটো সংগ্রহ করতে দু-একজনকে দেখা গেল। ওদিকে যে নদীর ওপর এক শিল্পী তাঁর প্যালেটের সব লাল রঙ ঢেলে দিয়েছেন, আর সেই লালে মিশেছে ক্রমে গাঢ় হওয়া অন্ধকার, সেই অপূর্ব ছবি দেখার অবসর জীবন তাদের দেয়নি। আমরা এতক্ষণ চা খাব বলে কোলাহল করছিলাম, কিন্তু কাঁসাই নদীর ওপর অস্তরাগের রঙ আমাদের চুপ করিয়ে দিল। একদম নদীর ধারে একটা নিষ্পত্র শিমুল গাছ, আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনারত মানুষের মতো লাগছিল। সেদিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা হওয়ার একটা মানে নিজের বুকের ভেতরে টের পেলাম। সন্ধ্যা মানে সারা দিনের ব্যস্ততার অবসান, সারাদিন পর নিজের মুখোমুখি হবার সময়। মনে হল সুগোল লাল সূর্যের টুপ করে নদীবক্ষে ডুবে যাওয়া দেখতে না পেলেও কোন ক্ষতি হয়নি। যা দেখেছি, তা চিরকালের স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে থাকল।

আচমকা ঝমঝম শব্দে পাশের রেল ব্রিজ দিয়ে উল্টোদিকে ট্রেন চলে গেল আর ট্রেনের জানলার খোপ খোপ আলো জলে এঁকে দিল সে কোন চিত্রকর! তবে চিত্রকর বড় আনমনা, তার আঁকা পরক্ষণেই ভাসিয়ে নিয়ে গেল জল, সে তা খেয়ালই করল না। তবে জল মুছে দিলেও, আমাদের বুকে রয়ে গেল সেই ছবি । হাটে পসরা গোটাচ্ছিল সবাই। আমরা ভাঙা হাটের মধ্যে দিয়ে ভরা মন নিয়ে ফিরছিলাম। আর তারপরেই শুরু হয়ে গেল সত্যিকারের পর্যটন।

 

এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ কবি ও কথাকার তৃষ্ণা বসাক গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী অনুবাদকর্মে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। তাঁর বিভিন্ন গল্প-কবিতা ইংরেজি, হিন্দি, মালয়ালম, মৈথিলী ও ওড়িয়ায় অনূদিত হয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রদত্ত ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার (২০১৩), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সোমেন চন্দ স্মারক সম্মান (২০১৮) সহ নানান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

 

রাবড়ি গ্রাম ভ্রমণ

সৌমাভ ঘোষ


দুর্গাপুজো ছাড়াও মিষ্টি হল বাঙালি জাতির আর একটা পরিচয়। এত ধরনের মিষ্টি, আর তাদের উদ্ভাবনের এতরকমের ইতিহাস, এ শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। এও তো একটা শিল্প। শিল্প থাকলেই থাকবে তার সমঝদার। তবে তো শিল্পীর মন ভরবে শিল্প সৃষ্টি করে। চিত্রকর চান দর্শক, গায়ক চান শ্রোতা, লেখক চান পাঠক। মিষ্টি শিল্পের কারিগর যারা 'মোদক' বা 'ময়রা' নামে পরিচিত, তাঁরাও চান সমঝদার যাদের এক কথায় বলা যায় 'খাদ্যরসিক' বা 'খাদক'। খাদক প্রজাতিটি না থাকলে ময়রার পরিশ্রম বৃথা। এবার আমাদের কথায় আসি। আমরা এই খাদক প্রজাতির। তবে এটা বললে পুরোটা বলা হয় না। আমরা পছন্দ করি যেখানে যে মিষ্টির উদ্ভব সেই স্থানে নিজেরা গিয়ে সেই মিষ্টির স্বাদ আস্বাদন করতে এবং সঙ্গে সেই জায়গাটি ঘুরে দেখতে। বাঙালির পায়ের তলায় যেমন আছে সর্ষে, তেমনই জিভে আছে মিষ্টির আস্বাদনের অনুভূতি। এছাড়াও এর ফলে ওই যে বলে 'রথ দেখা কলা বেচা' দুইই হয়। ঘুরতে ঘুরতে খাওয়া হয় বা খেতে খেতে ঘোরা হয়। এইভাবে কম জায়গায় তো আর মিষ্টির পিছু ধাওয়া করে গেলাম না! কলকাতার কথা বাদ দিলে, সরভাজা আর সরপুড়িয়ার জন্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী কৃষ্ণনগর, মিহিদানা, সীতাভোগের জন্য বর্ধমান, ক্ষীর দই-এর টানে লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নবদ্বীপ, ছানাবড়ার আহ্বানে সুবে বাঙলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ, মনোহরার জন্য জনাই, জলভরা তালশাঁসের জন্য চন্দননগর। আর মজার ব্যাপার হল আমাদের দেশে রাজা বা নবাবের সংখ্যা অসংখ্য হওয়ায়, রাজকর্মচারীর সংখ্যাও অনেক। তাই মিষ্টি খেতে গিয়ে কোথাও হতাশ হতে হয় না। রাজা বা নবাবদের কীর্তি না থাকলেও রাজকর্মচারীদের নির্মাণ কাজ দেখে চোখ, মন আর মিষ্টি খেয়ে জিভ সার্থক করে ফেরা যায়। কিন্তু ২০২০ সালের দোলের আগের দিন আমরা পাড়ি জমিয়ে ছিলাম একটি অখ্যাত গ্রামে। গ্রামটির নাম আঁইয়া। যেখানে রাজা, বাদশাহ এমনকি রাজকর্মচারীদের কারোর কোনও কীর্তি নেই। কিন্তু এখানকার সৃষ্ট বস্তু সবারই মনোরঞ্জন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিছু দ্রষ্টব্য স্থান নেই যখন, সুতরাং মিষ্টিটাই একমাত্র লক্ষ্য। যখনকার কথা বলছি তখন করোনা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুই খবরের কাগজের পাতায়। তাই মাস্ক, স্যানিটাইজার, লকডাউন এগুলোর সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়িনি। সবই তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। সকাল সকাল বনহুগলী থেকে ২৬ সি বাসে চেপে বসলাম আমরা। অবশ্য বসার আগেই কচুড়ি, জিলিপি ও ধোঁয়া ওঠা চা দিয়ে রাতঘুমের ফাস্টিংটা ব্রেক করে নিয়েছিলাম। যেতে যেতে গন্তব্য সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক। আগেই বলেছি গ্রামটি অখ্যাত হলেও তার পণ্য বিখ্যাত। তাই গ্রামের আসল নাম মুছে গিয়ে গ্রামটি এখন পণ্যের নামেই পরিচিত। তাই বাসে সেই নাম বলতেই বুঝে গেল। যথাসময়ে কন্ডাক্টর নামিয়ে দিল সেই গ্রামের রাস্তার মুখে। হেঁটে চললাম গ্রামের দিকে। আর প্রতিটা বাড়ি থেকেই নাকে আসতে লাগল দুধ জ্বাল দেওয়ার গন্ধ।

ভনিতা অনেক হল। পাঠকরা নিশ্চয়ই ভাবছেন এ আবার কীরকম জায়গা। এবার এরা কি গরম দুধ খেতে এল নাকি! না না এসেছি আমরা রাবড়ি ভক্ষণ করতে। হ্যাঁ সেই রাবড়ি যাতে পাতলা দুধের মধ্যে সাঁতার কেটে বেড়ায় মোটা মোটা দুধের সর। "রাবড়ি" কে না ভালবাসে? রাবড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি অনেক করেছি। কিন্তু সেদিন আমরা সপরিবারে হানা দিয়েছিলাম সেই গ্রামে। যে গ্রাম এখন "রাবড়ি গ্রাম" নামে পরিচিত, আসল নামটি খাতায় কলমে হয়ত রয়েছে।

প্রতিটি ঘরে রাবড়ি তৈরি হচ্ছে আর ভেসে আসছে দুধ জ্বাল দেওয়ার গন্ধ। কোথাও দুধ ঘন হচ্ছে, কোথাও বা গরম দুধে বাতাস করে সর তৈরি হচ্ছে, কেউ বা জমাট বাঁধা মোটা সর কাটছে। এই কাটা সরগুলোকেই ছেড়ে দেওয়া হয় জ্বাল দেওয়া দুধের মধ্যে। যেখানে তারা স্বচ্ছন্দে সাঁতরে চলে। রাবড়িকে যোগ্য সঙ্গত দিল মোটা রসের "সরভাজা"। এমনি সরভাজার থেকে তফাত হল দুপাশে মোটা সরের মাঝখানে রয়েছে ছানা, সুজি ও ময়দা মিশ্রিত পুর। সরভাজাটিকে দুই আঙুলে ধরে হাল্কা দাঁতের চাপ দিলেই সারা মুখ ঐ মিশ্রণে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। সত্যিই এক স্বর্গীয় অনুভূতি। নতুন অভিজ্ঞতা, খাওয়াও হল। আবার কেনাও হল। এবার ফেরার পালা। প্রাক-হোরি খেলা একটা ক্ষুদ্র ভ্রমণ যা আমাদের মনন এবং রসনাকে রাঙিয়ে দিয়ে গেল।

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.টেক. সৌমাভ ঘোষ বর্তমানে রেডিওফিজিক্স-এ পি.এইচ.ডি.রত। দেশবিদেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজের ফাঁকে অবসর কাটে বই পড়ে, ছবি এঁকে আর লেখালেখি করে। সবরকম বই পছন্দ হলেও ঐতিহাসিক ভ্রমণ ও থ্রিলারের আকৃষ্ট করে খুব। এছাড়াও ভালবাসেন বেড়াতে - সমুদ্র এবং ঐতিহাসিক স্থান বেশি পছন্দের। ভ্রমণের সঙ্গে অবশ্যই মিশে থাকে ভোজন - "ফুড ওয়াক"।

 

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher