উত্তরাখণ্ডে ট্রেক
মৃণাল মণ্ডল
জয়বাবা কেদারনাথ...
কেদারযাত্রার জন্য সোনপ্রয়াগে রেজিস্ট্রেশান করাতে হয়। সেটা আগেই সেরে নিয়েছিলাম। তাই গৌরীকুণ্ডের বাসস্ট্যাণ্ড থেকে যাত্রা শুরু করে দিলাম। যাত্রা শুরু করতেই সাড়ে ন'টা-দশটা বেজে গিয়েছিল। তাই প্রাতরাশটা আমরা গৌরীকুণ্ডেই সারলাম। আগেই বলেছি গোটা রাস্তার দৈর্ঘ্য ১৯ কিলোমিটারের কম বেশি। যা ২০১৩ সালের সেই বন্যার আগে ছিল ১৬ কিলোমিটারের কাছাকাছি। আর রাস্তা আগের তুলনায় অনেক বেশি খাড়াই। আমরা এখানে এসেছি গোমুখ অভিযান সেরে। তাই শরীর কিছুটা ধাতস্হ হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, খরস্রোতা মন্দাকিনীকে ডানদিকে সঙ্গী করে এগিয়ে চললাম ঢালাই করা খাড়াই পথে কেদারনাথ দর্শনে।
এমনিতে গতরাতে বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। আর আজকের দিনটাও মেঘাচ্ছন্ন। থেকে থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে ভারী রেনকোট আছে। আর আছে গঙ্গোত্রী বাজার থেকে কেনা পাতলা বর্ষাতি। কিছুটা ওঠার পরেই বামদিকে খচ্চরের স্ট্যাণ্ড। কেউ যদি মনস্থির করেন যে খচ্চরের পিঠে উঠে কেদার পৌঁছাবেন, তাঁরা এখান থেকে ভাড়া নিতে পারেন। একমুখী বা উভমুখী দুইধরণের যাত্রার জন্যই খচ্চরের ব্যবস্থা আছে এখানে। পাশে বোর্ডে ভাড়ার জন্য সরকারের তরফ থেকে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া আছে। তা নিয়ে যদিও দর কষাকষি চলে। তবে খচ্চর কিন্তু কেদারনাথ বেসক্যাম্প অবধি পৌঁছে দেবে বাকি দেড়-দু কিমি পথ পায়ে হেঁটেই পৌঁছতে হবে। আর হেলিকপ্টারে পৌঁছনোর কথা তো আগেই বলেছি।
এখানে একটা বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার কথা বলে রাখি। গোটা রাস্তাটা বর্ষার কারণে ভিজে আর কাদায় মাখামাখি। তার ওপর পুরো পথ জুড়ে খচ্চরের পটির তীব্র গন্ধ নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল পথের বাঁকে হঠাৎ আগত খচ্চরের বিচিত্র দোদুল্যমান গতি। আমরা যে পায়ে হেঁটেই উঠব সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 'জয় ভোলেনাথ' বলে এগিয়ে চললাম। দলের সদস্যরা আগু-পিছু করে চলতে লাগল। কোনো তাড়া নেই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
খচ্চর স্ট্যাণ্ড পেরিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনা স্বাগত জানাল। সেই জলে হাত-মুখ ধুয়ে এগিয়ে চললাম। একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। যাতে লেখা জঙ্গলচটি দেড় কিমি আর ভৈরব মন্দির আধা কিমি দূরে। তবে এই বোর্ড বন্যার আগে লাগানো নাকি পরে সেটা জানার অবকাশ বা ইচ্ছে কোনোটাই তখন ছিল না। ভৈরবমন্দির পেরিয়ে জঙ্গলচটি পৌঁছতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। আমরা যে বেশ ঢিমে তালেই চলছি সেটা মালুম হল। রাস্তায় ৫০০ মিটারের মতো দূরত্বে পরপর ধার ঘেঁষে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য লোহার বেঞ্চ পাতা। আর প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার পরপর ছাউনি দেওয়া বিশ্রামাগার। তাই অভিযাত্রীদের যে যথেষ্ট খেয়াল রাখার সুবন্দোবস্ত আছে তা বলাই বাহুল্য।
জঙ্গলচটিতে এসে শুনলাম এখানকার দূরত্ব গৌরীকুণ্ড থেকে ৫ কিমি। তাই সাইনবোর্ড নিয়ে আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না তা টের পেলাম। এখানে চা-পান সেরে মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। দুপুরের আহার লিঙচোলিতে সারবো বলে মনস্থির করেছি।
কিছুদূর পরপর একটু করে থেমে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সঙ্গে আমাদের রেশন অর্থাৎ কাজু, কিসমিস, খেজুর ছিল। প্রয়োজনমতো তা একটা দুটো করে খাচ্ছিলাম। আর অল্প জল। ট্রেক করার সময় একসঙ্গে অনেকটা জল একেবারেই খেতে নেই। এভাবেই চলতে চলতে ভিমবালিতে এসে পৌঁছলাম। এখানে বিশ্রামাগার, থাকার ও খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে, গাঢ়োয়াল বিকাশনিগমের উদ্যোগে। কারও যদি বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে কেদারযাত্রার ইচ্ছে থাকে তবে এই সমস্ত জায়গা থাকার জন্য উত্তম। আবার কেউ যদি ভাবেন যে আর হাঁটতে পারছেন না। তবে এখান থেকে প্রিপেড পনি (ঝুড়ির মতো একটা ব্যবস্থা, যার ওপর উঠে বসলে একজন ব্যক্তি পিঠে করে পনি সহ আপনাকে কেদার মন্দির অবধি পৌঁছে দেবে) ভাড়া পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে আপনি তার ভাড়াও পেতে পারেন।
এখান থেকে লিঙচোলি প্রায় পাঁচকিমি। চা-বিস্কুট ও কেক সহযোগে বিশ্রাম সম্পন্ন করে আবার রওনা দিলাম। রাস্তার পাশের মাইলফলক জানান দিল কেদার আর ১১ কিলোমিটার। এই ফলক বন্যার আগের না পরের সেই বিতর্কে আবারও গেলাম না। ভিমবালি পেরিয়ে একটা ছোট্ট ধাতব সেতু পড়ল। তারপর কিছুটা এগোতেই ঢালু পথে কিছুটা নেমে পড়ল মন্দাকিনী ব্রিজ। এখান থেকেই বর্তমানে কেদার যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তিত হয়েছে। আগের রাস্তা ছিল এতক্ষণ যে পাহাড়ের গা বেয়ে হাঁটছিলাম সেই পাহাড় দিয়েই, সোজা পথ, রামওয়াড়া দিয়ে। ২০১৩ সালের ১৬ জুন মন্দাকিনীর সেই বিধ্বংসী ধ্বংসলীলার, আজ যার চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর আর বোল্ডারের ধ্বংসাবশেষরূপে, পরে পরিবর্তিত হয়।
এখনকার রাস্তা মন্দাকিনীর ব্রিজ পেরিয়ে উল্টোদিকের পাহাড় দিয়ে। এখান থেকেই শুরু হচ্ছে প্রকৃত খাড়াই রাস্তা। যা অনেকাংশে সিঁড়ির ধাপের মত খাড়াই ও ধাপকাটাও বটে। হেলতে দুলতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিশ্রাম নিতে নিতে চলছিলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। তার মধ্যে ঢালাই পিছল রাস্তায় চলা খচ্চরের খুর পিছলে যাচ্ছিল। একটা বাঁকে তো এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটল। একটা খচ্চর তার পিঠে সওয়ার হওয়া মধ্যবয়স্কা এক ভদ্রমহিলাকে টাল সামলাতে না পেরে পিঠ থেকে রাস্তায় ফেলে দিল। নিজেও পড়ল পিছলে। ভদ্রমহিলা কোমরে ভীষণ চোট পেলেন। কাছে থাকা লোকজন তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরে তুলল। প্রাথমিক শুশ্রূষা করা হল তাঁর। আর আমরা এটা ভেবে চমকিত হলাম যে খচ্চর যদি একটু এদিক ওদিক পড়ত, তা হলে কী হত! একহাতের মধ্যেই যে খাড়াই পাহাড়ের ঢাল নেমে গিয়েছে নিচে!
আবার হাঁটা শুরু করলাম। কয়েকজনের মুখে শুনলাম আজই নাকি একটা খচ্চর পিছলে খাদে পড়ে গিয়েছে। শিহরিত হলাম। কিন্তু হাঁটা থামালাম না। আর অবশেষে এসে পৌঁছলাম লিঙচোলি। লিঙচোলিতেও থাকা ও খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। এখানে ঘরভাড়া ও টেন্টভাড়া দুইই পাওয়া যায়। জি এম ভি এন-এর কটেজগুলিতে বায়োটয়লেটের (কমোড) ব্যবস্থা আছে। লিঙচোলির উচ্চতা ২৮০০ মিটার। আর এখান থেকে কেদার বেসক্যাম্প ৪ কিমি (যদিও এই দূরত্বের পরিমাপও সন্দেহপ্রকাশের অবকাশ রাখে)।
ঘড়ি জানান দিচ্ছিল বিকেল চারটে পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তাই আমরা কেউ আলুর পরোটা, কেউ ম্যাগি সহযোগে আহার সেরে নিলাম। শেষে আর একপ্রস্থ চা সেবন করে আবার আমরা গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা দিলাম। বিকেল যত শেষ হচ্ছে আলো তত কমবে আর ঠান্ডা একটু একটু করে বাড়বে। তাই এবার একটু গা-ঝাড়া দিয়ে চলতে শুরু করলাম। দূরে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে কেদারপর্বত হাতছানি দিয়ে ডাকতে শুরু করল।
এরপরের পথও চড়াই। সেই চড়াই বেয়ে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে এগোতে থাকলাম। সূর্য অস্ত গিয়েছে অনেক আগেই। একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন ফেলে আসা পথের দিকে চাইলাম তখন মনে হল সত্যিই পর্বতারোহী হয়েছি। সে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। দুই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঠে আসছে পেঁজা তুলো মেঘ, যেন আমাদের অনুসরণ করে। ক্যামেরার লেন্সবন্দি হল সেই দৃশ্য। ধীরে ধীরে মেঘ আমাদের ধরে ফেলল। আর পনেরো কুড়ি মিনিট ধরে মুষলধারায় বৃষ্টি দিয়ে গেল। আকাশ আবার গাঢ় নীল হল। বাতাসে ভিজে হিমেল ভাব ছড়িয়ে পড়লো। আর প্রকৃতি ঢেলে দিল তার রূপের পসরা। আমাদের দৃষ্টিসুখের পরিতৃপ্তি দেওয়ার অভিলাষে। দিনের আলো দ্রুত কমে আসতে লাগল। আর পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল ঠান্ডা। আমরাও এগোতে থাকলাম তার সঙ্গে।
রাখীর অনেকদিনের সাধ নাকি প্রচুর বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে বরফ হাতে ধরার। অসীমা আর আমার সে অভিজ্ঞতা হয়েছে বহুবার। মনে পড়ে যেবার (২০১৬ সালে) দিব্যেন্দুদের সঙ্গে সিল্ক রুট গিয়েছিলাম, সেবার জুলুকের ওপরের দিকে থাম্বি ভিউ পয়েন্ট পেরোতেই তীব্র তুষার ঝড় শুরু হয়। আরও ১ কিমি যাওয়ার পর শুরু হয় তীব্র তুষারপাত। এত তুষারপাত শুরু হয় যে গোটা রাস্তা বরফে ঢেকে যায়। গাড়ি আর সামনে এগোনোর উপায় থাকে না। সবাই (দিব্যেন্দু, নিপা, দেবাঞ্জন, রিয়া, রতন আর মৌসুমি ছিল অসীমা আর আমার সঙ্গে) গাড়ি থেকে নেমে পড়ি ওই তীব্র তুষারপাতের মধ্যে। প্রত্যেকের পায়ে ভাড়া করা গামবুট। নেমে দেখি চারিদিক অস্পষ্ট ৩০-৪০ মিটার দূরের পর আর দেখা যাচ্ছে না কিচ্ছু। শুধু সাদা আর সাদা। পাশের পাহাড় গুঁড়ো বরফে ঢেকে। আমাদের পাও প্রায় গোড়ালি অবধি বয়ফে ঢুকে। গাড়ির চাকায় শেকল পরানোর চেষ্টা হল কিছুক্ষণ যাতে গাড়ির চাকা আর একটু গ্রিপ পায়। আর আমরা এগোতে পারি। কিন্তু গাড়ি আর এগোতে পারেনি। তাই আমরা ওই বরফের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে মজা করে আবার ফিরে গিয়েছিলাম নিচে সোজা রংলি। সেই অভিযানের অভিজ্ঞতাও পরে সময় পেলে একদিন বলব। যাই হোক রাখীর আশা পূর্ণ হল। রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট হিমবাহ পাওয়া গেল। আর উপরি পাওনা একটা ঝরনা। খানিকক্ষণ সেই হিমবাহ ও ঝরনার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। তারপর আবার এগিয়ে চললাম।
সন্ধ্যা নামল। সেই সঙ্গে বাড়ল ঠান্ডার প্রকোপ। ঠান্ডার জন্যই ক্লান্তি আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হল। সোমাঞ্জন ও অতনু স্রেফ মনের জোরেই এগিয়ে চলতে লাগল। কোনও প্রশংসায় তাই ওদের জন্য কম হত। অন্ধকার গাঢ় হল। আর রাস্তার পাশের টিমটিমে আলো জ্বলে উঠল। সেই হাল্কা আলো অপ্রতুল ছিল। তাই টর্চ জ্বালালাম। কিন্তু মনে হল টর্চ না জ্বালিয়ে হাঁটাটাই ভালো হবে। তাই টর্চ নিভিয়ে হাঁটতে লাগলাম। ধীরে ধীরে অন্ধকারে চোখও অভ্যস্ত হয়ে উঠল। পথে এমন দুটো জায়গাও পেরোলাম যেখানে হিমবাহ কেটে মাঝের রাস্তা চলার যোগ্য করা হয়েছে। সেখান দিয়ে পেরোনোর সময় পাশে বরফের দেয়ালের উপস্থিতি অনুভব করলাম হাতের স্পর্শে। রাস্তা ভীষণই পিচ্ছিল ও জায়গায় জায়গায় কর্দমাক্ত। সেসব বাধা তখন ক্লান্তির কাছে তুচ্ছ।
যাই হোক একটা ঝরনা পেরিয়ে একটা বাঁক ঘুরলাম। আবার খানিকটা চড়াই। আবার একটা বাঁক। আলো ঝলমলে কেদার বেসক্যাম্প দেখা যাচ্ছিল। সবাই মনকে এই আশা দিচ্ছিলাম যে আর তো মাত্র একটুখানি যেতে হবে। সেই একটুখানি পথও আমরা পেরিয়ে অবশেষে কেদার বেসক্যাম্পে উপস্থিত হলাম। তখন ঘড়ির কাঁটা রাত আটটা ছুঁইছুঁই। পাঁচ মিনিটও বিশ্রাম নিইনি সন্দীপদা একটা প্রস্তাব দিল, 'চল এখানে না, কেদারে গিয়েই বিশ্রাম নেব।' সবাই তখন ক্লান্ত, অবসন্ন। কিন্তু সন্দীপদার প্রস্তাবের কাছে হার মানল। আবার হাঁটা শুরু করলাম। অর্থাৎ আরও দেড়-দুকিমি পথ পাড়ি দিতে হবে। শুধু এবারের পথ ততটা চড়াই নয় এটাই যা রক্ষে।
অবশেষে যখন আমরা কেদার পৌঁছলাম তখন রাত নটা। প্রচণ্ড ঠান্ডা তখন। সেই সঙ্গে তুমুল হাওয়ার দাপট। বাকিদের একসঙ্গে এক জায়গায় বিশ্রাম নিতে বলে আমি আর সন্দীপদা এগোলাম টেন্ট বুকিং করতে। এখানে বলে রাখি কেদার মন্দিরের থেকে তিনশো-চারশো মিটার দূরে উঁচু একটা সমতলের ওপর এই জায়গাটা - কয়েকশো ছোট বড় টেন্ট খাটানো। প্রতিটাতে ছয় থেকে বারোজন করে থাকার ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে পাওয়া যায় বালিশ, স্লিপিং ব্যাগ ও কম্বল। আর টেন্টের তলায় পাতা থাকে মোটা ফোম। যাতে তলা থেকে ভেজা মাটির স্পর্শ না পাওয়া যায়। আর বাথরুম বলতে বাইরে অস্হায়ী কমন টয়লেট। সবই প্রিপেড সিস্টেমে ভাড়া করতে হয় নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে। এছাড়াও অন্য ব্যবস্থাও আছে। সেটা মন্দিরের আর একটু কাছাকাছি। হেলিপ্যাডের কাছাকাছি জি এম ভি এন-এর ছোটো ছোটো একতলা বা দুতলা কাঠের কটেজ আছে। তবে সংখ্যায় অপ্রতুল। আর সেগুলোকে অনলাইন বা আগে থেকে ভাড়া করে রাখতে হয়।
যাই হোক, বুকিং-এর জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি সেখানে দীর্ঘ লাইন পড়েছে। আর সেই সঙ্গে বিশাল জটলা। কথাকাটাকাটি ধাক্কাধাক্কি বেলাইন লাইনভাঙা সবই চলছে পুরোদমে। আমি আর সন্দীপদা দুটো আলাদা লাইনে দাঁড়ালাম। এখানে বলে রাখি, বুকিং-এর জন্য পরিচয়পত্র লাগে। আমরা ভোটারকার্ড বের করে লাইনে দাঁড়ালাম। লাইন যেন আর এগোতেই চায় না। তার উপর বেনিয়ম চলছিলই। বারংবার অভিযোগও হচ্ছিল। সেইসঙ্গে চলছিল লাইনের অসংলগ্নতার জন্য তুমুল ঝগড়াঝাটি। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হলেন বুকিং নেওয়া বন্ধ করতে। কিছুতেই তারা আর বুকিং নেবেন না। শেষে কয়েকজন মিলে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা রফাসূত্র বেরোল। আগে ভোটারকার্ড জমা দেওয়া হল। সেই সুযোগে একটু এগোনোও গেল মধ্যস্থতাকারী হিসাবে। তারপর ভোটারকার্ড ধরে নাম ডাকার পর বুকিং হয়ে গেল আটজনের একটা টেন্টে। মিলল কুপন। টেন্টের নাম্বার দেওয়া। ইতিমধ্যে সোমাঞ্জন এসে উপস্থিত সেখানে। ভাইয়ের প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। খাওয়ার জায়গায় কুপন কেটে খেতে হয়। মেলে হাতরুটি, পুরি আর দুইরকম ডালসহ ছয়রকম তরকারি। পছন্দ করে নির্দিষ্ট দাম দিয়ে কুপন কাটতে হয়। মেলে খাবার। সোমাঞ্জন আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে খেয়ে নিল এর মধ্যেই। আমাদের সঙ্গী অভিজিৎদাও সুযোগ পেয়ে এক ফাঁকে খেয়ে নিয়ে কোথায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। সন্দীপদা, আমি আর সোমঞ্জন মিলে ভাগাভাগি করে নির্দিষ্ট ঘর থেকে স্লিপিং ব্যাগ, কম্বল আর বালিশ সংগ্রহ করে অতনুদের উদ্দেশ্যে এগোলাম। অতনু, অসীমা, রাখী একজায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা একসঙ্গে হলাম। অভিজিৎদা তখনও বেপাত্তা। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে ওই আধো আলোতে আমরা এবার নির্দিষ্ট টেন্ট খুঁজতে লেগে গেলাম। অবশেষে কুপনের নম্বর মিলিয়ে টেন্ট খুঁজে পেলাম।
এবার উপস্থিত হল আরেক বিপত্তি। আমাদের ভাড়া করা টেন্টে অন্য লোক শুয়ে আছে। তারা মোট দশজন। আটজন দিব্যি গুছিয়ে শুয়ে আছে। পিছনের দিকের দুজন শুয়ে শুয়ে মোবাইলে মুভি দেখছে। প্রথমে বললাম যে এটা তাদের তাঁবু নয়। তাদের কুপনের নম্বর দেখাতে বললাম। কিন্তু কারও কোনও হেলদোল নেই। তারা দিব্যি কানে তুলো গুঁজে শুয়েই রইল। একজন শুয়ে শুয়েই কথা বলছিল। তার সঙ্গেই বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি চলল। কিন্তু তারা ওঠার কোনও উদ্যমই দেখাল না। প্রচণ্ড ঠান্ডায় হতোদ্যম হয়ে পড়ছিলাম। তাই আর তর্ক না করে সোমাঞ্জন আর আমি আবার বুকিং কাউন্টারে গেলাম। সেখান থেকে বহু কষ্টে একজনকে ডেকে নিয়ে এসে আর একবার চেষ্টা করা হল অনুপ্রবেশকারীদের ওঠানোর। কিন্তু সে চেষ্টাও বিফল হল। তখন পাশের একটা ফাঁকা টেন্টে আমাদের নতুন করে বন্দোবস্ত করে দেওয়া হল। নতুন টেন্টটা যদিও আগের টেন্টের থেকে নিচু তবুও আর তর্ক বাড়ালাম না। অন্য আরেকটা ফাঁকা টেন্ট থেকে আর একটা ফোম জোগাড় করে আনলাম মেঝেতে পাতার জন্য। তারপর শুরু হল জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার পালা। অভিজিৎদার তখনও দেখা নেই।
এবার আমি মেজাজ হারালাম আর খানিক চোটপাট করে শান্ত হলাম। পরে বুঝেছিলাম এটা বড় ভুল হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় এত ঝক্কি আর পরপর এতগুলো পরিস্থিতিবিমুখ ঘটনা পরপর সামলাতে হওয়ায় হয়তো আবেগবশত বেরিয়ে এসেছিল সেই অভিব্যক্তি। যদিও সহযাত্রীদের কেউ তখন বা পরে এই নিয়ে কোনও অভিযোগ করেনি। কিন্তু আজও আমার মনে হয় ওই আচরণের কোনও প্রয়োজন ছিল না। আজ ওই দিনের ভুল স্বীকার করে নিলাম। আর আমার সহযাত্রীদের ধন্যবাদ জানাই সেদিনের ওই ব্যবহারের পরেও আমাকে কোনও কথা না বলে সহ্য করার জন্য।
আবার কেদারের কথায় ফিরি। অভিজিৎদার দেখা মিলল অবশেষে। সোমাঞ্জন আর অভিজিৎদাকে রেখে আমি, অসীমা, অতনু, রাখী, সন্দীপদা আর অনসূয়া খেতে চলে গেলাম। সবাই পুরির জন্য কুপন কাটলাম। তার সাথে আলুর দম আর ছোলার তরকারি। এক প্লেট পনির মাসালাও চেখে দেখা হল। প্রসঙ্গত বলে রাখি এখানের সব খাবারই নিরামিষ। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা ঢালের দিকে একটু এগিয়ে দূর থেকে মন্দির দর্শন করলাম। সে এক মোহময়ী পরিবেশ। সমগ্র মন্দির চত্বর জুড়ে আলো আঁধারি খেলা। মন্দিরের গায়ের আলোর চেন যেন মন্দিরের গয়না। আর মন্দিরগাত্রের বিভিন্ন মূর্তিতে সার্চলাইট পড়ে সে এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। পিছনের দিকে অন্ধকারেও তুষারশুভ্র কৈলাসপর্বত যেন মহাদেবের হাসির মত উদ্ভাস সৃষ্টি করেছে। সে এক শিহরণ জাগানো সৌন্দর্য, যার কাছে যেকোনও উপমাই কম বলে মনে হয়।
ফিরে এলাম তাঁবুতে। অল্প কিছু গোছানো সেরে যে যার স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলাম। পুরুলিয়া অভিযানে অসীমা আর আমি জঙ্গলে রাত কাটিয়েছিলাম। তাঁবুতে আর স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে। তাই আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। তাই অন্যদের (বিশেষ করে সন্দীপদাকে) একটু সাহায্য করলাম সেটা কেমনভাবে ব্যবহার করতে হয় বলে। পরবর্তীকালে আবার ফোকতে-দারা অভিযানে আবার স্লিপিং ব্যাগ আর তাঁবু ব্যবহার করেছিলাম।
দু-চার কথা বলতে বলতে সবাই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম। তার অন্যতম কারণ ক্লান্তি। আর ছিল বাইরে তীব্র ঠান্ডা। কত তা মাপার উপায় ছিল না। কিন্তু তা যে মাইনাসের দিকে অনেকটাই সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল হয়ে গেছে। ভোরে উঠতে পারিনি আর। সকালের কাজ সেরে সবকিছু সঙ্গে নিয়ে আমরা মন্দিরের দিকে রওনা দিলাম। রাতের নিস্তব্ধ মন্দির তখন জনকোলাহলে গমগম করছে। আর পুজো দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন হেলিপ্যাড অবধি চলে গিয়েছে। তাই পুজো দেবনা এটা স্থির করে এগোলাম। কারণ আজই আবার নিচে নেমে চোপতার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
পঞ্চকেদারের প্রতিটি শিবমন্দির সম্ভবত একই আদলের। কারণ তিন কেদার (কেদারনাথ, তুঙ্গনাথ ও মদমহেশ্বর) আমরা অভিযান করেছি। সব মন্দিরই বহিরঙ্গে একই। পার্থক্য শুধু ভোলেবাবার রূপে। যে কথা আমি প্রথম পর্বেই উল্লেখ করেছি।
কপালে থাকলে আর আটকায় কে! হঠাৎ একজন পুরোহিত মশাই কোথা থেকে যেন আবির্ভূত হলেন। আর শুদ্ধ বাংলায় আলাপচারি শুরু করলেন। তাঁরই বদান্যতায় আর অনুগ্রহে পুজো দেওয়ার সুযোগও জুটে গেল। সবার হয়ে অসীমা আর রাখী পুজো দিতে গেল তাঁর সঙ্গে, ঘুরপথে। ওরা পুজো দিতে যাওয়ায় আমরাও ফোটোগ্রাফিতে মন দিলাম। আমার মোবাইল ও ক্যামেরা একসঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিভিন্ন স্মৃতি লেন্সবন্দি করতে। বিভিন্ন দিক থেকে মন্দিরের যত ইচ্ছা ছবি তুললাম। অন্যরা বেশি সেল্ফি তোলায় মন দিল। নিজের ছবির থেকে সামনের ছবি বেশি আকর্ষণীয় মনে হয় আমার। চারপাশের পরিবেশকে ধরে রাখার কাজে মনোনিবেশ করলাম। অসীমা আর রাখী ফিরে এলে পুজোর সামগ্রী গুছিয়ে নেওয়া হল। ওদেরও বেশ কিছু ছবি তোলা হল। তারপর মন্দিরের চারপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। মন্দিরের পিছনেই সেই বিশালাকার পাথরের চাঁই, এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। যে পাথর গড়িয়ে এসে এমন অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে যায় যে হড়পা বান-এর ফলে ফুঁসতে থাকা মন্দাকিনীর বিপুল জলরাশি দুটি ধারায় ভাগ হয়ে মন্দিরের গা ঘেঁষে দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। মন্দিরের ক্ষতি হয় যৎসামান্যই। মন্দির-সংলগ্ন বাকি সবকিছুই জলস্রোতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। সবাই এইভাবে মন্দিরের বেঁচে যাওয়ার ঘটনাকে অলৌকিক বলে মানে। আর বলে এ স্বয়ং মহাদেবের লীলা।
বেলা এগারোটা নাগাদ ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করলাম। লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত নামা যায়। তাই ভোলেনাথকে স্মরণ করে আমরা তাড়াতাড়ি নামতে শুরু করলাম। পথে সেই হিমবাহ, সেই ঝরনা সবার সঙ্গে আবার দেখা হল। একে একে সবাইকে বিদায় জানিয়ে হুড়মুড়িয়ে নামতে লাগলাম। আমার নামার গতি অত্যন্ত বেশি। সন্দীপদারও তাই। অনসূয়াও সমান তালে চলল। পুরো দলটা একটু ভেঙে ভেঙে নিজেদের গতি অনুযায়ী নামতে লাগল। পথে আরও একপশলা বৃষ্টি হল। আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি তো যখন তখন হচ্ছিল। আমি আর অসীমা নিজেদের মত করে শর্টকাট নিচ্ছিলাম। আর আমাদের দেখাদেখি শর্টকাট নিতে গিয়ে অতনু একটা বড় বিপদ ঘটাল। স্লিপ করে গড়িয়ে পড়ল। তারপর একটা পাথরের গায়ে গিয়ে আটকে গেল। হাত-পা খানিকটা ছড়ে গেল। বিপদ আরও বড় হতে পারত। কিন্তু হয়নি। ওর বিখ্যাত ভুঁড়িই এযাত্রায় বাঁচিয়ে দিল ওকে। ঘটনাটার উল্লেখ করে অতনু আজও নিজের ভুঁড়ির গুণগান করে।
আর একটু নেমে একজায়গায় একটা পরিচ্ছন্ন বায়োটয়লেট পেয়ে কয়েকজন শান্তিতে প্রাতঃকৃত্য সেরে নিলাম। তারপর ওই চত্ত্বরের দোকানেই আবার মধ্যাহ্নভোজন সারা হল। অর্থাৎ উদর খালি ও পূর্তি সম্পন্ন করে আবার নামতে লাগলাম। খুব সহজেই গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে গেলাম। উঠতে যেখানে এগারো ঘন্টার কাছাকাছি লেগেছিল, সেই পথ নামতে আমাদের লাগল সাড়ে তিন ঘন্টার কমবেশি। এর থেকেই কেদারের পথ কতটা খাড়াই তা সহজেই অনুমেয়। যদিও পরবর্তী উত্তরাখণ্ড অভিযানে মদমহেশ্বরের পথ এর থেকেও খাড়া বলে মনে হয়েছিল। সেটা দুবছরের সময়ের পার্থক্যের জন্য মনের ভুল কিনা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারব না।
গৌরীকুণ্ডে আরেকপ্রস্থ আহার সেরে টাটাসুমো চেপে সোনপ্রয়াগে ফিরলাম। সেখানে মোমিন অপেক্ষা করছিলেন আমাদের গাড়ি নিয়ে। চা পর্ব সেরে আমরা গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি রওনা দিল সঙ্গে সঙ্গেই। আর এক অভিযানের উদ্দেশ্যে।
~ সমাপ্ত ~
হাওড়া জেলার অঙ্কুরহাটি কিবরিয়া গাজি ঊচ্চবিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক মৃণাল মণ্ডলের নেশা ভ্রমণ, খেলাধূলা ও সাহিত্য চর্চা।