রূপকুণ্ডের রূপের রহস্যে
দীপঙ্কর রায়
~ রূপকুণ্ডের ট্রেক রুট ম্যাপ || ছবি - দীপঙ্কর রায় - সুব্রত দত্ত ~
কোন মহাপুরুষ যেন বলেছিলেন ভাল কাজের জন্য মিথ্যা বললে সেটা মিথ্যা হয়না! এবারে আমাদের রূপকুণ্ড ট্রেকিং-এর শুরুতে সেই কথাকেই আপ্তবাক্য করে আমি আর সোমনাথ বেরিয়ে পড়েছিলাম। সোমনাথ দে, কলকাতার বাসিন্দা আর আমার আন্তর্জালে খুঁজে পাওয়া ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু। ২ জুন আমি মহারাষ্ট্রের লাতুর থেকে আর সোমনাথ কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করি হরিদ্বারের উদ্দেশে। আমরা দুজনেই অফিসে ও বাড়িতে অর্ধসত্য বলি। আমি নিজের উন্নতির জন্য যোগ-ধ্যান শিবিরের কথা জানাই আর সোমনাথ আমার পরিবারের সঙ্গে হরিদ্বার-হৃষীকেশ-লছমনঝোলা ঘোরার কথা বলে। সোমনাথের কল্যাণে চিরকুমার আমি কিছুক্ষণের জন্য বৌ-বাচ্চার মালিক হয়ে যাই! এর আগে আমাদের সান্দাকফু-ফালুট ছাড়া অন্য বড় ট্রেকের অভিজ্ঞতা ছিলনা। তাই স্রেফ পাহাড়ে ওঠার নেশাকে সম্বল করেই বেরিয়ে পড়লাম। যাবার আগে শুধু লোহারজঙের গাইড নরেন্দ্র সিং এর সঙ্গে দু-একবার ফোনে কথা হয়েছিল।
০৩/০৬/১২ – সোমনাথ আমার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল, আমি পৌঁছলাম রাত আটটার পর। ও স্টেশনে আমাকে নিতে এসেছিল। একেবারে দাদা-বউদির হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে গেলাম।
০৪/০৬/১২ – ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে জি.এম. ও. ইউ. স্ট্যাণ্ড থেকে বাস ধরলাম। গন্তব্য লোহারজঙ। সরাসরি কোন বাস নেই, এমনকী কর্ণপ্রয়াগের বাসেও জায়গা না পেয়ে রুদ্রপ্রয়াগের বাসে উঠলাম। হৃষীকেশ – দেবপ্রয়াগ – শ্রীনগর হয়ে ছঘন্টা সময় লাগল রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছাতে। এখান থেকে বাসে কর্ণপ্রয়াগ। আরও কয়েকবার জীপ পালটে রাত নটায় লোহারজঙ পৌঁছাই নারায়নবাগার – থারালি – দেবল হয়ে। পিণ্ডার নদীর ধারে দেবল এখন বেশ জমজমাট। রাত হয়ে যাওয়ায় থারালি থেকে লোহারজঙ ভায়া দেবল দুবার জীপ রিজার্ভ করতে হল ৪০০/- আর ৮০০/- টাকায় । হরিদ্বার থেকে জীপ রিজার্ভ না করায় সস্তার তিন অবস্থার পনের ঘন্টার প্রাণান্তকর ধকল হজম করতে হল প্রায় ২৪০ কিমি রাস্তায়! প্রচণ্ড গরম আর ধোঁয়াশায় প্রয়াগ দৃষ্টিনন্দন লাগল না। গিয়ে দেখলাম নরেন্দ্রজী ইণ্ডিয়া হাইকসের লোকাল ম্যানেজার হয়ে কাজ করছেন। এঁরা নির্ঝঞ্ঝাটে রূপকুণ্ড ঘোরার ব্যবস্থা করে থাকেন।এঁদের আস্তানাতেই রাত কাটালাম। নরেন্দ্রজীর সঙ্গে আলোচনাও সেরে নিলাম। উনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। ৮০০০ ফিট উচ্চতায় পৌঁছে হাল্কা ঠাণ্ডায় শরীরটা জুড়াল।
০৫/০৬/১২ – সক্কাল বেলায় গাইড নারায়ণ এসে ঘুম ভাঙাল। একটি ঘোড়া সহ পোর্টার গুড্ডুকে পাওয়া গেল।নারায়ণ রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে এল। স্থানীয় দোকান থেকে রসদ নেওয়া হল। কেরোসিনের অভাবে গমকল থেকে নেওয়া হল ডিজেল। লোহারজঙ-এ ট্রেকিং এর সবকিছুই কিনতে বা ভাড়ায় পাওয়া যায়। ওপরে টেন্ট পাওয়া যাবে তাই টেন্ট নেওয়া হয়নি। আলুপরটা আর চা খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করতে ১০ টা বেজে গেল।আজকের গন্তব্য দিদিনা, দূরত্ব প্রায় ৭ কিমি।অনেকেই অবশ্য গাড়িতে আরও এগিয়ে ওয়ান গিয়ে ট্রেক শুরু করেন।
প্রথমেই নামা। আমাদের রুকস্যাকও ঘোড়ার পিঠে। মনের আনন্দে খালি হাতে নাচতে নাচতে নামতে গিয়ে প্রথমেই বিপত্তি। আমার অতি বিশ্বস্ত হাঁটুযুগলের ডানদিকেরটি বিগড়ে গেল!আড়াই ঘণ্টার উৎরাই পথ তখন প্রাণান্তকর লেগেছিল। যদিও রডোডেনড্রন-ওক-পাইনের জঙ্গলে ঘেরা পথটা বেশ সুন্দর। একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম আর নীলগঙ্গা নদী পার হয়ে এবার একটা প্রাণান্তকর চড়াই পথ। হালকা বৃষ্টিও শুরু হল। আমি প্রায় এক পায়েই উঠতে থাকলাম। পথে হাওড়ার চার যুবকের সঙ্গে আলাপ হল। মোট পাঁচ ঘণ্টা ট্রেক করে বিকাল ৩ টা নাগাদ বৃষ্টিভেজা দিদিনায় পৌঁছলাম। ছবির মত সুন্দর মাটি-পাথরের দোতলা বাড়িতে উঠলাম। এটাই এখানকার থাকার ব্যবস্থা,হোম-স্টে। উচ্চতা ৮০০০ ফিট,তাই ঠাণ্ডাও হালকা। চা খেয়েই লেগে গেলাম এদের কাঠের উনুনে খিচুড়ি বানাতে, সাহায্যে নারায়ণ। হাওড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে সন্ধ্যাটা কাটল। রাতে আবার হেঁশেলে ঢুকে ডিমের ঝোল আর ভাত রান্না করলাম, সঙ্গে স্যালাড।
০৬/০৬/১২ – গাইড-পোর্টারের রান্না করাতে বেশ অনীহা, তবুও সকালে তারাই খিচুড়ি বানাল। সোমনাথ ওর নীক্যাপ দিল, সেটা লাগিয়ে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করলাম। আজও প্রায় ৯ টা বাজল বেরোতে। শুরুতেই শুকনো পাতায় বিছানো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কঠিন চড়াই। টোলাপানি হয়ে উঠলে চড়াইটা একটু সহজ হত। ঘণ্টা চারেকে পৌঁছলাম খুপাল টপ-এ। এখান থেকেই শুরু আলি বুগিয়ালের। বুগিয়ালের সবুজ গালিচায় বসে ছাতু মেখে খেলাম। আকাশ পরিস্কার থাকলে অনেক তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়। আরও ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে দেখা পেলাম বিখ্যাত বেদিনী বুগিয়ালের। প্রায় ১২ কিমি পথ সাত ঘণ্টায় ট্রেক করে বেদিনী বুগিয়ালের ক্যাম্পে পৌঁছলাম বিকাল ৪টা নাগাদ। উচ্চতা প্রায় ১২০০০ ফিট। সোনালি রোদ, আকাশে ত্রিশূল, নন্দাঘুন্টি বিদ্যমান। অন্যদিকটা মেঘলা থাকায় এর বেশি পর্বতশৃঙ্গ দেখা গেলনা। এখানটায় ফরেস্টের পাঁচটি হাট আর একটা ঝুপড়ি, থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও সেখানে ফোন করার সুবিধাও ছিল। ইণ্ডিয়া হাইকসের টেন্টেই আমাদের জায়গা হল। রোদে ঘাসের উপরে আরাম করে বসে মুড়ি-বাদাম খেতে শুরু করি, চাও এসে যায়। ইহা'র বিরাট একটা দল রূপকুণ্ড করতে ব্যর্থ হয়ে বেদিনী ফিরল। একটা হাট রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল, আমরাও সেখানে ডিমের ঝোল ভাত বানিয়ে নিলাম। ওদের ক্যাম্প ফায়ারেও যোগ দিলাম। বেশ ঠাণ্ডা। টেন্টের মধ্যেও বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। আমাদের স্লিপিং ব্যাগও বোধহয় বেশি উচ্চতার জন্য উপযুক্ত ছিলনা, হয়ত আমরা উচ্চতা ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ও পাইনি।
০৭/০৭/১২ – সারারাত দুজনেরই ভাল ঘুম হয়নি। সকালটা মেঘলা। নারায়ণের কল্যাণে প্রাতরাশটা ওদের সঙ্গেই হয়ে গেল। যদিও পেটরোগা দুজনেই তেল চপচপে পুরী-সব্জি ভক্তি করে খেতে পারলাম না। আজ ৭ টা নাগাদ বেরলাম। হাওড়ার বন্ধুরা বেদিনীতেই থেকে গেল উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। বেদিনী কুণ্ডের পাশের ছোট্ট মন্দিরে পুজো দেওয়া হল। বর্ষার পর কুণ্ডে যখন জল থাকে তখন নন্দাঘুন্টি আর ত্রিশূলের অসাধারণ প্রতিফলন দেখা যায়। শুরুতেই দূরে পাহাড়ের খাঁজে যেখানে রাস্তাটা মিলিয়ে যেতে দেখা যায় সেটা ঘোড়ালোটানি। সামান্য চড়াই ভেঙ্গে সেখানে পৌঁছে গেলাম। এরপর সহজ লম্বা পথ পাথরনাচুনি পর্যন্ত। আমরা বিশ্রাম নিতে নিতেই এগোচ্ছিলাম। এক বিদেশি দম্পতি যেন পাখির মত উড়ে গেল আমাদের টপকে! পাথরনাচুনিতে ফরেস্ট হাট আছে, বেদিনীর মত একটা ঝুপড়িও আছে। এখান থেকে দেখা যায় সামনের পাহাড়ের মাথায় কলু বিনায়ক। কঠিন চড়াই। মনে আর হাঁটুতে জোর সঞ্চয় করে লড়াইটা শুরু করে দিলাম! মাঝপথে ছাতু খাবার অছিলায় বেশ খানিকটা বিশ্রাম। পথের ধারে বরফ পেতে থাকলাম। কলু বিনায়ক ছোট্ট একটা মন্দির। মেঘলা আবহাওয়া। আকাশ পরিস্কার থাকলে এখান থেকেও দারুণ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এখান থেকে একটা সহজ পথ গিয়েছে বাগুয়াবাসা ক্যাম্পে। মে মাসে যারা এসেছিল তাদের এখান থেকেই বরফ কেটে এগোতে হয়েছিল। আমরাও এই পথ মাঝেমধ্যেই বরফে ঢাকা পেলাম। প্রায় ৯ কিমি পথ ৯ ঘণ্টায় ট্রেক করে বিকাল ৪ টে নাগাদ পৌঁছলাম। বাগুয়াবাসার উচ্চতা প্রায় ১৪০০০ ফিট। আবহাওয়া মেঘলা, তবুও ঠাণ্ডাটা ভালই লাগছিল। ইণ্ডিয়া হাইকসের (ইহা) টেন্টেই জায়গা হল। ওদের স্লিপিং ব্যাগও পেলাম। এখানেও ফরেস্টের দুটি হাট আছে।এই সময় ইহা'র বিরাট দল রূপকুণ্ড করতে ব্যর্থ হয়ে খুব খারাপ অবস্থায় ফিরল। যেন কোনরকমে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে। তখনো আমরা দূরে দেখছিলাম আরও চারজন নামছিল। তাদের নামাটা দেখছিলাম। বড় দলটা ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেল বেদিনীর উদ্দেশে। বাকি চারজন নামার পর দেখলাম দুজন ট্রেকার ব্যর্থ হয়ে বারবার বরফে আছাড় খেয়ে সম্পূর্ণ ভিজে শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে যেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এল এমন অবস্থা,বাকি দুজন গাইড। এরাও একটু পরে চলে গেল,জানিনা কী অবস্থা হয়েছিল তাদের! ক্যাম্পের পাশের বরফের ওপর আমি একটু অভ্যেস করে নিলাম! কিন্তু কিছুতেই সোমনাথকে বরফের উপর নিয়ে যেতে পারলাম না। অন্য এক গাইড ভুবনও তার দলকে বরফে নিয়ে গেল। তাদের সঙ্গে আমাদের একপ্রস্থ আলোচনা হল। বিদেশিরা যাবেনা, আমরা দুই দলই যাব। সোমনাথ হাল ছেড়ে দিয়ে পরদিন আমাকে একাই যেতে বলল। আবহাওয়া আরও খারাপ হতে থাকল। আমরা তাঁবুর মধ্যে ঢুকে বাগুয়াবাসাতেও উচ্চকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করতে লাগলাম - কখনো 'একলা চল রে' বা কখনো 'ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি'। তাই শুনে বিদেশী পুরুষটি বাঁশি বাজিয়ে শোনাল। পরে জানলাম, ওঁরা দার্জিলিং প্রবাসী - হিন্দি,বাংলাও জানেন। আর ছিল নারী-পুরুষ মিলিয়ে দিল্লির ছ'জন। আমরা তিনটে আলাদা দল এক সঙ্গেই খেলাম। শেষমুহুর্তে সোমনাথও সাহস সঞ্চয় করে - যা হয় হবে দেখা যাবে - মনোভাব নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল।পরদিন কাকভোরে যাত্রা শুরু হবে ঠিক হল।
০৮/০৬/১২ – ভোর ৪ টেয় উঠে দেখি সারারাত তুষারপাত হয়েছে, যদিও আবহাওয়া ভালই মনে হল। আমি দুটো কাজ করলাম, নিজের পেটে জ্বালানি ভরে নিলাম, আর রাস্তার জন্যও বানিয়ে নিলাম। জুতোয় ইহা'র ক্রাম্পন লাগিয়ে ৫ টায় যাত্রা শুরু হল। গাইডদের কাছে বাকি সরঞ্জাম। আমরা দুজন, দিল্লির এক মহিলা সহ তিনজন আর ৪ জন গাইড মিলে মোট ন'জন। আজকের পুরো পথটাই প্রায় চড়াই আর বরফে ঢাকা,তাই বেশ কঠিন। মাসখানেক পরে বরফ গলে যাবার পর আবার ততটাই সহজ। তখন এই পথে ব্রহ্মকমল, হেমকমল ইত্যাদি অধিক উচ্চতার পাহাড়ি ফুল দেখতে পাওয়া যায়।ওদের গাইড ভুবন আগে থেকে পথ বানাচ্ছিল বরফ কেটে। আমরা ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করছিলাম। শুরু থেকেই আমরা পিছিয়ে ছিলাম। উচ্চতা নিয়ে আমাদের মনে একটা ভয় ছিলই। এর আগে বরফের উপরে হাঁটলেও সেটা ছিল বিনোদন, আর এখানে মুহূর্তের ভুলে প্রাণসংশয়। মাঝপথে সোমনাথের আনা কোকা-৩০ একডোজ খেয়ে নিলাম দুজনেই।
ঠিক ৭-৩০ টায় আমরা প্রায় এক সঙ্গেই রূপকুণ্ডের মন্দিরে পৌঁছলাম। উচ্চতা প্রায় ১৬০০০ ফিট। নীচে চারদিকে বরফের ঢালে ঘেরা বরফাবৃত রূপকুণ্ড। সেই মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সোমনাথ সাষ্টাঙ্গে মন্দিরের সামনের বরফে শুয়ে পড়ল। এখানেও পুজো দেওয়া হল। তারপর হঠাৎ এক গাইড মোবাইলে দারুণ একটা গাড়োয়ালী গান চালিয়ে দিয়ে নাচতে থাকল। আমিও তাতে যোগ দিলাম, এবং একে একে অন্যেরাও সেই স্বতস্ফূর্ত আবেগে ভেসে গেল। রূপকুণ্ড বা মিস্ট্রি লেকের গল্পটা গাইডই শোনাবে, আমি রহস্যই রেখে দিলাম! আমাদের সৌভাগ্য আবহাওয়া তখন দারুণ সুন্দর । আমরা ঠিক করলাম জোনারগলি পাসেও উঠব। সোমনাথ আর ওদের দলের মহিলাটি এক গাইডকে নিয়ে নেমে যাবে,বাকি ছ'জন উঠবো। স্বর্গের সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠতে শুরু করলাম। এক ঘণ্টায় পৌঁছেও গেলাম। উচ্চতা প্রায় ১৭০০০ ফিট। চারিদিকে ধবধবে সাদা বরফ, নীলাকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ।এ তো স্বর্গই!এমন জায়গায় পৌঁছনোর জন্য মৃত্যুকেও তুচ্ছজ্ঞান করা যায়। চোখের সামনেই নন্দাঘুন্টি আর ত্রিশূল। আর নীচে শৈলসমুদ্র পার করে এই দুই পর্বতের মধ্যে দিয়েই হোমকুণ্ড আর রন্টি স্যাডল যাবার পথ। সেখানে যেতে গেলে অগস্টে বা তার পরে আসতে হবে। আমার ছাতুমাখা আর ওদের আপেল ভাগ করে খাওয়া হল। এবার স্বর্গ থেকে মাটিতে নেমে আসার কঠিন বাস্তবতা! বরফের রাজ্য থেকে কর্কশ পাথুরে জমিতে ফিরে আসা। তবুও নামার সময়েও সাবধানের ত্রুটি ছিলনা। আমি অনেক দেরিতে সবার শেষে বাগুয়াবাসায় ফিরলাম ১০ কিমি পথ ৭ ঘণ্টায় হেঁটে, তখন বেলা ১২ টা। ফিরে দেখি হাওড়ার বন্ধুদের মধ্যে শুধু সৌম্যাশীষ হাজির,মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিধ্যস্ত, বাকি তিনজন ওয়ান ফিরে গেছে। ওর তাঁবুতে বসেই আড্ডা মারতে লাগলাম। আমাদের পেয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। দিল্লির দলটাও চলে গেল। আমরা থেকে যাব ঠিক করলাম। আসলে ওই বরফের রাজ্য থেকে ফিরতে মন চাইছিলনা। শুরু হল প্রবল তুষারপাত। খিচুড়ির সঙ্গে তাঁবুর মধ্যে আমাদের আড্ডাও জমে উঠল। আলাপ হল ওর গাইড বিখ্যাত মোহন সিং বিস্ত-এর সঙ্গে। বাগুয়াবাসাতে আজ আমরা তিনজন মাত্র। রাত্রে ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে আমরা খালি হাটে গিয়ে ঢুকি তিনজনেই। সৌম্যাশীষ তার মোবাইলে অঞ্জন দত্তের 'বান্ধবী' নাটকটা শোনাল। অসাধারণ পরিবেশে অনবদ্য প্রেমের গল্প! পাহাড়কে যারা ভয়ডরহীন ভাবে ভালবাসে তাদের ভালবাসার খবর কেউ রাখেনা। অথচ জীবনে গভীর আঘাত না পেলে পাহাড়কে এইভাবে হৃদয় দিয়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরা যায়না।
০৯/০৬/১২ – এবার ফেরার পালা । সকালে সামান্য কিছু খেয়ে ৭ টায় বেরলাম বাগুয়াবাসা থেকে। একই পথে বেদিনী পৌঁছোতে দুপুর।বৃষ্টিও ভোগাচ্ছিল। তুষারপাতও শুরু হয়ে গেল। খিচুড়ি খাওয়া হল। আমরা ওয়ানের পথে রওনা দিলাম। কঠিন উৎরাই পথ, সেটাও আবার বৃষ্টিভেজা শুকনো পাতায় বিছানো। দুজনেই বারকয়েক পড়তে-পড়তে কিম্বা মরতে–মরতে বেঁচে গেলাম! ছোট্ট ফরেস্ট ক্যাম্প গাইরলি পাতাল পার করে,নীলগঙ্গা পার করে সামান্য চড়াই। দূর থেকে ওয়ান ফরেস্ট ক্যাম্প দেখে ভাবছিলাম পথ তাহলে ফুরাল, কিন্তু সেখান থেকেও গ্রাম অনেকটাই দূর। ২১ কিমি পথ প্রায় ১২ ঘণ্টা ট্রেক করে ৭টায় ওয়ান পৌঁছলাম। উচ্চতা ৮০০০ ফিট, এখানেও এক রাত কাটান যেত, কিন্তু আমরা নিরুপায়। এখান থেকে জীপ ভাড়াই করতে হবে, তাই ৮০০/- দিয়ে রাতেই লোহারজঙ পৌঁছে গেলাম। জিএমভিএন এ রাত কাটালাম। ইহা'র আস্তানা নতুন দলে ভর্তি।
১০/০৬/১২ – লোহারজঙ থেকে সকাল ৬-৩০ টায় দিল্লিগামী একটা বাস ছাড়ে। এটায় হলদোয়ানি যাওয়া যাবে। পরেরটা ৭-৩০ টায় কর্ণপ্রয়াগ। সময়ের গণ্ডগোলে আমরা সেটা পেলাম না। তবে শেয়ার জীপ পেলাম। দেবল থেকে ৯টায় প্রেসের জীপে কর্ণপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, উখিমঠ হয়ে বেঁচে যাওয়া ছুটিতে আমাদের গন্তব্য দেওরিয়াতাল–চোপতা–তুঙ্গনাথ। সে অন্য গল্প।
~ রূপকুণ্ডের ট্রেক রুট ম্যাপ || ছবি - দীপঙ্কর রায় - সুব্রত দত্ত ~
কলকাতায় বড় হলেও গত দশ বছর বাংলার বাইরে-বাইরেই কেটেছে দীপঙ্কর রায়ের। বর্তমানে মহারাষ্ট্রের লাতুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাকাউন্টস বিভাগের প্রধান দীপঙ্করের নেশা বেড়ানো। পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্র বাদ পড়েনা কোনটাই।একবার বেড়িয়ে এসেই বসে পড়েন পরের বেড়ানোটা ছকে ফেলতে।বেড়ানোর পাশাপাশি কলম ধরার অভিজ্ঞতা এই প্রথম।