"ছুটির পাখিটা ছটফট করে রোজ
খাঁচায় বন্দি পালাতে পারে না তাই
দানাপানি তাকে যতই দাও না তুমি
পাখির কিন্তু ছুটির আকাশ চাই।"
দৈনন্দিন জীবনের মাঝে সেই আকাশটা খুঁজে নিতে শনিবার,১২ মে, ২০১১ সন্ধ্যায় কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমির জীবনানন্দ সভাঘরে ‘আমাদের ছুটি’-র বন্ধুরা আড্ডায় বসেছিলেন। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ও বিবিসি-র প্রবীণ সাংবাদিক ঊর্মি রহমান, কথাসাহিত্যিক মানব চক্রবর্তী, তথ্যচিত্র পরিচালক সৌমিত্র দস্তিদার। আড্ডায় অংশগ্রহণ করেন পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাস এবং ‘আমাদের ছুটি’-র বন্ধুরা। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত ।
সুমন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়-সুরে অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল ছোট্ট দুই ছুটি বন্ধু আকাশলীনা দাশগুপ্ত এবং তোর্সা চট্টোপাধ্যায়। স্লাইড প্রদর্শনীতে, ভদ্রকালী পদাতিকের সদস্য পর্বতারোহী সুব্রত দাস দেখান ‘মণিরাং অভিযান’-এর আলোকচিত্র এবং খ্যাতনামা ট্রেকার ও আলোকচিত্রী রতনলাল বিশ্বাসের ক্যামেরায় উঠে এসেছিল কাশ্মীর থেকে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ‘হিমালয়ের হ্রদরাজি’। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সুগত মুখোপাধ্যায়।
বন্ধুদের আগ্রহ ও উৎসাহে ‘আমাদের ছুটি’-র প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান স্মরণীয় হয়ে থাকল। আর দূরের যে বন্ধুরা সেদিন যোগ দিতে পারেননি এই আড্ডায়, অথচ উৎসুক হয়ে ছিলেন, তাঁদেরও সেই আড্ডার শরিক করে নিতে এবারের এই কথোপকথন।
♦আমার সঙ্গে, আমার পাশে আজ এমন কয়েকজন বিদগ্ধ মানুষ রয়েছেন যাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে 'ভ্রমণ' শব্দটা। বি.বি.সি.তে কাজের সূত্রে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরেছেন ঊর্মি রহমান। কলকাতার অলিগলি থেকে উপজাতি অধ্যুষিত গ্রাম-অরণ্য, দাঙ্গার আগুনে জ্বলতে থাকা গুজরাট, উত্তপ্ত মণিপুর প্রত্যক্ষ করেছেন সৌমিত্র দস্তিদার। সমাজমনস্ক তথ্যচিত্রকার হিসেবেই সৌমিত্রদাকে আমরা জানি কিন্তু সৌমিত্রদা এমন অনেক কাজ করেছেন যেগুলো ভ্রমণের ক্ষেত্রে বড় মাপের জায়গা - বর্ধমান, মালদা, বাঁকুড়ার পুরাকীর্তি, শঙ্করদেব কলাক্ষেত্র মিউজিয়াম, সুন্দরবন নিয়ে তোলা তথ্যচিত্র। মানুষের কথা লেখার জন্য বার্ণপুরের ইস্পাত কারখানার চাকরি ছেড়ে বছরের পর বছর সাঁওতালদের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন মানব চক্রবর্তী। তাঁর কলমেই উঠে এসেছে অন্তেবাসী বৃহন্নলাদের জীবনকাহিনি। আবার অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পাহাড়ে-সাগরে ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি। তবে শুধু মঞ্চের এই ক'জনই নন,আজ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন আমাদের সকলের প্রিয় ট্রেকার-ফোটোগ্রাফার রতনদা – রতনলাল বিশ্বাস, পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাস ও সুব্রত দাস, কথাসাহিত্যিক আলপনা ঘোষ, বোড়ো ভাষার অন্যতম লেখক-গবেষক হীরাচরণ নার্জিনারি এবং আপনারা সবাই – যাঁরা শত ব্যস্ততার মধ্যেও এখানে এসেছেন আড্ডা জমাতে।
'আমাদের ছুটি'-র ১ম বর্ষপূর্ত্তি উৎসবের আরো ছবি
♦ সৌমিত্রদার সঙ্গে আড্ডাটা আসলে বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছে। ওঁর কাছেই ঊর্মিদি, আপনার ‘এদেশে বিদেশে’ বইটা দেখছিলাম। আমার যেটা মজার লেগেছে যে আপনি যেভাবে বইটা সাজিয়েছেন, বাংলাদেশের সুন্দরবন আর পশ্চিমবঙ্গের লাভা-লোলেগাঁওয়ের মাঝে রয়েছে গ্রীস, মঁ ব্লা, টেমসের কথা, রাইখেনবাখ ফলস, পম্পেই নগরী। এ যেন বাংলা থেকে বেড়িয়ে বিশ্ব ঘুরে আবার বাংলায় ফেরা।
ঊর্মিদি বইটা সাজানোর সময়ও কী এইকথাটাই মাথায় ছিল?
ঊর্মি - হয়ত সেভাবে ঠিক ভাবিনি। আসলে আমার শৈশব কেটেছিল সুন্দরবনে। বাবা ফরেস্টার ছিলেন, আমরা থাকতামই হাউসবোটে। বড় হয়েও যখন অনার্স পড়ছি তখন আবার সুন্দরবনে থেকেছি। অতদিন থাকতে থাকতে সুন্দরবনের সঙ্গে একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভীষণরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মত। সেইজন্যই হয়তো সুন্দরবনটা প্রথমে এসেছে। আর যখন যেটা দেখেছি, লিখেছি, ইচ্ছা করেছে কারোর সঙ্গে শেয়ার করি। যেমন, একটা সুন্দর জিনিস দেখলে, ভালো একটা গান শুনলে, একটা ভালো কবিতা পড়লে আমাদের শেয়ার করার ইচ্ছা হয়...অন্য ভাষাভাষী মানুষদের কথা বলতে পারবনা তবে বাঙালির কিন্তু ভীষণ ইচ্ছা হয় অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করার...
♦আমাদের ছুটি-র ব্যাপারটাও কিন্তু তাই, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নেওয়া।
ঊর্মি -আসলে প্রকৃতির মতো ওরকম সুন্দর তো আর কিছু হয়না। গোটা পৃথিবীটা ছড়িয়ে আছে...নানান দেশে নানান জায়গা...সেখানে আমরা একজন গেলাম, দেখলাম দুচোখ ভরে, তখন মনে হয় একটু ছড়িয়ে দিই। সেই ভাবনা থেকেই লেখাগুলো এসেছে।
♦ ঊর্মিদি, আপনার লেখায় পম্পেই নগরীর কথা রয়েছে...ছেলেবেলায় 'লাস্ট ডেজ অব পম্পেই' খুব প্রিয় বই ছিল, কতবার যে পড়েছি...
সৌমিত্র – আমারও ভীষণ ফেভারিট ছিল...
ঊর্মি – একটা অ্যামেজিং জায়গা। ভিসুভিয়াসের লাভা এসে পুরো একটা জনপদ নিমেষে শেষ হয়ে গেল। লন্ডনে একটা টিকিট পাওয়া যায় ইন্টাররেল কার্ড - ১৬০ পাউন্ডের, সেটা কিনলে ইউরোপের উনিশটা দেশে ট্রেনে আনলিমিটেড সার্ভিস। আমরা ওভাবেই ইটালি গিয়েছিলাম... পম্পেইটা মনে হয়েছিল না দেখে আসা যাবেনা কিছুতেই।
♦সৌমিত্রদা, শুরুতে আপনার সম্বন্ধে যে কথাটা বলছিলাম রাজনৈতিক সত্তার বাইরে যে অন্য মানুষটা...আপনার অন্যরকম কাজ বা রাজনৈতিক তথ্যচিত্রগুলো তুলতে গিয়েও দেখা গেছে তার মধ্যেও প্রকৃতির অনুসঙ্গ চলে এসেছে বা কাজের ফাঁকে আপনি বেড়িয়েছেন...কিছুদিন আগেতো কাশ্মীরও ঘুরে এলেন...সেই বেড়ানোগুলোর কথা...আপনার অন্যরকম ভাবনাচিন্তার কথা...
সৌমিত্র – আসলে আমি জানিনা ঠিক এভাবে সাজিয়েগুছিয়ে মঞ্চে কতটা আড্ডা মারা যায়, তবে আমি আড্ডাবাজ মানুষ...
♦সেদিন আপনার বাড়িতে যে আড্ডাটা চলছিল তারই একটা এক্সটেনসন করে নিতে চাইছি...
সৌমিত্র – আজকে আমি অবশ্য একটু চাপে আছি...মানবদার মতো এরকম বিখ্যাত গল্পকার, লেখক, আর তার চেয়েও চাপে আছি যে ঘটনাচক্রে ঊর্মি রহমান শুধু যে বিখ্যাত তাই নন, আমার মামী শাশুড়িও বটে। শাশুড়িকে পাশে বসিয়ে কতটা আড্ডা মারা যাবে আমি জানিনা, মামাও বসে আছেন ওখানে।
মামীমা আসায় খুব ভালো লাগছে...তুমি যেখান থেকে শুরু করেছিলে, কালকে মামীমার বইটা পড়তে পড়তে একটা জায়গায় এসে...খুলনা থেকে বেরিয়ে একটা প্রায় নোম্যানস ল্যান্ডে এসেছে, ওপাশটা হচ্ছে দক্ষিণ চব্বিশ-পরগণা, আমার নস্টালজিয়া কাজ করল যে খুলনা আমার মামারবাড়ি, ওই সুন্দরবনটা আমার দেখা হয়নি, এই সুন্দরবনটায় আমি একাধিকবার গেছি। জানিনা মামীমা তুমি জানো কীনা, সুন্দরবনেই একটা দ্বীপ আছে, তার নাম রাখা হয়েছে খুলনা, আমি সেখানেও একাধিকবার গেছি। সমাজকর্মী তুষার কাঞ্জিলালের নামতো আপনারা জানেন। তুষারদা আর আমি পাশাপাশি থাকতাম। একদিন বললাম, তুষারদা আমি সুন্দরবন দেখতে যাব। উনি খুব রেগেটেগে বললেন তুই সুন্দরবন কী হিসেবে দেখতে যাবি, ট্যুরিস্ট হিসেবে? বললাম, ওই লোকে যেমন যায় লঞ্চটঞ্চ ভাড়া করে...উনি বললেন, তুমি একদম ওভাবে যাবেনা, যদি যেতে চাও গরমের দিন, যখন কালবৈশাখী হয়টয়...যথেষ্ট বিপদের একটা ভয় ভয় ব্যাপার থাকে...তবে অবশ্য এখানে দেবাশিস বিশ্বাস বা আরো যাঁরা আছেন তাঁদের কাছে অবশ্য বিপদটিপদ বলে একটু অস্বস্তিই করছে। যাইহোক, তুষারদাতো প্রায় ধাক্কা মেরে বললেন, তুই চলে যা...ঘটনাচক্রে সেই প্রথম কাছ থেকে সুন্দরবন দেখা। তারপরতো অনেকবার গেছি। মামীমার লেখা পড়তে পড়তে সেসব মনে পড়ছিল। আরও একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস, জানিনা মামীমাকে বলেছি কিনা, যেহেতু মামারবাড়ি খুলনা, আমি যখন প্রথম খুলনায় যাই, তখন কয়েকজন লেখক বললেন যে, এখন কারফিউ চলছে, এককাজ কর, আমরা গভীররাত্রে তোমায় খুলনা দেখাতে নিয়ে যাব। আমিতো রাত আড়াইটে-তিনটের সময় খুলনায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম, আর যেখানে যেখানে আমার সঙ্গী তিনজন আমায় নিয়ে যাচ্ছে...বলছে এটা কবরখানা...আমি বলছি হ্যাঁ, এটা সাহেবের কবরখানা, বলছে এটা পুকুর...হ্যাঁ, সাহেবের পুকুর। তারপরে আমিই বললাম, এটা ভৈরবের রাস্তা, এটা রূপসার রাস্তা। ওরা তখন ভাবছে, বাবা এই লোকটা কী জাতিস্মর, নাকি ভুতের ভবিষ্যতের কোন ভুত? আমি বললাম, না না, আসলে মার কাছে, দিদিমার কাছে এত গল্প শুনেছি যে ছবির মত হয়ে গেছে।
ঊর্মি – এখানে একটু বলে নেওয়া ভালো, রূপসা আর ভৈরব দুটো নদী। রূপসার চেয়ে ভৈরব অনেক ছোট, তবে সেটাও নদী, নদ নয়। আসলে কোনটা যে কেন নদী আর কেন নদ সেটা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।
সৌমিত্র - আমার ঘোরাটা খানিকটা এলোমেলো, খানিকটা ভালোলাগে বলে। যার সঙ্গে আমি সবথেকে বেশি ঘুরেছি,আমার স্ত্রী, উনিও এখানে রয়েছেন। সময়সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেরোই...মামীমার মতো সারা পৃথিবী ঘোরার সুযোগতো পাইনি...
ঊর্মি – না না, সারা পৃথিবী আমারও ঘোরা নয়।
সৌমিত্র – যাইহোক, তাও অনেকটা পৃথিবী। তাও ঘুরি...যখন পেশার জায়গাটায় আসি...দময়ন্তী, তুমি ঠিকই বলেছ...আমি প্রথম শুটিং করতে যাই মালদা। কিন্তু সেখানে বাংলার ইতিহাসের একটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ দিক লুকিয়ে আছে, আমি জানতামনা। পাঠান সংস্কৃতি কীভাবে ওখানে ঢুকেছে এবং লক্ষণ সেনের সময়ের সংস্কৃতির সঙ্গে তার মিশ্রণ বা মধ্যযুগে সংস্কৃতির যে মেলবন্ধন এটা মালদা আমাকে শিখিয়েছিল। এরপর বাঁকুড়া, বর্ধমান...তখন আমি একজন বড় গুরু পেয়ে গিয়েছিলাম...বিখ্যাত, অনেকেই নাম জানেন, তারাপদ সাঁতরা। আমরাতো শুটিংয়ের গ্রুপ নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটাও গল্পের মত, আড্ডার মতো। আমার প্রথম তিনটে ছবির ক্যামেরা করেছিল সব্যসাচী চক্রবর্তী, তখনই গোরা করে ও বেশ বিখ্যাত। আমি ওকে বললাম, তুই ক্যামেরা করলে একটা বিপদ হবে প্রচুর লোকজন দেখতে আসবে। বলল যে না না তেমন কেউ আসবেনা। বাঁকুড়ায় বহুলারা বলে একটা মন্দির আছে। সেটা এত উঁচু, টেন্থ সেঞ্চুরির মন্দির। যখন শুটিং করতে গেছি, দেখি পিলপিল করে গ্রাম থেকে লোক আসছে। প্রথমেতো আমি খুব উত্তেজিত, ভেবেছি বোধহয় শুটিং দেখতে আসছে, তারপরে দেখি আমাদের পাত্তাই দিচ্ছেনা। সবাই সব্যসাচীর অটোগ্রাফ নিচ্ছে।
মানবদার কথাও আমরা শুনব। মানবদার বইটাও আমি দেখছিলাম...সাঁওতালদের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। এখানে হীরাচরণ নার্জিনারিও আছেন। হীরাদা আবার বলবেন এইতো তোমাদের দোষ, তোমরা আদিবাসী বলতে শুধু সাঁওতাল আর মুণ্ডা আর মাহাতোদের বোঝ। আমরা যারা বোড়ো, লেপচা আমাদের কি কোন অস্তিত্বই নেই? ওই গ্রামগুলোতে গিয়েও কিন্তু আমার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল... ছোট নদী, বোড়ো গ্রাম, বৃষ্টি পড়ছে,...বোড়ো সভ্যতার একটা প্রাচীন ইতিহাস আছে।
আমার ঘোরাটা খানিকটা পেশার কারণে। যেটা দময়ন্তী প্রথমেই বলছিল, মণিপুরের কথা...মণিপুর নিয়ে যখন ছবিটা যখন প্রথম প্রথম দেখান হচ্ছে তখন খুবই উত্তেজনা, হইচই চলছে, মণিপুরের মেয়েরা, মায়েরা নগ্ন প্রতিবাদ করেছেন, সেই ছবিটি। সেইসময়ে লোকে আমায় জিজ্ঞাসা করেছে যে কী আমাকে সবচেয়ে বেশি টানল? সবাই ভাবছে যে আমি বলব রক্তারক্তি ব্যাপার...সেগুলোতো নিশ্চয় আমাকে ভাবিয়েছে, ব্যথা দিয়েছে, নইলে ছবিটা আমি করলাম কেন? কিন্তু আমার ভালোলেগেছে মণিপুরের অত রক্তগঙ্গার ভেতরেও অদ্ভুত রঙের একটা সূর্য অস্ত যাচ্ছে...নীল নদী। তারপরে আমি মামীমাকেও বলেছিলাম, কোনদিন যদি সুযোগ পাওতো ঘুরে এস মৈরাং থেকে, সুভাষ বোস যেখানে প্রথম জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন...লোকতাক – এশিয়ার অন্যতম বড় হ্রদ। লোকতাকের ঠিক উল্টোদিকেই মায়ানমার। একসময় যুদ্ধ করতে রাজারা মায়ানমার থেকে আসত। ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে যেটা মনে হয় অন্যরকম একটা পৃথিবী আছে, সেটা আমার ঘুরে দেখতেও ভালোলাগে, আবিষ্কার করতেও ভালোলাগে।
আরেকটা কথা মামীমা যেটা বলছিলেন, বা মানবদাও হয়তো বলবেন, সত্যি শেয়ার করতে ইচ্ছা করে। কুড়ি মিনিটের কী আধঘন্টার একটা ছবিতে হয়তো কোন একটা বিষয় নিয়ে কিছুটা চর্চা হয়, সেটা হয়তো ছবির দিকটা, কিন্তু তার বাইরেও যে কতরকম ছবি থাকে...কতরকম নদী দেখা যায়, মানুষ দেখা যায়, কতরকম প্রকৃতির কথা আমরা বুঝতে পারি, জানতে পারি, কত পাখি, কত গাছ...আমাকে এগুলো ভীষণ টানে। ইনফ্যাক্ট, আমার শ্যালক আছেন, ডঃ কল্লোল দাস, কল্লোল তো দীর্ঘদিনধরেই পাহাড়ে চড়ে, ওর পাল্লায় পড়ে আমাদেরও কিছু কিছু জায়গায় ট্রেক করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি জিজ্ঞাসা করতাম, তোরা এই পাহাড় দেখছিস, কিন্তু তোদের কখনো কি মনে হয় এগুলোর নীচে নীচে যে গ্রামগুলো আছে সেগুলোর অবস্থা কী? গ্রামগুলো কত পালটে যাচ্ছে গত পাঁচবছরধরে...দশবছরধরে...গোটা পৃথিবী কত পালটে যাচ্ছে...। চল্লিশ বছর-পঞ্চাশ বছর আগে আপাতসরল যে জীবন ছিল তা কি আছে? আমারও জানতে ইচ্ছা করে। যেখানেই যাই তাই মানুষের সঙ্গে মিশি, দেখি জনজীবন কেমন, স্থাপত্য কেমন...সেটাই এখানে চেষ্টা করলাম শেয়ার করা যায় কিনা।
♦ সৌমিত্রদা, খুব ভালোলাগছে আপনার সঙ্গে গল্প করতে, এই যে দেখার ব্যাপারটা, গত সংখ্যায় কথোপকথনে বসেছিলাম রতনদার সঙ্গে – রতনলাল বিশ্বাস, রতনদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ছবি দেখতে দেখতে আমার সেই কথাই মনে হচ্ছিল। আজকে যেমন আমাদের ইচ্ছা ছিল আড্ডায় অডিয়েন্সকেও টেনে নেওয়া। পাগলের মতোই হয়তো আইডিয়াটা। কিন্তু আল্টিমেটলি জানলাম কর্ডলেস মাইক পাওয়া যায়নি।
সৌমিত্র, মানব (সমস্বরে)– মাইক ছাড়াও শোনা যাবে...শোনা যাবে...
♦ মানবকাকু, তুমিতো সদ্য অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প ট্রেক করে ফিরলে, এর আগে আরওতো নানান জায়গায় গেছ, তোমার বেড়ানোর গল্প একটু বল।
মানব – প্রথমেই আমি ‘আমাদের ছুটি’-র সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই...একটা ভালো কাজ হয়েছে। সাহিত্যের সভাসমিতিতো অনেকই হয়, কিন্তু নিছক ভ্রমণ...আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিন্তু ভ্রমণ সুপ্ত আছে, কারও পাখা মেলে কারও মেলেনা। তফাত শুধু এইটুকুই। কিন্তু প্রত্যেকটি মানুষই প্রতিমুহূর্তে ভ্রমণের মধ্যেই আছে। আট বাই দশ ঘরে থাকলেও মনটা কিন্তু মাঝে মাঝেই উড়াল দেয়...কখনো সেটা ঘটে, কখনো ঘটেনা। সেই হিসেবে আমরা সবাই ভ্রমণকারী। তোমরা যে এই উদ্যোগটা নিয়েছ তার জন্য অকুন্ঠ ধন্যবাদ তোমাদের পাওয়া উচিত। চমৎকার অনুষ্ঠান...হলভর্তি...ওই যে বললাম, প্রত্যেকের মনের মধ্যেই একটা ভ্রমণপাখি আছে, যার সুযোগ পাচ্ছে উড়ছে, যার পাচ্ছেনা, উড়তে পারছেনা।।
♦ আর সেইজন্যই বোধহয় সবাই এখানে হাজির হয়েছেন, সেই ভ্রমণপাখিটার টানে...।
মানব – ডেফিনিটলি, এটা একটা ব্যাপার, আর দ্বিতীয় একটা ব্যাপার, আমার আরও ভালো লাগছে, এই অনুষ্ঠানের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল রতনলাল এবং দেবাশিস থাকায়। ওরা আমাদের সমগ্র বাঙালি জাতিকে গর্বিত করেছে, এরজন্য ওদের কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। দেবাশিস, বসন্ত সিংহ রায়, রতনলাল এরা আমাদের মাথার খুব দুর্মূল্য মুকুট। এঁরা কী করেছেন তা আপনারা জানেন, কীকরবেন তাও জানতে পারবেন...সবচেয়ে বেশী বুঝতে পারবেন যখন এঁরা আর করবেননা। সেইদিন আরও বেশী করে বোঝা যাবে বাঙালি কী পারে, কী পারেনা, বাঙালির কী দুর্দম স্পৃহা।
আমি নিজে তেমন কিছুই ট্রেকার নই, শখতো আছে, একটু বেশী বয়সেই শুরু করেছি পাগলামি। এই ধরো পঞ্চকেদার, ঘরের কাছে সান্দাকফু, হেমকুণ্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার, কোস্টাল ট্রেক – পয়েন্ট ক্যলিমার টু কুড্ডালোর। সেটা আবার রতনবাবুরই লেখা থেকে নোটফোট বার করে...একবছর আগে। কিছুদিন আগে অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প করলাম। সদ্য কিশোর থেকে যৌবনে পা রাখা ছেলেমেয়েদের পাহাড়কে ভালোবাসা, প্রকৃতি মুখী করার আমার একটা টেনডেন্সি আছে। সেটা শুরু করেছিলাম আমার ছেলেকে দিয়ে...সান্দাকফু ঘুরে আসার থেকে ও আমাকে বলে, আমি দিল্লি-বোম্বে যাবনা বাবা, আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে চল...ওকে নিয়ে এবারে ঘুরে এলাম, আজকেও নিয়ে এসেছি। ও খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে, শুনছে...দেবাশিস, রতনলালের নাম এত শুনেছে, এখন চাক্ষুস দেখছে, এটা আমার কাছেও একটা বড় প্রাপ্তি।
ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনের বিরাট একটা বিস্তৃতি হয়। পাহাড়ের কাছে গেলে বোঝা যায় যে উচ্চতায় আছে, তার চেয়ে আমরা মানুষ কত দীন, কত হীন, কত ছোট। এর পাশাপাশি এটাও সত্য যে কোনকিছুই অগম্য নয়, কোনকিছুই দুর্গমনীয় নয়। একজন বিখ্যাত পর্বতারোহীর কথা আছে – ম্যান ইজ সিক্স ফিট টলার দ্যান এভারেস্ট। অর্থাৎ এভারেস্টের মাথার ওপর যে লোকটা দাঁড়ায় সেও কিন্তু এভারেস্টের থেকে ছ'ফিট উঁচুতে থাকে। সুতরাং এভরিথিং ইজ পসিবিল। আমি ষাট পেরিয়েছি, আমি দেখেছি সত্তর বছরের এক অস্ট্রেলিয়ান দোর্দণ্ড পদক্ষেপে এবিসি-র দিকে হেঁটে যাচ্ছেন, এক হাঁটু বরফের মধ্যে। এবছর প্রচণ্ড আইসফল হয়েছে। মৎসপুছাড় বেস ক্যাম্পে সারারাত ধরে বরফ পড়ে গেছে। সকালে উঠে দেখছি ধু ধু বরফে ঢাকা। আমরা শুধু অপেক্ষা করছিলাম ওই ভদ্রলোকের জন্য। উনি যেই বেরিয়ে গেলেন, ওঁর ফুটপ্রিন্ট ধরে ধরে আমরাও এগিয়ে গেলাম। আসলে বয়সটা কোন ফ্যাক্টর নয়। পাহাড়কে ভালোবাসা, প্রকৃতিকে ভালোবাসা...
একটু আগেই সৌমিত্রদা আরেকটা কথা বলছিলেন, সেখানকার মানুষ, সত্যি তাদের সততার কোন তুলনা নেই। যদি সামান্য কিছু বিচ্যুতি ঘটে থাকে তা আমাদের মত সমতলের লোকেদের জন্য, একথা বলতে আমি দ্বিধা করিনা। আমরা সস্তার লজেন্স, বিস্কুট দিয়ে ওদের মন জয় করার চেষ্টা করি। কিন্তু ওদের যে প্রকৃত সমস্যা...আমরা কজন ট্রেক শেষ হওয়ার পর ওদের সমস্ত ওষুধপত্র দিয়ে আসি? আমরা কজন ব্যবহার করা প্লাস্টিক নিজেদের স্যাকে রেখে আবার সমতলে এসে ফেলব, তা করি? এখন ভারতীয় আর নেপাল হিমালয়ান রেঞ্জে যে মাত্রায় পলিউশন হচ্ছে তা অকল্পনীয়। শুধুমাত্র এভারেস্ট রিজিওনে 'ক্লীন এভারেস্ট' বলে একটি অভিযান সংগঠিত হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রীদের নিয়ে, সেখানে বিশ টন, বাইশ টন ওয়েস্ট বার করা হয়।
পাহাড় আমাদের যে উচ্চতার কাছে নিয়ে যায়, সমুদ্র যে গভীরতার কাছে নিয়ে যায়, এটা মানুষের মনে একটা বিরাট ফেলো ফিলিং তৈরি করে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার পেছনের লোকের কষ্ট হচ্ছে, আমি এগিয়ে যাচ্ছি, নাহয় কিছুক্ষণ ওর স্যাকটা আমি টেনে দিলাম। এই ফেলো ফিলিংটা কিন্তু জীবনের বড় প্রাপ্তি। আজকে আমরা কী দেখছি...কলকাতাতেই তো বাপি সেন মারা গেল, চোখের সামনে অ্যাসল্ট হচ্ছে কেউ দেখছেনা, চলে যাচ্ছে...আমার বন্ধু তরুণ লেখক সৌগত ঘোষ কলকাতার রাস্তায় পড়ে রক্তপাত হতে হতে মারা গেল। একজন পাহাড়কে ভালোবাসা লোক, একজন প্রকৃতিকে ভালোবাসা লোক, একজন ট্রেকিংকে ভালোবাসা লোক, একজন অজানার সন্ধানে ছুটে যাওয়া লোক কিন্তু একজন অসুস্থ লোককে দেখলে পালিয়ে যাবেনা। অবশ্যই তাকে তুলবে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ তার ভেতরের সেট আপটাই সেভাবে তৈরি হয়ে গেছে। পাহাড়কে বা জঙ্গলকে ভালোবাসায় মানুষের ভেতরের যে জিনিসটা প্রকাশিত হয়, সেটাই আমাদের বোঝাতে হবে তরুণদের কাছে, কিশোরদের কাছে। আমাদের তো অনেক বয়েস হয়ে গেছে, কষ্ট হয়। কিন্তু যাদের শরীরে সেই সক্ষমতা আছে, অল্পবয়স, তারা যখন ইন্টারেস্টেড হবে তখন আসল সুফল পাবে আমাদের সমাজ। সব কিছুর পেছনেইতো একটা সোশ্যাল কমিটমেন্ট আছে। এই যে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসগুলো আছে, স্কুল-কলেজের ছেলেরা যত বেশি এতে যাবে, তত শুভ প্রবৃত্তিগুলো জাগরিত হবে। এই মোটো নিয়েই আমি এখনো ঘুরে বেড়াই। এই ভালোবাসাটা বেঁচে থাকুক। বিবেকানন্দ একটা খুব মজার কথা বলেছিলেন, জ্ঞান হচ্ছে সমুদ্র, তুমিতো পুরো সমুদ্রের জল পান করতে পারোনা যে তুমি জ্ঞানী হবে। তুমি কী করতে পার? তোমার হাতে একটা কাপ আছে, তা দিয়ে তুমি তোমার তৃষ্ণা নিবারণ করতে পার। অর্থাৎ তোমার যতটুকু জ্ঞান প্রয়োজন ততটুকু তুমি সমুদ্র থেকে অর্জন করতে পার। আমিও তাই বলি, এই পৃথিবী বিশাল বৈচিত্র্যময়। ঘুরে বেড়ানোর শেষ নেই। ভারতবর্ষ শেষ করতেই জীবন চলে যাবে। সুতরাং, তাতো হবেনা। আমার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য দু'চার কাপ যদি আমি সংগ্রহ করতে পারলাম, আমি তাতেই তৃপ্ত।
♦ আলপনা – মানব, তোমাকেতো অনেকদিনধরে দেখছি...তোমার অনেকগুলো দিক, এরমধ্যে ভ্রামণিক মানবকেই আমরা এখন দেখছি। পাহাড়ের কথা তো বললে কিন্তু সমতলে তোমার যে ভ্রমণ, তোমার একটা সঙ্গীও ছিল, ওয়ান্ডার। আর তুমি যেখানে থাক, তার নাড়ি-নক্ষত্র, অলিগলি সবকিছু তুমি জানো বা জানার চেষ্টা কর। ভ্রমণ করতে গেলে ভালোবাসা চাই, সাহস চাই এবং জানার আগ্রহ, সবথেকে বড় কথা বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা যেটা তোমার মধ্যে আছে।
মানব – বৌদির এই প্রসঙ্গ ধরে বলি, আমার একটা স্কুটার ছিল তার নাম 'ওয়ান্ডার'। আমি জানিনা অযান্ত্রিকে গাড়িটার নাম ঠিক কী ছিল...
সুগত -‘জগদ্দল’।
মানব – হ্যাঁ জগদ্দল। কিন্তু অযান্ত্রিকের সঙ্গে আমার গল্পটার একটা তফাত আছে, আমার ওয়ান্ডার আমাকে বিপদ থেকে সচেতন করে দিত। আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগের কথা বলছি, তখন খুব ডিস্টার্বড জায়গা, ওই দিকটায় কেউ যেতোনা। মেদিনীপুর, গোপীবল্লভপুর হয়ে, উড়িষ্যা হয়ে, বারিপদা হয়ে লুলুং চলে গেলাম। লুলুং থেকে চলে গেলাম বিশই পাহাড় বলে একটা জায়গা। স্কুটার যতদূর যায়, তারপরে লক করে রেখে দিই, সেখানে গ্রামে গিয়ে রাত কাটালাম। সকালে উঠে দেখি আমার স্কুটারের ওপর একটা বাঁদর বসে লুকিং গ্লাসে মুখ দেখছে। চারপাশটা কুয়াশায় ভিজে আছে। দৃশ্যটা দেখে ছবি তুললাম। ওয়ান্ডারকে নিয়ে একটা গল্প লিখলাম গল্পটার নাম ‘ওয়ান্ডারের মৃত্যু’, ওই নামে আমার একটা গল্প সঙ্কলনও আছে। যেখানে কাউকে চিনিনা তেমন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম ওয়ান্ডারের সঙ্গে।
♦ আলপনা – তোমার ভ্রমণ আর গল্প-উপন্যাস লেখা – এর মধ্যে সম্পর্কটা কী? 'সভ্যতার রথ'-এ বোধহয় সেই উত্তরটা আছে।
মানব – এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। আসলে ভ্রমণ একটা জিনিস, সাহিত্য একটা অন্য জিনিস। বিশেষ করে ফিকশন। ফিকশনের মধ্যে লেখকের কল্পনাশক্তি কাজ করে। ভ্রমণে কিন্তু তা করেনা। উমাপ্রসাদের যে ভ্রমণবৃতান্ত আছে, বা আমাদের বাংলাসাহিত্যে চিরকালীন যেসব নামকরা ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে, ভ্রমণকাহিনী পড়ার মানসিকতা নিয়ে পড়লে সেটা ভালো লাগবে, আদারওয়াইজ, আমি যদি তারমধ্যে গল্প-উপন্যাসের আদল খুঁজি, আমার কিন্তু ভালো লাগবেনা। 'অমৃতকুম্ভের সন্ধানে'-তেও সমরেশ বসুকে মূল ভ্রমণকাহিনী থেকে সরে মানবিক আখ্যানের দিকে ঢুকতে হয়েছিল। মানবিক আখ্যানটাকে বাদ দিয়ে শুধু ভ্রমণকাহিনী কিন্তু ততটা আকর্ষণীয় হয়না। তাই ক্রিয়েটিভ লেখক চেষ্টা করে চরিত্রগুলোকে নিজের মতো গড়ে নিতে, কিন্তু পাহাড়কে তো আর নিজের মতো গড়া যায়না, সেতো শাশ্বত, প্রকৃতির সৃষ্টি, সেইজায়গায় একজন লেখক মার খায়। তবু বলছি, আজ থেকে পনের বছর আগে যখন আমি প্রথম সান্দাকফু যাই, তখন একটা উপন্যাস লিখি। কলকাতার 'দিশা' বলে একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। নাম দিয়েছিলাম, 'শীর্ষতা'। তাতে আমি একটা জিনিস দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম, একজন মানুষ যখন উঠতে উঠতে একেবারে ওপরে পৌঁছে যায়, সর্বোচ্চ জায়গায় চলে যায়, ধরুন, এভারেস্টে যায়, আর তো তার ওপরে যাওয়ার জায়গা নেই। ওখানে একটা ফিলোজফি কাজ করছিল – একদম এক্সট্রিম ওপরের পর আবার ডিসেন্ডিং শুরু হয়। অবতরণ একসময় শুরু করতেই হবে। আমি ভ্রমণকাহিনী সেভাবে লিখিনি, কিছু পত্রপত্রিকায় লিখেছি। কিন্তু তা কতটা সাহিত্য আমার নিজেরই সন্দেহ আছে।
সুগত - আমার একটা প্রশ্ন ছিল, আড্ডাটাতো খুব সুন্দর জমে উঠেছে, খুব ভালোই লাগছে, আমরাও খুব ইনভলভড হয়ে পড়ছি। আপনাদের তিনজনের কাছেই আমার এই প্রশ্নটা, আপনাদের ভ্রমণের সময়ে আপনারা সেরকম ভয়ঙ্কর কোন অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছেন কিনা বা সেরকম নাড়া দেওয়ার মতো কোন ঘটনা যদি আপনাদের কাছে থাকে। সেটা যদি আমাদের একটু বলেন তো খুব ভালোলাগবে।
♦ আমারতো মনে হয় বিপদ ঘটার মতো জায়গার কথা ভাল বলতে পারবেন দেবাশিসদা। এবারে যে অন্নপূর্ণা শিখর ছুঁয়ে এলেন সেই অভিজ্ঞতার কথা একটু বলুননা।
(মাইক হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আড্ডা জমিয়ে তোলেন দেবাশিস বিশ্বাস)
দেবাশিস – আসলে বিপদের মধ্যেইতো আমরা যাই, আমরা জেনেই যাই যে এটা কতটা বিপদসঙ্কুল। আমি হয়তো যেটা ভাবছি তেমন বিপদ না, সেটা বেশী ডিটেলসে বললে হয়তো মনে হবে মারাত্মক একটা জিনিস। এভারেস্টে গিয়েছিলাম ২০১০-এ। টোটাল আটান্ন দিন লেগেছিল। প্রতিদিন কিছু না কিছু তো ঘটেইছিল, আসলে ছোট করে বলাটা খুব মুস্কিল। আটান্ন দিন ধরে বললেও হয়তো শেষ করতে পারবনা। আমরা দক্ষিণ দিক দিয়ে গিয়েছিলাম। দুদিক থেকে ক্লাইম্ব করা যায় – চিনের দিক থেকে আর নেপালের দিক থেকে। সেবছর চিন সরকার কাউকে পারমিশন দিচ্ছিলনা। নেপালে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প পর্যন্ত অনেকেই যান, সেখানপর্যন্ত বলার মতো কোন ঘটনাই নেই। এভারেস্ট বেসক্যাম্পের পরে খুম্বু আইসফলটা পড়ে, ফুটিফাটা একটা এলাকা, সেটা পার হওয়াটা কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জিং। বিপজ্জনক বলবনা, কারণ আমরা জেনেই গেছি, পড়াশোনা করেই গিয়েছিলাম যে কতটা বিপদ আছে। সেটা ওভারকাম করতে হবে, এটা আমাদের মাথায় থাকে সবসময়। তবে বিপদের ভয়টা যদি মাথায় চলে আসে, এইধরণের বড় এক্সপেডিশনে যদি কোন হেজিটেসন আসে, তখন তার ব্যাক করে আসাই ভালো।
যেকোন বরফের নদী আমরা জানি মুভ করে, ওপর থেকে নীচের দিকে আসে। লিকুইড আর সলিডের মধ্যে ফারাকের জন্য এটা যেকোন বাঁকে ক্র্যাক হতে থাকে। কোনসময় যখন আড়াআড়ি টার্ন নেয় তখন কোনাকুনি ক্র্যাক আসে – ক্রিভার্স বলে। নীচে যদি কোন উঁচুনীচু থাকে, তখন অন্য একটা ক্র্যাক আসে – এরকম দুরকম ফাটল আসে। ছোট ছোট ফাটলগুলো – এক ফুট, দেড় ফুট আমরা লাফিয়ে পার হই। কিন্তু যখন বড় ফাটল হয়, তখন তার ওপরে মই পাততে হয়, কোনসময় একটা, দুটো ... খুম্বু আইসফলে দেখা গেছে অনেকসময় পাঁচটা-ছ'টা মইও একটা সেট থেকে আরেকটা সেটে যাওয়ার জন্য বাঁধতে হয়। নীচ থেকে মনে হয় যে মইয়ের ওপর দিয়ে কিভাবে যাব, পায়ে ক্র্যাম্পন থাকে, ব্যালেন্স করাটা খুব মুস্কিল। এতো বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে যাওয়া নয়ত যে রেলিংটা ধরলাম। একটা দড়ি দেওয়া থাকে। তবে দড়ি ধরে কোন সাপোর্ট নেওয়ার থেকে না নেওয়াই ভালো, পায়ের ওপর দাঁড়ানোটাই ভালো। সিঙ্গল ল্যাডারের ওপর দিয়ে হাঁটা সহজ, কিন্তু যখন দুটো বা তিনটে-চারটে জোড়া থাকে তখন কাঁপতে শুরু করে। আর নিচের দিকে যখন তাকিয়ে দেখছি যে অন্ধকার তখন মনের কোন জায়গায় একটা কাজ করে যে ঠিকঠাক যেতে পারব কিনা। খুব চ্যালেঞ্জিং, প্রতিটা ক্রিভার্স পার হওয়ার পর মনে একটা স্যাটিসফেকশন আসে যে এটাও পেরে গেলাম। এটা একবার করলে হয়না, বারেবারে করতে হয়, অ্যাক্লেমাটাইজ করার জন্য। আমরাতো একেবারেই জিরো লেভেলের মানুষ। সি লেভেল থেকে বড়জোর তিরিশ ফুট, চল্লিশ ফুট – আর আমরা যাচ্ছি ঊনত্রিশ হাজার ফুটে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা – মাইনাস পঁচিশ, মাইনাস তিরিশ...হাওয়া বাড়লে মাইনাস পঞ্চাশেও নেমে যেতে পারে। এভারেস্টের মাথার দিকে আটহাজার, সাড়ে আটহাজার মিটারের ওপরে প্রচণ্ড হাওয়া – ১৮০-১৮৫ কিলোমিটার পার আওয়ার। একটা মানুষকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সেখানে খাপ খাইয়ে নিতে হয় – প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, কীংবা প্রচণ্ড হাওয়া, বাতাসে অক্সিজেন খুব কম, বাতাসের প্রেসারও খুব কম। বারেবারে পার হতে হয়, আমাদের খুম্বু গ্লেসিয়ার তিনচারবার ক্রস করতে হয়েছিল। একবার এরকম নীচে নামছিলাম, তখন আমাদের দুবার ওঠানামা হয়ে গেছে, নামার সময় দেখছি কয়েকজন ফরেনারকে একজন শেরপা দেখাচ্ছে কীকরে এই ল্যাডার ক্রস করতে হয়। আমাদের ওপর থেকে নামতে দেখে সরে গেছে। আমি নামতে গিয়ে পায়ের ক্র্যাম্পনদুটো ফাঁকের মাঝখানে আটকে গেল, আটকে যাওয়ামাত্র আমি পা টানতে গিয়ে পড়ে গেলাম। আমাদের সাইডে যে দড়িটা থাকে তার একটা ছোট্ট এক্সটেনসন থাকে কোমরে বাঁধা, তার মাথায় একটা ক্যারাবিনার থাকে, ছোট্ট সেফটিপিনের মতো, কিন্তু অনেক ওয়েট ক্যারি করতে পারে। আমরা যদি পড়েও যাই তাহলে একেবারে নীচের গর্তে পড়বনা, ঝুলতে থাকব। কিন্তু যদি দড়িতে ঝুলি তাহলে শরীরটাকে টেনে তোলা কিন্তু খুব কঠিন। ওইটুকু ঝোলাতেই কিন্তু প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার মতো কষ্ট হতে পারে। কিন্তু আমি পারলামনা, যখনই টাল খেয়ে গিয়েছিলাম, তখনই রিফ্লেক্স হোক আর যাই হোক, দুপাশে পা দিয়ে বসে পড়লাম, ঘোড়ার পিঠে বসার মত। যখন উঠলাম, আমার মনে হল, যাদের শেখাচ্ছে তারা হয়তো ভয় পেয়ে যেতে পারে। তাদেরতো প্রথমদিন শেখাচ্ছে কীভাবে ক্রিভার্স ক্রস করতে হয়। আমি বললাম, যদি কোনসময় তোমাদের পা ফসকে যায়, তাহলে এভাবেই বসে যাবে। আমি বুঝতে দিলামনা যে আমি পড়ে গেছি, ওরা ভাবল হয়ত ওদের ডেমোনস্ট্রেশন দিল একটা।
এরকম ঘটনাতো অনেক থাকে। যেমন এভারেস্টের আরেকটা ঘটনা বলি, ক্যাম্প থ্রি উঠে গেছি, উঠে আবার নেমে এসেছি। তো ক্যাম্প থ্রি-র জায়গাটায় এভারেস্টের সাইডে লোৎসে বলে একটা পিক আছে, ফোর্থ হায়েস্ট পিক। তার ওয়ালে আইস কেটে পাব লাগাতে হয়। ওখানে কিছু হাম্প - বরফের দ্বীপের মতো থাকে, ওটা হ্যাঙ্গিং গ্লেসিয়ারের মতো। সেগুলো ভেঙ্গে পড়ার ভয় থাকে। আবার যখন উঠে ক্যাম্প থ্রি শিফট করব, গিয়ে দেখি ওপর থেকে হ্যাম্প ভেঙ্গে তাঁবুগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এটা কিন্তু আমরা থাকতেও হতে পারত। বিপদ কিন্তু প্রতি মুহুর্তেই আছে। আমরা যখন চার নম্বর ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছি, সাউথ কল, তখন দেখছি একজন রাশিয়ান মারা গেছে, তাকে নামিয়ে আনছে, অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিল। যেকোনসময়েই অ্যাক্সিডেন্ট ঘ্টতে পারে। আমি যে অক্সিজেন মাস্ক ইউজ করছি সেটার পাইপটা হয়তো ফুটো হয়ে গেল। সাড়ে আটহাজার-নহাজার মিটারের ওপরে যদি মাস্কটা কোনকারণে কাজ না করে আমারতো মনে হবে আমাকে বালিশ চাপা দিয়ে রেখেছে, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাব।
এবছর অন্নপূর্ণায় গেছিলাম, অন্নপূর্ণাকে তো বলে কিলার মাউন্টেন। মোট চোদ্দটা আটহাজারের মিটারের ওপর পিকের মধ্যে সবথেকে আগে ক্লাইম্ব হয়েছে অন্নপূর্ণা ১৯৫০ সালে। আবার সবচেয়ে কম ক্লাইম্বও হয়েছে এটা। আর সবথেকে বেশী ডেথ এখানে হয়েছে, সবথেকে বেশী অ্যাক্সিডেন্ট। যেকারণে অ্যাক্সিডেন্ট হয়, অ্যাভালাঞ্চ নামে। একটা জায়গায় একটা নালার মত আছে। ওটা ক্রস করতে হয়। তার উপরে বিশাল জায়গা জুড়ে প্রতিমুহূর্তেই ভাঙ্গতে পারে। ভাঙ্গলে ওই নালাতেই আসবে। ফুডোয়ার্ক বলে আমাদের মাউন্টেনিয়ারিং-এর ভাষায়। আমাদের জানাই ছিল যে ওটা দিয়ে অ্যাভালাঞ্চ আসে, যত তাড়াতাড়ি পারবে ক্রস করবে। কিন্তু এতো কলকাতার রাস্তা না যে দৌড় মারলাম। আমি একটা আইস ওয়ালে ক্লাইম্ব করছি। আমাদের যদি আধঘন্টা-চল্লিশ মিনিট টাইম লাগে আমাকে ওই সময় ধরেই ক্লাইম্ব করতে হবে। যদি অ্যাভালাঞ্চ আসে আমাকে সেটা মেনে নিতে হবে। এবং আসলও, আমরা যখন ক্রস করছিলাম, ক্যাম্প টু থেকে ক্যাম্প থ্রি, বিরাট একটা অ্যাভালাঞ্চ আসল। প্রথমে আমার যেটা কাজ করল, সৌমিত্রদা যেটা বলছিলেন, শেয়ার করা, আমরা যে চোখটা দিয়ে দেখছি, আমিতো খুব রেয়ার জায়গায় গেছি, কালকে আবার ইচ্ছা হলে আমি সেখানটায় যেতে পারবনা। সেখানকার প্রচুর ছবি তুলি, রতনদাও যে ছবি তুলে নিয়ে আসে, তার পিছনেও ওই মোটিভেশনটাই কাজ করে যে শেয়ার করব সবার সঙ্গে। যখন অ্যাভালাঞ্চের আওয়াজটা আসল তখন আমার মাথায় প্রথমেই এল ক্যামেরাটা বের করি। মরতে মরতে অ্যাভালাঞ্চের ছবিটা তুলে নিয়ে আসি। আমি না থাকি, ক্যামেরাতো থাকবে। কিন্তু ক্যামেরা বের করার আগেই অ্যাভালাঞ্চ নেমে চলে এল। প্রচণ্ড বড় একটা অ্যাভালাঞ্চ আসল, কিন্তু কপাল ভালো যে ওইযে স্নো...আমরা বাংলায় সবই বরফ বলে দিই, কিন্তু আইস আর স্নো-র তফাত আছে। স্নো একেবারে গুঁড়ো বরফ – নানারকম শেপ থাকে - পাউডারের মতন, পেঁজা তুলোর মতন, সাবুদানার মতন। পাউডার স্নোগুলো আমার গায়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর আইসের চাঙ্কগুলো যে নামল, প্রচুর বড় একটা, সেটা কিন্তু ডান সাইড দিয়ে বেরিয়ে গেল। ততক্ষণে কিছুটা নালা ক্রস করে বাইরে চলে এসেছি। সেদিনই আবার অ্যাভালাঞ্চ আসে, যখন আমরা ক্যাম্প থ্রিতে গিয়ে তাঁবু খাটালাম। অনেকগুলো তাঁবু ছিল। আমরা তুষারধ্বস বলি, কিন্তু সবসময় ওটা ঠিক অ্যাভালাঞ্চ নয়। ওপর থেকে একটা আইসব্লক ভেঙ্গে আসল। অ্যাভালাঞ্চ আসে কিন্তু আইসব্লক সচরাচর আসেনা। পাশেই একটা বড় ওয়াচটাওয়ার ছিল, সেটা ভেঙ্গে চলে এসেছিল। পাশের দুটো তাঁবু পুরো গুঁড়িয়ে দিল। অনেক মাউন্টেনিয়ার উঠছিল, তারা পরেরদিন খুব ভয় পেয়ে গেল এই দুটো ঘটনায়। পরেরদিন ১৮ তারিখ সকালবেলায় সবাই নীচে চলে গেল। আমরা অনেক পরে শুরু করেছিলাম। ওরা ২৬ মার্চ থেকে ওখানে বসে আছে, বারেবারে ওঠানামা করেছে। আমরা ৯ এপ্রিল পৌঁছেছিলাম। ১০ তারিখ রেস্ট নিয়ে ১১ তারিখ ওঠা শুরু করেছিলাম। এদিন আমরা ডিসিশন নিলাম, নামবনা নীচে, ওপরের দিকে উঠে যাব। ক্যাম্প থ্রি উঠে এসেছি, এবার সামিটের দিকে যাব। আমরা কিন্তু তারপরে ১৯ তারিখ রাতে বেরিয়ে ২০ তারিখ সামিট করলাম।
মানববাবু বললেননা যে অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে গিয়েছিলেন, খুব বাজে ওয়েদার। পুরো হিমালয়েই খুব বাজে ওয়েদার ছিল। অনেক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, অনেকে মারাও গেছেন। দিল্লির একটি ছেলে অর্জুন বাজপেয়ী, বুকে জল জমে গেছে, পালমোনারি এডিমার জন্য নামিয়ে আনতে হয়েছে। আমাদের ভাগ্যটা এতটাই ভালো পরেরদিন উঠে গেলাম, সামিট হল। সেই বিদেশিরা কিন্তু এখনও বসে আছে, সামিট হয়নি। হয়তো মা অন্নপূর্ণা চেয়েছিলেন আমরা ক্লাইম্ব করে আসি, তাই দশদিনের মধ্যে আমরা ক্লাইম্ব করে আসতে পেরেছি।
বিপদের গল্প করলেতো প্রচুর গল্প। আমি অনেক এক্সপেডিশনে গেছি, তবে সবাই জানে এভারেস্ট থেকেই।
মানব – আমার একটা প্রশ্ন আছে। একটা এক্সপেডিসনের আগে কীরকম শারীরিক প্রস্তুতি নাও? অনেক তরুণ ছেলেমেয়েরা জানতে চায়।
দেবাশিস – একটু খাটতে হয়। আমি প্রচুর দৌড়োই। এখন আমার এমন অবস্থা হয়েছে যে আমাকে বারণ না করলে হয়তো আমি দৌড়তেই থাকব। আর ফ্রীহ্যান্ড করি। ব্রিদিং প্র্যাকটিস। এখন আমি অনেকক্ষণ শ্বাস না নিয়েও থাকতে পারি। তবে পাহাড়ে যাওয়া, আমি আটহাজার মিটারের কথা বলছিনা, সে সান্দাকফুই হোকনা কেন, সবেতেই কিন্তু শারীরিক জোরের থেকে মানসিক জোরটা বেশি জরুরি। আমি যদি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি, আমি কোনদিনও বিকেভঞ্জন থেকেই সান্দাকফু উঠতে পারবনা। আমাদের কী হয় এখন, মনে হয়, আমি ওইখানে গেছিতো, এটা কিছু হবেনা। ওটাই আমার মানসিক জোরটা বাড়িয়ে দেয়।
তেষট্টিদিন ধরে আমাদের কাঞ্চনজঙ্ঘার অভিযান চলেছিল...
♦ 'আমাদের ছুটি'-র এই সংখ্যায় দেবাশিসদার কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে লেখাটা বেরিয়েছে।
দেবাশিস - খুব ভালো করেছে আমি দেখেছি। দু-তিন পৃষ্ঠায়তো পুরোটা ধরান সম্ভব নয়, একেবারে টাচ করে গেছি। আমি ওদের বললাম, আমিতো আর ফেসবুক খুলে নিজেরটা ভালো হয়েছে সেটা কমেন্টস করতে পারিনা, শুধু লাইক করে দিয়েছি। প্রেজেন্টেসনটা ভালো হয়েছে। 'আমাদের ছুটি'-র এই প্রোগ্রামটা খুব ভালো, দময়ন্তী আমাকে যখন বলেছে, প্রথমেই বলেছিল, আমি বললাম আগেরদিন একটু আমায় ফোন করে দিও, আমি নিশ্চয় আসব। আমরা যেমন একটা থেকে আরেকটা শৃঙ্গে আরোহণ করছি আমিও চাইব 'আমাদের ছুটি' যাতে প্রকাশনার জগতে এভারেস্টের মত উচ্চতায় উঠুক।
♦ অনেক ধন্যবাদ দেবাশিসদা।
শ্রোতা - অত ওপরে যখন যান, তখন জলতো জমে যায়, জলটা কীভাবে পান?
দেবাশিস - ওপরে যখন যাই, জল জমে যায়। বললামই যে মাইনাস তিরিশ, মাইনাস চল্লিশ...আমি ফেদার জ্যাকেটের ভেতরেও ছোট বোতলে জল রাখার চেষ্টা করেছি, দুশো মিলিলিটারের বোতল, জমে গেছে। জল খাওয়া যায়নি। আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে বেরিয়ে সামিট করে ফিরে এসেছি সাড়ে আঠাশ ঘন্টায়, একফোঁটা জল পাইনি। অন্নপূর্ণাতেও আগেরদিন রাত দশটায় বেরিয়ে পৌঁছেছি পরেরদিন সকাল দশটা-সাড়ে দশটায়, আবার ফিরে এসেছি বিকেল চারটে নাগাদ। একফোঁটা জল পাইনি। জল ছাড়াই যেতে হয়েছিল।
♦আমাদের সময় সীমিত হয়ে গেছে, আমি সৌমিত্রদাকে একটা প্রশ্নের ভেতর দিয়ে আমাদের আড্ডাটা শেষ করব। সৌমিত্রদা, পাহাড় থেকে এবার কলকাতায় ফিরি। আপনার ‘ইতিহাসের কলকাতা’ তথ্যচিত্র রয়েছে, আপনার ‘এলোমেলো’ বইটাতেও কলকাতার কথা পড়েছিলাম। সেদিনকেও আড্ডা দিতে গিয়ে আপনি বলছিলেন এখনও কলকাতার অলিতেগলিতে আপনি ঘুরে বেড়ান। কলকাতা নিয়ে একটু আমাদের বলুন।
সৌমিত্র – প্রথম কথা হচ্ছে যে দেবাশিসের বলার পর অতটা উচ্চতায় গিয়ে আবার কলকাতায় ফিরব! আমি যে কোথায় চলে গেছি...
♦ওই জন্যইতো একটু বাস্তবে ফিরে আসতে চাইছি।
সৌমিত্র - ছোটবেলায় স্কুলে পড়তে ডিউক, পিনাকী বলে দু’জন আন্দামানে গিয়েছিল, আমরা তাদের দেখতে ভিড় করেছিলাম। আর তখন ভাবতেই পারিনি যে আমার সামনে দেবাশিসের মত একটা ছেলে বসে থাকবে, যে এভারেস্টের মাথায় উঠে গেছে! আমরাতো পাঁচ ফুট দু ইঞ্চির বাঙালি – আমাদের যাওয়া মানে দীঘা আর পুরী...
কলকাতা মানে, ওই যে বললামনা তারাপদ সাঁতরার পাল্লায় পড়েছিলাম, ওঁর কাজই ছিল পায়ে হেঁটে গোটা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ানো। কলকাতাতেও উনি আমায় বলতেন, এইটা দেখ, ওইটা দেখ, কতরকমের স্থাপত্যরীতি আছে। তার আগেতো সবাই যেমন কলকাতা দেখে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তাই দেখতাম কী বড়জোর দুচারটে সাধারণ বইটই পড়লাম। ওনার এক চেলা, সে এখন প্রায়শই লেখে, দেবাশিস বোস, পেশায় ডাক্তার, নেশায় কলকাতা গবেষক, বাংলার ইতিহাস নিয়ে কাজ করে আরকী। দেবাশিস প্রথমেই বলল, ওগুলো ফেলে দাও। বললাম, ফেলে দেব কেন? ও বলল, কারণটা হচ্ছে, ওরা কেউ পায়ে হেঁটে দেখেনি। তুমি যদি পার, পায়ে হাঁটতে শুরু কর। এইভাবেই কলকাতা দেখা। তবে কলকাতায় তো এত চমৎকার, চমৎকার জায়গা আছে - মাইকেল কোথায় ব্যাপটাইজড হয়েছিলেন, সেইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা চার্চ। গোটা কলকাতা সেদিন ভাগ হয়ে গিয়েছিল, গোঁড়া হিন্দুরাতো প্রায় বিক্ষোভই ডেকে ফেলেছিল। বা ধর যেখানে জব চার্ণকের সমাধি আছে। এইগুলো যেমন সাহেব কলকাতা। ঠিক তেমনি আমার দেখতে ইচ্ছা করে, জানতে ইচ্ছা করে হাতিবাগান নামটা কেমন, কোথায় হাতিরা ছিল আরকী, হালসিবাগানটা কোথায় ছিল। আবার আমরা জোড়াবাগান বলতে যে জায়গাটা বুঝি, ইতিহাস তা বলেনা। ইতিহাস বলে যে, সেটা আসলে রোড টু জোড়াবাগান। যে জায়গাটাকে আমরা চিৎপুর বলি সেটা হল রোড টু চিৎপুর। ডেভিড হেয়ার যেখানে থাকতেন, যেটা এখন নিক্কো হাউস হয়েছে বা আলেকজান্ডার ডাফ যেখানে থাকতেন, ঘটনাচক্রে আমি সেই কলেজেই পড়তাম – স্কটিশ চার্চ কলেজ -১৭৫ বছরের ছবিটাও আমাকেই করতে হয়েছিল। আমার মাস্টারমশাই অলোক রায় বলেছিলেন যে লাইব্রেরিতে দেখলে হয়তো মিনিটস পেতে পার। সেটা দেখে শিহরিত হয়েছিলাম যে আলেকজান্ডার ডাফ স্কটিশচার্চ কলেজ প্রতিষ্ঠা করছেন। আমার কলকাতা দেখা খানিকটা হচ্ছে ওই, বই ঘাঁটা, দেখতে দেখতে নতুন করে ভাবা...
আরেকটা কথা এইখানে বলি, যেটা মানবদা ধন্যবাদ জানিয়েছে, আমিও দময়ন্তী আর রত্নদীপকে বলব...কিন্তু আমার একটা কোথায় ভয় হয় এভারেস্ট যতই পড়ি পাতার পর পাতা, এটা যে চট করে সাহস নিয়ে কেউ যাবেনা, কিন্তু এটা কী হয়, কষ্ট লাগে যে, বাঙালি ঘুরতে ভালোবাসে এটা যেমন সত্যি ঠিক তেমনি বলে, আচ্ছা, এখানে বাঘ দেখা যাবেনা? এমন চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে যে, আপনারা বলেছিলেন, বাঘ আসবে, কই বাঘতো এলনা!!! আবার কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা, অমুক জায়গায় যাচ্ছি,কী দেখার আছে বলুনতো? আমার বউ একবার আমায় শর্ত দিল যে পুজোর সময় আমরা এমন জায়গায় বেড়াতে যাব সেখানে যেন কোন বঙ্গসন্তানের দেখা না পাওয়া যায়। আমি বললাম, এরকম বিরল ঘটনা চাঁদ ছাড়া আর কোথাও আছে বলে আমি জানিনা। যাইহোক, আমরা তার আগে পশ্চিম উড়িষ্যার একটা জায়গায় শুটিং করতে গিয়েছিলাম, লামটাপুট। গদোবা আদিবাসীদের জায়গা, সেটা হচ্ছে কোরাপুট হয়ে মাচকুণ্ড বলে একটা জায়গা আছে, সেইখানে। এর একদিকে উড়িষ্যা আর অন্যদিকে অন্ধ্র – দোদামার ডাক – বিখ্যাত লেখাও আছে, মানবদা ভালো বলতে পারবেন। মাচকুণ্ড হয়ে আওরা গুনাইপাড়া হাটে আসছি, অসাধারণ একটা সূর্য অস্ত যাচ্ছে...কোন বইতেও নেই, হাজার ছবি তুললেও হয়তো পাওয়া যাবেনা। হঠাৎ করে মনে হল সামনে দিয়ে কারা যেন যাচ্ছে কুকুরের মত। গাড়িটা থামাতে বললাম – অসম্ভব সুন্দর একটা নেকড়ে দম্পতি, তারা বিস্মিত হয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, আমরাও দেখছি...। আমাদের সঙ্গে দুজন বঙ্গসন্তান ছিলেন, আমাদেরই বন্ধু, তাঁরা এত চিৎকার করতে লাগলেন, ওরে ওরে দেখ নেকড়ে, নেকড়ে...নেকড়েতো সেই যে গেছে, আমার ধারণা আজ অব্ধি তারা ওখানে ফিরে আসেনি...
অ্যাডভেঞ্চারের কথা বললে একটা জায়গার কথা বলা যেতে পারে, একবার শুটিং করতে গিয়ে ঝড়ের সময় রায়মঙ্গলে দুই বন্ধুতে মিলে রাত কাটিয়েছিলাম। যদি বর্ষায় কারো সুন্দরবন যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে বলব অতি বড় সাহসীরও বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবে। সারেংকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটাতো ডুবে যেতে পারে, বলল, ডুবেতো প্রায়ই যায়। তখন বললাম, সারারাত্রিতো থাকব, লঞ্চতো ডুববে, তাছাড়া আর কী কী হতে পারে? বলল, এমনি কিছুনা, এখানে একরকম সাপ আছে, আমরা বলি ঘামছা...বললাম, সেটা কীরকম? ওই সুড়সুড় করবে, মনে হবে কেউ কাতুকুতু দিচ্ছে, যেই নড়বেন, একটা সঙ্গে সঙ্গে জিব বের করবে, আপনি মরে যাবেন। তারপর অনেকক্ষণ পরে ঝড়টা যখন শান্ত হল, ভোর হল, আমার বন্ধু, সেই ফিল্মের এডিটর মহাদেব শী বলল, দেখতো ভালো করে আমরা বেঁচে আছি কিনা?
শ্রোতা ( দেবাশীষ রায়) - বিপদের কথা হচ্ছে দেখে একটা কথা মনে এল, আমাদের ছুটি ডট কম-এর দুরকম পাঠক আছে, একদল হচ্ছে, দু-তিনমাস আগে থেকে টিকিট-ফিকিট কেটে, বাক্স-প্যাঁটরা বেঁধে, কোথায় গিয়ে নামতে হবে, কে নিয়ে যাবে...এভাবে ভ্রমণ করতে ভালোবাসে, আরেকদল হচ্ছে, ওই বেরিয়ে পড়ল, যেদিকে দুচোখ যায়। দুটোর ক্ষেত্রে দুরকম বিপদ। একটা বিপদতো হচ্ছে অজানা, বিপদ যদি জেনেই যাব, তাহলে বিপদের কোন মাহাত্ম্য নেই। আর যারা ওভাবে প্যাকিং করে যেতে ভালবাসে তাদের কাছে মসকুইটো কয়েল নিয়ে যাব কিনা সেটাও একটা বড় বিপদ। ওখানে গিয়ে ইন্ডিয়ান স্টাইল না কমোড সেটাও একটা বড় বিপদ। আমিই যেমন একটু এদিক-ওদিক চলে যেতে ভালোবাসি, আর আমার গিন্নী চান ওই মসকুইটো কয়েলটাও প্যাক করে নিতে। যদি আমাদের ছুটি ডট কম এমন কিছু পথের সুলুক-সন্ধান দেয়, আমাদের চেনা পথের বাইরে কিছু অফবিট জায়গার তাহলে আমাদের মত মানুষেরা আরও আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
সৌমিত্র - দময়ন্তীর কাছ থেকে সময়টা কেড়ে নিয়েই আমি বলছি, এটা খুব সত্যি কথা। এমনকী কলকাতাতেই এত অজস্র জায়গা আছে – যেমন বেলেঘাটায় যেতে যেতে গ্রীক সেমেটারি যদি দেখেন, এত চমৎকার স্থাপত্য, কলকাতায় খুব একটা নেই। আমি বলছিনা যে শুধু কলকাতাই দেখতে হবে। কিন্তু অনেক শহরে এটা আছে, এভাবে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা ট্যুরিজম বলতেই বুঝি শুধু চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া, শহীদ মিনার। কলকাতার পুরোনো বাড়িগুলো যদি আপনি দেখতে শুরু করেন, শুধু যদি চিৎপুর রোড ধরে আপনি হাঁটেন... চিত্রসেনের মন্দির থেকে শুরু করে আমাদের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পাশে দেবেন ঠাকুর প্রথম যে ধর্মসমাজ তৈরি করেছিল, যেটা এখন গোডাউন হয়ে গেছে, যে বাড়িতে কেশব সেন জন্মেছিলেন... আমার মনে হয় এগুলোর দরকার এইকারণে, যাঁরা নতুন এলেন তাঁরাতো বটেই, আমরাও যারা কলকাতায় থাকি, কলকাতায় বড় হয়েছি বলে গর্ববোধও করি, আমরা কিন্তু কিছু জানিটানিনা। আমিও দময়ন্তীকে এটা সাজেশন দেব, এটা যদি কোনভাবে লেখা যায়, আমরা ছুটির দিনে যখন বাচ্চা নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাই, কোথায় গ্রীক চার্চ আছে, সেটাও বোধহয় আমরা দেখে আসতে পারি।
♦আপনারা দুজনেই খুব ভালো বললেন। আসলে আমাদের ছুটিতো শুধু আমরা দুতিনজন মিলে করা নয়, চেনা-অচেনা সব বন্ধুরা মিলেই করা। আমাদের এই বন্ধুরাই তথ্য দিচ্ছেন, নতুন জায়গার খবর দিচ্ছেন। এভাবেই আমরা নিশ্চয় আস্তে আস্তে চেনা জায়গার পাশাপাশি নানান অচেনা জায়গার তথ্যে-লেখায়ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠব।
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই আড্ডা শেষ করছি। খুব ভালো লাগল আপনাদের সবার সাথে কথায়-কথায় এতক্ষণ কাটাতে।
'আমাদের ছুটি'-র ১ম বর্ষপূর্ত্তি উৎসবের আরো ছবি