অরণ্যের দুয়ারে

তপন পাল



-১- হাওড়া নিউ জলপাইগুড়ি বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধনী যাত্রায় যাওয়া, আর নিউ জলপাইগুড়ি হাওড়া বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রায় ফেরা – এর মাঝে আমার হাতে ছিল একটি দিন – ৩১শে ডিসেম্বর ২০২২। আমার শুভাকাঙ্খীরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন ওইদিন দার্জিলিং যাওয়ার; তবে আমি সবিনয়ে প্রত্যাখান করে ডুয়ার্সের দিকে যেতে চাইলাম। তাই শুনে তাদের কী হাসি; বাপ্পাদা/বাপ্পাজেঠু বুড়ো হয়ে গেছে; শীতে ভয় পাচ্ছে। কথাটা আমার আঁতে লাগল। আমি খুব একটা শীতকাতুরে তা নই, তবে কেন যেন মনে হয়, পাহাড়ে সমতলের লোকেদের না যাওয়াই ভাল। পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্র অতিশয় ভঙ্গুর, পাহাড়ে পর্যটক যাওয়া মানেই সেই বাস্তুতন্ত্রের ওপর অত্যাচার। পাহাড় থাক না পাহাড়ের মত – বিশালকায়, মহিমান্বিত, দিগন্তজোড়া – দেবতাদের আর পাহাড়ি মানুষজনদের নিয়ে – সমতলের মানুষ তাকে দেখুক না দূর থেকে; শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়।

অরণ্যে হামেশাই যাই, একদা কর্মসূত্রে যেতেও হত। তবে অরণ্যে জীবজন্তু জানোয়ার দেখতে আমি আগ্রহী নই। বাড়িতে অনাহূত অতিথি এলে আমি যেমন বিরক্ত হই, অরণ্যের প্রাণীরাও নিশ্চয়ই তেমন হয়। সুন্দরবনের এক সমাজকর্মী বলেছিলেন মানুষ সুন্দরবনের বাঘ সম্বন্ধে যতটুকু জানে, সুন্দরবনের বাঘ মানুষ সম্বন্ধে তার চেয়ে বেশি জানে। প্রথম যৌবনে এক পিতৃবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম সুন্দরবনে বাঘশুমারির স্বেচ্ছাসেবক হতে চাওয়ার আবদার নিয়ে। তিনি 'তাহলে তোর বাপ আমায় পিটবে' বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তবে তার আগে একটি তথ্য দিয়েছিলেন। সুন্দরবনে গিয়ে তুমি যখন বাঘকে দেখতে পাবে, জানবে বাঘটা তার অন্তত আধঘণ্টা আগে থেকে তোমায় দেখছে।

একবার হরিদ্বারের কাছে রাজাজি ন্যাশনাল পার্কে গিয়েছিলাম এক শুভাকাঙ্খীর বদান্যতায় – তিনি জিপে উঠে হাতি হাতি করে অস্থির। আমার বিরক্ত লাগছিল – হাতির দর্শনাকাঙ্ক্ষায় যদি ক্যামেরা খুলে নিরন্তর তাকিয়ে থাকতে হয়, তাহলে ঘরে বসে ডিসকভারি বা অ্যানিমাল প্ল্যানেট দেখলেই হত, এত পয়সা খরচ করে এতদূরে আসার কী ছিল! চওড়া পাতার পর্ণমোচী, ঘেসোজমি, নদীপারের উদ্ভিজ্জ, সরলবর্গীয় গাছ, চারপাশে এত মহীরূহ, বাতাসে তাদের পাতা নড়ছে, পড়ছে শিশিরের শব্দের মত, সরসরানি উঠছে ঘাসে, মাথার ওপরে ওলটানো বাটির মতো আকাশ, কেউ সদ্য সদ্য নীলগোলা জলে তাকে চুবিয়ে তুলেছে – এইসব না দেখে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ! মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, আমি গেছি শুনে লালমুখো বাঁদরেরা (rhesus macaque/Macaca mulatta) দল বেঁধে দেখা করতে এল; কাশির মত খক খক শব্দ করে জিজ্ঞাসা করলো, 'কি রে বাপ্পা! ভালো আছিস! তোর বাবা মা ভালো আছে?' তাই শুনে এক শজারুর (Indian crested porcupine/Hystrix indica) কী হাসি!

আমার শুভাকাঙ্খীর উৎসাহ দেখে জিপচালক বললেন আপনারা বাবুজি হাতি হাতি করে লাফান; আর আমরা সব জানোয়ারের মধ্যে সবচেয়ে ভয় পাই হাতিকে। কখন ওর মুড কীরকম থাকবে, ও যে কখন কী করবে তা কেউ জানে না। সকালে উঠে ভগবানকে বলি, 'আজ যেন হাতির সঙ্গে দেখা না হয়। আর যদি কপাল খারাপ হয়, আমি ফন্দিফিকির জানি, আমি ঠিক পালাতে পারব – আপনারা কি করবেন ভাবুন।' বলতে না বলতেই 'शैतान का नाम लिया, शैतान हाजिर'। আমাদের গাড়ির ঠিক সমুখে, শ'দেড়েক ফুট দূরে, একাকী এক দাঁতাল। আমার বইপড়া বিদ্যা জানে, দলছাড়া একা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হাতি অতীব বিপদজনক – ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী ও পার্বতীবাবুরা বলেছেন। জিপচালক ডান হাত বার করে পিছনের গাড়িগুলিকে থামতে বললেন, তারা থামলেন; কিন্তু হাতি মহারাজ নড়েও না চড়েও না – রাস্তার মাঝখানে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পড়া না পারা অবাধ্য জেদি গোঁয়ার ছাত্রের মত, সূর্যালোক পিছলে যাচ্ছে তার ত্বকে। 'মহারাজ, একি সাজে এলে হৃদয়পুরমাঝে! চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে॥ গর্ব সব টুটিয়া মূর্ছি পড়ে লুটিয়া, সকল মম দেহ মন বীণাসম বাজে॥'

শুরু হল প্রতীক্ষা, সে কখন নড়বে। কথা বলা বারণ, নড়াচড়া বারণ, সিগারেট খাওয়া বারণ, চা পাওয়ার প্রশ্নই নেই; সেই পৌনে এক ঘণ্টা যে কী অসহনীয় বিরক্তিকর উদ্বেগের মধ্যে কেটেছিল বলার নয়। আমার মনে পড়ছিল ভাওয়াইয়া – 'হস্তির নড়ান হস্তির চড়ান হস্তির গলায় দড়ি - ওরে সত্য করিয়া কনরে মাহুত কোনবা দ্যাশে বাড়িরে। ও তোমরা গিলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে'। নিম্ন অসমের লোকজীবনের গান কেমন খাপ খেয়ে গেল শিবালিকে। একটা গানের চলন কৌম ইতিহাসের চাবিকাঠি হতে পারে, তা আগে তো ভাবিনি। হাতির চলার ছন্দ আর এই গানের ছন্দে হুবহু মিল। তাহলে কি হাতির চলার ছন্দেই এই গান বাঁধা হয়েছিল?

একসময় তিনি নড়লেন, রাস্তা থেকে নেমে গেলেন নাবাল ঘেসোজমিতে, আমাদের এবং পিছনের সব গাড়ি তারপরেও দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ – কে জানে হাতি বাবাজি ঘেসোজমিতে ঘাপটি মেরে বসে আছেন কি না আমাদের জন্যে। তারপর ওই জায়গাটি সবকটি জিপ পার হল উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে।

প্রায় সমতুল অভিজ্ঞতা ঘাটশিলায়। শহর পেরিয়ে অগণন টিলা আর জঙ্গল পার হয়ে বাসাডেরা গ্রাম, সেখান থেকে আদিবাসী গাইড নিয়ে চড়াই পথে জঙ্গল চিরে আধঘণ্টা হাঁটলে ধারাগিরি জলপ্রপাত। বর্ষীয়ান আদিবাসী গাইডটি সকাল থেকেই মহুয়ামাতাল, সস্নেহে বললেন কাল রাতেও হাতি বেরিয়েছিল। হাতির মুখোমুখি পড়লে কি করতে হবে তাও সে বিমানবালিকাদের সিকিউরিটি ড্রিলের মত পাখি পড়া করে বুঝিয়ে দিল, ঝাঁপ দিয়ে পাশে সরে যেতে হবে, কোনক্রমেই হাতির যাত্রাপথে থাকা চলবে না। শুনে অপার নিস্পৃহতায় আমি হাসলাম; বিমানবালিকাদের অঙ্গভঙ্গি আমি কোনওদিন দেখি না, বকবকানি শুনি না। আমি ঠিকই করে নিয়েছি যে কিছু হলে সিটেই বসে থাকব, যা হওয়ার হোক; কারণ শুনেছি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ মেলে। এক্ষেত্রেও শুনলাম না; যা হওয়ার হোক। 'তাই হোক তবে তাই হোক, রূপের অতীত রূপ দেখে যেন প্রেমিকের চোখ – দৃষ্টি হতে খসে যাক, খসে যাক মোহনির্মোক॥'

অরণ্য আমার 'প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি'।

-২-
রাতটা ছিলাম জলপাইগুড়ির এক হোটেলে। সাতটায় এক রেলতুতো ভাই এলেন, তার দ্বিচক্রযানের পিছনে বসে দেখতে বেরোলাম ভারি প্রিয় এই জলশহর। প্রথমে গেলাম হলদিবাড়ি নিউ জলপাইগুড়ি লাইনের জলপাইগুড়ি স্টেশনে। স্টেশনটি অতি প্রাচীন; ১৮৭৮ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হাতে এর স্থাপনা। দার্জিলিং মেল একদা এখান থেকেই ছাড়ত। স্টেশনটিতে দুটি প্ল্যাটফর্ম, আর চারটে লাইন। একদা পদ্মার উত্তর পাড়ের সারাঘাট থেকে শিলিগুড়ি রেল চলত এই পথে। ১৯১২ সালে হার্ডিঞ্জ সেতু চালু হওয়ার পরে ১৯২৬ এ শিয়ালদহ রানাঘাট ভেড়ামারা হার্ডিঞ্জ সেতু ঈশ্বরদি সান্তাহার হিলি পার্বতীপুর নিলফামারি হলদিবাড়ি জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ি পুরো পথটিই ব্রডগেজে রূপান্তরিত হয়। আমরা থাকতে থাকতেই ৭৫৭২২ হলদিবাড়ি শিলিগুড়ি ডেমু ঢুকল, মিনিট তিনেক দাঁড়াল।

এবারে আমরা গেলাম সাহেবঘাট। এইখানে করলানদীর ওপর দিয়ে ফেরি চলত; Eastern Bengal State Railway ও Bengal Dooars Railway-র যোগসূত্র ছিল সেই ফেরি। তারপরে দেখলাম উদাসিনী তিস্তাকে, আর করলাকে।

তারপর বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেট। রাজবাড়ির ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো এবার পাঁচশ তেরো বছরে পড়ল। হোটেলে ফিরে প্রাতরাশ।

বৌদ্ধ গ্রন্থ 'খুদ্দ নিকায়' (Minor Collection। থেরাবাদী বৌদ্ধদের অতীব মান্য গ্রন্থ। ত্রিপিটকের সুত্ত পিটক অংশের পঞ্চম ভাগ। খুদ্দক শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র। নামে ক্ষুদ্র হলেও এর আয়তন বেশ বড়)-তে গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, সংসার আর সম্পত্তি ছেড়ে যদি সাধনা করতে হয়, তাহলে গণ্ডারের মত একা একা চরে বেড়াও – 'একো চরে খগগবিষাণ–কপ্পো'। সোমবার সকালে তাই একটা গাড়ি নিয়ে একা একা বেরিয়ে পড়লাম পূর্বদিকে; তিস্তার সঙ্গে একবার দেখা না করলেই নয়। অনেকের মতো ডুয়ার্স আমারও অনেকখানি আবেগ আর তার চেয়েও বেশি ভালোবাসার জায়গা। এতদুরে এসে ময়ূর বানর পাখপাখালি আর গউরের সঙ্গে দেখা না করলে চলে? ১৯৮৪তে আমাদের মধুচন্দ্রিমার পয়সা নেই শুনে অগ্রজ সহকর্মীরা প্রভাব খাটিয়ে গরুমারা, জলদাপাড়া, লাটাগুড়ি, চালসা বনবাংলোয় বিনিপয়সায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই স্মৃতি 'এল আমার ক্লান্ত হাতে ফুল-ঝরানো শীতের রাতে কুহেলিকায় মন্থর কোন্‌ মৌন সমীরণে'। এই উত্তর-প্রৌঢ়ত্বে, হাত পা সচল থাকতে থাকতে ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই একবার তার সঙ্গে দেখা করে নেওয়া দরকার।

সেখান থেকে ১৫৬৩৩ বিকানির গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার জন্য খ্যাত দোমহনি। সেখানকার রেললাইনের Y Link Layout দেখলাম, তারপরে স্টেশন। পূর্বতন Bengal Dooars Railway (১৮৯১ -১৯৪১) এর সদর ছিল শান্ত, স্থিতধী এই স্টেশন। স্টেশনের পাশেই এক সাবেকি ট্রলি শেড।

পরবর্তী বিরতি নেওড়া নদীর তীরে ৭১৭ জাতীয় সড়কের ওপরে গরুমারা জাতীয় উদ্যানের খুব কাছে প্রকৃতি পর্যটনকে নিয়ে বেড়ে ওঠা ডুয়ার্স পর্যটন রাজধানী লাটাগুড়ি। শহরে একটি 'প্রকৃতি তথ্যকেন্দ্র' (Nature Interpretation Center) রয়েছে, যেখানে স্থানীয় প্রাণী ও উদ্ভিদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষিত। গরুমারা জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন লাটাগুড়ি মডার্ন নার্সারির প্রতিষ্ঠা ১৯৯২ সালে। উত্তরবঙ্গের ত্রিশ প্রকারেরও অধিক ভেষজ উদ্ভিদ এখানে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। শুনলাম এইখানে এমন কিছু ভেষজ পাওয়া যায় যা অদ্যাবধি বিজ্ঞানসম্মত পরিচয়প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। আছে একটি ডিয়ার পার্ক। পর্যটন আকর্ষণ বৃদ্ধি ও ডুয়ার্সের লোকসংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করে তুলতে গত কয়েক বছর ধরে লাটাগুড়িতে শুরু হয়েছে উত্তরবঙ্গ লোকসংস্কৃতি উৎসব ও ডুয়ার্স প্রকৃতি-পর্যটন মেলা।

একদা লাটাগুড়ির অর্থনীতি ছিল কাঠের ব্যাবসা নির্ভর। এলাকায় ছিল অগুন্তি করাতকল, প্লাইউডের কারখানা। রেলের স্লিপার ও বিদ্যুতের খুঁটিও তখন লাটাগুড়ি থেকে সরবরাহ করা হত। ১৯৮০ সালে বন সংরক্ষণ আইন চালু হওয়ায় এই ব্যাবসার বিপদ ঘনায়, মিলগুলি বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকরা কাজ হারায়। সেখান থেকে লাটাগুড়ির অর্থনীতি আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রকৃতি পর্যটন (ইকো ট্যুরিজম)কে আঁকড়ে। অতীতের মিলমালিকেরা অনেকেই রিসর্ট খুলেছেন; এলাকার অনেক যুবক গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন, গাইডের কাজ করছেন – এছাড়া পর্যটনকে কেন্দ্র করে চলছে নানা হস্তশিল্প সামগ্রীর দোকান, হোটেল, ধাবা, চায়ের দোকান, এমনকি লন্ড্রিও। হস্তশিল্প সামগ্রীর দোকান থেকে পৌত্রীর জন্য কিছু কেনাকাটা সেরে আমরা ধাঁ!

লাটাগুড়ি সম্প্রতি সংবাদ শিরোনামে এসেছে জ্যান্ত পেত্নি ধরে। লাটাগুড়ি মালবাজার রাস্তায় রাতে ভূত ঘোরে, এমন গুজব অনেকদিনের, অনেকেই দাবি করছিলেন তারা ভুত দেখেছেন। সৌভিক ভট্টাচার্য নামের এক পর্যটক সড়কপথে মালবাজার থেকে লাটাগুড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ির সামনে ভুত দেখে গাড়ি থামাতেই ভুত গাড়ির বনেটের ওপর লাফ দেয়। আওয়াজ করে ভয় দেখায়। অপ্রতিভ না হয়ে সৌভিক হাতেনাতে ধরে ফেলেন জ্যান্ত ভুতকে। দেখা গেল পাতলা চেহারার এক মহিলা সাদা থান পরে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে উঠে এসে ভয় দেখাচ্ছেন। তাকে দেখে পালিয়েছে অনেকেই। কিন্তু কেন এহেন কাণ্ড ঘটাচ্ছিলেন ওই মহিলা? স্থানীয়দের অভিযোগ, গাড়ি চুরির লক্ষ্যেই নাকি এই ভুতুড়ে কাণ্ড।

'কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ চূড়ে। বাঁধি নীড় থাকে সুখে।' তেমনি উচ্চ চূড়ে দেখা মিলল কতিপয় শকুনের (white-rumped vulture, Gyps bengalensis)। প্রজাতিটি আমার ভারি প্রিয়, কারণ আমার মতই এরা বুদ্ধপন্থী অহিংস, কদ্যপি জীবিত কোন প্রাণীকে আক্রমণ করেন না। ক্রমিক diclofenac poisoning-এর ফলে কিডনি অচল হয়ে হয়ে প্রজাতিটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে; International Union for Conservation of Nature (IUCN) এর Critically Endangered তালিকাভুক্ত। অথচ ১৯৮৫তেও কেম্ব্রিজের International Council for Bird Preservation ভেবেছিল এরা 'the most abundant large bird of prey in the world'। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি গবাদিপশুর জন্য এই ঔষধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে সরকারকে রাজি করায়। এরপর শকুনের সংখ্যা স্থিতিশীল হতে শুরু করে, এবং কিছু কিছু জায়গায় তাদের সংখ্যা বাড়তেও শুরু করে। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের রাজাভাতখাওয়া শকুন প্রজনন কেন্দ্র এক্ষেত্রে দিগদর্শক।

গরুমারা জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে বাতাবাড়ি হয়ে মূর্তি, পাথর বিছানো নদীবক্ষ – হাজারে হাজারে ছোট বড় পাথর। তাদের ওপর দিয়ে, নিচ দিয়ে, পাশ কাটিয়ে স্বচ্ছতোয়া মূর্তির চলন। পাথরের বাধায় উৎসারিত জলে বিকীর্ণ হচ্ছে ফেনা, রামধনু। আক্ষরিক অর্থেই মূর্তির 'পথে পথে পাথর ছড়ানো। তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্না-ঝরানো'। পাথরের ওপর পা ফেলে ফেলে নদীর সঙ্গে দেখা; সাহসীরা তারপরেও পাথর ভেঙে, জলের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যান মাঝনদীতে কোন বড় পাথরের ওপর – নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকেন, সেলফি তোলেন; পাথরটাই যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ – তাদের দু পাশ দিয়ে নদী বহমানা। এখানে ঘড়িয়াল (মেছো কুমির Gharial, Gavialis gangeticus বিরল প্রজাতির মিঠাজলের কুমিরবর্গের সরীসৃপ) অতিখ্যাত। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ঘড়িয়ালের নাকের ডগার আকৃতি ঘড়ার মত, জলের ওপর এইটুকুই জেগে থাকে। তাই এমন নাম। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ঘড়িয়াল কুড়ি ফুট অবধি হতে পারে; মহিলা ঘড়িয়াল আট থেকে চোদ্দ ফুট। ইস্কুলজীবন থেকেই আমি সিনেমার পোকা। সেই যুগে ফরিয়াল নামে হিন্দি সিনেমার এক প্রতিনায়িকা ছিলেন। জুয়েল থিফ (১৯৬৭), সাচ্চা ঝুঠা (১৯৭০), ঝিল কে উস পার (১৯৭৩) যারা দেখেছেন, তারা হয়তো আজও তাকে মনে করতে পারবেন। কেন জানি না, বহুদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল ঘড়িয়াল কোনভাবে ফরিয়াল এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।

আকাশ আকাশ নীল, ঘুরে ফেরে একা চিল; ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় শামুকখোল (Asian Openbill, Anastomus oscitans), গিরিয়া হাঁস (Garganey, Spatula querquedula), দেশি মেটেহাঁস (Indian spot-billed duck,(Anas poecilorhyncha); নদীর জলে পাথরের উপরে বসে জল থেকে খাবার জোগাড় করে Plumbeous water redstart (Rhyacornis fuliginosus)। পুরুষদের গায়ের রং নীল, লেজ মরিচা রঙের; স্ত্রী পাখিদের রং ধূসর। এদের কাজই পাহাড়ি খরস্রোতা জলধারায় পোকা ধরা। সমতলে এঁকে দেখা যায় না; তাই প্রচলিত বাংলা নামও নেই। এঁদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হেলিকপ্টারের মত সরাসরি ওপরে ওড়া। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা, চারদিক সবুজে সবুজ। জায়গাটি আমার ভারি প্রিয়। যখন চাকরি করতাম, এখানে অনেকবার এসেছি। চাকরিটি যাওয়ার পর কখনও ভাবিনি আবার এখানে আসা হবে। অথচ হল তো!

