--> :: Amader Chhuti : :স্মৃতির ভ্রমণ

বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য এবার পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পত্রিকার পাতায়।

 

[ব্রজেন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনন্দিনী দে-র কন্যা সরোজনলিনীর (৯ অক্টোবর ১৮৮৭- ১৯ জানুয়ারি ১৯২৪) জন্ম হুগলি জেলায়। লেখাপড়া বাড়িতেই শিখেছেন। খেলাধুলা এবং সংগীতচর্চায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ১৯০৫ সালে ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহোত্তর জীবনে বিভিন্ন সামাজিক এবং জাতীয়তাবাদী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। মেয়েদের মধ্যে পরদাপ্রথার অবসানের চেষ্টাঙ্করে গেছেন আজীবন। চরকা আন্দোলনের একজন অন্যতম কর্মী ছিলেন। সারা জীবনে বিভিন্ন নারী সমিতি নিজেও গঠন করেছেন এবং বিভিন্ন নারী সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারী উন্নয়নমূলক কাজ করে গেছেন। তাঁর বহুমুখী জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি সরকারের থেকে এম. বি. ই. উপাধি লাভ করেন। 'সরোজনলিনী মহিলা সমিতি ও শিক্ষামন্দির' অকালপ্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতিতে নামাঙ্কিত এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন গুরুসদয় দত্ত। স্বামীর সঙ্গে তিনি জাপান ও বিলাত ভ্রমণ করেন। 'জাপানে বঙ্গনারী' প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯২৮ সালে। তাঁর বিলাত ভ্রমণকাহিনি পুর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হয়নি। লেখাটির ছোট্ট একটি অংশ প্রকাশিত হয়েছিল মাঘ ১৩৪৬-এর বঙ্গলক্ষ্মী পত্রিকাতে।]


বিলাতে ক'দিন*

সরোজনলিনী দত্ত

৭ই জানুয়ারী ১৯২০। সকালে উঠে স্নান করলুম; তারপর কাপড় পরে প্রাতরাশের পর আমরা হেঁটে "কেনসিংটন গার্ডেনে" গেলুম; বস্তা (সরোজনলিনীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা) তার কলেজে গেল। আমরা হেঁটে Lyceum Club পর্য্যন্ত গেলুম, সেখানে মিস মেটা আমার ছাতাটা এনে পোর্টারের (ক্লাবের চাকর) কাছে রেখে গেছে, লিখেছে, আমি সেদিন তার বাড়ী চা খেতে গিয়ে ছাতাটা ফেলে এসেছিলুম। আমি একখানা ঢাকাই সাড়ী পোর্টারের কাছে রেখে এলুম মিসেস টাটাকে দেবার জন্য। তারপর সেখানেই ক্লাবে ভর্ত্তি করবার কি-কি নিয়ম, তাই দেখলুম। পরে ব্রম্পটন রোড্‌ হয়ে হেঁটে বাড়ী এলুম।
লাঞ্চ খেয়ে বসবার ঘরে আগুন জ্বালিয়ে বসে ইতিহাস পড়লুম। তাতে "ইজিপ্ট"এর প্রাচীন সভ্যতার কথা আছে। উনি বুঝিয়ে দিলেন। বেলা ৪টা পর্য্যন্ত পড়ার পর চা খেয়ে আমরা "হাউস্‌ ডেকরেশন একজিবিশন্‌" (গৃহসজ্জা-প্রদর্শনী) দেখতে গেলুম। হোয়াইট চ্যাপেল আর্ট গ্যালারীতে এই প্রদর্শনীটা দেখবার মত। বিশেষভাবে গরীব লোকদের অল্প পয়সাতে কেমন সুন্দর করে ঘর সাজান যায়, আর কি রকম বাসন ইত্যাদি ব্যবহার করলে কম পয়সায় ভাল জিনিস পাওয়া যায়, তাও দেখিয়েছে। এটা দেখে আমরা আবার ভূগর্ভ পথ দিয়ে বাড়ী এলুম। দেখলুম বস্তা ফিরেছে। সবাই ডিনার খেতে বসলুম। বাবার, ডলির ও দিদির চিঠি এলো; বাবার চিঠি বস্তার চিঠির মধ্যেই ছিল, সেজন্য আসতে দেরি হয়েছিল। আমরা জ্যোতিষের চিঠি কালই পেয়েছি। "কুক্‌"রা (টমাস্‌ কুক কোম্পানী) বস্তার চিঠি বড় দেরিতে পাঠায়।
পরদিন সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। স্নানাদি সেরে ব্রেকফাষ্ট খেয়ে বেরুলুম। বস্তাকে ভূগর্ভ-রেল ষ্টেসন পর্য্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমরা ব্রম্পটন রোড্‌এ কিছু জিনিষপত্র কিনলুম। তারপর হেঁটে নাইটস্‌ ব্রিজ হয়ে কেন্‌সিংটন পার্ক দিয়ে গ্লচেষ্টার রোড্‌ হয়ে জুতার দোকান ও পশমের দোকান হয়ে বাড়ী ফিরলুম।
এসে লাঞ্চ খেয়ে একটু পড়লুম। সাড়ে তিনটায় ভূগর্ভ-রেল ধরে বেরন্‌স্‌ কোর্টএ নাবলুম। সেখান থেকে হেঁটে মিস লিসের বাড়ী চা খেতে গেলুম।
মিস লিস বেশ বাড়ীতে আছেন, ওঁদের নিজেদেরই বাড়ী। ওঁর অন্য অবিবাহিতা বোন আর তিনি একাই থাকেন। মিসেস এমারসন, ওঁর ছোট বোন, ওঁদের সঙ্গে থাকেন না। তিনি একটু পরে আসবেন বলেছিলেন। মিস লিস অনেক কথাবার্ত্তা বল্লেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন; চা খাওয়ালেন।
তিনি বল্লেন যে বিলিতি মেমরা ভারতবর্ষে গিয়ে সে-দেশের ভাষা শিখতে চেষ্টা করে না, এটা বড় দুঃখের বিষয়। এমনি নানারকম কথা হোল। সিউড়ীর পিতল ও কাঠের পাত্র ওঁদের ঘরে সাজান রয়েছে দেখলুম। পাঁচটার সময় মিসেস এমারসন এলেন; তিনি ক্রম্‌ওয়েল রোড্‌ এ থাকেন। সেটা আমাদের হোটেলের মতই একটা ছোট হোটেল। মিসেস এমারসন বুধবারে আমাদিকে তাঁর বাড়ী চা খেতে যেতে বললেন। তাঁর সঙ্গে অনেক গল্প করলুম।
এমারসনের এক ছেলে, সে স্যাণ্ডহার্টস্‌এ পড়ে; ভারতীয় সেনাদলে আসছে বছর যোগ দেবে। এখন ছেলের বয়স ঊনিশ বছর।
আমরা ৬টার সময় এখান থেকে বিদায় নিলুম। মিসেস এমারসন আগেই চলে গিয়েছিলেন। এমারসন ঢাকার কমিসনার হবেন ও লিস বোর্ডের মেম্বর হবেন – মিস লিস বল্লেন।
বাড়ী এসে দেখলুম বস্তা ফিরে এসেছে। তখনো ডিনারের ঘন্টা হয় নি। একটু গল্প করা গেল।
৯ই তারিখে কলেজ নাই, সেজন্য আমরা তিনজনে হেঁটে গ্লচেষ্টার রোড্‌ হয়ে কেন্‌সিংটন পার্কে বেড়াতে গেলুম। সেখান থেকে পশমের দোকানে কোটের গলার কাছে একটা চেন লাগিয়ে জুতোর দোকান থেকে জুতো নিয়ে বাড়ী এলুম। এসেই আমরা সবাই দেশের মেলের জন্য চিঠি লিখলুম। আমি হেমতাকে ও জ্যোতিষকে লিখলুম, তারপর লাঞ্চ খেয়ে কিছুক্ষণ শেলাই করলুম। বস্তাও বসে তার পড়া তৈরী করলে।
চারটায় চা খেয়ে উনি ওঁর কেম্‌ব্রিজের কলেজের সহপাঠী একজন বন্ধু Mr Dines এর বাড়ী গেলেন। বন্ধুটি মিটিরিয়োলজি অফিসে কাজ করেন। তিনি ওঁকে বলেছেন যে এ বছর শীতটা খুব শুষ্ক হবে, বেশী বৃষ্টি হবে না। আমরা আর বেরুলুম না, বড় ঠান্ডা ছিল। তাছাড়া বস্তা পড়তে চাইলে, আমারও কুঁড়েমি লাগল। উনি সাতটার সময় ফিরে এলেন।

* সরোজনলিনীর লিখিত বিলাত-ভ্রমণের দিনলিপি হইতে।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি আর্কাইভ]

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher