চেনা পুরীর অচেনা ঠিকানায়
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
২০১৬ সাল। মার্চের মাঝামাঝি। সকালবেলাতেই গনগনে সূর্যের আলো সমুদ্রের জলে যেন ঠিকরোচ্ছে। সাগরের নোনা গন্ধ, উঁচু উঁচু ঢেউ, দিগন্তরেখা পর্যন্ত নীল জলের বিস্তার আর চিরচেনা বাঙালি পর্যটকের ভিড় – পুরী সবসময়েই সাদরে আহ্বান জানায়।
সমুদ্রে স্নান করতে চিরকালই ভাল লাগে। কিন্তু এবারে শরীর খারাপের জন্য বেশিক্ষণ জলে থাকতে পারছি না, ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। স্থানীয় কোস্ট-গার্ডদের বসানো গার্ডেন আমব্রেলার ছায়ায় মায়ের পাশে চেয়ারে বসে থাকতেই আরাম লাগছে। দীপ একাই দুহাতে আমাদের সতেরো বছরের কন্যা আর ছ'বছরের ভাইঝিকে সামলাচ্ছে। আমার মেয়ে প্রায় মাছের মতোই জল ভালবাসে। সাঁতারও জানে। কিন্তু সে-ও পুরীর এই উত্তাল ঢেউ আর পায়ের তলায় বালি সরে যাওয়াটায় খুব স্বচ্ছন্দ হতে পারছে না। ওড়িশায় সুপার সাইক্লোনের পর বিচের বালিয়াড়ি বেশ ভেঙে গেছে জায়গায় জায়গায় – ঢেউয়ের তোড়ে সরে যাওয়ার পর আচমকাই জলের তলায় পা নেমে যায় দু-এক ফুট নিচে।
সময় কীরকম বদলে যায় –মায়ের সঙ্গে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসি। বেড়াতে এসে সত্তোরোর্ধ মা চল্লিশোর্ধ আমার থেকে বেশি চনমনে রয়েছেন। 'আমাদের ছেলেবেলায় এদেরই বলা হত নুলিয়া। ছোটবেলায় তোদের যখন নিয়ে এসেছি তখনও। রোগা রোগা চেহারার মানুষগুলো গাড়ির টায়ার নিয়ে ঘুরে বেড়াত লোকজনকে সমুদ্রে স্নান করানোর জন্য। আর এখন 'কোস্ট গার্ড' জ্যাকেটে অনেক সফিস্টিকেটেড দেখতে, বাড়তি রোজগারের জন্য চেয়ারও ভাড়া দিচ্ছে।'
ওদিকে মিষ্টিবিক্রেতারা সমানে হাঁক পেড়ে ঘুরে যাচ্ছে– মদনমোহন, রসগোল্লা…। যেকোনোরকম মিষ্টির প্রতি আমার দুর্বলতা চিরকালের। ইদানীং ডায়াবেটিসের জন্য নিজেকে বেশ সামলে চলতে হয়। কিন্তু আগে কখনও 'মদনমোহন' খাইনি, আর জীবনে একবারই তো বাঁচব। ফলে চেঁচিয়ে ডাকি– মদনমোহন খাব। খেতে অনেকটা বাংলার কমলাভোগের মতোই, তবে পিচরঙা আর লম্বাটে আকারের। শালপাতায় নিয়ে সেই মদনমোহন আনন্দ করে খেয়ে ফেলি সবাই। কিন্তু আমার ছোট্ট ভাইঝি ঊর্জার চোখ রঙিন রঙিন বলের দিকে। আকুলভাবে তার 'ইসেমশাই'কে জিজ্ঞাসা করে, 'তোমার কাছে কি বল কেনবার টাকা আছে?' তারপর 'ইসেমশাই'-এর সঙ্গে অদূরের একটা খেলনার স্টল থেকে গোলাপি রঙের ডিজনি প্রিন্সেস আঁকা একটা বল কিনে খুব খুশি হয়ে ফিরে আসে। খানিকপরেই আবার আবদার - হয় ঘোড়া নয় উটে চড়ব…। এবারে 'ইসেমশাই' নরম হন না, গম্ভীরভাবে জানান, সবে তো আসা হয়েছে, এখনও অনেক সময় আছে ওইসব করবার জন্য। আরও ঘন্টাখানেক জলে ঝাঁপাঝাঁপি করে উঠে এসে ডাবের জল খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে সবাই ফিরে চললাম হোটেলের দিকে।
পরেরদিনের গন্তব্য জগন্নাথের মন্দির। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী দেখার উৎসাহই আমার বেশি। বছর পনেরো আগে যখন শিশুকন্যাকে নিয়ে পুরী এসেছিলাম, সেবার জগন্নাথ মন্দিরে যাওয়া হয়নি, আর ছেলেবেলার দেখা তো আর মনে নেই সেভাবে। পুরীর বিখ্যাত মন্দিরটি একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে গঙ্গা বংশের চোরগঙ্গার নির্মিত বলে অনুমান করা হয়। তবে ঐতিহাসিক ফার্গুসনের মতে পুরী হচ্ছে প্রাচীন দন্তপুর যেখানে কলিঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্ত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের শ্ব-দন্তের ওপর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই মন্দিরটিই জগন্নাথ মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। চোরগঙ্গা সেটির সংস্কার করেছিলেন মাত্র। কথিত যে দেবমূর্তি গড়া শেষ হওয়ার আগেই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন রানি গুণ্ডিচাদেবীর অনুরোধ এড়াতে না পেরে মূর্তিনির্মাতার নিষেধ অগ্রাহ্য করে মন্দিরের দ্বার খুলে দেখেছিলেন। তাই জগন্নাথদেবের মূর্তি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
পুরীর মন্দিরের স্থাপত্য কোনারকের সূর্যমন্দিরকে মনে করায়। যদিও এখানে মন্দিরের 'জগমোহন' অংশ অটুট রয়েছে। কলিঙ্গ স্থাপত্যরীতির সবকটি নিয়ম মেনেই এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। পশ্চিম থেকে পুবে মন্দিরের চারটি অংশ – বেলেপাথরে নির্মিত দেউল, জগমোহন, নাটমন্দির ও ভোগ মণ্ডপ পরপর রয়েছে। মন্দির অঞ্চলকে বেষ্টন করে রয়েছে পাথরের উঁচু পাঁচিল। মূল মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে বিমলাদেবীর মন্দির, লক্ষ্মীদেবীর মন্দির, ধর্মরাজ অথবা সূর্যনারায়ণ মন্দির, পাতালেশ্বর শিব মন্দির, ভোগ বিতরণস্থল আনন্দবাজার, স্নান বেদি, রন্ধনশালা, বৈকুন্ঠ বা যাত্রীশালা। মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বারের সামনে রয়েছে অরুণস্তম্ভ। অষ্টাদশ শতকে কোনারক মন্দির থেকে এনে মন্দিরের সিংহদ্বারের সামনে প্রতিষ্ঠা করা হয় স্তম্ভটি। শোনা যায়, কালাপাহাড়-এর বিধ্বংসী আক্রমণের সময়ে কোনারকের মন্দির থেকে মূল সূর্যদেবতার মূর্তিটি এখানে নিয়ে আসা হয়। সেইটি দেখার কৌতূহল ছিল সবথেকে বেশি। কিন্তু সূর্যদেবের মূর্তি বলে যা পুজো হয় এবং তার পেছনের অদৃশ্যপ্রায় মূর্তিটিও যতটুকু দেখা গেল, খুব একটা বিশ্বাস উদ্রেক করল না। হয়তো সবটাই গল্পকথা।
সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখে, সকালে সমুদ্রস্নান আর বিকেলে সৈকতে হাঁটাহাঁটি করে দিব্যি আরও দুদিন কেটে গেল। কোণার্ক-ভুবনেশ্বর-নন্দনকানন-উদয়গিরি-খণ্ডগিরিকেন্দ্রিক প্রচলিত 'সাইটসিইং'-এ যাওয়ার কোনও ইচ্ছে আমাদের ছিল না, ফিমার-নেক বদলানো মা-কে নিয়ে অতটা ঘোরাঘুরি করা সম্ভব নয়ও। কিন্তু দ্বিতীয়দিন দীপ জিজ্ঞাসা করল পটচিত্রের গ্রাম রঘুরাজপুর যাব কিনা? উৎসাহিত হয়ে যোগ করলাম সঙ্গে ধৌলিও ঘুরে আসা যাক। অশোকের শিলালিপি – সেই কবে ইতিহাস বইতে পড়েছি। কিন্তু আসল সমস্যা হল এই গরমে মা আর ঊর্জাকে নিয়ে সারাদিনের জন্য বেরোনোটা। ওরা কি পারবে ধকলটা নিতে? মায়ের উৎসাহের তো কখনোই কমতি নেই, আর ঊর্জা বেরোতে পারলেই খুশি। অতএব ট্যুর প্রোগ্রামে চৌষট্টি যোগিনী মন্দির আর পিপলিও জুড়ে দেওয়া গেল।
পরদিন সকাল আটটায় গাড়ি নিয়ে হইহই করে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ গরম। সকালেই রোদের তেজ যথেষ্ট। প্রথমে সোজা চললাম ধৌলি। ওড়িশার রাস্তায় যেটা আমার সবচেয়ে চোখে পড়ে, তা হল চওড়া মসৃণ পথের দুপাশে কোনও রাজনৈতিক হোর্ডিং নেই। জ্বলজ্বল করে না নেতা-মন্ত্রীদের মুখ। বাংলার সাম্প্রতিক হাল ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। পথের ধারে এক ধাবায় জম্পেশ ব্রেকফাস্ট সারা হল। এমনকি ধাবার বাথরুমটাও এত পরিষ্কার যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ট্যুরিস্টস্পটে বাথরুমের হালের কথা ভেবে রীতিমতো লজ্জা করল।
ধৌলি – সবুজে ঢাকা শান্ত ছোট্ট একটি টিলা, শুধুমাত্র বৌদ্ধস্তূপের পাশে স্থানীয় শিবমন্দিরের পাণ্ডা-পুরুতদের অত্যাচার বাদে। পথে যেতে যেতেই অশোকচক্রের প্রতীকসহ লৌহস্তম্ভ চোখে পড়েছিল।
কিন্তু অশোকের সেই বিখ্যাত শিলালিপি খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথাও। একটা ঢিবির ওপরে ছেলেবেলার ইতিহাস বই থেকে উঠে আসা হাতির প্রস্তরমূর্তিটি মুগ্ধ করেছিল। শেষপর্যন্ত কেয়ারটেকার আমাদের উদ্ধার করলেন। হাতির ঠিক নিচেই টিলার গায়ে তালাচাবি দেওয়া ঘেরাটোপের মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মী হরফে খোদিত অশোকের শিলালিপি। ওপরের দিকের পাথর কেটে হাতির মূর্তিটা তারই চিহ্নস্বরূপ খোদিত হয়েছিল, যাতে টিলাটা দূর থেকেই চেনা যায়।
তালা খুলে দিলে ভিতরে ঢুকে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। কোন প্রাচীনকালে এক রাজার আদেশে কে বা কারা এই মোনোলিথিক টিলাগাত্রের পাথরে এসব হরফ খোদাই করেছিলেন যা আজ এত বছর পরেও বিদ্যমান। এক লহমায় অতীত যেন জীবন্ত হয়ে উঠল চোখে। দুহাজার বছরেরও বেশি আগে ২৬১ খ্রিস্টপূর্বে মৌর্য সম্রাটের ক্ষমতাবিস্তারের আকাঙ্খা পূরণ করতে অনতিদূরের দয়া নদীর জল লাল হয়ে গিয়েছিল রক্তে।
দুলাখেরও বেশি হতাহত হয়েছিল সেই কলিঙ্গ যুদ্ধে। জয়লাভের পর সম্রাট অশোক অনুতপ্ত হয়েছিলেন। হিংসার পথ ত্যাগ করে মানবকল্যাণ তথা বুদ্ধের বাণীপ্রচারের ভার তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। সাম্রাজ্যের নানা জায়গায় এমনই সব বড় বড় টিলার গায়ে প্রাকৃত ভাষায় খোদাই করিয়েছিলেন তাঁর অনুশাসন।
পরের গন্তব্য হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনী মন্দির। জায়গাটা সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। এটা খুব একটা জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট নয়ও। মন্দিরের রাস্তা কেউ ঠিক বলতে পারছেন না, গুগল ম্যাপ ভরসা করে এগোনো। একটা খাল পেরিয়ে মূল রাস্তা থেকে পাশের রাস্তায় নেমে গেছি অনেকক্ষণ। মন্দিরের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে কয়েকজন শেষ রাস্তাটুকুর সন্ধান দিলেন। বিশাল পুকুরের পাশে গাড়ি থামল।
একটু এগিয়ে লোহার ছোট গেট পেরিয়ে সবুজে ভরা বড় চত্ত্বরের একেবারে শেষে মন্দির। গোলাকার ছাদবিহীন মন্দিরটা দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। রোদে তখন পাথরে পা রাখা যাচ্ছে না। জুতো খুলে এক দৌড়ে... নাহ্, মন্দিরের ঢোকার ছোট্ট গলিতে মাথা নিচু করতে হল। দেবীর কাছে আগত ভক্তকে প্রবেশ করতে হবে নত হয়ে। ভেতরে কোথাও রোদ্দুর কোথাও বা পাথরের দেওয়ালের ছায়া। ওইটুকু জায়গার ভেতরে যে এতগুলি দেবীর অধিষ্ঠান তাও ভাবিনি। আবার সেই অবাক হওয়ার পালা। গোল মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালের নীচের দিকে ছোট ছোট কুঠুরিতে সুন্দরী সব দেবী, সুডৌল গঠন তাদের, যেমনটা দেখা যায় চিরাচরিত ভারতীয় ভাস্কর্যে। মূর্তির মুখ কখনও মানুষের, কোনটা বা পশুর। অনেকগুলি মূর্তির হাত বা কোনও অঙ্গ ভেঙে গেছে, তবু মোটের ওপর বোঝা যায়। মোট ষাটটি কুঠুরি। দরজার একেবারে সোজাসুজি মহামায়া মূর্তিটি গ্রামদেবী হিসেবে পূজিত। পরে জেনেছি যে ভারতের চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরগুলির মধ্যে একমাত্র এই মন্দিরেই পুজো চালু আছে। মন্দিরের কেন্দ্রে যে স্তম্ভ, তাতে আরও চার কুঠুরির মধ্যে একটি ফাঁকা, বাকি তিনটেতে তিন দেবী। এখানে শিবের মূর্তিও রয়েছে।
বৃত্তাকার মন্দিরটির বাইরের দিকের ডায়ামিটার ৩০ মিটার। ল্যাটেরাইট পাথরে তৈরি মন্দিরটির বৃত্তাকার অংশটি স্যান্ডস্টোন ব্লক দিয়ে তৈরি। মূল দরজাটি একটি ছোট গলি দিয়ে বৃত্তাকার অংশের সঙ্গে যুক্ত। কালো ক্লোরাইট পাথরের স্ল্যাব থেকে কাটা যোগিনী মূর্তিগুলি একেকটি মোটামুটি দু ফিট উচ্চতার। সবকটি মূর্তির ভঙ্গীই দাঁড়ানো অবস্থার। মাটির কাছাকাছি ওপরে আর্চওলা প্রত্যেকটি যোগিনী মূর্তির ক্ষুদ্রাকার কুলুঙ্গিগুলিকে একেকটি ক্ষুদ্রাকার মন্দির রূপে ধরা হয়। মন্দিরের পুরোহিত মূর্তি চেনান ঘুরে ঘুরে। আমরাও যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে দেখি – চণ্ডিকা, তারা, নর্মদা, যমুনা, লক্ষ্মী, বারুণী, গৌরী, ইন্দ্রানী, বরাহী, পদ্মাবতী, মূরতী, বৈষ্ণবী প্রভৃতি বিচিত্ররূপিনী দেবীদের। আমাদের চেনা সরস্বতী মূর্তি থেকে একেবারেই আলাদা এখানকার সরস্বতী। দেবী মূর্তিটি একটি সর্পের ওপর দণ্ডায়মান। ডান কাঁধ থেকে একটি তারের বাদ্যযন্ত্র (তুমুরু) কোনাকুনিভাবে ঝুলছে। মাথার ওপরে চুলগুলি চালচিত্রের আকারে রয়েছে। দেবী বাম হাতে গুম্ফ মোচড়াচ্ছেন।
দেবী বিনায়কী বা গণেশানীর পেটমোটা হাতিমুখো চেহারা দেখলে গণেশের কথা মনে পড়বেই। তবে বাহন গাধা। দুই হাত আর মাথায় জটাজূট বা জটামুকুট। দেবী কালী চিরাচরিত কালীমূর্তিকে মনে করায় এক পায়ের তলায় শিব রয়েছে বলেই। যোগিনী মূর্তিটি দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাতই অনেকটা ভাঙা। যোগিনীর কাছে একটি ত্রিশূল রয়েছে। মাথার ওপরে খোঁপা। পায়ের তলার পুরুষ মূর্তিটির ত্রিনয়ন। মাথায় মুকুট ও কিরীট। একটি হাত মাথার তলায় রাখা। ত্রিনয়ন বলেই শিব হিসেবে সনাক্তকরণ।
পূজারি আমার অনুরোধে দু-তিনবার ঘুরে ঘুরে সব মূর্তিকে বারবার করে চিনিয়ে দেন। মন্দিরের যেখানে রোদ এসে পড়ছে পা রাখা যাচ্ছে না। মধ্যগগনে থাকা সূর্যের তাপ কাপড়ের টুপি ভেদ করে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। তবু অবাক হতে আশ্চর্য হতে কিম্বা বিস্মিত হতে আমার আটকাচ্ছে না একটুও। মন্দিরের মাঝের দেওয়ালের গায়ে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর দণ্ডায়মান দেবীমূর্তিটি আকারে-আয়তনে অন্যান্য মূর্তিগুলির থেকে কিছুটা বড়। দশটি হাত চিরাচরিত দুর্গামূর্তির কথা মনে পড়ায়। মূর্তির পায়ের কাছে চৌকো আকারের শক্তিপীঠ। মাথায় মুকুট ও কিরীট। গলায় অপরূপ সুন্দর একটি হার। রত্নখচিত গোট, বাজুবন্ধ ও নূপূর। গ্রামদেবী হিসেবে এখনও পুজিত হন এই মহামায়া। তাঁর নামেই মন্দিরের স্থানীয় নাম মহামায়া মন্দির ও সংলগ্ন পুকুরটির নাম মহামায়া পুষ্করিণী। তবে পুজোর ঠ্যালায় রঙিন কাপড় আর গাঁদা ফুলের স্তুপের আড়ালে এই দেবী মূর্তিকে দেখা একেবারে অসম্ভব। তাই কৌতূহল রয়েই যায়। মহামায়ার আড়ালে চাপা পড়েছেন দেবী রতিও। কাপড় একটু সরিয়ে সেই মূর্তিটি দেখান পূজারী।
মন্দিরের নিচের অংশের ষাটটি কুঠুরিতে ষাটটি যোগিনী মূর্তি রয়েছে। বাকি চারটি যোগিনী মূর্তি ও চারটি ভৈরব মূর্তির অবস্থান মন্দিরের কেন্দ্রে একটু উঁচুতে অবস্থিত গোলাকার চণ্ডী মণ্ডপ বা যোগিনী মণ্ডপে। বলা হয় কোনও একসময় এই মণ্ডপে নৃত্যরত নটরাজ মূর্তি পূজিত হত। কিন্তু এখন তার কোনও অস্তিত্ব নেই। এরমধ্যে ৬১তম যোগিনী সর্বমঙ্গলার কুঠুরিটি ফাঁকা। এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে।
মন্দিরের বাইরে দরজার দুপাশে দুই দ্বারপাল তো আছেই। ঢোকার গলির দুপাশেও দুটি পুরুষ মূর্তিও রয়েছে। আর মন্দিরের বাইরের গায়ে রয়েছে নয় কাত্যায়ণী। এই পরিচারিকারাও মন্দির রক্ষা করছেন। উচিত ছিল বাইরেটা দেখে নিয়ে ভেতরে ঢোকা। কিন্তু মন্দিরের পাথরগুলো রোদে এমন তেতে ছিল যে প্রায় এক্কাদোক্কা খেলার ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। বারদুয়েক মূর্তি চিনতে চিনতে খালি পা অনেকটাই গরম সয়ে ফেলল। অতএব গলি দিয়ে বেরোতে যাই। পূজারিকে সঙ্গে নিয়েই বেরোই। গলির মধ্যে ভয়ঙ্কর দেখতে পুরুষ মূর্তিদুটি কারা জানতে চাই তাঁর কাছে। আমার বাম হাতে অর্থাৎ ঢোকার সময়ে ডান হাতের মূর্তিটি কাল ভৈরবের। আর অন্যটি বৈকাল ভৈরব। দুজনেরই কঙ্কালসার চেহারা, মাথায় জট পাকানো চুল আর লড়াকু ভঙ্গী। কাল ভৈরবের ডান হাতে একটি কাপালা আর বৈকাল ভৈরবের বাম হাতে একটি নরমুণ্ড। কাল ভৈরবের মূর্তির স্তম্ভমূলে একটি ফুলগাছ, একটি শেয়াল আর কাটারি ও কাপালা হাতে দুজন পরিচারক। বৈকাল ভৈরবের পরিচারক দুজনের মধ্যে একজন রক্তপানে ব্যস্ত আর আরেকজনের দুহাতে দুটি কাপালা। মন্দিরে ঢোকার দরজার দুপাশে দুই পুরুষ দ্বারপাল। দুজনেরই দুই হাত এবং স্তম্ভমূলে পদ্মলতা। দক্ষিণের দ্বারপালের কানে অলংকার। উত্তরের দ্বারপালের একটু মোটাসোটা রাগী চেহারা। বাঁ হাতে একটি কাপালা। এবারে নব কাত্যায়ণীদের দেখি ঠা ঠা রোদ্দুর সইয়ে সইয়ে। হালকা হলুদ রঙের বালিপাথরে মূর্তিগুলি আড়াই থেকে প্রায় তিন ফুট পর্যন্ত লম্বায়। অধিকাংশেরই দুই হাত আর দাঁড়িয়ে রয়েছে ছিন্ন নরমুণ্ডের ওপরে।
ফেরার পথে পিপলির রাস্তার ধারের ঝলমলে রঙিন দোকানগুলি থেকে অ্যাপ্লিকের কাজ করা কয়েকটা ব্যাগ কেনা হল। সবশেষে পৌঁছালাম পটচিত্রশিল্পখ্যাত ছবির মতো গ্রাম রঘুরাজপুরে। তখন মধ্যদুপুর, মা আর ঊর্জা দুজনেই খুব ক্লান্ত। আমরাও কমবেশি। ওরা গাড়িতেই বসে রইল।
রঘুরাজপুর খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে পটচিত্রশিল্পের জন্য খ্যাত। এখানকার শিল্পীরা বংশানুক্রমে এই কাজ করে আসছেন। পাশাপাশি গোতিপুয়া নৃত্যশিল্পের জন্যও এর নাম রয়েছে। যা বর্তমান ওড়িশি নৃত্যের পূর্বসূরী। খ্যাতনামা ওড়িশি নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের জন্মস্থানও। পুরীর থেকে চৌদ্দ কিলোমিটার দূরে মাত্র একশো কুড়ি ঘর বাসিন্দাদের তাল, নারকোল গাছে ঘেরা এই ছোট্ট গ্রামটাতে ঢুকতেই প্রথমেই যেটা পড়ল তা হল রাস্তার দুধারে প্রতিটা বাড়ির বাইরের দেওয়ালে অসাধারণ সব ছবি আঁকা। কোথাও শ্রীকৃষ্ণের জীবন কাহিনির নানান দৃশ্য, কোথাও হনুমান, কোথাও গণেশ, কোথাও বা সুন্দর সুন্দর নকশা। ঢুকলাম একটা বাড়ির ভেতরে।
বাড়ির প্রথম ঘরটাই শিল্পীর স্টুডিয়ো, বেশ বড়ো একটা হলঘর। একটা ছোট গ্রামে, একটা অতি সাধারণ বাড়ির ভেতর যে অসাধারণ সমস্ত চিত্র রয়েছে তা কল্পনার অতীত। শিল্পী এর ইতিহাস, নির্মাণ পদ্ধতি সব জানালেন। পট্ট অর্থাৎ বস্ত্র এবং চিত্র অর্থাৎ ছবি, সোজা কথায় পটচিত্র কাপড়ের ওপর আঁকা ছবি। পুরীতে জগন্নাথদেবের প্রধান দুটো উৎসব হল স্নানযাত্রা এবং রথযাত্রা। স্নানযাত্রার সময় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে একশো আট ঘড়ার জলে স্নান করানো হয়। এর ফলে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তখন তাঁদের দর্শন পাওয়া যায় না। আবার রথযাত্রার সময় তাঁরা মাসির বাড়ি যান, তখনও মন্দিরে থাকেন না। এই সময় সর্বসাধারণের দর্শনের জন্যে জগন্নাথদেবের পরিধেয় বস্ত্রের ওপর তাঁদের তিন ভাই বোনের ছবি আঁকার প্রচলন হয়, কালক্রমে যা পটচিত্র নামে বিখ্যাত হয়।
পটচিত্র আঁকা হয় তসর বা অন্য কোনো কাপড়ে। প্রথমে কাপড়ের টুকরোর ওপর তেঁতুলের বিচির আঠার প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রয়োজনে দুটো কাপড়ের টুকরোকে একসঙ্গে জোড়াও হয়। এরপর শুরু হয় আঁকার কাজ। পটচিত্র আঁকার জন্যে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহৃত হয়, এটাই এর বৈশিষ্ট্য। যেমন শাঁখের গুঁড়ো থেকে সাদা রঙ, কেরোসিন তেলের ল্যাম্পের ওপর টিনের প্লেট রেখে তাতে পড়া কালি থেকে কালো রঙ, তাছাড়া আরও নানা রকম পাথরের গুঁড়ো থেকে অন্যান্য রঙ। শাকসবজি থেকে তৈরি রঙও এঁরা ব্যবহার করেন। পটচিত্রে আঁকার বিষয়বস্তু জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ছাড়াও বিষ্ণুর দশাবতার, রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণের নানান ঘটনা।
পটচিত্রের আকার বিভিন্ন রকমের হয় – কখনো বড়ো, কখনো ছোটো, কখনো বা সরু লম্বা এক ফালি কাপড়। কিন্তু সবক্ষেত্রেই যা চোখ টানে তা হল এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ এবং উজ্জ্বল রঙ। রামায়ণ, মহাভারতের নানান ঘটনা যেন এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে শিল্পীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায়। কাপড়ের ওপর ছাড়াও শুকনো তালপাতার ওপর আঁকা হয়। তালপাতার ওপর প্রধানত কালো কালি দিয়েই আঁকা হয়। এর জন্যে ব্যবহৃত হয় লোহার পেন। শুকনো তালপাতার সরু সরু ফালি সুতো দিয়ে জুড়ে তার ওপর আঁকা হয়, আবার তা ভাঁজে ভাঁজে মুড়েও ফেলা যায়। ছোট্ট ছোট্ট তালপাতার ওপর কী নিখুঁত আঁকা তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বহুকালের পুরোনো পটচিত্রও আজও সমান উজ্জ্বল রয়েছে।
রঘুরাজপুরের হস্তশিল্পের আরো সুন্দর সুন্দর নমুনা আছে। নারকোল ছোবড়া, নারকেলের মালা, সুপুরি প্রভৃতি দিয়ে নানা রকম জিনিস তৈরি করা হয়। সকাল থেকে ঘোরাঘুরি করে দলের বয়স্কতমা ও কণিষ্ঠতমা দুজনই বেশ ক্লান্ত, হাতে সময় কম থাকায় গোটা গ্রাম ঘুরে দেখা হল না। আবার আসিব ফিরে… একথা ভেবে নিজেকে আশ্বস্ত করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।
পরেরদিন সকালে ঊর্জা এবং তার দিদিয়া দুজনেই ঝলমলে জ্বিনপরানো উটের পিঠে চড়ল। আমার পশুপ্রেমী কন্যা উটের মুখ বাঁধা দেখে খুব দুঃখ পাচ্ছিল। প্রশ্ন করে উটওলাদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া গেল যে না হলে উট নাকি কামড়ে দিতে পারে! ভারী আশ্চর্য হলাম আমরা। ইতিমধ্যে লাদাখ আর রাজস্থানে উটের পিঠে আমরা সকলেই চড়েছি। কিন্তু তারা যদি সেখানে না কামড়ায় তাহলে খামোখা এখানে কামড়াবে কেন!!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার –
১) কলিঙ্গের দেবদেউল – নারায়ণ সান্যাল
২) Sixty Four Yogini Temple Hirapur - Suresh Balabataray
'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেছেন। বর্তমানে পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি স্বাধীন গবেষণায় রত। তাঁর সম্পাদনায় বেশ কয়েকটি পুরোনো ও নতুন ভ্রমণকাহিনির বই প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কাজ – আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত - ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গমহিলাদের ভ্রমণকথা (চার খণ্ড)। ভালোবাসেন বই পড়তে, গান শুনতে, লেখালেখি করতে আর বেড়াতে।