-->
বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী প্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য এবার পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পত্রিকার পাতায়।
[রাজিয়া সেরাজুদ্দিনের পরিচয় সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না, তবে তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় যে তিনি একজন শিক্ষিত সংবেদনশীল বাঙালি মহিলা। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে (১৯০৪ খ্রি.) বেগম রোকেয়ার 'কূপমণ্ডুকের হিমালয়দর্শন' বাঙালি মুসলমান মহিলার লেখা প্রথম ভ্রমণকাহিনি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই ভ্রমণকাহিনিটিই সম্ভবত দ্বিতীয়।
মূল লেখাটি 'সওগাত' পত্রিকার অগ্রহায়ণ, ১৩৫২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।]
ভূস্বর্গ কাশ্মীর
রাজিয়া সেরাজুদ্দিন
যাঁরা কাশ্মীর যান নি তাঁদের উপর দয়া করা উচিত। সুমেরু অঞ্চলে অভিযানের জন্য একজনের পর্য্যটক হিসেবে বেশ খ্যাতি আছে, কিন্তু কাশ্মীর যদি সে না গিয়ে থাকে, তাহলে আমি বলব, সে বিখ্যাত পর্য্যটক নয়। হংকং-এর পুরাতন আসবাব সামগ্রী, টাঙ্গানিকার বাঘের চামড়া আপনার বাড়ীতে থাক, কিন্তু যদি কাশ্মীর না যান তবে আমি বলব, ভ্রমণের সুরুচি আপনার নেই।
বানিহাল থেকে যদি কাশ্মীর উপত্যকার দৃশ্য দেখে থাকেন, তবে আপনার জীবনে তা একটা অমূল্য সঞ্চয়। ফিয়োসোল থেকে ফ্লোরেন্সের দৃশ্য নাকি মনোরম। তেমনই মনোরম মিস্ত্রার ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে স্পার্টা নগরী দর্শন। কিন্তু কাশ্মীর উপত্যকার দৃশ্য আরো মনোরম ও মনোহর। তফাৎ শুধু এইটুকুঃ এখানে গম্বুজ নেই, মিনার নেই অথবা আকাশ-স্পর্শী শিখর নেই।
শ্রীনগর পৌঁছবার আগে যেদিকে খুশী তাকান দেখবেন, আপনার সম্মুখে বন্ধ্যা সুদীর্ঘ দেবদারু তরুর সারি আর মাঝে মাঝে ধানের ক্ষেত। ক্ষেতে কাজ চলছে। পাশে সরু খাল - সারা বছর পানীতে ভরা থাকে, তার উপর পীত রঙের ফুলের জোয়ার।
দেবদারু-ঢাকা সড়কের উপর দিয়ে চলার সময় চোখে পড়ে ছোট ছোট গ্রাম। চারিদিকে ধোঁয়া উঠছে। তারই ভেতর দিয়ে গায়ের আবছা আভাস। দেখে মনে হবে, সব কিছু পুড়ে গেছে, এইগুলো শুধু অবশিষ্ট ছাই। পৃথিবীর বুকের উপর যেন অসংখ্য ব্যাঙের ছাতা। তারই ভেতর মানুষ বাস করে। শুধু বাস নয়, তাদের সমস্ত জীবন এইখানে কাটে। এই নোংরা বস্তী দেখে সমাজের অন্যায় আর অবিচারের কথা সহজেই মনের পর্দ্দায় ভেসে ওঠে।
কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ বলা হয়। কিন্তু প্রথম দর্শনে কাশ্মীর হতাশা সৃষ্টি করে। হ্রদের পাশে, জলভূমির পাশে ডিঙির উপর ঘরগুলো আদৌ মনোরম নয়। বিখ্যাত 'মিরান কাদাল' একটা সাধারণ বাজার ছাড়া আর কী! কিন্তু কাশ্মীরের সৌন্দর্য্য এত বিভিন্ন প্রকৃতির, যে ধীরে ধীরে তার আস্বাদ পাওয়া যায়। তখন হতাশার স্থান অধিকার করে আনন্দ।
কাশ্মীর সহরের কোলাহল ছেড়ে যদি ডাল হ্রদের তীরে পৌঁছান আপনার চোখে পড়বে, সুন্দর সুন্দর 'হাউজ-বোট" পানীর উপর ভাসছে। বাতাসের সাথে খেলা করে তাদের রঙ্গীন পর্দ্দা আর চাঁদোয়া।
সিন্ধু উপত্যকার উপর দিয়ে মোটরে চড়ে যান অথবা ফ্রেসলন থেকে পাহল গাঁ পর্য্যন্ত যদি পায়ে হেঁটেই বেড়ান –দৃশ্যের কোন পরিবর্তন নেইঃ দেবদারু গাছের সারি, ধানের ক্ষেতে আর তার তার বুক জুড়ে সরু দাগের মতো ছোট ছোট খাল। কক্ষ পাহাড়তলীর পথ দিয়ে চলতেও এই দৃশ্যই চোখে পড়ে।
জুলাই বা আগষ্ট মাসে যদি গরম বোধ করেন অথবা ভাপসা আবহাওয়া আপনার পছন্দ না হয়, তাহলে গুলমার্গে একটী কুটীর ভাড়া নিতে ভুলবেন না। ভাল কাঠের তৈরী এই সব কুটীর দেখলে মনে হয় যেন হ্যান্স এ্যান্ডারসনের রূপকথার দেশে এসেছি। ইঁট-পাথরের কোন বালাই নেই এখানে। জঙ্গলের মৃত তরুদের হাড় যেন চারিদিকে ছড়ানো ।
যাঁরা খুব ফুল ভালবাসেন, তারা যেন দয়া করে 'ফিরোজপুর নালা" ধরে গুলমার্গ থেকে টানমার্গ পর্য্যন্ত একবার পায়ে হেঁটে যান। আপনার মনে হবে যেন একটী প্রাকৃতিক উদ্যানের ভেতরে এসে পৌঁছলেন। এই উদ্যানে বিশৃঙ্খলতাই যেন সবচেয়ে বড়ো কথা। পাথরের আড়াল ছেড়ে কত রকমের ফুল না উঁকি মারে। দুপাশে শুধু ফুলের বেড়া। বাঁশ-কঞ্চির বেড়া এ-জগতে কেউ দেখে না।
যদি গল্ফ খেলায় আপনার ঝোঁক না থাকে তা হলে সোজাসুজি পাহল গাঁয়ে গিয়ে আস্তানা পাতবার উপদেশই আমি আপনাকে দিতে চাই। জায়গাটা এখনও মধ্যযুগের ওপারে, এইটুকুই যা অসুবিধা। সুইজারল্যাণ্ডের সঙ্গে পাহল গাঁর পার্থক্য শুধু এইখানে। এই জায়গার আবহাওয়া খুব মনোরম এবং স্বাস্থ্যকর। পানীতে নানা ধাতব উপাদান আছে, বিশেষজ্ঞদের মত। পাহল গাঁ থেকে অমরনাথ তীর্থ দর্শন করতে পারেন। কাশ্মীরে দুটো গ্লেসিয়ার আছে। পাহল গাঁ থেকে যেতে বেশ সোজা। কিন্তু আধুনিক জগতের সব সুবিধা এখানে প্রত্যাশা করবেন না। তাই আগেই বলেছি, কাশ্মীর এখনও মধ্যযুগের ওপারে রয়েছে।
কাশ্মীর শহরের ট্রাফিক আর জনতার কোলাহল ভাল না লাগে, আশা করি আপনি তাহলে (…)* তাঁবু পাতবেন। এখানে রৌদ্র পোহান আরামে। রৌদ্রও সৌরভমাখা। বাদাম গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে মাটির উপর আলো-ছায়ার লুকোচুরি দেখে চোখ ভরে যায়। এই পার্কই ছিল একদিন মোগল সম্রাটদের বিশ্রামের মঞ্জিল।
(*ছাপা অস্পষ্ট ছিল। সম্ভবত 'শালিমার বাগে' হবে।)
মনসবল, গন্দরবল আর সোনামার্গ বন-ভোজনের মনোরম জায়গা। রবিবারে নিশাতি ও শালিমার উদ্যান আরো দূরে শাহী ও হারওয়ান ঝর্ণা – যে কোন দিকে আপনার উদাস মনের রাশ ঢিল দিতে পারেন। ঐ সব বাগান আর ঝর্ণার ধারে ঘাসের উপর যারা শুয়ে থাকে সেই সব সুন্দর আর সুন্দরীদের দিকে চেয়ে আপনার মনে হবে, আপনি দেশ-ভ্রমণে আসেন নি – আপনি এখানে পড়ছেন ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ যার পাতা এডমন্ড ডুকরের আঁকা নয়, তার চিত্রকর স্বয়ং বিধাতা। নিশাৎবাগ থেকে ডাল হ্রদের সৌন্দর্য্য বেশী খোলতাই হয়। হ্রদের বুকের উপর শিকারা (নৌকাঘর) গুলো ছেলেদের খেলনার মত দেখায়।
কাশ্মীর মোগল আমলে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল। এই জন্য কাশ্মীরে সৌন্দর্য্যের এত বিভিন্ন প্রতীক ছড়ানো। মুর-সম্রাটগণ স্পেনে কফি, লিলাক আর গুলাম-আহারের সারি প্রথম আনে। মোগলেরা কাশ্মীরে এনেছে দেবদারু আর চেনারের সারি।
তবু কাশ্মীরে ফেরীওয়ালাদের জ্বালায় অস্থির হোতে হয়। দুপুরের ঘুম বা স্নানের সময় মালী ফুল নিয়ে হাজির। কেউ নিয়ে আসে কুঁড়ি। সব চেয়ে বিপদজনক নাপিত। আপনার চুলের দিকে চেয়েই বাড়ীর মুরুব্বিদের মত মন্তব্য করবে, আপনার চুলকাটা দরকার।
কাম্মীরীদের সৌভাগ্য যে তাদের জন্মভূমিতে বৃষ্টি হয়, বরফ পড়ে। আর সূর্য্যের আলোও খুব প্রখর । বীজাণু-নাশের কাজ প্রকৃতির এই সব দূতেরাই সম্পন্ন করে। সব চেয়ে সুন্দর দেশের অধিবাসীরা এত নোংরামি পছন্দ করে। নোংরা থাকা কাশ্মীরীদের একটা স্বভাবগত অভ্যাস। শুধু সূর্য্যের জন্যই এরা বাঁচে। নচেৎ দু-মাস অন্তর কাশ্মীরে মহামারী দেখা দিত। একবার এক জার্ম্মাণ ডাক্তার কাশ্মীরের সৌন্দর্য্যের উপর পুস্তক রচনার জন্য এ-দেশে আসেন। কিন্তু তাঁর পেশাগত উপজ্ঞা-ইনসটিঙ্কট তাঁকে রেহাই দিল না। কাশ্মীরীদের প্রত্যেকের হাতের চামড়ায় তিনি এক রকম রোগ আবিষ্কার করলেন। শেষে তিনি বই লিখলেন চিকিৎসা-শাস্ত্রে।
কাশ্মীরী অভিজাতদের ব্যবহার আর সংস্কৃতির গুণ সকলকে মুগ্ধ করে। কিন্তু আমাদের উঁচুতলা আর নীচুতলার অধিবাসীদের মধ্যে এত ফাঁক আর ব্যবধান বোধ হয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই। কাশ্মীরের ব্যবসাদারদের শঠতা আর চালাকী প্রায় প্রবাদ বাক্যের সামিল। কাশ্মীরে এলে তার যাথার্থ ভাল করে উপলব্ধি করা যায় –সোজা ভাষায়, হাড়ে হাড়ে বোঝা যায়। কিন্তু এরা সুদক্ষ কারিগর সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। চীনেদের মতো কাশ্মীরীদের একটা স্বভাবগত সৌন্দর্য-প্রাণ আছে। কাশ্মীরী শালের কাজ, কা'কে না মুগ্ধ করবে। বুদ্ধি আর বিচক্ষণতায় ত এরা ওস্তাদ। কিন্তু এরা নীতিবিদ নয়। মিথ্যা কথন যেন কাশ্মীরী ভাষার অঙ্গ। কথায় কথায় কিরে কাটা এদের বিশেষ স্বভাব।
কাশ্মীরী মেয়েদের সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে অনেক কথা শোনা যায়। তাদের ময়লা শরীরের ভেতর দিয়ে রূপ হয়তো ফোটে, মাঝে মাঝে সুন্দরী মেয়েও চোখে পড়ে বৈকি, কিন্তু কাশ্মীরী মেয়েদেরর তনু আঁকা চলে না। মাথার চিত্র আঁকা সম্ভব, কারণ এদের পোষাক অবয়ব সবই ঢাকা থাকে, শিল্পীকে হতাশ হোতে হয়।
কাশ্মীরী মেয়েদের গৃহস্থালীর কাজ সম্পন্ন করার ভেতর নানারকম ছন্দ ফুটে ওঠে। এটা শিল্পীদের লোভনীয় স্থান। কিন্তু ছবি আঁকবার সরঞ্জাম দেখলেই মেয়েরা পাত্তাড়ি গুটায়।
পয়সার লোভে যারা 'মডেল' হয় তাদের অভিনয় সুলভ ক্ষমতা আছে। কিন্তু মেয়েরা ছবি আঁকার ইজেলকে মনে করে ক্যামেরা – তাই তারা হাতে হাতে ফল প্রার্থনা করে।
তিন মাস কাশ্মীরে হাওয়া বদলের পর অনেকের আর কাশ্মীর হয়ত ভাল লাগে না। তখন কাশ্মীরে নাড়ী নক্ষত্র আপনার জানা।
কাশ্মীর থেকে ফিরে এলেন। সঙ্গে নানা সামগ্রীর কাশ্মীরী শাল, ভাইপো-ভাগিনেয়ীদের জন্য খেলনা, বন্ধুদের জন্য মোটা রঙ্গীন কাগজের তৈরী অন্যান্য চিজ। প্রতিজ্ঞা করবেন "না, আর কাশ্মীর নয়। সমগ্র ছবিটী ঘরে আছে, কাশ্মীরে যাওয়ার আর প্রয়োজন নেই।"
কিন্তু পরের বছর আবার আপনাকে কাশ্মীর আসতেই হবে, এম্নি কাশ্মীরের যাদু। আবার নতুন করে শুরু হবে আপনার অভিজ্ঞতার যাচাই।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আনসারুল ইসলাম
[অভ্রতে কিছু কিছু বাংলা বানান টাইপের অসুবিধাটুকু বাদ দিলে মূল লেখার বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক]
HTML Comment Box is loading comments...