সেখানে চা খেয়ে মূর্তি নদীর ব্রিজ পেরিয়ে খুনিয়া মোড়। সেখান থেকে নাগরাকাটা পথ গিয়েছে গরুমারা চাপড়ামারি অরণ্যের মধ্য দিয়ে। ময়ূর, বাঁদর আর বনমুরগির দেখা মিলল। নাগরাকাটার জলঢাকা সেতুর গায়ে নদীবক্ষে গজিয়ে উঠেছে হৃদয়াকৃতির এক চড়া - লোকমুখে নাম পেয়েছে লাভ আইল্যান্ড। জলঢাকা আন্তঃসীমান্ত নদী; দক্ষিণ-পূর্ব সিকিমে উৎপন্ন হয়ে ভুটানে, সেখানে তার নাম দিচু, মানসাই আর সিঙ্গিমারি। ভারতে ঢুকে তারপর বাংলাদেশে; সেখানে তার নাম ধরলা। কুড়িগ্রামের কাছে ব্রহ্মপুত্রে তার সমাপ্তি।

সেখান থেকে চা বাগানের মধ্য দিয়ে অনেকখানি পথ হেঁটে রেললাইন, তীব্র এক বাঁক নিয়ে সে উঠে গেছে সেতুতে। বসে রইলাম ১৫৪৮৩ আলিপুরদুয়ার দিল্লি সিকিম মহানন্দা এক্সপ্রেস দেখার আশায়। রেললাইন ধরে লোকজন কাঠ বয়ে আনছে, সংরক্ষিত অরণ্যের চোরাই কাঠ – তবু এদের চোর বলতে যেন বাধে – এদের কঠোর পরিশ্রমটুকু তো উপেক্ষণীয় নয়। সিকিম মহানন্দা এক্সপ্রেস দেখে চাপড়ামারি সংরক্ষিত অরণ্যের ভিতর চাপড়ামারি রেলগেটে; হাতিরা এখানে রেললাইন পেরোয়, তাই বোর্ডে লেখা ANIMAL CROSSING DRIVE SLOW। কাছাকাছি হাতিরা থাকলে রেলগাড়ি চালককে সতর্ক করার জন্য রেললাইনের আড়াআড়ি লাল দরজা।

সেখান থেকে চালসা। চালসা মেটেলি Bengal Dooars Railway-র রেল চলার সূত্রপাত ১৯১৮য়। সেই রেললাইন হারিয়ে গিয়েছে অরণ্যে। ভিউ পয়েন্ট থেকে পাহাড় আর জঙ্গল – যখন চাকরি করতাম, এদিকপানে প্রায়ই আসতে হত। সেই সূত্রে এই জায়গাটি আমার ভারি প্রিয়। সেখান থেকে নিউ মাল – চ্যাংড়াবান্ধা – নিউ কুচবিহার লাইনের মালবাজার স্টেশন। অবৈদ্যুতায়িত, একটিই প্ল্যাটফর্ম – সারাদিনে চারটি রেলগাড়ি চলে।

রেলস্টেশন দেখে মালবাজার বাস টার্মিনাস, সেখানে বরোলি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। খেতে খেতে আলাপ হল স্থানীয় শিক্ষক সব্যসাচী ঘোষ মহোদয়ের সঙ্গে। তিনি জালালেন রেলকলোনির ভিতরে রেলের কিছু অতি পুরাতন বাড়িঘর আছে। আমরা সেগুলি দেখতে গেলাম। মালবাজার আলো ঝলমল ঝাঁ চকচকে শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট ও দূষণমুক্ত পর্যটকপ্রিয় শহর; এখান থেকেই অনেকে ডুয়ার্স ভ্রমণ শুরু করেন। হাতি ও বাইসন (গউর, Gaur, Indian Bison, Bos gaurus)-এর উৎপাতের জন্য প্রসিদ্ধ। 'মাল পার্ক' টি চমৎকার। বনভোজনের জন্য এখানে আছে 'কুমলাই পিকনিক স্পট'।
পাহাড়ের পাশ দিয়ে, চা-বাগানের গা ঘেঁষে, জানা-অজানা নদী ও ঝোরা পার হতে হতে বাগরাকোট চা বাগান। গাড়ির রাস্তার পাশাপাশি চলেছে রেলের লাইন। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস সহ বেশ কয়েকটি ট্রেন এই পথে যাতায়াত করে। রাস্তাময় লটারির দোকান, নিশ্চয় বিক্রিবাটা হয়; নইলে এরা সারাদিন টিকিট সাজিয়ে বসে আছে কেন? চা-বাগানের অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রায়ই দীর্ঘ নিবন্ধ পড়ি। বামপন্থী বন্ধুরা প্রায়ই বোঝাবার চেষ্টা করেন চা-বাগানের শ্রমিকরা কতখানি বঞ্চিত, শোষিত, নিষ্পেষিত। তবু সেই সীমায়িত আয়ের মধ্য থেকেই অপরাপর খরচ কমিয়ে তারা লটারির টিকিট কাটেন! আশ্চর্য! আমি তো বিগত তিরিশ বছরে লটারির টিকিট কেটেছি বলে মনে করতে পারলাম না।

বাগরাকোট থেকে নাথুলা যাবার নতুন রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নীল আকাশের নিচে সবুজ গালিচা, সজীব প্রকৃতি; টিলা আর সমতল।

শিলিগুড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে তিস্তা নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে ওদলাবাড়ি অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম গাজলডোবায়। তিস্তা এখানে শান্ত, বিস্তৃত; দূরে পাহাড় আর অগণন পাখি। উত্তরবঙ্গের এটিই নবতম পর্যটন গন্তব্য – ঠিক যেভাবে মিরিক গড়ে উঠেছিল সাতের দশকে। গাজলডোবায় তৈরি হচ্ছে ইউথ হস্টেল, রিসর্ট, আয়ুর্বেদিক ভিলেজ। ২১০ একর এলাকায় ইতিমধ্যেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। যাতায়াতের সুবিধার জন্য পূর্ত দফতর তিনটি রাস্তা তৈরি করছে জাতীয় সড়কের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। এছাড়া গোটা এলাকায় বিদ্যুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে একটি পাওয়ার স্টেশন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। গ্রামের পাশেই বৈকুন্ঠপুর বন। সেখানে নাকি কৃষ্ণ আর রুক্মিণী কিছুদিন ছিলেন, অনেকেই দেখেছেন! সেই স্মৃতিতে ইস্কন এক মস্ত মন্দির বানিয়েছে।

তবে গাজলডোবার খ্যাতি তার পক্ষীকুলের নিমিত্ত। নভেম্বরের শুরু থেকেই এখানে আসতে শুরু করে মালাড, গ্রেল্যাগ গুজ, নর্দার্ন ল্যাপউইং, কমন মারগ্যানজার, নর্দার্ন শোভেলার। ভারতে যত প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস আসে, তাদের সব ক'টি প্রজাতিকেই নাকি এখানে দেখা যায়। যাঁরা তিস্তায় মাছ ধরেন, তাঁরাই নৌকা করে পাখি দেখাতে নিয়ে যান, নিয়ে যেতে যেতে তারাই এখন গাইড। পাখিদের নাম তাঁদের কণ্ঠস্থ, কোন পাখির ঝাঁক কোথায় থাকতে পারে, তাও তাদের জানা। নৌকাগুলি অতি সরু; ছপছপ আওয়াজ ওঠে, জলে চিকচিকে রোদ, মাথার ওপর দিয়ে ডাকতে ডাকতে উড়ে যায় হাঁসের ঝাঁক। হোগলা বনের ফাঁকে ডিঙিনৌকা, হাওয়ায় জেলেদের টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসে। দাঁড় টেনে এগোতেই দেখা মিলল ব্রাহ্মণী হাঁসের (Ruddy Shelduck, Tadorna ferruginea), Northern Pintail (Anas acuta), Mallard (Wild Duck,Anas platyrhynchos)। এক সময়ে নৌকা এসে থামল চরে। সেখানে ঘুরে বেড়ায় কাস্তেচরা (Red-naped Ibis, Pseudibis papillosa), River lapwing (Vanellus duvaucelii), Little ringed Plover (Charadrius dubius), Northern lapwing (Vanellus vanellus), Common shelduck (Tadorna tadorna), সরাল lesser whistling duck (Dendrocygna javanica), European Sand Martin (Riparia riparia). Grey-headed Lapwing (Vanellus cinereus), ডুবুরি হাঁস (Little Grebe,Tachybaptus ruficollis), Eurasian Teal (Anas crecca), Tufted Duck (Aythya fuligula), লাল কাঁক (Purple Heron, Ardea purpurea), Western Osprey (Pandion haliaetus), Bar-headed Goose (Anser indicus), ইউরোপিয়ান নীলকণ্ঠ (European Roller, Coracias garrulus), ইউরেসিয়ান বউ কথা কও (Eurasian Golden Oriole, Oriolus oriolus), Eurasian wigeon, (Mareca penelope), Northern Lapwing (Vanellus vanellus), Graylag Goose (Anser anser), হলুদ খঞ্জন (Citrine wagtail, (Motacilla citreola), কুরচি বক (Little Egret, Egretta garzetta), Wood Sandpiper (Tringa glareola), Common Sandpiper (Actitis hypoleucos), পানকৌড়ি (Great Cormorant, Phalacrocorax carbo), বড় পানকৌড়ি (Oriental Darter, Anhinga melanogaster), বেলে বগেরি (sand lark (Alaudala raytal); সাইবেরিয়া রাশিয়া, কোরিয়া জাপান থেকে উড়ে এসেছে ছোট্ট Siberian Stonechat (Saxicola maurus), কেলে কসাই (Long-tailed Shrike/ Rufous-backed Shrike, Lanius schach), Olive-backed Pipit (Anthus hodgsoni), Long-legged Buzzard (Buteo rufinus)।

সেখান থেকে করোনেশন সেতু, ১৯৩৭-এ রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেকের স্মারক, চার লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি এই সেতু চালু হয়েছিল ১৯৪১ সালে। উন্মত্তা তিস্তার বুকে কোন স্তম্ভ নেই, পুরোটাই ঝুলন্ত। স্থানীয়দের কাছে এই সেতু বাঘ পুল, কারণ সেতুর একমাথায় দুটো বাঘের মূর্তি আছে। ডুয়ার্সের সঙ্গে শিলিগুড়ির যোগাযোগের মূল মাধ্যম সেতুটির পিলারের মাটি সরে গিয়েছিল বহুদিন আগে। ২০১১ সালের ভূমিকম্পে সামান্য ক্ষতির পর এই সেতুর উপর দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত পিলারের নিচে পাথর বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। তিস্তার জল যাতে পিলারের আর ক্ষতি করতে না পারে, সেই জন্য পিলারের চারপাশে পাথর এবং লোহার জালি বসানো হচ্ছে। পর্যটনের স্বার্থে এই সেতুর সংরক্ষণ ও শিলিগুড়ির সাথে ডুয়ার্সের যোগাযোগ নিবিড় করতে তিস্তার উপর দ্বিতীয় এক সেতু – এই দুই দাবিই উঠতে শুরু করেছে।

১৮৫৮ সালে ডুয়ার্সে চা বাগান গড়ে ওঠা শুরু হয়। চল্লিশ বছরের মধ্যে তিস্তার পার থেকে সঙ্কোশ নদী পর্যন্ত শতাধিক চাবাগান গড়ে ওঠে – তাল মিলিয়ে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়। তখন আজকের শিলিগুড়ি ছিল না; চিকিৎসা, শিক্ষা, চাবাগানের সমস্যা সব কিছুর জন্য প্ল্যান্টার্সদের ছুটতে হত দার্জিলিংয়ে। ফুলবাড়ি ঘাট দিয়ে তিস্তা পেরিয়ে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং যেতে হতো। মালবাজার শহরের ব্যবসায়ী সিং পরিবার ছিলেন এই ঘাটের ইজারাদার। ১৯২৫ সাল নাগাদ ডুয়ার্সে চায়ের উৎপাদন বাড়ে। জমির পত্তনি নিয়ে গড়ে ওঠে একের পর এক চা বাগান। তিস্তার পার বরাবর শিলিগুড়ি থেকে গেলিখোলা ন্যারো গেজের রেললাইন ততদিনে চালু হয়ে গেছে। সেই রেলপথে মালপত্র এনে ১৯৩৭ সালে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ষাটের দশকে খ্যাতনামা রেল ইতিহাসবিদ ও কার্টোগ্রাফার জন গিলহ্যাম সাহেব দার্জিলিং রেলপথের মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। সেখানে এই লাইনটি দেখানো আছে। তিনি এই লাইনে শালুগাড়া নামের একটি স্টেশনের উল্লেখ করেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই সময়কালের সময় সারণিতে ওই স্টেশনের কোন উল্লেখ নেই। এই সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয় ১৯৪২-এ।

অতঃপর সেবকের জঙ্গল, সরলবর্গীয় উন্নতশির বৃক্ষরাজির পাশাপাশি শাল-সেগুনের ছায়াময় মায়াময় রাস্তা – বাতাস হিমেল। বাংলা-সিকিম সংযোগকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ সেবক রোড ধস নামার জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। ধস নামলেই সিকিমের রাস্তা বন্ধ, বন্ধ শিলিগুড়ি থেকে ডুয়ার্স এবং কালিম্পং যাওয়ার রাস্তাও। জঙ্গল শেষ হলেই অনুপমা তিস্তা দুই পাহাড়ের মাঝে সবুজ জল বুকে নিয়ে – আর রুপোলি রেল সেতু।

ধর্মহীন ভ্রমণব্যসনে বাঙালি নিম্ন-মধ্যবিত্তের মননে কোথায় যেন মিশে থাকে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধ। বিধানবাবু যখন মাইথনে শ্রমিক পর্যটন আস্তানা বানিয়েছিলেন, তখনও কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের অনুষঙ্গ ঝেড়ে ফেলা যায়নি। দীঘা নেহরু মার্কেটে কালীমন্দির বানাতে তবে লোকে যেতে শুরু করলো। এভাবেই, বছর দশ বারো আগে তিনশো ফুট উচ্চতায় গজিয়ে উঠেছে সেবকেশ্বরী কালী। তার মাহাত্ম্য প্রচারে সন্তানকুল উচ্চকিত, পঞ্চমুখ। ভক্তিভরে ডাকলে মা নাকি কাউকেই ফেরান না। কবে এখানে পুজো শুরু, তা নাকি কারোরই জানা নেই; সম্ভবত টেথিস সাগর থেকেই তার উত্থান। এখান থেকেই নাকি পঞ্চমুন্ডি আসন, বেদি আর ত্রিশূল পেয়েছিলেন এক সাধক ইত্যাদি ইত্যাদি। গোটা পাহাড় ঘুমিয়ে পড়লেও 'সেবকেশ্বরী মা' নাকি জেগে থাকেন; তাই অমাবস্যার রাতে এখানে বিপুল জনসমাগম, পাহাড়ে নাইট লাইফ বলতে বিশেষ কিছু নেই কিনা! এসব গল্প শুনলেই আমার হাই ওঠে। তবে পাহাড়ের গায়ে এমন কালীমন্দির এরাজ্যে সম্ভবত বিরল। সম্প্রতি আবার উত্তরবঙ্গের তিনটি মন্দির — ভ্রামরীদেবী মন্দির, সেবক কালীবাড়ি এবং দেবী চৌধুরানী মন্দির – নিয়ে একটি নতুন পর্যটন সার্কিট তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন।

তিব্বতি লামা কালু রিনপোচে শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে প্রতিষ্ঠা করেছেন মস্ত এক মঠের। শালুগাড়া মঠ (আন্তর্জাতিক তাশি গোমাং স্তুপ) শহরের মধ্যেই, সেনাছাউনির পাশেই। দলাই লামার অনুগামীদের দ্বারা নির্মিত মঠটির পরিচালনাভার Droden Kunchab Chodey Buddhist Association-এর হাতে। মঠের স্তূপটি একশো ফুট, বৌদ্ধধর্মের পাঁচরকম পবিত্র স্মরণচিহ্ন এখানে সংরক্ষিত।

ঘেরা মঠ, বাইরের প্রাচীরে বুদ্ধের ধ্যানরত চিত্রণ, ভিতরে কাঠের মেঝে, অনুগামীদের জন্য প্রার্থনার আসন পাতা। মঠাভ্যন্তরে এক ছোট ঘরে মাখন প্রদীপ জ্বালাবার বন্দোবস্ত, চমরী গাইয়ের দুধের মাখনও উপলব্ধ। তার পাশেই এক মস্ত বড় প্রেয়ার হুইল। তিব্বতি ধূপের গন্ধে বাতাস ভারি, ওঁ মণিপদ্মে হুঁ মন্ত্রোচ্চারণে মুখরিত। দেবতাত্মা হিমালয়ের পাদমূলে শান্তি ব্যাপ্ত চারিদিকে। ওঁ মণিপদ্মে হুঁ পরম করুণাময় অবলোকিতেশ্বরের উদ্দেশে উচ্চারিত তিব্বতি মহাযান বৌদ্ধধর্মের পবিত্রতম মন্ত্র। ছোট ছোট চিরকুটে এই মন্ত্র লিখে তা প্রার্থনা চক্রের মধ্যে ভরে দেওয়া তিব্বতের চিরন্তন ঐতিহ্য। পঞ্চাশ বছর আগেও তিব্বতি জীবনযাত্রা জীবনচর্যা নিয়ে জানতে হলে কালিম্পং যেতে হত। এখন তা শিলিগুড়িতেই পাওয়া যাচ্ছে।

রোমাঞ্চকর বেঙ্গল সাফারি এর কাছেই। কাছেই হার্বাল পার্ক ও শালুগাড়া বিট অফিস।

পরিশেষে শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন। পাঁচটি ব্রডগেজ প্ল্যাটফর্ম, একটি ন্যারোগেজ। নিউ জলপাইগুড়ি আলিপুরদুয়ার শামুকতলা রোড, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে ও কাটিহার শিলিগুড়ি লাইন সমূহের প্রাণকেন্দ্র এই শিলিগুড়ি জংশন (Station Code SGUJ)। স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে এর পথ চলা শুরু; বৈদ্যুতায়িত ২০২০ তে। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের লোকজনের সৌজন্যে তাদের লোকো শেড ও ওয়ার্কশপ দেখা হল।

রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন সকালে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন (Station Code SGUT)। দু ফুটের ন্যারোগেজ ও সাড়ে পাঁচ ফুটের ব্রডগেজ – সঙ্গে স্মারকরূপে কিছুটা মিটারগেজ লাইন। দুটি ব্রডগেজ প্ল্যাটফর্ম, একটি ন্যারোগেজ। North Bengal State Railway-র এই স্টেশনের পথ চলা শুরু ১৮৮০-তে, বৈদ্যুতায়িত ২০২০-তে। স্টেশনের গায়ের হকার্স কর্নার চিরে ন্যারোগেজ লাইন হ্যানয়ের Train Street বা থাইল্যান্ডের Maeklong Railway Market এর কথা মনে পড়ায়। দার্জিলিং মেল একদা এই স্টেশন থেকেই ছাড়ত।

তারপর ভুটিয়া মার্কেট ও হংকং মার্কেট। কেনাকাটা সেরে নিউ জলপাইগুড়ি জংশন স্টেশন দুটোয়। ২২৩০২ নিউ জলপাইগুড়ি - হাওড়া বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রা তিনটে পাঁচে, আমাদের কামরা ই ২, এক্সেকিউটিভ শ্রেণিতে। সারা রাস্তা উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি, শুধু রাতের খাওয়া দেওয়ার সময় এক পিসিমা আমিষ ও নিরামিষ আহার্য কেন একসঙ্গে আনা হচ্ছে তাই নিয়ে তুমুল হইচই জুড়লেন – আর তাই নিয়ে সারা কামরায় ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ঝড় উঠল, এক নব্য যুবা দাবি করলেন তার মাতাঠাকুরানি নাকি মুরগি রেঁধে কড়ায় একটি তুলসিপাতা ফেলে দেন। হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে লাগল মন্তব্যেরা। হাওড়া সাড়ে দশটায়।

পুনঃ –
১। কবিদের আমার ভারি ঈর্ষা হয়, কারণ কবিতার তথ্যগত ভ্রান্তি নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না। গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। তার মধ্যেই রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা - কেউ কি কখনও প্রশ্ন করেছে কী ধান দাদু, আমন না আউশ না বোরো; তাই থেকে কী চাল হবে, দুধেশ্বর না মিনিকিট, লোহু না বাঁশকাঠি।
কবিরা লিখেই খালাস, প্রামাণ্যতা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমরা যারা বেড়িয়ে এসে গুগল টাইমলাইন দেখে দেখে বিস্তর গুলগাপ্পা দিয়ে বেড়াতে যাওয়ার গল্প লিখি, তাদের মহা জ্বালা। বিন্দুমাত্র তথ্যগত ভ্রান্তি থাকলেই সতর্ক পাঠক চেপে ধরে, 'কী মশাই, শিলিগুড়ি বাজারে দক্ষিণমুখো দাঁড়িয়ে কুমড়ো কিনতে কিনতে আপনি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলেন কী করে!'
তাই বলছি, ঝটিকা সফর কাহিনিটিতে কেউ কোন তথ্যগত ভ্রান্তি দেখলে জানাবেন। শুধরে নেব।
২। পাখিদের বাংলা নাম মাঝিদের থেকে সংগৃহীত, ইংরাজি ও বৈজ্ঞানিক নাম আমার সংযোজন। উল্লিখিত সব পাখিই আমি দেখেছি এমনটি কিন্তু নয়।

হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূল ক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সে বিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালের বাংলায় ভ্রমণকাহিনি লেখালেখির প্রেরণা 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না।'

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher