ল্যুরে ক্যাভার্নস
দীপান্বিতা গঙ্গোপাধ্যায়
পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় প্রায় পঁয়তাল্লিশ কোটি বছর আগে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট ল্যুরে ক্যাভার্নস (Luray Caverns) আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৩ অগাস্ট, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। স্বভাববশত হিসেব করতে শুরু করলাম, আমরা ১২ অগাস্ট, ২০২৩ অর্থাৎ আবিষ্কারের ঠিক ১৪৫ বছরের মাথায় সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এসে পড়েছি আমেরিকার পূর্ব প্রান্তের বিস্ময়কর এই গুহা দেখতে! বাবলিদি বার বার বলেছে, ভার্জিনিয়া গেলে এবার ল্যুরেতে যাস। যদিও অন্ধ্রপ্রদেশে আরাকু ভ্যালির কাছে বোরা কেভস্ তোদের দেখা।
বোরা কেভস্ যেন ল্যুরের ছোটো সংস্করণ। আবিষ্কারের সাল তারিখ বলছে, বোরা কেভস্ আবিষ্কৃত হয়েছিল, ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে। ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক উইলিয়াম কিং ছিলেন এর আবিষ্কারক। লক্ষ বছর আগে বয়ে যাওয়া নদীর জল চুনা পাথরের বিশাল দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে ঢুকে মাটি, নানা খনিজ পদার্থের সংমিশ্রণে আশ্চর্য সব আকার নিয়েছে বোরা কেভসের ভেতর। স্থানীয় লোককথা বলে, এখানে রাম-লক্ষ্মণ নাকি বনবাস যাপন করেছিলেন। একটু পৌরাণিক ছোঁয়া আমাদের আরও উৎসাহিত করে। পর্যটকরা এর সন্ধান পান গত শতকের আটের দশকে। মনে আছে, প্রায় একশো কুড়িটা সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে নেমেছিলাম। একটা জায়গায় ছিল, দূরে মাথার ওপরে বেশ বিরাট গর্ত দিয়ে সূর্যের আলো সোজা গুহার ভেতর ঢুকছে। যেন হেসে বলছে, এবার তো ওপরে ওঠার পালা। ওঃ! সময় নিয়ে, থেমে থেমে, হাফাঁতে হাঁফাতে ওঠার কথা মনে হতেই কেমন দুমড়ে গেলাম। তা বেশ কয়েক বছর আগের দম আর এখনকার দম, ওরে বাবা! জিষ্ণুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি রে, বোরা কেভসের মতো নাকি, পারব?' মুচকি হাসি, 'চল না।' অভয় হাসি দেখলাম বলেই তো মনে হল।
গুহার বিরাট দরজার সামনে দাঁড়াতেই যেন অদৃশ্যে কেউ বলে উঠল, চিচিং ফাঁক! লাইন দিয়ে ঢুকে গেলাম গুহা পরিক্রমায়। দুরুদুরু চিত্তে গভীরে, আরও গভীরে যাচ্ছি, সুন্দর রাস্তা ধরে অবলীলাক্রমে যাচ্ছি শুধু আমরা নই সত্তর-আশি ঊর্ধ্ব যুবক যুবতীরাও। মাঝে মাঝে উত্তরণ, অবতরণ আছে বটে কিন্তু তাতে কারো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। পরিকল্পনামাফিক পথ কাটা। পথে দেখতে পাওয়ার মতো মাঝে মাঝে আলোও আছে। এদেশের এই দিকটা আমার খুব পছন্দের। যেকোনও কিছুতেই এরা অল্পবয়সীদের সঙ্গে বয়স্ক মানুষও যাতে আনন্দ উপভোগ করতে পারে তার কথা চিন্তা করে। আর শিশুদের প্রাধান্য তো সবার আগে। যদিও ল্যুরে ক্যাভার্নস সরকারি নয়, গ্রেভস্ পরিবারের ব্যক্তিগত মালিকানায় সংরক্ষিত। এতক্ষণে মনে বেশ সাহস এসে গেছে। বুঝলাম, বাইরের গরম থেকে আমরা গুহার ভেতর ঠান্ডায় জুড়িয়ে যাচ্ছি। যত ভেতরে ঢুকছি আহ! ঠান্ডা ঠান্ডা, কুল্ কুল্। আর মেজাজে খচাখচ্ ছবি তোলা শুরু।
গুহার বিরাট দরজার সামনে দাঁড়াতেই যেন অদৃশ্যে কেউ বলে উঠল, চিচিং ফাঁক! লাইন দিয়ে ঢুকে গেলাম গুহা পরিক্রমায়। দুরুদুরু চিত্তে গভীরে, আরও গভীরে যাচ্ছি, সুন্দর রাস্তা ধরে অবলীলাক্রমে যাচ্ছি শুধু আমরা নই সত্তর-আশি ঊর্ধ্ব যুবক যুবতীরাও। মাঝে মাঝে উত্তরণ, অবতরণ আছে বটে কিন্তু তাতে কারো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। পরিকল্পনামাফিক পথ কাটা। পথে দেখতে পাওয়ার মতো মাঝে মাঝে আলোও আছে। এদেশের এই দিকটা আমার খুব পছন্দের। যেকোনও কিছুতেই এরা অল্পবয়সীদের সঙ্গে বয়স্ক মানুষও যাতে আনন্দ উপভোগ করতে পারে তার কথা চিন্তা করে। আর শিশুদের প্রাধান্য তো সবার আগে। যদিও ল্যুরে ক্যাভার্নস সরকারি নয়, গ্রেভস্ পরিবারের ব্যক্তিগত মালিকানায় সংরক্ষিত। এতক্ষণে মনে বেশ সাহস এসে গেছে। বুঝলাম, বাইরের গরম থেকে আমরা গুহার ভেতর ঠান্ডায় জুড়িয়ে যাচ্ছি। যত ভেতরে ঢুকছি আহ! ঠান্ডা ঠান্ডা, কুল্ কুল্। আর মেজাজে খচাখচ্ ছবি তোলা শুরু।
প্রায় ঘন্টাদেড়েক ধরে গুহা পরিক্রমা; শুধু আশ্চর্য হয়ে দেখছি, বিশ্বকর্মার নিপুণ হাতের কারিগরি! কখনও সাদা, কখনও লাল, কখনও লৌহকালো রঙের আপনাআপনি তৈরি এক একরকম আকৃতির চুনাপাথরের শিল্প। কোথাও মনে হচ্ছে যেন শাড়ির কুঁচি, কোথাও সারি সারি হাতির পাল, সারি সারি টাটকা লইট্যা মাছ, কোথাও গণেশ, কোথাও খোদাই করা গুহামানব তো কোথাও পদ্মকুঁড়ি! নিজের মতো করে ভেবে নিতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। একেবারে যাকে বলে 'ভাবনার শতদল'। এই মাথার ওপরে ঝুলছে তো এই ভুঁইফোঁড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিষ্ণু, ইন্দ্রনীল বলছে এই দেখো স্ট্যালাকটাইটস (stalactites) স্ট্যালাগমাইটস (stalagmites)। গুহার অনেকটা ভেতরের দিকে স্বচ্ছ জলের ওপর স্ট্যালাকটাইটস-এর প্রতিবিম্বে মনে হচ্ছে যেন আয়নায় নিজেদের মুখ দেখছে। আবার এক একটা স্ট্যালাগমাইট যেন ইয়া বড়া উইয়ের ঢিপি।
এগোতে এগোতে দেখি একটা বিরাট জায়গা জুড়ে অন্ধকার গুহার মাঝে অসংখ্য প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। একেবারে আমাদের দেওয়ালির আলোকসজ্জা। আবার খানিক এগোতে দেখি একটা জায়গায় জটলাপাকানো ভিড়। দেখলাম, গুহার গা চুঁইয়ে পড়া অদ্ভুত সবুজ জমা জল, লেখা আছে, Wishing Well। অনেকে মনস্কামনা করে ডলার, খুচরো সেন্ট ফেলছেন। বাহ্, আমরাও তো গঙ্গা বা যেকোনও পবিত্র স্থান পেলেই এমনই করি।
আচ্ছা,আমাদের বোরা কেভসের গল্পের মতো এই গুহার কোন গল্প নেই? হ্যাঁ, আবিষ্কারের গল্প আছে। নেটিভ আমেরিকানদের কাছ থেকে জানা যায়, একদিন কয়েকজন ইউরো-আমেরিকান সহ পাঁচজন স্থানীয় মানুষের চোখে পড়ল, চুনা পাথরের একটা পাহাড়ের খানিকটা জায়গা দেখা যাচ্ছে আর সেখানকার একটা ছোট ফুটো দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বেরোচ্ছে। তাহলে কি এখানে গুহা আছে? শুরু হল অনুসন্ধান, সেই ফুটো কেটে বড় করার কাজ। চার ঘন্টা ধরে খোঁড়াখুঁড়ির পর ছোটখাট মানুষ ঢোকার মত গর্ত হতেই দলের সবচেয়ে বেঁটে দুজন গুঁড়ি মেরে ওই গর্তে ঢোকেন। সঙ্গে দড়ি ও মোমবাতি নিয়ে এগোতে এগোতে আবিষ্কার করলেন এই আশ্চর্য গুহা। সেইদিনটাই ছিল ১৩ অগাস্ট ১৮৭৮। ভিজে ভিজে, ঠান্ডা ঠান্ডা, উঁচু নিচু পথে আওড়াতে আওড়াতে যাচ্ছি স্ট্যালাকটাইটস স্ট্যালাগমাইটস। এই যাঃ, ভুলে গেলাম তো কে কোনটা। ও জিষ্ণু! 'মা এতো ভুলে যাচ্ছ কেন মা। শোন, স্ট্যালাকটাইটস-এর 'সি'-তে সিলিং মনে কর আর স্ট্যালাগমাইটস-এর 'জি'-তে গ্রাউন্ড।' একগাল হেসে ছেলে বলল, 'এবার আর ভুল হবে না বলো?'
গুহা পরিক্রমার শেষ পর্যায়ে আর এক চমক! আমেরিকান গাইডের ইংরেজি বোঝা কী মুশকিল! ছেলেদের শরণাপন্ন হওয়াই ভালো। এই মুহূর্তে যেখানটায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেখানে গিনেস বুকে স্থান করে নেওয়া ৩.৫ একর জুড়ে দ্য গ্রেট স্ট্যালাকপাইপ অরগান (The great stalacpipe organ) রয়েছে। মি. লেল্যান্ড ডব্লিউ. স্প্রিঙ্কলার ১৯৫৪ সালে এখানে লিথোফোন (lithophone)-এর সন্ধান পেয়েছিলেন । তিনি ছিলেন একজন গণিতজ্ঞ এবং ইলেকট্রনিক্স সায়েন্টিস্ট। গুহার ভেতরে গাইডের ডেমনস্ট্রেশন দেখে তিনি চমকে ওঠেন। গাইড একটি চুনাপাথরের ওপর ম্যালেট (রবার আর কাঠের তৈরি ছোট হাতুড়ি) দিয়ে আলতো আঘাত করতেই সুন্দর মিষ্টি সুর সৃষ্টি হচ্ছে।
মি. স্প্রিঙ্কল ওই বিশাল গুহার চেম্বারে বিশেষ বিশেষ স্ট্যালাকটাইটস নির্বাচন করে তিন বছরের চেষ্টায় কয়েকটি টিউন সেট করলেন। এক একটি ইলেক্ট্রিক্যাল ম্যালেট দিয়ে ছোট্ট করে ঠুক ঠুক করে ভিন্ন ভিন্ন পাথরের মধ্যে বিভিন্ন রকম সুরেলা আওয়াজ শুনতে পেলেন। এই সুরের অনুরণন আমাদের শোনার উপযুক্ত করে তৈরি করলেন অর্গানের সুর। আমরা সেই লিথোফোনের অর্গান-এর সুর শুনলাম। সারা এলাকা জুড়ে অর্গানের মৃদু সুর গুহার অন্ধকার ভেদ করে মনের গহনে যে অনুরণন তুলল তা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। প্রকৃতির এই আশ্চর্য সৃষ্টির রহস্য ভাবছি – বাইরের বাতাসের কার্বনডাইঅক্সাইডের সংস্পর্শে এসে গুহার ভেতরের জল মাটির সঙ্গে মিশে কার্বনিক অ্যাসিড তৈরি করে। আর সেই মিশ্রণ মাটির ভেতরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে চুনাপাথরের পরতে পরতে গিয়ে এমন নানা আকার তৈরি করছে। আবার সেই পাথরেই সুরের সঞ্চার হচ্ছে!
'কঠিন লোহা কঠিন বুকে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইল কে?
লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপন, ওগো, তায় জাগাইনু রে।'
সাধে কী আর বিশ্বকবি! নিজের অজান্তেই মি. স্প্রিঙ্কল-এর জন্যও গান লিখে গেছেন।
দীপান্বিতা গঙ্গোপাধ্যায় সঙ্গীতপ্রেমিক ও ভ্রমণপিপাসু। বিভিন্ন স্মারক সংকলনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।