মাওয়ালি পাসের পথে
সুদীপ বিশ্বাস
~ মাওয়ালি পাস ট্রেক রুট ম্যাপ || ট্রেকের আরো ছবি ~
১৪ জুন, ২০১১
আজ থেকে আমাদের আটজনের দলের হাঁটা শুরু। আজকের গন্তব্য কেদারনাথ। ১১ তারিখে কলকাতা থেকে দুন এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে গতকাল রাত্রে গৌরীকুণ্ড পৌঁছেছি। আমরা অর্থাৎ বারুইপুরের 'অনুভব নেচার লাভারস অ্যাসোসিয়েশন' -এর সদস্য এবং টিম ম্যানেজার বাবলুদা, লিডার আমি, কোয়ার্টার মাস্টার সমীরণ, ধ্রুবদা, চিন্ময়, রাউতদা মানে বিনোদ কুমার রাউত, অর্পণ আর রজত।
সকাল সাড়ে ন'টা নাগাদ প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। কেদারের পথ যেমন ঘিঞ্জি, তেমনি নোংরা – পথচারী, যাত্রীবাহী ঘোড়া, ডুলি সব একসাথে ধাক্কা খেতে খেতে পথচলা। এরমধ্যে বৃষ্টি এসে পথ আরও অকথ্য করে তুলল। পুরো রাস্তার ২-৩ কিলোমিটার বাদে সবটাই কম-বেশি চড়াই। সুবিধার জন্য আমরা দুটো-তিনটে দলে ভাগ হয়ে হাঁটছিলাম। এরমধ্যে আবার ধ্রুবদার পা মচকাল। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ কেদারে পৌঁছে একটা ডরমিটরিতে আশ্রয় নিলাম। সবাই বেশ ক্লান্ত। কিন্তু রান্না-খাওয়া সেরে বাইরে এসে দাঁড়াতেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে একনিমেষে ক্লান্তি কেটে গেল। রাতের পরিষ্কার আকাশ ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। সেই আলো পড়ে অপরূপ হয়ে উঠেছে কেদারনাথের মন্দির আর শৃঙ্গ।
১৫ জুন, ২০১১
আজ বিশ্রামের দিন। সিদ্ধ ডিম, বিস্কুট, কাজু, কিসমিসের প্যাকেট লাঞ্চ নিয়ে আমরা চললাম চোরাবালিতাল দর্শনে। এখানেই প্রথম বরফের দেখা পেলাম। সারাটাদিন অনেক মজা করে কাটিয়ে বিকেলে আবার কেদারে ফিরে এলাম। এপথে যেটা প্রথম থেকেই অসুবিধা হচ্ছে যে পোর্টারদের সঙ্গে ঝামেলা লেগেই আছে। খাবারদাবারের হিসেবও সব মিলছেনা। যাইহোক বাকি খাবার দিয়ে ডিনার সেরে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। কাল থেকে আবার হাঁটতে হবেতো।
১৬ জুন, ২০১১
সকাল সাড়ে ন'টায় স্যাক কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম। আজকের গন্তব্য বাসুকিতাল। কেদারনাথ মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁদিকে যে পর্বতশিখর দেখা যায় তার পিছনেই বাসুকিতাল। এই ৮ কিলোমিটার রাস্তা প্রায় পুরোটাই বেশ চড়াই। মেঘমুক্ত ঝকঝকে নীল আকাশ, থার্মোমিটারের পারদ ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। পৌঁছানোর দু'কিলোমিটার আগে হঠাৎ ঘন সাদা মেঘে চারদিক প্রায় ঢেকে গেল, মাত্র পাঁচ ফুট দূরেও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। ঘড়িতে তখন বেলা তিনটে। রাউতদার পরামর্শ মতো সেখানেই থামলাম। এই যাত্রায় আজকেই প্রথম টেন্টে থাকা হবে, তোরজোড় শুরু হয়ে গেল। বিরাট এক বরফ উপত্যকার গা ঘেঁষে আমাদের টেন্ট পড়ল। বরফ গলানো জলে তৈরি হল গরম গরম স্যুপ আর ম্যাগি। খাওয়াদাওয়া শেষ করে পাশের বরফের ময়দানে শুরু হল আমাদের বরফে চলার নেট প্র্যাকটিশ।
১৭ জুন,২০১১
সকালে চলতে শুরু করেই বোঝা গেল সেদিন ধ্রুবদার পায়ে বেশ ভালমতোই লেগেছিল। ফলে আর না এগিয়ে ফিরে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল ধ্রুবদা। ওর সঙ্গে অর্পণ আর একজন পোর্টারও ফিরে গেল। আমরা এগিয়ে চললাম।
ওপরে পৌঁছে দেখি চারদিক একেবারে সাদা – কঠিন বরফ আর নরম তুষারে ঢেকে রয়েছে – যেন কোন স্বপ্নপুরীর দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছি। একটা পাথরের ওপর বসে যে যার প্রয়োজনমতো গেটার, সানগ্লাস ইত্যাদি পরে নিলাম। সামনে আর কোন পথ নেই – গাইডের পিছু পিছু পাহাড়ের ঢাল ধরে ধরে হাঁটা। কোথাও নরম বরফে এক-দেড় ফুট পর্যন্ত পা ডুবে যাচ্ছে। তবে এপথে চড়াই তেমন নেই, বাসুকিতাল পর্যন্ত পুরোটাই প্রায় উতরাই।
বাসুকিতাল প্রায় সবটাই বরফের চাদরে ঢেকে রয়েছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই যেন ধু ধু বরফের মরুভূমি। সাদা মেঘ নেমে এসেছে অনেকটা নীচে, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সামনে প্রায় কিছু দেখা যাচ্ছেনা - যেন এক মায়াবী পরিবেশের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। আরও দু' কিলোমিটার এগিয়ে একটা বরফগলা নদীর পাশে ভারী সুন্দর জায়গায় আমরা তাঁবু ফেললাম। নদীর সামনেই মাওয়ালি পাসে ওঠার পথ আর পিছনে একের পর এক নাম না জানা তুষারশৃঙ্গ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাপমাত্রা শূন্য থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই রয়েছে।
১৮ জুন, ২০১১
সকালে ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। আজকের গন্তব্য মাওয়ালি পাস পেরিয়ে মাসার তাল। কিন্তু ভাবা এক, হয় আরেক...। দু'জন পোর্টারের শরীর খুব খারাপ, তারা ফিরে গেল এখান থেকেই। বাকি চারজন পোর্টারের কাছেই আমাদের ছ'জনের মালপত্র। ফলে তারা ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে লাগল। গাইডও পোর্টারদের ওপরে নজর রাখতে পিছনে রয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা যখন পাস থেকে আর মাত্র দু' কিলোমিটার দূরে তখন ওদের কাউকেই আর দেখতে না পেয়ে একটা পাথরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘন্টা দুয়েক বসে থাকার পরও কারোর দেখা নেই। এদিকে তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে আস্তে পড়লেও ক্রমশ তার তেজ বাড়ছে। পাথরের দেওয়ালে একটা গর্তের মতো জায়গা ছিল, তাতেই আশ্রয় নিলাম। যতক্ষনে গাইড আর পোর্টাররা এসে পৌঁছালো ততক্ষনে সাদা মেঘে চারদিক ঢেকে গেছে...তুষারপাতও বাড়ছে। আমরাতো ঠাণ্ডায় একেবারে জমে গেছি। আর না এগিয়ে এখানেই টেন্ট পাতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। একটা টেন্টেই ছ'জনে আশ্রয় নিলাম গা গরম রাখতে। প্রায় ৪৮০০ মিটার অল্টিচুডে তাপমাত্রা শূন্যের বেশ কয়েক ডিগ্রি নিচে।
১৯ জুন, ২০১১
ঝকঝকে একটা সকাল। সূর্যের আলো বরফের ওপর পড়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছে। সানগ্লাস ছাড়া কোন উপায় নেই। পৌনে ন'টা নাগাদ চলা শুরু। বেশ খানিকটা প্রাণান্তকর চড়াই পেরিয়ে মাওয়ালি পাসের ঠিক আগে একটা বরফের প্রান্তরে পৌঁছে কালকের মতোই আবার অপেক্ষা গাইড আর পোর্টারদের জন্য। প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা পরে আবার সবাই একত্র হলাম।
বেলা একটা নাগাদ আবার যাত্রা শুরু। প্রচণ্ড খাড়া চড়াই – হাত, পা সব দিয়েও যখন এগোনো যাচ্ছেনা তখন গাইড আর রজত মিলে আইস-এক্স দিয়ে বরফ কেটে ধাপ তৈরি করছে। অবশেষে প্রায় সোয়া দুটো নাগাদ ৫৪০০ মিটার উঁচু বহু আকাঙ্খিত মাওয়ালি পাসে পৌঁছালাম। এত উঁচুতে ধু ধু বরফের মাঝে দাঁড়িয়ে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। হাতে বেশি সময় নেই, সন্ধ্যের মধ্যেই মাসার টপে পৌঁছতে হবে। পুজো দিয়ে, সবাই মিলে ফটো তুলে আবার নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।
নরম তুষারে কোথাও একফুট আবার কোথাওবা দু'ফুট মতো পা ডুবে যাচ্ছে। খানিকটা নামার পর সামনে ৩৫০ ফুটের একটা ৮০ ডিগ্রি ঢালু দেওয়াল পড়ল। এবারে দড়ির সাহায্যে নামতে হবে। মুশকিল হল যে আমাদের দড়িটার দৈর্ঘ্য মোটে ১৫০ ফুট। বাকিটা রোপ ছাড়াই নামতে হবে। কাণ্ড যেটা হল নামতে গিয়ে শেষরক্ষা হলনা, আমি পড়ে গেলাম। রাউতদার তৎপরতায় প্রাণে বাঁচলেও ডানহাতে বেশ ভালোমতোই চোট লাগল। তখন অবশ্য ব্যথাটা তেমন টের পাইনি। অবশেষে মাসার টপে পৌঁছে রাতের মতো থামা।
২০ জুন, ২০১১
সকালে টেন্টের বাইরে বেরিয়েই মনটা ভরে গেল – আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় দূরের পিকগুলোও ঝকঝক করছে। সেগুলো মোটামুটি আমাদের সমান উচ্চতায় হওয়ায় আমরা যে বেশ ওপরেই আছি সেটা বোঝা যাচ্ছে। প্রচণ্ড জোরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। কিছুটা দূরে মাওয়ালি পাসের সেই রাস্তা, যেটা দিয়ে আমরা গতকাল এসেছি। একটু বাঁদিকে একটা বড় গ্লেসিয়ারের মধ্যে ধ্বসের চিহ্ন বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর অনেকটা নীচে প্রায় পুরোটাই জমে রয়েছে মাসার তাল। আমাদের পায়ের নীচ থেকে মাসার তাল পর্যন্ত একটা সোজা বরফের দেওয়াল নেমে গেছে প্রায় ৭০ ডিগ্রি ঢালে।
আজ গাইডের পিছু পিছু সাবধানে চলা। কালকের সেই হাতের ব্যথাটা সকাল থেকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে। মাসার তাল অবধি নেমে এসে বাঁদিকে মাসার তালকে রেখে এবার এগোনো ছোট মাসার তালের দিকে। মাঝে মাঝে কোথাও অনেকদিনপর একটুকরো সবুজ জমি চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে – এতদিনপরে কেমন জানি বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। মাঝে আরও তিনটে তুষার দেওয়াল পেরোলাম, তারমধ্যে দু'টো বেশ বিপজ্জনক। এই ঢালগুলি শেষ হয়েছে একেবারে ২০০০ ফুট নীচে নদীগর্ভে। প্রায় সারাদিন হেঁটে পৌঁছালাম চৌকি ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভিলাঙ্গনা নদী। নদীর ধারে সবুজ ঘাসের চাদর আর দূরে বরফ সাদা খাতলিং গ্লেসিয়ার আর খাতলিং পিক। পড়ন্ত বিকেলের রোদে চারদিক যেন মায়াময় হয়ে উঠছিল। এক কাপ কফি হাতে চুপ করে বসে সেই অসাধারণ সৌন্দর্য অনুভব করতে লাগলাম।
২১ জুন, ২০১১
যাত্রার প্রায় শুরুতেই ভিলাঙ্গনা নদীর ওপর সরু কাঠের ব্রীজ পেরোনো। এটা বোধহয় একইসাথে ধৈর্য্য, ব্যালেন্স আর ভয়কে জয় করবার পরীক্ষা। নীচে প্রবল স্রোতস্বিনী ভিলাঙ্গনার দিকে চোখ পড়লে বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যায়। ব্রীজ পেরিয়ে নদীর বাঁদিক দিয়ে জঙ্গলের পথ ধরলাম। ১৪ কিলোমিটার দূরে খারসোলি। মাঝে মাঝে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কতগুলো আইস-প্যাচ বা আইস-ব্রীজ। খারসোলি পৌঁছে নদীর ধারে ক্যাম্প ফেললাম।
২২ জুন, ২০১১
আজকের গন্তব্য গাঙ্গি। আজ থেকে টেন্টের পাট চুকলো। এবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা। খারসোলি থেকে কল্যাণী বুগিয়াল পেরিয়ে একটা গ্রামে পা রাখতেই শুরু হল বৃষ্টি। ফাঁকা গ্রামে একটা ছোট বাড়িতে এক বৃদ্ধা ছাড়া কাউকেই আমরা দেখতে পেলামনা। তিনি প্রথমে সাহস করে আমাদের আশ্রয় দিতে রাজি হলেননা। পরে কাফ সিরাপ, গ্লুকন ডি ইত্যাদি উপহার দিয়ে অনেক কষ্টে তাঁর গোয়ালে আশ্রয় মিলল। কোনমতে একটা প্লাস্টিক পেতে সবাই মিলে ঘন্টাখানেকের মতো ঘুমিয়ে নিলাম। বৃষ্টি থামতে প্রায় ছ'টা বেজে গেল। তারও একঘন্টা পরে পৌঁছালাম গাঙ্গি বাংলোয়। বেশ কয়েকদিন পর পরোটা আর আলু চচ্চড়ি খেয়ে পাকা ছাদের নিচে ঘুম দিলাম।
২৩ জুন, ২০১১
আজ সকালে আমাদের ছোটার পালা, দু'দিনের পথ যাব একদিনে – গাঙ্গি থেকে রি হয়ে ঘুট্টু - ২০ কিলোমিটার। শেষ একঘন্টা খুব ভিজে প্রায় সন্ধ্যে ছ'টার সময় ঘুট্টুতে এসে পৌঁছালাম। আজ রাতের মেনুতে অনেকদিন পর রুটি-মাংস।
আমাদের পথ হাঁটার উপাখ্যান এখানেই শেষ। এরপর হরিদ্বার হয়ে কলকাতায় ফেরা।
~ মাওয়ালি পাস ট্রেক রুট ম্যাপ || ট্রেকের আরো ছবি ~
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুদীপের শখ ট্রেকিং। বারুইপুরের ‘অনুভব নেচার লাভারস অ্যাসোসিয়েশন’ -এর সদস্য সুদীপ গত দশ বছরে সান্দাকফু-ফালুট, জোংরি-গোয়েচালা, গোমুখ-তপোবন-নন্দনবন, সিঙ্গালিলা প্রভৃতি নানান ট্রেকে অংশ নিয়েছেন।