বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
বেথুয়াডহরিতে একদিন
পথিক
২৬ জুন, ২০২৩
প্রবল গরমে নাকানিচোবানি খেতে খেতে ঝুম বৃষ্টিতে ভেজার কথা মনে হত।
এই মাসের প্রথমে গরম কমার বিন্দুমাত্র লক্ষণ না দেখে কিছুটা ব্যাজার মুখেই বেথুয়াডহরিতে জায়গা বুক করি।
আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। চা-পর্ব শেষ করে চলে এলাম এখানকার রিজার্ভ ফরেস্টে। দু-পা এগোতেই নামল বৃষ্টি। একদৌড়ে উঠলাম বনদপ্তরের একটা ছোট্ট অফিসের বারান্দায়। অফিসে কেউ নেই। ভিতর থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে বারান্দায় আরাম করে বসলাম। ঘন জঙ্গলের ওপর বৃষ্টি দেখতে ভালই লাগছিল। একটু বাদে বৃষ্টি কমলে দুজন এল। বলল, আরেকটু বসে যেতে। গাছের থেকে বৃষ্টির জলটা খানিক ঝরে যাক।
খানিক বাদে উঠলাম। একটু এগিয়ে ডান হাতে বেঁকে কিছুটা গিয়ে পাখির জায়গা। একটা গাছপালা ঘেরা মাঠ; সেটাকে জাল দিয়ে ঘিরে কয়েকটা পাখিকে আটকে রাখা হয়েছে। তার একধারে দেখি লোহার ডান্ডা দিয়ে পাখিদের বসার জায়গা। সেখানে চারমূর্তি বসে আছেন। তাঁদের তিনজনই সবুজবর্ণ। আরেকজন অবশ্য সবুজের ওপরে অনেকখানি হলুদ। সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাতেই ইষৎ ঘাড় বাঁকিয়ে তিনি বলে উঠলেন, কঃ। অর্থাৎ আমার কুশল জানতে চাইছেন। বললাম, ভালো। শুনে ঘাড়খানা উল্টোদিকে বাঁকিয়ে বললেন, কঃ। এবারে হয়তো আমি কে সেটাও জেনে নিতে চাইছেন। এই মেঘলা দিনে এমন একটা গভীর দার্শনিক প্রশ্ন শুনে বিচলিত হয়ে উঠতেই পাশ থেকে ক্যাঁ ক্যাঁ আওয়াজ এল। দেখি দুটি অপেক্ষাকৃত ছোটো সবুজ পাখি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে কী যেন আলোচনা করছে। আমাকে দেখেই এমন ভাব করল যেন – আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই। আমি তাদের আলোচনায় নাক গলাতে চাইলাম না। পাখির খাঁচার উল্টোদিকে আরেকটা বড়ো ঘেরা জায়গায় একটা নীলগাই উদাস ভাবে পদচারণা করছিলেন; সেদিকে ফিরলাম। 'নীলগাইটার রং কেন কালো ঠেকছে' – এই গভীর তত্ত্বকথা ভাবতে যেতেই কেমন মনে হল কেউ যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ফের পাখির জায়গাটার দিকে ঘুরতেই দেখলাম একটা ময়ূর তার বিরাট পেখম বন্ধ করে রেখে একটা কৌতুকপূর্ণ চোখে দেখছে আমায়। ভাবখানা – এ ব্যাটা আবার কে? কোত্থেকেইবা এল? এমনসময় আবার বৃষ্টি নামল। ঝুম বৃষ্টি। ইচ্ছে হয়েছিল ময়ূরবাবাজির সঙ্গে একটা সেলফি তুলব তা এই বৃষ্টিতে জামা-কাপড়, চশমা সব ভিজে একশেষ। তাই সেলফির চেষ্টা না করে বৃষ্টির মধ্যেই এগোলাম জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলার পথ ধরে।
২৭ জুন
গতকাল একজনের মুখে শুনেছিলাম পাটুলি-গঙ্গা ঘাটের কথা। জায়গাটা বেথুয়াডহরি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার। বছর দশেক আগেও ছিল প্রায় ১৫ কিলোমিটার। প্রতি বর্ষায় গঙ্গা ভাঙতে ভাঙতে এখন দূরত্ব কমে এসেছে।
সে যাই হোক, আজ সকাল নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। সামনের চায়ের দোকানদারের বদান্যতায় একটা অটো মিলে গেল যে নিয়ে যাবে, ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করবে আর তারপর ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। গতকাল থেকেই আকাশ কালো হয়ে আছে। পথে বাজার থেকে একটা ছাতা নিয়ে নিলাম। মিনিট চল্লিশ বাদে অটো পৌঁছে গেল পাটুলির ঘাটে। এদিকে নদী বেশ নিচে। বালির বস্তা দিয়ে নদীর ধারটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে - ভাঙন আটকানোর প্রয়াস। তবে এতে কি নদীর ভাঙন আটকানো যায়?
এখানে গঙ্গা বেশ চওড়া। ওপারে বিস্তীর্ণ চর। উঁচু ঘাসে ঢাকা। দেখলাম একটা নৌকা ওপারে যাবে। সামনে দিয়ে একটা মোটরবাইক দি্ব্যি তাতে উঠল। আরও কয়েকটি ছেলে-বুড়ো। বাচ্চা কোলে একজন বউ। মাঝিকে বললাম ও পারে যাব আবার ফেরত আসব, কত দেব? সে বেশ উদাস ভাবে বলল আসুন, যা হয় একটা দেবেন। গুটিগুটি নৌকায় চেপে বসলাম। নৌকা একটু পরেই ছাড়ল। নদীটা অনেকখানি পার করে ওপার ঘেঁসে যেতে লাগল। ওপারের কাছে যেতেই কতগুলো জোয়ান ছেলে ঝুপ-ঝুপ করে জলে লাফিয়ে পড়ল। আমি বেশ অবাকই হলাম কান্ড দেখে। নৌকাতে বাকিরা নিরুত্তাপ। বুঝলাম এমন ঘটনা এখানে হামেশাই হয়ে থাকে। যেতে যেতে বৃষ্টি নামল, জোরে নয় যদিও। ভিজতে বেশ ভালই লাগছিল। হঠাৎ মনে পড়ল খানিক আগেই ছাতা কিনেছি। হারিয়ে যাওয়ার আগেই সেটা ব্যবহার করা দরকার। অতএব ছাতা মাথায় নৌকা ভ্রমণ। ধীরে ধীরে নৌকা এগোচ্ছে। পাশের লোকটির সঙ্গে আলাপ জমালাম।
আপনার নাম কী?
সনাতন।
বাড়ি?
ওই পারে, পাটুলি বাজারে।
আচ্ছা, পাটুলির ঘাট এই পারে আর বাজারটা ওপারে কেন?
আগে গঙ্গা আরও দূরে ছিল, পাটুলি বাজার পেরিয়ে।
বুঝলাম, নদী ভাঙতে ভাঙতে এদিকে চলে এসেছে। তাই পাটুলির ঘাটখানা এপারে কিন্তু বাজার আবার গড়ে উঠেছে পুরোনো জায়গাতে, চরের ওপরে।
এইযে, একটু আগে, ছেলেগুলো নদীর ধারে লাফিয়ে পড়ল কেন?
চরার জল-কাদায় মাছ ধরবে ওরা।
কী মাছ?
ছোটো ছোটো কত মাছ। যা পাওয়া যায়।
স্রোতের টানে নৌকা দিব্যি এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে ওই পাড়ে একটা ছোট্ট ঘাটে এসে দাঁড়াল। একটি বউ বাসন ধুচ্ছে। একবার এদিকে তাকিয়ে দেখেই আবার কাজে মন দিল। ঘাটের থেকে একটা কর্দমাক্ত হাঁটাপথ চলে গেছে। নিশ্চয়ই বাজারের দিকে। মাঝি নৌকোটা পাড়ের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মোটরবাইকটা ঠেলে নৌকা থেকে নামিয়ে কাদাপথটা পার করে দিল। বাকি কয়েকজনও একটু একটু করে নৌকা থেকে নেমে কাদাপথ পেরিয়ে হাঁটা দিল। আমি ছাতা মাথায় নৌকাতে দাঁড়ালাম। দুপাশের সবুজ চিরে নদী আরও নিচে নেমে হুগলীতে ঢুকেছে, তারপর কলকাতা। খুব দূরে না কিন্তু কত আলাদা।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ফিরলাম। ফেরার পথে আবার কয়েকটি ছেলে কোমর-জল থেকে নৌকাতে উঠল। এরা সেই ছেলেগুলো না। তাদের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। কোমরে গামছায় বাঁধা মাছ। নিজেদের মধ্যে বকবক করে যাচ্ছে। এ ওকে নিজের রোজগার দেখাচ্ছে। উঁকি মেরে দেখলাম অনেকগুলো বেলে মাছ আর ছোটো ছোটো কী কী সব মাছ। অনেকক্ষণ কোমর পর্যন্ত জলে দাপাদাপি করে ওই ক'টা ছোটো মাছ জুটেছে!
মানুষ কত অল্পতে আনন্দ পেতে পারে, কত অল্পতে তৃপ্ত থাকতে পারে! এইসব ভাবতে ভাবতে নৌকাটা কেঁপে উঠল। চমকে তাকিয়ে দেখলাম পাটুলির ঘাটে এসে নৌকাটা ঠেকেছে।
পথিক ভালোবাসেন উদ্দেশ্যহীন বেড়াতে, গান শুনতে আর গাইতে।