ওকাম্পোর দেশে
শ্রাবণী ব্যানার্জী
কলকাতাতে যখন বড় হচ্ছিলাম তখন আর্জেন্টিনা দেশটির নাম শুনলেই কেন জানি না রবীন্দ্রস্নেহধন্যা অভিজাত পরিবারের 'ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো'-র নামটাই চোখের সামনে ভেসে উঠত।
ব্রাজিলে কার্নিভাল দেখতে গিয়েছিলাম তাই ভাবলাম সেই দক্ষিণ গোলার্ধেই যখন যাচ্ছি তখন একসঙ্গে আর্জেন্টিনারও কয়েকটা জায়গা সেরে আসা যাক। কিছু নামজাদা ফুটবল খেলোয়াড়দের টিভিতে দেখে, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কথা পড়ে, ম্যাডোনার 'এভিতা' সিনেমাটি দর্শন করে এই দেশটিকে দেখার ইচ্ছা ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠছিল, তাছাড়া ব্রাজিল আর্জেন্টিনার বর্ডারে ইগুয়াজু ফলস্ আর গ্লেসিয়ার-এর আকর্ষণ তো আছেই।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই রিও থেকে প্লেনে ইগুয়াজু পৌঁছে গেলাম। আমাদের ব্রাজিলের দিকের হোটেলটা প্রায় ন্যাশনাল পার্কের মধ্যেই থাকায় সোজা টিকিট কেটে ঢুকে পড়া গেল। সারি সারি মাথাবিহীন বাসে প্রায় মিনিট পনেরো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে একটি বড় কাঠের পাতাটনের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। জঙ্গলে অনেক সুন্দর সুন্দর পাখি, প্রজাপতি ছাড়াও বেশ কিছু বড় কাঠবেড়ালিকেও প্রচন্ড গতিতে আশেপাশে ঘুরতে দেখলাম। এসব জায়গায় বেশি স্ন্যাক্স নিয়ে যাওয়া আদৌ বাঞ্ছনীয় নয় কারণ একটির মুখে দেখলাম গোটা পটেটো চিপস-এর প্যাকেট শোভা পাচ্ছে।
এই কাঠের পাটাতনগুলি ধরে চলতে চলতে ফলস্-এর একেবারে কাছেই চলে আসা যায়। ব্রাজিল-এর দিকে জলের তোড় আর্জেন্টিনার মত না হলেও প্রায় তিনশোটা জলপ্রপাতের সমন্নয়ে এই প্যানোরামিক ভিউটি দৃষ্টিগোচর হলেই দেখবেন বিস্ময়ে মুখটা আপনা থেকেই হাঁ হয়ে যাচ্ছে। দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতায় এ একেবারে নায়াগ্রা ফলস্-এর বাবা। একদা আমেরিকার ফার্স্ট লেডি এলিনর রুজভেল্টের মতনই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল 'পুওর নায়াগ্রা'। কথিত আছে, এ তল্লাটের এক বিরাট ক্ষমতাশালী দেবতা নাকি নাইপি নামক এক মনুষ্যসুন্দরীর প্রেমে পড়েন, বেচারীর আর একটি প্রেমিক বর্তমান থাকায় সে দেবতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়। প্রেমিকযুগলকে নৌকো নিয়ে পালাতে দেখে দেবতা ক্ষেপে গিয়ে ইগুয়াজু নদীটাকেই একেবারে দ্বিখণ্ডিত করে দিলেন আর অসহায় প্রেমিকযুগল সেই ঢাল দিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে মারা গেলেন। এইভাবেই নাকি ইগুয়াজু ফলস্-এর সৃষ্টি হল। তা দেবতারাই যদি প্রত্যাখ্যান নিতে না পেরে এরকম গুণ্ডা মস্তানদের মত ব্যবহার করেন তাহলে খামোখা আর মর্তের মানুষগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ কী বলুন?
পরের দিন আর্জেন্টিনার দিক থেকেও ফলসটিকে দেখতে পেলাম। এদিকটায় আবার জলের তোড় এমনই যে মনে হয় যেন কোনও বড়সড় দৈত্য ধেয়ে আসছে বিশেষ করে 'ডেভিলস থ্রোট' দেখলে তো কথাই নেই। রেনকোট পরে কাছে যাওয়ার আগেই মনে হল এর দাপটেই বোধহয় উড়ে যাব। কায়দা করে যে সেলফি তুলবেন সে সম্ভাবনাও নেই বড়জোর অতীতে টিভিতে দেখা নিজেকে সেই লিরিল সাবানের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন বলে মনে করতে পারেন। উনিশশো চুরাশি সালে এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট আখ্যা পায়। এখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে পুয়ের্তো গিয়ে ইগুয়াজু আর পারানা নদীর মিলনস্থল ছাড়াও একই সঙ্গে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা আর প্যারাগুয়ের বর্ডার দেখারও সৌভাগ্য হল।
পরের দিন সোজা প্লেনে চেপে বিকেলের মধ্যেই রাজধানী বুয়েনস আইরেস্ শহরটিতে পৌঁছে গেলাম। ষোলোশো শতাব্দীতে স্পেন থেকে যখন জাহাজে চেপে ইউরোপিয়ানরা আসে তখন নোঙর ফেলার জন্য এই জায়গাটা বেশ উপযুক্ত মনে হওয়ায় তারা নাম দেয় 'বুএনস আইরেস' স্প্যানিশ ভাষায় যা হল ভালো বা অনুকূল বায়ুপ্রবাহ। ঠিক ছিল পরের দিন সকালেই আবার প্লেন নিয়ে পেরিতো মেরিনো গ্লেসিয়ারটি দেখে ফিরে এসে বেশ সময় করে এই শহরটাকে ঘুরে দেখব। তাই সে রাতটা নষ্ট না করে সোজা মাদেরো ট্যাঙ্গো দেখতে জলের ধারে গিয়ে হাজির হলাম, নাচের সঙ্গে অবশ্য খানাপিনার ব্যবস্থাও ছিল। প্রায় দেড়শো বছর আগে এদেশে কিছু আফ্রিকান ক্রীতদাস ও নিম্নশ্রেণীর সাদাদের সমন্নয়ে এই যুগল নৃত্যটির জন্ম হয়, এখন অবশ্য সারা পৃথিবী জুড়েই এর ব্যাপ্তি।
যাইহোক, যতক্ষণ তেনারা জোড়ায় জোড়ায় কোমর ধরে নৃত্য করছিলেন ততক্ষণ দিব্যি লাগছিল কিন্তু যখন মাঝে মধ্যে স্প্যানিশ ভাষায় নাটকের মত কথা চালাতে লাগলেন তখন অগত্যা অন্যদের হাসতে দেখে আমিও ফিক ফিক করে হাসলাম আর জনগণ গম্ভীর হয়ে গেলে আমিও গাম্ভীর্য অবলম্বন করলাম। ভাষা না বোঝার শতেক জ্বালা। তবে ডিনারটি সুস্বাদু হওয়ায় নাচা গানা খানা পিনা নিয়ে মোটের ওপর সন্ধ্যাটা বেশ ভালোই কাটলো। ভাবলাম পরেরদিন ভোরবেলাতেই প্লেন নিয়ে গ্লেসিয়ারটা দর্শন করে আসি তারপর আবার নাহয় এই শহরটিতেই ফিরে আসা যাবে।
ঘণ্টাতিনেক প্লেন যাত্রা করে পরেরদিন সুন্দর এক ছোট্ট পাহাড়ি জায়গায় এসে পৌঁছোলাম যার নাম এল-কালাফাতে। ছবির মতো সুন্দর রাস্তাঘাট, ছোট ছোট কাঠের কটেজ, তারি মধ্যে একটি আমাদের হোটেল। এককথায় গাছপালা দিয়ে ঢাকা জায়গাটি ভারি মনোরম। রাস্তার ধারে একটি ছোট্ট দোকানে দেখলাম গণেশের মূর্তিও রাখা আছে।
সেদিন বিকেলেই লেক আর্জেনতিনোর উল্টোদিকে Glaciarium বা আইস মিউজিয়াম দেখতে গেলাম। গ্লেসিয়ারের উৎপত্তি থেকে ধীরে ধীরে তার বিস্তার খুব সুন্দরভাবে এখানে ফুটিয়ে তুলেছে। পরেরদিন সকালে ট্যুর বাস এসে আমাদের ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট – লস গ্লেসিয়ারেস ন্যাশনাল পার্কের দিকে নিয়ে চলল। পাহাড়ি সৌন্দর্য ছাড়াও প্রায় দুশোটা হিমবাহ এখানে দেখা যায় কারণ এই পার্কের অর্ধেকটা জুড়েই রয়েছে পাতাগনিয়া আইস ফিল্ড আর তার মধ্যেও সবথেকে সুন্দর 'পেরিতো মেরিনো' গ্লেসিয়ার।
পৃথিবীর বেশিরভাগ গ্লেসিয়ার যখন গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে তাদের কলেবরটি ক্রমশ খাটো করে যাচ্ছেন তখন এই তিরিশ কিলোমিটার লম্বা গ্লেসিয়ারটি প্রতিদিন নিজেকে প্রায় দু মিটার করে বাড়িয়ে যাচ্ছেন। কাঠের পাটাতন দিয়ে হাঁটতে থাকলে একেবারে সামনেই পৌঁছে যাবেন আর দেখবেন মাঝেমধ্যেই হুড়মুড় করে বরফ আপনার সামনেই ভেঙে পড়ছে। এই গ্লেসিয়ারটির অবশ্য ভাঙা-গড়া সমান তালেই চলে।
জলের ওপর দিয়ে আমাদের লঞ্চ যখন আরও কাছে নিয়ে গেল তখন দেখি কয়েকটা জায়গা থেকে হালকা নীল টিউব লাইটের মতো আলো বেরোচ্ছে আবার কোনও কোনও জায়গায় ঝলক দিচ্ছে কমলা রংয়ের দ্যুতি, সে এক অপরূপ দৃশ্য। আলাস্কাতে হিমবাহ দেখে আমার ঠিক এই অনুভূতি হয়নি, তাই ক্যামেরাতে কিছুটা ধরা পড়লেও এর বর্ণনা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এইভাবেই কোথা দিয়ে যে ঘণ্টা সাতেক কেটে গেল কে জানে! পরেরদিন আবার প্লেন নিয়ে বুয়েনস আইরেস্ ফিরে গেলাম কারণ এরপর কয়েকদিন এই শহরটিকেই ভালো করে দেখার পালা।
পরেরদিন শহরটি দেখতে গিয়ে সত্যিই প্রায় চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। চারিদিকে নিও-ক্লাসিকাল ধাঁচের সুন্দর সুন্দর বাড়ি, মাথা ঘোরানো সব চওড়া রাস্তা, দারুণ সাজানো পার্ক, আলো ঝলমলে কাফে আর দামি দোকানের সারি। শুনেছিলাম এই শহরটিকে নাকি প্যারিসের অনুকরণে সাজানো হয়েছিল যদিও চারিদিকে অজস্র ইতালিয়ান ও স্প্যানিশ ছাপও দেখলাম। আমি একেবারেই এতটা আশা করে আসিনি, তাই বোধহয় চমকটা একটু বেশিই লাগল।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যদিও দেশটি চামড়া, মাংস, গম, পশম এসব বিক্রি করে অত্যন্ত বড়লোক ওঠে কিন্তু তারপর থেকেই এদেশের পতন ঘটতে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি এতটাই দেনায় ডুবে আছে যে ব্যাংকে টাকা ভাঙাতে গেলেও দেখবেন বারবার হোঁচট খাচ্ছেন। আজ ডলার ভাঙাতে গিয়ে যা টাকা পাবেন পরের দিন দেখবেন ঢের বেশি পাচ্ছেন আর সত্তর শতাংশ সুদের হার ধরলে তো কথাই নেই। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট 'হুয়ান পেরণে'র সময় থেকেই এদের দিন খারাপ হতে থাকে। একটু বেশি মাত্রায় জনদরদি হওয়ায় উনি আর ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ইভা পেরণ শ্রমিক ও গরিব সম্প্রদায়ের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন বটে, কিন্তু অর্থনীতির অবস্থা ক্রমেই মন্দার দিকে যেতে থাকে, তার ফলে ওঁদের বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে ইভা পেরণ ক্যান্সারে মারা যান, আজও অবশ্য এদেশে তিনি বেশ জনপ্রিয়। সঙ্গীত শিল্পী ম্যাডোনা 'এভিতা'চলচিত্রে ওঁর ভূমিকায় 'ডোন্ট ক্রাই ফর মি আর্জেন্টিনা' গানটি বড় চমৎকার গেয়েছিলেন। উনিশশো ছিয়াত্তর থেকে তিরাশি পর্যন্ত সামরিক শাসক হুনতার অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু অল্পবয়সি ছেলেমেয়েও রাস্তাঘাট থেকেই গায়েব হয়ে যায়। আজও দেখবেন মায়েরা তাদের ফিরে আসার আশা নিয়ে রাস্তায় মোমবাতি জ্বালিয়ে যিশুর কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছেন। এদেশে প্রায় সবাই রোমান ক্যাথলিক, বর্তমান পোপ ফ্রাণ্সিস্ও এদেশেরই বাসিন্দা ছিলেন।
সাতানব্বই শতাংশ জনগণই এদেশে শ্বেতাঙ্গ আর এতবড় দেশে জনসংখ্যাও সাড়ে চার কোটির বেশি নয় তবুও অর্থনীতির অবস্থা খুবই সঙ্গীন, কিন্তু আশপাশ দেখলে বোঝে কার সাধ্যি। এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল প্লাজা দে মাইও বা মে স্কোয়ার।
১৮১৮ সালে স্প্যানিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পর এই দু ব্লক জুড়ে জায়গাটাকে রাজনৈতিক দপ্তর, সুন্দর সুন্দর মিউজিয়াম ও গাছপালা ফোয়ারা দিয়ে দারুণ করে সাজানো হয়। তার মধ্যে ইতালিয়ান ধাঁচে তৈরি 'কাসা রোজাদা' অর্থাৎ গোলাপি রংয়ের রাষ্ট্রপতি ভবনটি চোখে পড়ার মতো। সামনে একটি বিরাট স্মারক স্তম্ভ নিয়ে জায়গাটা যেন আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু এগোলেই চোখে পড়বে এক মাথা-ঘোরানো চওড়া রাস্তা আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটি সুন্দর ওবেলিস্ক।
এই ৪৬০ ফিট্ চওড়া জুলাই ৯ বা ন নম্বর হুলিও নামক রাস্তাটি এতটাই চওড়া যে চোখ পিটপিট করে রাস্তা পেরোতে গিয়ে বার তিনেক ট্রাফিক লাইটেই আটকে গেলাম। প্যারিস-এর Champs Elysees-এর প্রায় দুগুণ চওড়া, এক দুই তিন করে রাস্তা গুনতে গুনতে অবশেষে ষোলোতে এসে ঠেকে গেলাম।
মে এভিনিউ দিয়ে চলতে চলতে 'অভেনিদা' থিয়েটার হল, দুপাশে সুন্দর সুন্দর কাফে বিশেষ করে 'তরটিনী' যা কিনা এদেশের সবথেকে পুরোনো কাফে দেখে তাই লোভ সামলাতে না পেরে পেস্ট্রি খেতে ঢুকে পড়লাম। খেয়ে মনে হল এ যেন অস্ট্রিয়ান পেস্ট্রির থেকে বেশি উপাদেয়। রাস্তায় এক অদ্ভুত দর্শন বাড়ি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম, গাইড বলল এই বাইশ তলা বাড়ির নাম 'বারোলো'।
উনিশশো তেইশ সালে এক ইতালিয়ান আর্কিটেক্ট নাকি দান্তের 'ডিভাইন কমেডি' পড়ে এই বাড়িটিকেই পুরগাতোরিও অর্থাৎ শোধনকারী হিসাবে স্বর্গ মর্ত্য পাতালে ভাগ করে তৈরি করেছিলেন, বাড়ির দুটো তলা মাটির নীচে বা পাতালে তাই সেটা নাকি নরক। এক থেকে পনেরো তলা মর্ত্য অর্থাৎ মাঝামাঝি জায়গায় নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে ষোলো থেকে সোজা স্বর্গের দিকে হাঁটা দেবেন। বাইশ অর্থাৎ একবার পেণ্টহাউস পৌছে গেলেই স্বর্গের রাস্তা খোলা। কে জানে হয়তো এই সিম্বলিজম আমাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
শুনেছিলাম ফ্লোরিডা স্ট্রিট শপিং-এর স্বর্গ তাই সেদিকেই হাঁটা দিলাম। এদের বিখ্যাত চামড়ার ব্যাগ কিনে একসময় কফি খেতে বসে পড়লাম। বাংলায় কথা বলতে শুনে ঈশিতা নামক একটি বাঙালি মেয়ে অন্য টেবিল থেকে তার স্প্যানিশ বন্ধুদের ছেড়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে চলে এল। যদিও আইটির দৌলতে ভারতীয়রা এখন সারা পৃথিবী জুড়েই বিদ্যমান তবুও এদেশে তারা এখনও সংখ্যায় খুব কম তাই মাতৃভাষা শুনে এত আনন্দ। বেচারা জানাল এখানে একটা ছোটো ইন্ডিয়ান স্টোর আছে বটে কিন্তু পোস্ত-র কোয়ালিটি আদৌ সুবিধের নয়।
পরের দিন পুরোনো বন্দরের পাশে 'লা বোকা' নামে এক সাংঘাতিক রংবেরংয়ের জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম কোথাও প্রমাণ সাইজের পুতুল দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আর কোথাও বা পুরো রাস্তার মেঝেটাই রঙিন ছবি দিয়ে ঢাকা এছাড়া দেওয়ালের গায়ে ম্যুরাল তো আছেই।
নীল হলুদ জার্সির রঙে সাজানো 'বোকা জুনিয়র'স্টেডিয়ামের সামনে দেখলাম বেঁটেখাটো মারাদোনার একটি মূর্তি, তাঁর জীবন নাকি এই গরিব পাড়া থেকেই শুরু হয়। 'মেসি' আসার আগে ফুটবল তারকা হিসাবে মারাদোনাই ছিলেন এদের ন্যাশনাল হিরো।
বুয়েনস আইরেস্-এর আর একটি জমজমাটি জায়গা 'সান তেলমো', যদি একবার সেখানে রবিবারে গিয়ে পৌঁছতে পারেন তাহলে দেখবেন চারিদিকেই মেলা বসেছে আর লোকজন ফুর্তিতে রাস্তাতেই ট্যাঙ্গো নেচে যাচ্ছে।
সেখান থেকেই প্রায় আধঘণ্টা ট্যাক্সিতে চেপে এখানকার বিখ্যাত 'ডন হুলিও' রেস্তোঁরাতে পৌছলাম। বহুদিন আগে থেকে রিজার্ভেশন না করলে এখানে জায়গা পাওয়া অসম্ভব কারণ এর নাম নাকি সারা পৃথিবীর প্রথম কয়েকটি রেস্তোঁরার মধ্যে রয়েছে। রিজার্ভেশন থাকা সত্ত্বেও লাইন দিতে হওয়াতে তেনারা রাস্তাতেই কিছুটা করে শ্যামপেন আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। যারা বিফ স্টেক খেতে ভালবাসেন এদেশ তাদের স্বর্গ। প্রায় চারঘণ্টা ধরে ঢিমে আঁচে মসলা মাখিয়ে বার্বিকিউ বা পারিয়া তৈরি করা হয় তাই এত স্বাদ, এদের ওয়াইন-এর সম্ভার দেখলেও মাথা ঘুরে যায় কারণ আর্জেন্টিনা ওয়াইন-এর জন্যও বিখ্যাত।
শহর থেকে একটু দূরে রেকোলেটা জায়গাটি স্থাপত্যকলার আর এক চমৎকার নিদর্শন, ইতালি থেকে একসময় এখানে আনা হয় ছয় হাজারের ওপর ভাস্কর্য। এখানকার বিখ্যাত সমাধিস্থলে ইভা পেরণ থেকে রবীন্দ্র স্নেহধন্যা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো সবার সমাধিই দেখতে পাবেন। তাই এই দেশটিকে বিদায় জানানোর আগে সেই বহুশ্রুত ভিক্টোরিয়া বা 'বিজয়া'র বাড়ির দিকেই রওনা হলাম।
ভিক্টোরিয়া ছিলেন একজন নারীবাদী লেখিকা ও সাহিত্য সমালোচক। 'সুর' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন - ইংলিশ, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইতালিয়ানও তিনি মাতৃভাষার মতনই জানতেন। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও কোনও স্কুল কলেজে যাননি কিন্তু বাড়িতে ঢের বেশি পড়াশোনা করেছিলেন। ইংল্যান্ড-এর রাজপরিবারের পুরস্কার ছাড়াও কলম্বিয়া হার্ভার্ড-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীও সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি তার হাতে তুলে দেয়। শোনা যায় ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি' পড়ে তিনি রীতিমতো রবীন্দ্র অনুরাগী হয়ে পড়েন। ১৯২৪ সালে পেরু মেক্সিকো ভ্রমণের পথে যখন রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন আর্জেন্টিনাতে বিরতি নিতে বাধ্য হন আর সেটা জানতে পেরে ভিক্টোরিয়া তাঁর নিজের বাড়িতে কবিকে এনে দুমাস রেখেছিলেন। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে প্লাতা নদী আর তার ধরে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখে যাচ্ছেন কবিতা আর তাঁর পায়ের কাছে বসে আছেন ভিক্টোরিয়া।
অবশেষে ট্রেনে করে আমিও একসময় বুয়েনস আইরেস্ থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সান ইসিদ্রোতে সেই বিশাল বাড়িটির সামনে পৌছে গেলাম। এখন অবশ্য ভিলা ওকাম্পো ইউনেস্কোর সম্পত্তি কারণ বিশ্বের কবি সাহিত্যিকরা আজও এখানে একত্রিত হন। বাড়িটিতে ঢুকে আমার কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি হল, বসার ঘরে রবীন্দ্রনাথ-এর লেখার ডেস্ক ও ছবি দেখে মনে হল আমিও যেন মানসিকভাবে সেই সময়টাতে ফিরে গেছি।
ভিক্টোরিয়া বাংলা জানতেন না কিন্তু অবাক হয়ে দেখতেন কবিতার কাটাকুটি থেকে কি চমৎকার ছবি তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাই বারবার জিজ্ঞাসা করতেন রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকেন না কেন। পূরবী গ্রন্থের এই কাটাকুটি থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে ছবি আঁকার প্রেরণা জোগান আর অনেক পরে ১৯৩০ সালে প্যারিস-এর বিখ্যাত গ্যালারি 'পিগালে'তে ভিক্টোরিয়া রবীন্দ্রনাথের ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। এই ছবি প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার আর একটা দিক আমাদের কাছে খুলে গেল।
প্রথম যখন দুজনের দেখা হয় তখন রবীন্দ্রনাথের বয়েস তেষট্টি আর ভিক্টোরিয়ার চৌত্রিশ কিন্তু মানসিক ভাবে তাঁরা এতটাই কাছাকাছি চলে এসেছিলেন যে এটিকে অনেকে প্লেটোনিক লাভ আখ্যা দিয়ে থাকেন। সান ইসিদ্রোর 'মিলারিও'বাড়ির বারান্দায় আর কখনও বা তিপা গাছের ছায়ায় বসে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে নিজের কবিতা ইংরাজিতে তর্জমা করে শোনাতেন আর ভিক্টোরিয়া তাঁর পায়ের কাছে মুগ্ধভাবে বসে থাকতেন।
একসময় ভিক্টোরিয়াও লিখে ফেললেন যা বাংলা করলে হয় – 'সান ইসিদ্রো উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর'। বিদায় জানানো কারোর পক্ষেই খুব সহজ ছিল না তাই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন –
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমায় শুধাই 'বলো দেখি
মোরে ভুলিবে কি'
হাসিয়া দুলাও মাথা; জানি জানি মোরে ক্ষণে ক্ষণে
পড়িবে যে মনে,
দুই দিন পরে
চলে যাব দেশান্তরে,
তখন দূরের টানে স্বপ্নে আমি হব তব চেনা –
মোরে ভুলিবে না।
'পূরবী' গ্রন্থ উৎসর্গ করে ভিক্টোরিয়া বা বিজয়াকে শান্তিনিকেতন থেকে চিঠিতে লিখলেন – তুমি তো জানো সেই আমাদের উজ্জ্বল দিনগুলি যা ধরা দিয়েছে আমার কবিতায় তাই হয়তো এটিই হবে আমার শ্রেষ্ঠ রচনা। লেখাটা শেষ করার আগে 'বিদেশী ফুল'-এর আরও কয়েকটা লাইন এখানে তুলে দিলাম -
হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম –
'কী তোমার নাম',
হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তবে
নামেতে কী হবে।
আর কিছু নয়
হাসিতে তোমার পরিচয়।
শ্রাবণী ব্যানার্জির জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস পাঠ ও সঙ্গীত-চর্চাতে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।