সফর কেমব্রিজ
সঞ্চারী দাশগুপ্ত
কেমব্রিজের মতন স্বনামধন্য একটি স্থানের স্বচক্ষে দেখতে পেরেছি ভাবলেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে যায়। শুরু থেকে শুরু করা যাক।
লন্ডনের লিভারপুল স্টেশন থেকে ঝাঁ চকচকে, উন্নত প্রযুক্তির, সুসজ্জিত ট্রেনে চেপে রওনা দিলাম কেমব্রিজ-এর উদ্দেশ্যে। ট্রেনের দীর্ঘকায় জানলা দিয়ে নীল অসীম আকাশের ছাউনির নিচে মাইল-এর পর মাইল বিস্তৃত মনোরম সবুজ মাঠ ঘাট দেখতে দেখতে যেতে বড্ড আরাম হচ্ছিল। আরও অভিভূত হলাম যখন হলুদ সরষে ক্ষেত অনেকখানি সফর জুড়ে বিনোদন জোগাল। মনটা সতেজ ও ফুরফুরে হয়ে গেল যেন। দেশের কথাও ঝিলিক মারছিল মনের মধ্যে বারবার। নানা কথায় ডুবে আছে মন, তখনই জানা গেল গন্তব্যস্থল ইতিমধ্যে হাজির।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখলাম শহরটাতে ছিমছাম গোছগাছ করা একটি পরিপাটি ব্যাপার রয়েছে যেটি প্রথমেই বেশ মন কাড়ল। আমি একটু পিটপিটে স্বভাবের কিনা। তা যা হোক, একটি বাস ধরে সোজা সিটি সেন্টার রওনা দিলাম। বাস থেকে নেমে বুঝলাম সিটি সেন্টার নামটি যথাযত মর্যাদাই পেয়েছে এখানে। বেশ প্রাণবন্ত, এমনকি ক্যাকোফোনাসও বলা চলে। হঠাৎ করে পর্যটকদের এত ভিড় ও অনর্গল কিচিরমিচিরে খানিক থতমতই খেলাম। আবারও হতবাক হলাম যখন দেখলাম রাস্তার ধারে স্টল দিয়েছে কিছু হিন্দু ধর্মের প্রচারক এবং তারা সমানে হরে কৃষ্ণ গান করে চলেছে, সঙ্গে বিনামূল্যে গীতা বিতরণীও চলছে। তার পরে পরেই হদিস মিলল একটি মেলা প্রাঙ্গণের, যেখানে হরেক রকমের টফি ও ফাস্টফুড স্টল স্বভাবতই আমার কেমব্রিজ ভ্রমণের পিপাসাকে মুহূর্তের জন্য হলেও খানিক ছাপিয়ে গেল। কিছুটা ডাইভার্ট হয়েই রসনাতৃপ্তি সেরে ফেললাম। এত ধর্মের, এত জাতের মানুষের মিলনের সাক্ষী হব এখানে এসে, তা উপলব্ধি করে বেশ একটা পরিতৃপ্তিও হল।
এরপর আর সময় নষ্ট না করে মনোনিবেশ করলাম ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাস তো নয়, যেন এক আস্ত শহর! কতো সুদৃশ্য, আকর্ষণীয় দোকানপাট! বুঝতে একটু অসুবিধাই হচ্ছিল, এখানে কি আদৌ কোনও কলেজ থাকা সম্ভব? এমন ভাবামাত্রই দেখলাম স্বয়ং কিং'স কলেজ, বেশ অট্টালিকামাফিক আকৃতি নিয়ে, মাথা উঁচিয়ে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুঠোফোনে মুহূর্ত বন্দী করতে বিন্দুমাত্র দেরি করলাম না।
এরপর যতই এগোতে থাকলাম রাস্তা ধরে, একের পর এক বিশ্ববিখ্যাত কলেজ ট্রিনিটি, সেন্ট জনস্-এর মতো আরও অনেক প্রতিষ্ঠানই ঝাঁকে ঝাঁকে উঁকি দিতে লাগল। গঠনের ভঙ্গি দেখে বোঝা যায়, এদের দম্ভ আজও বিশেষ ক্ষীণ হয় নি। শত শত বছরের বেশি পুরোনো এই সব ইমারত আজও কেমন দোর্দণ্ডপ্রতাপে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রয়ে গেছে ভাবলেই বিস্ময় জাগে! কতো মজবুত এদের ভিত! কতো প্রবাদপ্রতিম মানুষের পা পড়েছে এই সব কলেজে, এই সব রাস্তায়, ভাবলেই মেরুদন্ড শক্ত হয়ে যায়।
শুনেছি শুধুমাত্র শিক্ষার গুণগত মানের পরিপ্রেক্ষিত এই নয়, আর্কিটেকচারের দিক থেকেও নাকি কেমব্রিজ অন্যতম একটি শহর। বাদামি রঙের, অধিকাংশই গথিক স্টাইলে নির্মিত স্থাপত্যগুলির মধ্যে সাদৃশ্য থাকলেও, খতিয়ে দেখলে টের পাওয়া যায়, একে অন্যের থেকে খানিক আলাদাও বটে; বিশেষত তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে। পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে চলতে চলতে, প্রাচীন শহরটার অলিগলির সঙ্গে পরিচিত হতে হতে বেশ একটা ইউরোপিয়ান আমেজ বোধ করছিলাম।
আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলাম যখন ট্রিনিটি কলেজ প্রাঙ্গণের সামনে জটলা পাকিয়ে কয়েকজন পর্যটককে বিশেষ একটা কিছুর ওপর ক্যামেরা ফোকাস করতে দেখলাম। কাছে গিয়ে জানতে পারলাম, সমস্ত উত্তেজনার মূলে স্যার আইজাক নিউটন-এর সেই বিখ্যাত অ্যাপল ট্রি। ভেবেই রোমাঞ্চিত হলাম যে আমিও আজ সেই বিস্ময়কর ঐতিহাসিক আবিষ্কা্রের সাক্ষী হলাম তবে! সেই কোন্ ছোটবেলা থেকে পড়ে এসেছি নিউটন-এর এই আপেল গাছ ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার-এর ঘটনা। সেই গাছ চাক্ষুষ করে বড়ই প্রাপ্তি বোধ হচ্ছিল। যদিও পরমুহূর্তেই এক সত্য উন্মোচিত হয়ে আমার সমস্ত উৎসাহে জল ঢেলে দিল, যখন জানতে পারলাম এই ট্রি-টি শুধুমাত্রই একটি মডেল, প্রকৃত গাছটির অনুকরণে নির্মিত মাত্র।
আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে সরে পরলাম ট্রিনিটির সামনে থেকে। এরপর একের পর এক কলেজ অতিক্রম করে ক্রমশ এগিয়ে চললাম এই চত্ত্বরের পাশ দিয়ে বহমান ক্যাম নদী দর্শনে। খুব ইচ্ছে ছিল রিভার-পান্টিং অর্থাৎ ক্যাম নদীর ওপর দিয়ে বোটিং করার ও দুপাশের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার। সাথে ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ কলেজগুলির দেখা পাওয়া তো উপরি পাওনা বটেই, তবে তা আর সম্ভব হল কই? কনকনে, ঝোড়ো হাওয়া বাধ সাধল যে প্রতিবারের মতোই। বোট কর্তৃপক্ষ যদিও সবাইকে ব্ল্যাংকেট দেওয়ার বন্দোবস্ত করছিল বটে তবু্ও প্রবল ঠান্ডায় অমন সবদিক খোলা বোটে চেপে নদীবক্ষে পরিভ্রমণের দুঃসাহস আর দেখালাম না।
অগত্যা, খানিক হতাশ হয়েই বিপরীতমুখী হয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম। রাতও হয়ে আসছিল বেশ। সফরটা যেন 'শেষ হয়েও হইলো না শেষ' হয়েই সমাপ্ত হল। তবে সেদিন প্রাপ্তির ঝুলিতে হরেকরকম ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতাই জড়ো হল। এই মুহূর্তগুলোই তো সারা জীবনের পথ চলার পাথেয় হয়ে রয়ে যাবে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সঞ্চারী দাশগুপ্ত বর্তমানে ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। ফ্রিল্যান্স লেখালেখি করেন, ঘুরেবেড়াতে ভালবাসেন।