তপস্বীর নির্জনতায় ব্রহ্মতাল
সুদীপ্ত দত্ত
অনিশ্চয়তার কুয়াশা
ট্রেকের প্ল্যান তো কতই হয়, কিন্তু তার কটাই বা আর যেতে পারি! ব্রহ্মতালের পরিকল্পনাটাও হয়েছিল প্রায় ছ'মাস আগে, তখন হিসেবে প্রায় জনা ছয়েকের টিম। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহেই নেতাজি জয়ন্তী আর প্রজাতন্ত্র দিবসের ছুটি মিলিয়ে একটা লম্বা ছুটিকে কি আর উপেক্ষা করা যায়? কিন্তু চার মাস আগে যখন টিকিট কাটা হল তখন দলে মাত্র তিন! আর যাওয়ার দিন পনের আগে 'রইল বাকি দুই', আমি আর মানিক। তা হোক, কিন্তু আমাদের এই ট্রেকে যাওয়া চাই-ই চাই। সময় যত এগিয়ে আসতে থাকল, সমস্যা যেন সেই অনুপাতে বাড়তেই থাকল। হঠাৎই দেখি আমাদের গাইড ফোন ধরছে না। এদিকে যাত্রার মাত্র সাতদিন বাকি। দেব আমার পূর্বপরিচিত গাইড, ওর তত্ত্বাবধানে বছর পাঁচেক আগে আমরা রন্টি স্যাডেলের পথে পাড়ি দিয়েছিলাম। ওকে যতটুকু চিনেছিলাম তাতে অন্তত দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মনে হয়নি। সৌভাগ্যবশত দেবের ভাই আনন্দের ফোন নম্বরও আমার কাছেই ছিল। ওর কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে দেবের ছোট্ট ছেলেটা স্কুল থেকে ফেরার পথে বাস অ্যাক্সিডেন্টে গুরুতর জখম হয়ে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে ভর্তি। আনন্দই আমাদের জন্য অন্য এক ট্রেক ম্যানেজারের ব্যবস্থা করে দিল। দেবের 'বিশেষ বন্ধু' মহেন্দর একেবারে অপরিচিত নয়, রন্টি স্যাডেলের পথে আলাপ হয়েছিল ওঁর সঙ্গে। সেই স্বল্প পরিচয়ের ওপরেই ভরসা রেখে আমরা যাত্রা শুরু করলাম।
'এই পথ যদি না শেষ হয়'
লোকাল ট্রেনের মতো প্রায় 'অলস্টপ' বাঘ 'এক্সপ্রেসে' চড়া মানে আসলে ধৈর্যের পরীক্ষা। রাতে হাওড়া থেকে ছেড়ে রাইট টাইমে চলা ট্রেন পরদিন দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়ালেও বিহারের নাগাল এড়াতে পারে না! ট্রেনের জানলা দিয়ে ধূ ধূ মাঠ দেখতে দেখতে এক এক সময় একঘেয়ে ভাব এসে যায়। সময় কাটানোর জন্য সহযাত্রীদের সাথে আলাপ জমানোই সবচেয়ে ভালো উপায়। ব্রহ্মতালের পথে চলা আরেক ট্রেকারের সঙ্গে আলাপ হল, ওদের দলের সবাই বাঙালি। দলের পরিচালক সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের মাধ্যমে তৈরি করেছেন এই ট্রেকিং টিম। অধিকাংশই অ্যামেচার ট্রেকার, কিন্তু উৎসাহের কিছু কমতি নেই। অগুনতি স্টপেজে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই পেরিয়ে গেল আরও একটা রাত। সকালের সূর্যের লাল আভায় যেন নতুন করে উৎসাহ দিয়ে গেল। ট্রেন তখন 'বিফোর টাইম' চলছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই 'ট্রেন যন্ত্রণা' থেকে মুক্তি পেতে চলেছি। সময়ের আগেই আমরা কাঠগোদাম পৌঁছে গেলাম। উত্তরাখণ্ডের এই স্টেশনটার অনন্য সৌন্দর্যই এর বিশেষত্ব। তিনদিক পাহাড়ে ঘেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেলস্টেশনের সঙ্গে আমাদের দেশের খুব কম স্টেশনেরই তুলনা করা যায়।
আমাদের যেতে হবে অনেক দূর, সেই লোহাজং। তাই সময় নষ্ট না করে কাঠগোদাম থেকে নেমেই একটা শেয়ার গাড়ি জোগাড় করে ফেললাম। আপাততঃ যেতে পারব 'গরুড়' পর্যন্ত। পথে এল ভীমতাল, এ তল্লাটের সবচেয়ে বড় লেক। আর কিছুটা এগোতেই গোলা নদীকে পাশে রেখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি পথে।
কিন্তু না খেয়ে দেয়ে তো আর বেশিদূর চলা যায় না, তাই একটা রোডসাইড ধাবায় ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ সেরে নিলাম। এটা নামেই রেস্টুরেন্ট আসলে একটা ছাউনি দেওয়া দোকান। তবে সামনে বেশ কিছুটা পাথরবাঁধানো উঠোন থাকায় খোলা আকাশের নিচে চেয়ার পেতে বসার সুযোগ রয়েছে। তবে এই 'রেস্টুরেন্ট' থেকে নিচের ছবিটা দেখলে মন ভরে যায়। সেখানে ধাপ কাটা চাষের জমি আর সবুজ পাহাড়ের সারি একসঙ্গে জুটি বেঁধেছে। ধাবায় কিছু খাবার খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম।
আলমোড়ার ট্রাফিক জ্যাম এড়ানোর জন্য গাড়ি রানিখেতের তুলনামূলক নিরিবিলি পথ বেছে নিল। আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে হঠাৎই দূরে বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়ের চূড়া ধরা পড়ল। আমাদের ভাড়া করা অল্টো গাড়িটা বেশ পুরোনো তাই গ্রামের মেঠো রাস্তাই হোক বা হাইওয়ে, পেছন থেকে আসা সমস্ত গাড়িকেই নির্বিবাদে পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে গরুড় পৌঁছতে পৌঁছতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। একে রবিবার, তার ওপরে বেলাশেষে 'প্যাসেঞ্জার' পাওয়া দুষ্কর, তাই পরের রাস্তায় শেয়ার গাড়ি পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল। অগত্যা আবার একটা গাড়ি রিজার্ভ করে আমাদের গোয়ালদাম পৌঁছাতে হল। এদিকে দুপুরের খাবার ততক্ষণে হজম হয়ে আবার পেট চুঁইচুঁই করছে। গোয়ালদামের একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডার দিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। পড়ন্ত আলোতে দূরে মেঘের ওপরে মাথা উঁচিয়ে ত্রিশুল পর্বতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গোয়ালদাম শহরের একফালি ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল।
গোয়ালদাম থেকে একটা গাড়ি বুক করে দেবল পর্যন্ত পৌঁছানো গেল। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে, তাই পথের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পিন্ডার নদীর গর্জন শুনতে পেলেও দর্শন পেলাম না। দেবল থেকে মহেন্দরজির সাহায্যে একটা গাড়ি জোগাড় করে যখন লোহাজং পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে প্রায় আটটা। এভাবে ভেঙে ভেঙে যেতে গিয়ে যা খরচা হল তাতে একবারে কাঠগোদাম থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে নিলে হয়ত খরচ কিছু কমই হত।
যন্ত্রশিল্পী এক অসুর
লোহাজং পৌঁছতেই মহেন্দর এসে অভ্যর্থনা জানাল। আমাদের থাকার জন্য একটা হোটেলের ব্যবস্থা সে আগেই করে রেখেছে। এখানে হোটেল বলতে সবই আসলে ট্রেকারদের জন্য গেস্টহাউস। 'স্টার'মার্কা হোটেল এখানে আশা করা যায়না। ঘরগুলোতে রাতে থাকার অসুবিধা হয়না, কিন্তু বাথরুমে কল, গিজার বা কমোডে কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ থাকলে সেটা সারাই করার লোক মেলাও দুষ্কর।
লোহাজং 'টাউনে' গাড়ির স্ট্যান্ডটাই যা একটু জমজমাট। এর বাইরে পুরোটাই নিরিবিলি। সন্ধ্যা আটটাতেই প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ। একটি মাত্র সরাইখানা তখনও খোলা রয়েছে, সেখানেই রাতের খাবারের বন্দোবস্ত হয়েছে। রাত যত বাড়ছে ঠান্ডাও ততই জাঁকিয়ে বসছে, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব 'ফ্রেশ' হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। একটু পড়ে মহেন্দর এসে দেখা করল। জানতে পারলাম দেব এর ছেলেটা চিরদিনের মতো বাবা-মা কে ছেড়ে তারাদের দেশে পাড়ি দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।
পরদিন ভোরে উঠেই শহরের মাথায় মুকুটের মত নন্দাঘুন্টি চোখে পড়ল। লোহাজংয়ে 'ভিউ' বলতে দারুণ কিছু নেই, সকালের সূর্য ওঠাটাও পাহাড়ের আড়ালে থেকে যায়। তবে নন্দাঘুন্টির উল্টোদিকে পাহাড়ের সারির পেছনে ভোরের আকাশের লাল আভায় চোখ জুড়িয়ে যায়।
লোহাজংয়ের লোককাহিনি লোহাসুরকে নিয়ে। এখানেই নাকি দেবী পার্বতীর সঙ্গে লোহাসুরের যুদ্ধ ('জং') হয়েছিল, তাই জায়গার নাম লোহাজং। তবে গল্পকথা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেলে পালটে যায়। বিষ্ণুপুরাণে নাকি লোহাসুরকে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্রে বধ করেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। আবার বাংলার চরক মেলাতেও লোহাসুরের কাহিনির উল্লেখ মেলে!
ব্যাঙের আনুগত্য
সকাল প্রায় সোয়া আটটায় গাইড গৌরবকে নিয়ে আমরা ধুলোমাখা পাথুরে পাহাড়ি পথে চড়াই বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। এদিন আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। নন্দাঘুন্টিকে আরো কাছ থেকে দেখা গেল। ওপর থেকে পাহাড়ের সারির কোলে লোহাজংয়ের ছোট ছোট গ্রামগুলো চোখে পড়ল। ভেড়ার পাল শুকনো ঘাসের মাঝে খাবার খুঁজে নিচ্ছিল কিন্তু পালের সর্দার এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করছিল না। পথের ধারে রডোডেনড্রনের সরবত থেকে শুরু করে পানীয় জল সবই মেলে তবে পকেটের কথা ভেবে সময় সময় পিছিয়ে আসতে হয়। তবে জায়গায় জায়গায় বাঁশের থাম আর পলিথিনের ছাউনিতে তৈরি হওয়া চায়ের দোকানগুলোর হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন। এখানে পায়ে চলার পথে একটিই সিমেন্টের সেতু পাওয়া গেল, কোথায় যেন 'যান্ত্রিকতা'-র ছোঁয়া, বাকি পথের পুরোটাই প্রাকৃতিক। আরও ঘন্টাদেড়েক এগোতে বরফে ঢাকা পথের হদিশ পেলাম।
জমাট বরফের ওপর দিয়ে চলতে গেলে পা হড়কানোর সম্ভাবনা থাকে বটে কিন্তু সেই লোহাজং থেকে সঙ্গী হওয়া সাদা আর কালো কুকুরদুটো অবলীলায় তাতে খেলা করতে থাকল! বরফের পথ থেকে আরেকটু এগিয়েই চোখে পড়ল এদিনের ক্যাম্পসাইট। ঘড়িতে মাত্র সাড়ে বারোটা। আমাদের টেন্ট তখনও বসানো হয়নি, তবে কয়েকটি গ্রুপের টেন্ট আগে থাকতেই বসানো ছিল। এখানে পৌঁছে আমাদের দুজনকে একটা সর্বভারতীয় ট্রেকিং টিমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল। গাইড এবং টেন্ট আলাদা তবে খাওয়া-দাওয়া একসঙ্গে করা হবে। ব্যাপারটায় আমরাও খুব একটা আপত্তি করলাম না, কারণ এরকম টিমের সঙ্গে চলার অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। তাছাড়া এই গ্রুপের টিম লিডার ঊষা ম্যাডাম যথেষ্ট আন্তরিক, আমাদের দুজনকে ওঁর নিজের দলের সদস্যদের মতই একাত্ম করে নিলেন।
ক্যাম্পসাইটটা একটা বৃত্তাকার পুকুরের ঠিক পাশেই। এই পুকুরের তিনদিকে খাড়াই পাহাড় আর একদিকে মস্ত ঢাল। এর পাশেই একটি পানীয় জলের ধারা রয়েছে যেখান থেকে ট্রেকিং ক্যাম্পে ব্যবহারের এবং খাওয়ার জল আনা হচ্ছিল। তবে কী না সেই জল যে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। কারণ আমার আর মানিক এবং আরও কয়েকজনের এই দিন থেকে পেটের গোলমাল দেখা দিয়েছিল। সৌভাগ্য এই যে সেটা একদিনের বেশি সমস্যায় ফেলেনি। তবে এটি খুব প্রচলিত ক্যাম্পসাইট, আমরা ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দলও এখানেই আশ্রয় নিয়েছে।
ক্যাম্পসাইটের পুকুরের একপাশের পাহাড়ের পেছনেই বেকালতাল। বিকেলে দলবেঁধে সেই পথে চললাম। খুব বেশি হলে মিনিট পনেরোর দূরত্ব। বেকালতাল লেক হিসেবে ছোটোই, একপাশ বরফে ঢাকা, অন্যপাশে স্বচ্ছ জল। তবে সেই জলেও ডালপালা আর কিছু প্লাস্টিকের প্যাকেট চোখে পড়ল। লেকের একপাশে অনেকটা খোলা জমি, দলের সঙ্গে খেলাধূলো করে বেশ কিছুক্ষণ কাটালাম। হয়তোবা ট্রেকিং দলের আন্তরিকতাতেই আমরাও বয়সকে অনেকটা পিছিয়ে দিতে পেরেছিলাম।
এরপর আবার টেন্টে ফেরার পালা, তবে অন্যপথে। ফেরার পথে লেকের পাশে নাগদেবতার মন্দির চোখে পড়ল। স্থানীয় লোককথায় এই নাগদেবতার অনুচর নাকি একটা ব্যাঙ! বেকালতাল অর্থাৎ ব্যাঙের সরোবর নাকি ওই নিরীহ ব্যাঙের জন্যেই বানানো। ফেরার পথে পাহাড়ের ওপর থেকে বেকালতালের সম্পূর্ণ আকৃতি চোখে পড়ল। লেকটাকে অনেকটা ব্যাঙের মতই দেখতে। এই লেকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও কিছু লোককাহিনি। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ব্রহ্মতালে কঠিন তপস্যার পর নাকি এই বেকালতালের কাছে কোনো গুহায় বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। বেকালতাল থেকে ফেরার সময় পড়ন্ত সূর্যের আলোয় পাহাড়ের ওপর থেকে আমাদের ক্যাম্পসাইটটা নজরে এল। পাহাড়ের কোলে এত সুন্দর সূর্যাস্ত দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য সচরাচর হয়না। ফিরে এসেই চা আর সন্ধ্যা হতে না হতেই রাতের খাবার পেয়ে গেলাম। আমাদের এদিন খুব বেশি হাঁটতে হয় নি, তাই ক্লান্তিও সেভাবে কাবু করতে পারে নি। তবুও দলের নিয়ম অনুযায়ী রাতের খাবার খেয়ে খুব তাড়াতাড়িই টেন্টে আশ্রয় নিতে হল। ঢালু জমিতে পাতা টেন্টে ঘুমোতে কিছুটা অস্বস্তি হলেও কখন যেন ঘুমে চোখ বুজে এল।
শান্ত নিস্তব্ধ ব্রহ্মতাল
পরদিন সকাল থেকেই আকাশ কিছুটা মেঘলা। ওর মধ্যেই ক্যাম্পসাইট থেকে বেকালতালের পেছনের পাহাড়ের ওপর চড়তে শুরু করলাম। বার্চ বনের মধ্যে পেঁজা তুলোর মত জমে থাকা তুষারের মাঝে পায়ে চলা পথ ধরে ক্রমেই ওপরে উঠতে থাকলাম। মাত্র ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেলাম। এখানে অনেকটা সমতল জমিতে একটি নামকরা ট্রেকিং এজেন্সি তাদের ক্যাম্প পেতেছে। শুকনো ঘাসে ঢাকা এই হিলটপের নাম তিলান্ডি।
তিলান্ডি থেকে একপাশে কয়েকটা স্তরে কিছু পাহাড়ের সারি দেখা গেল বটে তবে আকাশ মেঘলা থাকায় দূরের বরফঢাকা পাহাড় চূড়াগুলো আর নজরে এল না। এখানে এসে ইলশেগুঁড়ি তুষারপাত বেশ অনুভব করতে পারলাম। একনাগাড়ে সুক্ষ্ম তুলোর মত তুষার পড়তে থাকল, এদিকে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়ার মতোও কোন আস্তানা নেই। তাই স্নোফলের তীব্রতা বাড়ার আগেই আমরা তিলান্ডি থেকে রওনা দিলাম। পরের পথ মোটামুটি সমতল, দুই পাহাড়ের মাঝের শিরা বা রিজ ধরে এগিয়ে চলার রাস্তা। আসলে পুরোটাই একটা ঘাসে ঢাকা পাহাড় বা বুগিয়াল, তবে শীতকালে ঘাসের রং আর সবুজ নেই, শুকনো বাদামি হয়ে রয়েছে। সেই পথ ধরে চলতে বিশেষ কষ্ট হয় না তবে গাছপালা না থাকায় বৃষ্টি বা স্নোফলের হাত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় মেলাও সম্ভব নয়।
মিনিট দশেকের একটা ছোট চড়াই বেয়ে উঠতেই আমরা আরেকটি 'রিজ'-এর সামনে এসে উঠলাম। এর পরের পথে আর চড়াই নেই, প্রায় পুরোটাই একই লেভেলের রাস্তা। দূরে একটা টপের দিকে পায়ে চলা পথের রেখা এগিয়ে গেছে, আমরাও সেই পথ ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম। গাইডের কাছে জানতে পারলাম পথ আর বেশি বাকি নেই, এদিকে ঘড়িতে সবে সাড়ে দশ। তাই ঘড়ির দিকে তাকানো বন্ধ করে দুচোখ ভরে চারদিকের বরফে ঢাকা বুগিয়ালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম। বরফের বুক চিরে পায়ে চলা পথ এগিয়ে চলেছে দূরের ওই পাহাড়ের দিকে। আমরাও দুচোখ ভরে সেই ছবি দেখতে দেখতে গাইডের পেছন পেছন চলতে থাকলাম। আমরা পুরো দল থেকে আলাদা হয়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছিলাম। তবে গৌরব কখনোই আমাদের চোখের আড়াল করেনি।
আরও কিছুটা এগোতেই দূরে কয়েকটা স্থায়ী ছাউনি চোখে পড়ল। দূরে একটা ত্রিশূলও দেখতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম এখানে কিছু জনমানুষের দেখা মিলবে। জানলাম এটা 'ঝান্ডি টপ', এদিনের ট্রেকের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট।
একটা ছাউনিতে হরেক রকমের খাবার দাবার নিয়ে দোকান সাজিয়েছে লছমনজি। তবে এটা নাকি 'হোটেল'। লছমনজির বাড়ি লোহাজংয়ে তবে এখানেই থাকেন পাঁচ মাস। লেবু চা কাপপিছু ৩০ টাকা আর ম্যাগি প্রকার অনুযায়ী প্লেট পিছু চল্লিশ থেকে আশি টাকা। তবে কিনা 'সামান নিচে সে লানা পড়তা হ্যায়' বলে এই দাম মেনে নিতেই হয়।
ঝান্ডি টপের মাথায় এক মস্ত ত্রিশূল বসানো রয়েছে। তার চারদিক লাল-গেরুয়া কাপড়ে ঘিরে একটা ব্যারিকেড করা। আমরা যখন ত্রিশূলের কাছে পৌঁছলাম তখনও একনাগাড়ে স্নোফল চলছেই আর এখন তুষারকুচিগুলোর আকারও অনেক বড়। তাই ত্রিশূলের কাছে বেশিক্ষণ সময় কাটানোর উপায় নেই, আবার ফিরে এলাম লছমনজির 'হোটেলে'। ছাউনিতে বসে উনানে হাত সেঁকতে সেঁকতে বাইরের তুষারপাত বেশ উপভোগ করতে থাকলাম। অনেকেই মনের আনন্দে তুষারবৃষ্টিতে নাচ করতে শুরু করল। এভাবে ছাউনিতেই একঘন্টারও ওপর কাটিয়ে দিতে হল। শেষমেশ তুষারবৃষ্টি কিছুটা কমতে আবার রওনা দিলাম পরের ক্যাম্পের দিকে। অনেক্ষণ তুষার পড়ার ফলে রাস্তার বেশিরভাগই সাদা হয়ে রয়েছে, তবে এরকম তুলোর মত তুষারে পা স্লিপ করার সম্ভাবনা কম।
ঝান্ডি টপ থেকে পাশের পাহাড়ের দিকে চোখ পড়ল। ওই পথেই বছরপাঁচেক আগে রূপকুণ্ড হয়ে রন্টি স্যাডেলে গেছিলাম। আবারও সেই স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। দুপাশে পেঁজা তুলোর মত জমে থাকা বরফের বুক চিরে শুকনো বাদামি ঘাসের পথ ধরে আমরা 'নাক বরাবর' এগিয়ে চললাম। পায়ে চলার পথটুকু বাদ দিলে ডান-বাঁ দুদিকেই বরফে ঢাকা দুধসাদা বুগিয়াল। অল্প কিছুটা এগিয়ে যেতেই পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে নিচে নেমে যাওয়ার মত একটা পাথুরে পায়ে চলার পথের দেখা পাওয়া গেল। গলতে থাকা তুষারের জলে সেই পথ কাদায় পিছল হয়ে পড়েছে। মিনিট পনের-কুড়ির চেষ্টায় আমরা সেই পথ ধরে নিচের সমতলে নেমে এলাম। তুষারবর্ষণের তখনও খামতি নেই, বরং সময় সময় তুষারের ঝাপটা বেশ জোরালো আকার নিচ্ছে। যে পথে নেমে এসেছি, পেছন ফিরে দেখি সেই পথও সাদা বরফে প্রায় ঢেকে গেছে।
ঘড়িতে তখন সবে দেড়টা, ব্রহ্মতালের ক্যাম্পসাইট খুব একটা দূরে নয়। সম্ভবতঃ পোর্টাররা তখনও সেখানে পৌঁছে ক্যাম্প তৈরি করে উঠতে না পারায় আমাদের অপেক্ষা করতে হল। সেই তুষারবৃষ্টির মধ্যেই আমরা স্নোবল তৈরি করে সময় কাটাতে লাগলাম। প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর আমাদের আবার এগিয়ে যেতে বলা হল। তখন তুষারপাত কিছুটা কমে এসেছে। সামনে একটা মন্দিরকে লক্ষ্য করে আমরা এগিয়ে চললাম।
এই মন্দিরটি নাগদেবতার। বেকালতালে দেখা মন্দিরের চেয়েও আকারে অনেক ছোটো এই মন্দির। মন্দিরটি কবে তৈরি হয়েছে তা এর গায়ে খোদাই করা থাকলেও লেখাটি খুবই অস্পষ্ট। মন্দিরচত্ত্বর থেকে একটু এগিয়ে যেতেই নিচে পবিত্র ব্রহ্মতাল চোখে পড়ল। লেকের একটা বড় অংশ বরফে ঢাকা আর সেই বরফে বেশ কিছু রহস্যময় গর্ত চোখে পড়ল। আরও কিছুটা এগিয়ে লেকের কিনারায় গিয়ে উঠলাম। নিস্তরঙ্গ লেকটা যেন এত মানুষের হইচই কোলাহলের শব্দও নিমেষে শুষে নিচ্ছিল।
পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী স্বয়ং ব্রহ্মা এখানে বসে তপস্যা করেছিলেন, সেই আবহ যেন এখনও অনুভব করা যাচ্ছিল। গাইডের তাগাদায় বেশিক্ষণ লেকের ধারে থাকা সম্ভব হল না, একটু এগিয়েই ক্যাম্পসাইট, ততক্ষণে টেন্টগুলোও পাতা হয়ে গেছে। ভাবলাম ব্যাগপত্তর রেখে আবার লেকের ধারে ফিরে আসব। কিন্তু হায়, একটু পরেই শুরু হল জোরালো তুষারবৃষ্টি। এর মধ্যে আবার আবিষ্কার করলাম টেন্টের দরজার চেনটাও কাটা। গাইডের সাহায্য নিয়েও সেটা ঠিক করা গেল না, শেষমেষ নিরুপায় হয়ে টেন্টের পেছন দিক দিয়ে বেরোনোর মত একটা রাস্তা তৈরি করতে হল। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আর চারদিক বরফে ঢাকা পড়ে গেছে, লেকের ধারে সময় কাটানোর মতো উপায় নেই আর। বিকেল থেকে শুরু হয়ে রাতভর তুষারবৃষ্টি চলতেই থাকল। রাতে বেশ কয়েকবার ঘুম থেকে উঠে টেন্টের ছাদ ঝাঁকিয়ে তুষার ঝেড়ে ফেলতে হল, নয়তো বরফের ভারে টেন্ট ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভোররাতে টেন্টের বাইরে বেশ হইচই শুনতে পেলাম। বেরিয়ে এসে দেখি ট্রেকাররা 'স্নো-ম্যান' বানাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। দেখলাম অনেকেই এই কাজে বেশ নিপুণ, কিছু শুকনো জংলি ফুল, ডালপালা আর রান্নাঘর থেকে জোগাড় করা কাঁচালঙ্কা-গাজর দিয়ে মানুষের চেহারাটা সুন্দরভাবে দাঁড় করিয়ে দিল। আর কোনও এক ট্রেকারের সঙ্গে থাকা খেজুর দিয়ে স্নো-ম্যান-এর 'চক্ষুদান' হল! অবশেষে সেই 'স্নো-ম্যান' বরফঢাকা ক্যাম্পের রাতপ্রহরী হয়ে জেগে রইল। ভোরের আলো ফুটতেই সে সবাইকে সুপ্রভাত জানাল। মেয়েরা ছেলেদের মত অত বড়ো স্নো-ম্যান বানাতে না পারলেও ছোটো আকারের দু'দুটো বরফ শিশু বানিয়ে ফেলেছিল।
তুষারসাদা 'ফেয়ারি টেল'-এর পথ
সকালে আবছা আলোতে দূরের পাহাড়গুলো দেখা গেল। তবে আকাশে তখনও মেঘের আনাগোনা। সারারাত তুষার পড়ায় শুধু ক্যাম্পসাইটই নয় দূরের পাহাড়গুলোও সাদা বরফে ঢেকে গেছে। পরিকল্পনা ছিল প্রথমে ওই দূরের পাহাড়ে চূড়ায় উঠব তারপর শিরা (Ridge) বেয়ে ঝান্ডি টপে পৌঁছে যাব। কিন্তু আবহাওয়া আর জমা বরফের কথা চিন্তা করে গাইড পাহাড় চূড়ায় পৌঁছানো নিরাপদ মনে করল না। এদিকে ফেরার পথও তখন বরফে ঢেকে গেছে। গাইড আর তাঁর সঙ্গীরা সকাল সকাল সেই বরফের মধ্যে দিয়ে চলার পথ খুঁজে রেখে এসেছেন। সকাল আটটা বাজতেই আমরা ফেরার পথ ধরলাম। পা ডুবে যাওয়ার মতো ঘন তুষারের মধ্যে দিয়ে গাইডের দেখানো পথ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই নাগদেবতার মন্দির দেখতে পেলাম।
বরফের মধ্যে দিয়ে আমাদের দলের লম্বা মিছিল চলতে থাকল। সবাই একসঙ্গে থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হল। কেউ পিছিয়ে পড়লে পুরো দল তার জন্য অপেক্ষা করল। এভাবে প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর আমরা পাহাড়ের শিরায় পৌঁছলাম। এর পরের রাস্তায় আর চড়াই নেই বললেই চলে। ততক্ষণে আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ উঠেছে। আমরাও ফটোশেসনের জন্য বেশ কিছুটা সময় পেয়ে গেলাম। খানিকপরেই সামনে 'ঝান্ডি টপ' চোখে পড়ল। ঝান্ডি টপে তখন চড়া রোদ। নীল আকাশের নিচে দূরের পাহাড়ের সারি তখন খালি চোখেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এখানে লছমনের হোটেল থেকে প্লেটপিছু আশি টাকার ডিমের কুচি দেওয়া ম্যাগি আর তিরিশ টাকার লেবু চা খেয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নামার প্রস্তুতি শুরু করলাম। তুষারগলা জলে নিচে নামার পথ বড়ই পিছল হয়ে রয়েছে। মুহূর্তের অসতর্কতায় অনেকেই বারকয়েক ডিগবাজি খেল। ওক গাছের বনের মধ্যে দিয়ে কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ চলার পর রডোডেনড্রন গাছে ঘেরা সুন্দর এক তুষারঢালে এসে পড়লাম।
নিটোল বরফে ঢাকা এই রাস্তাটা যেন এক লহমায় কাদামাখা পথে চলার সমস্ত বিরক্তি ভুলিয়ে দিল। গাছের পাতায় জমে থাকা তুষারকুচি আর বরফে ঢাকা ঢালু মাঠ যেন হ্যান্সেল আর গ্রেটেলের রূপকথা থেকে উঠে এসেছে। আর কিছুটা পথ নামতে ডালদুম গ্রাম চোখে পড়ল।
জঙ্গলের মধ্যে এটাও একটা ক্যাম্পসাইট বটে তবে আমরা কেউই আর এখানে রাতে ক্যাম্প করে সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। এখানে একটাই 'হোটেল' - চা-বিস্কুট আর ম্যাগিও মেলে। তবে আমাদের মধ্যে তখন যেন 'সবই দেখা হয়ে গেছে' ভাব, তাই লোহাজং ফেরাটাই যেন একমাত্র কাজ বলে মনে হল। ট্রেকের শেষবেলায় অনেকসময়ই এরকম একটা ভাব চলে আসে, আর এতে ট্রেকিংয়ের অনেক সৌন্দর্য-রোমাঞ্চ চোখের আড়ালেই থেকে যায়। ডালদুম থেকে কিছুটা এগোতেই প্রথমে মাটির আর তারপর ঢালু ধুলোমাখা পাথুরে পাহাড়ি পথ ফিরে এল। বুঝতে পারলাম লোহাজংয়ের খুব কাছেই পৌঁছে গেছি। ক্লান্ত পায়ে আরও কিছুটা এগোতেই একটি মন্দির আর তার নিচে লোহাজং শহর চোখের সামনে ভেসে উঠল। ঘড়ি বলছে মাত্র সোয়া তিনটে, লোহাজং শহরটা দিনের আলোয় দেখার কিছুটা সময় পাওয়া যাবে।
ব্রহ্মতাল ট্রেক, জানুয়ারি ২০২৩
'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণপত্রিকার সহসম্পাদক সুদীপ্ত দত্ত ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়েন নিরালার খোঁজে। নতুন জায়গার সাথে মিশে আপন করে নেন সেখানকার জীবন, সংস্কৃতি আর খাদ্যাভ্যাস। তারপর তাঁর প্রিয় পত্রিকাটির পাঠকদের সাথে ভাগ করে নেন সেই যাত্রাপথের খুঁটিনাটি।