সবুজরানি দুয়ারসিনি

সৌমেন্দ্র দরবার


কথায় আছে বাঙালির পায়ের তলায় সরষে। বাঙালি মানেই দু-তিন দিনের ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়া প্রকৃতির সন্ধানে। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি বলে মন চাইছিল নতুন কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসতে। সবুজ প্রকৃতি আর তার কোলে শান্ত, নিরিবিলিতে দুদিন নিশ্চিন্তে অবসর। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। আমাদের এবারের গন্তব্য সবুজ রানি দুয়ারসিনি।
ওয়েস্টবেঙ্গল স্টেট ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির ইকোট্যুরিজম ওয়েবসাইট থেকে রুম বুক করে ট্রেনের টিকিটও কেটে ফেললাম। সকাল পৌনে সাতটার হাওড়া বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে করে শুরু হল যাত্রা। জানলা দিয়ে সবুজ প্রকৃতিকে দুচোখভরে উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললাম। খড়গপুর স্টেশনে ভাঁড়ে চা আর সঙ্গে গরম সিঙাড়া মনটাকে সতেজ করে দিল। প্রায় সোয়া নটা নাগাদ ট্রেন ঘাটশিলা পৌঁছল। ট্রেনযাত্রা এখানেই শেষ। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে অটোস্ট্যান্ডে এসে দেখলাম বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ায় জন্য নিদিষ্ট ভাড়ার চার্ট টাঙানো আছে। দুয়ারসিনির নিদির্ষ্ট ভাড়া আটশো টাকা। ঘাটশিলা থেকে দুয়ারসিনির দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। অটোর সঙ্গে কথা বলে পাড়ি দিলাম দুয়ারসিনির উদ্দেশ্যে।

কিছুদূর যাওয়ার পর ছোটো ছোটো পাহাড়ে ঘেরা দুদিকের প্রাকৃতিক নির্জন আর শান্ত পরিবেশ মন ভালো করে দিল। রাস্তার ধারে ছোট্ট একটা দোকানে অটো দাঁড় করিয়ে গরম গরম কচুরির সঙ্গে জিলিপি খেতে খেতে উপভোগ করলাম প্রকৃতির কোলে গ্রাম্য জীবনের সরলতা। প্রায় ঘন্টাখানেক পর অটো এসে উপস্থিত হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দুয়ারসিনি প্রকৃতি ভ্রমণকেন্দ্রে।

ঝাড়খণ্ড সীমান্তঘেঁষা বান্দোয়ানের অরণ্যসুন্দরী দুয়ারসিনি এককথায় অনবদ্য। টিলার ওপর ছবির মতো তিনটি কটেজ। মাঝের কটেজটি অনলাইনে বুক করা ছিল। অটো ভাড়া মিটিয়ে রিসেপশনে এন্ট্রি করে কটেজে এলাম। কটেজের ভেতরটা অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো। সমস্ত আসবাবপত্র কাঠের তৈরি। হাত-মুখ ধুয়ে ব্যালকনিতে বসতে বসতেই চা চলে এল। দুপুরের লাঞ্চ আগেই ফোনে বলা ছিল। এখানে খাবারদাবার ঘরোয়া কিন্তু সুস্বাদু। সেগুন গাছের মাঝে বাঁশের তৈরি ছাওয়ায় খাওয়ার ব্যবস্থা যেন স্বাদটা আরও বাড়িয়ে দেয়। দ্বিপ্রাহরিক আহার সাঙ্গ করে বিকেলের রোদ গায়ে মেখে চললাম প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে।

২৯৪ হেক্টরের প্রাকৃতিক জঙ্গলে ঘেরা দুয়ারসিনি। গভীর অরণ্যের মাঝে ছোটো ছোটো টিলা। কেন্দু-সেগুন-আসন-কুসুম-করণ-শাল-মহুয়া-আমলকি-বহেড়ায় ছাওয়া টিলাগুলি। ফাগুনে পলাশ ও শিমুলের রঙে রাঙা হয় দুয়ারসিনির আকাশ। কিছুদূরেই পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে শীতল সাতগুড়ুম নদী। কাচের মতো স্বচ্ছ জল, ছোটো ছোটো মাছ খেলে বেড়াচ্ছে।

গাছে গাছে কত নাম না-জানা পাখির কলরব। নাম না-জানা কত গাছে কত ফুলের বাহার। মনে হল যেন হারিয়ে যাচ্ছি প্রকৃতির গহনে। কাঠবেড়ালিগুলো খেলে বেড়াচ্ছে এক গাছ থেকে অন্য গাছে। সূর্য অস্ত যেতেই বুঝতে পারলাম প্রকৃতির কোলে সন্ধে নামছে। সে এক মোহময় পরিবেশ যা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। ফিরে এলাম প্রকৃতি ভ্রমণকেন্দ্রে। সন্ধেবেলায় চিকেন বলের সাথে গরম কফি। সন্ধেটা কাটল লনে ব্যাডমিন্টন খেলে। রাতে পরোটা আর কষা মাংস দিয়ে ডিনার সেরে মেঘহীন আকাশে তারাদের শুভরাত্রি জানিয়ে বিকেলের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। টিয়া, ফিঙে, দোয়েল, ময়না, মুনিয়া, কোকিল আরও কত নাম না জানা পাখি। চা খেয়ে বেরোলাম পাশের জঙ্গলে ঘুরতে। দেখা হল বনমুরগি, গোসাপ, গিরগিটি আর রং বেরঙের প্রজাপতিদের সঙ্গে।
কটেজে ফিরে প্রাতরাশ সেরে গাড়ি নিয়ে বেরোলাম ভালোপাহাড় আর বান্দোয়ানের উদ্দেশে। পথে দেখে নিলাম দুয়ারসিনি মাতার মন্দির, গ্রাম্য হাট, বি এস এফ ব্যারাক।

হাটে দেখলাম শাকসবজি, খাজা-গজা থেকে শুরু করে জামাকাপড়, চটি-জুতো, মাছ-মুর্গি নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেচা কেনা চলছে। কোথাও কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ভালোপাহাড়ে এসে মনটা ভালো হয়ে গেল। ১৯৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর কমল চক্রবর্তীর হাতে এর সূচনা।

হরেকরকম গাছ গাছালি, মাছ, গৃহপালিত প্রাণীদের থাকার ঠিকানা। এখানে আছে একটি অনাথদের স্কুল আর দাতব্য চিকিৎসালয়। সারা বছর এঁরা যুক্ত থাকেন বিভিন্ন সামাজিক গঠনমূলক কাজে। ভালোপাহাড়ে এলে মন ভালো হবেই। বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে গেলাম বান্দোয়ানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সবুজ যে এত সবুজ হতে পারে তা এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না।

ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়েই বিকেলের দিকে অলস পায়ে হাঁটা লাগালাম দুয়ারসিনি গ্রামের দিকে। গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছোটো ছোটো মাটির বাড়ি, নানারকম সুন্দর সুন্দর আলপনা আঁকা বাড়ির দেওয়ালে, দরজায়। গ্রাম দেখে গেলাম সানসেট পয়েন্টে। সানসেট পয়েন্টের রাস্তাটা অতীব মনোরম। এখানে এসে তো অবাক। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখি উড়ে যাচ্ছে এ গাছ থেকে ও গাছে। এত টিয়াপাখি আগে কখনও দেখিনি।

দেখতে দেখতে চারিদিক রঙিন চাদরে মুড়ে অস্ত গেল সূর্য। সে এক অপূর্ব মনোরম দৃশ্য। ফিরে এলাম কটেজে। চিকেন পকোড়া আর কফি খেয়ে আবার মেতে উঠলাম ব্যাডমিন্টন খেলতে। রাতে রুটি আর দিশি মুরগি। কেয়ারটেকার বাড়ি যাবার আগে বলে গেল রাতে যেন কমপ্লেক্সের বাইরে না যাই। জঙ্গলের এলাকা, এদিকে রাতের দিকে নানা রকম জংলি জানোয়ার ঘোরাফেরা করে। দলমা হাতির দলও নাকি এ রাস্তায় যাতায়াত করে মাঝেমাঝেই। বাইরে চারিদিকে ঘন অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মাঝে জোনাকিদের যেন আসর বসেছে। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে আনন্দে। সেগুন পাতা বাতাসের তালে খসখস শব্দ তুলছে। দূরের থেকে ভেসে আসছে মাদলের আওয়াজ। জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে অরণ্য।

পরেরদিন সকালের মিষ্টি রোদ্দুর গায়ে মেখে চলে গেলাম ঝোরার ধারে। বসলাম পাথরের ওপর। পায়ে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঝোরার ঠান্ডা জল। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। সকাল বড় মধুর হয়। তার মিষ্টি আলোয় ঝলমল করে ওঠে চারিদিক। হরেক রকম পাখির দেখা মিলছে এখান থেকে। এদিকটায় প্রচুর সজনে গাছ। সব ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। সজনে ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছে ফুলে ফুলে। মনোরম এক পরিবেশ যেখানে শুধু বসে থেকেই অনেকটা সময় কাটানো যায়। ফেরার সময় সজনে ফুল কুড়িয়ে এনে বড়া ভাজার জন্য রাঁধুনিদের দিয়ে এলাম।

কটেজে ফিরে এসে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম ঘাটশিলার উদ্দেশে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। মন ভারাক্রান্ত। অটোকে আগেই বলা ছিল, ঘুরে নিলাম ঘাটশিলার সমস্ত দর্শনীয় স্থান। পড়ন্ত বিকেলে বারবিল হাওড়া জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে পাড়ি দিলাম বাড়ির পথে। চোখে লেগে রইল অবর্ণনীয় সবুজ সৌন্দর্য।

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারীরবিদ্যাতে স্নাতকোত্তর ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট সৌমেন্দ্র দরবার বর্তমানে কলকাতার এক প্রখ্যাত ঔষধ প্রস্তুতকারক সংস্থার গবেষণা ও উদ্ভাবনবিভাগের পদাধিকারী। দেশে ও বিদেশের বহু জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে একটু ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়েন প্রকৃতির কোলে, অজানার সন্ধানে। কবিতাপাঠ ও লেখা তাঁর অন্যতম নেশা। ভোজনরসিক আর সংগীতপ্রিয় সৌমেন্দ্র ভালোবাসেন অবসরে কন্যার সঙ্গে সময় কাটাতে।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher