করোনার আগে ডুয়ার্সে
সুপ্রিয় চক্রবর্তী
জঙ্গল আমায় পাগল করে, মাতাল করে তোলে। জঙ্গলের প্রেমে উত্তাল ঢেউয়ের মতো, প্রবল ঝড়ের মতো বারবার ছুটে যাই তার কাছে। তার গন্ধ নিয়ে নিজেকে স্নাত করব বলে, ডুবিয়ে দেব তার নিস্তব্ধতার গভীরে, পাখির কলতান আর নদীর জলের বয়ে যাওয়ার শব্দে নিজের কানকে পবিত্র করব বলে।
সেই চাওয়া অনেকদিন পর আবার সার্থক হয়েছিল যখন দেবুদার ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে গেলাম আমার প্রাণের প্রিয় ডুয়ার্স-এর জঙ্গলে। সেবার গিয়েছিলাম মাদারিহাট আর বক্সাতে।
শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে চড়ে হাসিমারা স্টেশনে নেমে প্রথমে গেলাম মাদারিহাট-এ। সেখানে ছিলাম চা বাগান ঘেরা অসাধারণ এক প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে। চারিদিকে চা বাগান আর মাঝে এই রিসর্টটি প্রায় তিন বিঘা জমিতে দাঁড়িয়ে আছে। রিসর্ট-এর নিজস্ব জমিতে চাষাবাদ হয়। বাঁধাকপি, আদা, রসুন, হলুদ, লঙ্কা আরও অনেক কিছু।
সন্ধেবেলায় হাতি এসে ক্ষেত উজাড় করে বাঁধাকপি কলাগাছ খেয়ে বেড়া ভেঙে চলে গেল সেটাও সার্চলাইটের কল্যাণে চাক্ষুষ করলাম খুব কাছ থেকে।
আজ পর্যন্ত যতবার মাদারিহাটের জঙ্গলে গেছি ততোবারই হাতির পিঠে চড়ে গভীর জঙ্গলে ঘুরেছি তাই এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। জঙ্গলে যাব আর হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল দেখব না এটা হতেই পারে না। এবার যেহেতু হলং-এ থাকতে পারিনি তাই মাত্র পাঁচ ঘণ্টা লাইন দিয়ে অবশেষে টিকিট পেলাম পরের দিন ভোরে হাতি চড়ার। হাতি চড়তে গিয়ে এবারও পেলাম এক ছোটোো মিষ্টি হাতির বাচ্চাকে। সেটা যেমন দুষ্টু তেমন চঞ্চল। জঙ্গলে দেখা দিল বাইসন, ময়ূর, হরিণ-এর মতো কয়েকটি প্রাণী আর আমাদের দেখল আরও কত কত প্রাণী, পাখি আর কীটপতঙ্গ।
আজ এমন কিছু মানুষের কথা বলব যারা আমার উত্তরবঙ্গের জঙ্গল ভ্রমণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার মধ্যে যেমন মানবদা, দেবুদা আছে যারা উত্তরবঙ্গ উৎসবে গান গাইতে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে আমায় নিয়ে বক্সা জয়ন্তীও চিনিয়েছে। আবার লাটাগুড়ি, চাপড়ামাড়ি, মূর্তি নদী, চালসা, ময়নাগুড়ি চিনেছি দেখেছি আর ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় গানের অনুষ্ঠান করেছি আশিষদার জন্যে।
কিন্তু যতবার হলং টুরিস্ট লজ-এ গিয়েছি এবং থেকেছি সেখানে খুব খুব আপনজন হয়ে উঠেছিল তৎকালীন ম্যানেজার লাখপতিদা, ওখানকার রাঁধুনিরা, অন্যান্য কর্মচারী যাঁরা আমাদের দেখভাল করতেন আর অবশ্যই মাহুতরা। সন্ধেবেলা এদের সবাইকে নিয়ে বসে গান শোনাতাম আর মাহুতদের বাড়ি যেতাম হাতির পিঠে চড়ে চা খেতে আর তাদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গল্প করতে।
এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অর্জুনদা। প্রথম থেকে তৃতীয় হলং ভ্রমণে অর্জুনদার লক্ষ্মী হাতিতে চড়েই ঘুরেছি জঙ্গলে। অর্জুনদা তখন ছিলেন মাহুতদের দলপতি। তাঁর হাতেই থাকত একটা বন্দুক, হিংস্র জন্তুদের জন্যে। তিনি থাকতেন হাতির দলে সবার আগে।
এইবার গিয়ে আর কারোর দেখা না হলেও অর্জুনদাকে একমাত্র পেলাম চেনাজানা মানুষ। অর্জুনদা এখন বিট অফিসার। সমস্ত হাতির চার্জে আছেন। ভীষণ অমায়িক আর লাজুক মানুষ অর্জুনদা। খুব অল্প আর আস্তে কথা বলেন। কিন্তু হাতির পিঠে চড়ে গভীর জঙ্গলে যখন "মাইন" "মাইন" বলে হাতিকে এগিয়ে যেতে বলতেন সেটা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
আমি কখনোই জঙ্গলে ওয়াইল্ড লাইফ দেখতে যাই না। বারবার ছুটে যাই জঙ্গলের রূপ দেখতে, জঙ্গলের গন্ধ নিতে, জঙ্গলের ভেতরের নিস্তব্ধতাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে আর তার মধ্যেকার ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে বুঁদ হতে অথবা ময়ূরের কেকা ধ্বনি আর পাখির কিচির মিচির শুনে এক অদ্ভুত নেশায় মাতাল হতে।
তবে জঙ্গলের ভেতরে চলতে চলতে যদি পথের মাঝে কোনো প্রাণী এসে দাঁড়িয়ে পথ আটকায় বা সামনে দিয়ে রাস্তার এপাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ওপাশের জঙ্গলে চলে যায় তাহলে তাদের সেই সৌর্ন্দযকেও মুগ্ধ হয়ে দেখব।
মাদারিহাট-এর শেষ দিনটা কাটালাম সূর্যোদয়ের ছবি তুলে, চা বাগান দেখে আর রিসর্টে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে অরবিন্দ বলে একটা আদিবাসী ছেলের সঙ্গে ওর গ্রাম (ওদের ভাষায় চা বাগান এর ২৮ মাইল চা বস্তি) ঘুরে বেড়িয়ে আর ওর বাড়ি গিয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে বসে চা মুড়ি খেতে খেতে ওদের জীবনের ওদের প্রতিদিনের লড়াইয়ের গল্প শুনে। খুবই দরিদ্র একটা পরিবার ওখানকার আর বাকি পরিবারগুলোর মতোই কিন্তু কী হাসিমুখে আছে ওরা, দেখে অনেক কিছু শিখে এলাম ওদের কাছ থেকে। ওরা যা পায়, যতটুকু পায় তাতেই ওরা খুব খুশি থাকে। অরবিন্দদের পরিবারে মোট সাড়ে ছয়জন মানুষ। অরবিন্দ, ওর বাবা-মা, বোন, দাদা, ওর বউ আর ওদের একটা বাচ্চা ছেলে – দেখলাম সে উদোম হয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। শুনলাম ওদের কিছুটা জমি একটা কোম্পানিকে দিলেও তারা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ওরাই সেখানে চা বাগান করে চাষ করে আর বাকি সময় রিসর্টে কাজ করে। প্রতি কিলো চা পাতার জন্যে ওরা পায় পনের থেকে কুড়ি টাকা। সিজনে একটু কম পায়। পাতা তোলে মেয়েরা আর সেটাই বস্তা বন্দী করে ওরা দিয়ে আসে চা পাতা তৈরির ফ্যাকট্রিতে। বস্তাতে কতটা পাতা আছে সেটা মেপে ওদের টাকা দিয়ে দেয় তারপর সেই পাতা শুকিয়ে ভেঙে তৈরি হয় পানের উপযুক্ত চা পাতা। সন্ধে নামার আগে আবার ফিরে এলাম রিসর্টে। গতকাল হাতি এসেছিল তাই ম্যানেজারবাবু বারবার বলে দিয়েছিলেন সূর্য ডোবার আগে ফিরে আসতে। রিসর্টে ফিরে অরবিন্দর হাতে জোর করে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ওর ছেলের আর ওর বাড়ির সবার জন্যে কিছু নিয়ে আসতে বললাম। ও ছেলের জন্যে ক্যাডবেরি আর বাকি সবার জন্যে মিষ্টি এনে আমায় দেখিয়ে নিয়ে গেলো। পরেরদিন সকালে রওনা দেবো বক্সার উদ্দেশ্যে, তাই আজ আর বেশি রাত না করে শুয়ে পরলাম ওদের এই সারাদিন আনন্দে খুশিতে থাকার রসায়নের কথা ভাবতে ভাবতে...।
১৯ ফেব্রুয়ারি খুব সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ে রিসর্টের সামনের চা বাগানে একটু ঘুরে সূর্যোদয় আর পাখি দেখে, সকালের চা ও পরে প্রাতরাশ খেয়ে উঠে দেখি দেবুদার আগে থেকেই ঠিক করে রাখা গাড়ি এসে গেছে আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে।
প্রায় ছয় বছর পর উত্তরবঙ্গে এসে এবার যেটা দেখে সব থেকে খুশি ও অবাক হলাম সেটা হলো এখানকার রাস্তা। উফ্ কি অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে রাস্তাঘাটের। একদম মাখনের মতো পথে তোর্সা নদীর ওপর দিয়ে বক্সার প্রবেশ দ্বার রাজাভাতখাওয়াতে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগলো না।
ছয় বছর পর উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে এসে এবার আর একটা জিনিসও নতুন দেখলাম সেটা হল সমস্ত ভ্রমণকারীর থেকে বিভিন্ন এন্ট্রি ফিজ ও গাইড-এর নাম করে অনেক টাকা নিচ্ছে বন দফতর। এটা প্রথম দেখেছিলাম হলং-এর ক্ষেত্রে আবার এখানে এসেও দেখলাম সেটা। রাজাভাতখাওয়াতে যে মিউজিয়াম আছে সেখানে একশো টাকা প্রতিজন ও প্রতি গাড়ির জন্যে তিনশো টাকা দিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি মিলল তিন দিন বক্সা ও জয়ন্তীতে থাকা ও ঘোরার জন্যে। যদিও মিউজিয়াম দেখার জন্যে আলাদা করে কোনও টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়নি।
এবার আসি এই জায়গাটার নাম রাজাভাতখাওয়া কী ভাবে হল সেই গল্পে। এই বিষয়টা নিয়ে অনেকের অনেক রকমের মত থাকলেও আমি বনবিভাগের দেওয়া তথ্যটাই ছবি আকারে তুলে ধরছি। মিউজিয়ামের সামনে একটা বিরাট বোর্ডে এই ইতিহাস লেখা আছে দেখে আমি সরাসরি ওটার ছবি তুলে নিয়ে আসি। এই মিউজিয়ামে অনেক জন্তুজানোয়ারের ছবি, মূর্তি, বিভিন্ন পাখির ছবি মূর্তি, ডিম ছাড়াও আছে বিভিন্ন কীটপতঙ্গের ছবি ও ফরমালিনে ভেজানো আসল মৃত অনেক পাখি, সাপ, কীটপতঙ্গ ও দুটো বাচ্চা হাতির শরীর, যাদের মধ্যে একটা বাচ্চা মারা গিয়েছিল মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেই যখন ওর মায়ের মৃত্যু হয় বাজ পড়ে অন্য বাচ্চাটাও তার মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেই মারা যায় সেটার সঠিক কারণ যদিও জানা যায়নি। যে মা হাতিটি বাজ পড়ে মারা গিয়েছিল তাকে ওখানেই কবর দিয়ে কবরের ওপর হাতিটির একটা মূর্তি তৈরি করে দিয়েছে বনবিভাগ।
এর পর বক্সা জয়ন্তীর ভেতরে ঢোকার অনুমতিপত্রটা হাতে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। একটু এগোতেই বক্সা জঙ্গলে ঢোকার প্রবেশ দ্বারে ওটা দেখিয়ে স্ট্যাম্প মেরে নিতে হল। এরপর গাড়ি ছুটে চলল দুপাশে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এক ফালি সরু রাস্তা ধরে। আর জানলা দিয়ে মুখ বের করে প্রাণায়ামের পুরো নিশ্বাস নিয়ে নিতে থাকলাম জঙ্গলের সেই সোঁদা গন্ধ আর শুনতে লাগলাম সেই ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ যা আমায় মাতাল করে দেয় এক অদ্ভুত নেশায়। হারিয়ে গেলাম অনুভূতির এক অন্য জগতে যেখানে আছি শুধু আমি আর আমার প্রাণাধিক প্রিয় এই ডুয়ার্স-এর জঙ্গল। কখন যে গুন গুন করে গাইতে শুরু করেছি, 'কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা মনে মনে...'।
হঠাৎ আমাদের গাড়ির বাঁদিকে বাঁক নিয়ে একটা বনবস্তির ভিতরে ঢুকে পড়তে বুঝলাম আমি এসে পৌঁছে গেছি দেবুদার হোম স্টে 'বক্সা ইকো হাট' ২৯ নম্বর বনবস্তিতে। এখানকার লোকজন একে বনবস্তি বললেও আসলে এটা একটা সুন্দর গ্রাম যেখানে বাস করে জঙ্গলে কাজ করে এমনকিছু মানুষ আর এর চারিদিক ঘেরা জঙ্গল দিয়ে। এর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ছুটে আসতেই হবে এই 'বক্সা ইকো হাট'-এ।
এই রিসর্টে দুটো পৃথক হাট। দুটোই কাঠের তৈরি। একটা দোতলা বাড়ি যেখানে ওপরের তলায় থাকার ঘর চারটে সঙ্গে আলাদা বাথরুমসহ আর নিচের ঘরগুলো ডরমেটরি ড্রাইভার দাদা ও ওই রিসর্টের কাজের ভাইদের থাকবার জন্য। এর পাশেই আছে আরও দুটো ঘর যেগুলো আকারে কিছুটা বড়ো ও একটা বড়ো বারান্দাওলা। সামনে একটা সুন্দর বাঁশের সাঁকো যেটা হাট দুটোকে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
রিসর্টে পৌঁছে তাড়াতাড়ি করে স্নান করে খেয়ে নিলাম কারণ অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল আর খিদেটাও নেহাত কম পায়নি।
জয়ন্তী নদী ও পাহাড়
'বক্সা ইকো হাট' এ পৌঁছে দুপুরে খেয়ে উঠে কিছু ছবি তুলে গাড়ি নিয়ে যাই জয়ন্তী নদী আর জয়ন্তী পাহাড় দেখতে।
জয়ন্তী পাহাড় যেখানে শেষ হয় ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয় জয়ন্তী নদী। শোনা যায় যে এই জয়ন্তী নদী আগে যেখানে ছিল তার থেকে আজ প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে অবস্থান করছে। জয়ন্তী নদীর নিচের পলিমাটি পাথর ওপরে উঠে এসে জয়ন্তী নদীর ওপরে থাকা একটা আস্ত ব্রিজকে অদৃশ্য করে দিয়েছে। অনেক আগের বিরাট জঙ্গল আজ এই নদীর গহ্বরে তলিয়ে গেলেও নদীর বুকে কিছু গাছ ও কিছু গাছের গুঁড়ি এই কথার প্রমাণ আজও বহন করে চলেছে। এই তথ্যের কোনো লিপিবদ্ধ প্রমাণ না থাকলেও ওখানকার বাসিন্দা, গাইড, সাফারি জিপ-এর ড্রাইভারদের কাছ থেকে একথা জেনেছি।
এই নদীর পাড়ে খুব জনপ্রিয় একটি বাংলা সিনেমা গৌতম ঘোষ-এর 'আবার অরণ্যে'-র শ্যুটিং হয়েছিল।
জয়ন্তী পাহাড় আর নদীর মাঝে আছে এক গভীর জঙ্গল। এই জঙ্গলে অনেক বন্য প্রাণী আছে। ছবছর আগে এসে এই জঙ্গলে ঢুকেছিলাম। জঙ্গলে বেশ কিছু বন্য প্রাণীও দেখেছিলাম, যেমন ময়ূর, হরিণ ইত্যাদি। কিন্তু এবার গিয়ে সেই সুযোগ আর পেলাম না। কারণ এখন আর ওই জঙ্গলে কাউকেই গাইড ও জিপসি জিপ ছাড়া যেতে দেওয়া হয় না।
এবার এসে দেখলাম এখানকার অনেককিছু বদলে গেছে। যেমন অনেক ছোটোোবড়ো হোটেল রিসর্ট গজিয়ে উঠেছে জয়ন্তীর তীরে। আগেরবার দেখেছিলাম মাত্র দুটো রিসর্ট একটা সরকারি আর একটা বেসরকারি। বেসরকারি রিসর্টে ছিলাম কারণ ওটা আমার আলিপুরদুয়ারের এক খুব প্রিয় মানুষ মানবদার ছিল। সেই মানবদা যিনি আমাকে তিনবার 'উত্তরবঙ্গ উৎসব'-এ আর একবার 'উত্তরের উৎসব'-এ গান গাইতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবার গিয়ে দেখলাম জয়ন্তী নদীকে কেন্দ্র করে আমি যেখানেই যেতে চাইব সেখানে যেতে হলে আমায় বনবিভাগ থেকে জিপ ও গাইড অবশ্যই নিতে হবে বন দফতরের নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে। তাই পড়ন্ত বিকেলটা কাটালাম জয়ন্তী নদীর মাঝে ছবি তুলে আর এই নদী পাহাড়ের শোভা দেখে ও নদীর বুকে গোধূলি বেলায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে। এই সূর্যাস্তের শোভা যে কী অপরূপ আর মনোরম সেটা যে না দেখেছে তাকে বোঝানো যাবে না। এটা আমার সারাটা জীবন এর যত ভালো অনুভূতি আছে তার মধ্যে একটা অন্যতম সুখের অনুভূতি, যা কিনা কোনোভাবেই ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এটা দেখতে দেখতে কেমন জানি হারিয়ে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরল যখন বনরক্ষী এসে নদী থেকে উঠে যেতে বলল। এখন, এই সময়ে, নদীতে একফোঁটাও জল থাকে না। শুধুই পাথরের স্তূপ। কিন্তু বর্ষাকালে এই নদীর অন্য রূপ দেখতে পাওয়া যায়। যেহেতু ওইসময় জঙ্গল বন্ধ থাকে তাই পর্যটক থাকে না বললেই চলে কিন্তু কেউ পারলে একবার বর্ষাতে এসে এই জয়ন্তী নদীর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবে। যাই হোক অন্ধকার নেমে আসায় ফিরে এলাম রিসর্টে।
পাটুর সঙ্গে সন্ধ্যার ইকো হাট রিসর্ট
জয়ন্তী দেখে সন্ধেবেলায় যখন রিসর্টে ফিরছি চারদিকে গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে। গাড়ি রাস্তা ছেড়ে গ্রামের পথ ধরেছে, দূর থেকে আমাদের রিসর্টটা দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। চারিদিকে অন্ধকার আর তার মাঝে রিসর্টের বাইরের ছোটো ছোটো আলোগুলো জ্বলছে। সেটা দেখে ওই কাঠের বাড়িটাকে যে কী মোহময়ী রূপবতী লাগছে কী বলব! যে বাড়িটাকে দুপুরে দেখে গেছি একটা সুন্দর রিসর্ট হিসেবে সেটা যে সন্ধ্যের পর এমন সুন্দরী মোহময়ী হয়ে উঠবে সেটা কল্পনাতেও আনতে পারিনি।
যাই হোক ফিরে এসে দেখি পাটু মুড়িমাখা, বেগুনি আর লিকার চা তৈরি করে অপেক্ষা করছিল। ফিরে আসতেই আমাদের রিসর্টের বাইরের বারান্দায় আগের থেকে গুছিয়ে রাখা টেবিলে সেগুলো দিয়ে গেল আর আমিও চেয়ারে বসে একটা বেগুনি তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে বারান্দার কাঠের রেলিং-এ দুটো পা তুলে দিয়ে একটু আয়েশ করে বসলাম। সেই সময় পাটু এসে অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিল। বলল, 'স্যার আপনি যদি বলেন তাহলে রিসর্টে সব আলোগুলো নিবিয়ে দেব? শুধু চাঁদের আলোতে বসবেন?"
অসাধারণ এই প্রস্তাবটা পেয়ে আর এক মুহূর্ত চিন্তা করিনি, বললাম এক্ষুনি সব আলো নিবিয়ে দে পাটু। বলার সঙ্গে সঙ্গে রিসর্টের সব কটা আলো নিবিয়ে দিয়ে এসে আমার সামনে মাটিতে বসে পড়ে আবার একটা আবদার করল। ও হঠাৎ করে বলল, 'স্যার, আমি জানি আপনি লোকগান করেন, আপনি, আমার একটা খুব প্রিয় ভাওয়াইয়া গান – তোর্সা নদীর উথাল পাথাল, এটা শোনাবেন?' ওই অন্ধকারে আকাশের ওই কিশোরী চন্দ্রালোকে ওর মুখে চোখে অদ্ভুত একটা উৎকণ্ঠা একটা আশা একটা চরম ভালোলাগা দেখতে পেলাম। বললাম, 'আমি তোকে, একটা না তিনটে, তিন রকমের গান শোনাব কিন্তু তার পরিবর্তে আমারও তিনটে শর্ত আছে যদি তুই সেটা মেনে নিস তাহলেই শোনাব।' ও কিছু না ভেবেই বলল, 'আমি নিশ্চয়ই মানব স্যার, কী আপনার শর্ত বলুন।' বললাম, 'প্রথম শর্ত হল তুই আমাকে আর স্যার না বলে শুধুই দাদা বা সুপ্রিয়দা বলে ডাকবি আর আমার সামনের এই ফাঁকা চেয়ারে বসে এই একই বাটি থেকে মুড়ি বেগুনি আর চা খাবি। দ্বিতীয় শর্ত তোর জীবনের কাহিনি মানে ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত জঙ্গলে বেড়ে ওঠার কথা বলবি আর তৃতীয় শর্ত হল আগামীকাল খুব ভোরে তুই আমায় ওই উল্টোদিকের জঙ্গলে নিয়ে যাবি, আমরা দুজন পায়ে হেঁটে জঙ্গল ঘুরে দেখব, এখন বল, তুই আমার এই তিনটে শর্ত মানতে রাজি কি না?' বুঝলাম, পাটু খুব অস্বস্তিতে পড়েছে। একটু মাথা চুলকে কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলে ওর পছন্দের ভাওয়াইয়া গানটা সহ আরও একটা ভাটিয়ালি আর একটা লালনগীতি শোনালাম।
এরপর ও বলল ওর জীবনের বিভিন্ন গল্প যা আজও ও ভোলে নি বা ভুলতে পারে নি। সেটা বলার আগে এটা বলা উচিত যে 'পাটু' এই অদ্ভুত নামের মানুষটা কে?
পাটু হল 'ইকো হাট রিসর্ট'-এর সবরকম সবধরণের কাজের লোক। একাধারে রান্না থেকে শুরু করে, আগত পর্যটকদের দেখভাল, রিসর্ট আর রিসর্টের সুন্দর সাজানো বাগানের যাবতীয় কাজ করা একটা আদিবাসী কিন্তু ভীষণ সরল আর তার সঙ্গে ভীষণই বুদ্ধিমান একটা মিষ্টি ছেলে। খুব বেশি বয়েস না হলেও গতবছর বিয়েটা সেরে নিয়েছে। মা, দাদা, বৌদি আর বউকে নিয়ে এমনই আরেকটা বন বস্তিতে ওদের বাড়ি। অফসিজনে বাড়িতে থাকে। পর্যটক থাকলে ও এই রিসর্ট ছেড়ে এক পাও কোথাও নড়ে না।
জঙ্গলে ওর ছোটোো থেকে বেড়ে ওঠার আর বাবার অদ্ভুত রহস্যময় মৃত্যুর কাহিনি শুনলাম। ওর বাবা ছিলেন বনবিভাগের গাছ কাটার কর্মী । একদিন অন্যান্যদের সঙ্গে গভীর জঙ্গলে একটা বিরাট বড়ো কিন্তু বুড়ো হয়ে যাওয়া গাছ কাটতে গিয়েছিলেন। রোজকারের মতো যেই না উনি কুড়োল দিয়ে গাছে একটা কোপ মেরেছেন অমনি গাছটা থেকে তাজা রক্ত ওর বাবার গায়ে ছিটকে এসে পড়ে। এরপর সবাই গাছটা কাটতে বারণ করলেও উনি আবার এক কোপ দিতেই ওঁর চোখে মুখে আবার কিছুটা রক্ত ছিটকে পড়ে আর উনিও চিৎ হয়ে পড়ে গিয়ে এক মিনিটখানেকের মধ্যেই মারা যান।
আমি গল্পটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না দেখে বলল আমার মনে কোনও সন্দেহ হলে ওদের বস্তিতে নিয়ে গিয়ে ওর মা আর সেই দিন যারা ওখানে ওর বাবার সঙ্গে গাছ কাটার কাজে ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথাও বলিয়ে দেবে।
ঠিক তখনই কিশোরী চাঁদের আলোয় দেখলাম ওর দুচোখের কোণে সাদা মুক্তোর মতো দুফোঁটা জল জমে আছে কিন্তু পড়ছে না। চাঁদের আলোতে চিক চিক করছে ওই জমে থাকা দু ফোঁটা জল। বেশ কিছুক্ষণ আর কোনও কথা বলতে পারলাম না শুধু ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর ভেতরের সেই উষ্ণতাটাকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম মাত্র।
এই ভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর লক্ষ্য করলাম যে ততক্ষণে আকাশের কিশোরী চাঁদটাও বেশ যুবতী হয়ে উঠে তার ভরা যৌবনের জোছনাকে আমার শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে মাখিয়ে দিচ্ছে আর আমিও দুচোখ বুজে সেই পরশকে সারাটা শরীরে মাখতে মাখতে তার বর্ণ গন্ধকে অনুভব আর উপভোগ করছিলাম। বেশ কিছুক্ষণের জন্যে হারিয়ে গেলাম মায়ার এক অজানা দেশে যেখানে আছে শুধুই আনন্দ শুধুই ভালোবাসা আর শুধু তৃপ্তির ছোঁয়া। আর এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া না করে আমিও নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম সেই বহমান অনাবিল অনন্ত আনন্দের প্রেম সাগরে।
শিকিয়াঝোরা
একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম বা কোনো জঙ্গলঘেরা বনবস্তিতে (যা আসলে একটা খুব ছোটোো গ্রাম) উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এখানে ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার জন্যে কোনোদিনও কখনও কোনও অ্যালার্ম ক্লক এর প্রয়োজন পড়ে না। এখানে মোরগ আর পাখির ডাকই হল এই গ্রাম্য পরিবেশের অ্যালার্ম ক্লক। আমারও তার ব্যতিক্রম হল না, সকাল আটটা থেকে নটায় ওঠার মানুষও ওই মোরগের ডাক আর বহু পাখির সম্মিলিত কলতানে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম ভোর পৌনে পাঁচটায়।
উঠেই মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘরের বাইরে। বাইরে এসে যে অপরূপ দৃশ্য দেখলাম আর শুনতে পেলাম অনেক পাখির সমবেত সুরেলা কন্ঠের কলরব, কলতান; যে কোনও মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এক সীমাহীন আনন্দ সাগরে।
যাই হোক ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে সকলের ব্রেকফাস্টটা দিয়ে দিতে বললাম কারণ ব্রেকফাস্ট করেই যাব প্রথমে শিকিয়াঝোরা আর তারপর মহাকাল মন্দিরে। মাদারিহাট থেকে আনা গাড়িটা আজ বিকেলের মধ্যে ছেড়ে দেব। যাই হোক আগে থেকে বলে দেওয়া গরম রুটি, কালোজিরে দিয়ে মুচমুচে কড়কড়া আলুভাজা, ডিমের পোচ, মিষ্টি আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি নিয়ে বেরলাম শিকিয়াঝোরার উদ্দেশ্যে।
রিসর্ট থেকে বেড়িয়ে রাজাভাতখাওয়া পর্যন্ত এসে আমাদের গাড়ি জয়গাঁও যাওয়ার রাস্তা ধরে কিছুটা এগোনোর পর বাঁদিকে ঘুরে একটা গ্রাম্য পথ ধরে পৌঁছে দিল শিকিয়াঝোরাতে। প্রবেশ, গাড়ি রাখা আর নৌকো চড়ার টিকিট কেটে ঢুকতে হল শিকিয়াঝোরার ভিতরে। এই শিকিয়াঝোরা হল আসলে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সাপের মতো কেবেঁকে চলা একটা ঝোরা। বক্সাতে যতবার আসি ততোবারই নৌকো চড়ে ঝোরার বুকে ভেসে এখানকার এক রহস্যময় জঙ্গলের শোভাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে চলে আসি। এই নৌকো ভ্রমণটা কিন্তু কোনও লেকের জলে নৌকোভ্রমণের মতো একেবারেই নয়। এর উত্তেজনা এর রহস্যময়তা এর ভীতিপূর্ণ মজা যে না উপভোগ করেছে তাকে লক্ষবার বলেও বোঝানো যাবে না।
একদম আক্ষরিক অর্থেই সাপের মতো এঁকেবেঁকে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে গেছে এই ঝোরা। মাঝে মধ্যে জঙ্গলের গাছ পড়ে রাস্তা আটকেছে অথবা জলের নিচে গাছ পড়ে নৌকোকে এগোতে দিচ্ছে না। আমাদের এই ফাইবারের নৌকোতে দুজন মাঝি ছিল। একজন বয়স্ক আর একজন একদমই বাচ্চা ছেলে। ওর বয়েস খুব বেশি হলে উনিশ কী কুড়ি হবে। ওরা দুজন মিলে নৌকোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল গভীর জঙ্গলের ভিতরে ঝোরাটার বুক চিরে। রাস্তায় অসংখ্য পাখি দেখতে পেলাম, একটা বিরাট ঈগলসহ। আমি একমাত্র ওই ঈগলটারই ছবি তুলতে পেরেছি যখন নৌকো আসার শব্দ পেয়ে উড়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই। এই ঝোরাতে জল খেতে আর এপাশের জঙ্গল থেকে ওপাশের জঙ্গলে যেতে প্রায়শই অনেক বন্য জন্তু আসে। সব থেকে বেশি আসে হাতি, হরিণ, বুনো কুকুর, শিয়াল, ময়ূর আর বাইসন।
নৌকোতে যাওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হয় দুটো জিনিসের ওপর। এক হল ঝোরাতে ঝুঁকে পড়া গাছের ডাল চোখে মুখে বা মাথায় লাগার আগে তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়া আর দু দিকের জঙ্গল থেকে কোনও বন্য জন্তু বা ঝোরার জল থেকে কোনও সাপ নৌকোতে চলে আসছে কিনা সেটা লক্ষ্য রাখা আর এটা লক্ষ্য রাখতে রাখতেই প্রকৃতিকে উপভোগ করতে হবে সারা শরীর ও মন দিয়ে, উপভোগ করতে হবে বিভিন্ন পাখির দেখা পাওয়া আর তাদের ডাককে, উপভোগ করতে হবে জঙ্গলের নিস্তব্ধতার মধ্যেই জলের ভেতরে বৈঠার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ আর বিভিন্ন বন্যজন্তুর ডাক, যা কোথা থেকে আসছে সেটা বোঝা না গেলেও কোন জন্তুর ডাক সেটা বুঝিয়ে দিল নৌকোর মাঝিভায়েরাই।
ওই কিশোর মাঝি ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় করে আর অনেক গল্প করে যে লাভটা হল যে বনদফতরের নিয়ম ভেঙে শাস্তি ও যে কোনোরকম দুর্ঘটনার ভয় না করে ওর একটা গুলতি আর একটা কুকরির ভরসায় জুতো খুলে প্যান্ট গুটিয়ে নৌকো থেকে কাদার মধ্যে নেমে পড়ে জঙ্গলে ঢুকলাম একটা হরিণের পাল দেখতে পেয়ে ওদের ছবি তুলতে। কিন্তু আমার পর্বতপ্রমাণ শরীরটাকে নিয়ে নৌকো থেকে কাদায় লাফ মারার শব্দেই এক ঝলকে অতগুলো হরিণ যে কোথায় লুকিয়ে পড়ল সেটা হাজার চেষ্টা করেও আর কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। এরপর দুজনে মিলে কয়েকটা সেলফি তুলে জঙ্গলের ভেতরে এগোতে গিয়েও অসংখ্য কাঁটাওয়ালা গাছের ঝুড়ি সরিয়ে বেশি দূর এগোতে পারলাম না। আবার ফিরে নৌকোতে উঠতে গিয়ে দেখলাম হাতি সহ আরও অনেক বন্যজন্তুর পায়ের ছাপ (সঙ্গে আমারও)। আমারটা ছাড়া কোনটা কোনও প্রাণীর পায়ের ছাপ সেটা পাটু বলে দিল। সেই পায়ের ছাপ-এর কিছু ছবি তুলে অনেক কষ্টে আবার নৌকোতে উঠলাম কারণ ততক্ষণে নৌকোটা বেশ কিছুটা দূরে সরে গেছে পাড় থেকে।
এরপর আস্তে আস্তে আবার ফিরে এলাম যেখান থেকে আমরা নৌকোতে চড়েছিলাম সেখানে। চলে আসার সময় দুজনকে মিষ্টি খাওয়ার জন্যে সাধ্যমতো কিছু টাকা দিলাম আর বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলাম ওদের কাছ থেকে। লিখতে লিখতে কিছুতেই ওদের দুজনের নামটা মনে করতে পারলাম না। এর পর ওখানে ওই গ্রামের মেয়েদের দ্বারা চালিত একটা খাবারের দোকান থেকে চা খেয়ে বেড়িয়ে পরলাম আবার জয়ন্তীর উদ্দেশ্যে মহাকাল দর্শন করতে যাব বলে পাহাড়ের ওপরে। পিছনে পড়ে রইল আমার খুব প্রিয় এই শিকিয়াঝোরা আর তার বুকে এই অসাধারণ নৌকোভ্রমণের স্মৃতি আর নাম ভুলে গেলেও মন থেকে আজও মুছে না যাওয়া ওই কিশোর মাঝিভাইটি।
মহাকাল
মহাকাল আসলে শিবঠাকুরেরই একটা রূপ বা তাঁরই একটা নামও বলা যায়। পাহাড়ের ওপরে অদ্ভুতভাবে তৈরি হওয়া একটা শিবঠাকুরের মন্দিরই হল আসলে মহাকাল মন্দির। এই মহাকাল মন্দির আবার একটা না দু-দুটো। অবাক লাগছে তো? হ্যাঁ, প্রথমে শুনে আমারও খুবই অবাক লেগেছিলো। আসল মহাকাল মন্দির, যেটাকে এখানকার মানুষরা বড় মহাকাল মন্দির বলে, সেটা পাহাড়ের বেশ অনেকটাই ওপরে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়েছে। এটা নাকি নিজের থেকেই তৈরি হয়েছে অনেকটা কেদারনাথ-এর মতো, এটা এখানকার মানুষের বিশ্বাস। আর সেখানে যাবার রাস্তাও বেশ কঠিন ও দুর্গম। সবাই পায়ে হেঁটে সেখানে যেতে পারে না বলেই নাকি ভগবানই সেই মন্দিরের অনেকটা নিচে আরও একটা প্রাকৃতিক মন্দির সৃষ্টি করেছেন যেটা আকারে বড় মহাকাল মন্দিরের থেকে অনেক ছোটোো আর একটা গুহার ভেতরে অবস্থিত। এটাকে এখানকার মানুষজন ছোটো মহাকাল মন্দির বলে।
আমি এর আগে এখানে এসে যদিও এই মন্দিরের কথা শুনিনি। এবারে তাই ওখানেই যাব বলে ঠিক করেছিলাম। যাওয়ার দিনটা যেহেতু শিবরাত্রির আগের দুপুর ছিল তাই সেদিন হাজারে হাজারে মানুষ পুণ্যঅর্জনের জন্যে সেই মহাকাল দর্শনে চলেছিল আর সেই জন্যেই সেদিন যেকোনো গাড়িকেই গাইড ছাড়াই ওখানে যেতে দিচ্ছিল বন দফতর। কিন্তু আমার নেওয়া গাড়ির ড্রাইভার কিছুতেই ওই পাথরের নদী পেরিয়ে পাহাড়ে উঠতে চাইল না। অগত্যা সাতশো টাকা দিয়ে একটা জিপ ভাড়া নিতে হল। ভাগ্য কিছুটা ভালো থাকায় জিপের চালক দাদা গাইড নিল না আর জিপে আরও দুজনকে তুলে নিল যারা খুব সম্ভবত নববিবাহিত কপোত কপোতী। এর ফলে আর্থিক চাপটা কিছুটা হলেও কমল।
জিপ নিয়ে রওনা দেওয়ার পর বুঝলাম যে ড্রাইভার দাদাই গাইডের কাজটাও খুব সুনিপুণভাবে করে দিচ্ছেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই প্রথমে জয়ন্তী পাহাড় ও নদীর ইতিহাস ও ভূগোলটা বলার সঙ্গে মহাকাল মন্দিরের ইতিহাসটাও জানিয়ে দিলেন। আরও বললেন যে আসলে মহাকাল মন্দিরে যে পাহাড়ে যাব সেটা কিন্তু ভারতবর্ষ নয় ভুটান। তাই পাসপোর্ট আর ভিসা ছাড়াই একটা নতুন দেশও ঘোরা হয়ে যাবে।
ড্রাইভার দাদার কথা শুনতে শুনতে আস্তে আস্তে নদী পার করে পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছি এমন সময় দেখি রাস্তার একটা জায়গায় কিছু মানুষ সব গাড়িগুলোকে রাস্তায় লাইন করে দাঁড় করিয়ে সেই গাড়ির সবাইকে গাড়ি থেকে নিচে নামিয়ে লাইন করিয়ে কপালে একটা যন্ত্র ঠেকিয়ে কী যেন পরীক্ষা করছে। এই লাইনে এগোতে এগোতে আমার পালা এলে পরে ওঁদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে এটা ভুটান সরকার সেই দেশে বাইরের দেশ থেকে আগত সমস্ত যাত্রীদের শরীরেই এই পরীক্ষা করছে, কারণ সারাবিশ্বে এক ভয়ংকর মহামারী করোনা ভাইরাস-এর আবির্ভাব ঘটেছে আর সেটা নাকি খুবই ভয়ঙ্কর ও ছোঁয়াচে। তাই তারা সবাইকে পরীক্ষা করে তবেই তাদের দেশে ঢোকার ছাড়পত্র দেবে। ওরা একটা যন্ত্র সবার কপালে ছুঁয়ে দেখছে। যে যন্ত্রটা সবার কপালে ছুঁয়ে দেখছে সেটা নাকি আসলে একটা ডিজিটাল থার্মোমিটার। আর সেই থার্মোমিটারে যদি কারোর জ্বর আছে দেখা যায় তাহলে তাঁকে ওই মহাকাল মন্দির-এ যেতে দেওয়া হবে না।
যাইহোক সবার করোনা ভাইরাস এর প্রাথমিক পরীক্ষা হবার পর জ্বর না থাকায় আবার এগিয়ে চললাম পাহাড়ের পথ ধরে। আর দুপাশে দেখতে পেলাম অসংখ্য ভক্ত আর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া বিভিন্ন রকমের ভান্ডারা। কেউ বিশ্রাম করার জায়গা দিচ্ছে কেউবা যাত্রীদের বিনে পয়সায় খাবারের ব্যবস্থা করছে। আর মানুষের স্রোত বয়ে চলেছে পায়ে হেঁটে, বাস, লরি, মোটর সাইকেল, জিপ সহ বিভিন্ন গাড়িতে চড়ে, শিবরাত্রির শুভলগ্নে, মহাকাল দর্শন করে পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে। পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা নদীর পাড়ে সবাইকে গাড়ি থেকে নেমে যেতে হল। কারণ ওই পর্যন্ত গাড়ি যাবে তার পরের পথ সবাইকেই পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। নেমে দেখলাম সেখানে ওই পাহাড়ের ওপরে নদীর তীরে একটা বেশ ছোটোখাটো মেলা বসে গেছে। আমাদের ড্রাইভার দাদা তার গাড়িটা একটা ভালো জায়গায় রেখে বললেন যে যদি এই বেলাশেষে বড় মহাকাল মন্দির দর্শনে যাই তাহলে সেখান থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে, কারণ আজ শিবরাত্রির আগের দুপুর বলে সেখানে প্রচুর লোকের ভিড় আর তাই সেখানে গিয়ে ঠিক মতো মহাকাল দর্শনও নাও পেতে পারি। তাই ঠিক করলাম ওই বড় মহাকাল মন্দিরের উল্টোদিকের পাহাড়ের কোলে, ছোটো মহাকাল দর্শন করেই এবারের মতো পুণ্য অর্জন করে ফিরে যাব আর পরে আবার অন্য যে কোনও সময় (বর্ষা কাল বাদে) এসে বড় মহাকাল মন্দির দর্শন করে যাব। আর এটা ঠিক করে ড্রাইভার দাদাকে সঙ্গে নিয়ে চারজনে প্রথমে একটা বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পেরিয়ে তারপর সত্যি এক দুর্গম পথ ধরে উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ের ওপরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে অত্যন্ত এক খাড়াই পথ ধরে। খুবই সংকীর্ণ এই পথ একসঙ্গে পাশাপাশি দুজন ভালো করে হাঁটতে পারা যায় না। খুবই সন্তর্পনে এই পথ উঠছি না বলে চড়ছি বলাই ভালো। তবে এই পথ চলতে চলতে যেটা লক্ষ্য করলাম ও অনুধাবন করলাম, সেটা হল ওই যুগলের মধ্যে মেয়েটির প্রথম এই পাহাড় চড়ার নতুন অভিজ্ঞতাকে সে খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে, তার খুবই প্রিয়, মনের ও কাছের মানুষটির হাত ধরে এই দুর্গম পাহাড়ের ওপরে উঠতে উঠতে। আর আমিও ওদের এই আনন্দ উপভোগ করাকে প্রশয় দিয়ে আর ওদের সঙ্গেই এই অকৃত্রিম, পবিত্র পরমানন্দে আনন্দিত হয়েই পৌঁছে গেলাম ছোটো মহাকাল মন্দিরে।
মন্দিরে পৌঁছে দেখে বহু সাধু আর পুণ্যার্থী আগেই ভিড় জমিয়েছে। আর দেখলাম পাহাড়ের গায়ে একটা খুব ছোটো একটা গুহা না বলে কুঠুরি বলাই ভালো সেখানে শিবের মূর্তি, শিবলিঙ্গ ও ত্রিশূল আছে আর এক পুরোহিত বসে সবার পুজো নিবেদন করে দিচ্ছে ভগবান শিবের কাছে। ওরা দুজন পরস্পর পাশাপাশি বসে মোমবাতি ধরাল আর পুজো দিল আর আমি আর ড্রাইভার দাদা দূর থেকেই প্রণামটা সেরে নিলাম। এরপর হঠাৎ করেই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে পাহাড়ের কতোটা ওপরে উঠে এসেছি যেটা উঠতে উঠতে বুঝতেই পারিনি। ওপর থেকে দুএকটা ছবি তুললাম নিচে বয়ে যাওয়া নাম না জানা এই নদীটার।
একটা বিষয় খুব অদ্ভুত লাগল সেটা হল এই মুহূর্তে জয়ন্তী নদীতে এক ফোঁটা জল না থাকলেও এই নদীটাতে কিন্তু বেশ ভালই স্বচ্ছ জল বয়ে চলেছে অবিরাম ধারায়। বহু মানুষ যেমন এই নদীর এই স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল খাচ্ছে আবার অনেকেই এই নদীর শান্ত, স্নিগ্ধ, শীতল জলে শরীরকে ভিজিয়ে নিয়ে পবিত্র ও শান্ত হচ্ছে।
ছোটো মহাকাল দর্শন করে গাইড ড্রাইভার দাদার দেখানো পথে আবার একটু ওপরে চলতে শুরু করলাম একটা পাহাড়ি ঝরনা দেখব বলে। খুব বেশি দূর যেতে হল না সেই ঝরনার দর্শন পেতে। আহা কী অপরূপ রূপ আর সৌন্দর্য এই অপরূপা লাবণ্যময়ী মোহময়ী রূপবতী পাহাড়ি ঝরনার। যার নাম না জানা হলেও সত্যি আবার নতুন করে প্রেমে পড়লাম ওই রূপবতী যুবতী নারীর যে কিনা তার ভিজে এলোচুলে, সিক্ত বসনে কটিদেশ উন্মুক্ত করে আকর্ষিত করছে আমার মতো বহু প্রকৃতিপ্রেমী পুরুষকে। আমি তো আমি, অদ্ভুত লাগল যুগলের সেই মেয়েটির কথা শুনে, যে কিনা তার মনের মানুষটির হাত ধরে তার কাছে বায়না ধরেছে সে নাকি এই পাহাড়, এই নদী আর এই পাহাড়ি ঝরনা দেখে এতটাই আপ্লুত ও উত্তেজিত যে তার আর এই জায়গা ছেড়ে ফিরে যেতে চায় না আবার ওই কলকাতার কংক্রিটের জঙ্গলে।
বেলা পড়ে আসছে দেখে অগত্যা ড্রাইভারদাদাসহ তিনজনে ওকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে চললাম ছোটো মহাকালকে আরও একবার প্রণাম করে নিচের দিকে নদীর পাড়ে যেখানে গাড়িটা রেখে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। নামতে নামতে ড্রাইভার দাদার কাছে শুনলাম যে এখানকার মানুষ নাকি বিশ্বাস করে যে মহাকাল-এর জটা থেকেই নাকি ওই ঝরনা বেরোচ্ছে আর সেই জলই নাকি ওই নদী দিয়ে বয়ে চলেছে মহাকাল-এর পা ধুয়ে দিয়ে।
ডুয়ার্স-এর শেষ দিন
সকালে আমি আর পাটু চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাকা রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা বক্সা ফোর্ট-এর দিকে যাবার পর ও আর আমি ডান দিকের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। জঙ্গলে ঢুকেই একটা সাদা বালি আর পাথরের রাস্তা ধরে কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল একটা নদী যেখানে এখন একদম জল না থাকলেও বর্ষাকালে এর জল কূল ছাপিয়ে পাকা রাস্তা আর তার পাশের গ্রাম ভাসিয়ে দেয়। এই বনবস্তির এত কাছে যে এমন সুন্দর একটা নদী আছে সেটা পাটু না থাকলে কিন্তু সত্যি জানতেই পারতাম না। ও বলল, এর আশপাশে এক্ষুণি একটা হরিণের পাল আর একটা ময়ূর ময়ূরীর দল ছিল কিন্তু আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে ওগুলো গা ঢাকা দিয়েছে। যদিও অনেক পরে দুটো ময়ূর ময়ূরীর দেখা পেয়েছি খুব অল্প সময়ের জন্যে। কিন্তু ওদের ডাক শুনে গেছি অবিরাম অবিরত। পাটু আর আমি বেশ কিছুটা হাঁটলাম ওই নদীটার শুকিয়ে যাওয়া বুকের ওপর দিয়ে। ও মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে কী শুনছিল আর গন্ধ শুঁকছিল সেটা তখন না বুঝলেও একটু পরে ও বলে যে দাদা আর এগোনো যাবে না খুব কাছেই একটা বুনো কুকুরের দল আছে। ওরা তাড়া করলে আমরা দুজনের কেউই আজ আর বাড়ি ফিরতে পারব না আর ওদের প্রাতরাশটা আজ দারুণ হবে তোমার আর আমার শরীরের মাংসে। এই কথা শোনার পর আর বেশি দেরি করিনি ওখান থেকে ফিরে আসতে। পাটু কিন্তু আসার সময় আমায় ওই বুনো কুকুর, ময়ূর আর হরিণের সাদা বালিতে টাটকা পায়ের ছাপও দেখিয়েছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটার আসার সময় এক বনরক্ষীর সঙ্গে দেখা হতে সে জানাল যে আজ জলের একটু অসুবিধা হবে তার কারণ গতকাল রাতে একটা হাতির দল, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বনবস্তিতে যাওয়ার সময় জলের পাইপ ফাটিয়ে দিয়েছে।
রিসর্টে ফিরে খুব তাড়াতাড়ি করে জলখাবার আর চা খেয়ে আবার দুজনে বেরোলাম ওই গ্রামটা ঘুরে দেখতে আর দেশি মুরগির খোঁজে। এই গ্রামে যে কয়টি পরিবার থাকে তাদের সকলের জীবিকা এই জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল আর এদের সবাই প্রায় আদিবাসী বা নেপালি। পাটুকে দোভাষী করে অনেকের বাড়িতে ঢুকে তাদের জীবন জীবিকা নিয়ে খোঁজ নিলাম আর জানতে পারলাম ওদের প্রতিদিনের জীবনসংগ্রামের কথা। ওদের বাগান থেকেও অনুমতি নিয়ে গন্ধরাজ লেবু নিলাম। কিন্তু দেশি মুরগি খাওয়া এবার আর হল না তার কারণ ওদের কাছে বিক্রির জন্যে যে মোরগ বা মুরগিগুলো আছে সেগুলো অনেক বড়। আর এতো বড় মুরগি নিয়ে এই দুপুরে সেটা খেয়ে শেষ করতে পারব না তাই সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র গ্রাম ঘুরে, গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে, গল্প করেই ফিরতে হল রিসর্টে। কারণ বিকেল সাড়ে চারটেয় ট্রেন ধরতে হবে আলিপুরদুয়ার স্টেশন থেকে। তাই রিসর্টে ফিরে আমি তাড়াতাড়ি স্নান পুজো সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম আর পাটুও দুপুরের রান্না সেরে নিয়ে আমায় খাইয়েও নিজেও খেয়ে নিয়ে সব গুছিয়ে নিল।
এবারে অপেক্ষা করতে লাগলাম দুর্গার জন্যে। দুর্গা কে বলুন তো? দুর্গা হল অটো ড্রাইভার - একটা ছেলে যার অটোতে চড়ে যাব আলিপুরদুয়ার স্টেশনে আর পাটু যাবে ওর বাড়িতে। যাইহোক দুর্গা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে এসে খুব তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে রওনা হল। পাটুও চলল সঙ্গে। বক্সা ছেড়ে রাজাভাতখাওয়া ছেড়ে কিছুটা এগোনোর পর দুর্গার অটো থামল পাটুকে নামানোর জন্য। পাটু খুব করে ওর বাড়িতে যেতে বললেও এবার আর সেটা হল না কারণ এমনিতেই আমার বেশ অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, তাই পাটুকে কথা দিলাম যে এর পরেরবার এখানে আসার সময় আমি আগে পাটুদের বাড়ি এসে ওর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তারপর ওকে নিয়ে যাবো 'ইকো হাট রিসর্ট'-এ।
অনেক দিন পর আবার আমি আমার খুব চেনা আলিপুরদুয়ার শহরটাকে দেখলাম, দেখলাম আমার অত্যন্ত পরিচিত আলিপুরদুয়ার স্টেশন আর স্টেশনের সেই পূর্বরেলের অতিথিশালাকে। যেখানে আমি চারবার থেকেছি এখানের 'ডুয়ার্স উৎসব' আর 'উত্তরের উৎসব'-এ গানের অনুষ্ঠান করতে এসে। খুব নস্টালজিক হয়ে আর কাউকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দুর্গাকে নিয়ে দেখালাম আর আমিও বহুদিন পর দেখলাম সেই অতিথিশালা আর থাকার সেই ঘরগুলোকে।
ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে যাওয়াতে তাড়াতাড়ি করে দুর্গার অটো ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনের নির্দিষ্ট কামরাতে। 'কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস' বিরাট একটা হুইসেল দিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে লাগল আলিপুরদুয়ার স্টেশন ছেড়ে, আর একরাশ মন খারাপ আর নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম জানলা দিয়ে সেই ফেলে চলা জঙ্গল আর চা বাগানের দিকে।
গান গাওয়াই পেশা এবং নেশা সুপ্রিয় চক্রবর্তীর। প্রিয় আঙ্গিক লোকসঙ্গীত। ভালোবাসেন সময় পেলে খানিক বেড়িয়ে আসতে, বিশেষত জঙ্গলে।